জালি
ভোর থেকেই বাড়িতে উদবিগ্ন ব্যস্ততা। ফিসফাস কথা, বিষণ্ণ চাহনি, পা টিপে টিপে চলাফেরা। এক-তলায় সিঁড়ির পাশের ঘর থেকে একটা কাতর একটানা গোঙানি ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে সেটা তীক্ষ্ণ হয়ে সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা ভাইবোন, দেবু আর মিঠুকে কান্নার কিনারে ঠেলে দিচ্ছে। মিঠু তার দাদার গা ঘেঁষে সরে এসে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, দেবু নিজের ঠোঁটে একটা আঙুল চেপে হিস-হিস করে উঠল। তা সত্ত্বেও মিঠু বলে ফেলল, ঠিক মানুষের গলায় চ্যাঁচাচ্ছে, নারে? আমার কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে শুনতে।
নীচের ঘরে তখন ওদের মা দীপালি, বাবা বিমান আর চাকর সুকুমার। ঘরে পাখা নেই তাই দোতলা থেকে টেবিল-ফ্যানটা আনা হয়েছে। সেটা একটানা ভোমরা ডেকে যাচ্ছে। মেঝেয় সতরঞ্চিতে শুয়ে আছে একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর। পাখার হাওয়া তার ধূসর মেশানো কালো লোমে কাঁপুনি তুলছে। গত তিন দিন ধরে সে প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। লিজা, লিজা..লক্ষ্মীমেয়ে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু আসছেন তোমার কিছু ভয় নেই। সোনা আমার…আর একটু কষ্ট সহ্য করো তো মা। লিজার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দীপালির স্বর বেদনায় রুদ্ধ হয়ে এল।
পরশুদিনই ডাক্তারকে খবর দিলে ভালো হত। বিমান আফশোস করল।
তুমি গাড়িটা নিয়ে যাও-না, একেবারে সঙ্গে করেই তাহলে আনতে পারবে।
তাই যাই।
আজ আর অফিস যেয়ো না।
না না, অফিস যাওয়ার কথাই ওঠে না। ইসস কী কষ্ট পাচ্ছে দ্যাখো তো!
আমরাই-বা আর কী করতে পারি।
সুকুমার চুপ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। বিমান তাকে বলল, দেবু আর মিঠু যেন নীচে নামে দেখিস। আর রান্নাবান্না আজ আর করে দরকার নেই। তুই বরং— বিমান তাকাল দীপালির দিকে।
যা গরম পড়েছে, দই-চিঁড়ে আর আম নিয়ে আসুক। দীপালি বলল।
আমিও তাই বলতে যাচ্ছিলুম। কাল ম্যাক্সিমাম ছিল, থার্টি এইট পয়েন্ট ফোর, হিউমিডিটি নাইনটি থ্রি পারসেন্ট। অসহনীয়, অসহ্য…রিচ রান্নাবান্না এখন থাক।
বিমান ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, ভাইবোন সিঁড়িতে বিষণ্ণ মুখে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে।
দেবু মিঠু, তোমরা কিন্তু এক-তলায় একদম নামবে না, সিঁড়ি থেকে উঁকিঝুঁকিও নয়। যাও, ওপরে যাও। লিজার বাচ্চা হওয়ার পর নামবে, তার আগে নয়।
বাবা, কখন হবে? দেবু বলল।
ডাক্তারবাবুকে আনতে যাচ্ছি।
ঘর থেকে কাতরানি ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে দীপালির উদবিগ্ন অনুরোধ, তুমি আর দেরি কোরো না। কী রকম যেন করছে।
যাচ্ছি। বিমান তাকাল ছেলে মেয়ের দিকে। তারা গুটিগুটি দোতলায় উঠে গেল। দোতলার বাথরুমের পাশ দিয়ে গেলে পশ্চিমের বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালে, রাধাচূড়া গাছের ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে বাস, মোটর, অটোরিকশার চলাচল দেখা যায়। আরও দূরে দেখা যায় ট্রেন। বাড়িটার পিছনে এলিট আর স্কাইলাইন নামে দুটো হাউজিং-এর সীমানা পাঁচিলের সংযোগ যেখানে হয়েছে তার পাশেই প্রায় বিঘা পাঁচেক সরকারি জমি। কিছু-একটা ইমারত হয়তো সেখানে একদিন উঠবে। আপাতত পাঁচিলের ধারে দুই হাউজিং-এর ভাঙা ইট, সিমেন্টের চাঙড় আর যাবতীয় আবর্জনার কয়েকটা ঢিপি তৈরি হয়ে গেছে।
সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেওয়া পাশের বাড়ির জগদীশবাবু রবারের নল দিয়ে তাঁর ছোটো বাগানটিতে জল ছিটোচ্ছেন। গোলাপের শখ। মুখ তুলে বারান্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী গো দেবুবাবু, লিজার বাচ্চা হল?
দেবুর আগেই মিঠু বলে উঠল বাবা ডাক্তারবাবুকে আনতে গেছে। লিজার খুব কষ্ট হচ্ছে তো।
তাই নাকি? আহা, বেচারা।
জগদীশবাবু আবার জল দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হলেন। ওরা তা দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দেবু বলল, কাল-পরশুই তো বৃষ্টি নামবে, তাহলে আর জল দিচ্ছেন কেন?
কে বলল বৃষ্টি নামবে?
বাবা। কাগজে লিখেছে আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই এসে যাবে।
আসুক তো আগে। জগদীশবাবু কাজে মন দিলেন তবে বিব্রত মুখে।
দাদা এবারও যদি গতবারের মতো তেমন বৃষ্টি হয়? মাছ ধরবি?
গত বছর টানা তিন দিন প্রায় না থেমে বৃষ্টি হয়েছিল। চারদিকের রাস্তায় কোথাও কোথাও জল বয়স্কদের কোমরেরও উপর উঠে যায়। কাছেই একটা গোরস্থান, তার মধ্যে ছোটো ছোটো ছেলেরা গামছা আর একটু বোরা মশারি দিয়ে মাছ ধরতে শুরু করে। দুপুরে দেবু আর মিঠু বারান্দা থেকে তাই দেখছিল। অবশেষে এই দুর্লভ মজা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টায় আর নিযুক্ত না থেকে, দুজনে বাথরুমে কাচার জন্য রেখে দেওয়া মায়ের হাউসকোটটা হাতে নিয়ে চুপি চুপি নীচে নেমে আসে।
একটি মাছও তারা ধরতে পারেনি। তবে কিছু আদুড় গায়ে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ হইচই করে তারা বুঝতে পেরেছিল বাড়ির বাইরে আলাদা ধরনের একটা জগৎ অপেক্ষা করছে, বেশ কঠিন আর মজাদার। দেবুর হাত থেকে হাউসকোটটা ছিনিয়ে নিয়ে দুটি ছেলে মাছ ধরতে শুরু করে। খুদে খুদে পাঁচ-ছটা ট্যাংরা আর বেলে পেয়েছিল। একটা টিনের মধ্যে সেগুলো রেখে তারা হাউসকোটটা ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, যা ভাগ এবার, আর এগোলে ডুবে যাবি।
যেমনভাবে গেছল, তেমনি চুপি চুপি ওরা বাড়ি ফিরে আসে। মিঠু ভিজে হাউসকোটটা মুখের কাছে ধরে বলেছিল, দাদা এঁকে দ্যাখ, মাছের গন্ধ! দেবু নাকে চেপে ধরে বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বলেছিল, মনে হচ্ছে।
দুজনে অবাক চোখে মেঝেয় পড়ে থাকা বস্ত্রটির দিকে তাকিয়ে থাকে আর লিজা তখন দরজার বাইরে থেকে দেখছিল ওদের মুখ। লিজাটা ভাগ্যিস মানুষ না। তাহলে মাকে বলে দিত। মিঠু বলেছিল।
এবার মাছ ধরব না।
কেন রে?
এমনিই।
মাছধরা খুব শক্ত। মিঠু তার সিদ্ধান্ত জানায়।
জগদীশবাবু চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন, সামার ভেকেশন কবে শেষ হবে?
ছাব্বিশে জুন, দেবু জবাব দিয়েই মিঠুকে বলল, বাবা আসছে।
দুজনে বারান্দার গ্রিল থেকে যতটা সম্ভব ঝুঁকে দেখল, বিমান এবং সঙ্গে আর একজন ব্যস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামল।
লিজার এবার কটা বাচ্চা হবে বল তো দাদা?
আটটা।
এমনি, আন্দাজে, আগের বারও আটটা হয়েছিল না?
সব বিক্রি করে দিল। এবার বাবাকে বলবি একটা বাচ্চা রেখে দিতে?
তুই বলিস বাবাকে।
না।
দেবু বোনের মুখের ভাব লক্ষ করে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল, এক-একটা বাচ্চার দাম কত জানিস? দেড় হাজার, দু-হাজার টাকা। লিজার পেডিগ্রি আছে-না?
পেডিগ্রি কী রে দাদা?
ফাঁপরে পড়ে যাওয়াটা লুকোবার জন্য দেবু বলল, এসব কথা একদম বলাবলি করবি না। সেদিন বটুকদাকে বাবা বলল-না, তোমাদের এই উঁচুজাত, বড়ো বংশ, বড়ো ঘরের, গল্পোগুলো এবার বন্ধ করো। বড়োলোকি কথাবার্তা বাবা খুব অপছন্দ করে।
লিজা খুব বড়োলোক?
জানি না, আমি তো আর জার্মানিতে গিয়ে লিজার বাড়ি দেখে আসিনি।
আচ্ছা, জার্মানি থেকে প্লেনে এল কী করে বল তো, যদি কাউকে কামড়ে দিত?
কত বার তো শুনেছিস একটা ফাইবার গ্লাসের বাক্সের মধ্যে করে মদনকাকু এনেছিল। অ্যাই, এক বার সিঁড়িতে গিয়ে দেখে আসবি?
বাচ্চা হল কি না?
হ্যাঁ।
মিঠুর সঙ্গে দেবুও সিঁড়ি পর্যন্ত গেল। পা টিপে টিপে মিঠু সিঁড়ি দিয়ে নেমে ল্যাণ্ডিংটা ঘুরেছে আর সঙ্গে সঙ্গে দাঁতচাপা গর্জন উঠল।
বলেছি না একদম নামবে না। যাও, যাও। সুকুমার, দুটোকে ঘরে বন্ধ করে দিয়ে আয় তো।
মিঠু চার লাফে দোতলায় ফিরে এসেছে। দেবুর দিকে অনুযোগের দৃষ্টি রেখে বলল, তোর জন্যই তো।
সুকুমার দোতলায় এসে ঘরের মধ্যে দুজনকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, খুব খারাপ ব্যাপার। লিজার এখন যমে-মানুষে টানাটানি। এখুনি অপারেশন করতে হবে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার টাইম নেই। ডাইনিং টেবিলের ওপর অপারেশন হবে। একদম নীচে যাবে না। দাদা–বউদির এখন মাথার ঠিক নেই, বুঝেছ? একদম শব্দটব্দ করবে না। করলে ডাক্তারবাবুর হাত নড়ে যাবে আর…
লিজা তাহলে মরে যাবে সুকুমারদা?
মিঠু ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে। দেবু ঢোঁক গিলল।
সুকুমার মাঝবয়সি, বারো বছর এ বাড়িতে কাজ করছে। দেবুর জন্ম হয় কাজ নেবার দু মাস পর। তার কোলেপিঠেই এরা বড়ো হয়েছে। দুজনের অবস্থা দেখে সুকুমার কষ্টবোধ করল।
মরবে কেন। খুব মন দিয়ে ভগবানকে ডাকো, দেখবে লিজা ভালো হয়ে যাবে। গরম জল বসিয়ে এসেছি। তোমাদের পরে খেতে দোব। দরজাটা ভেজানো থাক, বেরিয়ে না কিন্তু।
দরজা বন্ধ হওয়ামাত্র মিঠুর চোখ জলে ভরে এল। বিছানায় আছড়ে পড়ে সে বালিশে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
দেবু উদভ্রান্তের মতো বলল, কাঁদছিস কেন? সুকুমারদা বলে গেল-না ভগবানকে ডাকতে?
মিঠুর কান্না আরও বেড়ে গেল। দেবু খাটে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইল পা ঝুলিয়ে। কিছুক্ষণ পর সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে উৎকর্ণ হল। কোনোরকম শব্দ, এমনকী কথা বলার ফিসফাসও শুনতে পেল না। ছমছম করল তার বুকের মধ্যে। ধীরে ধীরে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
রাধাচূড়া গাছটার ফাঁক দিয়ে সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। দু-দিক থেকে দুটো ট্রাম এসে চলে গেল। গাছের ডালে বুলবুলি ফুড়ুৎ ফুড়ৎ উড়ছে। শালিক আর কাকও সে লক্ষ করল কিন্তু কোনো কিছুই তার মনের উপর বসছে না।
প্রচন্ড গরম আর রোদের ঝাঁঝের জন্য দেবু বেশিক্ষণ দূরের দিকে তাকাতে পারছে না। বাতাসে গাছের পাতা নড়লেও দরদরে ঘাম তার কনুই আর ঘাড় বেয়ে নামছে। বারান্দায় এখনও রোদ পড়েনি। ঘামে সপসপে গেঞ্জিটা খুলে দেবু পা ছড়িয়ে বসল।
লিজার অপারেশন হচ্ছে। ব্যাপারটা কতটা গুরুতর সে-সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তবে অপারেশন শব্দটা অনেক বারই শুনেছে। ক্লাসের পুণ্যব্রত আগে বলেছিল তার মায়ের পেটে পাথর হয়েছিল, অপারেশন করে বার করে নেওয়া হয়। ছোটোপিসিমার পা ভেঙেছিল গাড়ির ধাক্কায়, হাড় সেট করতে অপারেশন করতে হয়েছিল। এখন দিব্যি চলাফেরা করে। সুকুমারদার বাবার চোখে কী হয়েছে, তার গ্রামের ডাক্তার বলেছে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে অপারেশন করালে সেরে যাবে। অনেক টাকার ধাক্কা।
দুই হাউজিং-এর সীমানা-পাঁচিলের বাইরে জমে থাকা ভাঙা ইট সিমেন্ট আর জঞ্জালের স্কুপের উপর কিলবিল করে উঠল কয়েকটা প্রাণী। দেবু গলা লম্বা করে সিধে হয়ে বসল। আরে, ওগুলো তো কুকুরছানা!
এরা কোথা থেকে এল। দেবু বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে গুনতে শুরু করল, এক দুই, তিন…চার, পাঁচ…ছয়!
রংগুলো সাদার ওপর ব্রাউন আর কালো। হয়তো ডাকছে কিন্তু এতদূর থেকে দেবু শুনতে পাচ্ছে না। ব্যস্ত চঞ্চল হয়ে ওরা চেষ্টা করছে জঞ্জাল থেকে নামতে। মনে হচ্ছে ভালো করে চোখ ফোটেনি, নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। একটা তো গড়িয়ে পড়েই গেল। ওঠার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু পায়ে জোর নেই। এমনকী চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে টলছে।
আশ্চর্য তো। এগুলো এল কোথা থেকে? কালকেও তো সে বারান্দা থেকে এদিকে তাকিয়েছে, চোখে তো পড়েনি। কার ছানা? এদের মা কে? দেবু সব কিছু ভুলে, কুকুরছানাগুলোর প্রতি তার মন নিবদ্ধ করল।
কান লেজ আর পিঠের কিছু অংশ কালো, এমন একটা সাদা কুকুর ধীরে ধীরে ছানাগুলোর দিকে এগিয়ে এল। পেটটা ঝুলে রয়েছে। দেবু স্তনের বোঁটাগুলো দেখতে পাচ্ছে। কুকুরটাকে সে স্কুলে যাবার সময় রোজ দেখেছে। জুয়েল কেটারিং-এর দোকান থেকে চিত্তরঞ্জন সুইটস পর্যন্ত পাঁচ ছ-টা বাড়ির সামনের রাস্তায় যে তিন-চারটে কুকুর বসে থাকে, ঘুমোয় আর অন্য কুকুরদের সঙ্গে মারামারি করে, তাদের মধ্যে দেবু একেও দেখেছে। একে সে চেনে।
একদিন লিজার ভিটামিন ট্যাবলেট ফুরিয়ে যাওয়ায় সুকুমার কিনতে যাচ্ছিল। দোকানে ওষুধ ছাড়াও অনেকরকম জিনিস বিক্রি হয়। একধারে আছে সিন্দুকের মতো একটা ডিপ ফ্রিজের বাক্স। সফট ড্রিঙ্কসের বোতল আর আইসক্রিম তাতে রাখা আছে। মা-র কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেবু আর মিঠু সুকুমারের সঙ্গে যায়।
ওরা কাঠের চামচ দিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরছিল। পাশে পাশে হাঁটছিল একটা কুকুর। মজা করার জন্য মিঠু একটু আইসক্রিম চামচ থেকে উঁচু করে ফেলল। কুকুরটা তৈরি ছিল না, তাই রাস্তায় পড়ল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চেটে নিল। এরপর আরও পাবার আশায় চলতে চলতে মুখ তুলে বার বার সে মিঠুর দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু মিঠু আর ওকে খাওয়াতে রাজি নয়।
দে-না ওকে। দেবু বলেছিল।
আহাহা, তুমি দাও-না। এইটুকু তো কৌটো। একটা খেয়ে কি কিছু হয়?
ঠিক এই সময়ই দেবু হোঁচট খেল একটা ইটে আর পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেও আইসক্রিমের প্লাস্টিকের কৌটোটা হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ল। সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। কুকুরটাও। কিন্তু তাড়াতাড়ি চেটে খেয়ে নেবার বদলে সে দেবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। সেই সময় দেবু কুকুরটার চোখে কেমন একটা দুঃখ পাওয়ার মতো ভাব যেন দেখতে পায়। তখন ছুটে এসে আর একটা কুকুর জিভ দিয়ে আইসক্রিমটা চেটে নিতে নিতেই গোঁ গোঁ শব্দ করে ভয় দেখাল। কেউ যেন, এমনকী অন্য কুকুরটাও যেন তার খাবারে ভাগ না বসায়।
সুকুমারের কাছে টাকা ছিল, সে দোকানে ফিরে গিয়ে আর এক কৌটো আইসক্রিম কিনে এনে দেবুর হাতে দেয়। মিঠু তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলেছিল, দাদা তো কৌটোটা শেষ করেই ফেলেছিল, তাহলে আবার একটা নতুন কেনার কী দরকার।
মোটেই শেষ করে ফেলিনি। আদ্দেকেরও কম খেয়েছি। আচ্ছা তুই একটু নে।
মিঠু আপত্তি করেনি। দেবু লক্ষ করল তখনও কুকুরটা তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। মিঠু বলল, এবার তুই ওকে দে।
দোবই তো।
ঝুঁকে নীচু হয়ে দেবু কৌটোটাই ওর মুখের কাছে ধরল। মুখ সরিয়ে নিল কুকুরটা, অপ্রতিভ যতটা নয় তার থেকেও বেশি অবিশ্বাসভরে।
খা খা, খেয়ে নে।
কেমন একটা লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে সে প্রথম জিভ দিয়ে একটু চাটল, তারপর কৌটোয় জিভ ঢুকিয়ে কয়েক সেকেণ্ডেই সাফ করে দিল।
এরপরও সে ওদের পিছন পিছন চলছিল। দেবু ধমক দেয়, আর নয়, এবার এখানে থাম। কুকুরটা আর এগোয়নি।
বোধ হয় জীবনে এই প্রথম আইসক্রিম খেল। মিঠু বলে।
স্বভাবটা ভালো।
খুব লক্ষ্মী। লিজার মতোই।
না, তা কী করে হবে, দুজনের কখনো তুলনা হয়? দেবু মৃদু ভৎসনা করেছিল বোনকে।
দাদা, সুকুমারদা কী বলছে।
দেবু চমকে উঠে আবর্জনা স্তুপের থেকে মুখ ঘুরিয়ে পিছনে দরজার দিকে তাকাল। মিঠু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তার পিছনে সুকুমার। মুখ বসে গেছে। চোখের কোণে জল।
তোমাদের খাবার দিয়ে যাচ্ছি। ওপরে বসেই খেয়ে নাও। লিজাকে আর বাঁচানো গেল না। দাদা বলে দিলেন ওকে দেখলে মনে আঘাত পাবে, তাই একদম নীচে নামবে না।
ভাইবোন কিছুক্ষণ পরস্পরের চোখের দিকে অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে জীবনের প্রথম শোকসংবাদটা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখল। তারপর মিঠু নীচু গলায় বলল, লিজার পেটের বাচ্চারাও মরে গেছে?
ডাক্তারবাবু পেট কেটে বার করে নিয়েছেন। ছ-টার মধ্যে দুটো মরে গেছে। খুব ফুটফুটে হয়েছে।
সুকুমার সুসংবাদ দেবার মতো উত্তেজনার আমেজ আর উৎফুল্লতা মিশিয়ে ফুটফুটে শব্দটি মুখ থেকে ছড়িয়ে দিল। ভাইবোনের চোখ ঝকমক করে উঠল।
লিজার মতো দেখতে হয়েছে? দেবু জানতে চাইল।
বড়ো হলে নিশ্চয় হবে।
আর রং? মিঠু তার উচ্ছাস ধরে রাখতে পারল না।
একেবারে মায়ের মতো…পরে দেখো, এখন আমি নীচে যাচ্ছি।
সুকুমার নীচে নেমে যাবার পরই ওরা প্রায় ছুটেই সিঁড়ির কাছে এল। চার-পাঁচ ধাপ নেমে মাথা কাত করে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল এবং দুজনের মুখ থেকে বিহ্বল বিষণ্ণতা ধীরে ধীরে সরে গেল।
আমি শুনতে পেয়েছি।
আমিও। গিয়ে দেখে এলে বাবা কি বকবে?
বকবেই তো। আমরা মনে আঘাত পাই, বাবা কি সেটা চান?
সুকুমার দই-চিঁড়ে-আম দিয়ে তৈরি ফলার বাটিতে করে দিয়ে গেল। দেবুর খাবার ইচ্ছে নেই, মিঠুরও।
না খেলে মা বকবে। খালিপেটে থাকলে অসুখ করে।
ছাই করে, খেতে হয় তুই খা।
বাটি নিয়ে দেবু বারান্দায় এল, জগদীশবাবুর বাড়ির বারান্দা বা জানলায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না দেখল। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে বাটির ফলার বাগানে ছুড়ে ফেলল, একটা গোলাপ গাছের পাতার উপর ছিটিয়ে রইল চিড়ে-দই। দুটো কাক ঝাঁপিয়ে নামল ছাদের পাঁচিল থেকে।
দাদা আমারটাও ফেলে দোব?
আমি কী জানি। ইচ্ছে হয় খাবি নইলে খাবি না। লিজার জন্য তোর দুঃখু হচ্ছে না?
হচ্ছে।
মিঠুও ছুড়ে দিল তার বাটির ফলার। বাথরুমের কলে বাটিটা ধোবার সময় বারান্দা থেকে দেবু তাকে ডাকল।
দেখে যা মিঠু। ওই যে মাঠে, পাঁচিলের ধারে ওই যে নোংরাটোংরা উঁচু হয়ে আছে…।
দেবুর আঙুল লক্ষ করে মিঠু তাকাল।
দাদা কুকুরছানা রে।
মা-টাকে দেখছিস?
কাত হয়ে শুয়ে আছে কুকুরটা আর ছটা বাচ্চা স্তন্যপান করার জন্য নিজেদের মধ্যে হামলাহামলি করে যাচ্ছে। মায়ের পিঠের উপর দিয়ে, মাথার উপর দিয়ে, পিছনের দুই পায়ের মধ্য দিয়ে ওরা স্তন খুঁজে চলেছে আর মুখে পাওয়ামাত্র শান্ত হয়ে পা ছড়িয়ে চুষতে শুরু করছে। লাইন দিয়ে উপুড় হয়ে ছটা ছানা। কুকুরটা মাঝে মাঝে ঘাড় তুলে যে ছানাটিকে কাছে পাচ্ছে তারই গা-মাথা চেটে দিচ্ছে। আবার জঞ্জালে মাথা পেতে শুয়ে পড়ছে।
সেইটে না রে, আমাদের সঙ্গে আসছিল আইসক্রিম খাওয়ার জন্য?
দেবু মাথা নাড়ল।
কী নাম রে ওর?
রাস্তার কুকুরের আবার নাম থাকে না কি।
কবে বাচ্চা হল?
জানি না। কাল-পরশু হবে হয়তো।
দুধ খাবার পর ওরা কী করবে?
ঘুমোবে। তুইও তাই করতিস।
মা আমাকে ওইভাবে দুধ খাওয়াত? তুইও খেয়েছিস?
হ্যাঁ। সবাই খায়। বাবা খেয়েছে, মা খেয়েছে। বুকের দুধ না খেলে বাচ্চারা আর খাবে। কী? দাঁত তো নেই যে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। মা দুধ না খাওয়ালে বাচ্চারা মরে যায়।
লিজার বাচ্চাদের কী হবে?
কথাটা দেবু হৃদয়ঙ্গম করতে মিনিট খানেক সময় নিল। তারপরই সে সচকিত হল।
ওরা মরে যাবে? মিঠু তার ভয়টা প্রকাশ করে ফেলল।
বাবা কিছু-একটা নিশ্চয় করবেই। দেবু জোর দিয়ে কথাটা বলল বটে, কিন্তু তার মুখে ফুটে উঠল অনিশ্চয়তা।
সন্ধ্যার মধ্যেই লিজার মৃতদেহ নিয়ে গেল। সুকুমার দুজন লোক নিয়ে আসে। তারা এই কাজই করে। চট দিয়ে মুড়ে ধরাধরি করে লোহার চাকা-লাগানো ঠেলাগাড়িতে তুলে যখন লিজাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন দোতলার ঘরে দরজা বন্ধ অবস্থায় ছিল দেবু আর মিঠু।
একসময় দীপালি দরজা খুলে দুজনকে নীচে নামিয়ে আনল। সিঁড়ির পাশের অন্ধকার ঘর থেকে কুঁই কুঁই আওয়াজ আসছে। দুজনে ছুটে গেল। দীপালি ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
মা ওরা খাবে কী?
ঘরের এককোণে সতরঞ্চির উপর কালো বলের মতো চারটি ছানা। থরথর করে কাঁপছে। চোখে দৃষ্টি নেই। ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে আর ডেকে যাচ্ছে। চলার চেষ্টা করলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তবু হিঁচড়ে হিঁচড়ে এগিয়ে একটা ছানা দেয়ালে বাধা পেয়ে সেখানেই বসে পড়ল।
মা ধরব? দেবু বলল।
একদম না। অত বাচ্চার গায়ে এখন হাত দিতে নেই। দেখা তো হয়েছে, এবার বাইরে এসো। আলো ওদের চোখে সহ্য হয় না, কষ্ট পায়।
মা ওরা খাবে কী? মিঠু দ্বিতীয় বার জানতে চাইল।
ড্রপারে করে মুখের মধ্যে দুধ ঢেলে দেওয়া হবে। সুকুমার ডুপার কিনতে গেছে।
বিমান বসার ঘরে সোফায় আনমনা মেঝের দিকে তাকিয়ে। ছেলে-মেয়েকে দেখে শুকনো হাসল।
কষ্ট হচ্ছে?
দেবু আর মিঠু মাথা নাড়ল শুধু। দুজনকে কাছে টেনে নিয়ে সে পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, মন খারাপ করার কী আছে। এবার দুটো বাচ্চা রেখে দেব। লিজারই তো বাচ্চা। একটার বদলে দুটো লিজা আমাদের হবে।
মা নেই বলে বাচ্চাদের কষ্ট হবে না? মিঠু করুণচোখে বাবার দিকে তাকাল।
এখন অত কিছু বোঝার মতো মন ওদের হয়নি। এখন শুধু পেটভরে দুধ খেতে পেলেই ওরা খুশি থাকবে।
যখন বড়ো হবে?
যখন হবে তখন দেখা যাবে। বড়ো হলে কি কেউ বাবা-মাকে আর চায় নাকি। তোমরাও আর আমাকে বা মাকে চাও কি?
বিমান দুজনের দিকে তাকিয়ে মিটমিটে হাসি ছড়িয়ে দিল। মিঠু তার মুখ বাবার কোলে গুঁজে দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে চলল, চাই চাই চাই। দেবু অপ্রতিভ, লাজুক চোখে শুধু অনুযোগ জানাল এইভাবে তাদের বিব্রত করার জন্য।
ছেলের আর মেয়ের কাছ থেকে বিমান তো এটাই চায়। তার জীবনে এটাই এখন শ্রেষ্ঠ সম্পদ—ওদের হৃদয়, এখনও যা দূষিত হয়নি, এখনও যাতে অবিশ্বাস অবহেলা অশ্রদ্ধার থাবা আঁচড় টানেনি। সে তৃপ্ত মনটিকে তারিয়ে উপভোগ করল।
ডাইনিং-কে অপারেশন থিয়েটার বানিয়ে, ক্লোরোফর্ম করে এত বড়ো ব্যাপার কি সাকসেসফুল হয়! বিমান অসহায়ের মতো কৈফিয়ত দিল কারুর দিকে না তাকিয়ে।
দীপালি বলল, দু-দিন ধরে ব্যথা উঠেছে, আমারই বোঝা উচিত ছিল কমপ্লিকেশন দেখা দেবে। হাসপাতালে আগেই পাঠানো উচিত ছিল।
ড্রপার কিনে এনেছে সুকুমার। কিন্তু তাই দিয়ে ছানাদের দুধ-খাওয়ানো যাচ্ছে না। কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ওগরানো দুধ। কিছুটা পেটে যাচ্ছে বটে কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। দীপালি ছেঁড়া কাপড়ে পলতে বানিয়ে সেটা দুধে ভিজিয়ে ওদের মুখে ধরল। তাতেও কাজ হল না। এভাবে ওরা খেতে চাইছে না। বিমানও চেষ্টা করল এবং হতাশ হয়ে অবশেষে বলল, ব্রেস্ট ফিডিং ছাড়া উপায় নেই। বেশি জোরজবরদস্তি করলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে।
নিরুপায় চোখে দীপালি তাকিয়ে। বিমান অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সুকুমার রান্নাঘরে ফিরে গেল। দেবু এবং মিঠু অস্থির হয়ে উঠছে।
মা, না খেলে তো ওরা মরে যাবে।
মিঠু, এসব কথা এখন বলে না। যাও, এখন ঘরের বাইরে যাও। বিমান মানসিক স্থৈর্য আর রাখতে পারছে না। মেয়েটা বিশ্রী রকমের এমন একটা সত্যিকথা বলেছে, সেটা নিয়ে কিছুই করা যাচ্ছে না। এমন একটা সমস্যায় যে পড়তে হবে কে জানত।
কী করা যায় বলো তো? বিমান বিশেষ কাউকে উদ্দেশ না করেই বলল। কেউ উত্তর দিল না। কারুর তা জানাও নেই।
দাদা একটা কথা বলব।
সবাই ফিরে তাকাল সুকুমারের দিকে।
আমার ছোটোমাসির যখন ছেলে হয় তখন ওর ননদেরও ছেলে হয়। কিন্তু ননদটা বাঁচেনি। বাচ্চাটাকে ওরা ছোটোমাসির কাছে দিয়ে যায় বুকের দুধ খাওয়াবার জন্য। চার মাস ছিল।
তা আমি এখন এগুলোর জন্য ছোটোমাসি কোথায় পাব।
সদ্য বিইয়েছে এমন কুকুর একটা খুঁজে বার করতে পারলে হত।
কোথায় এখন খুঁজবি? আর খুঁজে পেলেও এই চারটেকে নিয়ে যাওয়াও এখন সম্ভব নয়।
এই সময় মিঠু কানে কানে দেবুকে জিজ্ঞাসা করল, দাদা বিইয়েছে মানে কী রে?
মানে হয় না। চুপ কর।
সুকুমারদা, তুমি যে বললে খুঁজে বার করলে হত, কী কুকুর সেটা?
সদ্য বাচ্চা হয়েছে এমন কুকুর।
আমাদের পিছন দিকের মাঠে একটা কুকুরের…জান সুকুমারদা, সেই সেইটে গো, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আইসক্রিম খাবার জন্যে আসছিল, মনে আছে তোমার?…তার ছটা বাচ্চা হয়েছে। দাদা গুনেছে!
দু-মিনিটের মধ্যে বাড়ি চঞ্চল হয়ে উঠল। দেবুও জানিয়েছে সে নিজের চোখে দেখেছে, পিছনের মাঠে বাচ্চাদের সমেত মা-কে শুয়ে থাকতে।
কিন্তু ওকে তো আনতে হবে আর কীভাবে তা সম্ভব? মানুষ তো নয় যে বললাম আর চলে এল। বিমান এতক্ষণে আশার ক্ষীণ একটা আলো দেখতে পেয়েছে। কিন্তু সেটাকে উজ্জ্বল করে তুলতে হলে ফন্দি এঁটে এগোতে হবে। বুদ্ধির প্রয়োগ দরকার। বুদ্ধির চর্চার এই সুযোগটা তাকে উত্তেজিত করে তুলল।
কাছে গিয়ে চট করে দড়ির ফাঁস ছুড়ে গলায় যদি… বিমান থেমে গেল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, এভাবে টেনে আনলে খেপে যাবে, বাচ্চাগুলোকে হয়তো কামড়ে মেরে ফেলে দেবে।
রাস্তার কুকুর তো, দীপালি নিশ্চিত স্বরে বলল, কিছু খাবারটাবারের লোভ দেখাও, দেখবে সুড়সুড় করে চলে আসবে।
আসবে। দেবু টগবগিয়ে উঠে দু-হাত ঝাঁকাল। আইসক্রিম খেতে ভালোবাসে।
কিন্তু এই অন্ধকারে ধরে আনা, মানে এভাবে লোভ দেখিয়ে আনা কি সম্ভব হবে? তা ছাড়া ওটাকে এখন পাবেই-বা কোথায়?
ওষুদের দোকানের কাছে বসে থাকে। যাব বাবা, আমি আর সুকুমারদা?
অবশেষে দেবু আর সুকুমার গেল। অনুমানটা সঠিকই হয়েছে, কুকুরটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। একটি মেয়ে দই কিনে হাঁটা শুরু করতেই সে লেজ নাড়ল।
তিন কৌটো আইসক্রিম তারা কিনেছিল। দুটো যখন শেষ হল তখন বাড়ির দরজায় কুকুরটা পৌঁছে গেছে। বসার ঘরের জানলার আড়ালে রুদ্ধশ্বাসে বিমান, দীপালি আর মিঠু দেখছে।
দেবু ভিতরে ঢুকে তৃতীয় কৌটোটা নীচু করে ধরে, আয় আয় চু চু…আয়, বলে ডাকল। কুকুরটা ইতস্তত করছে। লেজ নেড়ে, কান দুটো ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে সে দেবুকে তার সুখের খবর দেওয়া ছাড়া ভিতরে জন্য এগোল না। সুকুমার উৎকণ্ঠাভরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে।
তখন মিঠু ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেবুর হাত থেকে আইসক্রিমের কৌটোটা নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে হুবহু দীপালির মতো গলা করে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে, কিছু ভয় নেই; এসো, ভেতরে এসো…এসো তো মা।
কুকুরটা জোরে লেজ নাড়তে নাড়তে মিঠুর কাছে এল। মিঠু ওর মাথায় সতর্কভাবে ডান হাত রেখে, বাঁ-হাতে কৌটোটা মুখের কাছে ধরল। জিভ দিয়ে খানিকটা চেটে তুলে নিল।
মিঠু পিছিয়ে গেল, কুকুরটাও দরজা পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। সুকুমার প্রায় ছুটে গিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল, শব্দ না করে।
মিঠু গায়ে হাত দিয়ো না; কামড়ে দিতে পারে। ঘর থেকে উদবিগ্ন কন্ঠে দীপালি বলল।
ওকে ওই ঘরে নিয়ে যা মিঠু। দেবু নির্দেশ দিল।
মিঠুর সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা এগোল। ভেজানো দরজা ঠেলে মিঠু ঘরে ঢুকল, আলো জ্বালল। বাচ্চাগুলোর চোখে আলো লাগামাত্ৰ কুঁই কুঁই করে ডাকতে শুরু করল। কুকুরটা দরজার কাছ থেকে সচকিত হয়ে তাকাল।
এসো লক্ষ্মীমেয়ে…ওদের মা মরে গেছে কিনা তাই কাঁদছে, সারাদিন ওদের খাওয়া হয়নি, খিদে পেয়েছে…তুমি ওদের দুধ খাওয়াবে…খাওয়াবে না?
বাচ্চাদের মতো স্বরে, চোখে-মুখে গভীর দরদ নিয়ে মিঠু কথা বলছে। কুকুরটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে। মিঠু কৌটোটা মেঝেয় রাখল। ও এগিয়ে এসে খেতে শুরু করল। ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল কেউ। টলতে টলতে বাচ্চাগুলো চেষ্টা করছে কাছে আসার। কী ভাবে যেন ওরা টের পেয়েছে, জীবনদায়ী একটা আশ্বাস তাদের কাছাকাছি এসেছে। কুকুরটা কৌতূহলী চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে। ওরা যে ভাষায় কুঁই কুঁই করছে তার অর্থ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
মিঠু তখন সাহসভরে একটা বাচ্চাকে দু-হাতে তুলে ওর মুখের কাছে ধরল। মুখটা সরিয়ে নিল। মিঠু আবার ধরল। আবার সরিয়ে নিয়ে তারছা চোখে সে মিঠুর মুখের দিকে তাকাল। বাচ্চাটাকে সে মেঝেয় নামিয়ে রাখল।
ঘরের জানলায় বিমান, দীপালি, দরজা ফাঁক করে দেবু আর সুকুমারের মুখ উঁকি দিচ্ছে।
এই মিঠু, বল আর আইসক্রিম দোব। ভাত ও মাংস দুধ বিস্কুট পাঁউরুটি সব দোব।
কিন্তু মিতু কিছু বলার আগেই কুকুরটা চেটে দিল বাচ্চার মাথা। তারপর আলতোভাবে ঝোলা পেটটা মেঝেয় ছড়িয়ে কাত হয়ে বসল। স্তনের টসটসে কালো বোঁটাগুলো সাদা কোটের বোতামের মতো দেখাচ্ছে।
কী ভালো গো, তাই না মা? মিঠু জানলার দিকে তাকিয়ে বলল।
বাচ্চাটা নিজে থেকেই তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে গেল। মিঠু বাকি তিনটিকেও তুলে এনে বসিয়ে দিল পেটের কাছে।
নিস্তব্ধ হয়ে আছে সারা বাড়ি। জোড়া জোড়া চোখ নিবদ্ধ সারি দিয়ে উপুড় হওয়া চারটি বাচ্চার দিকে। সকালের শোক ঢেকে দিয়ে গাঢ় প্রশান্তি বিরাজ করছে। বিমানের চোখ ছলছল করে উঠল। দীপালি চোখ মুছে বলল, সত্যনারায়ণ দোব।
মাথার কাছে বাবু হয়ে দুজনে বসে। মাঝে মাঝে মিঠু মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কুকুরটা চোখ বুজে উপভোগ করছে আদর।
দাদা, এর নাম কী রে?
নাম নেই।
একটা নাম দে তাহলে।
দেবু নাম খুঁজতে ব্যস্ত হল। একটার পর একটা নাম বলে যায় আর মিঠু সেগুলো বাতিল করে দেয়। অবশেষে দেবু বলে, লিজার মতো অত ভালো নাম কি চট করে পাওয়া যায়। কাল বলব।
কেন, ওকে লিজা বলে ডাকলেই তো হয়।
পাগল, তাই কখনো হয়? রাস্তার কুকুরের নাম লিজা রাখলে লোকে হাসবে।
তাহলে লিজা উলটে জালি নাম রাখা।
লিজা, নিজালি… জালি জালি, জালিকা…ঠিক আছে, জালিই থাক। বসার ঘরে বিমান চিন্তিত, দীপালিও।
ছেড়ে দিলে আবার যে ফিরে আসবে তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি? বিমান অনিশ্চিত, অথচ সমাধান একটা চাই-ই, এমন অবস্থায় পড়ে গেছে।
সারা দিন সারা রাত কি এভাবে থাকতে চাইবে? পোষা কুকুর তো নয় দীপালিও সমাধান চায় কিন্তু বাধাগুলো সে জানে।
না চাইলেও রাখতে হবে। অন্তত দিন সাতেক তো বটেই। একটু নিষ্ঠুরতা হয়তো…কিন্তু লিজার বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে হবে তো। সেটাও ভাবো? বিমান ব্যাপারটাকে এমন জায়গায় নিয়ে এল যেখানে কুকুরছানাগুলো মানুষের গলায় কথা বলতে পারে।
কিন্তু ওর নিজেরও বাচ্চা আছে, ছ-টা।
তাহলে কি ওকে ছেড়ে দেব? আমাদের বাচ্চাগুলোকে মরার পথে ঠেলে দেব?
মাথা নীচু করে অনেকক্ষণ সে ভাবল। দীপালি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। বিমান ধীরে মাথা তুলে সন্তর্পণে বলল, এরকম ব্যাপার যদি দেবু বা মিঠুর ভাগ্যে ঘটত?
খাবার টেবিলে মিঠু বলল, জালির খুব খিদে পেয়েছিল, অত ভাত মাংস কত তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল।
জালি কে?
দেবু বাবার মুখভাব দেখে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল, লিজা উলটালে জালি হয়, তাই মিঠু ওই নাম দিয়েছে। ও লিজা রাখতে চেয়েছিল, আমি আপত্তি করি।
মন্দ নয়, ভালোই তো নামটা। বিমান স্ত্রীর দিকে তাকাল অনুমোদনের জন্য। দীপালি হাসল শুধু। জালিকে ছেড়ে দেওয়া হবে কি হবে না, সে-সম্পর্কে সুকুমারের মতামত চাওয়া হল।
না দাদা, ছাড়বেন না। ওকে হয়তো আবার ধরে আনা যাবে কিন্তু বুকে দুধ আর তখন অবশিষ্ট থাকবে না, ছ-টা বাচ্চা চুষে শেষ করে রাখবে।
মাই গড, এটা তো ভাবিনি! বিমান কৃতজ্ঞ রইল সুকুমারের কাছে। মানসিক যন্ত্রণার গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার পথটা সুকুমার পাইয়ে দিয়েছে।
রাতে ফিসফিস করে মিঠু পাশের খাটে দেবুর কাছে জানতে চাইল, জালির বাচ্চারা তাহলে কী খেয়ে থাকবে?
জানি না।
ওদের খেতে দেবার তো কেউ নেই।
দেবু উত্তর দিল না।
ওরা খেতে না পেয়ে মরে যাবে দাদা?
যাবে। কিছুক্ষণ পর। তুই-ই তো প্রথম খবরটা দিলি, জানো সুকুমারদা, সেই সেইটে গো, ছ-টা বাচ্চা হয়েছে, কেন বলতে গেলি?
দেবু উঠে বসে বিছানায় ঘুসি বসাল। আমি কি তখন জানতুম যে.. মিঠু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।–লিজার বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে না বুঝি।
আরও পরে মিঠু বিছানায় উঠে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আবার শুয়ে পড়ল।
ভোর হতেই দেবু বারান্দায় এসে মাঠের আবর্জনার দিকে তাকিয়ে স্বস্তি বোধ করল। বাচ্চাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ বসে, কেউ হাঁটার চেষ্টা করছে। তার মনে হল, ওরা ডাকছে, বোধ হয় একা থাকতে ভয় পেয়ে।
নীচে এসে মিঠুর কানে কানে সে বলল, সব কটা বেঁচে আছে, আমি গুনলুম।
খাওয়ার টেবিল থেকে বিমান বলল, আজ অফিসে গল্প করতে হবে। লিজা থেকে জালি, নাটক লেখা যায়।..আমি বরাবরই বলেছি আজও বলছি, মিঠুই বেশি ট্যালেন্টেড দেবুর থেকে।
ওদের সামনে এভাবে বোলো না, দুজনেই তাহলে আঘাত পাবে।
বিমান অপ্রতিভ হয়ে বলল, ওরা এখন কুকুরবাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত।
দেবু দুপুরে আর এক বার বারান্দায় গিয়ে দেখে এল। গনগনে রোদ। রাস্তায় মানুষ নেই। আবর্জনার উপর ছটা ছানাই শুয়ে। বোধহয় ঘুমোচ্ছ।
সারাদিনই ওরা ব্যস্ত রইল। লিজার কলারটা জালির গলায় বেঁধে চেইনটা তাতে লাগিয়ে মিঠু ওকে রাস্তায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল, দীপালি রাজি হল না।
যা করার ছাদে গিয়ে করে আসুক। ওকে আর রাস্তা দেখিয়ো না, তাহলে বিগড়ে যাবে।
ঠিকে ঝি হাজারি জগদীশবাবুর বাড়িতেও কাজ করে। ব্যপারটা শুনে তিনি দেখতে এলেন। জালি চার পা ছড়িয়ে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। তার পেটের কাছে দুটো আর মাথার দিকে দুটো ছানা, তারাও ঘুমোচ্ছে। টেবিল ফ্যানের হাওয়া বিলি কাটছে জালির লোমে।
বাহঃ দিব্যি পোষ মেনে গেছে তো। ভাগ্যিস ঠিক সময় পেয়ে গেছ, কোথায় ছিল এটা?
দীপালি প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, পোষ মানবে না কেন। পুরো নেড়ি তো নয়, মুখের গড়নটা দেখেছেন, ল্যাব্রাডরের ধাঁচ রয়েছে না? হয়তো ওর ঠাকুমা কি ঠাকুরদার জন্ম ক্রস ব্রিডিংয়ে… দেবু শুনছে দেখে দীপালি থেমে গেল।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেবু প্রথমেই বারান্দায় গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ছানাগুলোকে আর তো দেখতে পাচ্ছে না।
গ্রিলে পা দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে মাঠের অনেকটাই তার নজরে এল। দূরে রাস্তা দিয়ে একটা বড়ো কুকুর চলে যাচ্ছে দেখল কিন্তু আবর্জনায় কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ল না। তাহলে ওরা গেল কোথায়? খাবার জন্য সে নীচে নেমে গেল।
দুধ শেষ করে টেবিলেই সে অপেক্ষা করল। বাবা কাগজ নিয়ে বাথরুমে, মা রান্নাঘরে, মিঠু জালির কাছে। আর কেউ নেই যে তাকে লক্ষ করবে। সে নি :সাড়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল।
এলিট হাউজিং-এর পাঁচিল ঘুরে সে মাঠের উপর দিয়ে এগোল। দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে তাদের বারান্দাটা দেখতে পাচ্ছে, গ্রিলে-গুঁজে-রাখা বারান্দা মোছার সবুজ ন্যাতাটাও চোখে পড়ল। কিন্তু ওরা?
চারটে কাক কী যেন ঠোকরাচ্ছে। ভাঙা ইট, ভাঙা বোতল, কৌটো, তুলো, ডাবের খোলার কিনারে দেবু দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ সরু করে তাকিয়ে হাত নেড়ে হুশশ হুশশ বলে চেঁচিয়ে উঠল। কাকগুলো বিরক্ত হল এবং একটি মাত্র সামান্য উড়েই আবার ফিরে এসে ঠুকরে টেনে টেনে বার করে খেতে শুরু করল।
দেবু আর একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়াল এবং যেন কারুর ধমক খেয়ে পিছিয়ে গেল দু পা। ধীরে ধীরে তার চোখ বিস্ফারিত হল, বিন বিন ঘাম কপালে ফুটল, শ্বাস-প্রশ্বাস গভীর এবং দ্রুত হতে হতে চেতনা থেকে স্বাভাবিক বোধের সংযোগগুলো ছিঁড়ে যাওয়া মাত্র সে নীচু হয়ে বার বার ইট কুড়িয়ে ছুড়তে শুরু করল। তখন গোঙানির মতো অবোধ্য একটানা শব্দ ওর মুখ থেকে বোররাতে থাকে।
নাহ নাহ নাহ।…খাবি না, ওদের খাবি না।…মেরে ফেলব, সবাইকে মেরে ফেলব…।
হাঁফাচ্ছে দেবু। দুটো হাত পাশে ঝুলছে। দরদর ঘাম গড়াচ্ছে মুখ-গলা-ঘাড় বেয়ে। চোখের পাতা প্রায় বন্ধ। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শনশন একটা দূর থেকে ভেসে আসা ঘূর্ণিঝড়ের মতো শব্দ হচ্ছে।
অ্যাই খোকা, সক্কাল বেলায় ইট ছুড়ছ? বিকেল বেলায় তাহলে কি বোমা ছুড়বে? অ্যা? কাক-চিল যদি খায় তো খাক-না। ভালোই তো, পচা গন্ধ বেরোবে না।..যাও বাড়ি যাও।
স্কাইলাইনের তিন-তলার জানালা থেকে একটা রোগা মুখ খেকিয়ে উঠল। দেবু মুখ তুলে। তাকাল। ঘোলাটে উন্মাদের মতো চাহনি। তারপর ছুটতে ছুটতে সে বাড়ি ফিরে একই গতিতে দোতলায় উঠে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিকালেই দীপালিকে ডাক্তার ডাকতে হল। তিনি বাবার সময় আশ্বাস দিয়ে বললেন, এই প্রচন্ড গরমে এরকম হয়ই। ওষুধগুলো এখুনি আনিয়ে নিন, মনে হয় রাতের মধ্যেই টেম্পারেচারটা নেমে যাবে। চিন্তার কিছু নেই। কয়েক দিন রেস্টে থাকুক, ওষুধগুলো খেয়ে যাক। ঘোরাঘুরি যেন না করে।
দেবুর জ্বর একশোর নীচে নামল পাঁচ দিন পর। তারপরও কয়েক দিন তাকে বিছানায়ই থাকতে হল। বাড়ির সকলে তার কাছে এসে গল্প করেছে। মিষ্টি গলায় কথা বলেছে। তাকে খাওয়ানো, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, গল্পের বই এনে দেওয়ার মতো কাজগুলো তারা ব্যস্ত হয়ে করেছে। দেবুও নানা বিষয়ে ছোটো ছোটো প্রশ্ন করেছে কিন্তু জালি এবং লিজার বাচ্চাদের সম্পর্কে সে একবারও কৌতূহল প্রকাশ করেনি। এ ব্যাপারে কেউ কথা তুললে সে শুধু নীরবে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে; তারপর মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে আকাশে চোখ রেখেছে।
একদিন মিঠু বলল, কোন দুটো বাচ্চা আমরা রাখব, বাবা বলল বেছে নিতে। দাদা তুই নীচে আসবি একবার?
দেবু মাথা নাড়ল।
কেন? আয়-না, এক মিনিট। জানিস দাদা, কাল প্লেটে করে দুধ দিয়েছিল মা, কেমন চুক চুক করে ওরা খেল। বাবা বলল, আর জালিকে দরকার হবে না।
কয়েক সেকেণ্ড মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দেবু বলল, জালিকে তো তাড়িয়ে দেওয়া হবে। ও কোথায় যাবে?
কেন, যেখানে ছিল সেখানেই যাবে। আচ্ছা দাদা, আমরা যখন আইসক্রিম কিনতে যাব। তখন ও আমাদের চিনতে পারবে? কুকুরের তো বুদ্ধি খুব, মানুষের মতোই… বাবা-মা দুজনেই বলছিল কুকুরের মায়াদয়া মানুষের মতো, মা-মরা বাচ্চাদের দেখেই জালি কীরকম যেন হয়ে গেল, তাই না?
জালির জন্য তোর কষ্ট হচ্ছে না?
হচ্ছে না আবার! আমার থেকেও বেশি কষ্ট হবে তো বাচ্চাগুলোর।
তুই যা এখন।
দেবু পাশ ফিরে চোখ বুজল। একসময় সে সিঁড়িতে কথার শব্দ শুনতে পেল, বাবা বলছে, এমন চোব্যচোষ্য খাওয়া পেলে চলে যেতে হলে কষ্ট হবে না?
মা বলল, বাড়ি তো চিনে গেছে, নিশ্চয় আবার আসবে। সুকুমারকে বলেছি, এলে যেন কিছু খেতেটেতে দেয়।
দেবু বিছানা থেকে উঠে জানলায় দাঁড়াল। মেঘ উড়ে আসছে কিন্তু জমা হচ্ছে না। আকাশটা লিজার গায়ের রঙের মতো হয়ে রয়েছে। সে গুটিগুটি বারান্দার দিকে এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। দরজা থেকে উঁকি দিয়ে রাধাচূড়া গাছ, তাতে বসা শালিক, কাক, পাতার ফাঁক দিয়ে ধাবমান মিনিবাসের চাল দেখার পর দৃষ্টিটা আবর্জনাস্তুপের উপর পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে মুখটা টেনে নিল। সদ্য-জন্মানো কুকুরছানার মতো টলমল করতে করতে ঝাপসা চোখে সে খাটের দিকে এগোল।
গরমের ছুটিশেষে স্কুল বাসে যাবার সময় দেবু একদিন দেখল, মিষ্টির দোকানের সামনে তিনটে কুকুরের সঙ্গে জালিও মুখ তুলে বসে। একটা বাচ্চা ছেলে শিঙাড়া খাচ্ছে। জালি ল্যাজ নাড়ছে। জানলা দিয়ে মাথা বার করে দেখতে দেখতে দেবুর মুখে আলতো একটা হাসি ফুটে ওঠে।