আমার বাবু
সারারাত রক্তমাখা দেহটা আম গাছের তলায় পড়েছিল ।কালবৈশাখী ঝড়ে আম কুড়াতে এসে আলো-আঁধারে পায়ে ঠেকল একটা কিছু।কি এটা?
– বাবু,,,,,উঃ,,,বা,,,,বু,,,বা,,বু,,উ, – কোথায় গেলি বাপ। মায়ের বুকফাটা চিৎকার শুনে পাড়ার লোকজন ছুটে এলো আমতলায়।
– সারারাত ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে মৃতদেহটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে। কিছু জায়গায় রক্তের মাটিতে পিঁপড়ে ঘিরে রয়েছে। বাবুর বুকের ওপর মা আছড়িয়ে পড়ছে, ততই চিৎকার। এক মর্মান্তিক দৃশ্য যা দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
– কে এমন করল? কে হতে পারে বাবুর শত্রু? চারিদিকে ফিসফিস আর জটলা। নাকের মধ্য দিয়ে পিঁপড়ে আর মাছিরা ঘোরাঘুরি করছে। গলার নলি টা কাটা। ওই ছিন্ন দেহের ওপর মায়ের আর্তনাদ।
– আমার বাবু কোথায় গেলি বাপ? গ্রামবাসীদের দু’চোখ বেয়ে জল। কিছুক্ষণ বাদে পুলিশ এসে মৃতদেহ বেঁধে থানায় পাঠায়। কে যাবে? পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সমীরণ রাজি হলো।
– আপনি গাড়িতে উঠুন, পুলিশি মেজকর্তার হুকুম।- হ্যাঁ চলুন। ওদিকে তিন চাকা ভ্যানে ঘষটাতে ঘষটাতে চলেছে বাবুর দেহ।
– পৌঁছালে থানার এক পাশে পড়ে রইল ভ্যানসহ মৃতদেহ। অন্যদিকে ভিতরে চলল কিছু জেরা এবং কাগজপত্রের প্রসেস।
– আপনার নাম?
আজ্ঞে সমীরণ।
– বাড়ি কোথায়?
চৌতলা গ্রাম
– ওনাকে কতদিন চিনতেন?
– আজ্ঞে ছেলেবেলা থেকে স্যার। একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। খুব স্টুডিয়াস ছিল। চেষ্টা করেও চাকরি পায়নি। তাই কোনো কাজ না পেয়ে অনাদি ঘোষের ঐ জমিটা রাতে পাহারা দিত। যা পেত ওই দিয়ে মা ছেলের চলে যেত।
– পরক্ষনেই পাড়া থেকে প্রচুর ছেলেরা চলে এলো। ওর মা পাগলের মত একটা রিক্সা ধরে কাঁদতে কাঁদতে হাজির।
– আপনি ওখানে বসুন। কেন এলেন? পাড়ার সবাই তো এসেছেন।
– স্যার ঐ সমীরণকে আমার ভালো লাগছে না।
– কেন ?সন্দেহ হয়?
– আমার মনে হচ্ছে স্যার ওই আমার ছেলেকে খুন করেছে।
– কি বলছ কাকিমা!আমি ওকে মারবো কেন? ও আমার বন্ধু ছিল। কেউ আসছিল না তাই আমি গাড়িতে উঠে চলে এলাম। তোমাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে কাকিমা।
– মিস্টার মন্ডল। ওনাকে ওই ঘরে নিয়ে রাখ।
– চলুন সমীরণ বাবু।
– আমি তো কিছুই করিনি স্যার।
– পাড়ার ছেলেরা শশব্যস্ত হয়ে উঠল। মায়ের কান্নার রোল আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চলল নানা আলোচনা পর্যালোচনা।
– ডেড বডি জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে মর্গে পাঠানো হলো।
– দাদা,ওই সমীরণ ব্যাটা খুন করেছে। তখন ভাবছিলাম আগে আগে চলে এলো কেন ।সবার চোখকে ফাঁকি দেওয়া? দেখেছো ।তোমার দিকে দেখছে ব্যাটা।
– তোরা ওদিকে যা।আমি কথা বলে নিচ্ছি।
– ওকে বস। সব চল চল । ওদিকে চল।
– স্যার সমীরণকে ছেড়ে দিন। পাড়ার ছেলে আমি বুঝে নেব।
– সমীরন দাদার পায়ে এসে পড়ে কাঁদতে লাগল। দাদা তুমি আমার রক্ষাকর্তা। আমাকে বাঁচাও। আমি কিছু করিনি। শুধু শুধু ওরা,,,,,
– পুলিশ চুপ। পরক্ষণে খসখস করে লিখে সব কাগজ তৈরি। আর মায়ের বেদনার চিৎকারে পাখিরা গান গাইতে ভুলে গেল।
– পরদিন দামি মালা ,সাজানো গাড়িতে পাড়া সরগরম। প্রতিশ্রুতি তস্যপ্রতিশ্রুতি। ডেড বডি চলল শ্মশানের পথে। পাড়ার সেরা ছেলেটি চোখের জলে বিদায় নিল। কয়েকদিন গ্রামটা জমজমাট। টিভির পর্দায় ওই দেখ আমাদের গ্রামকে দেখাচ্ছে।ওই তোপচা ,ভোম্বল, সুলেখারা দাঁড়িয়ে আছে।
– কাজ মিটলো। মায়ের হাতে অনেক টাকা। ফলমূলে ঘর ভর্তি। পচে যেতে লাগল সব। কান্না থেমেছে আজ। বেঁচে থাকতে হবে যে। আর কত কাঁদবে মা।
– কিছুদিন মিডিয়া, রংবেরঙের সব দল ভিড় বাড়িয়েছিল। এখন আর আলো জ্বলে না বাবুদের বাড়ি তে। নিস্তব্ধ চারিদিক। যেন ভুতুড়ে পুরী। মাঝেমধ্যে রব ওঠেশাস্তি চাই।
– ধীরে ধীরে সব চুপ। গ্রামবাসীরা কাজে ব্যস্ত। বাবুর মা ফুঁপিয়ে ওঠে। ভাগ্যিস বাবু বিয়ে করেনি। নইলে কচি বউ টা বা বাচ্চাকাচ্চা গুলোর কি হতো!
– এ ঘটনা চিরকাল হয়ে আসছে। বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে যায়। কত বাবু হারিয়ে যায়। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি হয় ।আর বাবুর মায়ের বুকফাটা কান্নার আওয়াজ আকাশ-বাতাসে ঘুরে বেড়ায়।