সংলাপ
সংলাপ ওর ডাক্তার স্বামীর সঙ্গে ‘রং দে বাসন্তী’তে বসেছিল ,একটুকরো রামধনুর রং ছিটিয়ে পড়বে শরীরে। মায়াবী আলোয় টেবিল টা সাজানো ছিল। অনেকদিন পর এমন একটা সুযোগ এলো। দুই বছর করোনা রোগী, মানুষের হাহাকার এই নিয়ে ডাক্তারদের জীবন কেটেছে। প্রতিটা মুহূর্ত চিন্তায় কেটেছে পৃথিবীতে ওদের অস্তিত্ব থাকবে কি না। এইসব নানান চিন্তা ভাবনায় এখনো সন্তান নেওয়া হয়নি। সংলাপের ইচ্ছা থাকলেও সৌর এখনো মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত নয়। আগে দায়িত্ব কর্তব্য তারপর নিজের কথা ভাববো- এইভাবে চারটে বছর চলে গেছে। এমনকি ওদের মেলামেশাটাও অনেক দূরত্ব রাখে। সৌর বাড়ি ফিরে ডিনারের পর ঘুমিয়ে পড়ে। মনের কথা বলা, আনন্দ করার অবকাশ থাকে না। আবার কখনও নাইট ডিউটি থাকে। সংলাপের জীবনটা বড্ড একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তবুও সৌরকে ও খুব বোঝে। বিবাহিত নতুন জীবনেএকটা কালো মেঘ কখনো কখনো ওকে তাড়া করে বেড়ায়। কিছু কিছু সময় বাপের বাড়িতে চলে যায়। বাবা- মা ব্যস্ত ভাইয়ের সংসারে। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি ছাড়া কেউ নেই। তিনি ননদের মেয়ের আবদারে বেশিটাই দুর্গাপুরে থাকেন। একাকিত্ব জীবন সংলাপকে গ্রাস করে ফেলেছে।
– সৌর, অনেকদিন পর আমরা শ্বাস নিচ্ছে বলো। তোমার মুখোমুখি বসার অবকাশ আমাদের হয় না। আজ ডিনার অপেক্ষা তোমার কাছে বসে থাকতে বেশী ভালো লাগছে। আজ আমি খুব খুশি।
– হুম। কিন্তু বাড়িতে একটু রেস্ট হতো। ছুটির অর্থ এই নয় যে রেস্টুরেন্টে খেতে হবে সংলাপ।
– সংলাপের সুন্দর মুখটায় কালি পড়ে গেল। ইচ্ছে তো করে সৌর। ফেসবুকে কত ছবি আপলোড হয় বলতো, সৃজনী – বাট্টু রোজ কোন না কোন রেস্টুরেন্টে বসে চমৎকার ছবি আপলোড করে।
– আমি বাট্টু নই। আমি একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার সৌরদীপ রায়। সকলের সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না। আমি ছেলেবেলা থেকে মেধাবী ছিলাম। পড়াশোনা ছাড়া কিছু ভাবতে পারতাম না। ওরা যখন খেলে বেড়াতো, আমি তখন পড়াশোনায় ডুবে থাকতাম। আমার কেরিয়ার আগে। আমার জন্য তোমার সুখ এসেছে। বাড়ি গাড়ি কি পাওনি তুমি সংলাপ। দামি কাপড় ,গয়না সব পেয়েছ।
– তা হয়ত পেয়েছি সৌর। কিন্তু কিছু ছোট ছোট জিনিস যা সংসারে আনন্দ দিতে পারে তা থেকে আমি বঞ্চিত।
– কি পাওনি বলো। তোমার বাবা- মাকে পর্যন্ত বেড়াতে নিয়ে যাই। বিশ্বব্যাপী এমন অঘটন না ঘটলে আমরা বছরে দুবার বেড়াতে যাই। ফাইভ স্টার হোটেলে উঠি। এর পরেও তুমি বলছো তুমি সুখী নও।
– আমি তা বলিনি সৌর। প্রতিদিনের ছোট ছোট বিষয় গুলি মানুষকে শান্তি এনে দেয় সেই কথাটাই বলেছি। আমি চাকরি করতে চেয়েছিলাম। তুমি অনুমতি দাও নি।
– ডক্টর সৌরদীপ রায় এর স্ত্রী করবে চাকরি! তোমার রূপে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সংলাপ। তোমার কোয়ালিফিকেশন আমাকে খুশি করতে পারেনি।
– এভাবেই সুখে থাকো। এর মধ্যে আমাকে বিদেশ যেতে হতে পারে। মাসখানেকের জন্য। তখন তুমি দিদিভাই এর বাড়ি মায়ের সঙ্গে থাকতে পারো। আশা করি ভালো লাগবে।
– সৌর এসব আলোচনা আমার ভালো লাগছে না। আমার একটা ছবি তুলে দাও তো সৌর। ক্যামেরার হাতটা তোমার খুব ভালো। দাও দাও প্লিজ ।
– আমার এসব আদিখ্যেতা ভাল লাগেনা সংলাপ। যে দেশে কিছুদিন আগে পর্যন্ত মানুষ না খেয়ে ছিল, যে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা শোচনীয়, সেখানে রেস্টুরেন্টে বসে সময় কাটানোর মত মানসিকতা আমার নেই। তাড়াতাড়ি করো, খেয়ে বাড়ি চলো।
– সৌর, আমিও ভাবি আমার আশপাশের মানুষদের কথা। সেভাবে হয়তো কিছু করতে পারিনা। কিন্তু তোমার আনা জিনিস থেকে কিছু কিছু খাবার আমি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতাম। আজ এক বছর শিখাদির সংসারটা চালিয়েছি। অত বড় ছেলেটা মারা গেল। কিছুতো উপার্জন করতো। বাসন মাজে আর শিখাদি কাঁদে। এরই মাঝে আমারও ইচ্ছা করে তোমার সাথে কিছুটা সময় বাইরে কাটাবো। তুমি আমাকে ভুল বোঝ সৌর। সেদিন পাড়ায় অনাথ শিশুদের জামা কাপড় দেওয়া হচ্ছিল। আমার হাত খরচের টাকা দিয়ে পাড়ায় কিছু জামাকাপড় কিনে দিয়ে এসেছি। আমিও কষ্ট পাই সবার জন্য। বলতে পারি না সৌর।
– তুমি পাড়ার ক্লাবে যাও? ওই বাজে ছেলে গুলোর সামনে? আমার মান সম্মান সব চলে গেল। সৌরদীপ রায়ের স্ত্রী পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে। এরপর তো অন্য কিছু ,
– কি বলতে চাইছো সৌর? অন্যকিছু মানে? কী মিন করছো? সৌর আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে। বাবা- মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি। মেলামেশা করলে খারাপ হয় না। তুমি থাকো না। কোন বিপদ হলে ওই ছেলেগুলো দৌড়ে আসবে। ওরা এক একজন পাড়ার নক্ষত্র। হয়তো ওদের শিক্ষাদীক্ষা চাকরি অনেকটা কম। কিন্তু ওদের মধ্যেও সম্মান বোধ কাজ করে। মানুষকে সম্মান দিতে জানে। ওদের ঘরে বাবা মা রা শান্তিতে থাকে। পুরনো জামা কাপড়ের মধ্যেও দামি পারফিউমের গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়ে। কত কষ্ট করে ওরা ছোট ছোট উৎসব পালন করে। সমস্ত আত্মীয়দের কাছে ডাকে। বাড়িগুলো ঝলমলে হয়ে ওঠে। অথচ দেখ এত দিন হয়ে গেল আমি বাড়িতে বাবা – মা- ভাই – ভাইয়ের বউকে ডাকতে পারিনি। তুমি বাড়িতে থাকো না, আবার তুমি এগুলো পছন্দ করো না। আমার সুখ টা কোথায় বলতে পারো?
– তোমাকে বিয়ে করে ভুল হয়েছিল আমার । আমরা রোগীদের কাছে ভগবান। তাই সংসার অপেক্ষা কাজকে গুরুত্ব দিই বেশী। আমাদের একটা ছোট ভুল মানে একজনের প্রাণহানি।পাপ। এ পাপের ক্ষমা নেই।
– আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে সৌর। আমার কিছু ভালো লাগছেনা।
– শেষ হবে না। আমরা জীবন ফিরিয়ে দিই সংলাপ।
– কি বলতে চাইছো সৌর।
– আমরা মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে নিই। সময় নষ্টের প্রয়োজন নেই। ভুল শুধরে যাবে। তুমিও মুক্তি পাবে।
– এত বড় আঘাত দিতে পারলে তুমি। একটা ঘন্টা আনন্দের জন্য এত বড় শাস্তি?
– শাস্তি কেন। তুমি বাঁধা পড়েছিলে, মুক্ত করে দিলাম।দেখা হবে,কথা হবে। কিন্তু সংসার হবেনা।
– তুমি খুব স্বার্থপর সৌর।
– কেন? আমি ভীষণ ব্যস্ত ,তোমার কষ্ট হয়। এমন কাউকে যদি পাও বিয়ে করতে পারো।
– আমি?
– হ্যাঁ।তোমার পছন্দের মানুষকে। তোমাকে নিয়ে যিনি ঘুরে বেড়াতে পারবেন।
– বাজে কথা বলোনা। নিজের সুখের জন্য এই ডিসিশন নিতে পারো না।
– বাজে কথা? কোনটা বাজে? সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম বন্ধুর একটা পার্টিতে তোমাদের দেখলাম। এছাড়া কালকেও দেখলাম রেস্টুরেন্টে।
– তোমরা বিয়ে করে সুখী হও।এখন বাড়ি চলো।কাল ব্যবস্থা নেব।আমি একজন বন্ধু হয়ে পাশে থাকব।
– বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত। দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা।
– এক্সকিউজ মি প্লিজ। কোন কাপল মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।
– সংলাপের কণ্ঠস্বর শুনে জনৈক পুরুষ টি চমকে উঠল। তবে কি সংলাপ? সংলাপের কণ্ঠস্বর?
– সংলাপ কেমন আছো?
– আমি সংলাপ নই, আমি মধুশ্রিতা।
– সরি। কিছু মনে করবেন না। সম্পূর্ণ মিল তবে কি করে সম্ভব?
– ছি! কাকে বললাম। কিন্তু সংলাপের জন্য মনটা উদাস কেন? বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল সৌর। একবার! একবার যদি তোমায় দেখতে পেতাম সংলাপ। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
– গভীর রাতে একা কি বিছানায় ছটফট করছে সৌর। হঠাৎ সংলাপের হাতের স্পর্শ।
– সৌর কেমন আছো?
– ভালো আছি। তোমার সাথে দেখা হয়েছিল একাডেমির রাস্তায়।
– আলো- আঁধারি পরিবেশে কথা বলতে পারতে সৌরর গলাটা শুকিয়ে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। সংলাপের হাতটা হিম।
– সংলাপ তুমি আমার কাছে চলে এলে একেবারে, আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
– হুম। তোমাকে যত্ন করতে হবে ডক্টর রায়। খাবে তো?
– হঠাৎই ঝোড়ো বাতাসে কারেন্ট অফ, চারিদিকে অন্ধকার ,একটা দীর্ঘনিশ্বাস সৌরভের সারা শরীরকে কাঁপিয়ে দিল।
– সৌরভের যখন জ্ঞান এলো তখন বাড়িতে লোকারণ্য।