Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সোনালী সেই দিনের কথা || Sankar Brahma

সোনালী সেই দিনের কথা || Sankar Brahma

সোনালী সেই দিনের কথা

(এক).

“সেই দিন এই মাঠ
জীবনানন্দ দাশ

সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি—
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন —
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
আমি চলে যাব ব ‘লে
চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে?
লক্ষী পেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষীটির তরে?
সোনার স্বপ্নের সাধপৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

চারিদিকে শান্ত বাতি— ভিজে গন্ধ— মৃদু কলরব ;
খেয়া নৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে ;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল ;—
এশিরিয়া ধূলো আজ —বেবিলন ছাই হয়ে আছে।

কাব্যগ্রন্থ
রূপসী বাংলা”

জীবনের অপরাহ্নে এসে,বেহিসাবী জীবনের কথা ভাবতে বসে,হিসেব নিতে গিয়ে মন ভাবে,ছেলে খেলা করেই তো জীবনটা কাটালে , তবে আর এখন হিসাব করতে বসা কেন?
জীবনের হিসাব মেলাতে মন না চাইলেও , হৃদয়ের দিশেহারা ভাব কিছুটা লাঘব করার জন্যই,এ রচনার সূত্রপাত। প্রসঙ্গতঃ কয়েকজন সুজনের আন্তরিক উৎসাহ এ’পথে চলার প্রেরণা জুগিয়েছে। হ্যাঁ,এ এক রকম পথ চলাই তো।মনে,মনে,দিনের পর দিন পথ চলা।নিজের মুখোমুখি বসে, পুরানো সে সব অতীত দিনের,সোনালী বয়সের স্মৃতি রোমন্থন করতে মন্দ লাগে না।নিজেকে ঘিরেই গুটিপোকার মতো , যেন অবিরাম ঘোরা ফেরা।পাকে পাকে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে,ক্রমাগতঃ সময়ের স্রোত বেয়ে এগিয়ে চলা,থমকে দাঁড়ানো কিংবা পিছিয়ে পড়া।
সে সব ঘটনার পরম্পরা যেন আত্মপ্রকাশের উৎসমুখ খুঁজে ফেরে অদ্ভুত এক আবেশে। যা ক্রমাগতঃ ভিতরে ভিতরে আলোড়ন তোলে , মথিত করে।তখন তাদের প্রকাশ্যে আনা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
অস্বস্থি বাড়তে থাকে।তার থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্যই , মন বলে ওঠে —

••• “এই তো আমার অঞ্জলিতেই মস্ত পুকুর
কেউ বলে জল,কেউ বা স্মৃতি,কেউ বা সময়
কেউ আচমকা ছুঁড়লে ঢেলা
হঠাৎ যেন একটু একটু প্রকাশ্য হয়
খুব নগন্য ছেলে বেলা ” •••
( কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী )

(দুই).


” পুরনো সেই দিনের কথা ক’জন রাখে মনে
যখন ছিল ভালবাসা গোপনে নির্জনে,
ছুটতো তখন ফাগুন হাওয়া রিক্ত বনে বনে
পুরনো সেই দিনের কথা ক’জন রাখে মনে?

পুরনো সেই দিনের কথা ভুলতে পারা যায়?
মনের মধ্যে স্বপ্ন সে সব এখনও গান গায়,
হয় তো তা আর কোনকালেই হবে না পুরণ হায়
তবুও তার আবেগ যেন , দুকূল ছাপিয়ে যায়।

পুরনো সব দিনের কথা ভুলতে যারা চায়
তা’রা না হয় ভুলেই থাকুক, আমার কিবা দায়?
সে সব দিন মণিকোঠায় স্মৃতি হয়ে আছে
পুরনো সেই দিনের আবেশ মনের মধ্যে নাচে।

সে সব নিয়ে নাড়াচাড়ায় আজকাল যে কাটে
হয় তো হৃদয় স্মৃতি মেদুর আপনা থেকে ফাটে,
আনন্দে এই জীবনটাকে কাটাতে যদি চাও
ভালবাসার কাঁটার মুকুট মাথায় পরে নাও।”
[ শংকর ব্রহ্ম ]

আমরা ছিলাম আট ভাই বোন।
শূদ্রক মৃচ্ছকটিক নাটকে, এক জায়গায় বলেছন,যার সন্তান নেই তার মত অভাগা কেউ নেই।সে দিক দিয়ে ভাবলে আমার মা সৌভাগ্যবতী ছিলেন।
বাবা চাকরি করতেন পি ডাবলু ডি অফিসে গার্ডের। পেতেন হাতে আশি টাকা। তাতে সংসার চলত না।নাইট ডিউটি সেরে এসে, বাবা সকালে বিকালে একটা রেশন দোকানে মাল মাপার কাজ করতেন |অমানুষিক পরিশ্রম। সংসার বাঁচাতে তাই করতেন অক্লেশে।
তাতেও সংসারের অভাব মিটত না।
মা বাড়িতে ঠোঙা বানাতেন। আমি দোকানে দোকানে দিয়ে আসতাম। তাতে উপরি কিছু আয় হত। মা বাবার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না, আমাদের সবার মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিয়ে হাসি ফোটাবার। তবুও,অভাবের তাড়নায় দুবেলা পেট ভরে খাবার জুটত না। বিনা চিকিৎসায় পথ্যের অভাবে আমার চোখের সামনে পর পর চারটে ভাই বোন মারা যায়।
ধরে নিয়ে ছিলাম আমিও একদিন
এভাবই মরে যাব। তাই চারটে ভাই বোনের মৃত্যুতে তখন তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি,বিচলিত বোধ করিনি সে’সময়।ভেবে নিয়েছিলাম এটাই স্বাভাবিক।
আমি ছিলাম সবার বড়। ফলে সমস্ত ঝড়ের ঝাপটা এসে প্রথম পড়ত আমার মাথায়। চোদ্দ বছর বযসে স্কুলে পড়ার সময়, সকালের দিকে বাজারে সব্জি বেচে, স্নান খাওয়া সেরে দুপুরে স্কুল যেতাম। বিকালে ডিম বেচতাম লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে। এই ভাবে দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল। একবার ভেবে ছিলাম একটা পানের দোকান দেব। দু তিন দিন চেষ্টা করেও, পানের খিলি মুড়তে শিখতে পারিনি বলে, সে পরিকল্পনা বাতিল করে ছিলাম।
কি করিনি তখন?
লেকের বাড়িতে ফাই ফরমাম খেটেছি মাত্র চার আনা,আট আনা এক টাকার জন্য। তাতে কোন গ্লানি বোধ করিনি।
কোন কাজকেই আমি ছোট ভাবতাম না।
তবে চিটিংবাজি, লোক ঠকানো, সাট্টা, জুয়া, লটারি খেলে টাকা আয়ের ইচ্ছা আমার কখনও হয়নি।
– “গরীর হয়ে যাওয়া আর মরে যাওয়ার ভিতরে মরে যাওয়াই আমার পছন্দ, গরীব হয়ে যাওয়া নয়। মরনে দুঃখ অল্প, দারিদ্রে দুঃখের শেষ নেই।দারিদ্র থেকে আসে লজ্জ্বা।লজ্জ্বা পেলে তেজ চলে যায়,আর
তেজ না থাকলে নিগ্রহ সহ্য করতে হয়
নিগ্রহ থেকে আসে আত্মগ্লানি,আত্মগ্লানি থেকে শোকাচ্ছন্ন হয়,শোকাচ্ছন্ন হলে বুদ্ধি চলে যায়,বুদ্ধি না থাকলে সব শেষ হয়ে যায়,দারিদ্রই সব বিপদের মূল।”
এ সব আমার কথা নয়,শূদ্রক বলেছেন মৃচ্ছকটিক নাটকের এক জায়গায়।
এই ভাবেই দেখতে দেখতে একদিন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে গেলাম।
এক সময় আমার খুব ঘুড়ি উড়াবার শখ ছিল।ঘর থেকে বেরলেই ছিল,
দিগন্ত প্রসারিত উদার মাঠ,যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতো,”আয় আয় ছুটে আয় চলে
ঘর দোড় সব রেখে ফেলে।”
সে’সব মাঠ এখন প্রমোটারের থাবায় উধাও। এখন ঘুড়ি উড়াতে ইচ্ছে হলে, ছাদই ভরসা।তাতে বিপদের সম্ভবনা বেড়ে যায় অনেক।ছাদ থেকে পড়ে মারা যাওয়ার সম্ববনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সে’সময় ঘুড়ির কত নাম ছিল,এখনও সে সব নাম আছে কিনা জানি না অবশ্য।
যেমন – ময়ূরপঙ্খী,চাঁদিয়াল, মুখপোড়া,
পেটকাট্টি, চন্দ্রমুখি ,চাপরাশী, সতরঞ্জী,
মোমবাতি,কড়িটানা, চৌরঙ্গী প্রভৃতি।
বিশ্বকর্মা পূজার সাতদিন আগে থেকে
ঘুড়ি উড়ানো শুরু করতাম।শেষ হতো পূজার সাতদিন পর।সে যে কী মজায় দিনগুলো কাটতো,তা আর কি বলবো?
নিজের হাতে ঘুড়ি তৈরী করে নিতাম।
সে ঘুড়ি উড়াবার মজাই ছিল আলাদা।
সে সব এখন স্মৃতি।
বিশ্বকর্মা পূজার দিন তো সারা আকাশ জুড়ে ঘুড়ির মেলা থাকত সে’সময়।
আকাশে তাকালে আজকাল আর
সে’রূপ চোখে পড়ে না তার।মনটা উদাস
হয়ে যায়,রুক্ষতায় ভরে ওঠে।

” পাবলো নেরুদা
(১৯০৪-৭৩)
(চিলি)
মুঠোবন্দী মন

আরো একটি গোধূলি এলো গেল।
চরাচরজুড়ে নীল রাত নামছে,
অথচ সন্ধ্যায় আমাদের হাত-ধরাধরি হাঁটাই হলো না।

আমি জানালা দিয়ে দেখলাম
অনেক দূরের পাহাড়চূড়ায়
সূর্যাস্তের উৎসব বসেছে।

কখনো কখনো আমার হাতের তালুতে
মুদ্রার মতো
একটুকরো সূর্য পুড়তে থাকে।
মনটা বিষণ্ণ –
তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল
যে মনের কথা তুমি ছাড়া বেশি কে জানে!

তুমি কোথায় ছিলে তখন?
সাথে আর কে ছিল?
কী কথা তাহার সাথে?
যখন মনটা খুব খুব খারাপ থাকে
টের পাই, তুমি অ-নে-ক-দূ-রে,

বলো তো তখন হঠাৎ সব ভালোবাসা আমাকে পেয়ে বসে কেন?

গোধূলি এলে আমার পড়ার বন্ধ বইটা হাত থেকে পিছলে পড়ে,
চোট পাওয়া কুকুরের মতো আমার নীল সোয়েটারটি
আমারই পায়ের কাছে গড়াগড়ি যায়।

প্রতিটি দিন সন্ধ্যা এলে
তুমি সন্ধ্যাকে পেছনে ফেলে
স্মৃতির মূর্তি মুছে ক্রমশ এগোতে থাকো গোধূলি-দিকে।”

(তিন).


“সুখের সংজ্ঞা
– রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

সুখ মানে একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে
ঝাঁপিয়ে পড়া
সুখ মানে ভালোবাসার টাকাগুলো
অচল করে দেয়া।
সুখ মানে নারী ফেলে, ফুল ফেলে
আগুনে সমর্পিত হওয়া
সুখ মানে নির্বিঘ্নে একটি নির্বিকার
সিগারেট ধরানো।

[অগ্রন্থিত কবিতা – ১১-০৫-৭৪ (সন্ধ্যা) লালবাগ,ঢাকা।]”

আমি তখন আঠারোর দামাল কিশোর। যৌবনের সন্ধিক্ষণে আটকে পড়েছি। চোখে অনেক স্বপ্ন, বুকে অনেক আশা, মনে অনেক কল্পনা নিয়ে ভর্তি হলাম সিটি কলেজে ( সাউথ) বানিজ্য বিভাগে।
সুকান্তর কবিতাটা মনে পড়ে?
আমার তখন ঠিক সে রকম অবস্থা ।
~ আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা উঁকি

আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়
আঠারো বছর জানে না কাঁদা। ~”

কিছুদিন মন দিয়ে কলেজের ক্লাস করার পর, দেখলাম, অধ্যাপকরা যে ভাবে ইংরেজিতে টানা লেকচার দিয়ে যান, আমি তার কিছুই বুঝতে পারি না।
বুঝলাম বাংলা মিডিয়ায় পড়ার ফল এটা।
এই ভাবে কিছুদিন টানা ক্লাশ করার পর, পাঠ্য বইগুলি পড়বার আগ্রহটাই চটকে গেল।পাঠ্য বইয়ে ধুলো জমতে শুরু করল।আমি পড়তে শুরু করলাম, ইতিহাস – জ্ঞান বিজ্ঞান – দর্শন – সমাজ বিদ্যা – সাহিত্য শিল্প প্রভৃতি গ্রন্থ সমূহ।
কাছেই গোলপার্কে ছিল পুরনো বইয়ের কয়েকটা দোকান। সে দোকানগুলিতে ঘুরে ঘুরে বই পড়ে কাটাতাম কলেজের ক্লাস না করে,ফাঁকি দিয়ে।
ধীরে ধীরে সেই সব দোকানদারা, বসন্ত দা, প্রভাস, নির্মল, সত্য, পি এন দা সবাই আমার স্বজন হয়ে উঠেছিল, আজও সে সম্পর্ক অক্ষুন্ন।
আমার সাথে এমন সম্পর্ক ছিল, ধার বাকীতে বই কেনার সুযোগ ছিল আমার। হিসাব খাতায় লিখে রাখত। মাসের প্রথমে টিউশনের টাকা পেলে শোধ করতাম।
তা ছাড়া ছিল গড়িয়াহাটে শংকর সরকারের বিখ্যাত লিটলম্যাগাজিন ষ্টল।
সেখানেও ঘন্টার পর ঘন্টা সদ্য প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনগুলো পড়তাম। যেমন, কৃত্তিবাস, শতভিষা, কবিপত্র, ধ্রুপদী, সত্তর দশক, লা- পোয়েজি, বেলা অবেলা, কাল প্রতিমা প্রভৃতি।
সেগুলো পড়ার এমন আকর্ষণ ছিল যে, কোন কোনদিন সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত শংকরদার সঙ্গে অই দোকানে কেটেছে । গড়িয়াহাটা হোটেলে একসঙ্গে ভাত খেয়েছি কত দুপুর। আমাদের মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।
অই ষ্টলে আমি বহু কবি সাহিত্যিকদের প্রথম দেখি।
যেমন, সুনীল, শীর্শেন্দু, দিব্যেন্দু পালিত, সমরেশ বসু, শঙ্খ ঘোষ, মৌমিত্র চ্যাটার্জী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কত জনকে।
১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার সময় গৌর কিশোর ঘোষকে গলায় কুকুরের বকলেস বেঁধে ঘুরতে দেখেছি, গড়িয়াহাটের অই ষ্টলে বসেই।
ইন্দিরা সরকারের, জরুরী অবস্থায়, কন্ঠ রোধের প্রতিবাদে তিনি গলায় কুকুরের বকলেস এঁটে ঘুরতেন। নীরব প্রতিবাদ।
আজ মনে হয়, এই তো যেন সেদিনের কথা।
অথচ তারা আজ অনেকেই আমাদেন মধ্যে নেই।
পাঠ্য বই কিছুই পড়া হয়নি দেখে ঠিক করলাম, ফাইনাল পরীক্ষায় এবার বসব না।
আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু বলল, দিয়ে দে, যা হয় হবে। ও আমার পরীক্ষার ফিসও জমা দিয়ে দিল।

কি ভাবে যে বি কম পাশ করে ছিলাম, নিজেও জানি না। মিরাকেল ঘটেছিল বোধহয়, পাশ করে গেছিলাম।

এর পর অনুভব করতে শুরু করলাম বেকারত্বের তীব্র দাহ। বাড়িতে প্রচন্ড অভাব। আমার আয়ের কোন মুরোদ নেই। তখন চোখের সব স্বপ্ন, বুক ভরা আশা, মনের যত কল্পনা মিলে মিশে একটা মন্ডে পরিণত হল।
তাই বাড়ির বাইরেই বেশীর ভাগ সময় কাটাতে শুরু করলাম। বেশীর ভাগ সময়ই কাটত গোলপার্কের সেই সব পুরনো বইয়ের দোকানে,বই পড়ে।বাড়ি ফিরতাম রাত করে।

” প্রত্যাশার বাইরেই ছিল
শামসুর রহমান

প্রত্যাশার বাইরেই ছিল ব্যাপারটি। রোজকার
মতোই টেবিল ঘেঁষে পুরোনো চেয়ারে
আরামে ছিলাম বসে, ঘড়িতে তখন
সকাল আটটা ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি কি না-লেখা কোনও কবিতার পঙ্‌ক্তি মনে-মনে
সৃজনে ছিলাম মগ্ন? একটি কি দুটি শব্দ হয়তো-বা ভেসে
উঠছিল আমার মানস-হ্রদে। আচমকা
চোখে পড়ে ঘরে একটি প্রজাপতির চঞ্চলতা।

বেশ কিছুকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ দিব্যি গিলে রেখেছে আমার,
আমাদের বসতিকে। আলো জ্বালাবার
প্রয়াস নিমেষে ব্যর্থ হয় জাহাঁবাজ
তিমিরবিলাসী ক্রূর হাওয়ার সন্ত্রাসে নিত্যদিন। তবুও তো

একজন রঙিন অতিথি ঘরটিকে দান করে অকৃপণ
সোন্দর্যের আভা, মুগ্ধ চোখে দেখি তাকে। মনে হয়,
একটি কবিতা যেন ওড়াউড়ি করছে এ-ঘরে,
অথচ দিচ্ছে না ধরা আমার একান্ত করতলে, যার ধ্যানে
দীর্ঘকাল মগ্ন ছিল কবিচিত্ত সম্ভবত অবচেতনায়
আধো জাগরণে কিংবা ঘুমের আংশিক এলাকায়।

[ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে কাব্যগ্রন্থ থেকে]

(চার).

“ছেলেটা
—শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে
মানুষ ছিলো নরম, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো ।
অন্ধ ছেলে, বন্ধ ছেলে, জীবন আছে জানলায়
পাথর কেটে পথ বানানো , তাই হয়েছে ব্যর্থ ।
মাথায় ক্যারা , ওদের ফেরা যতোই থাক রপ্ত
নিজের গলা দুহাতে টিপে বরণ করা মৃত্যু
ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে
মানুষ ছিলো নরম, কেটে , ছড়িয়ে দিলে পারতো।
পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত
মানুষ বড় সস্তা , কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।”

সত্তর দশক মুক্তির দশক।
এই স্লোগানে ফাঁকা দেয়ালগুলি ভরে উঠছিল, লেখায়- পোষ্টারে, সেটা সত্তর দশকের কথা।
নকশাল আন্দলোন তীব্র আকার ধারণ করে দাবানলের মত শহরের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। গড়িয়া খাল দিয়ে কত যে তরুণের লাশ তখন ভেসে যেতে দেখেছি। চারিদিকে থমথমে আতঙ্কের পরিবেশ। জটিল পরিস্থিতি। কলকাতা শহর উত্তাল। আমরা তরুণরা দিশেহারা।
অন্য দিকে বাংলা দেশে, মুজিবর রহমানের
কন্ঠে গর্জে ওঠে ধ্বনি _
আমাগো দাবাইয়া রাখতে পারবা না।
রেডিওতে নিয়মিত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাত্ত গলায় উত্তেজক ভাষ্য ও সংবাদপাঠ আমাদের রক্তে দোলা দিত। মনে আলোড়ণ তুলত।
কিছু একটা করার তীব্র ইচ্ছা জাগত মনে।
কিন্ত কি যে করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।
বয়স তখন আমার উনিশ-কুড়ি।
প্রতিবাদের ইচ্ছা জাগত মনে। কিন্তু কি ভাবে প্রতিবাদ করব?
কবিতা লিখে তা প্রকাশ করার চেষ্টা করতাম।
এ ভাবেই একদিন ঢুকে পড়ি কবিতা শহরে।

কারও দুঃখ কষ্ট অসহায়তা দেখলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। সহ্য করতে পারি না। আমার এইসব অভাবী মানুষদের পরবাসী মনে হয়।
তাদের নিয়ে লিখতে বাধ্য হই পরবাসী কবিতাটি

“পরবাসী

ওই যে যুবতী পরনে রয়েছে ছেঁড়া ত্যানা
এ কেবল তার গ্লানি আমাদের নয়

ওই যে তরুণ অর্থাভাবে শুধু বিপথগামী হল
এ কেবল তার ব্যথা আমাদের নয়

ওই যে শিশুটি অনাহারে মারা গেল কাল
এ কেবল তার ক্ষতি আমাদের নয়

ওরা বুঝি আমাদের কেউই নয়?
আমাদের পাশাপাশি কিছু কাল
ছিল পরবাসী হয়ে?”

(ক্রমশঃ)

(পাঁচ).

” চিলি
নিকানোর পাররা
১৯১৪.
————–

আমার বলা কথাগুলো আমি ফিরিয়ে নিতে চাই
চলে যাবার আগে
আমার একটি প্রত্যাশা পূরণের বাসনা আছে।
শ্রদ্ধেয় পাঠক
আমার বইগুলো পুড়িয়ে ফেলুন।
আমি যা বলতে চেয়েছিলাম এতে মোটেও তা নেই
যদিও এসব রক্ত দিয়েই লেখা হয়েছিল,
কিন্তু এগুলো তা নয়
যা আমি বলতে চেয়েছিলাম।
এরা কেউই আমার চেয়ে বেশী বিষাদ বহন করতে পারে না,
কিন্তু আমি আমার ছায়ার কাছেই হেরে গেছি :
আমার শব্দরা আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে
ক্ষমা করুন পাঠক, প্রিয় পাঠক
যদি আমি আপনাকে
উষ্ণ আলিঙ্গনে বিদায় জানাতে না পারি,
যদি আমি একটি বিষণ্ণ হাসি রেখে
জোর করে বিদায় নিতে চাই।

হয়ত এই লেখাগুলোর সবটাই আমি
তবু আমার শেষ কথাটুকু শুনুন :
আমি ফিরিয়ে নিতে চাই আমার কথাগুলো।
এক পৃথিবী বিষাদ নিয়ে বলা
আমার কথাগুলো আমি ফিরিয়ে নিতে চাই। “

এভাবেই সত্তর দশকের শুরুটা হল, উৎকন্ঠায় দিন যাপন, শঙ্কায় নিশি যাপন। এই ছিল তখন পরিস্থিতি। কাল কি আবার নতুন কোন লাশ ভেসে যাবে গড়িয়া খাল দিয়ে, কোন স্বজন বন্ধুর লাশ নয়তো? জীবনের কোন নিরাপত্তা ছিল না।
এসব কিছু পরের কথা। তার আগের কথা,
কলেজে পড়ার সময়ই আমরা দুজনে মিলে জোনাকি নামে একটা মাসিকপত্রিকা বের করি। নামটা সুশীল রায়ের দেওয়া। কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়ে বন্ধু মহলে আলোড়ণ তোলে। কিছুদিন রমরমিয়ে জ্বলে জোনকি। তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই একদিন আলো নিভে যায়।
জোনকির আলো নিভলেও, আমার ভিতরের আলো তখন জাজ্বল্যমান।
তার অল্পদিন পরেই, গল্পকার শ্যামল মজুমদার আর আমি মিলে বের করি – সোনালী বয়স – নামে আর একটি পত্রিকা, সেখানে লিখেছিলেন, বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চ্যাটার্জী, তারাপদ রায়, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখেরা।
তখন আমার দিন কাটত টালিগঞ্জ কলাবাগান লেনে শ্যামল মজুমদারের বাড়ি। এক সময় শ্যামল, সুনীল গাঙ্গুলীর ছেলেকে পড়িয়েছিল কিছুদিন। পরবর্তীকালে ওর অনেক গল্প উপন্যাস বেরিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকায় ।
ওর সঙ্গে একদিন যাই কবি শিশির চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। শিশিরদা মননশীল মার্জিত রুচির একটি পত্রিকা বের করতেন, নাম – অন্যদিন -।
তারপর কয়েকদিন ওনার বাড়িতে গেছি। আলোচনা হয়েছে, কবিতার আঙ্গিক প্রকরণ নিয়ে। হঠাৎ আমাদের বিমূঢ় করে একদিন, অকালেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। আমরা অনাথ হলাম।
এদিকে আমার পারিবারিক জীবনে দারিদ্রের দংশন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কি করব আমি বুঝতে পারি না। দিশেহারা হয়ে পড়ি।অসহায় ছটফট করি নিজের ভিতরে নিজে একা।

” আনন্দ-ভৈরবী
– শক্তি চট্টোপাধ‍্যায়

আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ‍্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।

আজ সেই গোঠে আসে না রাখাল ছেলে
কাঁদে না মোহনবাঁশিতে বটের মূল
এখনো বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে
বিদ‍্যুৎ-রেখা মেলে।

সে কি জানিত না এমনি দুঃসময়
লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি
সে কি জানিত না হৃদয়ের অপচয়
কৃপণের বামমুঠি।

সে কি জানিত না যত বড় রাজধানী
তত বিখ‍্যাত নয় এ হৃদয়পুর
সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি
আনখ সমুদ্দুর।

আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ‍্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।”

(ছয়).

“দাবানল
– অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

এক পা রেখেছে মৃত্যুর গহ্বরে,
রোদ্দুরে অন্য পা,
সাঁওতালী মেয়ে কোন ফুসমন্তরে
বেঁধে নিল তার খোঁপা।

লাল জবা গুঁজে পাশের অরণ্যেই
ঢুকে গেল ধিকিধিকি
আগুন, পিছনে পড়ে থাকে চিরুনিরা
এবং আয়না–দিঘি।

[ কাব্যগ্রন্থ – ‘ মরমি করাত ‘ ] “

সাহিত্যের নেশা আমার আমার মাথায় ঢোকে স্কুলের শেষ পর্যায়ে এসে ১৯৬৭ – ৬৮ সালে।
আমি তখন নাকতলা হাই স্কুলে পড়তাম। আমার সহপাঠী ছিল চন্দন সেনগুপ্ত ( কমঃ নিরঞ্জন সেনগুপ্তর ভাইপো, প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের উদ্বাস্তু ও পুনর্বাস মন্ত্রী হয়েছিলেন।)
তখন আমার সাহিত্য আলোচনার সঙ্গী, উৎসাহদাতা সবই ছিল চন্দন। সে গল্প লিখত, আমি কবিতা। তার গল্পের একটি বই আছে, নাম- প্রিয়তমাসু -।
থাকত বাঁশদ্রোনীতে। ওদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল। ওদের বাড়ির চিলেকোঠায় বসে কতদিন মাইকেল, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্র রচনাবলী পড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি তার কোন হিসাব নেই।
বিভূতিভূষণের আরন্যক পড়ে চোখ খুলে গেছে নিবিড় ভাবে প্রকৃতিকে দেখবার, অনুভব করবার।
রূপসী প্রকৃতিকে নিবিড় ভাবে অনুভব করে তার প্রেমে পড়ে গেছি তখন গভীর ভাবে।
আর সে সময় আকস্মিক ভাবে হাতে এলো শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত সমগ্র, পড়ে এমন আপ্লুত ও মোহগ্রস্থ হলাম যে দুজনেরই ঘোরে কাটল কয়েকটা দিন।
এরপর আমরা নিশুতি রাতের
অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য টালিগঞ্জের কবর খানায়
(এম আর বাঙুর হাসপাতালের পিছনদিকে) রাত কাটালাম কয়েকবার।
এরপর আমি একা, কালিঘাট ও নিমতলা শশ্মানে তিনরাত কাটিয়ে ছিলাম ঘোরের মধ্যে মোহাচ্ছন্ন।
শরৎচন্দ্র আর বিভূতিভূষণ পড়ে মানসিক ভাবে ভবঘুরে হয়ে পড়েছিলাম।
সেই সময় আর একটি বই পড়ে ভীষণ
আলোড়িত হয়েছিলাম, তা হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা। তাঁর লেখা সার্বজনীন বইটি পড়ে ভেবেছিলাম, এভাবেও উদ্বাস্তু জীবন সমস্যা নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়?
বইটি আমাকে ভীষণ স্পর্শ করে ছিল। কারণ,আমরা ছিলাম উদ্বাস্তু। দেশ ভাগের পর মা বাবা এখানে চলে আসেন। আমার জন্ম অবশ্য কলকাতার চেতলায়। আমি এদেশী, তাই নয় ?
সে সময় তারাশংকরের লেখা গল্প অগ্রদানী, বেদেনী, ডাকহরকরা, রসকলি, কালিন্দি, হারানো সুর, জলসা ঘর, বিপাসা, সপ্তপদী, নিশিপদ্ম পড়েছি।
উপন্যাস – গণ দেবতা, হাঁসুলী বাকের উপকথা, আরোগ্য নিকেতন পড়ে অভিভূত হয়েছি, মুগ্ধতায়
বিমূঢ় বিস্ময়ে ভেবেছি, লেখকরা কি অপরূপ ভাবে চরিত্র চিত্রায়ন করেন।
এসব পড়তে পড়তে একদিন মনে হল, নিজেদের অভিজ্ঞতা, অনু্ভূতি মনের কথা জানানোর জন্য একটি নিজেদের পত্রিকা প্রয়োজন। যেমনি ভাবা , তেমনি কাজ।
আমি আর এক সহপাঠি মিলে বের করলাম
– মেঘদূত – পত্রিকা।
কয়েকটি সংখ্যা বের হবার পর, তা মুখ থুবড়ে পড়ল অর্থাভাবে। কিন্তু আমার সাহিত্যের নেশা কাটলো না। দিন দিন বেড়েই চলল।

বাড়িতে তখন দারিদ্র চরমে। চাকরীর জন্য কার কাছে না গেছি? যে হাত ধরার যোগ্য নয়, তার পায়ে ধরেছি । কিন্তু কেউ মুখ তুলে তাকায়নি। আপদ বিদায় করেছে রুক্ষ ভাষায় রুক্ষ ভাবে।
হঠাৎ একদিন, বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মত,একটি কাজ জুটল, একটি নির্মান সংস্থায় হিসাব রক্ষকের কাজ। এটা জুটল,এক মহানুভব ব্যক্তির সহৃদয়তায়। মনে মনে ভাবলাম, যাক্ বাঁচা গেল।অলক্ষ্যে ভাগ্য বিধাতা হাসলেন।
নিয়মিত অতি উৎসাহে, সময়ের আগেই গিয়ে হাজির হতাম। মন দিয়ে হিসাব দেখতাম। যত্ন করে খাতায় হিসাব লিখতাম।
কয়েকদিন কাজ করার পর টের পেলাম, ঘাবলা আছে। হিসাবের কারচুপি ধরে ফেললাম।
আমি নিজে এ কাজের অযোগ্য,একদিন মালিককে সে কথা জানালাম গেলাম।
মালিক সব শুনে হাসলেন। বললেন এ জন্যই তো তোমার মত বিশ্বাসী লোক চাই, যে বাইরে ডিসক্লোজ করবে না।
যাই হোক, তুমি যখন এ কাজ করতে অপারগ তখন তুমি বরং এক কাজ কর, বাড়িতে আমার মেয়েকে পড়াও,এবার মাধ্যমিক দেবে।
আমি কিছু বলার আগেই , উনি আমার হাতে দুটো একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখ কাল থেকে আমার বাড়ি যাবে।
পরে, পকেট থেকে বের করে ওনার একটা ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।

“আন্দ্রেস এলোয় ব্লাংকো’র (১৮৯৭-১৯৫৫) কবিতা
দরিদ্র ছন্দের সনেট

আমায় দাও রুটি তোমার নিজের হাতে দলা
আমায় দাও রুটি তোমার উনুনেতে সেঁকা
আমায় দাও রুটি তোমার যাতাকলে পেষা
আমায় দাও রুটি তোমার বেলনেতে বেলা

আমায় দাও জমি তোমার হাতের তালুয়ে গোঁজা
আমায় দাও পালং তোমার ঘরের কোনে ঠেসা
আমায় দাও চুমুক তোমার পিয়াসে নিংড়ানো
আমায় দাও পোশাক তোমার গায়ের ঘামে ভেজা

(অসমাপ্ত)


(সাত).

” শুধু কবিতার জন্য
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু
কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।

[আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি – কাব্যগ্রন্থ থেকে ]”

১৯৬৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক ( এটাই ১১ ক্লাসের শেষ ব্যাচ) পাশ করে, গোলপার্কের সিটি ( সাউথ) কলেজে আমি কলেজে আমি একাই গিয়ে ভর্তি হলাম, বাড়িতে আর কেউ ছিল না নিয়ে যাবার মতো কোন লোক।
যেন মুক্ত আমি, স্বাধীনতা পেলাম।
সাহিত্য চর্চার সুযোগ আরও বেড়ে গেল। কাছেই পুরনো বইয়ের দোকান। ক্লাস অফ থাকলে পড়ে থাকতাম সেখানে, বসে বসে ঘন্চার পর ঘন্টা বই ডড়তাম। কতদিন আবার ক্লাস ফাঁকি দিয়েও, ওখানে বসে বসে বই পড়ে কাটিয়েছি। সে সব ভাবলে এখন স্বপ্ন মনে হয়।
ক্লাসের পর বিকেল ৫/৬ টায় কোন দিন যেতাম সুশীল রায়ের বাড়ি কাঁঁকুলিয়া রোডে। আবার কোন দিন যেতাম, ঢাকুরিয়া ব্রীজের নীচে সুনীল গাঙ্গুলীর ভাড়া বাড়ির চার তলায়। সুনীল দা তখনও বিয়ে করেননি, মাকে নিয়ে ওখানে থাকতেন তিন শো টাকা ভাড়ায়।

[ তার আগে স্বাতীদি সাথে প্রেম হয়।
স্বাতীদিকে সুনীলদার লেখা একটি চিঠি।
( সুনীলদার প্রণয়-প্রস্তাবে স্বাতীদি সম্মত হবার পর,এ চিঠি লেখা হয়েছিল। সুনীলদা বয়স তখন ৩২ বছর )

বহরমপুর / বুধবার
২২ শে জুন ১৯৬৬

স্বাতী,
মনটা কী চমৎকার হালকা হয়ে গেছে আমার, কী যে ভালো লাগছে আজ। যে-কথাটা বলার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে ঘুরেছি এ ক’দিন, অথচ মুখ ফুটে বলতে পারিনি, বলার সাহস হয়নি, সেদিন সন্ধ্যেবেলা যখন হঠাৎ বলে ফেললুম, হাঁটুর উপর মুখ রেখে তুমি যখন আস্তে বললে ‘হ্যাঁ’, সেই মুহূর্তে আমার জীবনটা বদলে গেল। আমি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই,তোমাকে চাই _তোমাকে হারাবার ক্ষতি কিছুতে আমি সহ্য করতে পারবো না_ এই কথাটা প্রবলভাবে দাবি করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু ভয় ছিল যদি এ আমার স্বার্থপরতা হয়, তাছাড়া, আমি তোমাকে চাই, তুমি যদি আমাকে না চাও? সত্যিই, স্বাতী, সত্যিই তুমি আমার হবে, এবং আমি তোমার হবো? আমি তো তোমার হয়েই আছি।
তুমি আমার সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছুই জানো না, আমি নানা রকম ভাবে জীবন কাটিয়েছি, অনেক ভুল এবং হঠকারিতা করেছি, কিন্তু কখনো কোনো অন্যায় করিনি, আমি গ্লানিহীন, আমার স্বভাবে কোনও দোষ নেই- এ কথা তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। আমি এ পর্যন্ত তোমার কাছে একটিও মিথ্যে কথা বলিনি, ভবিষ্যতেও তুমি যা জিজ্ঞেস করবে তার কোনো মিথ্যে উত্তর দেবো না। আমি তোমার যোগ্য নই, কিন্তু ক্রমঃশ যোগ্য হয়ে উঠতে পারি, হতে শুরু করেছি, তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই আমার নিজের মধ্যে একটা পবিত্রতার স্পর্শ ও বোধ পেয়েছি। তুমি আমার জীবনকে স্নিগ্ধ করে দিতে পারো। আমি তোমাকে জানি। আমি তোমাকে দেখেই তোমাকে সম্পূর্ন জেনেছি। মানুষ চিনতে আমার কখনো ভুল হয় না, আমার চোখের দৃষ্টি কত তীক্ষ্ণ তুমি জানো না। আমি তোমাকে দেখেই জেনেছি – তোমার এমন অনেক দুর্লভ গুণ আছে – যা তুমি নিজেই জানো না। তুমি কি সত্যিই আমাকে গ্রহণ করবে? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাকে গ্রহণ করলে তোমাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু তোমাকে পেলে আমার কিছুই হারাবার নেই – বরং, আমি অশেষ সৌভাগ্যবান হবো। তুমি কি আমার জন্য সেসব ত্যাগ স্বীকার করতে চাও? পারবে, তোমার এতদিনের চেনা পরিবেশ ছেড়ে আসতে? তোমাদের বাড়ি খুব সম্ভব আমাকে স্বীকার করবে না। আমার তো কোনো চালচুলো নেই। আমি বিদেশে গিয়েছিলুম – এটা কারুর কারুর কাছে হয়তো সম্মানের বা ঈর্ষার হতে পারে – কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে তার তো কোনো মূল্যই নেই। আমাদের দেশ থেকে সবাই বিদেশে যায় উঁচু ডিগ্রী নিয়ে আসতে বা চাকরীর উন্নতি করতে – আমি শুধু ছন্নছাড়ার মত গিয়েছিলাম খেয়াল খুশীমতো জীবন কাটাতে। তা ছাড়া, বড় চাকরি করা বা খোঁজার চেষ্টা হয়তো আমার দ্বারা আর ইহজীবনে সম্ভব হবে না। আমি এক ধরনের স্বাধীনতা, অর্থাৎ লেখার স্বাধীনতা ভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের পরিবার যদিও নির্ঝঞ্ঝাট কিন্তু কিছুটা নিম্ন মধ্যবিত্ত, তুমি যে-ধরনের জীবন যাপনে অভ্যস্ত- তাতে হয়তো তোমার খানিকটা কষ্ট হবে – অবশ্য জানি, জীবনের ক্ষেত্রে এসব কিছুই না, এতে কিছুই যায় আসে না – তবু, অভ্যেস বদল করা সত্যিই কষ্টকর। কিন্তু তুমি যদি এসব সহ্য করতে পারো – তবে বাকিটা আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দিতে পারি। আমি এতদিন খানিকটা অবিশ্বাসী হয়ে গেছিলুম, আমি ভেবেছিলাম আমার পক্ষে এ জীবনে কারুকে ভালোবাসা সম্ভব হবে না, কিন্তু আমি হঠাৎ বদলে গেলাম, তোমার জন্যে আমার এক বুক ভালোবাসা রয়েছে। আগে অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছে, কিন্তু তোমার মত কঠিন সরলতার সম্মুখীন হইনি আগে। আমি এরই প্রার্থী ছিলাম। তুমি আমাকে এত বেশি সম্মান দিলে প্রথমেই, আমার সামান্য অকিঞ্চিত্‍কর জীবনকে তুমি এমন মূল্যবান করে তুললে যে আমি অভিভূত হয়ে পড়লুম। আমি ক্লান্ত ছিলাম। আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম, কেউ এসে আমাকে ডাক দিক। সেই সময় তুমি এলে। আমি তোমাকে ভেবে দেখতে বলেছি। তুমি খুব ভালো করে ভেবে দেখো। অন্য কারো কথা না শুনে, তুমি নিজেই ভেবে দেখবে। তোমার মনের দিক থেকে সামান্যতম দ্বিধা থাকলে – আমি বিদায় নিয়ে চলে যাবো। এবং ভেবে দেখবে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে- আমার প্রতি কোনো দয়া বা ভদ্রতাবোধ যেন দৃষ্টি আচ্ছন্ন না করে, কারণ প্রশ্নটা যে সত্যিই খুব বড়ো। তোমার যে-কোনো একটু ইঙ্গিতে আমি দূরে সরে যেতে পারি। আর, যদি তুমি রাজী থাকো, তবে কোনো বাধাই আর বাধা নয়, সব বাধাই তখন তুচ্ছ, তখন আমি জোর করে তোমার ওপর আমার অধিকার দাবি করে নিতে পারবো। সেদিন তোমার বান্ধবীর বাড়ির কাছে যখন তুমি নেমে গেলে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়ালে, সেই মুহূর্তে তোমাকে খুবই দুর্বল, অসহায় আর উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। তোমার মনের মধ্যে একটা দারুন ওলোট পালোট চলছে তখন- মুখ দেখেই বোঝা যায়। একটু পরেই আমার মনে হলো – তোমাকে ও-রকম ভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি আমার, তখন তোমার রাস্তা পার হবারও ক্ষমতা ছিল না, আমার উচিত ছিল তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকা, তোমাকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু তখন আমি খানিকটা দূরে চলে এসেছি, ফিরে গিয়ে আর তোমাকে পাবার উপায় নেই। কেন যে ঠিক সময়ে আমার ঠিক কথাটা মনে পড়ে না! কিন্তু এবার থেকে আর ভুল হবে না।
এখানে বন্ধু-বান্ধবরা খুব হৈ-হল্লা করছে। আমি কী লিখছি জানার জন্য অনেকেরই কৌতূহল ও ব্যগ্রতা। কিন্তু আমি একটুও জানাতে চাই না। কালকেই দুপুরে কলকাতায় ফিরবো। আশা করছি ফিরেই তোমার একটা চিঠি পাবো। সেদিন বাড়িতে কি খুব বেশী বকুনি দিয়েছে?

সুনীল। ]

আবার কখনো যেতাম ঢাকুরিয়া ব্রীজ ছাড়িয়ে, ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডে বীরেনদার ( বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) বাড়ি কিংবা ফণিভূষণ আচার্যর ( অধ্যাপক ও বাংলা ব্যাকরণ ও রচনার পুস্তক প্রণেতা – পি. আচার্য) বাড়ি। এই ভাবে দিনগুলো কবে ফুরিয়ে গেছে,টেরও পাইনি মোটে।
আগে কখনও টিউশনি করিনি। কোন অভিজ্ঞতা নেই। সুনীল দা ( সুনীল গাঙ্গুলী)একদিন ডেকে বলেছিলেন, বেকার বসে না থেকে টিউশন করো। আমিও এক সময় করেছি। মনে পড়ে গেল। লেগে গেলাম সেই মেয়েটিকে পড়াতে।মেয়েটি পড়ত লা মার্টিন হাই স্কুলে। সকাল দশটা থেকে ওদের ক্লাস শুরু হত। আমি সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে পৌঁছে যেতাম।
মেয়েটির নাম মৌ। কথা বলত খুবই কম, না বলার মত।
পড়া যখন বোঝাতাম আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। পড়া বুঝছে কিনা বুঝতে পারতাম না। কোন প্রশ্ন করত না।যদি জানতে চাইতাম, বুঝেছ? মুখে কোন উত্তর দিত না। মাথা কাৎ করে সন্মতি জানাত।
মাস খানেক এ ভাবে কেটে গেল অনায়াসে।পরের মাসেও ভদ্রলোক আমায় দুশো টাকা দেন।শুধু বলেন, মৌকে দেখবেন,যেন মাধ্যমিকটা উৎরে যায়।আমি কোন উত্তর না দিয়ে নিজের সারা মুখে হাসি মাখিয়ে রাখি ক্রীমের মত।
একদিন নীরবতা ভেঙে মৌ জানতে চাইল,স্যার, আমাকে আপনার ভাল লাগে?
– কেন?
– এমনি, বলুন না।
– হ্যাঁ
……………………….
এই ভাবে চলছিল।
একদিন বৌদি ( মৌয়ের মা) বলল, মৌয়ের আজ অবন মহলে একটা নাচের ফাংসন আছে সন্ধ্যা ছটায়, তুমি একটু নিয়ে যেতে পারবে বাবা?অনুরোধের ভঙ্গীতে বললেন।
আমি “না” বলতে গিয়েও মুখে বলতে পারলাম না। মুখে কিভাবে যেন আটকে গেল “না”কথাটা।গেলাম নিয়ে অবন মহল
হলে,ঢাকুরিয়া ব্রীজের নীচে ছিল।এখন আম্রি হসপিটাল হয়েছে।

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-
(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়িরে ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার। নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেকেরে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা;
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই,
আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি ….., ব্যক্তিগত জিরো আওয়অর;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাত্‌ড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদুরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে
বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।

[আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি – কাব্যগ্রন্থ থেকে ]

(আট).

“রুমির কবিতা

” ফিরে এসো হৃদয় আমার , আর কতদিন
তুমি প্রতারণার বাগানে থাকবে?
আমি তোমাকে একশো বার্তা পাঠিয়েছি
আমি তোমাকে একশ পথ দেখিয়েছি
হয় এগুলি তুমি পড়নি
অথবা আমার পরামর্শ উপেক্ষা করেছো
ফিরে এসো আমার আত্মা, নষ্ট করো না
সময় ঠান্ডা হৃদয়ের সাথে
তারা তোমার মূল্য জানে না,
তবু কেন তুমি জল চাও
তুমি যখন নিজেই স্রোত?… ”
( “The Garden Of Soul” থেকে –
“Come back my soul,how much longer
will you linger in the garden of deceit?
I have sent you a hundred messages
I have shown you a hundred ways
either you never read them
or you ignore my advice
Come back my soul,don’t waste
time with cold hearted
they don’t know your worth,
Why do you seek water
when you are the stream?…”)

সে সময় প্রচুর বই পড়তাম আমি। খুব আনন্দ পেতাম এক একটা বই পড়া শেষ করে। সে আনন্দ উপলব্ধির প্রকাশ আমার পেত,আমার দৈনন্দিন আচরণে। অস্থিরভাবে অকারণে ঘোরাঘুরি করতাম এখানে সেখানে।
ভাবতাম, চাকরী নেই তো হয়েছে কি?আমি পড়াশুনা নিয়েই থাকব। লেখা লেখি করব। লেখা লেখি করেই বাঁচব। কতজন তো লেখাকেই জীবিকা করে বেঁচে আছেন। তাহলে আর চিন্তা কীসের? হাতের কাছে যে বই পেতাম পড়ে ফেলতাম। ভাল মন্দের বাছবিচার ছিল না তখন তেমন কোন। পড়ায় কোন ক্লান্তি ছিল না। কাগজের ঠোঙা ছিঁড়ে পড়ে অনেক ভাল লেখার সন্ধান পেয়েছি।
পড়তে পড়তে রাত ফুরিয়ে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠত কোন কোন দিন। সে সময় সাহিত্যের উৎসাহ উদ্দীপনায় ভরপুর মসগুল ছিলাম দিনরাত।
এন্তার এই সব বই পড়া তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল নিজের লেখায় মগ্ন হয়ে পড়া। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের খেয়ালে লিখতাম, যা খুশি মনে আসত। তখন একদিনে দিস্তা দিস্তা লিখতে পারতাম। তেমন কিছুই হত না সে সব লেখা। কিন্তু আসলে লেখার চর্চা হত।
সুনীল দা, কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন ( তখন তার প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে দেশ শারদীয়া সংখ্যায় ) উপন্যাস লিখতে হলে দিনে অন্ততঃ কুড়ি পাতা লেখার এলেম তোমায় ধরে রাখতেই হবে।
সুনীল দা একথা মনে প্রাণে বিশ্বাম করতেন বলেই তাঁর বিপুল সাহিত্য সম্ভার আমরা উপহার পেয়েছি।
এই প্রসঙ্গে মনীষ ঘটক ( মহাশ্বেতা দেবীর পিতা) বলেছেন,
-” আমার শেষ প্রার্থনা এই যে যাঁর লিখবার কিছু ক্ষমতা আছে তিনি অন্ততঃ দিনে তিন ঘন্টা আপন মনে লিখে যাবেন, রাতারাতি বড় লোক হবার আশা ত্যাগ করে। “-

সাহিত্য নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকার ফলে, বাস্তব জীবনের নানান অভাব অভিযোগের সাঁড়াশি আক্রণের থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছিলাম মানসিক ভাবে। বলা ভাল, সাহিত্য থেকে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেয়েছিলাম, সেই উত্তাল সময়ে ( সত্তর দশকে) ।

মৌ কে পড়াচ্ছি দু মাস হয়ে গেছে। সামনের মাসে মৌ এর জন্মদিন ওর মার মুখে শুনে জানলাম।
জন্মদিনে কি উপহার পেলে মৌ খুশি হবে মনে মনে ভাবলাম। দামী কলম, ভাল বই নাকি অন্য কিছু?

একদিন দিন মৌ-কে একটা ভাব সম্প্রসারণ বোঝাচ্ছি
> ‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে'<
মৌ তন্ময় হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছে, দেখলাম।
বোঝানো শেষ করে, ওর কাছে জানতে চাইলাম, বুঝেছ?
ও ঘাড় কাঁৎ করে, বুঝেছে ,সে সন্মতি জানাল । কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
খানিকক্ষণ পরে বলল, স্যার্ কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলব আপনাকে ?
– হ্যাঁ বল
– আপনি কাউকে ভালবাসেন?
– হঠাৎ এ কথা কেন?
– না, এমনিই, আপনি বলুন না।
– না
– কেন?
– কাকে বাসব? তেমন কেউ চোখে পড়েনি এখনও।
মৌ হাসল, লাজুক ভঙ্গীতে।
ওর মনে বোধহয় তখন ভাসছে, মাতৃক্রোড়ে শিশুর ছবি।

“গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল (১৮৮৯-১৯৫৭) (চিলি)
শিল্পীর জন্যে দশ আদেশনামা –

১). তুমি অবশ্যই সুন্দরকে ভালবাসবে;
সুন্দর হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের ওপর ঈশ্বরের ছায়া।
২). ঈশ্বরহীন কোনো শিল্প নেই।
তুমি স্রষ্টাকে ভালো না বাসলেও তাঁর প্রতিরূপ সৃষ্টি করে তাঁর সাক্ষী হতে পারো।
৩). তুমি সুন্দরের স্রষ্টা হবে,
কিন্তু তোমার সৃষ্ট সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ভোগের জন্যে নয়
আত্মার পুষ্টির জন্যে নিবেদিত হোক।
৪). কখনো সুন্দরকে বিলাসিতা ও অহংকারের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করো না,
তাকে বরং আধ্যাত্ম নিবেদনের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করো।
৫). কখনো আনন্দোৎসব বা মেলায় সুন্দরকে খুঁজতে যেও না; সেখানে তোমার শিল্পকেও উৎসর্গ করো না, কারণ সৌন্দর্য কৌমার্যও বটে এবং তাকে আনন্দোৎসব বা মেলায় পাওয়া যায় না।
৬). সুন্দরের উত্থান হবে তোমার অন্তর থেকে সংগীতের রূপ ধরে এবং তুমি তাতে প্রথম পরিশুদ্ধ হবে।
৭). তুমি সুন্দরকে এমনভাবে সৃষ্টি করো তা যেন করুণার প্রতিমূর্তি হয় এবং মানুষের হৃদয়কে সমবেদনায় ভরে দেয়।
৮). মা যেমন নিজের রক্ত থেকে, অন্তর থেকে সন্তানের জন্ম দেয়, তুমিও শিল্পের জন্ম দেবে সেভাবে।
৯). সুন্দরকে ঘুম-পাড়ানো আফিমের মতো নিও না; সুন্দর হবে কড়া মদের মতো, যা তোমাকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করে। তুমি যদি যথার্থ পুরুষ বা যথার্থ নারী হতে ব্যর্থ হও, তুমি শিল্পী হতেও ব্যর্থ হবে।
১০). প্রতিটি সৃজনকর্মের শেষে নিজেকে বিনয়ী করো কারণ তোমার সৃষ্টি কখনো তোমার স্বপ্নের মতো মহৎ নয় এবং তা অবশ্যই ঈশ্বরের সবচেয়ে অসাধারণ স্বপ্ন প্রকৃতির চাইতে নিকৃষ্ট।”

(নয়).

পাখিদের মন
– প্রেমেন্দ্র মিত্র
নির্জন প্রান্তরে ঘুরে হঠাৎ কখন,
হয়তো পেতেও পারি পাখিদের মন।
আর শুধু মাটি নয়, শস্য নয়,
নয় শুধু ভার,
আর-এক বিদ্রোহী ধিক্কার—
পৃথিবী-পরাস্ত-করা উজ্জ্বল উৎক্ষেপ।
আজো এরা মাঠে-ঘাটে মাটি খুঁটে খায়,
মেনে নেয় সব কিছু দায়;
তবু এক সুনীল শপথ
তাদের বুকের রক্ত তপ্ত ক’রে রাখে।
জীবনের বাঁকে-বাঁকে, যত গ্লানি যত কোলাহল
ব্যাধের গুলির মতো বুকে বিঁধে রয়,
সে-উত্তাপে গ’লে গিয়ে হ’য়ে যায় ক্ষয়।
শুধু দুটি তীব্র তীক্ষ্ণ দুঃসাহসী ডানা,
আকাশের মানে না সীমানা।
কোনোদিন এ-হৃদয় হয় যদি একান্ত নির্জন
হয়তো পেতেও পারি পাখিদের মন
—আর এক সূর্য-সচেতন।

প্রথমে কুড়ি বছর বয়সে, মেঘদূত, তারপর বাইশ বছরে জোনাকি, পরে সোনালী বয়স পত্রিকা বের করি চব্বিশ বছর বয়সে।
তারপর যুক্ত হই আবর্তর সাথে পঁচিশ বছর বয়সে। তারপর বের করি বেদব্যাস পত্রিকা ছাব্বিশ বছর বয়সে।
এইভাবে নানা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সে সময়। এ ছাড়া সহযোগী সম্পাদক হিসাবে যুক্ত ছিলাম – অশনি, দেয়া, প্রতিশব্দ, বুলেটিন, ঋক, ইন্দানী প্রভৃতি সব পত্র পত্রিকার সঙ্গে।
সে সময় অনেকগুলো পত্র পত্রিকার নামকরণও আমি নিজেই করেছিলাম। যেমন – মেঘদূত, সোনালী বয়স, বেদব্যাস, প্রতিশব্দ ও বুলেটিন (শৌভিক চক্রবর্তীর) , আবর্ত ( দীপাঞ্জন দ্ত্তর, আগে বের হতো সোনার তরী নামে) , সাহিত্য চিন্তা ( রবীন্দ্রপুরুস্কার প্রাপ্ত কবি কিরণশংকর সেনগুপ্তর, আগে বের হতো উত্তরণ নামে) , ঋক (ব্রজ চট্টোপাধ্যায়ের), ব্যতিরেক ( কেদার ভাদুড়ীর, আগে বের হতো সময়ানুগ নামে দেবকুমার বসুর সঙ্গে,একসঙ্গে বের করতেন। পরে কেদার ভাদুড়ী ‘ব্যতিরেক’ একাই বের করতেন আমার নামকরণে।
এর ফলে সে সময় সাম্প্রতিক বহু লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেই সব লেখা পড়ে ঋদ্ধ হয়েছি অনেক। সেই সব পত্র পত্রিকায় লিখতেন – পেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুশীল রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়,শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপধ্যায় প্রমুখ।

মৌ – এর জন্মদিন খুব ঘটা করেই পালিত হয়েছিল। আমি উপহার দিয়েছিলাম সুনীলদার কবিতার বই
– বন্দী জেগে আছ।
প্রমোটার পিতার কল্যাণে, ছোট আসর বসেছিল ড্রিংস এর তার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে। আমার অফার ছিল। যাইনি সে আসরে।
জন্মদিনের নাচ গান খুব জমে উঠেছে, এমন সময় হঠাৎ মৌ আমার কাছে এসে বলল, কথা আছে, আসুন আমার সাথে ছাদে।
বুকটা দুরদুর করে শঙ্কায় কেঁপে উঠল, কি কথা আবার।
গেলাম ওর পিছে পিছে খোলা ছাদে।
এখানে দাঁড়ান, আমি আসছি।
শাড়িতে খস্ খস্ আওয়াজ তুলে মৌ দ্রুত নীচে নেমে গেল।
মৌ সেদিন শাড়ি পরে ছিল। অন্যদিন সালোয়র কামিজ পরে। শাড়ি পরায় ওকে খুব বড় লাগছিল। যুবতী নারী মনে হচ্ছিল। ওকে ঠিক এখন আমার,ছাত্রী মনে হচ্ছিল না।
মৌ দ্রুত ফিরে এলো। দেখি হাতে একটা জল ভর্তি কাচের জার ও কাচের গ্লাস।
আঁচল সরিয়ে কোমড় থেকে ছোট একটা স্কচের বোতল ( নিব) বের করে বলল, বাবার সামনে খেতে পারেননি জানি। এখানে বসে খান আমি আছি।
আমারও মাথায় আচমকা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল।
বললাম, খেতে পারি।যদি তুমি খাও।
তোমায়ও কিন্তু খেতে হবে।
ও মৃদু আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু আমার জোরের কাছে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারল না।
মৌ নীচে আর একটা গ্লাস আনতে যাচ্ছিল।
আমি ওর হাত চেপে ধরে বললাম, লাগবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।
ভাবলাম, নীচে গ্লাস আনার ছলে গিয়ে যদি আর না ফেরে।
গ্লাসে খানিকটা স্কচ্ ঢেলে জল মিশিয়ে ওকে দিলাম। আর বোতলটায় আমি জল মিশিয়ে নিলাম অনেকটা।
ও গ্লাসে মৃদু চুমুক দিচ্ছিল, আর পারিবারিক নানা গল্প করছিল। কয়েক চুমুকের পর আমারও ধীরে ধীরে মৌতাত জমে উঠছিল।
মৌ কি বলছে সবটা তখন মাথায় ঢুকছিল না, শুনছিলামও না।
মৌ এর স্কচপান করার লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছিল, একেবারে অনভ্যস্থ নয় ও এ’ব্যাপারে।
হঠাৎ কি কথার পর ও বলে উঠল, স্যার আপনাকে আমি খুব ভালবাসি। আগের কথাটা কি বলেছে, খেয়াল করিনি।
নীচ থেকে মৌয়ের মা ডাক দিলেন, মৌ তোমরা খেতে এসো।
মৌ বলল, যাচ্ছি মা।

” পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমেরমত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথমযৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

(দশ).

“ মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে : কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে। ”
– হুমায়ূন আজাদ।

পত্র পত্রিকাগুলো, সেই সময় সম্পাদনের কাজে যুক্ত থাকার ফলে আমার দু ধরণের লাভ হয়েছে। পরোক্ষ ভাবে লাভ আর প্রত্যক্ষ ভাবে লাভ।
পরোক্ষ ভাবে লাভ হয়েছে।
এক.নানা লেখকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটেছে।
দুই.সাম্প্রতিক নানা পত্র পত্রিকা পড়ার প্রয়োজনে অনেক কিছু শেখা হয়েছে।
এই দুই পরোক্ষ লাভ থেকেই প্রত্যক্ষ লাভ ঘটেছে। সে লাভ হল, সাম্প্রতিক কালের ভাল সাহিত্যের সন্ধান পেয়েছি,স্বাদ পেয়েছি তার।
লেখকদের সঙ্গে আলাপচারিতায়,
ভাল ভাল সব লেখা ও লেখকদের কথা জানতে পেরে, সে’গুলো সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করেছি।
নানা পত্র পত্রিকা পড়ে, সেখান থেকেও ভাল লেখার সন্ধান পেয়েছি।
সেগুলো সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করেছি।ফলে ভাল সাহিত্যের বোধ প্রাঞ্জল হয়ে গেছে।
সাহিত্য পড়ার নেশা তখন আমার রক্তে মিশে গেছিল। সারা দিনে একটা ভাল লেখা না পড়তে পারলে, মন খারাপ হয়ে যেত। মনে হত দিনটা নষ্ট হল আজ।
কি না পড়েছি তখন?
রামমোহন, মাইকেল, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্র রচনাবলী ছাড়া,
মায়াকোভক্সি, হো চি মিন, গোর্কি, লূ সুন, চেকভ , মোঁপাসা, ও হেনরী, কামু, জাঁ পল সাত্রে, কাফকা, ভাস্কো পোপা, গীয়াম আপোলিনিয়ার, তাদেউজ রুদেভিজ, ও ল্যাটিন আমেরিকান কবিদের কবিতা ।
বাংলায় পড়তাম জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, অশোকবিজয় রাহা, অরবিন্দগুহ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,তরুণ সান্যাল, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, কৃষ্ণ ধর, সিদ্ধেশ্বর সেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত , আলোক সরকার, শান্তি ঘোষ, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, শান্তি লাহিড়ি, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, মনিভূষণ ভট্টাচার্য, তুলসী মুখোপাধ্যায়, তুষার রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, রত্নেশ্বর হাজরা, মৃণাল বসু চৌধুরী , মানিক চক্রবর্তী দেবাশিস বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ।

মৌ এর জন্মদিনের পর,দুদিন পেরিয়ে গেছে আমার আর যাওয়া হয়নি ওদের বাড়ি । শনিবার ও রবিবার ছিল। পড়াতে যাওয়ার কথা ছিল না।
সোমবার সকালে গিয়ে হাজির হলাম।
দরজা খুলে, একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মৌ বলল, আসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম।
আমি ভিতরে ঢুকে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, কি ভাবছিলে?
– বলব কেন?
– বেশ,বোলো না।
_ বাব্বা, বাবুর আবার রাগ হল।
যে মৌ দুদিন আগে বোবা ছিল। সে যেন এখন কেমন মুখরা হয়ে উঠেছে।
আজ আচমকা মৌ যেন প্রস্ফূটিত হয়ে পড়েছে কথায় কথায়।
পড়াতে বসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার টেষ্ট পরীক্ষা কবে?
– দু মাস বাকী।
স্যার, আপনার কে কে আছেন?
– কেন বল তো?
মৌ কোন উত্তর না দিয়ে, এমন ভাবে হাসল, তাতে যেন সব কিছুই প্রকাশ পেল আবছায়া ভাবে।
একটু পরে বলল, আস্তে স্বরে, বাহ্ জানতে হবে না?
– কেন? তাদের দিয়ে কি করবে তুমি? ভালবাসবে নাকি ?
– তা তো বাসতেই হবে।
মৌ নিঃশব্দে, চোখ রেখে চোখে রহস্যময়ভাবে হাসল।
-কেন?
-সে আপনি বুঝবেন না।

সেদিন, এসব অবান্তর কথায় সময় ফুরিয়ে গেল।আসল কাজ পড়াশুনা কিছুই হল না।
আমি ফিরবার সময় বললাম, টেষ্টের মাত্র দু’মাস বাকী। এখন মন দিয়ে পড়াশুনার সঙ্গে একটু প্রেম কর। পরে কারও সঙ্গে করার অনেক সময় ও সুযোগ পাবে।
ও আমার কথা শুনে এমন উচ্ছ্বল ভাবে হাসল যে ওর দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।
বলল, সত্যি বলছেন তো?
আগে কখনও ওর গজদাঁতটা চোখে পড়েনি। আজ প্রথম দেখলাম, ওর মুখে একটা গজ দাঁত আছে।
মৌ বলল,কি দেখছেন অমন ভাবে?
আমি বললাম, বলব কেন?
মৌ বলল, বেশ আর বলতে হবে না, আমি শুনতে চাই না।

” বুকের মধ্যে বাহান্নটা আলমারি
পূর্ণেন্দু পত্রী
——————–
বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি,
যা আকাশময় সোনালী ডানার ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ,
যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার ঢেউ
সেই সব স্পর্ম,
যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।

যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।

নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধকার খুপরীর থাকে-থাকে,
খাজে-খাজে বুকের মধ্যে।

( বুকের মধ্যে বাহান্নটা আলমারি )”

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress