শনিগ্রহ (সাহিত্যরসে আকাশ-বিজ্ঞান ও পুরাণ)
সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে এক বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে শনি গ্রহ, যাকে ঘিরে আছে এক মনমোহিনী বলয়। রঙও তার বিচিত্র নানা দিক ও সময়ের তারতম্যে। বিজ্ঞানলব্ধ ও প্রতিষ্ঠিত শনির রঙের প্রাধান্য পেয়েছে গাঢ় সুন্দর স্বচ্ছ নীল রঙের “নীলা”র এক প্রতীকে, আমাদের জ্যোতিষশাস্ত্রে।
আসলে নীলা বা sapphire একটি মিনারেল। রাসায়নিক যৌগ পদার্থ “অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড” নাম “Corundum ” বর্ণহীন জ্বলজ্বলে স্বচ্ছ , আছে নানা গুন অনুযায়ী নানাবিধ নামের স্বভাব চরিত্রের বৈচিত্র্য। এর রাসায়নিক ফর্মুলা, গঠন ইত্যাদিতে না গিয়ে সহজ করে বলি, ভেজালহীন কোরান্ডাম হলো দামী “পোখরাজ” রত্ন। হিরা বাদে অন্যান্য বহুমূল্য দামী রত্ন সমূহেরও (পান্না, চুনী ইত্যাদির) একই ফরমুলা।
পবিত্র কোরান্ডামে, একটু অন্য ধাতুর মিশ্রণ ঘটলেই, তাতে আসে নানা রঙের ছটা।
যেমন নীলাতে নীল রঙের কারণ, অতি স্বল্প পরিমান ধাতু যৌগ আইরণ ও টাইটেনিয়মের উপস্থতি। বিশদে আর যাচ্ছি না, কতটা নীল রঙের গভীরতা হবে,তাও নির্ভর করে ঐ ভেজাল ধাতুর উপর। ঈষৎ হলদে থেকে ময়ুরনীল নীলা জানা আছে, তবে সবচেয়ে দামী হলো cornflower নীল রঙ বিশিষ্ট নীলা।
মূল্য নির্ভর করে, পৃথিবীর মাটিতে উপস্থিতির পরিমাণ কতটা আছে , আর ঊজ্জ্বলতা, কাঠিন্য এবং আলো প্রতিফলনের ক্ষমতার উপর। এই মূল্যবান বিবিধ রত্নগুলি খৃষ্টপূর্ব ৮০০ বছর থেকেই জানা।
আসি দ্বিতীয় বৃহত্তম শনি গ্রহ প্রসঙ্গে আবার —ঘনত্ব কম হলেও বৃহদাকার বলে পৃথিবীর চেয়ে ওজন অনেক প্রায় পঞ্চানব্বই শতাংশ বেশি এই ষষ্ঠ গ্রহ শনির। সূর্যকে প্রদক্ষণ করতে সময় লাগে ২৯ বছর । শনিতে বোঝাই আছে নানা খনিজ পদার্থ , আইরণ , নিকেল, সিলিকন অক্সাইড, সাথে মেটালিক হাইড্রোজেন, তরল হাইড্রোজেন তরল হিলিয়াম ।
আকাশে তার চাঁদ শোভা পায় মোট ৮২, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যেন হাঁফিয়ে উঠেছেন ৫৩ টির অবস্থান ও নামকরণের পর। সবচেয়ে বড়ো চাঁদের নাম ” Titan” , বুধ গ্রহের চেয়েও বড়ো আর অনেকটা পৃথিবীর মতো আবহাওয়া। চাঁদ গুলি ছাড়া আবার আছে এক বলয়, যাতে ঠাসা আছে বরফ, ধুলো আর পাথর — সূর্য রশ্মিতে ঝরে পরে তার ঝলসে ওঠা রূপ ওখানেও আছে আবার একশ খানেক আলো ঝলকানো চাঁদ। পাথর ধুলোর বরফের বলয় শনির রূপের এক অসামান্য সৌন্দর্যের প্রতীক— না — নেই , এমনটি আর , কোথাও নেই। সৌরজগতে শনিকে বলা হয়– A Jewel, এক রত্ন।
অনেক কথা বলার অপেক্ষা রাখে , শুধু আরও একটি প্রধান কথা হলো—না, প্রাণের কোন অস্তিত্ব সেখানে কিছু নেই।
ইংরেজী “Saturn” নামকরণ হলো শনির রোমান ও গ্রীক দেবতা, “Saturnus” ল্যাটিন শব্দ থেকেই। এ দেবতা অতি বলিষ্ঠ এক পুরুষ এবংJupitar এর সে পিতা। তিনি সময় ইঙ্গিতবাহী এবং বয়স মাত্রায় অতি বলিষ্ঠ। তিনি কৃষিকর্মেরও দেবতা । নিজস্ব পাখা আছে বিচরণের জন্য। হিন্দু পুরাণেও শনি এক সুন্দর শক্তিমান এক পুরুষের প্রতীক, “শনিশ্চর” (যিনি ধীরে চলেন) নামেও পরিচিত, দেবতা। তার দুই স্ত্রী, নীলা এবং মান্দা বা ধামিনী। নীলা শনিদেবের নীলকান্তমণির চিহ্নস্বরূপ। তিনি শনিদেবের প্রিয় ও ঐশ্বর্য বৃদ্ধির সহায়ক। তাদের পুত্র। ঋসি “কুলিগ্না”। দ্বিতীয় স্ত্রী মান্দা গন্ধর্বরাজ কন্যা, নৃত্য পটিয়সী তিনি কলার দেবী। ধামিনী নামে অধিক পরিচিত, পুত্রের নাম “মান্দী”।
পুত্র কামনায় মান্দা যখন প্রথম শনিদেবের কাছে গিয়েছিলেন, শনিদেব তখন কৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, পতিদেবের কাছ থেকে উপেক্ষিত মান্দা অভিশাপ দেন, “তোমার দৃষ্টি যার উপর পড়বে, তার সর্বনাশ হবে।” এইজন্য শনিদেবের সুদৃষ্টি কুদৃষ্টি দুইই আছে। মান্দা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নৃত্যে সকলকেই মোহিত করতে পারতেন। তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী, শনিদেবের ঐশ্বর্যের রক্ষাকর্ত্রী।
শনিদেবের চার হাত –এক হাতে গদা বা তির- ধনুক অন্যান্য হাতে তরবারি,ত্রিশুল ও অভয়। ঐশ্বর্যের প্রতীক, কিন্ত বিলাস বৈভবের জন্য নয় আর বিচারযোগ্যতা ও সুধর্মকর্মের প্রতিফলনরূপ দেবতা তিনি। স্বভাবতই জ্যোতিষশাস্ত্রে আছে শনির প্রতীক পাথর ধারণের বিষয়ে নানা বিচার বিবেচনা।তাদের মতে শনি উগ্রদেবতা, বক্রদৃষ্টির প্রভাবও উল্লেখ্য। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের এই শনি দেবতার বাহন হলো “বায়স” অর্থাত “কাক” মতান্তরে “শকুন”। শকুনকে সুশ্রীরূপ করলেও, গলার পালকহীনতা যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। বায়সকেও যথাসম্ভব আভিজাত্যে চিহ্নিত করা অন্তত চক্ষুপীড়ার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই কি? যেমন ছবি সব কল্পনায় সৃষ্ট। শুধুচোখে শনিকে দেখায় আর পাঁচটা গ্রহের মতোই স্থির আলোর নক্ষত্রসমান , কোন বৈশিষ্ট্য কিন্তু ধরা পড়ে না। অথচ কত না রহস্য এই গ্রহটিকে ঘিরে!!!