সঞ্চয়িতা
জয়গোপালের সঙ্গে আমার পরিচয় সে প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল। এই পাঁচ বছরে অনেক। দেখেছি এবং জয়গোপাল সম্পর্কে আমার ভীতি ক্রমশ বেড়ে গেছে। আসলে জয়গোপাল ভারি অমায়িক, নিরীহ ছেলে, কোনও দোষ নেই, বিনয়ী, বিদ্বান, মিতব্যয়ী।
কিন্তু জয়গোপালের এই শেষ গুণটি, এই মিতব্যয়িতাই আমার পক্ষে মর্মান্তিক। তখন প্রথম আলাপ, একদিন শীতের দুপুরবেলায় জয়গোপালের সঙ্গে দেখা। জয়গোপাল মৃদু হেসে এগিয়ে এল, এই যে, কী খবর? এসো এই পার্কে বসে একটু গল্প করা যাক। ভাল কথা, ফ্রুট খাবে, শীতের দিনে ফ্রুট খাওয়া ভাল।
জয়গোপাল দুই পয়সার টোপাকুল কিনে নিয়ে এল।
দুজনে পার্কে ঘাসের উপর বসে আছি। কথাবার্তা বলছি, এমন সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে জয়গোপাল পকেট থেকে একটা ডায়েরি বার করে খুটখুট করে লিখে আবার ভাঁজ করে রাখল। আমার কেমন কৌতূহল হল। প্রশ্ন করলাম কী ব্যাপার?
মৃদু হেসে জয়গোপাল জানাল, না, কিছু না।
অনেক দিন পরে জয়গোপালের বাড়িতে একটা অন্যায় কাজ করেছিলাম। টেবিলের ওপর ডায়েরিটা রয়েছে, সে স্নান করতে গেছে। ডায়েরিটা খুলে দেখলাম ওই তারিখে লেখা রয়েছে, দুপুরবেলা–চ্যারিটি–দু পয়সা। টোপাকুল সাতাশটা। আমি আঠারোটা, অমুক নটা।
এই রকম ছোট-বড় খরচের খতিয়ান পাতায় পাতায়, সকালবেলা জিলিপি দু আনা, আমি তিন, বলরাম এক। এমনকী দৈনিক কটা করে কঁচালঙ্কা খরচ হচ্ছে তার হিসেব, গুনে দেখলাম পাঁচ-ছয় দিন যোগ করে যেই পঁচিশটা হচ্ছে, তার পাশে লেখা আনুমানিক এক ছটাক, এক আনা।
আর বেশি দেখার সুযোগ পেলাম না, জয়গোপাল স্নান সেরে ফিরে এল। খালি গায়ে। গলায় পইতে, তাতে অনেগুলো বিরাট বিরাট চাবি ঝুলছে। আমি বললুম, তোমরা বামুন তা তো জানতাম না! বসু কি বামুন হয়?
না, না, সেজন্যে পইতে নয়। এই চাবি ঝোলানোর খুব সুবিধে হয় কিনা তাই আমি পইতে ব্যবহার করি, আসলে আমার পইতে-টইতে কিছুই হয়নি। জয়গোপাল ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল আমাকে।
জয়গোপাল চাকরকে ডেকে চা করতে বলল। চাকর চায়ের জল চাপিয়ে এসে আবার দাঁড়াল।
কী চাই? জয়গোপাল জিজ্ঞেস করল।
চা! চাকরটা জানাল।
হ্যাঁ। বলে জয়গোপাল ওদের পুরানো আমলের ভারি লোহার সিন্দুকটা খুলে ফেলল। তারপর আমাকে ডাকল, এই ডালাটা একটু তুলে ধরো তো।
ডালাটা তুলে ধরলাম, সিন্দুকের মধ্যে শুধু কৌটো ছোট-বড় নানা আকারের। সবগুলোর গায়ে লেবেল মারা,-চা, হলুদ, ছোলার ডাল! যাবতীয় জিনিস সিন্দুকের মধ্যে। জয়গোপাল চায়ের কৌটো বার করে মেপে দু চামচ চা দিল চাকরের হাতে। তারপর আবার খুব যত্নে সিন্দুক বন্ধ করল।
আমি ঘরে ঘণ্টা-দেড়েক ছিলাম। এর মধ্যে আমাকে বার সাতেক সিন্দুকের ডালা ওঠানো নামানোয় সাহায্য করতে হল। কনুইয়ের থেকে কবজি পর্যন্ত আর ঘাড়ের দু পাশে পিঠ দিয়ে ঘুরে বুক পর্যন্ত রীতিমতো ফুলে গেল।
পরে শুনেছিলাম জয়গোপালের মতো নিরীহ, অমায়িক ছেলে বহুবার প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে শুধু এই একই কারণে। একবার মল্লিকমশায় দুহাতে প্লাস্টার করা একটি মেয়েকে রাস্তায় দেখিয়ে আমাকে বলেছিলেন, জয়গোপালের সদ্য প্রাক্তন প্রেমিকা। কাল চার ঘণ্টা জয়গোপালের বাড়িতে গল্প করেছে। আমি কিন্তু অবিশ্বাস করতে পারিনি।
আমি মল্লিকমশায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জয়গোপালকে চিনলেন কী করে?
জয়গোপালকে চিনব না! মল্লিকমশায় বললেন, আমার পিসেমশায়ের বাবাকে ওর ছোট ঠাকুরদা খুব ভালবাসতেন। মরার সময় বলে গিয়েছিলেন, তোকে এমন জিনিস দিয়ে গেলাম তিন পুরুষ বসে খাবি। উইলে দেখা গেল পিসেমশায়ের বাবার নামে একটা কাঁঠাল কাঠের পিড়ি।
সব কৃপণ ব্যক্তিকে নিয়েই এ ধরনের গল্প থাকে। মল্লিকমশায়ের গল্পও হয়তো তাই। কিন্তু জয়গোপাল সম্পর্কে আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল, এ গল্প শোনারও অনেক পরে।
ভীষণ বৃষ্টি নেমেছে। রাত দশটা বাজে প্রায়। জয়গোপালদের বাড়ির গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে আছি, একটা থামের আড়ালে, এমন সময় আরে নক্ষত্রবাবু না! আরে এসো ভেতরে এসো! বাইরে। কী করছ? জয়গোপাল আমাকে জোর করে বাড়ির মধ্যে ঢোকাল, বৃষ্টি তো ছাড়বে না, তুমি এখানেই ডিনার করে যাও।
দিন কয়েক আগে আমার কনুইয়ে একটা ফোঁড়া উঠেছিল, আশঙ্কায় ছিলাম, সিন্দুকের ডালা তুলতে না হয় আবার, তার বদলে ডিনার। ভাবাই যায় না। একসঙ্গে খেতে বসলাম। দু প্লেটে দুটো আটার রুটি, একটা আমার, একটা জয়গোপালের।
তারপরে, খাবে কী দিয়ে? কী দিয়ে খেতে ভালবাসো? গুড় না কাঁচালঙ্কা? জয়গোপালের প্রশ্ন সেই সঙ্গে চাকরের প্রবেশ একটা প্লেটে আধ চামচে পরিমাণ গুড় আর একটা কাঁচা লঙ্কা নিয়ে। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।
জয়গোপাল আমার মনে সঞ্চয়ের কামনা ঢুকিয়েছিল। যখন-তখন দেখা হলেই বলত, কিছু জমছে তো হাতে-নাতে? এখন জমাবার মতো অবস্থা আমার নয়। কিন্তু জয়গোপাল নিজের উদাহরণ দেখাত, ভিখিরিদের উদাহরণ দেখাত। বলতো, সবাই কিছু কিছু জমিয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও জয়গোপাল আমাকে দু-একজন অমিতব্যয়ী লোকের জীবনের করুণ কাহিনি শোনাত। মানিকগঞ্জের গোপাল চৌধুরীর আপন ভাগ্নেকে সে পায়ের জুতো বেচতে দেখেছে। ভেড়ামারার কোনও এক জমিদারি সেরেস্তার নায়েব ছিল জয়গোপালের কোনও এক বন্ধুর বাবা, তার প্রসঙ্গও মধ্যে মধ্যে আসত। প্রচুর উপার্জন করতেন ভদ্রলোক কিন্তু নিমপাতা সেদ্ধ আর ডাল ভাত ছাড়া কিছুই খেতেন না। আর সেই নিমপাতাও কিনতে হত না। তার সেই কাছারিঘরের সামনেই ছিল বিরাট একজোড়া নিমগাছ। জয়গোপাল এই কাহিনি বলাকালে একাধিকবার সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলত।
মল্লিকমশায় এসব কথা শুনে বিশেষ উত্তেজিত হয়ে যেতেন, আমাকে আলাদা পেলেই বললেন, ডুববেন মশায়, জয়গোপাল আপনাকে পথে বসিয়ে ছাড়বে। ওই একটা থার্ড ক্লাস কৃপণের সঙ্গে মেলামেশা করতে আপনার ঘেন্না হওয়া উচিত মশায়।
কৃপণের এই শ্রেণী বিভাগ বিষয়ে মল্লিকমশায়ের একটা থিয়োরি ছিল। সব কৃপণই যাতায়াতের পয়সা বাঁচানোর জন্যে গাড়িতে না উঠে গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়ে যায়। যারা ট্যাক্সির পিছনে দৌড়োয় তারা ফার্স্ট ক্লাস। এরই মধ্যে বড় ট্যাক্সি ছাড়া আর কিছুর পিছেই দৌড়ায় না এই ধরনের অভিজাত প্রথম শ্রেণীও একটা আছে। (প্রসঙ্গত সেই সময়ে কলকাতায় বড়-ছোট দুই রকম ট্যাক্সি ছিল দুই রকম ভাড়ার।) কিছু কিছু আয়েসি কৃপণ ফিটন, রিকশা এই সব শ্লথগতি যানের পিছনে। দৌড়ায়, তাদের পয়সা বাঁচানোর খুব ইচ্ছে–কিন্তু শারীরিক সামর্থ্যের অভাব। এরা দ্বিতীয় শ্রেণীর। তৃতীয় শ্রেণীর কৃপণেরা ট্রাম-বাসের পিছনে দৌড়ায়। ট্যাক্সি কিংবা ফিটনের পিছনে দৌড়ে বেশি টাকা বাঁচানোর মতো মনের প্রসারতা বা উদারতা এদের নেই। ট্রামের কিংবা বাসের পিছনে দৌড়ে দু-চার পয়সা বাঁচাতেই এদের যা আনন্দ। জয়গোপাল এই শ্রেণীর। তাও নিকৃষ্ট পর্যায়ের। এর মানসিকতা দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রামের পিছে দৌড়ানোর। ফার্স্ট ক্লাস ভাবতেও ওর বুক কেঁপে ওঠে।
মল্লিকমশায় আমাকে গালাগাল করতেন, আরে দৌড়াবেনই যখন বড় ট্যাক্সির পিছনে দৌড়ে পাঁচ টাকা বাঁচবে, আমার পিছনে দৌড়ান, তা নয়, সেকেণ্ড ক্লাস ট্রাম, ওই জয়গোপালের পিছনে দৌড়চ্ছেন! এই সব বলে তারপর আমাকে বলতেন, নিন এবার এক প্যাকেট সিগারেট কিনুন। সঞ্চয়ের বিষয়টা একবার পার্কে বসে স্থিরমস্তিষ্কে ভাবতে হচ্ছে।
একদিকে জয়গোপাল অন্যদিকে মল্লিকমশায়, সঞ্চয়ের বাসনা আমার প্রবল হয়ে উঠল। কাউকে কিছু না জানিয়েই গোপনে গোপনে একদিন ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলাম। অ্যাকাউন্ট খোলা খুবই সোজা, শুধু যদি আপনার এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় থাকে যার ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে। আমি অনেক ভাবলাম কিন্তু এমন একজনের কথা ভাবতে পারলাম না আমার চেনালোকের মধ্যে যার ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে, বাধ্য হয়ে আবার জয়গোপালের শরণাপন্ন হতে হল। কিন্তু। আশ্চর্য, জয়গোপালেরও কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। সে দেখলাম একটা সঞ্চয়িতার মলাটের মধ্যে টাকা রাখে। সঞ্চয় করার জন্যেই তো সঞ্চয়িতা, এর মধ্যে বাবা টাকা জমাতেন, আমিও জমাই, এই কাপড়ের মলাট একটু ব্লেড দিয়ে চিরে ভেতরে ঢুকিয়ে রাখবে, একেক দিকের মলাটে পঞ্চাশটা করে দশ টাকার নোট, দুদিকের মলাট ভরে গেলে পুরো হাজার টাকা। জয়গোপাল নিশ্চয় আমাকে খুব বিশ্বাসী বলে ধরে নিয়েছিল। মাথার কাছে কালো শক্ত কাঠের আলমারি খুলে দেখাল, প্রায় তিন-চারশো সঞ্চয়িতা তাকে তাকে যত্ন করে সাজানো।
জয়গোপালের ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম মল্লিকমশায়ের বাড়িতে। মজুমদারসাহেবও রয়েছেন। মল্লিকমশায় খুব হাসলেন, ও, ব্যাঙ্কে টাকা রাখবেন বুঝি! পরে তুলতে চান তো, বিপদ আপদে পড়লে টাকাটা আপনি তুলতে চাইবেন তো।
মল্লিকমশায়ের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, সে কে না চাইবে। আমার টাকা আমার প্রয়োজনে আমি তুলব।
এক টুকরো সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে মল্লিকমশায় বললেন, আপনার নাম লিখুন তো এখানে।
নাম লেখা হল। কিন্তু মল্লিকমশায় প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে অন্য এক সরসতর আলোচনায় মনোনিবেশ করলেন। ঘণ্টাখানেক পরে আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, তা আপনারও কি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই?
আমার আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়। আপনার থাকবে কিনা সেটাই বড় কথা। নিন নিজের নাম লিখুন। মল্লিকমশায় তখন হাকিমি পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন। কণ্ঠস্বরে আদেশের ভাব দেখলাম।
তবু আমি বললাম, একবার তো সই করলাম! আবার কেন?
আরে মশায় বলছি করুন। এইবার আবার সই করার পরে মল্লিকমশায় আমার সই দুটো মজুমদারসাহেবের হাত দিয়ে বললেন, দেখুন তো, এ দুটো একই হাতে লেখা কিনা?
মজুমদারসাহেব বললেন, অসম্ভব মশায়! একই চেহারার যেমন দুজন লোক হয় না, তেমনই একই রকম সই একই নোক দুবার করতে পারে না। যতই চেষ্টা করুন কিছুতেই মিলবে না।
এবার আমি নিজের সইদুটোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। একেবারে দুরকম। কোনও মিল নেই। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, টাকা জমা দিলে আর রক্ষা নেই। সই মিলবে না, টাকাও উঠানো যাবে না।
কিন্তু অনেক লোকে তো ওঠায়?
এর পরেও আমি কী করে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে সক্ষম হয়েছিলাম, সে রহস্য আমি নিজেও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝে উঠতে পারিনি, সে বিষয়ে কোনও আলোচনায় প্রবেশ করা আমার পক্ষে খুব সম্মানজনক হবে না।
মল্লিকমশায় যা বলেছিলেন, তা কিন্তু মিলল না। ব্যাঙ্ক আমার চেক অনেক সময়েই ফেরত দিয়ে দিত বটে কিন্তু আমার সই মিলছে না বলে নয়, একেবারে অন্য এক সামান্য কারণে, অ্যাকাউন্টে টাকা নেই বলে। এত কম টাকা তুলতুম একেকবারে যে সই মেলানোর প্রশ্নই বোধহয় উঠত না।
এইভাবে কিছুদিন চলল। তারপর একদিন ধীরে ধীরে কী করে আমার ব্যাঙ্ক-উৎসাহে ভাটা লাগল, টাকা জমা দেওয়া বহুদিন বন্ধ। একাধিকবার টাকা তুলতে গিয়ে জানলাম আর টাকা তোলা যাবে না, তুলতে গেলে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে তুলতে হবে। ইচ্ছার অভাবে এবং বিশেষত অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার নানা কাল্পনিক হাঙ্গামার কথা ভেবে কিছু আর করলাম না। ব্যাঙ্কে আমারও একটা অ্যাকাউন্ট আছে, আমার নিজের নামে পাশবই, চেকবই আছে, আমার কুৎসিত স্বাক্ষর কোনও এক লাল চামড়া দিয়ে বাঁধানো মোটা দামি লেজার-খাতায় অসংখ্য ধনী লোকদের স্বাক্ষরের সঙ্গে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে, আমার জীবনের এই গৌরবময় দিকটা পর্যন্ত কী অনায়াসে অবহেলা করলাম।
ভুলেই গিয়েছিলাম বলা উচিত। হঠাৎ ছয় বছর পরে সেদিন ব্যাঙ্ক থেকে একটা চিঠি এসে। উপস্থিত, পঙ্গু তর্জমায় চিঠিটা এইরকম দাঁড়াতে পারে–
প্রিয় মহাশয়,
আমাদের ব্যাঙ্কে ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাস হইতে আপনার অ্যাকাউন্টে আর কোনও কাজকারবার হয় নাই। শেষ কারবারের তারিখে আপনার জমা টাকার পরিমাণ ছিল একুশ টাকা বাষট্টি নয়া পয়সা।
আমাদের ব্যাঙ্ক আইনের ১৭(২) (খ) সূত্রের পঞ্চম উপসূত্র অনুযায়ী অ্যাকাউন্টে পঁচিশ টাকার কম জমা থাকিলে প্রতি অর্ধ বৎসরে দেড় টাকা করিয়া কাটিয়া লওয়া হয়। তদুপরি উক্ত আইনের ২৯(৩) (চ) সূত্রের বিশেষ উপসূত্র অনুযায়ী যেহেতু আপনাকে চেকবই দেওয়া হইয়াছিল এবং উক্ত আইনের ২৯ (৩) (ঝ) সূত্রের দণ্ডাদেশ অনুযায়ী যেহেতু আপনার গচ্ছিত অর্থ একশত টাকার কম ছিল, প্রতি মাসে পঁচিশ নয়া পয়সা হিসাবে আপনার হিসাব হইতে কাটিতব্য।
এমতাবস্থায় আপনার একুশ টাকা বাষট্টি নয়া পয়সা কাটিয়া আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হইল বলিয়া আপনাকে নিবেদন করা যাইতেছে।
ইতি ২২।৫৬৩
আপনার বিশ্বস্ত
অস্পষ্ট স্বাক্ষর
এমন নিদারুণ নির্মম চিঠি জীবনে আমি খুব বেশি পাইনি। সারাদিন ধরে মাথা ঘুরতে লাগল। একুশ টাকা–একুশ-বাষট্টি-টাকা-নয়া পয়সা, রাতে ভাল করে ঘুম হল না। শেষরাতে ভাল করে স্নান করলুম, তারপর এক কাপ চা খেয়ে ব্যাঙ্কের এজেন্টকে চিঠি লিখলাম–
প্রিয় মহাশয়,
আপনার অমুক তারিখের পত্রের জন্য ধন্যবাদ। আমার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হইয়াছে তাহা আমাকে জানাইয়া সদাশয়তার পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু এই বিষয়ে আমার একটি বক্তব্য আছে।
১৯৫৭ সালের নভেম্বর হইতে এ পর্যন্ত চৌদ্দটি অর্থ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে, প্রতি ছয় মাসে যদি দেড় টাকা হয় তবে তাহাতে একুশ টাকা কাটা যাইবে। তদুপরি এই ঊনআশি মাসে পঁচিশ নয়া পয়সা করিয়া (চেকবই রাখা বাবদ) উনিশ টাকা পঁচাত্তর নয়া পয়সা আমার নিকট আপনাদের প্রাপ্য। অর্থাৎ মোট চল্লিশ টাকা পঁচাত্তর নয়া পয়সা আপনারা এখন পর্যন্ত আমার কাছে পাইবেন। ইহার পরিবর্তে আমার একুশ টাকা বাষট্টি নয়া পয়সা আপনারা কাটিয়াছেন।
আমি সৎ ব্যক্তি, এইরূপ হিসাবে উনিশ টাকা তেরো নয়া পয়সা আপনাদের ক্ষতি হইতেছে। আমি ইহা হইতে দিতে চাহি না।
আমি আপনাদের ব্যাঙ্ককে আমার নিকটে একটি অ্যাকাউন্ট খুলিতে বলি। আপনাদের কোনও টাকা পয়সা জমা দিতে হইবে না, এই উনিশ টাকা তেরো নয়া পয়সা জমা থাকিলেই চলিবে, তবে চেকবই দিতে পারিব না। আর যেহেতু আপনাদের জমা পঁচিশ টাকার কম, আপনাদেরই আইন অনুযায়ী প্রতি ছয় মাসে দেড় টাকা করিয়া কাটিব। এইরূপে আগামী চৌদ্দো বৎসরে আপনাদের বেয়াল্লিশ টাকা কাটা যাইবে, অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে আপনাদের নিকট হইতে আমি আমার প্রাপ্য অর্থ লইয়া আসিব।
আশা করি, এই আইনসম্মত ব্যবস্থায় আপনাদের কোনওই অসুবিধা হইবে।
ইতি
ভবদীয়