Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাজাহানের জতুগৃহ || Sanjib Chattopadhyay

সাজাহানের জতুগৃহ || Sanjib Chattopadhyay

অক্ষয়চন্দ্র মেমোরিয়াল হাসপাতাল

অক্ষয়চন্দ্র মেমোরিয়াল হাসপাতালের চোদ্দো নম্বর বেডে আমার মা শুয়ে আছেন। মাথায় পুরু ব্যান্ডেজ। কপাল ঢেকে আছে। চোখ দুটো আধবোজা। বিছানার পাশে একটা লম্বা স্ট্যান্ডে বোতল ঝুলছে। বোতল থেকে একটা স্বচ্ছ নল ওপর হাতের শিরায় গিয়ে ঢুকেছে। এই আমার মা। আমার মা, আমার ছোট বোন শিখার মা।

আমরা নয়নজুলির তিনতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ির ওপরের ফ্ল্যাটে থাকি। আমরা দুই ভাই বোন, মা আর বাবা। বাবার কথা আমার লিখতে ইচ্ছে করে না। আমার বাবা অতি খারাপ লোক। খারাপ ছেলের কথা অনেক শুনেছি, খারাপ বাবা এই প্রথম দেখলুম। মা যে এমন একটা মানুষকে কেন বিয়ে করেছিলেন কে জানে? অবশ্য বাবা-মার বিয়ের ওপর ছেলেদের কোনও হাত থাকে না। বিয়ের পরই তারা বাবা-মা হন।

আমার বয়েস সতেরো। আমার বোনের বয়েস তেরো।

মা তার বাঁ-হাতটা অল্প একটু তুললেন। বুঝলাম আমি যে এসেছি তিনি দেখতে পেয়েছেন। বিছানার পাশে একটা ছোট টুল। আমি সেই টুলে বসলাম। আমি মায়ের জন্যে কিছু আনতে পারিনি। কারণ আমার কাছে হাসপাতালে আসা আর যাওয়ার পথখরচ ছাড়া আর কিছু ছিল না। বাজারে এখন আপেলের দাম আট টাকা কেজি। একটা মুসম্বি প্রায় এক টাকা দাম। পঞ্চাশ পয়সার কম দামের যে সন্দেশ তা ছুন্নিগুলির মতো এবং অখাদ্য।

মা ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, “তোরা কেমন আছিস?”

বললুম, ভালো। কিন্তু আমরা মোটেই ভালো নেই। এই পৃথিবীতে একা-একা থাকতে কার ভালো লাগে। অনেক বইয়ে পড়েছি, জীবন একটা সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম যে এই সংগ্রাম, কে জানত।

মা আবার ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, বাবা ফিরেছে?

বাবার কথা শুনে কেমন একটা ঘৃণা হল। এমন মানুষের ফেরা আর না ফেরা!

না ফেরেননি। তুমি কি মনে করো ফিরে আসবেন?

আমার প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। মা চুপ করে গেলেন। বোতল থেকে কী একটা জল টিপটিপ করে নলে পড়ছে। নল থেকে মায়ের শরীরে।

শিখা কী করছে রে?

শিখাকে নীচের ফ্ল্যাটের মাসিমার কাছে রেখে এসেছি।

আজ তোরা কী খেলি?

চিনি আর পাউরুটি।

মা আবার আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। চোখের কোণে দু-ফেঁটা জল নামল।

দূর থেকে জুতোর শব্দ তুলে নার্স হেঁটে আসছেন। সাদা ধবধবে পোশাক। পৃথিবীটা এত ভালো তবু কত খারাপ!

তোমার মাকে আর বকিও না, এবার উঠে পড়ো। আবার কাল।

সিস্টার বোতলটা একবার কঁকিয়ে দিলেন। মায়ের মাথার ব্যান্ডেজটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এমন রোগী, এমন বিপদ এঁরা সারাদিনে কত দেখছেন। মনে সব সয়ে গেছে।

উঠতে যাচ্ছি, মা আবার বাঁ-হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। নীচু হয়ে মুখটা মায়ের মুখের সামনে নামিয়ে আনলাম। মা ফিসফিস করে বললেন, বিনু তুই আমার কানের দুল দুটো খুলে নিয়ে যা। বেচে কিংবা বাঁধা দিয়ে যেমন করে পারিস কিছু টাকা জোগাড় কর। তা না হলে কী করে চলবে রে।

না মা, ও আমি পারব না। বরং আমার হাতঘড়িটা–।

মায়ের মুখ বড় করুণ হয়ে উঠল। মাকে কী ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল– ঘড়িতে হবে না রে বিনু। কত আর পাবি। অনেক খরচ। তুই খুলে নে বাবা! পরে আবার সব হবে।

মানুষের দিন কি ভালো হয়। আমার এই সতেরো বছরের জীবনে কোনও ভালোই তো দেখিনি। মা-ও বেশ ভালোই জানেন, জীবনে ভালো দিন আর আসবে না। টাকা সত্যিই চাই। আজকের দিন চলে গেলে কাল কী হবে তা কেউ জানে না।

অনেক ভেবে নীচু হয়ে মায়ের কান থেকে একে একে দুল দুটো খুলে নিলুম। মায়ের নিশ্বাস পড়ছে ধীরে-ধীরে। উষ্ণ বাতাসের মতো গায়ে লাগছে। বেশ জ্বর হয়েছে। জীবন যেমন ক্ষয়ে যায় সোনার অলংকারও তেমনি শরীরের স্পর্শ লেগে-লেগে কেমন বিবর্ণ, কেমন ক্ষয়-ক্ষয়া হয়ে যায়। দুল দুটো হাতের তালুতে রাখতেই মনে হল, এ সুখের শরীর থেকে আসেনি, এসেছে দুঃখের ছোঁয়া লাগা, জর্জরিত কোনও শরীর থেকে বিষণ্ণ, ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে। দুল দুটোর দিকে তাকাতেই আমি যেন আমার মায়ের জীবনের অতীত দেখতে পেয়ে গেলুম। যিনি হাসতে চেয়ে কেঁদে গেলেন, যিনি ভালোবাসতে গিয়ে পুড়ে গেলেন। আমার মায়ের কিছু হল না। এ যেন সেই গাড়ি, যার চালক জানে না যে পথে ছুটে চলেছে সেই পথের শেষে বিশাল একটা খাদ। সন্ধে নেমেছে শহরে। আজ বৃহস্পতিবার। রঙ্গমঞ্চে এতক্ষণ আমার বাবা রেশমের পোশাক পরে ফুটলাইটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখে মিহি মদের গন্ধ। তিনি আমার বাবা নন। শাজাহান। একান্নতম রজনির সফল অভিনেতা। মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই দর্শকের প্রশংসার হাততালি।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress