Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বাগত সাতাশি || Sanjib Chattopadhyay

স্বাগত সাতাশি || Sanjib Chattopadhyay

স্বাগত সাতাশি

সুপ্রভাত সাতাশি। গুড মর্নিং। তার আগে দিশি কোম্পানির এক চাকলা কেক খেয়ে নি। পিঠেপুলি তো আর তেমন ধাতে সয় না। বাঙালি প্রথায় একমাত্র মালপো ছাড়া সবই অখাদ্য। চালের ডোর খোলসের ভেতর গুড় দিয়ে চটকানো নারকেলের পুর ঠেসে, তারপর হয় জলে, না হয় দুধে সিদ্ধ করে, ছুঁচোর মতো দেখতে কী একটা তৈরি করা হয়! অপূর্ব! অনবদ্য! ওই বস্তুটিই মনে হয় গীতার আত্মপুরুষ যাকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্ৰানি, নৈনং দগ্ধতি পাবক।’ দাঁতে ফেললেই বোঝা যায়, সহজে কাবু হওয়ার জিনিস নয়। কাবু করার জিনিস। ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই’-এর মতো, যতবার দাঁত বসাতে যাই, নিবে যায় বারে বারের মতো, ফিরে আসে বারেবারে। ছেলেবেলায় ইরেজার খাবার অভিজ্ঞতা। এর নাম পিঠে। পুলি পিঠে না সিদ্ধ পিঠে, কী যেন বলে! এই পিঠে পেটের জিনিস নয় পিঠের জিনিস। সাউথ আফ্রিকা, জাপান প্রভৃতি দেশে জনতা ছত্রভঙ্গ করার জন্যে রাবার বুলেট বন্দুকে পুরে ছোড়া হয়। আমাদের দেশেও গুলি চালিয়ে পুলিপিঠে চালানো যায়। দমাদ্দম পিঠে চালিয়ে রাজভবন কি এসপ্ল্যানেড ইস্ট থেকে জনতা ছত্রভঙ্গ করলে, জনগণেরও কিছু বলার থাকবে না। প্রবাদেই আছে, পেটে খেলে পিঠে সয়। অনেকটা হরির লুটের মতো।

আমাদের ভাষায় যেন বাংলা আর ইংরেজির পাঞ্চ, সেই রকম সংস্কৃতিতেও বাঙালি, বিহারি, ইংরেজি, পাঞ্জাবি, ফরাসি, ফারসি, তুর্কি, মুর্কি, যা পেয়েছি, সব ঢুকিয়ে মানিকপীরের মতো এক আলখাল্লা তৈরি হয়েছে। সাতাশিকে তাই সুপ্রভাত বললে হবে না, গুড মরনিং, রাম রাম, সালাম আলেকম সবই বলতে হবে। কেক, পিঠে, সরুচাকলি, চরণামৃত, বোতলামৃত সব দিয়েই ভজনা করতে হবে।

পিঠে আর পেটো যেমন প্রায় এক হয়ে এসেছে, মালমশলা আর শিল্পনৈপুণ্যে, সেই রকম হয়েছে। কেকের অবস্থা। কেক আর ডাংকেক প্রায় সমান। আগে যে চাল ছিল, সে চাল আর নেই। বাসমতীই আছে তবে মুখে তোলার আগে দম বন্ধ করে তোলাই ভালো। আর মুখে পুরে ফোঁস না করাটাই নিরাপদ, কারণ তাহলেই মনে হবে ধাপায় ডাইনিং টেবিল পেতে লাঞ্চ করছি। এক বড়কর্তাকে জিগ্যেস করেছিলুম, মশাই, ভাত আর ভালুক—একই রকম গন্ধ হল কী করে! কোন কায়দায়? ভালুক বলায় তিনি ভেবেছিলেন আমি বিয়ারের সঙ্গে তুলনা করছি। বললুম, বোতলজাত ভালুক নয়, সেই ভালুক, যা কলকাতার রাস্তায় খেলা দেখায়। তিনি বললেন, ‘কী। জানি মশাই! আমার সাইনাস আছে। সারা বছরই নাক বুজে থাকে।’

যাঁরা প্রবীণ তাঁরা অতীতের স্বর্ণময় দিনের স্মৃতি রোমন্থন করেন। এক আনায় ষোলোটা হিঙের কচুরি। দু-পয়সার মটকির ঘি কিনলে জয়েন্ট ফ্যামিলির সবাই পেট ভরে ফুলকো লুচি খেতে পারতেন। এক পয়সায় দু-হাত মাপের জ্যান্ত রুই। সেই প্রবীণরাই আক্ষেপ করেন, ‘আর পিঠে! সেই পিঠে! আমার পিসিমা করতেন। সে কী ফ্লেভার! দুধ আর নলের গুড়ে ফুটছে, মনে হচ্ছে বাস্তু বেরিয়েছে।’

‘বাস্তু বেরিয়েছে মানে?’

‘হা ভগবান! বাস্তু জানো না! বাস্তু হল বাস্তু সাপ। বাস্তু সাপ। বাস্তু সাপের অপূর্ব সুগন্ধ।’ শহরে আর সাপ কোথায়। ক-জনেরই বা বাস্তুভিটে আছে! আমরা যে সাপ চিনি, তা বেরোয় মানুষের মনের গর্ত থেকে! গন্ধ নেই, ছোবল আছে। তা সেকালের পিঠেতে নাকি চাল আর গুড়ের গুণে মিঠে মিঠে, সোঁদা সোঁদা অদ্ভুত এক গন্ধ বেরোত। একালের চাল তো আর বস্তায় থাকে না, থাকে মানুষের চলনে। সমাজে চালিয়াত চন্দরের অভাব নেই। কেক হল পিঠের মেড-ইজি। চাল। গুঁড়োনোর হাঙ্গামা নেই। নারকেল কোরার ঝামেলা নেই। দোকানে দোকানে রঙিন সেলোফেন মোড়া পিঠ উলটে পড়ে আছে বিলিতি পিঠে।

টোপর ছাড়া বিয়ে হয় না। কেক ছাড়া আজকাল নববর্ষ হয় না। ইংরেজি নববর্ষ। যাকে প্রকৃত কেক বলে, তা তৈরি হয় বড় নামী জায়গায়। দামও সাংঘাতিক। এক টুকরো খাবার পর এক। ঘণ্টা ধ্যানস্থ। বিবেকের সর্পদংশন। পাঁচ-দশ টাকা ভুল হয়ে গেল। আড়াই টাকা দাঁতের খাঁজেই লেগে রইল। আগে ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে দাঁত ফিল করিয়ে দুঃসাহস দেখানো উচিত ছিল। হ্যাপি নিউ ইয়ার করতে গিয়ে সারা মাস ডালভাত! প্রায় মলমাসের মতো অবস্থা।

টুনি-জ্বলা পাড়ার দোকানে যে মাল ‘অ এ অজগর’ হয়ে আছে তার দশা ওই পিঠের মত। আটা চটকানো চিনির ড্যালা। কুমড়োর বরফি যেন কাচ বসানো খাদির ওড়না। পাউরুটির মিষ্টি সংস্করণ। দাঁতে জড়িয়ে যায়। বাটালি দিয়ে দাঁত চাঁছতে হয়। টুথব্রাশের কর্ম নয়। পেটে ঢুকে হামাগুড়ি দেয়। চা পড়া মাত্রই অম্বল। নিউ ইয়ার টকে যায়। অ্যান্টাসিড দিয়ে সামলাতে হয়।

শুরু যদি এই হয়, শেষে কী হবে জানা আছে। কত বছরই তো এইভাবে এল আর গেল। না। বাড়ল ধন-সম্পদ, না বাড়ল মানসম্মান। বাড়ার মধ্যে বাড়ল কেবল বয়স। যুবক থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ। দশ বছর আগে সাইকেল চালক বলত, ‘দাদা সরে, দাদা সরে’, এখন বলে, ‘দাদু সরে, দাদু সরে।’ আগে আমি গুঁতিয়ে বাসে উঠতুম, এখন আমি তো খেয়ে ছিটকে পড়ি। বছর আসে বছর যায়, বুঝতে পারি ভালোবাসা কমছে। বছর আছে, ক্যালেন্ডার আছে, প্রেম। নেই।

ছিয়াশির পয়লা কী হয়েছিল মনে আছে! আমার জন্যে এক টুকরো কেক কেটে ডিশে ফেলে রেখেছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘ইন গুড ফেথ’—সেই পূর্ণ আস্থা নিয়ে মুখে ফেলে দিলুম। জিভ পরোটা। কে জানত পিঁপড়েরাও নববর্ষ করে! হাজার খানেক লাল পিঁপড়ে জড়িয়ে ছিল। মুখে ফেলার সময় এক লহমার দেখায় ভেবেছিলুম কারিকুরি। পোস্তর দানা মাখিয়েছে। প্রথমে জিভটাকে কামড়ে শেষ করে দিলে। একটা বাহিনী টনসিল আক্রমণ করে গলায় বড়ে গোলাম আলির জোয়ারি এনে দিল। বাকি সব স্টম্যাকে ঢুকে সেলাইকল চালাতে লাগল। ডিভিসি-র জল ছাড়ার কায়দায় গলার সুইস গেট খুলে কয়েক গ্যালন চালিয়ে দিলুম। নে সব ডুবে মর। গেরস্তের সে কী হাসি! সবাই বললে, সাঁতার শিখে নে।

সাঁতার তো শেখাবে। কোন সাঁতার? সংসার সমুদ্রে সাঁতার কাটা শেখাবে কি! সেই সাঁতারই আসল সাঁতার। এত চেষ্টা করেও যা শেখা গেল না। টাকার লাইফবোটে চেপে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যায়, সেই টাকাই তো নেই। এখন একটা ষাঁড় খুঁজছি, যার ন্যাজ ধরে বৈতরণীটা অন্তত পার হওয়া যায়! সেটা তো পেরোতে হবে! সাতাশি তো সেই কথাই স্মরণ করাতে চায়। জীবন। তো বালির ঘড়ি। ঝুরঝুর করে ঝরেই চলেছে। এ ঘড়ি গোল হয়ে ঘোরে না। বারোটা-একটা। নেই। সোজা ছুটছে। মানুষের সঞ্চয় কমে এলে ভয় হয়। পুঁজি তো আর বেশি নেই। চেকবই শেষ হয়ে আসছে। এর পর হঠাৎ একদিন সেই লাল স্লিপটা বেরিয়ে পড়বে। সতর্কবাণী—আর মাত্র পাঁচটা আছে। জীবনের বছর এমন ব্যাঙ্কে জমা আছে, যে ব্যাঙ্ক দ্বিতীয় বার আর চেকবই দেয়। না।

ইংরেজিতে বলে, লুক বিফোর ইউ লিপ। ঝাঁপাবার আগে দেখে ঝাঁপাও। বছর এমন এক নদী, সেখানে না দেখেই ঝাঁপাতে গিয়ে ছেলেবেলায় নদীতে প্রথম সাঁতার শেখার কথা মনে পড়ছে। হাফপ্যান্ট পরে কোমরে গামছা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি ঘাটে, আচমকা ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিলেন আমার সাঁতার শিক্ষক। হাবুডুবু। বোয়াল মাছের মতো গ্লাব গ্লাব করে জল খাচ্ছি। একবার ডুবছি, একবার উঠছি। বেঁচে থাকার কী অদম্য ইচ্ছা! যিনি আমাকে হঠাৎ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলেন, তিনিই আবার চুলের কুঁটি ধরে ভাসিয়ে দিলেন। সেই যে ভাসতে শিখলুম জলে, আর ডুবিনি কোনওদিন। সেদিন প্রচণ্ড অভিমানে কেঁদে ফেলেছিলুম। আমার সাঁতার শিক্ষক কাকাকে জিগ্যেস করেছিলুম, ‘কেন আপনি অমন করে ঠেলে ফেলে দিলেন?’ তিনি বলেছিলেন, ‘বোকা। জল না খেলে সাঁতার শিখবি কী করে!’

পুরোনো বছর আমার সেই সাঁতার শিক্ষক, আচমকা ধাক্কা মেরে নতুন বছরের স্রোতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। জলে পড়লে হাত-পা তো ছুঁড়তেই হবে। উপায় নেই। ছিয়াশির মতো সাতাশিতেও হাত-পা ছুড়ব। শীত শীত ভাব কেটে গিয়ে আসবে ক্ষণবসন্ত। কোথাও না কোথাও একটা কোকিল ডাকবেই। এসে যাবে গ্রীষ্ম। গদিতে যাঁরা গদিয়ান, তাঁরা প্রথমে চিকার। করবেন, ‘খরা খরা’ বলে। তারপরই আসবে বন্যা। শুরু হয়ে যাবে বন্যাত্রাণের নাচা-গানা। কলকাতার পুকুর পানিতে নাকানিচোবানি খেতে খেতে আমাদের দাদ, হ্যায়জা, খুজলি হয়ে যাবে। এক্সপার্ট তাঁর মাচা থেকে ওপিনিয়ান ছাড়বেন, কলকাতা হল বাটি, এ বাটিতে জল। জমবেই। কুইন ভিক্টোরিয়া কি জর্জ দি ফিফথের সঙ্গে ওপরে গিয়ে দেখা হলে বোলো, ‘কী প্ল্যান করেছিলেন মশাই! ভূ-গর্ভের নকশাটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি ম্যাডাম। একটা কপি দিতে। পারো! স্বপ্নে প্রশান্ত শূরকে জানিয়ে দাও।’

স্বাগত সাতাশি। যা হওয়ার তা হবে। যা হওয়ার নয়, তা হবে না। এই তো জেনেছি। ময়দানে ফুটবল পড়বে। হয় মোহনবাগান, না হয় ইস্টবেঙ্গল জিতবে। নতুন নতুন ছেলে-মেয়েরা নতুন নতুন প্রেমে পড়বে। কিছু কর্মচারী রিটায়ার করবেন, নতুন কিছু চাকরি পাবেন। পাত্রপাত্রীর কলামে বিজ্ঞাপন হাতড়াবেন ছেলেমেয়ের বাপ। সানাই বাজবে আবার বলহরি-ও হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে হাতাহাতি হবে। কারুর সঙ্গে হলায়-গলায় হবে। কর্তার মেজাজ কখনও চড়বে, কখনও নামবে। গৃহিণী কখনও সরাসরি কথা বলবেন, কখনও দেয়ালে ক্যামেরার আলোর। কায়দায় বাউন্স করিয়ে। সার সত্য—চলছে চলবে। টাকেও চিরুনি চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *