স্বামী-স্ত্রী সংসার
দেখো, বছর পাঁচেক হল আমাদের বিয়ে হয়েছে. প্রশান্ত চায়ের কাপে চুমুক লাগাল। প্রথম চুমুকটা সশব্দে। পরেরটা একটু কম শব্দ। তৃতীয়টা নিঃশব্দে। অর্থাৎ ঘোরতর আবেগ, স্বল্প আবেগ এবং পরিতৃপ্তি। সামনে পোর্সেলিনের প্লেটে ঘিয়ে-ভাজা ফুল ফুল চিঁড়ে, তার ওপর মিহি করে ছড়ানো মরিচের গুড়ো। পাশে আড় করে রাখা ঝকঝকে একটি চামচে।
কাপটা বেশ সন্তর্পণেই নামাতে চেয়েছিল। দূরত্ব আর বেগের হিসেবের সামান্য গোলযোগে সেই ঠকাস শব্দটা হলই হল।
প্রমীলা সামনের সোফায় বসে সোয়েটার বুনছিল। এই বোনার সময় সে গোলমতো অদ্ভুত একটা চশমা পরে। নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখে বিচক্ষণ মোক্তারের মতো। প্রমীলা কোনও কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। প্রশান্ত অপরাধীর মতো মুখ করে বললে, আই অ্যাম সরি। আমি সাবধানেই নামাই, আর তখনই টেবিলটা ওপর দিকে উঠে আসে, এ এক অদ্ভুত ভৌতিক ব্যাপার।
প্রমীলা বোনায় মনোনিবেশ করে বললে, হুঁ, এর দাওয়াই আমার জানা আছে।
এর আবার দাওয়াই কী?
স্টিলের গেলাস। বাহারি কাপ তোমার জন্যে নয়।
প্রশান্ত ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিঁড়ের প্লেটটা যেই তুলতে গেল, চামচেটা পেঁকির মতো উলটে পড়ল মেঝেতে পেতে রাখা কার্পেটে। সঙ্গে কিছু চিঁড়ে। অনেকটা সুন্দরীর মূৰ্ছা যাওয়ার মতো। প্রশান্ত এইবার কাঁচুমাচু মুখে বললে, আই অ্যাম সো সরি।
প্রমীলা বোনাটা পাশে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। প্রশান্তর পায়ের কাছে শয্যাশায়ী চামচে আর ছত্রাকার চিঁড়েভাজার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কোমরে হাত। নাকের ডগায় চশমাটা আরও ঝুলে গেছে। প্রশান্তর কোলেও কিছু চিঁড়ে। প্রশান্ত ফ্যাকাশে মুখে বললে, তুমি
কিছু ভেবো না, আমি একটা একটা করে সব চিঁড়ে তুলে দেব।
চিঁড়ে তো তুলবে, চিঁড়ের সঙ্গে যে মরিচ আর নুন ছিল সব তো ঢুকে গেল কার্পেটে। সে আমিব্রাশ দিয়ে ঘসঘস করে—
কার্পেটটার বারোটা বাজাবে। তোমার যা কালচার, তোমার উচিত রাস্তার রকে বসে মুড়ি তেলেভাজা আর মোটা কাচের গেলাসে চা খাওয়া।
প্রমীলা নীচু হয়ে চামচেটা তুলতে তুলতে বললে, কত কাজ যে বাড়াও। তোমার জন্যে একটা মিনিট শান্তিতে বসার উপায় নেই। বিছানার বেডকভারে কী ফেলেছিলে সকালে?
আমিই-ই!
হ্যাঁ, তুমি।
কই, কিছু না তো!
বিছানায় বসে দাঁত মাজছিলে?
বিছানায় বসে কেউ দাঁত মাজে?
তুমি সব পারো। তোমার তুলনা তুমি। আমাকে গোপালের মা বললে, দাদাবাবু টিভি দেখতে দেখতে মাজনের টিউব টিপছিল। ফটাস করে খানিকটা পড়ল। তার ওপর মাথার বালিশ চাপা দিয়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেল। আমরা সবাই জানি, কোনও একটা অপকর্ম করার পরই তুমি তোমার সেই বিখ্যাত শ্যামাসংগীতটা গাও।
প্রশান্ত বললে, তোমাদের কী হয়েছে জানো? যত দোষ নন্দ ঘোষ।
আজ্ঞে না, আমরা শুধু শুধু লোকের নামে দোষ দিইনা। মানুষের হ্যাবিটস থাকবেই। তোমার সবই ব্যাড হ্যাবিটস। চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়া। দাঁত মাজতে মাজতে টিভি দেখা। শোবার ঘরে চুল আঁচড়ানো। নাকে রুমাল চাপা না দিয়ে হাঁচা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে পাপোশে পানা মোছা। ভিজে তোয়ালে জড়ো করে রাখা। বাথরুমের আলোনা নেবানো। কলের মুখ। ভালো করে না বন্ধ করা। সারারাত ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার শব্দ। ওই দেখো, অফিস থেকে এসে জুতো খুলেছ। যেখানে খুলেছ সেইখানেই পড়ে আছে। মোজা খুলে জুতোর ভেতরে ভালো করে ঢোকাবার ধৈর্যও নেই। একটা বাইরে ঝুলে আছে জুতোর লেজের মতো। তুমি যে জায়গা দিয়ে হেঁটে যাবে সেখানে পাপোশ থাকলে ট্যারাবাঁকা। কার্পেট থাকলে ঢেউ খেলা। চটি থাকলে লাথি মারা। চুল আঁচড়াবে, চিরুনিতে চুল। দাড়ি কামাবে, সাবান মাখানোবুরুশটা পড়েই থাকবে। ডট পেন খুলবে বন্ধ করবে না। জামা খুলবে হ্যাঙারে ঝোলাবে না। বিছানায় শোয়া মাত্রই চাদর-মাদর গুটিয়ে একটা লন্ডভন্ড কাণ্ড। টুথব্রাশ জায়গায় না রেখে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা।
ছেলেবেলায় আমার মা শ্রীকৃষ্ণের শতনাম পড়তেন, এ যেন অনেকটাই সেই রকম। তাহলে শোনো আমি বলব না। দেখাব।
প্রশান্ত উঠে গেল। ফিরে এল একটা কাগজের বাক্স নিয়ে। বাক্সটা সামনের টেবিলে রেখে প্রশান্ত বসল। প্রমীলাকে বললে, তুমিও বোসো।
দুজনে মুখোমুখি। প্রশান্ত একজোড়া কানের টাব বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বললে, এগজিবিট নাম্বার ওয়ান। বাথরুমের জানলার ওপরে অবহেলায় পড়েছিল বোধহয় সাতদিন।
প্রমীলা বললে, অ, এইটা! আমি তো বাথরুমেই রাখি। সেফ জায়গা। খুলি, রাখি, রাখি, খুলি। তোমাকে কে হাত দিতে বলেছিল? চোরের স্বভাব!
মানে? চোরের স্বভাব মানে?
মানে খুব সোজা। সোনার মতো কিছু দেখলেই হাত দেবার ইচ্ছে, সরিয়ে ফেলার ইচ্ছে,
অনেকটা বেড়ালের স্বভাব। যতই খাওয়াও, খোলা মাছ দেখলে টেনে নিয়ে পালাবে। দুধ ঢাকা না দিলে ফিনিশ।
আচ্ছা, এই হল ব্যাখ্যা। তা সাতদিনে একদিনও খোঁজ হল না কেন?
কেন হবে, আমি জানি জায়গার জিনিস জায়গাতে ঠিকই আছে। ওখানেও যে চোখ পড়বে, কে জানত! আমার লাইফটা বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কলেজে তোমাকে বিশ্বাস করেছিলুম। তারপর বিয়ে করলুম, আবিষ্কার করলুম এক বিশ্বাসঘাতককে।
বাঃ কোথা থেকে কোথায় গেলে! আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ব্যাপারটাকে ওই লাইনে, মানে তোমানে লাইনে নিচ্ছি। খালি সাবানদানিতে, অল্প অল্প জলে এই একশো ষাট টাকা জিয়োল মাছ রাখার কায়দায় জিইয়ে রেখেছিলে?
আচ্ছা, এটাকে কেঁপে দেবার তালে ছিলে! তোমার ভয়ে টাকা তো আমাকে ট্যাঁকে নিয়ে ঘুরতে হয়। চান করার সময় রেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া। দেখিনি যখন কেমন করে বলি তুমিই চোর। তবে জানো তো চুরি হলে থানা সবার আগে দাগিদের ধরে এনে পেটায়। আমি তো দারোগা নই। বউ।
তুমি দারোগার বাবা। যবে থেকে ধরেছ, যাবজ্জীবন।
সে তো তোমাদের পুরুষদের লেখা গানেই আছে, লোহারি বাঁধনে বেঁধেছে সংসার। অথচ মেয়ে দেখলেই ম্যাও ম্যাও করবে, নেচে নেচে বিয়ে করবে, আর বছর না ঘুরতেই বয়লারের মতো। মেজাজ, বউগুলো সবব্রয়লার। শেম, শেম। চোখের সামনে তোমার পরিবর্তনটা দেখে অবাক হয়ে যাই। বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে, গোটাকতক প্রেমপত্র আছে। সে কী ভাষা, সে কী কী সম্বোধন! তুমি আমার পোস্টার, তুমি আমার কম্পাস, পেসমেকার, তুমি আমার নয়নতারা, ডাবের জল। তুমি শেষ রাতের পরি, ভোরের আকাশে কুমকুম, সারা রাত নেই ঘুম, নেই ঘুম।
মনে ধরেছিল বলেই মনে আছে। নিজের দোষটা কেউ দেখতে পায় না। কত কত প্রেমের কথা বলতে ইচ্ছে করে, শুরু করলেই বলবে, চুপ চুপ বিয়ে হয়ে গেছে, অশান্তি কোরো না। শান্তিতে ঘুমোও।
জেনারেটার চালানো দেখেছ, মিনি জেনারেটার? একটা ফিতে থাকে। জড়িয়ে নিয়ে মারো টান, জেনারেটার স্টার্ট। ফিতে অপ্রয়োজনীয়, প্রেমপত্র দিয়ে সংসার-জেনারেটার স্টার্ট হয়ে গেছে, এখন আর লেত্তিটা দিয়ে কী হবে।
বাপ রে! কী বিরাট বিরাট জ্ঞানের কথা। আচ্ছা, এই নাও আটটা সেফটিপিন। মুখ খোলা অবস্থায় বাথরুমের বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা। তিনটে চুলের ক্লিপ। এই নাও ব্যাঙ্কের চেক বই, খাটের তলায়। এই নাও তোমার ময়েশ্চারাইজারের ক্যাপ, টেবিলের তলায়। এই নাও চারটে ডট পেন। এই নাও তিনটে নেলকাটার, সাতটা উল বোনার কাঁটা। আর গত তিন বছর ধরে আমার। জন্যে যে সোয়েটারটা বোনার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলে, আপাতত যেটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতো ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে পরিত্যক্ত, এই সেই সোয়েটার। উলের গোলা, কাঁটা এবং একটি তাল। আমাদের ভাটা-পড়া প্রেমের ফলিত রূপ! গলিত রূপ! প্রথম বছরে চড় চড় করে আধহাত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে মাত্র চার ইঞ্চি।
আজ্ঞে না, তোমার ব্যাখ্যা তোমার মতো। আসলে ওই সোয়েটারে ধরা আছে আমাদের পারিবারিক বিপর্যয়। দ্বিতীয় বছরে মা অসুস্থ হলেন। সারাটা বছর যমে-মানুষে টানাটানি। তৃতীয় বছরে মা বিদায় নিলেন। এটা চতুর্থ বছর। মা ছিলেন আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তোমাকে বিয়ে করে। আমি কী পেয়েছি জানি না, তবে মায়ের মতো মা পেয়েছিলুম। ওই শূন্যতা কোনওদিনই আর ভরাট হবে না।
এই তো আসল কথাটি বলে ফেলেছ। টোপ না দিলে মাছ ধরা যায়! দেশলাই কাঠি না থাকলে প্রদীপ জ্বালা যায়! আমি না থাকলে মাকে পেতে বৎস! আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে! আমি হলুম তোমার বিচরণভূমি, শ্রীচরণের তলায় বুক পেতে পড়ে আছি।
ওটা কী হচ্ছে?
কোনটা?
সোফার নতুন কভারে হাত মুছছ কেন?
হাতে কিছু নেই। পরিষ্কার ধবধবে খটখটে।
আমি দেখেছি। চায়ের কাপটা সরালে। আঙুল চটচট করছিল, মুছলে!
তুমি কী বলতে চাইছ, এর ওপর হাত রাখা চলবে না?
অবশ্যই চলবে। তবে কোনও দুরভিসন্ধি থাকলে চলবে না। বাথরুমের ওপাশের জানলার পর্দায় দাড়ি কামাবার সাবানের ফেনা কে মুছেছে! নিশ্চয়ই আমি না।
ওটার ভালো দিন, অর্থনৈতিক দিকটা দেখতে পেলে না। ওখানে আমি সাবান স্টোর করছি। পরদাটা যখন কাচবে তখন আর সাবান মাখাতে হবে না, জলে ডোবাবে, তুলবে, শুকোতে দেবে। আচ্ছা! তুমি রান্না করতে করতে হাত কোথায় মোছ? নিজের শাড়িতে?
আজ্ঞে না। আমার একটা ন্যাপকিন আছে।
পরদাটা আমার ন্যাপকিন।
আর একদিন সাবান মুছে দ্যাখো। ভালো কথায় হবে না।
কী করবে?
যখন করব, তখনই দেখতে পাবে।
বললে সাবধান হব।
তোমার ওই লেসের কাজ করা সাদা পাঞ্জাবিতে মাংসের মশলা মাখিয়ে দোব।
আমিও তোমার চাঁপদানি শাড়িতে আলকাতরা লাগিয়ে দোব।
ওটা চাঁপদানি নয়, জামদানি। এদিকে এসো, ঘুরে দাঁড়াও, কাঁধের মাপ নেব।
যথেষ্ট চওড়া। তিন-তিনবার বাঁক কাঁধে নিয়ে তারকেশ্বর গেছি।
সেই কৃপাতেই আমাকে পেয়েছ।
তা ঠিক। মা চলে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, তুমিই আমার মা, সেই শাসন, সেই স্নেহ।
প্রমীলা এতক্ষণ যে সোয়েটার বুনছিল, সেই সোয়েটারটা কাঁধে ধরে মাপ নিতে নিতে বললে, পারফেক্ট!
প্রশান্ত বললে, এটা আমার জন্য করছ? উলটার কী সুন্দর রং! কী তোমার চয়েস মাইরি!
শীত এসে গেছে বাবা প্রশান্ত। তবে এই রং তোমার জন্য নয়। এই প্যাস্টেল শেড। লাইট কালার। একদিনেই বারোটার জায়গায় আঠারোটা বাজিয়ে দেবে!