জোকার
তার বাপ-মা’র দেওয়া কী নাম ছিল জানি না। তাকে আমরা চিনতুম—পিকক লম্বু বলে। ডাকতুম কখনও পিককদা বলে, কখনও লম্বুদা বলে। পাকানো কঞ্চির মতো লম্বা চেহারা, গায়ের রং। রোদে পুড়ে তামাটে। বুক-খোলা টি-শার্টের ফাঁক দিয়ে দেখা যেত বুকের উপর ঝুলছে অদ্ভুত একটা লকেট। বয়স কত হবে বলা শক্ত। তিরিশও হতে পারে, আবার চল্লিশ হওয়াও অসম্ভব নয়। আসলে এইরকম চেহারার লোকেদের বয়স বলা যায় না।
পিকক লম্বু কোন দেশের মানুষ, তাও বলতে পারব না। তবে বাংলা বেশ চমৎকার বলেন। তাঁর আবির্ভাব হঠাৎ-ই। প্রথমে আমরা লক্ষই করিনি। কিন্তু তাঁর ওপর নজর না দিয়ে আর উপায় ছিল না। প্রথমত, এমন চেহারার মানুষ দেখা যায় না বড় একটা। দ্বিতীয়ত, তাঁর দাড়ি কামানোর ঘটা আর সাজ-সরঞ্জামের বহর।
পথের পাশে একটা রকের উপর বেশ আয়েশ করে বসেছেন। পাশে একটা জরাজীর্ণ কিড ব্যাগ। ছোট্ট একটা তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে জল। হাতে ধরা আরশির একটা ভাঙা টুকরো। দাড়ি কামানোর বুরুশটারও অদ্ভুত ছিরি। টাক পড়ে তার চুল আর অবশিষ্ট কিছু নেই। একটা কেলে হাতলে কয়েক গোছা কোনওরকমে সান্ত্বনার মতো আটকে আছে। সাবান, কাপড় কাচার সাবানের একটা টুকরো।
বৃষ্টি পড়ছিল বলে বাড়ি থেকে বেরুতে পারছিলুম না। সকালবেলাতেই আকাশ ঘনঘটা করে নেমেছে। কখন থামবে কে জানে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে গিয়েই নজর আটকে গেল। বৃষ্টির গুঁড়ি গুঁড়ি ছাটে শরীর ভিজে যাচ্ছে, তবু দাড়ি কামাবার কী কসরত, এক হাতে আরশির টুকরোটা মুখের কাছে ধরে অন্য হাতে দাড়িতে ব্লেডের টান। ব্লেডে বোধ হয় তেমন ধারও নেই। মাঝে মাঝে আরশিটাকে হাঁটুতে ধরে রাখার চেষ্টা, যাতে দুটো হাত দিয়েই দাড়ির সঙ্গে যুদ্ধ করা যায়। মাঝে মাঝে করুণ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকানো। কার্নিশের জল পড়ছে বড় বড় ফোঁটায়। লটবহর টেনেটুনে একটু শুকনো জায়গার চেষ্টায় সরে গিয়েও তেমন সুবিধে হচ্ছে না। বৃষ্টির তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে তখন। চারদিক থেকে জলের বিন্দু তেড়ে আসছে। দু-একবার চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিতে হল। কিন্তু দাড়ি কামানো বন্ধ হল না।
ঘণ্টাকয়েক বৃষ্টি হল আর সেই দু-ঘণ্টা ধরে নাগাড়ে গালে ব্লেড ঘষে গেলেন ভদ্রলোক। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব অবাক মনে হল। এ মানুষ তো খুব সাধারণ মানুষ নন। গালের চামড়াও বলতে হবে খুব সাংঘাতিক, যে গাল এতক্ষণ ব্লেডের ঘষা সহ্য করতে পারে! প্রথম দিনে আলাপ হল না। বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গেই আমার বন্দিদশা ঘুচে গেল। এর পর তিনি কতক্ষণ রকে ছিলেন খেয়াল করিনি। প্রথম দিনেই কিন্তু একটা কৌতূহল জাগিয়ে ভদ্রলোক কখন এক সময়। চলে গেলেন।
পরের রবিবারে সেই একই দৃশ্য। সেই ভাঙা আরশি, তোবড়ানো বাটি, চুল ওঠা বুরুশ, কাপড় কাচা সাবানের টুকরো। দাড়ি কামানো শুরু হয়ে গেছে। ঠিক করে ফেললুম, চরিত্রটাকে আজ। একটু নাড়াচাড়া করে দেখতেই হবে। সাহস করে কাছে এগিয়ে গেলুম। কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই। টুকরো আরশিতে মুখ ধরার কৌশলে এত ব্যস্ত, যে নাকের ডগায় একটা ছেলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে সে খেয়ালই নেই। বাধ্য হয়ে আমাকেই প্রশ্ন করতে হল—আপনি কে? মুখটাকে ছুঁচোর। মতো করে দাড়িতে ব্লেড টানছিলেন, হাত থেমে গেল, পালটা প্রশ্ন এল—তুমি কে?
প্রথমে একটু থতমতো খেয়ে গিয়েছিলুম, তারপর যেন বেশ মজা লাগল। উত্তর দিলাম, আমি অপূর্ব।
—আমি পিকক লম্বু।
ভীষণ অবাক হয়ে গেলুম, এ আবার কী নাম!
—পিকক লম্বুটা কী?
—নাম।
—নাম তো বুঝলাম, এটা কী ধরনের নাম! কে রেখেছে এমন নাম?
—এ এক ধরনের নাম। রেখেছে মাস্টার।
—কোন মাস্টার?
—রিং মাস্টার।
—রিং মাস্টার আবার কী? ইতিহাসের মাস্টার, ভূগোলের মাস্টার, অঙ্কর মাস্টার শুনেছি, রিং মাস্টারটা কী?
কথার সঙ্গে হাত ঠিকই চলেছে, এক মুহূর্তও দাড়ি কামানো বন্ধ হয়নি। গালে একটু জল লাগিয়ে বললেন, কিছু জানো না দেখছি! রিং মাস্টারই তো পৃথিবীর আসল মাস্টার। সার্কাস দেখেছ কখনও?
—একবার। তাও অনেক আগে।
—হুঁ, তাই জানো না। রিং মাস্টার সার্কাসে বাঘের খেলা, সিংহের খেলা দেখায়। বুঝেছ?
—আপনি বুঝি সার্কাসে ছিলেন?
—ছিলেন কী! এখনও আছি।
—কোন সার্কাস? কী নাম আপনাদের সার্কাসের?
—ওয়ার্ল্ড সার্কাস।
—কোথায় কোথায় খেলা দেখান?
—সারা পৃথিবীতে।
শেষ কথাটি বলে, পিকক লম্বু আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। জড়ানো। এবং সেই হাসি-জড়ানো মুখেই বললেন,—ওই আকাশ আমার সার্কাসের তাঁবুর চাল, ওখানেই চলে ট্রাপিজের খেলা আর এই সার্কাসের এরেন, এইখানে হয় জমির খেলা। কথা শেষ করেই ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন। হাসি যেন আর থামতেই চায় না।
আমি শেষে ধমকে উঠলুম-অত হাসির কী আছে?
—আরে ম্যান, হাসির জন্যই তো আমার সার্কাসে সার্ভিস। কত রকমের হাসি আছে জানো?
—না। আগে আমি খুব হাসতুম। এখন আর হাসি না। হাসলেই মার খেতে হয়।
—এই দেখো। আমি হাসলেই পয়সা! আর তুমি হাসলেই প্রহার। আরে ম্যান, হাসতে জানতে হয়। আমি হাসলে লোক খুশি হয়; আর তুমি হাসলেই লোকে রেগে যায়। এই হল তফাত। কত রকমের হাসি আছে জানো?
—না, জানা নেই।
—কী করে জানবে? আমি আজ বিশ বছর ধরে প্র্যাকটিস করছি। কাঁদতে কাঁদতে হাসতে পারলে কান্নাটা আরও করুণ হয়। ব্যাপার এত সোজা নয় বুঝেছ মাস্টার। প্রথমে কিছুতেই হচ্ছিল না। কম চেষ্টা করেছি! চাকরিটাই শেষে চলে যাচ্ছিল। তারপর তারপর…হঠাৎ পিককদা থেমে। গেলেন। হাতে রইল আরশি। আকাশের দিকে চোখ তুলে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন, তারপর দম ফাটানো হাসি হাসতে হাসতে হাপুস কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! এমন ঘটনাও যে ঘটানো যায়! হাসি কান্না থামিয়ে পিককদা বললেন, আমার মেয়েটাই আমাকে এই শক্ত কাজটা শিখিয়ে গেছে।
—কোথায় গেল লম্বুদা আপনার মেয়ে?
কোনও উত্তর নেই। উদাস চোখে আকাশ দেখলেন। তারপর চোখ নামিয়ে বললেন,—অনেক দূরে চলে গেছে ভাই, যেখানে গেলে আর কেউ ফিরে আসতে পারে না। লম্বুদা ব্যাগ হাতড়ে একটা আধপোড়া বিড়ি বের করে দেশলাই খুঁজতে লাগলেন। অনেক খুঁজেও দেশলাই বেরুল না। বিড়িটা ঠোঁট থেকে খুলে আবার ব্যাগে ফেলে দিলেন।
—দেশলাই আনব লম্বুদা?
—না রে না। অত কষ্ট আর তোকে করতে হবে না। বিড়ি খেলেও হয়, না খেলেও হয়।
একমুখ হেসে লম্বুদা বললেন, আমার মেয়ে বছর এগারো আমার কাছে ছিল। বুঝলে মাস্টার। ফুটফুটে মেয়ে। একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। হঠাৎ কোথা থেকে এল জ্বর। ছাড়ে না। কিছুতেই ছাড়ে না। ছোট ডাক্তার বড় ডাক্তার সবাই এল। জমানো যে ক’টা টাকা ছিল সব গেল।
এদিকে সার্কাস চলে গেছে মাদ্রাজে। আমি দলছাড়া। মেয়েকে কার কাছে রেখে যাব?
—কেন মা’র কাছে?
—আরে ম্যান, মেয়ের মাকে পাব কোথায়? সে তো আগেই সরে পড়েছে। কত বড় ষড়যন্ত্র দেখো। আমার ঘাড়ে মেয়ের ভার দিয়ে, তিনি বেমালুম চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, রুমকি রইল তুমি দেখো। কী রকম স্বার্থপর একবার ভেবে দেখো, সার্কাসে না গেলে টাকা আসবে কোথা থেকে! আবার টাকা দেখতে গেলে মেয়ে থাকে কার কাছে! অবস্থাটা একবার ভাববা! যা ছিল একে একে সব বেচতে লাগলুম। একবেলা খাই, কোনওদিন খাই না। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এমন একগুয়ে কিছুতেই কি যেতে চায়!
শেষে ধরা পড়ল লিভারে কী যেন হয়েছে। হাতে আর তখন কিছু নেই। বেচার মতোও কিছু নেই, আছে শুধু মেয়ের গলায় একটা চিকচিকে সোনার হার। ওটাই শেষ ভরসা। কিন্তু হারটা নেব কী করে! ঠিক করলুম, চুরি করব। যেই ঘুমিয়ে পড়বে আস্তে আস্তে খুলে নেব। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মেয়ে তো মড়ার মতো সারাদিনই বিছানায় পড়ে থাকে। সন্ধ্যার দিকে ধুমজ্বরে একেবারে বেহুঁশ। আস্তে আস্তে গলা থেকে হারটাকে সরিয়ে নিলুম। তারপর দরজায় তালা দিয়ে বেরুলুম বিক্রির চেষ্টায়। ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে এলুম একেবারে ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে। পাড়ার সবচেয়ে বড় ডাক্তারদুশো টাকা যার ফি। দরজার তালা খুলে ঘরে পা দিয়েই দেখি মেঝেতে জল থইথই করছে। জলের কলসিটা কাত হয়ে পড়ে আছে, আর সেই জল থইথই মেঝেতে কলসির কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রুমকি! বোধহয় জল তেষ্টা পেয়েছিল, কোনওরকমে উঠে এসেছিল কলসিটার কাছে। জল কি খেতে পেরেছিল! তোমার কী মনে হয় ম্যান? আমি আর কী বলব! চুপ করে রইলুম। লম্বুদা বললেন, বোধহয় খেতে পারেনি ম্যান! গেলাসটা ছিল বাইরে। ডাক্তার আর ঘরে ঢুকলেন না, সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে ফি-র টাকা গুনে নিয়ে সরে পড়লেন। যতই হোক বড় ডাক্তার তো! ঘরের চৌকাঠে আর পা দিতে হল না। জ্বর ছেড়ে গেল। অত দিনের জ্বর। রুমকির গা একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা। তারপর থেকেই না, আমি হাসতে গেলেই খুব সহজেই কেঁদে ফেলি।
পিককদা তাঁর সেই রংচটা অদ্ভুত কিড ব্যাগে দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম ভরে ফেলে রক থেকে উঠে পড়লেন।
—কোথায় যাবেন এখন?
—দেখি কোথায় যাওয়া যায়!
একটা পা ফাইলেরিয়ায় মস্ত হয়ে ফুলে উঠেছে। সেই পা-টাকে অতি কষ্টে টানতে টানতে পিকক লম্বু পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।