ট্রাবলসাম প্রাণী
স্বামীদের মতো ট্রাবলসাম প্রাণী পৃথিবীতে আর দুটি নেই। যতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকে ততক্ষণই শান্তি। তাঁবুতে ফিরে এলেই দক্ষযজ্ঞ। ঘরে ঘরে স্বামীদের উৎপাতে স্ত্রী-রা জেরবার। সদাসর্বদা তাঁদের নাকের ওপর পার্মানেন্ট তিনটি ভাঁজ। মেজাজ তোলা উনুন, কণ্ঠস্বর ফাটা কাঁসি। বিবাহের আগে যার চলন ছিল কথাকলি, বিয়ের বছর না ঘুরতেই ক্যাঙারু। যাঁর স্পর্শে একদা ছিল কুসুমের কোমলতা, বছর না-ঘুরতেই খ্যাংরার কর্কশতা। অতীতে যিনি চাক-ভাঙা মধু মাখানো গলায় উত্তর দিতেন, যা আ আই (নীচের স্বরলিপি এইরকম গ ম প নি) বর্তমানে সাত ডাকের পর উত্তপ্ত রাগিণী কী হল কী (স্বরলিপি স ধা নি র্স)। কী হল কী-র অর্থ আবার ফ্যাচাং বের করলে?
স্বামী মানেই ফ্যাচাং। কনসেনট্রেটেড অশান্তি। কতভাবে যে গৃহশান্তি নষ্ট করা যায়, এঁদের কাছে শিখতে হবে। আর ফ্লোর ক্রসিং-এ এক্সপার্ট। দলবাজিতে তুলনাহীন। এই মায়ের দিকে তো পরমুহূর্তে বউয়ের দিকে। আবার পান থেকে চুন খসা মাত্রই প্রেমের তাজমহল ভেস্তে গেল, তোমাকে দেখলে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত রি রি করে। ডেরা পালটে গেল, মায়ের ঘরে
তখন অবস্থান। আবোল-তাবোল স্তোকবাক্য বৃদ্ধাকে, বুঝলে মা, এইবার ভাবছি, তোমাকে নিয়ে তীর্থে যাব। সংসারে কী আছে বলো? কে কার। মা আর সন্তান, আহা, কী স্বর্গীয় সম্পর্ক! মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে। বলো মা। মা আর ছেলের মতো দ্বিতীয় সম্পর্ক আর আছে! জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।
একটু মুচকি হাসি। আজ তোমার বোধোদয়, কাল তোমার বোধাস্ত। তিন দিন ধরে ঠুসঠাস চলছে, কাল মাঝরাতে তুমুল হয়েছে, আজ জ্ঞাননয়ন খুলেছে। মা এখন স্বর্গাদপি, কাল সেই পটপরিবর্তন হবে, সোহাগের রেড়ির তেলে সম্পর্ক হড়হড়ে হবে, তখন ফিশফিশ করে অন্তরালে বলবে, ষাট পেরিয়ে গেল এখনও স্বর্গেই যেতে পারলে না তো স্বর্গাদপি!
তোমার ঘরটা এইবার রং করতে হবে মা, সেই বাবা থাকতে একবার হয়েছিল। বেশ হালকা গোলাপি রং।
আমি যাই তারপর করাস। করাতে তো হবেই। কী অসুখে যাব কেউ তো জানে না।
তুমি ওইরকম সেন্টিমেন্টাল কথা বোলোনা তো, আমার চোখে জল এসে যায়। তুমি ছাড়া আমার কে আছে? তুমি তোমার নাতির বিয়ে দেখে যাবে। তোমাকে আমি চন্দনকাঠের চিতায় শোয়াব, ওই পঞ্চান্ন মিনিটের উনুনে নয়। তোমার শ্রাদ্ধে আমি সানাই বাজাব, গাওয়া ঘিয়ের লুচি খাওয়াব।
দাঁড়া আগে মরি।
আহা জন্মেছ যখন মরতে তোমাকে হবেই। শাজাহানও মরেছে, রাজকাপুরও মরেছে, বল্লভভাই। প্যাটেলও মরেছে। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে!
ধর যদি ক্যানসারে মরি, তাহলে শ্রাদ্ধের খরচ কী থাকবে, চিকিৎসাতেই দেউলে।
তুমি আমাকে কী ভাবো। বোকার মতো প্রেমে পড়ে হাবিলদারের মতো একটা হুমদো মেয়েকে বিয়ে করেছি বলে, সত্যিই কি আমি মাথামোটা। জানো তো, প্রেম হল থ্রম্বোসিস, সেরিব্রাল অ্যাটাক, টেম্পোরারি প্যারালিসিস। ফিজিওথেরাপিতে আবার ঠিক হয়ে যায়।
হয়, তবে আগের মতো হয় না। মুখটা বেঁকে থাকে। পা টেনে টেনে চলে। বিয়ের ছেলে আর বিয়ের পরের ছেলেতে অনেক তফাত।
তুমি যা বলতে চাইছ, আমি ধরেছি ঠিক, তবে তুমি বলার আগেই আমি নিজেকে ধরে ফেলেছি।
আর তোমার সুবোধ জরুকা গোলাম নেই। বেরিয়ে এসেছি। এখন কী গান গাইছি জানো, রামপ্রসাদ সেন, যার জন্য মরো ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে। সেই প্রেয়সী দেবে ছড়া অমঙ্গল হবে বলে। মা, মা-ই সব।
ধর যদি হয়।
কী হয়?
গলায় ক্যানসার।
কোন দুঃখে গলায় ক্যানসার হবে। তুমি কি আমার সেই মা, যে গলায় ক্যানসার ধরিয়ে আমাকে পথে বসাবে? শাস্ত্র কী বলছে মা, কুপুত্র যদি বা হয় কুমাতা কখনও নয়। তোমার ওই হলে আমার ভবিষ্যটা কী হবে ভেবে দেখেছ। বাড়ি যাবে, গয়না যাবে, তুমিও যাবে, গাছতলা।
আমার হবে কী, হয়ে বসে আছে।
যাঃ, কে বলেছে, ভয় দেখাচ্ছে।
ডাক্তার বলেছেন।
কিস্যু জানে না, হাতুড়ে। বায়োপসি না করে ক্যানসার বোঝা যায়?
সে-ও হয়ে গেছে।
কে করালে?
বউমা।
আমি থাকতে বউমা কেন?
তুই তো থেকেও নেই। তুই তো না বউয়ের, না মায়ের।
আমি তা হলে কার?
তুমি বাছা এখন ইউনিয়নের, পার্টির।
তোমার ব্যবস্থা তাহলে কী হবে?
কিছু না। যেদিন গিলতে পারি গিলব, তারপর উপোস, তারপর বলো হরি।
ওয়াইজ ডিসিশান। মরার জন্য বেমক্কা খরচের কোনও মানে হয় না।
কেন রে, চুল উঠে যাবে, চোখ ঢুকে যাবে, গলা শুকিয়ে যাবে, রক্ত ভেসে যাবে, সোনার বর্ণও কালো হয়ে যাবে।
আমি জানি, তুমি হিরো, বাবা মারা যাবার পর যেভাবে সংসারের হাল ধরেছিলে, যেভাবে আমাদের মানুষ করেছিলে, তুমি হিরো।
অবশ্যই। তা না হলে, এমন হিরের টুকরো জন্মায়।
মনে আছে ছেলেবেলায় তুমি আমাদের বলতে, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য। আমি জানি, তুমি মরতে ভয় পাবে না। যথেষ্ট বেঁচ্ছে আর বেঁচে কী হবে। সেই একই দিন একই রাত, সেই একই আলু, পটল, কচু, ঘেঁচু, মুলোনতুন তো আর কিছু হওয়ার নেই, বরং একটা নতুন শরীর হলে কত ভালো। আবার আমি তোমার মতো মায়ের ছেলে হব।
সে তাহলে আমার পরের পরের জন্মে।
কেন, পরের জন্মে কেন নয়?
আমাকে ধরতে পারবি না। হিসেবে আসছেনা। আমি মরার চল্লিশ বছর পর তুই মরবি। পঁয়তাল্লিশও হতে পারে। ততদিনে আমি দিদিমা হয়ে যাব। তুই আমার নাতি হতে পারিস।
তোমাকে একটু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মা মানেই তো ত্যাগ। কবে যেন উপনিষদে পড়েছিলুম, মা গৃধঃ, অর্থাৎ মায়েরা গাধা।
আচ্ছা, উপনিষদে আছে বুঝি! আমার বিদ্যে রামায়ণ, মহাভারত, লক্ষ্মীর পাঁচালি। তা কী ত্যাগের কথা বলছিস?
সামান্য ব্যাপার, মরার পর আবার দুম করে জন্মাবে না। একটু হাওয়া হয়ে থাকবে। পরের জন্মে তুমি কত বছর বয়েসে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছ?
এখনও করিনি, তবে যুগ তো তখন অনেক এগিয়ে যাবে। তিরিশের আগে কি করা যাবে?
কাকে?
আরও বড়লোকের কোনও ছেলেকে। আর যদি প্রেম করি। প্রেম করে হিন্দি সিনেমার কায়দায় আমার বাবার গাড়ির ড্রাইভারকে বিয়ে করি। মুম্বাইয়ের কোনও ঝুপড়িতে গিয়ে বাসা বাঁধি?
তুমি আমার মা হয়ে এমন অন্যায় কাজ করতে পারবে না! তুমি না আমার মা হবে।
বেশ, তাহলে কোনও কালোয়ারকে বিয়ে করব। অনেক টাকা।
নজরটা আর একটু উঁচু করো মা। টাকার সঙ্গে কালচারটাও যোগ করো। আনকালচারড ফ্যামিলিতে আমি জন্মাতে পারব না।
আমার প্ল্যান অন্য।
কীরকম?
পরের বার তুই যেই জন্মবি, সঙ্গে সঙ্গে কলাপাতায় মুড়ে ডাস্টবিনে। সারারাত তিনটে রাস্তার কুকুর তোকে পাহারা দেবে। পরের দিন অনাথ আশ্রমে।
এই তোমার বিচার?
হ্যাঁ, এই বিচার। পরের বাড়ির মেয়েকে গোলাপ ফুল শুকিয়ে, মালা দুলিয়ে, প্রেমের পানমশলা খাইয়ে বউ করলে। প্রেম তিন দিনেই চটকে গেল। কথায় কথায় চুলোচুলি। বাপ বললে শালা উত্তর। আজ তিন দিন হয়ে গেল না খেয়ে আছে। আমারও উপোস।
শোন, ক্যানসার আমার গলায় শুধু নয়,
তাবৎ মধ্যবিত্তের ঘরের বউদের গলায়,
কেন জানিস, একালের স্বামীরা অদ্ভুত এক ভূত।