আকাশ
মনীশ সান্যাল নীরবে বেশ কিছুক্ষণ সিগারেট টানলেন। মাথার ওপর ধোঁয়ার একটা চন্দ্রাতপ তৈরি হয়ে গেল। দু-পাশে দুটো বড় বড় জানলা। ভীষণ ঝোড়ো বাতাস বইছে বলে শার্সি বন্ধ। ঘরটা দশতলায়। বাইরে কলকাতার রাতের আকাশ। নীচে বিত্তবান মানুষের পল্লি। আলোর বাহার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চোখে পড়ছে। আলোয় উদ্ভাসিত। মনীশ তাকিয়েছিলেন মেমোরিয়ালের দিকে। হঠাৎ যেন ঘরে ফিরে এলেন। সিগারেট অ্যাশট্রে-তে গুঁজে দিয়ে বললেন, হয়নি। আপনার এই পরিশ্রমের পুরোটাই বরবাদ হয়ে গেল। মৌলিক কোনও চিন্তা নেই।
টেবিলের উলটোদিকে বসেছিলেন সুধেন্দু মুখার্জি। মধ্যবয়সি সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। মুখে একটা জ্যোতি। সোনার ফ্রেমের চশমায় জ্বলজ্বল করছে। কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে সুধেন্দুমুখ তুলে তাকালেন মনীশের দিকে। এতটুকু আহত না হয়ে বললেন, আমারও তাই মনে হয়েছে। ধরতাইটা ভালোই হয়েছিল। তারপর আর প্রলোভন জয় করতে পারলুম না। ফাঁদে পা। দিয়ে ফেললুম। ইমাজিনেশানের দারিদ্র। তুমি ঠিকই ধরেছ। একটা সময়ে আমার মনে হল, ধরতে হবে। কেউ যেন পালাতে না পারে। সব দিক থেকে ঘিরে ফেলতে হবে। একেবারে অভিমন্যু করে ফেলতে হবে। একের পর এক আসে আর যায়। একটাও স্ট্র্যান্ড করে না। সব ডিগবাজি।
মনীশ বললেন, সে আমি বুঝেছি, আপনি একটা বোম্বাই-বাংলা পাঞ্চ করতে চেয়েছেন। বিদেশি বোতলে বাংলা মদ।
সুধেন্দু বললেন, আমি ঠিক তা চাইনি। আমার একটা সলিড থিম ছিল; কিন্তু পায়ে পায়ে চলে গেল সেই গতানুগতিক দিকে। কিছুতেই আর ফেরাতে পারলাম না। জানো তে সৃষ্ট চরিত্র নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে। কাগজের ওপর অক্ষরমালায় জন্ম। প্রাণ থাকা উচিত লেখকের হাতে। লেখক হঠাৎ আবিষ্কার করে তারা নিজেরাই প্রাণ পেয়ে, নিজেরাই চলতে শুরু করে। লেখকের কাজ তখন হয় অনুসরণ করা। যেমন চালাও তেমনি চলি।
সুধেন্দুদা, আপনার থিমটা কী ছিল?
থিমটা ছিল, ফ্ল্যাটে যেসব শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মানুষ একালে বাস করে, তারা যে কী সাংঘাতিক আত্মকেন্দ্রিক, সেটা আমি দেখাব। তারা কেউ কারওর খবর রাখে না। সকলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আর দেখাতে চেয়েছিলুম, জেনারেশন-গ্যাপ। সেকাল আর একালের মূল্যবোধ কতটা। পালটে গেছে। একালে একজন বৃদ্ধ, ডাইনসোর কী টেরোড্যাকটিলের মতোই অবাক প্রাণী। মিসফিট, সর্বত্র সমালোচিত।
থিমটা তো খুব সিরিয়াস। তাহলে ডাকাতি দিয়ে শুরু করলেন কেন?
আমি প্রথম থেকেই অ্যাকশান দিয়ে জমিয়ে দিতে চেয়েছিলুম। যাতে ঝুলে না যায়।
বেশ, তাই! ওই মধুকে কেন কিডন্যাপ করালেন? ওইখানেই তো বাঁশ দিলেন নিজেকে। ডাকাতি হতেই পারে। ভেঙে পড়া প্রাচীন শহরের আইন-শৃঙ্খলার শিথিল দিক সেটা। কেউ সাহায্যের জন্যে এল না, সেটা হল আত্মকেন্দ্রিক মানুষের ভীরুতা। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু কিশোরী মধুকে উধাও করলেন কেন?
সাম্প্রতিক একটা ঘটনার প্রভাব। ওই যে এক পুলিশ অফিসারের মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে, আজও যার সন্ধান মেলেনি। ওই মেয়েটি এসে গেল কাহিনিতে।
সেখানে তো ডাকাতি, মারধোর এইসব ছিল না। ওখানে একটা প্রেমও থাকতে পারে।
আমিও একটা টিন-এজ লাভস্টোরি ঢোকাতে চেয়েছিলুম। আজকাল কিশোর-কিশোরী প্রেম খুব হিট করছে। কিন্তু ভাই ডাকাতিটাই সব বারোটা বাজিয়ে দিলে।
বিমল করের বালিকা বধূ, খড়কুটোর পর ওই চেষ্টাটা না করলেই পারতেন।
আমি একটু অন্য ধান্দায় ছিলুম। প্রেমহীন-আত্মকেন্দ্রিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা কত অসহায়, ইমোশন তাদের কীভাবে শিকার করে এইটা আমি দেখাতে চেয়েছিলুম। পারলুম না, ফেল। করলুম। মেয়েটাই বেরিয়ে চলে গেল হাত ফসকে। ডাকাতিটাই হয়ে উঠল কাহিনির নিয়তি।
ডাকাতিটা নিয়তি নয়, নিয়তি হল মধু অপহরণ। ডাকাতি হল, মাল-মশলা নিয়ে পালাল, মিটে গেল মামলা। আপনার অবচেতনে থ্রিলারের একটা থিম ছিল; কিন্তু আপনি জানেন না বাঙালির হাতে থ্রিলার জমে না। ডাকাতির কারণ খুঁজতে গিয়ে একেবারে লেজে-গোবরে হয়ে গেলেন। কল্পনা কাজ করল না।
তুমি পাকা লোক। ধরেছ ঠিক। একসঙ্গে অনেক সাম্প্রতিক ঘটনা আমাকে তালগোল পাকিয়ে
দিয়েছে। ব্যারাকপুর, বেহালা, মেহতা মার্ডার। মানুষ একালে হঠাৎ বড়লোক হয় কী করে! আমার তো ঠিক জানা নেই। শোনা আছে, কালো টাকা, স্মাগলিং, ড্রাগস এইসব। সব একসঙ্গে এসে গেল। ভয়ংকর একটা রহস্য-কাহিনি তৈরি করার বাসনা হল।
কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন। একবারও ভাবলেন না, এ দেশ থেকে সোনা বিদেশে যেতে পারে না। এ-দেশ সোনার দেশ নয়। গোল্ড বিস্কিট বিদেশ থেকে এ-দেশে আসে। গল্পের গরুকে গাছে ওঠালে হয়? সোনা যাচ্ছে মিউজিয়ামের আর্ট অবজেক্টের কেসে। সে-কেস আবার কাস্টমস চেকিং হয় না। এমন কথা কেউ কখনও শোনেনি। এইবার সোনার বদলে ড্রাগস আসছে। কী। করে আসছে? কীভাবে আসছে? কার কাছে আসছে? ব্যাপারটাকে আপনি এত সহজ করে নিয়েছেন যে ছেলেমানুষির পর্যায়ে চলে গেছে। এই পয়েন্ট থেকেই আপনার স্টোরি ঝলঝলে, খলখলে। তার ওপর দুটো গ্যাং ঢুকিয়েছেন যার একটার নাম ব্ল্যাক-প্যান্থার। সুধেন্দুদা, কোথায় আছেন আপনি ভুলে গেছেন। এটা পশ্চিমবাংলা! তা ছাড়া সেই পুরোনো আমলের ডিটেকটিভ স্টোরি-রাইটারদের আদলে আপনি পুলিশকে ফানি করে তুলেছেন। পুলিশ এলেই আপনাদের রসিকতা করতে ইচ্ছে করে। তাঁরা খিকখিক করে হাসেন। অকারণে মানুষকে হ্যারাস করেন। জ্যান্ত পুলিশ দেখেছেন আপনি?
দূর থেকে।
পড়েছেন?
হ্যাঁ। হেমেন্দ্রকুমার, নীহাররঞ্জন, শশধরবাবু।
তাঁরা এখনও আপনার ঘাড়ে চেপে আছেন। সব কাহিনির একজন হিরো-হিরোইন থাকে। আপনার হিরো কে?
সমস্যায় ফেললে। কে যে হিরো!
আমি স্টোরিটাকে যখন সেলুলয়েডে নিয়ে যাব, আমার হিরো কে হবে? বিমান?
বিমানের হিরো হওয়ার একটা চান্স আছে। মনে হচ্ছে সে-ই কন্ট্রোল করবে স্টোরির পরের পার্ট।
তাকে তো আপনি একটা স্পাইয়ের মতো খাড়া করেছেন। তার জীবন ও জীবিকা অস্পষ্ট। বিমান কে? সে ছাত্র? সে বেকার? তার বয়েস কত? বাড়ি কোথায়? তার কে আছে! সবই
ঘোলাটে।
ইনফ্যাক্ট আমিও জানি না।
আপনার চরিত্র, আপনি জানেন না?
না জানালে কী করে জানব। একালের স্টোরির তো কোনও প্ল্যান থাকে না। এ তো প্রি-প্ল্যান্ড মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিং নয়। যতদূর মনে হয় বিমান ড্রপআউট। ফ্যামিলির অবস্থা খুব একটা। খারাপ নয়।
বিমানের সঙ্গে মধুর আলাপ হল কী করে?
হয়ে গেল। যেভাবে হয়।
বাঃ, কোনও অগ্রপশ্চাৎ নেই! ফ্রি স্টাইল রেস্টলিং-এর মতো। হিরোইন কে?
ধরো মধু।
মধুর বয়স কত?
ধরো চোদ্দো-পনেরো।
চোদ্দো-পনেরোর প্রেমে আমি কী দেখাব? নাচ-গান?
ও-কথা বোলো না। চতুর্দশীর প্রেমের আবেগ জানো? ওইটাই তো ভুল করার বয়স। ভেসে যাবার বয়েস। তুমি বোঝো না কেন, মধু তো একটা প্রবলেম চাইল্ড।
মধুর বয়েস আপনি জানেন না!
সে কী?
হ্যাঁ। স্বপ্ন দৃশ্যে মধুকে খাটের তলায় ঢুকিয়েছেন। সেখানে বহুক্ষণ সে থেকেছে। ছবি এঁকেছে।
ওটা স্বপ্ন নয়, হ্যালুসিনেশান।
আধুনিক খাটের হাইট সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে? তার তলায় চোদ্দো বছরের বাড়ন্ত একটা মেয়ে ঢুকতেই পারে না। ঢুকলেও সর্বক্ষণ তাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হবে।
কল্পনায় সবই হয়।
মনীশ হা হা করে হেসে উঠলেন। আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কোনও একটা জায়গায় কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিলন প্রয়োজন। ফাউন্ডেশান ছাড়া বাড়ি দাঁড়ায়? শুয়ে পড়ে।
তুমি খাটের তলায় ঢোকাটাকে এত ইমপর্টেন্স দিচ্ছ কেন?
নিশ্চয় দেব। স্টোরির প্রতিটি ইঞ্চ মূল্যবান। তাৎপর্যপূর্ণ। মধুকে যদি প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন বিমানের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। বিমান না থাকলে, হিরো কে? দুটো তো ভিলেন তৈরি করে ফেলেছেন, সীতেশ আর ভাস্কর।
আচ্ছা ত্রিদিবেশকে হিরো করলে কেমন হয়?
খুব খারাপ হয়। ত্রিদিবেশকে আপনি বাংলা আর্ট ফিলমের টিপিক্যাল বুড়োর আদলে। ফেঁদেছেন। আত্মহত্যা করার জন্যে কামপোজ না কী যেন কিনতে ছুটছেন। ওই চরিত্রের সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু ছাড়া আর কোনও ভ্যালু নেই।
তাহলে এখন যাই কোথায়! আমার এতদিনের পরিশ্রম, ভাবনা সব জলে যাবে?
আমি সুধেন্দুদা আপনার কাছে টাইট, মিষ্টি একটা কাহিনি চেয়েছিলাম উপবাসী বাঙালি দর্শকদের চেয়ারের সঙ্গে একেবারে সেঁটে রাখার জন্যে। এ আপনি কী করলেন! থিমটা ভালোই ছিল। ঠিকমতো হ্যান্ডল করতে পারলেন না। ফার্স্ট দুটো চ্যাপ্টার রেখে বাকিটা জলে ফেলে দিন।
ডাকাতি হবে?
হোক। অ্যাকশান দিয়ে শুরু হোক।
মধু থাকবে, না কিডন্যাপড হবে?
ইয়েস, দ্যাটস দি পয়েন্ট। কিডন্যাপড হওয়া মানেই, রং্যানসাম আদায়ের জন্যে চিঠি। সেই জেমস হ্যাডলি চেজ মার্কা অ্যামেরিকান থ্রিলার। থ্রিলার আমরা পারি না সুধেন্দুদা। আমাদের। হাতে খোলে না। অকারণে হাতড়ে বেড়াবেন। কল্পনা ছুটবে বাঁধা পরিচিত রাস্তায়—পাড়ার গুন্ডা, সমাজবিরোধী, স্মাগলার, খুন, রেপ আপাতত নিরীহ মানুষের গোপন অপরাধ জীবন। এর বাইরে কিছুতেই আপনি বেরোতে পারবেন না। সুধেন্দুদা অন্যভাবে এগোন। মধুর চরিত্রটাই বাদ দিয়ে দিন।
বুঝেছি। আবার নতুন করে লেখার চেষ্টা করে দেখি। ধরতে পারি কি না! আচ্ছা আজ আমি তাহলে আসি।
সুধেন্দুমুখার্জি লিফটে করে নীচে নামবেন। করিডরে দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে ফাঁকা। রাত তো কম হল না। ফিলমের লোকেদের মাঝরাতেই দিন শুরু হয়। মনীশের এটা সন্ধে। সুধেন্দু করিডরের ঘোলাটে আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। লিফটের ইন্ডিকেটার প্যানেলে লাল। আলোর অক্ষর ভীষণ জ্বলজ্বলে। জ্বলছে, নিবছে। লিফট উঠছে। সুধেন্দুর সামনে এসে হুস করে দরজাটা খুলে গেল। দুধের মতো আলোয় ভেতরটা ভাসছে। কেউ নেই। কেউই উঠে এল নানীচ থেকে ওপরে। ভেতরটা নীল। সুধেন্দু এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। এক ধরনের অস্বস্তি। একটা। ভয়। এ যেন এক জগৎ থেকে আর এক জগতে প্রবেশ। সুধেন্দুক করে ঢুকে বোতাম টিপলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ। লিফট নামছে। দশ, আট, সাত। পাঁচে একবার থামল। দরজা খোলা মাত্রই এক সুন্দরী আধুনিকা ঢুকলেন। সুগন্ধে লিফট ভরে গেল। সুধেন্দু একপাশে জড়সড়ো। লিফটের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিলার চপ্পল নজরে আসছে। খুবই দামি পাদুকা। দামি সিল্ক। দামি জীবনের যাবতীয় আভরণ। মনে পড়ে গেল নিজের পুত্রবধূর কথা। অনেকটা এইরকমই। সুধেন্দু এইবার মহিলার মুখের দিকে। তাকালেন। সামান্য মিল যে নেই তা নয়। তবে সব আধুনিকা মোটামুটি একই রকম দেখতে। প্লাক করা ভুরু। খাটো করে ছাঁটা চুল। সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ। পেঁচিয়ে পরা সিল্কের শাড়ি। ঠোঁটে রং। তফাত বিশেষ নেই।
লিফটের দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে এসে লাগল মধ্য শীতের এক ঝলক শীতল বাতাস। একসময় সুধেন্দুর অনেক চুল ছিল। সেই স্টকেই চলছে। পাতলা হয়ে এলেও টাক পড়েনি। স্যাইড ব্যাগ থেকে একটা হিমাচলী টুপি বের করে মাথায় চাপালেন। বয়েস হয়েছে। ঠান্ডাটা ঝপ করে মাথাতেই লাগবে। সুধেন্দু শৌখিন মানুষ। জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েই বেঁচে আছেন; কিন্তু জীবনবোধ হারাননি।
সুধেন্দুর পুরোনো আমলের একটা ছোট্ট গাড়ি আছে। বেশ শক্ত-সমর্থ। সুধেন্দুর মতোই ঘাতসহ লাজুক। নিজেই ড্রাইভ করেন। মনোহরপুকুরে পৈতৃক আমলের বাড়িটি একটা মস্ত ভরসা। নীচেটা ভাড়া দিয়েছেন। দোতলাটা তাঁর। দরজা খুলে আসনে বসলেন। বাঁ পাশে কাত হয়ে জানলার কাচটা নামিয়ে দিলেন। ঘড়ি দেখলেন, প্রায় এগারোটা। স্টার্ট দিতে গিয়ে ক্ষণকালের জন্যে থামলেন। একটা প্রশ্নের উত্তর পেলেন—সুধেন্দুই তো ত্রিদিবেশ। পাঁচ বছর আগে জীবনে একটা ক্রাইসিস এসেছিল। আত্মহননের কথাও ভেবেছিলেন। শেষে নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলেন। হেরে যাব না। সাহায্য করেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী। একটি দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে। মহিলা বলাই ভালো। একটা নাচের স্কুল চালান দক্ষিণ কলকাতায়। মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যের মতোই দেহ-সৌষ্ঠব।
সুধেন্দুস্টার্ট দিল। হেডলাইট জ্বালালেন। সেই আলোয় দেখলেন লিফটের মহিলাটি কিছুদূরে তরতর করে হেঁটে চলেছেন। আশ্চর্য হলেন। এত রাত। গাড়ি নেই। একা কোথায় চলেছেন। পুত্রবধূ হেনার মতোই দেখতে পেছন থেকে। ছেলে প্রসূন আর হেনা এখন ব্যাঙ্গালোরে। বেশ ওয়েল টু-ডু। একটা ফর্মাল সম্পর্ক বজায় আছে এই মাত্র। কোনও ফর্মে ফাদারস নেম লিখতে হলে, প্রসূন সুধেন্দুই লিখবে; কারণ কোনও বিকল্প নেই।
গাড়িটা ধীরগতিতে এগোল। মহিলাকে পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়েও পারলেন না, সুধেন্দু থেমে পড়লেন। টিউন করা গাড়ি। ইঞ্জিন যেন নিশ্বাস ফেলছে। গাড়িটাকে পথ করে দিতে মহিলা এক পাশে থেমে পড়েছিলেন। সুধেন্দুবাঁদিকে প্রায় শুয়ে পড়ে বাঁ-পাশের জানলার কাছে মুখ এনে জিগ্যেস করলেন, আপনি যাবেন কোথায়?
মহিলা একটু ইতস্তত করে বললেন, চক্রবেড়িয়া।
কীভাবে যাবেন?
যা হয় একটা কিছু পেয়ে যাব।
আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে উঠে আসতে পারেন। আমি ওই দিকেই যাব।
আমি যে আপনাকে বিপদে ফেলব না কেমন করে বুঝলেন?
আপনারও বিপদ আমারও বিপদ। বিপদে বাঘে-মানুষে বন্ধুত্ব হয়। উঠে আসুন।
সুধেন্দুদরজা খুলে দিলেন। মহিলা সামনের আসনেই সুধেন্দুর পাশে বেশ সহজভাবেই বসলেন। একালের মেয়েরা বেশ স্মার্ট। সুধেন্দুফুরফুর করে গাড়ি চালাচ্ছেন। শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলোয় চরাচর আচ্ছন্ন। পাতলা চাদরের মতো কুয়াশার আঁচল নামছে। বহুকাল পরে বেশ। রোমান্টিক লাগছে নিজেকে। কিছুই না, কলকাতা যেমন ছিল তেমনি আছে। শুধু মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। একটু বিদেশি গন্ধ। সিল্কের আঁচল। ফুরফুরে চুল। উন্মুক্ত বাহু। এইসব আর কি। সুধেন্দু বেশ ভাবেই ছিলেন। মহিলা হঠাৎ বললেন, আমরা তো পরিচিত হতে পারি?
অবশ্যই। আমার নাম সুধেন্দুমুখার্জি।
কোন সুধেন্দু? লেখক সুধেন্দু?
আমি নিজেকে লেখক মনে করি না অবশ্য। চেষ্টা করি।
বিনয় ভালো; তবে আপনি আমার প্রিয়দের অন্যতম। আমার নাম তনুকা। এয়ার ইন্ডিয়ায় চাকরি করি।
তনুকা? সুধেন্দু অবাক হলেন।
কেন, তনুকা নাম হতে পারে না?
খুব পারে। তনুকা আমারই এক চরিত্রের নাম। একটি লেখায় আমার পুত্রবধূর নাম তনুকা। তার সঙ্গে আমার সংঘর্ষ।
এই তনুকার সঙ্গে সংঘর্ষ আপনার পুত্রের। আপনার পুত্রের কী নাম?
সীতেশ।
প্রায় মিলেছিল। এই শয়তানটার নাম সীতেন।
সীতেন? তা শয়তান কেন?
সে এক বড় গল্প। এই ফ্ল্যাটে আমার উকিল থাকেন। ডিভোর্সের মামলা চলছে। জোর ফাইট। উকিলের কাছে এসেই দেরিটা হল।
আজকাল ডিভোর্স খুব হচ্ছে। কোনওভাবে মিটমাট করা যায় না?
অসম্ভব। হি ইজ এ স্কাউন্ড্রেল। আমাকে তাহলে জিমনাসিয়ামে ভরতি হতে হবে। মারলেই মারব।
থাক দরকার নেই। আবার তাহলে বিবাহ করতে হবে।
আবার বিয়ে; কোনও পুরুষকে আমার বিশ্বাস নেই। টৌয়াইস চিটেড।
চক্রবেড়িয়ার মুখে গাড়ি এসে গেল। তনুকা বললেন, আমাকে এইখানেই নামিয়ে দিন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
এই মুখ থেকে আপনার বাড়ি কত দূর?
একটুখানি।
এখানে নামলে অসুবিধে হবে না তো? বলেন তো সামনেই নামিয়ে দিয়ে আসি।
এই প্রথম মহিলা প্রাণ খুলে হাসলেন। সুধেন্দু বহুকাল মেয়েদের জলতরঙ্গ হাসি শোনেননি। বয়েস তো তাঁর এমন কিছু হয়নি। সবে ষাট। বিলেতে এই বয়সের মানুষ বিয়ের কথাও ভাবে। তনুকা হাসি থামিয়ে বললেন, বেশ ভালো লাগল আপনাকে। এক রাতের পরিচয় এক রাতেই হারিয়ে যাবে?
তা কেন? সুধেন্দু বেশ উৎসাহী হলেন, আমার ভীষণ ভালো লাগল আপনাকে। বহুকাল পরে যেন হৃদয়ের শব্দ শুনতে পেলুম। বড় একা মানুষ তো আমি। কলম থেকে যে-সব চরিত্র নামে কিছুকাল তারাই আমাকে সঙ্গ দেয়। একসময় তারাও অদৃশ্য হয়ে যায় দুই মলাটের আড়ালে। তখন এই রাত আসে, দিন আসে, দুর্ভাবনা পায়চারি করে মনের বারান্দায়। অতীত এসে কাঁদে বিধবা রমণীর মতো।
বাঃ, কী সুন্দর বললেন। আপনার কেউ নেই?
দশ বছর আগে স্ত্রী মারা গেছেন ক্যানসারে। একটি মাত্র ছেলে। ওয়ান চাইল্ড সিন। ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে করে বউ নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে পালিয়েছে। আমি এখন একা।
Alone, alone, all all alone
Alone on a wide, wide sea!
And never a soul took pity on
My soul in agony?
সুধেন্দু একসময় ভালো আবৃত্তি করতেন। ইংরেজি নাটক করতেন। অর্সন ওয়েলস তাঁর মন্ত্রগুরু। গলাটা ভরাট। স্কটিশের সেই পাঁচের দশক যেন ফিরে এল।
তনুকা বললেন, আমিও একা। আপনি আমার বন্ধু হবেন?
বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত টিকবে তো?
কোনও কিছুর শেষ ভাববেন না। ধরে রাখুন, এন্ড ইজ অলওয়েজ বিটার। শুরুটা হোক না।
কিন্তু!
হ্যাঁ অজস্র কিন্তু আছে এর ভেতর। অনেক কথা, অনেক বাদ-অপবাদ।
আই ডোন্ট কেয়ার। সুধেন্দু সাহসী হলেন, বেশ, তবে তাই হোক।
এবং আজই। আমার বাড়িতে চলুন, সামান্য কিছু খেয়ে, এককাপ কফি নিয়ে ফিরবেন। আপনার বাড়ি তো খুব কাছেই।
আপনার বাড়ির লোক?
আবার কিন্তু! নিন গাড়ি ঢোকান।
নির্জন রাস্তা। চাঁদের আলো যেন হরতালের কলকাতায় ক্রিকেট খেলছে। অল্প শীত। বেশি
শীতেও মেয়েদের শীত করে না। সরু একটা সিঁড়ি দিয়ে সুধেন্দু তনুকার পেছন পেছন দোতলায় উঠছেন। তনুকা দরজায় খটখট করতেই, দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন এক প্রৌঢ়া। গায়ে গাঢ় রঙের আলোয়ান। বেশ একটা বড় হলঘরের মতো। মাঝখানে ছোট্ট একটা ঝাড়লণ্ঠন। উত্তরের কোনও একটা ফাঁক দিয়ে পৌষের বাতাস আসছে। ঝড়ে মৃদু একটা টিংলিং শব্দ। ঝকঝকে। খাবার টেবিল। অসম্ভব পরিচ্ছন্ন মায়াবি এক পরিবেশ। সোফায় একটা লোমওলা সাদা বেড়াল মহা আরামে ঘুমোচ্ছে।
তনুকা বললেন, আসুন। ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার এই দুজন আর কেউ নেই।
সুধেন্দু ভেতরে ঢুকলেন। দরজাটা পেছনে ক্লক করে বন্ধ হয়ে গেল। পুরোনো আমলের একটা ঘড়ি কোথাও বাজাচ্ছে—এক, দুই, তিন…
২.
চিরটাকালই সুধেন্দু দেখে আসছেন তাঁর সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আলো, অন্ধকার, মানুষের মুখ, গন্ধ, মেয়েদের মাথার চুল, শরীরের গঠন, ফার্নিচার সাজাবার ধরন, ঘরের বাতাস তাঁকে অনেক অপ্রকাশিত খবর দিতে পারে। যা নেই, যা ছিল, যা আসবে, তিনি যেন জানতে পারেন। পরে অবাক হয়ে দেখেছেন, মিলে গেছে। এই শক্তিটা তিনি অর্জন করেছেন। এক মহাপুরুষ অযাচিতভাবে দান করে গেছেন। জীবনের প্রথম পর্বে টগবগে যৌবনে প্রচণ্ড এক মানসিক বিপর্যয়ে আত্মহত্যার মুখোমুখি হয়ে সুধেন্দু ছিটকে চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ে দুটি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে—হয় ঈশ্বর না হয় আত্মহত্যা। পাহাড় আর বরফের নির্জনতায় মরে পড়ে থাকলে কেউ খুঁজে পাবে না কোনওদিন। কেউ বলতে পারবে না, কাপুরুষটা আত্মহত্যা করেছে। একটা রহস্যে আবৃত থেকে যাবে সুধেন্দুর অন্তর্ধান রহস্য। সাতটা দিন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালেন তিনি। বিরাট পর্বত, হিমবাহ, ঝরনা, নদী, হাড়কাঁপানো শীত, প্রবল বাতাস, অভ্রনীল আকাশ, বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল, সুধেন্দু! ঈশ্বরের কোনও রূপ নেই, তিনি অরূপ। বিরাটেই তাঁর অবস্থান। তিনি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র আবার বৃহতের চেয়ে বৃহৎ।
আত্মহননের ইচ্ছা মিলিয়ে গেল। মনুষ্যজন্ম এক মহাভাগ্য। এমন একটা শরীর, পরতে পরতে যার রহস্য। সেই ভয়ংকর, ভয়াবহ নির্জনতায়, বাতাসের হাহাকারে বসে সুধেন্দু নিজের শরীরের রহস্যে মজে গেলেন। শক্তিশালী ক্যামেরার লেন্সকে হার মানায় এমন দুটো চোখ। সূক্ষ্ম বেতার যন্ত্রের মতো দুটো কান। কয়েক কোটি স্পর্শকাতর স্নায়ু। বিন্দুর মতো একটি কীটের চলাফেরা। টের পায় এমন প্রাণবন্ত দেহত্বক। আঙুলের কী অদ্ভুত ছন্দ, কাজ করার কী করণকৌশল। দেহসন্ধির কী অসাধারণ কারিগরি! পাদুটো মোড়ে পেছন দিকে, হাত দুটো সামনে। সর্বোপরি মাথা। অতীত সেখানে স্মৃতি। বর্তমান সেখানে বিচার, ভবিষ্যৎ এক আশঙ্কা।
হিমালয়ের সেই হতাশ দিনে সুধেন্দু দেখা পেলেন তাঁর গুরুর। সন্ধ্যা নামছে। আর একটি অসহ্য শীতসন্ধ্যা। ভাবছেন, রাতটা কাটবে কী করে! অনাহারে দুর্বল শরীর। এমন সময় তিনি সামনে। এসে দাঁড়ালেন, সাক্ষাৎ মহাদেব। হাতে ত্রিশূল। বড় বড় চোখ, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। পিতার স্নেহে বললেন, আও বেটা।
দুজনে একটা গুহায় গিয়ে ঢুকলেন। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। তেমনি ঠান্ডা। সাধু আদেশ করলেন, বয়ঠো বেটা। সুধেন্দু আন্দাজে বসলেন। একটা কিছুর ওপর বসেছেন। স্পর্শে বুঝলেন, কম্বল। সাধু বললেন, চোখের আলো জ্বালাবার চেষ্টা করো। আমি অন্ধকারেও দেখতে পাই।
সুধেন্দু মনে মনে ভেবেছিলেন, আপনি মহাযোগী, মহাসাধক, আপনি তো দেখতে পাবেনই। আমার সে শক্তি কোথায়! আমি তো রাতের পাখি। অন্ধ।
সাধু বলেছিলেন, তোমার চিন্তা আমি পড়তে পেরেছি বেটা। আমি পারি। আগে পারতুম না, এখন পারি। আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। অন্ধকারে আগে আমিও দেখতে পেতুম না, এখন পারি। আমার চোখ দুটো পোলারাইজড হয়ে গেছে। সুধেন্দু অবাক হয়েছিলেন, সাধু শিক্ষিত। ইনফ্রা রেড, শর্ট ওয়েভ লেংথ, রাডার সবই জানেন। ফিজিক্সের লোক। সংসারে থাকলে বিজ্ঞানী হতেন। অনেক টাকা রোজগার করতেন। কার টানে সব ছেড়ে এই ভীষণ জায়গায়!
সাধু বলেছিলেন, বিজ্ঞানে ভগবানকে টের পেয়ে, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে এখানে এসে বসে আছি। যতদিন যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে, আলাদা করে ভগবান বলে কিছু নেই। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন। তিনি জলে, তিনি স্থলে, তিনি অন্তরীক্ষে তিনি সর্বঘটে। আমার ক্ষুদ্র আমিটাকে মারতে পারলেই সেই বৃহৎ আমির অনুভূতি আসবে।পাওয়ার হাউস থেকে। বিদ্যুৎ আসে, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে, আমি যেদিন সেই পাওয়ার হাউস হব, সেদিন আমি নিজেই আলো জ্বালাব, কল চালাব, আমাকে স্পর্শ করলে মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবে। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ঘটাবার ইচ্ছাশক্তি আমার নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমি মারতে পারব, আবার বাঁচাতেও পারব।
সুধেন্দু ঠিক বুঝতে পারেননি সেই সব কথা; কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেয়েছিলেন, শীত আর। করছে না, জিভে অপূর্ব একটা স্বাদ লেগেছে, খিদে আর নেই, মনে ভীষণ একটা সুখের ভাব। মৃত্যু বলে পৃথিবীতে একটা কিছু যে আছে, সেই বোধটাই চলে গেছে। গীতার সেই শ্লোকটি মনে ঘুরছে, যেখানে ভগবান বলছেন,
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বাভবিতা বান ভূয়ঃ
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।
এই আত্মা কখনও জন্মগ্রহণ করেন না বা মৃত্যুমুখে পতিত হন না। আত্মা অন্যান্য জাতবস্তুর মতো জন্মগ্রহণ করে অস্তিত্ব লাভ করেন না, কারণ সদরূপে আত্মা চিরবিদ্যমান। আত্মা। জন্মরহিত, নিত্য শাশ্বত এবং পুরানো, শরীরের নাশে আত্মার নাশ হয় না।
সেই মহাত্মার কাছে প্রায় তিন মাস ছিলেন সুধেন্দু। অসাধারণ, অলৌকিক সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শরীরটা যে কিছুই নয়, সেই ধারণাও ধারণ করতে পেয়েছিলেন। কারণ সেই মহাসাধক কোনও কিছুই আহার করতেন না। সুধেন্দুকে সপ্তাহের একদিন একটি করে পাকা হরিতকি খেতে দিতেন। সুধেন্দুর ক্ষুধা-তৃষ্ণা এক সপ্তাহের মতো নিবৃত্ত হয়ে যেত। একাসনে দিনের পর দিন বসে থাকার অভ্যাস হয়ে গেল। সন্ন্যাসী প্রণব মন্ত্র জপ করতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মনকে এমনভাবে নিবিষ্ট করবে যে, সময়ের কোনও জ্ঞান তোমার থাকবে না। দিন আসবে, রাত আসবে, তুমি কিছুই টের পাবে না। তোমার শরীর, জীবকোষ সব পালটে যাবে। নতুন একটা শরীর, জপের শরীর তৈরি হবে। আনন্দের সাগরে পদ্মফুলের মতো ভাসতে থাকবে। শ্বাসপ্রশ্বাস আর নাক দিয়ে পড়বে না, সুষুম্নায় বইতে থাকবে। তোমার সমস্ত শরীর শিরশির করবে। স্বেদ, পুলক, হর্ষ, কম্প হবে। আকাশ-বাতাস জুড়ে শুনবে নাদধ্বনি। সমুদ্রের গর্জন, মেঘের শব্দ, বাতাসের শীকার, কাঁসর-ঘণ্টা, পিনাক, ডমরু সব একসঙ্গে বাজতে থাকবে। নাকে পাবে ব্রহ্মকমলের গন্ধ। শিব-দর্শন হবে। রুপোলি আলোয় চরাচর ভেসে যাবে। দিব্যায় দেবায় দিগম্বরায়।
পাঁচ মিনিট, দশমিনিট, পনেরো মিনিট এইভাবে সময় বাড়তে লাগল। সুধেন্দু ক্রমশ ত্রিকাল থেকে মহাকালের দিকে এগোতে লাগলেন। সেখানে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নেই। গতি নেই, কম্পন নেই, আন্দোলন নেই, উদয় নেই, অস্ত নেই। প্রথমে ভীষণ একটা ভয়—নির্জন বনপথে যেতে বালকের যে ভয়, সেইরকম একটা ভয়। মনে মনে চিৎকার করেছিলেন কোথায় আমার মধুসূদন দাদা! সঙ্গে সঙ্গে মনের চোখে ভেসে উঠল একটি রথ। সারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, আসনে। স্বয়ং অর্জুন। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ কানে এল, চাকার ঘর্ষণ। বলগার আন্দোলন। ভয়টা কেটে গেল।
এর পরে যে দৃশ্য এল, সেটাও কম ভয়ের নয়। সুধেন্দু হঠাৎ একটা বিন্দুতে পরিণত হলেন, উজ্জ্বল একটি আলোক বিন্দু। সরু একটা নলের মধ্যে দিয়ে চলেছেন, সেই নলের গা বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, যেমন খনিতে জল চুইয়ে পড়ে। বিন্দুটা কমে একটা বেলুনের মধ্যে ঢুকে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রাস করে নিল শ্লেষ্মার মতো একটা পদার্থ। আবত হয়ে বিন্দুটির উজ্জ্বলতা। কমে শ্বেত শুভ্র একটি মুক্তোয় পরিণত হল। সুধেন্দু দেখতে পেলেন সেটি একটি মানুষের মুখ। তার হাত-পা সবই আছে। ক্ষুদ্র একটি মনুষ্যকীট। কোথা থেকে কলকল শব্দে জল এসে বেলুনের মতো সেই থলেটিকে ভরে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যকীটটি হেঁটমুণ্ডু, ঊর্ধ্বপদ অবস্থায়, সেই জলে ভাসতে লাগল। তার নাভিতে সংলগ্ন সরু সূক্ষ্ম একটি নালিকা, অনেকটা পদ্মের ডাঁটার মতো। ধ্যানস্থ সুধেন্দুর মনে হল, ভারহীন অবস্থায় সে টলটল করছে। যে গুহায় বসে আছে, সেটা জলে ভরে গেছে। কিন্তু কোনও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। বেশ একটা আরাম বোধ হচ্ছে। বেশ একটা। নিরাপত্তার ভাব। সুধেন্দু ডেকে উঠলেন—মা। সঙ্গে সঙ্গে একটি চিত্র হল চোখের সামনে কারণ সলিলে শ্রীবিষ্ণু যোগনিদ্রায় শায়িত। তাঁর নাভিকমলে চতুর্মুখ ব্রহ্মার অবস্থান।
এর পরেই সুধেন্দুর মনে হল, সেই মনে হওয়াটা আরও অদ্ভুত, মোমবাতির মতো তার দেহটা গলে যাচ্ছে। সমস্ত দেহটাই ক্রমে গলে গলে, শুধু শিখাটা জ্বলতে লাগল ভাসমান অবস্থায়। দেহ নেই, কিন্তু চেতনা-দীপটি আছে। এইভাবে ক-দিন গেল কে জানে! চোখ মেলে তাকালেন। গুহার গোলমুখের বাইরে সাদা দুধের মতো থকথকে আলো। তারই একটু আভা ভেতরে আসছে। গুহায় তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি ডাকলেন, সাধুজি, সাধুজি আপনি কোথায়! কোনও উত্তর নেই। তাঁর নিজের মাথার চুল বড় হয়ে গেছে। একমুখ দাড়ি। বাইরে এলেন। চারপাশে বরফ আর বরফ। চাঁদের আলোয় ধবধবে সাদা। দূরে পাহাড়ের চূড়া ঝলসাচ্ছে।
সুধেন্দু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিরাট কত বিরাট হতে পারে তাঁর ধারণা ছিল না কোনও। সেই রাতে হয়েছিল। লোকালয়ের বাইরে এই তো সেই স্রষ্টার সৃষ্টিশালা। ক্ষুদ্রকে গড়িয়ে দিয়েছেন নীচে সমতলে। গড়ে উঠেছে লোকালয়। কিলিবিলি মানুষ। প্রেম, ভালোবাসা, হিংসা, ষড়যন্ত্র, হত্যা, জন্ম, মৃত্যু, রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি।
গুহায় ঢুকতে গিয়ে দেখলেন বরফের ওপর সাধুর ত্রিশূলটি পড়ে আছে। মনই বলে দিল, সন্ন্যাসী, মহাত্মা আরও কোনও উচ্চলোকে চলে গেছেন। ত্রিশূলটা স্পর্শ করতে গিয়েও করতে পারলেন না। সেইখানেই পড়ে রইল। সুধেন্দু ফিরে এলেন অন্য মানুষ হয়ে। ছিলেন শ্যামবর্ণ হয়ে গেছেন ফরসা। চোখের জ্যোতি বেড়ে গেছে। কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। শরীর শীতল হয়ে গেছে। ঘাম চলে গেছে। ভেতরটা আনন্দে ভরে গেছে।
বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়েদের মধ্যে একটা খাবলা-খাবলি হচ্ছিল। বউদের তাণ্ডব নৃত্য। পিতার বিষয়-সম্পত্তি কিছু কম ছিল না। সেকালের নামকরা আইনজীবী ছিলেন। ফৌজদারি বিভাগে। চুটিয়ে প্র্যাকটিস করেছেন, দু-হাতে রোজগার করেছেন। প্রভূত ভোগ করেছেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। তারা শিক্ষিত হয়েছে, মানুষ হয়নি। বড়বোন সিনেমার হিরোইন হয়েছিল। খুবই জনপ্রিয়; কিন্তু চরিত্রের আঁট ছিল না। জীবনে মদ ও পুরুষ দুটোই ছিল। বছরে বছরে সঙ্গী পালটে যেত। সবাই বড়লোকের বেহেড ছেলে। দিদি সব কটাকেই ছিবড়ে করত। এই বিপজ্জনক খেলায় শেষদানে হারতেই হয়। দিদির শেষটা ছিল প্যাথেটিক। বাঁচেওনি বেশিদিন।
বিষয়-সম্পত্তির জটিলতা থেকে সুধেন্দু বেরিয়ে এসেছিলেন এক কথায়। ইটের একটা খাঁচা। রুমালের টুকরোর মতো একখণ্ড জমি। মানুষের হিসেবে বিশাল একটু কিছু বিরাটের দৃষ্টিতে কিছুই না। সেই মামলার ফয়সালা আজও হয়নি। পিতার মঞ্জিল এখন রিসিভারের হাতে।
সুধেন্দু একটা ফিলম কোম্পানিতে চাকরি পেলেন। এক বড় ডিরেকটারের সহকারী। পরপর সাতখানা ছবি হিট। স্টোরি অন্যের কিন্তু স্ক্রিপ্ট সুধেন্দুর। নাম, চাহিদা, খ্যাতি তিনটেই বেড়ে গেল। সুধেন্দুর হাতে সোনা ফলে। ব্যর্থ প্রেমিকের হাতে প্রেমের গল্পই খোলে ভালো। সুধেন্দু কলেজজীবন থেকেই বিশাখাকে ভালোবাসতেন। পাগলের মতো প্রেম। তাকে সুখী করার জন্যে জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ঝড়, গ্রীষ্ম, বর্ষা কিছুই মানতেন না। পুলিশের গুলি চলছে, কারফু; সুধেন্দুবিল্বমঙ্গলের মতো। বিশাখার কাছে হাজির। বিশাখা একদিন স্পষ্ট মুখের ওপর বলেই দিলে, আই ডোন্ট লাভ ইউ, রেদার আই হেট ইউ। তোমাকে দেখলে আমার ইরিটেশান হয়, নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। ক্লিয়ার অফ, ক্লিয়ার অফ।
সুধেন্দুর এখন ধারণা হয়েছে, মেয়েদের জোর করে ভালোবাসা যায় না, তারা যাকে ভালোবাসবে তাকেই ভালোবাসবে। অধিকাংশ মেয়েই যাকে বিয়ে করে তাকে ভালোবাসে না। প্রেমহীন একটা চুক্তির সংসার গড়ে ওঠে। ছেলেরা দেহ ছাড়া কিছুই পায় না। পাশাপাশি শুয়ে থেকেও টের পায় না, মাঝখানে অদৃশ্য পাশ বালিশের মতো আর একজন শুয়ে আছে। সে তার প্রেমিক। সে কোনও হতদরিদ্র ছেলে হতে পারে, ভয়ংকর এক মস্তান হতে পারে, একজন বয়েসে বড় গুণী মানুষ হতে পারে। মনের দখল কে নিয়ে রেখেছে বোঝা শক্ত। মেয়েরা অভিনয় করতে জানে। ফিলমে এসে সুধেন্দু সেটা আরও ভালো বুঝেছে। নায়িকা যত সহজে তৈরি করা যায় তত সহজে নায়ক তৈরি হয় না। ছেলেরা চিরকালই একটু মাথামোটা, দামড়া টাইপ। সূক্ষ্মবোধ, সূক্ষ্ম সেন্টিমেন্ট—এসবের বড়ই অভাব। খেলতে জানে না, খেলাতেও জানে না। মেয়েরা না কেঁদেও কাঁদতে পারে, না হেসেও হাসতে পারে, ভালো না বেসেও ভালোবাসতে পারে। অক্লেশে মনটাকে বের করে নিয়ে দেহটা দিয়ে দিতে পারে। ছেলেদের বেশিরভাগই শিবঠাকুরের ষাঁড়।
সুধেন্দু মেয়েদের মধ্যেই থাকেন; কিন্তু নারীর দেহের প্রতি তাঁর আর কোনও আকর্ষণ নেই। উন্মোচিত নারী দেহ, ছবিতে সামান্য অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষায় দেহদানের ঘটনা দেখে ধারণা। হয়েছে, কাম একটা জড়বস্তু। ওতে চেতনা নেই। চৈতন্যময় জগৎটাই জগৎ, বাকিটা ছোবড়া, যেমন নারকোলের জল আর শাঁসটাই আসল।
সুধেন্দু অক্ষত থাকার জন্যে বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটি ছিল সহজ, সরল, ধার্মিক, সংসারী। প্রেম, রোম্যান্স এসব বুঝত না। মাথাও ঘামাত না। সুধেন্দুকে আর সংসারটাকে সামলানোই ছিল তার প্রধান কাজ। আধুনিক খেলে সেকালের পুর। আদর্শই বড় ছিল। প্রবল ধর্মবোধ ছিল। হঠাৎ পরিচয়, হঠাৎ বিবাহ। পিতা ছিলেন সংস্কৃতে নামকরা পণ্ডিত। সারাজীবন স্বপাকে আহার করতেন আর মাঝেমধ্যেই কাশীতে চলে যেতেন মা-আনন্দময়ীর আশ্রমে। গোপীনাথ কবিরাজের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় দিন কাটত। এই কাশীতেই সুধেন্দুর পরিচয় ঘটেছিল পরিবারটির। সঙ্গে। সুধেন্দুকে ভাগ্যই নিয়ে এসেছিল কাশীতে। ন্যায়তীর্থমশাই সুধেন্দুকে পছন্দ করেছিলেন। সুধেন্দুর ভালো লেগেছিল সহজ, সরল, সুন্দর বৈশালীকে। নবনীতের মতো একটি শরীর, পৌরাণিক মন, তন্ত্রের লক্ষ্মণযুক্ত একটি শ্রীমণ্ডিত দেহছন্দ। কোমর পর্যন্ত ছাপিয়ে পড়া ঘন কালো চুল। আয়ত দুটি চোখ, দীর্ঘ আঁখিপল্লব। যে-প্রেম যক্ষিণীর মতো কলেজ সহপাঠী প্রত্যাখান করেছিল, সেই প্রেমই সুধেন্দু উজাড় করে দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। বিয়ের পর সুধেন্দুর ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। একের পর এক সাফল্য। আনন্দময়ী মা দুজনকেই অযাচিত দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাগ্য, অর্থ, গাড়ি, বাড়ি, সবই হল। তারপর বাজল ঘণ্টা। যেতে নাহি দিব। তবু যেতে দিতে হয়। এক বৈশাখী পূর্ণিমায় বৈশালী চলে গেল। সেই বছরই হিট করল সুধেন্দুর সপ্তম ছবি। একদা নামকরা নায়িকা, তখন পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী এক যায় যায়-যৌবন মহিলা খুব চেষ্টা। করলেন শূন্যস্থান পূর্ণ করতে। সুধেন্দু পাত্তা দিলেন না; কারণ সুধেন্দু রাতে আসনে বসলেই বৈশালীকে দেখতে পেতেন। প্ল্যানচেটের প্রয়োজন হত না। দেহ হল কপূর, উবে যায়; কিন্তু বায়ুমণ্ডলে থাকে অণু-পরমাণু হয়ে। সেই স্তরে নিজেকে তুলতে পারলে পরলোকগতকে পাওয়া যায়।
৩.
গরম কফি এসেছে। তনুকাই নিয়ে এল। পোশাক পালটেছে। সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। সুধেন্দু প্রশংসা করলেন, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার কোনও ছবিতে নামিয়ে দিই।
তনুকা কফিতে ছোট্ট চুমুক মেরে বললেন, আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল নিজের ভুলে।
নষ্ট মনে করলেই নষ্ট। আমি তো আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে এসেছি। বরং আমার ফিরতি পথটাই ভালো হল। ধাক্কা না খেলে বড় জোর ছাপোষা একটা কেরানি হতুম। যত না আয় তার চেয়ে বেশি ব্যয়। এখন দিব্যি আছি। এখন আমি বলতে পারি, এই দুনিয়া মজার কুটির, খাই দাই আর মজা লুটি। আপনিও তাই করুন, কোনও কিছুই কিছুনয়। রামপ্রসাদ বলেছিলেন, ভবে। আসা খেলতে পাশা। কিছু হল না, কিছু হল না, সবসময় এই ভাবলে বারুদ ভিজে যাবে। আমার মতো করুন। আমি রোজ ভোরে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে বলি, যা হয়েছে বেশ হয়েছে, এর বেশি আর কী হবে!
আপনি সাহিত্যিক, আপনি পুরুষ। আমি মেয়ে। জনঅরণ্যে একা। নেকড়ের পাল পেছনে ঘুরছে।
অবশ্যই সেটা একটা সমস্যা। মানুষ এখন আরও পশু। নারী এখন আরও ভোগের সামগ্রী। এর জন্যে আমরা ছবিওলারা কম দায়ী নই। পর্দায় মেয়েদের খোলা শরীর দেখিয়ে যৌনতা আরও বাড়িয়ে তুলেছি।
যখন যেখানেই যাই, যার কাছেই যাই, সে এমন চোখে তাকায়, কয়েকদিনের মধ্যেই এমন প্রস্তাব দেয় ছিটকে সরে আসি। আমি একটা সেক্স অবজেক্ট, ভাবলেই হতাশা আসে। মনে হয়, কোন পৃথিবীতে বাস করছি! বেড়াল, কুকুরের পৃথিবী না কি!
সুধেন্দু ঘড়ি দেখলেন। পৃথিবীকে পালটানো যাবে না। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির দৌলতে মানুষ যত। বিত্তবান হবে, পরিশ্রম বিমুখ হবে, ভোগের ইন্দ্রিয় তত প্রবল হবে। মুখে বলি হরি, কাজে অন্য করি। পুলিশ রেপ করবে, ধর্মগুরু ব্যভিচার করবে। শিক্ষক ছাত্রীর দেহ সম্ভোগ করবে। প্রবল একটা ভাঙচুর না হলে পৃথিবী সুন্দর হবে না।
সুধেন্দু বললেন, এত সহজ জিনিস, এমন জটিল হচ্ছে কেন? ডিভোর্স দিচ্ছেন না কেন?
অনেক প্যাঁচ আছে। আমাকে ছাড়তে তার আপত্তি নেই; কিন্তু আমার বিষয়সম্পত্তি ছাড়া কি সহজ! সেই লোভেই ধরে রেখেছে আমাকে। কিছুতেই মুক্তি দিচ্ছে না। মেন্টাল টর্চার করে মেরে ফেলতে চাইছে। একদিন ছঘণ্টা আমাকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। কেলেঙ্কারির ভয়ে। চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারিনি। আর একদিন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সেন্সলেস করার চেষ্টা করেছিল। উদ্দেশ্যটা ছিল সেক্স, ভালগার সেক্স। আপনি বলুন, লোকটা একটা বর্ন ক্রিমিন্যাল কি না!
এমন একটা ক্যারেটার জীবনে এল কী করে!
প্রথমে তো বোঝা যায় না। আপনার উপন্যাসের মতো। ক্রমশ প্রকাশ্য।
সুধেন্দু জানে, মানুষ এক দুর্বোধ্য প্রাণী। কখন কে কী করে বসবে বলা যায় না। সাধুর ভেতর শয়তানের বাসা থাকতে পারে। প্রেমিকের আড়ালে থাকতে পারে খুনি। খুব মিঠে গলায় একটা ঘড়ি জানান দিল, রাত একটা। সুধেন্দু দিনের পৃথিবীর চেয়ে রাতের পৃথিবী বেশি পছন্দ করে। সর্বত্র রহস্য। পুণ্যও যেমন গভীর হয়, পাপও সেইরকম থকথকে।
সুধেন্দু বললেন, এইবার আমি বিদায় হই। আপনি বিশ্রাম করুন।
সুধেন্দু উঠে দাঁড়ানো মাত্রই কেমন যেন একটা অনুভূতি হল। একটা শীত শীত ভাব। অনুভূতিটা পায়ের দিক থেকে উঠছে। সুধেন্দু জানেন, কী হতে চলেছে! আগেও কয়েকবার এমন হয়েছে। একটা সতর্কবাণী আসছে। কোনও একটা জরুরি খবর আসছে। কোথা থেকে আসছে, কী ভাবে আসছে জানা নেই। সুধেন্দুর মনে হয় হিমালয়ের সেই মহাত্মা, তিনি যেখানেই থাকুন, যে-ভাবেই থাকুন, সুধেন্দুকে জানিয়ে দেন, সাবধান হও। বিপদ আসছে। একবছর আগে একটা শুটিং-এর সময় এইরকম হয়েছিল। দৃশ্যটা ছিল, নায়ক রেগে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবে। সব রেডি, ক্যামেরা রেডি, লাইট, সাউন্ড রেডি। সুধেন্দু বলতে যাচ্ছেন—টেক—হঠাৎ সেই অনুভূতি। সুধেন্দু শুনতে পেলেন অদৃশ্য সেই শক্তি বলছে রিভলভারে গুলি আছে। সুধেন্দু সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। যথার্থই তাই। চেম্বারে গুলি। অর্থাৎ ঘোড়া টেপা মাত্রই অবধারিত মৃত্যু! কার কীর্তি, কে মারতে চেয়েছিল বাংলা সিনেমার টপ হিরোকে কোন স্বার্থে, অনুমান করা গেলেও কেউ অ্যারেস্ট হল না। যে প্রপার্টি সাপ্লায়ার সুধেন্দুকে মাল সাপ্লাই দিতেন, সুধেন্দু তাকে বাতিল করে দিলেন। চক্রান্তটা ওইদিকেই হয়েছিল, কারণ সুধেন্দুর সহকারীরা সবাই পুরোনো ও বিশ্বস্ত। নায়কের মৃত্যু হলে সুধেন্দুর জেল হত।
আর একবার একটা ক্রেন ছিঁড়ে নায়িকার ঘাড়ে পড়ত। সেবারেও সুধেন্দু এইভাবেই সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন। একবার নয়, বারবার এমন ঘটনা ঘটতে থাকায় সুধেন্দু বুঝে গেছেন একটা শক্তি কাজ করছে। আজও সেই কারণে সোফায় বসে পড়লেন চোখ বুজিয়ে।
তনুকা ভয় পেয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হল! শরীর খারাপ লাগছে! একটুব্র্যান্ডি দোব?
সুধেন্দু ইঙ্গিতে থামতে বললেন।
মিনিট পাঁচেক পরে চোখ খুলে জানতে চাইলেন, টেলিফোন আছে?
ওই তো আপনার পাশেই।
তনুকা দেখছেন, সুধেন্দু একটা নম্বর ডায়াল করছেন। কোথায় করছেন জিগ্যেস করার সাহস হল না। মানুষটা কেমন যেন বদলে গেছেন কয়েক মিনিটে। মুখে-চোখে অদ্ভুত একটা উত্তেজনার ভাব।
সুধেন্দু লাইন পেয়েছেন, হ্যালো লালবাজার! কে বিকাশ বলছ; আমি সুধেন্দু। শোনো, তোমাকে এখুনি একটা কাজ করতে হবে। তোমার কয়েকজন টাফ ম্যানকে, প্লেনের কথা বলছি না, প্লেন। ড্রেসে, যে ঠিকানাটা বলছি সেইখানে পাঠাও। প্রত্যেকেই যেন আর্মড থাকে।
সুধেন্দু তনুকাকে জিগ্যেস করলেন, আপনার ঠিকানা?
তনুকা একটু ইতস্তত করছেন। লালবাজার কেন? ঠিকানা কেন?
সুধেন্দু বললেন, কুইক, কুইক। টাইম ইজ রিয়েলি শর্ট।
তনুকা যথেষ্ট অবাক হয়ে বললেন, বাষট্টি।
সুধেন্দু আবার টেলিফোনে ফিরে গেলেন, শোনো বিকাশ, তোমাকে যা করতে হবে মন দিয়ে শোনো, খুব সাইলেন্টলি, স্টিলদিলি আসতে হবে। একেবার চোরের মতো, বেড়ালের মতো। তোমাদের গাড়িটা অনেক দূরে রাখবে। গাড়ির যেন কোনও শব্দ না হয়। এইবার বাড়িটাকে। নিঃশব্দে ঘিরে ফেলবে, আর চারজনকে যে ভাবেই হোক ছাদে পাঠাবে। সেখানে দেখবে দুটো আর্মড লোক বসে আছে, তাদের ইনটেনশান হল মার্ডার। এই বাড়িতে একজনই থাকে, মহিলা, তাকে মার্ডার করবে। আমি কেন এখানে? এর উত্তর আমিও জানি না। প্রভিডেনসিয়াল বলতে পারো। জাস্ট আই কেম। জাস্ট লাইক এ টম ক্যাট। পরে বলব। পরে বলব। আমার আসার মধ্যে রহস্য কিছু নেই, আবার আছেও।
সুধেন্দু ফোন রেখে ঘরের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। ফিলম ডিরেকটারের সন্ধানী। চোখ। তিনটে জানলা, দুটো বাইরের দিকে, একটা ভেতর দিকে। বাইরের দুটোর একটা রাস্তার ওপর, আর একটার ওপাশে সংলগ্ন বাড়ি। সেখানে একটা বারান্দা। বাড়িটার কোথাও আলো জ্বলছেনা। ভূতের মতো অন্ধকারের স্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দশ বিশ গজ দূরে। বাড়িটার। চারপাশ বাগান দিয়ে ঘেরা। সুধেন্দু যে বাড়িতে বসে আছেন, সেটারও তিন দিক বাগান ঘেরা। পেছনের অনেকটা জমি, সেখানে একটা গ্যারেজ আছে। গাড়িও একটা আছে, কালেভদ্রে চলে। পেছনে বিশাল গেট আছে। গাড়ি সেই পথেই বেরোয়-ঢোকে। ওদিকে একটা কুখ্যাত বস্তি আছে। যত রকম পাপ আছে, সবই ওখানে অভ্যাস করা হয়।
সুধেন্দু নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বাইরের দিকের জানলা দুটো সাবধানে বন্ধ করে ছিটকিনি দিয়ে দিলেন।
তনুকার মুখ-চোখ দেখলে মনে হবে ভয় পেয়েছেন। সুধেন্দুর বুকের কাছে সরে গিয়ে জিগ্যেস করলেন, চাপা গলায়।
কী হয়েছে?
তোমাকে খুন করার প্ল্যান হয়েছে।
কে করেছে?
তোমার স্বামী।
সুধেন্দু তুমিতে নেমে এসেছেন। আর আপনি বলতে পারছেন না। তনুকা এখন তার কেয়ারে। তার প্রপার্টি। অন্তত এই রাতটুকুর জন্যে। সুধেন্দু বললেন, ভয় পেয়ো না। একটা কথা, ছাদ থেকে নেমে আসার কোনও দরজা খোলা আছে কি?
না, সব বন্ধ।
দরজাগুলোর স্ট্রেংথ কেমন?
ভালোই।
তনুকা একটু জোরে কথা বলে ফেলেছিল। সুধেন্দু বললেন, আস্তে। তোমাদের বাড়ির পেছনে একটা ঘোরানো সিঁড়ি আছে তিনতলার ছাদ পর্যন্ত?
আছে। বাথরুমে ঢোকার জন্যে। বাবার আমলে জমাদাররা আসত।
ওপর আর নীচের বাথরুমের দরজা বন্ধ?
নীচেরটা বন্ধ, ওপরেরটা মনে পড়ছে না।
দেখে আসতে হবে।
আমার ভয় করছে, ভীষণ ভয়!
চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। আলো জ্বালবে না। অন্ধকারে পা টিপে টিপে।
দুজনে সন্তর্পণে সিঁড়ি গুনে গুনে দোতলায় উঠলেন। অন্ধকার থইথই। বড় বড় ঘর তালাবন্ধ। কেবলই মনে হচ্ছে, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে কেউ বসে আছে, এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ে। বাথরুমের দরজাটা হাটখোলা। সুধেন্দু ফিশফিশ করে বললেন, দেখছ কাণ্ড! এর চেয়ে ভালো এন্ট্রি পয়েন্ট আর কী আছে! ঘোরানো সিঁড়ির দিকের দরজাটাও খোলা।
সুধেন্দু এক মুহূর্ত দেরি না করে তনুকার হাত ধরে বাথরুমে টেনে নিয়ে দু-পাশের দরজাই বন্ধ করে দিলেন। বাথরুমের আলোর সুইচ বাইরে।
তনুকা বললেন, কী ব্যাপার!
কেউ একজন দোতলায় আছে ঘাপটি মেরে। দোতলার সব ঘরই কী তালা বন্ধ?
না, দুটো ঘর খোলা আছে।
এই সার্ভিস ডোরটা খোলা কেন?
জানি না।
জমাদার আসে এখানে?
না।
তাহলে?
কাল একজন এসেছিল, ইলেকট্রিশিয়ান, গিজারের লাইন দেখতে।
তুমি আসতে বলেছিলে?
না, নিজের থেকেই এসেছিল।
কত দিনের লোক!
ওর পরিচিত।
আই সি।
আমাদের এখানে কতক্ষণ থাকতে হবে?
যতক্ষণ না পুলিশ এসে বাড়ি ক্লিয়ার করছে। তুমি এই গিজার ব্যবহার করবে না। আমার লোক এসে যতক্ষণ না ওকে বলছে।
বাথটবের পাড়ে দুজনে কোনওক্রমে বসলেন। নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত। কোথাও সামান্য শব্দ হলেও শোনা যাচ্ছে। বাথরুমের বাইরে খুব সন্তর্পণে চলাফেরার শব্দ হল। তনুকা ভয়ে সুধেন্দুকে জড়িয়ে ধরলেন। জমাদার আসার দরজাটা বাইরে থেকে কে যেন ঠেলল একবার। লোহার সিঁড়িতে জুতোর তলায় বালি মাড়াবার শব্দ। দুটো প্রাণী আবদ্ধ খাঁচায়, বাইরে হায়নার দল। শুকছে, আঁচড়াচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে না–পুলিশের দল, এল কি এল না। টাইমিং ঘড়িতে দুটো বাজল। পুলিশের তো এসে পড়া উচিত। বাড়িটা সার্ভে করবে। তখন ঘোরানো লোহার সিঁড়িটানজরে পড়বেই। তনুকার শরীরটা ক্রমশ বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে সুধেন্দুর শরীরে এলিয়ে আসছে। সুধেন্দুর খুব। মায়া হল। মেয়েদের জীবন বড় কষ্টের। বড় হলে বাবা, মা ভাবে পর, আর স্বামী যদি শয়তান হয় ঘাটে ঘাটে ভেসে বেড়ানো। প্রকৃত বিশুদ্ধ ভালোবাসা দেওয়ার কেউ নেই। না ঘরকা, না ঘাটকা। এর ফলে মেয়েরা ক্রমশই মারমুখী, তিরিক্ষি স্বভাবের হয়ে উঠছে।
সুধেন্দুর প্রখর শ্রবণশক্তি। বহু দূরে একটা গাড়ির শব্দ হল। শব্দটা শুনেই মনে হল, একটা ভ্যান। বাঁধুনী আলগা। বহু ব্যবহারে পুলিশের গাড়ি যেমন হয়। সুধেন্দু আশ্বস্ত হলেন। বিকাশের ফৌজ এসেছে, এখন দেখা যাক অপারেশনটা কীভাবে চালায়। দেখা তো যাবে না, শব্দ শুনে বুঝতে হবে।
ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে পরপর কয়েকজন ছাদের দিকে গেল। শব্দে তাই মনে হল। বাথরুমের মাথার ওপর ছাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ধস্তাধস্তির শব্দ। বাথরুমের বারান্দার বাইরে একটা শব্দ হল। কেউ একজন পালাচ্ছে নীচের দিকে। সুধেন্দু সার্ভিস ডোরটা সাবধানে খুললেন, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অন্ধকারে দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। সুধেন্দু বললেন, বিকাশ কোথায়!
এই তো আমি। কে সুধেন্দু?
হ্যাঁ উঠে এসো, ভেতরে একজন আছে।
দাঁড়াও, নীচের ব্যারিকেডটা তৈরি করি। সে ব্যাটা বাথরুমের জমাদারদের দরজা দিয়েই পালাবার চেষ্টা করবে।
বিকাশ মল্লিক অবশেষে দোতলার বাথরুমে এসে উঠলেন।
শেষে এইখানে আশ্রয় নিয়েছিলে? জায়গাটা বেশ ভালোই।
কী করব, তা না হলে মেয়েটাকে মেরে ফেলত। তুমি দরজাটা খুলে ভেতরে যাও। আমি নীচের দিকে পালাবার শব্দ শুনেছি।
পুলিশের পাকা অফিসার বিকাশ বললেন, তোমরা দুজনে বাথটাবে শুয়ে পড়ো। ফায়ার করলেও সেফ থাকবে। সুধেন্দু আর তনুকাকে আদেশ মানতেই হল। বিকাশদরজার পাল্লাটা খুলতে খুলতে পাশে সরছেন। হঠাৎ গুলি করলেও গায়ে লাগবে না। বাইরে বেরিয়ে করিডরের আলো সব জ্বেলে দিলেন। কেউ কোথাও নেই। নীচে নেমে এলেন। পেছনে তাঁর সতর্ক প্রহরী।
সব শেষে তাঁরা এলেন বাইরের ঘরে। ফটফট করছে আলো। ফনফন করে পাখা ঘুরছে। সোফায় দিব্যি আরামে ঠ্যাং তুলে একজন স্বাস্থ্যবান লোক বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
বিকাশ তাঁর সহকারী, সুধেন্দু আর তনুকা ঘরে। সোফায় আরাম করে বসে আছে যে, সে কে!
বিকাশই প্রশ্ন করলেন, আপনি কে?
আলোর দিকে ধোঁয়া ছেড়ে লোকটি বললে, প্রশ্নটা তো আমারই করা উচিত, আমার বাড়িতে এই শেষ রাতে আপনারা কারা?
বিকাশ বললেন, মানে? আপনার বাড়ি মানে?
স্ত্রীর বাড়ি মানে স্বামীরই বাড়ি। সব দেশের আইনে সেই কথাই বলে মিস্টার পুলিশ অফিসার!
বিকাশ তনুকাকে জিগ্যেস করলেন, এঁকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ, একসময় আমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, তবে আমি ডিভোর্স চেয়ে মামলা করেছি। সেই মামলা চলছে।
আপনারা যখন বাথরুমে ছিলেন, তখন ইনি কোথায় ছিলেন? এইখানে?
না।
তাহলে কোথায় ছিলেন?
জানি না।
সুধেন্দু এগিয়ে এসে বললেন, আমি বলছি, ইনি বাড়ির ছাদ দিয়ে দোতলায় ঘাপটি মেরে বসেছিলেন। উদ্দেশ্য খুব একটা সাধু ছিল না বলে মনে হচ্ছে। তুমি ছাদে যে-দুটোকে ধরেছ তাদের জেরা করলেই জানতে পারবে। যে লোকটা দোতলায় ঘুরছিল সেই তোমার তাড়া খেয়ে নীচে এসে না পালিয়ে এইখানে এসে জমিয়ে বসে পড়েছেন।
ধীরে-সুস্থে আর একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে সেই লোকটি বললেন, আপনারা বসুন না, দাঁড়িয়ে কেন চা কফি কিছু খাবেন কি!
বিকাশ বললেন, সে পরে হবে, আপাতত আমরা আপনাকে একটু কষ্ট দেব, আমাদের সঙ্গে লালবাজারে যেতে হবে। সেখানেই আমরা আপনাকে চা খাওয়াব!
কোন অপরাধে! নিজের স্ত্রীর কাছে থাকার অপরাধে? যে স্ত্রী একটা আধবুড়ো লোককে এনে নিজের শোবার ঘরে তোলে তার স্বামী বাইরের ঘরে ব্রথেল কীপারের মতো বসে বসে সিগারেট টানে।
ছাদের লোক দুটো কোথা থেকে এল? ওরা কার অপেক্ষায় ছিল?
আমার অপেক্ষায়।
মানে?
মানে খুব সহজ, আজ এখানে আমাকে আসতে বলা হয়েছিল। অ্যান্ড দে লেভ আউট এ নাইস মার্ডার প্ল্যান অর ট্র্যাপ। প্রফেশনাল মার্ডারারকে ছাদে মজুত রেখেছিল।
বিকাশমল্লিক বললেন, আমার কাছে খবরটা গেল কী করে! হু ইনফর্মড মি?
বিকাশ সুধেন্দুর হাতে একটা চিমটি কাটলেন; অর্থাৎ চুপ থাকো।
লোকটি একটু নার্ভাস হলেন। একটু ইতস্তত করলেন, সিগারেট ধরা হাত একটু কাঁপল। বিকাশের নজর এড়াল না। অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসাররা এই মুহূর্তে অপরাধীকে চেপে ধরেন। দুর্বল মুহূর্ত।
লোকটি বললেন, দ্যাটস মাই গুড ফরচুন। আপনি খবর পেয়েছিলেন বলে আমি এখনও বেঁচে আছি।
আপনার সব খবর, আপনার আসল উদ্দেশ্য সব আমরা জেনে গেছি। আপনি যাদের ওপর। নির্ভর করেছেন তারা খুব বেসামাল মানুষ। আপনার এই যুক্তি আদালত মানবে তো!
লোকটি আধখাওয়া সিগারেট অ্যাশট্রে-তে চেপে রেখে বাঁ দিকে একটু কাত হলেন। সেই অবস্থা থেকে সোজা হতে হতে বললেন, এই যুক্তিটা তো মানবে যে, আমি সত্যিই তনুকাকে। ভালোবাসি। আর, ভালোবাসা আর ঘৃণার খুব তফাত নেই মিঃ অফিসার। আমি যে গভীরতায় যে ইনটেনসিটিতে ঘৃণা করি, ঠিক সেই ইনটেনসিটিতে ভালোবাসি। আমি পাইলট, আকাশ আমার ঠিকানা।
লোকটি চকিতে রগে রিভলভার চেপে গুলি করলেন। সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েও কিছু করা গেল না।
তনুকা ছিটকে সামনে এসে দাঁড়ালেন। একেবারে স্থির পাথরের মূর্তি। সেই মূর্তির তলায় একটি নিহত মানুষ। আকাশযার ঠিকানা। দুর্বোধ্য মানব সংসারের মাথার ওপর বিশাল এক ছাদের মতো। কখনও নীল, কখনও কালো।