ইচ্ছে পূরণ
শরীরটা অন্ধকার খাদের গহ্বরে তলিয়ে যাবার সময় তিথির মুখটা মনে পড়ছিল বারবার। অতলে নামতে নামতে ঐ যে বড় পাথরটায় লাগলো মাথাটা! কেদারনাথ থেকে নিমেষে এসে পৌঁছালাম লালগেড়িয়ায়। আমার তিথি ঘুমিয়ে আছে দিদার পাশে। আমি নিশ্চিন্ত।মেয়ের মুখটা আজ যেন মায়াময় লাগছে। আঁধার নেমে আসছে আমার চারপাশে…..
পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম লালগেড়িয়া। শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি সেভাবে, অভাবের তাড়নায়। দরিদ্র ঘরে মেয়ে বড় হওয়া মানেই তো আঁধার ঘনিয়ে আসা। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হয় নি। আমি কে? ক্ষুদ্র চাষী নৃপেন্দ্র মন্ডলের চতুর্থ কন্যা আকাঙ্ক্ষা। নামটা সুন্দর হলেও ছিলাম আমি অনাকাঙ্ক্ষিত। তাই পঞ্চম বারে পুত্র সন্তানের মুখ দেখেছিলেন বাবা। আমি তাই অনাদরেই বড় হয়েছি।বড় দুই দিদির বিয়ের কথা মনে নেই। ছোড়দির যখন বিয়ে হয় তখন আমি সবে ষোল। গুনে সরস্বতী না হলেও রূপে মা লক্ষী সবাই বলতো।গরীবের মেয়ে, তাই এরপর গল্পটা খুব ছোট। একদিন মেজদির বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এলো। ছেলে স্কুল মাস্টার। সতেরো বছর হতেই বিয়ে। আঠারোয় কোল আলো করে এলো তিথি। বছর পাঁচেক ভালোমন্দেই কেটে গেল দাম্পত্য।
সমস্যা শুরু হল মৃণালের বদলীর পর থেকেই। মুর্শিদাবাদ থেকে আমরা চলে এলাম মহানগরে। আমার আটপৌরে আদবকায়দা বড্ড বেমানান এখানে। আজকাল, বাড়ি ফিরতে খুব রাত হয় মৃণালের। জিজ্ঞাসা করলেই বলে, “স্কুল শেষে টিউশন পড়িয়ে ফিরতে তো দেরী হবেই”। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। এভাবেই একদিন চলে এলো মেয়ের জন্মদিন। মৃণাল স্কুলের বন্ধুদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালো। সুচেতাকে সেদিন প্রথম দেখা। বেশ প্রাণবন্ত স্কুল শিক্ষিকা। আগে গুণগান বহুবার শুনেছি মৃণালের মুখে। সেদিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে, সবাই খাবারে ব্যস্ত থাকলেও, ওদের দু’জনকে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি অন্তরঙ্গ ভাবে, বাড়ির ছাদে। সবাই চলে গেলে প্রশ্ন করায় উত্তর পেয়েছিলাম, “ও আমার ছোটবেলার বন্ধু, তোমার নোংরামি বন্ধ করো।”
চিরদিন আমি শিবভক্ত। ইচ্ছে ছিল কেদারনাথ দর্শনের। মৃণালকে বললেই বলতো, “বাচ্চা ছোট, তাছাড়া স্কুলে ছুটি পাবোনা।”এভাবেই পেরিয়ে গেছে বছরের পর বছর। হঠাৎ একদিন দুটো টিকিট হাতে দিয়ে বললো, ” পরশু তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে। তিথিকে মায়ের কাছে রেখে এসো।” দীর্ঘদিনের ইচ্ছে হঠাৎ পূরণ হতে চলেছে, মনে খুশীর জোয়ার।
ভুলটা ভাঙলো দ্বিতীয় দিন। দর্শন শেষে বেরিয়ে এসে হঠাৎ দেখা সুচেতার সাথে। পূর্বের ঘটনা না তুলে স্বাভাবিক থাকলাম। ও এলো আমাদের হোটেলে। বিকালে দেখি লাগেজ নিয়ে চলে এলো পাশের রুমে। আমার মনের ঘরে মেঘের ঘনঘটা। পরেরদিন সকালে সবাই একটু দেরীতে ঘুরতে বার হলাম। আমরা নালাচটিতে দাঁড়িয়ে পাহাড়ী ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। হঠাৎ মৃণাল বলে উঠলো, “তোমার ইচ্ছে পূরণ করে দিলাম, এবার আমায় মুক্তি দাও।আমি সুচেতাকে বিয়ে করতে চাই” আমি হতবাক! ঠিক শুনছি তো! যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছি না! চিৎকার করে বলে উঠলাম, “এ স্বপ্ন তোমার কোনদিনই পূরণ হবে না,আমি বেঁচে থাকতে”। ক্রমশঃ বাকবিতন্ডা বাড়তে থাকে। সহসা মৃণাল ক্রুর হাসি মিশ্রিত স্বরে বলে ওঠে, “তবে তোমার ইচ্ছে পূরণ হোক,” এরপর সজোরে একটা ধাক্কা…….