বিষাক্ত সমাজ
আজ আমার নাতির জন্মদিন।বেশ ঘটা করে পার্টি চলছে, হৈহৈ..ব্যাপার। আমার ছেলে কুনাল অ্যাপোলোর জেনারেল ফিজিসিয়ান, বৌমা নার্সিং স্টাফ। গরীবের মেয়ে কিন্তু অহংকারী খুব। শাশুড়ির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা ভক্তি ,কর্তব্যবোধ কিছুই নেই।আসলে আমার ছেলেকেই আমি ভালভাবে মানুষ করতে পারিনি। বৌমা’তো পরের বাড়ির মেয়ে। সামনে নাতির জন্মদিন, ঠাকুমাকে আসতে তো হবে । কিন্তু বৌমার আপত্তি, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা। ওদের মতো ফটর ফটর করে ইংরেজি বলতে পারিনা। ছেলে অ্যাপোলোর কাছাকাছি ফ্ল্যাটে থাকে আর আমরা বুড়ো বুড়ি ব্যারাকপুরে থাকি। স্বামীর বারণ সত্ত্বেও ছেলের ফ্ল্যাটে আমি একাই চলে আসি। ছেলে আমায় দেখে বলে, কেন’গো বাবা ভালো খাবার খাওয়াচ্ছে না বুঝি। আমি মজার ছলে বললাম ঠিক বলেছিস।তাইতো নাতির জন্মদিনে কব্জি ডুবিয়ে খাবো। বৌমা বলে দিল, ইস এই বয়সে আপনার এত লোভ! শোনো বৌমা, মা – ছেলের মধ্যে ঢুকবে না। আমার একমাত্র নাতি, আমি আসব না!!
সন্ধ্যা হতেই সারা বাড়িতে ঝলমল আলো। প্রচুর লোক নিমন্ত্রিত। কিন্তু ছেলের আদেশ নীচের হলে আমি না যাই।সময়মত খাবার তোমাকে দিয়ে যাওয়া হবে। আমি অনুষ্ঠানে যেতে পারবো না! মন খারাপ করে ঘরে বসে স্বামীর কথা ভাবছিলাম।হৈ চৈ হাসাহাসি সব শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ বৌমার সাথে এক ভদ্রলোক ওপরে আসেন। সামনে যাওয়া বারণ,তাই আড়াল থেকে দেখছিলাম।বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকের শরীর অস্হির করছিল ।এত গান বাজনার শব্দ। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই ডিস্কো টাইপ গান,নাচ পছন্দ করে।হয়তো তাইজন্য ছেলে আমাকে আননন্দানুষ্ঠানে যেতে বারণ করেছে। বৌমা ওনাকে বসিয়ে রেখে চলে যায় অনুষ্ঠানে।উনি বসে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলেন। উনি খাটের পাশে আয়না দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে বলেন, আরে সোমা তুই! আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে বলি, ভাস্কর দাদা!! তুমি আমার নাতির জন্মদিনে এসেছ! খুব খুশি হলাম। তারপর দুই জনের কত এলোমেলো গল্প । গল্প কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। অবশ্য গল্পের কোনো মাথা ও লেজ ছিল না। ওটা সেটা আলোচনা করে ভাস্করদা বলে চলো চলো নিচে চলো। আমাদের নাতির জন্মদিন ,কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ ডক্টর ভাস্কর সোমাকে টানতে টানতে নীচে নিয়ে যান।
ছেলে – বৌমা প্রচণ্ড রেগে গেছে,একে তো নিচে যাওয়া বারণ ,তারপর দুজনের হাত ধরা দেখে। বৌমা এসে বলে ওনাকে কেন নীচে আনলেন স্যার। উনি পার্টিতে কি করবেন! আমি বৌমা আসতে চাই নি। উনি তো জোর করে আনলেন। আরিব্বাস কি বললে ডাক্তার বাবু তোমাকে জোর করেছেন! তাও যদি রূপসী হতে! বৌমা মায়ের সাথে ভদ্রভাবে কথা বলবে। নিজের মায়ের সঙ্গে এইভাবে কথা বলো বুঝি! ডাক্তার তো মজা দেখছিলেন,আর ভাবছিলেন এরা হলো আধুনিক ছেলের আধুনিকা স্ত্রী। এতক্ষণে ডাক্তার মুখ খুললেন- আচ্ছা তুমি কি বলছিলে, তোমার শাশুড়িকে কেন নিচে আনলাম। কেন বলোতো উনি কি পাগলী,কামড়ে দেয় বুঝি!! ডক্টর এবার কড়া সুরে বলেন কেন আমরা যা করছি উনিও তাই করবেন। স্যার একটা প্রেস্টিজ আছে তো! স্যার বলেন, কিসের প্রেস্টিজ??? স্যার উনার কোনো ক্লাস নেই। ক্লাস বলতে কি বলছ একটু বুঝিয়ে বলবে!
ছেলে বলল নাহলে নাচতে নাচতে পরপুরুষের হাত ধরে খেতে আসে। ভাস্কর স্যার সপাটে কুনালের মুখে চড় মারলো!ইডিয়ট ,গবেট মায়ের কিসের ক্লাস!! এই কুনাল, তুমি ডাক্তার হয়েছ কার দৌলতে! কুনাল বলে, জন্ম দিয়েছে তাই পড়িয়েছে। স্যার আপনি চড় মারলেন কেন?? এখনো কি আমি আপনার ছাত্র? একঘর লোকের সামনে এত অপমান!এখন আপনার ও আমার মধ্যে পার্থক্য কি? আপনাকে ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ঘাড়…. থাক ভাস্কর সেই উপকার নাই বা করলে। মা তোমাকে নিচে আসতে বারণ করেছিলাম তো।উত্তর দাও কেন??? ক্ষিদে পেয়েছিল বুঝি!!
ভাস্কর স্যার যেতে যেতে বললেন নবাগত ডাক্তার তবে শোনো একটা ঘটনা। আর এই ঘটনা তোমাকে শুনতেই হবে। নাহলে ভাই বোনের এক পবিত্র সম্পর্কতে কালি যে পড়বে। সেদিন লাস্ট লোকালে এক জড়বুদ্ধি সন্তানসম্ভবা ষোল বছরের মেয়েকে বেশ কয়েকজন ধর্ষণ করতে আসে।তখন এই সোমা ও তাঁর স্বামী পুলিশকে ফোন করে রক্ষা করে ওই হাবাগোবা ষোড়শীকে।হাবা মেয়েটি আগেই ধর্ষিতা হয়েছিল।কোন পাষণ্ড এরকম কুকর্ম করেছে! তারপর ওনারা নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। আমি তখন সদ্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেছি।সময় হলে অন্তঃসত্ত্বা ষোড়শীকে ডেলিভারি করায়। কিন্তু বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে ষোড়শী মারা যায়।তারপর ওই বাচ্চার মা – বাবার সব কর্তব্য পালন করে নিঃসন্তান সোমাদেবী ও তাঁর স্বামী বিজয় বাবু।হয়ত ভাবছেন সবাই নিঃসন্তান ছিল বলে মানুষ করেছে ওই ফুটফুটে সন্তান কে। কিন্তু ওরা ইচ্ছে করলেই বাচ্চা আনতে পারতেন,কারণ তাঁদের বিবাহিত জীবন মাত্র দু বছরের।। তাঁরা ভেবেছিলেন কোন কারণে সন্তান জন্ম দেয় সোমা, সেই সন্তান বড় ভাইয়ের জন্ম পরিচয় কোন রকমে জেনে গিয়ে দাদাকে অজাত,কুজাত বলে গালি দেয়,তাহলে সোমা ও তাঁর স্বামী সহ্য করতে পারবে না। আসলে ক্লাস বলছিলে না… তোমার ক্লাস কি???? পাগলীর ছেলে! বেজন্মা!! আরে নিজের মামাতো বোনের হাত ধরলে অন্যায় বুঝি! তোমার বৌ যে লাল জল খাচ্ছে,সেটা ক্লাস বুঝি! কি তুমুল অশান্তি, চিৎকার চেঁচামেচি।আজ তোমার স্হান ছিল রাস্তায়,লোকে ভিখারির বাচ্চা বলত। তুমি কিনা মন্ডা,মিঠাই খেয়ে বড় হয়েছ।ডাক্তার হয়েছ! ডাস্টবিন থেকে ফেলে দেওয়া পচা খাবার খেয়ে বড় হবার ছিল। সোমা এই বাড়িতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কোনো রকম পালিয়ে স্টেশনে আসে। প্রৌঢ়া সোমা সবার অজান্তে সেদিন লাস্ট লোকাল ট্রেন ধরে স্বামীর কাছে ফিরছে…..। ফেরা আর হয় নি বাড়ি…ভোর রাতের ব্যারাকপুর লোকাল অপরদিক হতে ছুটে আসা ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ। চারিদিকে কাতর আর্তনাদ।
তারমধ্যে সোমা সবাইকে বলছে কেঁদো না , আমার ছেলের কাছে চলো , চিকিৎসা করিয়ে আনি… ওখান থেকে কোথায় হারিয়ে যায়!উন্মাদের মতো বকতে বকতে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বেঁচে হয়তো আছে শুধু বাড়ির ঠিকানা মনে নেই। সোমার বৌমা বলে পাগলীর ছেলে তার বর,যতই বড় ডাক্তার হোক না কেন,তার সাথে কি করে ঘর করব, তার সন্তানের মা হবো। ছিঃ ছিঃ এতদিন এই রকম বদ রক্তের সাথে বসবাস করে গা যেন ঘিনঘিন করছিল। ডাক্তার তার মাকে পাঁচ বছর পর এক আশ্রমের ধারে দেখতে পেয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। ছেলে চিকিৎসা করিয়ে অনেক ভালো করিয়েছে। ওরা মা বেটায় এখন দিব্যি আছে। তবে বাবা আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।