Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছত্রিশ পাড়ার উপকথা || Manisha Palmal

ছত্রিশ পাড়ার উপকথা || Manisha Palmal

ছত্রিশ পাড়ার উপকথা

রেল নগরী খড্গপুর পৌরসভার এক ছোট্ট প্রান্তিক অংশ আমি। আই আই টি লাগোয়া একটি ছোট্ট বহু ভাষাভাষী অঞ্চল। আইআইটি উড়ালপুলের পাশে পুরী গেট সংলগ্ন যে অঞ্চলটা একসময় সাম্পেটা বস্তি নামে পরিচিত ছিল বর্তমানে যাকে আম্বেদকর নগর বলা হয় আমি সেই ছত্রিশ পাডা গো! আমার ভোর হয় রেলের বাঁশি আর মাইকে সংস্কৃত স্তোত্রের সাথে! আমার জন্ম হয়েছে রেল শহরে আসা অন্ধ তেলেঙ্গানাওডিশার বহু ভাষাভাষী মানুষজনের বসতি গড়া দিয়ে। আজ থেকে পাঁচ দশক আগে এই অঞ্চল টা ছিল কিছু আদিবাসীর বাসস্থান। ধূ ধূ মাঠ।রেললাইনের পাশে কুর্চি ভূতভৈরবী খেজুরের জঙ্গল। মাঝে মাঝে দু একটা মাটির কুঁড়েঘর। রেল কারখানায় কাজ করতে আসা তেলেগু তামিল ওড়িয়া মানুষজন এখানে বসতি তৈরি করলো। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মিলিত বসতি হয়ে উঠল “ছত্রিশ পাড়া “নামে! অঞ্চলের সবার মুখের ভাষা হল হিন্দী। সংলগ্ন ঝাপেটা পুর,তল ঝুলি এলাকায় অনেক বিহারী ও উত্তর প্রদেশের মানুষ বসবাস করতেন। এই অঞ্চল টা পুরোপুরি বাংলায় থাকা” মিনি ভারতের “প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলো। তখন এখানকার বসবাসকারী মানুষ গুলোর বেশির ভাগই ছিল নিম্নবিত্ত! কয়েকজন মাত্র সম্পন্ন। তাই তথাকথিত ভদ্রলোকরা এই বস্তি টাকে এড়িয়ে চলতো। আমার “ছত্রিশ পাডা ” নামটা সার্থক হয়েছিল এই বহু ভাষাভাষী বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের একসাথে মিলেমিশে থাকার কারণেই! বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের নিজস্ব ধর্মচারণ করতো। একে অপরের উৎসবে সাগ্রহে অংশ নিত ।বড় আন্তরিক ছিলো এই সমাজ। বেশ কয়েক ঘর তেলেগু খ্রিস্টান ও থাকতো এখানে। রেললাইনের গা ঘেঁষে ছিল তাদের ছোট্ট চার্চ। বড়দিনে পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘরে তৈরি কেক ও রোজকুকি পাঠানো ছিল এদের প্রথা। বড় মন ছোঁয়া আন্তরিক প্রথা। এখানকার যে কোনো উৎসবেই ফুল ও ফুলের মালা লাগাতো । হাতে কাচের চুড়ি গলায় মঙ্গলসূত্র মাথায় ফুল লাগানো দক্ষিণী মাতৃমূর্তি খড়্গপুরের খুবই পরিচিত ছবি।
এই তেলেগু উড়িয়া ভাষাভাষী মানুষ দের প্রধান উৎসব হলো মাতা পূজা। বাংলা চৈত্র মাসের অমাবস্যার দিন টি তেলেগুদের নববর্ষের প্রথমদিন। এই দিনটিতে তারা মঙ্গলকামনায় মাতা মায়ের আরাধনা করেন। জলপূর্ণ ঘটে নিম পাতা দিয়ে ঘটের উপর মায়ের মুন্ডমূর্তি তৈরি করা হয় বাটা হলুদ দিয়ে। কালী মহা লক্ষী দূর্গা গায়ত্রী ইত্যাদি রূপে মায়ের মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয়। পূজার দিন মায়ের মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা করে মন্দিরে যাওয়া হয়। মাতা মায়ের শোভাযাত্রা যে যে রাস্তা দিয়ে যাবে সেখানে সুন্দর ফুল ও নিমপাতা দিয়ে তোরণ সাজানো হয়। অনেকেই নতুন কাপড় পেতে দেন শোভাযাত্রা সামনে।
মাতা পূজার ব্রতীরা একসাথে 5/7 জন থাকেন। এরা পুজোর ক’দিন সংযমে থাকেন ও মন্দিরে ফলাহার করেন। এরাই মায়ের মুর্তি মাথায় নিয়ে শোভাযাত্রায় যান। শোভাযাত্রার সামনে “কালী” নামের নৃত্যশিল্পী মাকে নাচ দেখান! এছাড়া” বাঘ নাচ” ও হয়। সারা গায়ে হলুদ কালো ডোরাকাটা মুখে বাঘের মুখোশ পরে তাসার তালে তালে অদ্ভুত লোক নূত্য এইবার বাঘনাচ। অনেকে মায়ের কাছে মানসিক করেন এই নাচের। মনস্কামনা পূর্ণ হলে মায়ের পুজো র শোভাযাত্রায় বাঘ নাচ করে মানসিক শোধ করেন। ছত্রিশপাড়ার প্রতিটি রাস্তার মোড়ে রঙিন রঙ্গলি একে মাকে আবাহন করা হয়। অনেকে মায়ের মূর্তি মাথায় ব্রতীদের সামনে মাটিতে শুয়ে পড়েন। ছোট শিশুদের শুইয়ে দেন। মূর্তি মাথায় ব্রতীরা এই মানুষদের ডিঙিয়ে চলে যান। বিশ্বাস এইভাবে ডিঙিয়ে গেলে রোগব্যাধি বিপদ আপদ দূর হয়ে যায়। অনেকব্রতীদের পায়ে হলুদ গোলা জল ঢালেন।
মাতামা মা শীতলারই রূপ। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ছত্রিশ পাড়ার সবাই এতে অংশ নেয়। মাতৃ বন্দনা র তেলেগু গীতের সারা পাডা মুখরিত থাকে।
আমার বুকে ধীরে-ধীরে পরিবর্তনের ঢেউ লাগলো। কিছু অবস্থাপন্ন মানুষ বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করলেন। আস্তে আস্তে ছত্রিশ পাড়া তার আগের গ্রাম্য ভাবমূর্তি ছেড়ে শহুরে রুপ ধারণ করলো। আধুনিকতা এল। নবরাত্রি তে দান্ডিয়ার প্রচলন হলো। সেই রেললাইনের পাশের ছোট্ট চার্চটা বিরাট হল। সারা “ছত্রিশ পাড়া” আধুনিকতা ও নাগরিকতার চাদরে ঢাকা পডলো।”ছত্রিশ পাডা” নামটা এখন আর কেউ পছন্দ করেনা। এখন “আম্বেদকর নগর “এই পোশাকী নামে ঢাকা পড়লাম আমি।
আজও নিগাঘী দুপুরে বট অশ্বথথ গাছের ছায়ায় যখন বেনে বউ , দোয়েল বুলবুলি আশ্রয় নেয় আমার মনে পড়ে যায় সেই মানুষগুলোর কথা যারা এই ছত্রিশ পাডাকে এক পরিবারের মতো মনে করত। মাতা পূজার ঐক্যে ডোরে বাঙালি তেলেগু বিহারী উড়িয়া নির্বিশেষে সবাইকে এক সুত্রে বেঁধে ছিল। আজও সেই বাঁধন তেমনি আছে। এইতো শাশ্বত ভারতের শিক্ষা— বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য– বিবিধের মাঝে মিলন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *