“ধর্ম” কি ঠুনকো এক বস্তু?
আমি অতি স্বল্প বুদ্ধির এক ক্ষুদ্র প্রাণী। প্রথমেই বুঝি জগতে টিকে থাকবার পক্ষে সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন একটি আশ্রয়, যে আশ্রয় জন্মগতভাবে পেয়ে আসি, বিভক্ত নানা স্রোতে, পরিচয় তার “ধর্ম “। ভালো, তারপর গড়ে ওঠে নিজস্ব মতবাদ। রাসায়নিক শাস্ত্রে, মৌলিক, যৌগিক সব বস্তুর চরিত্র বোঝাতে ইংরেজীতে বলে — Property যা দুরকম -physical , chemical আসলে বাহ্যিক আর অন্তর্গত আর property এর বাংলা তর্জমা রসায়ন বিজ্ঞানে হলো ” ধর্ম ” আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জীবন ধারণের প্রধান সহায়, কিন্ত অনেক প্রতিবন্ধি মানুষও আছেন, যেমন ধরুন কোন মানুষের হাতদুটিই নেই তা সে যে কারণেই হউক, কিন্ত তিনি দমে না থেকে বা অপরের সাহায্য ব্যতিরেকেই নিজ পদযুগলের সাহায্যে সব কিছু করেন, এমন কি লেখা, ছবি আঁকা, খাওয়া সব ….. তিনি যদি সে “পা” ( শরীরের এক অঙ্গ) এর সাহায্যে দেবতা বা ধর্ম গুরুর ছবি অঙ্কন করেন বা নিরীশ্বরবাদিদের পুস্তক লেখেন বা সে পুস্তক পা দিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে পড়েন, তাহলে কি ধর্মের অবমাননা হবে? বলবেন , তার ত কোন উপায় নেই, এইত…. কিন্তু কেন পদ অঙ্গ নিকৃষ্ট হবে, অনিচ্ছাকৃত স্পর্শে তা অপবিত্র হবে কেন? “গীতা” বা অন্য ধর্ম গ্রন্থ আমরা নিয়ত পড়ি হাতে নিয়ে কিন্তু কোন কারণে অনিচ্ছাকৃত ভাবে পায়ে লেগে গেলে, অনুতপ্ত হয়ে বার বার নমস্কার করি। কেন ? যে পদযুগল আমাদের চলনদার, শক্তির আধার অথচ অপবিত্র ভাবতে একটুকুও দ্বিধা হয় না। হ্যাঁ, তবে অবশ্যই পরিচ্ছন্নতার একটি প্রশ্ন ত আছেই। কিন্তু পা ত শুধুমাত্র এক অপরিহার্য অঙ্গ তার স্পর্শে কোন বস্তু অপবিত্র হবে কেন?
বাবা লোকনাথ বলতেন কে হরি, তোদের হরির উপর আমি দাঁড়িয়ে আছি, পায়ের তলে হরি…… ধরিত্রী প্রধান হলো মৃত্তিকা, সে মৃত্তিকাকে আমি পা দিয়ে আঁকড়ে রেখেছি। মৃত্তিকা যদি তাতে অপবিত্র না হন তাহলে পা অপবিত্র হবে কেন? ঈশ্বর সর্বত্র, আমাদের সর্ব অঙ্গেই তিনি বিরাজমান। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের কোন্ ধর্ম ছিল? তিনি ত জন্মগতভাবে ব্রাহ্ম ছিলেন। কেন হঠাৎই তিনি রাখী বন্ধনে (শ্রীকৃষ্ণের রক্ষাবন্ধন উৎসব)মেতে উঠলেন ভাতৃত্ত্বের বন্ধনে বাঁধবার সূত্রে শুধুমাত্র মানুষ ( যে ধর্ম গোষ্ঠির হউক) আকারধারীদের প্রতি? একশ বছর আগে শরৎচন্দ্রের বিতর্কিত উপন্যাস ” গৃহদাহ” ঝড় তুলেছিল সমাজে।
ভ্রষ্টা চরিত্র “অচলা”র সংস্পর্শে এক ব্রাহ্মণের ধর্ম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল নাকি, কি বলেছিলেন শরৎচন্দ্র ,মহিমের চিন্তাধারার মাধ্যমে—- আচারনিষ্ঠ রামবাবু যখন জানতে পারলেন তিনি কুলটা অচলার হাতে অন্নজল গ্রহণ করেছেন, তিনি তার নিজ জাত ধর্ম রক্ষার জন্য কাশীতে প্রায়শ্চিত্ত করতে গেলেন। মহিম মনে মনে বলল , “….. অচলার অপরাধের বিচার না হয় পরে চিন্তা করিবে, কিন্ত ও এই আচার-পরায়ন ব্রাহ্মণের এই ধর্ম কোন্ সত্যকার ধর্ম, যাহা সামান্য একটা মেয়ের প্রতারণায় এক নিমেষে ধুলিসাৎ হইয়া গেল, যে ধর্ম অত্যাচারের আঘাত হইতে নিজেকে এবং অপরকে রক্ষা করিতে পারে না, বরঞ্চ তাহাকে মৃত্যু হইতে বাঁচাইতে সমস্ত শক্তি অহরহ উদ্যত রাখিতে হয়। সে কিসের ধর্ম এবং মানবজীবনে তাহার প্রয়োজনীয়তা কোন্ খানে ? যে ধর্ম স্নেহের মর্যাদা রাখিতে দিল না, নিঃসহায় আর্ত্ত নারীকে মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া যাইতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করিল না, আঘাত খাইয়া যে ধর্ম এতবড় স্নেহশীল বৃদ্ধকে এমন চঞ্চল প্রতিহিংসায় এরূপ নিষ্ঠুর করিয়া দিল, সে কিসের ধর্ম? ইহাকে যে স্বীকার করিয়াছে, সে কোন্ সত্য বস্তু বহন করিতেছে? যাহা ধর্ম সে ত বর্মের মতো আঘাত সহিবার জন্যই! সেই ত তার শেষ পরীক্ষা!”
একবার শুধু জীবনচক্র ভাবুন, ঈশ্বরকে জানা ও বোঝা ১৪টি ইন্দ্রিয়সম্পন্ন মানুষের পক্ষে অসম্ভব । ত্রিমাত্রিক জগতের জীব আমরা– ক্ষমতাই নেই , বহুমাত্রিক জগতে ঘুরপাক খাবার, কেন এত বিশাল জগতে কোটি কোটি অপ্রার্থিব গ্রহ নক্ষত্র নীহারিকা অনন্ত কাল ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কি দরকার আছে এর নিদেনপক্ষে উদ্দেশ্যমূলক না হলে ঘুরবেই বা কেন? এর উত্তর বুঝবে মানুষ? এতো স্পর্ধা!
অতি মেধা সম্পন্ন মানবেরা যাবতীয় ধর্ম পুস্তকগুলি লিখে গিয়েছেন ভবিষ্যত মানুষদের শুভবুদ্ধি ও সমাজ কল্যাণের জন্য, তা সে ধর্ম গ্রন্থ কোথায় রেখেছিলেন কি অপবিত্র হলো না ভেবে পুস্তকে কি আছে অনুধাবন করুন। অপবিত্র জায়গা বলে কিছু নেই, সর্বত্র ঈশ্বর আছেন , সব পরিচ্ছন্ন রাখুন। মারপিট হিংসা বলী না দিয়ে বরং সযত্নে ধর্ম পুস্তক নিজ পছন্দস্থানে রাখুন। হিন্দু পূজোর ঘরে অন্য ধর্মের গ্রন্থ থাকলে পূজো কি ব্যর্থ হয়ে যাবে? ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের “ম্লেচ্ছ” বা “কাফের” বলবার অধিকার কি ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন? আর জন্ম মৃত্যু ত সবই ত ঈশ্বরের হাতে। দেহের প্রধান উপাদান রক্ত কি মানুষের ধর্ম বিশেষে ভিন্ন হয়? আমাদের পা থেকে চুল অবধি ঈশ্বর বিরাজমান, মৃত্যুর পর তিনি চলে যান আর শরীরে তখন দেহে ধরে পচন , সে দেহধারী যে ধর্মাবলম্বীই হন।