Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অদৃশ্য পাখি || Sunil Gangopadhyay

অদৃশ্য পাখি || Sunil Gangopadhyay

অদৃশ্য পাখি

জোনাকিরা অদৃশ্য হতে পারে না। জোনাকির আলো জ্বলে-নেভে। আলোটা না ৫ থাকলে ওদের দেখা যায় না। আবার চেষ্টা করলে দেখাও যায়। আর জোনাকিদের অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা নেই।

মশারা কি সত্যি-সত্যি অদৃশ্য হয়? এই একটা মশা গায়ের ওপর বসল, মারতে গেলেই কোথায় মিলিয়ে গেল। আর দেখা যায় না। কিন্তু অদৃশ্য হয় না বোধহয়। অত ছোট একটা প্রাণী, তাও মাঝে-মাঝে চোখে দেখা যায় না। মশারির মধ্যে মশা ঢুকলে তো অদৃশ্য হতে পারে না। আলো জ্বাললে মশারা যতই লুকোবার চেষ্টা করুক ঠিক মার খেয়ে মরে।

কিন্তু পাখিটাকে নিয়ে হীরু খুব ধাঁধায় পড়েছে।

ক্লাস সেভেনের ছাত্র হীরু, সে ক্লাসের পড়ার বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়েছে, তার এক সেট ছোটদের এনসাইক্লোপিডিয়াও আছে। কোথাও পাখিদের অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতার কথা লেখা নেই।

তাহলে এ পাখিটা যায় কোথায়?

প্রথমবার দেখেই হীরু চমকে উঠেছিল।

তাদের বারান্দার কার্নিসে এসে বসেছিল পাখিটা। ওরকম পাখি হীরু আগে কখনো দেখেনি।

হীরুদের বাড়ির পেছেনেই শেঠ জানকীরামের বিশাল প্রাসাদ। সেই প্রাসাদ ঘেরা বাগান, তাতে নানা রকমের বড়-বড় গাছ। শেঠ জানকীরামের মেয়ে চম্পার খুব গাছের শখ, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছ এনে লাগানো হয়েছে সেই বাগানে। পুরো বাগানটা উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।

হীরুদের ছাদ থেকে কিন্তু সেই বাগানটা দেখা যায়।

হীরুর বাবা বলেন, ওই বাগানটা আমাদেরও বলা যেতে পারে। আমরা জায়গা করে বাগান করিনি। আমাদের সে ক্ষমতাও নেই, কিন্তু বাগানটার সব শোভা তো উপভোগ করতে পারছি। ওদের বাগানে ফুল ফোটে, আমরা গন্ধ পাই।

বিদেশ থেকে গাছ আনতে হয়েছে, কিন্তু পাখি আনার দরকার হয় না। শেঠ জানকীরামের বাড়িতে পাখি পোষা হয় না। কিন্তু বাগান থাকলেই পাখি আসে। কতরকম পাখি, বুলবুলি, টিয়া, ফিঙে, মৌটুসী, মুনিয়া। কাক শালিখ-চড়াই তো আছেই।

কিন্তু এই পাখিটা অন্যরকম। অনেকটা ঘুঘুর মতন দেখতে। তবে গায়ের রং একেবারে ঝকঝকে হলুদ, ঠিক যেন সোনার মতন। হীরু বইতে পড়েছে যে নীল রঙের ঘুঘু হয়। খানিকটা ছাই-ছাই রঙের কিংবা খানিকটা সাদা রঙেরও হয়। কিন্তু হলুদ ঘুঘুর কথা কোনও বইতে নেই। ঘুঘর চেয়ে ঠোঁট লম্বা। অনেকটা লম্বা, প্রায় হাঁসের মতন।

প্রথম দিন বারান্দার কার্নিসে পাখিটাকে দেখে হীরু অবাক হয়েছিল। পড়তে-পড়তে চোখ চলে গিয়েছিল তার দিকে। চোখাচোখি হল হীরুর সঙ্গে।

উঠে যেই ভালো করে দেখতে যাবে, অমনি পাখিটা আর নেই।

কোথায় গেল? ওড়ার তো একটা শব্দ হবে। উড়তে দেখা গেল না। এই বসে ছিল এই নেই।

হীরু বারান্দায় গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারল। নিচের দিকেও যায়নি। হীরুর মনে একটা খটকা রয়ে জিন পর ইরু প্ৰদ পড়ে পাকাগজ বিছি

তিনদিন পর হীরু পাখিটাকে দেখতে পেল তার জানলার ওদিকে। ছুটির দিন বেলা এগারোটা। গায়ে রোদ পড়ে পাখিটার রং একেবারে ঝলমল করছে।

হীরুর মাও তখন মেঝেতে খবরের কাগজ বিছিয়ে পড়ছিলেন সেই ঘরে। কাগজ কিংবা বই পড়বার সময় মায়ের চশমা লাগে না। কিন্তু দূরে দেখার জন্য লাগে।

হীরু বলল, মা, দ্যাখো, দ্যাখো, কী সুন্দর পাখিটা।

মা মুখ তুলে বললেন, কই?

হীরু বলল, এই যে, জানলার ওপাশে? দেখতে পাচ্ছ না?

মা বললেন, চশমা? আমার চশমাটা কোথায় গেল?

কাগজের তলা থেকে চশমা খুঁজে পরতে-পরতে পাখিটা অদৃশ্য। হীরুর মা বললেন, কই রে, দেখতে পাচ্ছি না তো!

হীরু বললে, এই তো এখানে বসে ছিল। কোথায় গেল?

মা বললেন, উড়ে গেছে।

মায়ের চেয়ে হীরু জানালার অনেক কাছে বসে আছে। ঘুঘু পাখি উড়ে গেলে ডানায় ঝটপট শব্দ হয়। হীরু কোনও শব্দ শোনেনি আজও।

মাকে সে কথা বললে মা বিশ্বাস করবে না।

এর পরের বার শুধু অবাক হওয়া নয়। রীতিমতোই ঘাবড়ে গেল হীরু।

সেদিন মা আর হীরু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। মায়ের চোখে চশমা। শেঠ জানকীরামের বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে। কাছাকাছি একটা বড় গাছের একেবারে মগডালে ফুটেছে এক ধরনের লাল টকটকে ফুল। ওগুলোর নাম আফ্রিকান লিলি। তার পাশেই একটা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাকেশিয়া গাছ। অনেকগুলো শালিক কিচির-মিচির করছে সেখানে।

মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ পাশ ফিরে রেলিং-এর এক কোণে বসা পাখিটাকে দেখতে পেল।

হীরু ফিসফিস করে বললে,, এবার সেই পাখিটাকে দেখো।

মা বললেন, কই, কই?

হীরু বলল, ওই যে ডান দিকে। এরকম হলুদ রঙের পাখি তুমি দেখেছ আগে?

মা বললেন, কই রে, কোন পাখিটার কথা বলছিস!

মা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।

পাখিটা এতই কাছে যে দেখতে না পাওয়ার কথাই নয়। হীরু বলল, এই যে আমার আঙুলের সোজা। এদিকেই তাকিয়ে আছে।

পাখিটা সত্যিই হীরুর দিকে তাকিয়ে আছে।

মা বললেন, তুই কী বলছিস রে, হীরু। আমি তো ওখানে পাখি-টাখি দেখছি না!

হীরুর শরীর এবার ঝিমঝিম করে উঠল। পাখিটাকে তাহলে সে একাই দেখছে, আর কেউ দেখতে পায় না?

এবার হীরুর চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল পাখিটা। উড়ল না, নিচে ঝাঁপ দিল না। হীরু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তার মধ্যেই পাখিটা মিলিয়ে গেল কোথায়?

হীরু মায়ের হাত চেপে ধরে বলল, মা, মা, পাখিটা এখানে সত্যিই ছিল। হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। বিশ্বাস করো।

মা ঝরঝর করে হেসে ফেললেন।

ছেলের মাথার ওপরে হাত দিয়ে বললেন, খুব আমাকে ঠকাতে শিখেছিস, তাই না! আজ কি এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখ?

হীরু আর কিছু বলল না। সে নিজেই বুঝতে পারছে যে একটা পাখি অদৃশ্য। হয়ে গেল, এই কথাটা বোকার মতো শোনাল।

সে দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল, সেখানেও থরথর করে কাঁপতে লাগল।

এরপর আরও এরকম তিনবার হল। বারান্দায়, ছাদে। মা কিংবা অন্য কেউ রয়েছে কিন্তু তারা পাখিটাকে দেখতে পাচ্ছে না। শুধু হীরু দেখছে। সত্যি-সত্যি দেখছে। কল্পনা নয়। যেমন সে পাশে দাঁড়ানো মাকে দেখতে পাচ্ছে, তেমনি দেখছে পাখিটাকে। অথচ অন্য কেউ দেখে না কেন?

চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে পাখিটা যেন বুঝিয়ে দিয়ে যায়, সে অন্য কোনও পাখির মতো নয়।

হীরু খুব ভালোই জানে যে পাখি কখনো অদৃশ্য হতে পারে না। পৃথিবীতে যত জিনিস আছে, তার মধ্যে হাওয়া তার শব্দই শুধু চোখে দেখা যায় না।

তা হলে কি পাখিটা এ পৃথিবীর নয়? মহাকাশ দিয়ে উড়ে এসেছে, অন্য কোনও গ্রহ থেকে?

হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে। রহস্যময় মহাশূন্যে কত কী আছে কে জানে!

কিন্তু পাখিটা আর কেউ দেখতে পায় না। শুধু হীরু দেখতে পায় কেন?

হীরু এখন মাঝে-মাঝে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে কি আলাদা কোনও শক্তি আছে? কই, সে তো অন্য আর কিছু দেখতে পায় না। ভূতের গল্প পড়তে পড়তে এক-একদিন তার মনে হয়, সত্যি কি ভূত বলে কিছু আছে? এতদিন একটা ভূতকে (দূর থেকে) দেখতে পেলে মন্দ হতো না।

নাঃ, ভূত-টুতও সে কখনো দেখেনি।

তারপর হীরু বুঝল, পাখিটা ইচ্ছা করে তাকেই দেখা দেয় বলে সে দেখতে পায়। দু-এক মিনিটের বেশি সে থাকে না।

একদিন খুব ভোরবেলা হীরু হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখল, পাখিটা বসে আছে জানালার কাছে। পাখিটাকে দেখে মনে হয়, যেন এইমাত্র স্নান করে এল।

পাখিটা চেয়ে আছে হীরুর দিকে। প্রত্যেকবারই এরকমভাবে সে হীরুকে দেখে। তবে কি সে হীরুকে কিছু বলতে চায়? তার কি এমন কোনও কথা আছে, যা হীরুকেই শুধু বলবে?

হীরু পাখিটার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কে? তুমি কোথা থেকে এসেছ?

পাখিটা যেন হীরুর কথা ঠিক বুঝতে পারল। সে ডেকে উঠল। টুঁইংক! টুঁইংক!

ভারি মিষ্টি সেই ডাক। কিন্তু হীরু তো সেই ভাষা বুঝতে পারল না। সে শুধু তাকিয়ে রইল পাখিটার দিকে।

পাখিটা ঠিক ওই রকম ভাবেই আরও কয়েকবার ডাকল। ঠিক যেন কথা বলার মতন, কিন্তু অন্য কোনও ভাষায়।

হীরু জিগ্যেস করল, কী বলছ? কী বলছ?

পাখিটা তক্ষুনি অদৃশ্য হয়ে গেল।

সে আর কখনও আসেনি।

ঠিক সাতবার হীরু দেখেছিল পাখিটাকে।

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়, বারো বছর, পাঁচ মাস বয়সে হীরুর কাছে একটা সোনার রঙের আশ্চর্য পাখি কেন সাতবার এসেছিল, তা হীরু আজও জানে না। পাখিটা কী বলতে এসেছিল তাকে, আজও সে বুঝতে পারেনি।

তবু হীরু এখনও সেই উত্তরটা খুঁজে যাচ্ছে। সারা জীবন খুঁজে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *