সংকটে কবির সত্তা আরো বেশি চিন্তাশ্রয়ী হয়,
কতিপয় খর স্বপ্ন তাকে
বিচলিত করে খুব, বিশেষত মাথার বিষয়ে
ভাবে রাত্রিদিন-
শৈশবে জননী তার মাথার সতেজ ঘ্রাণ নিয়েছেন কত,
কখনো বা স্নেহভরে মাথার ওপর হাত রেখে,
মনে পড়ে, পড়েছেন দোয়া আর দরুদ অনেক,
এখনো তো মাঝে মাঝে পড়ন্ত বেলায় স্মৃতি জাগানিয়া স্পর্শে
বিলি কেটে দেন চুলে। দয়িতা মাথাটা তার কম্পিত দু-হাতে
নিয়ে বুকে কী বিপুল আবেগের খরস্রোতে ভেসে
জড়িয়ে ধরেছে কতবার।
প্রায় প্রতিদিন হয়তো বা সারাক্ষণ কোনো কোনো
নির্ঘুম রাত্তিরে কবি তার একা মাথার ভিতর
নিজেই ভ্রমণকারী; দ্যাখে সে মরাল কতিপয়
নীলিমার সঙ্গে রিশ্তা পাতে,
উড়ে চলে অন্তহীন আলাদা আকাশে, দ্যাখে দুঃস্থ
মাদারির দল হাঁটে, অদূরে বেদের ডেরা আর
জখমি শহরতলী হাবা গোবা ছায়া নিয়ে ভারি
অপ্রস্তুত, ভাঙা মঞ্চে বেজায় অপটু অভিনেতা,
স্মৃতিভ্রষ্ট, থেমে থেমে আওড়ায় পার্ট। কবি অন্যমনে তার
মাথার ভিতর করে ঘোরাফেরা-দ্যাখে এক কোণে
পুরোনো রূপালি তস্তরিতে
আধ-খাওয়া আম তার অন্তর্গত বাস্তবতা মেলে
ধরেছে হাওয়ায় রোদে। দুলছে একটি গাছ দ্রুত
ভিন্নতর বৃক্ষ হয়ে ওঠার ইচ্ছায়, একজন
রমণী অধিক রমণীয় হয়ে জেগে থাকবার
তীব্র আকাঙ্ক্ষায়
অলিন্দে অপেক্ষমাণ। কবি দ্যাখে, ভ্রমণকারীর
ওৎসুক্য নিয়েই দ্যাখে মাথার ভিতর মিছিলের
শেষাংশ, আকাশে দিগন্তের মতো ঠোঁট,
সবুজ এলিয়ে-থাকা মানবীয় ভাস্কর্য বিশাল।
সত্তার সংকটে দীর্ণ কবি দ্যাখে তার অগণিত
প্রতিধ্বনিময়
মাথার ভিতর অন্য এক দীপ্র মাথা শূন্যতায়
দ্বীপের মতোই দৃঢ়। নিজস্ব মাথাই বটে তার
ধুলোয় গড়ানো নয়, বেশ উঁচু, সোনালি থালায়
মখমলে রাখা,
যেন বা মুকুট এক। কবি তার মাথার চাদ্দিকে
কেবল চক্কর কাটে, শেষমেশ চুমো খায় খুব
ভালোবেসে মাথাটার গালে।
কবির মাথাকে ডেকে বলে বহুরূপী কারাগার,
তুইতো আমারই।
ঘাতকের হাত বলে, তোর প্রতি আমার প্রতিটি
রোমকূপ বিষম আকৃষ্ট।
বন্দুকের চোখ বলে, আয়, দাঁড়া এখানে নিথর
লাগুক চুলের স্পর্শ পাথুরে দেয়ালে, শেষ স্তোত্র
কর পাঠ, তুইতো আমারই।
জামিন কবির মাথা মেঘমালা আর পরিযায়ী
পাখি আর লতাগুল্মময় স্নিগ্ধ জমিনের কাছে,
জামিন কবির মাথা নক্ষত্রগুচ্ছের কাছে আর
পুশিদা পথের কাছে, ভিখিরী, উদাস পথচারী,
ভবঘুরে সার্কাসের ভাঁড় আর দুঃখিনী নর্তকী,
ক্লান্ত বাঁশি-অলা, পুষ্টিহীনতায় অতিশয় শীর্ণ
শিশুদের কাছে, শহরের উঁচু মিনারের কাছে,
জামিন কবির মাথা তৃষ্ণাদীর্ণ কবিদের কাছে।