Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাজল || Taradas Bandyopadhyay

কাজল || Taradas Bandyopadhyay

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’র পর অপুকে নিয়ে তৃতীয় পর্ব লিখেছিলেন উনার ছেলে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই তৃতীয় পর্বের প্রথম খণ্ড এই ‘কাজল’; দ্বিতীয় (শেষ) খণ্ড ‘তৃতীয় পুরুষ’।

ভূমিকা ও বিভূতিভূষণ ও কাজলের পশ্চাৎপট

ভূমিকা

উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে যিনি আমার পিছনে মাভৈঃ বাণী নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই মা আমাকে সর্বক্ষণ উৎসাহ দিয়েছেন, পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়েছেন। আমার এবং তঁর পরিশ্রম সমান সমান।

অনেক বিনিদ্র রাত্রির ইতিহাস রয়ে গেল এ বইয়ের পেছনে। লিখতে লিখতে মনে হয়েছে। পাঠকদের কথা, জানি না তারা একে কেমন ভাবে নেবেন। তঁদের জন্যই আমার পরিশ্রম, তারা গ্ৰহণ করলে আমি ধন্য হবো।

তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
আরণ্যক, ব্যারাকপুর

বিভূতিভূষণ ও কাজলের পশ্চাৎপট

১৯৪০ সনের ৩রা ডিসেম্বর আমার বিয়ে হয়। সে সময়ে উনি ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রীটের ‘প্যারাডাইস লজে’ থাকতেন। আমার বিয়ের প্রায় একবছর পরে ঐ মেসের বাস তিনি উঠিয়ে দেন।

ঐ মেসে ছিলেন উনি বহুদিন, কাগজপত্র বইখাতা জিনিসপত্র জন্মেছিল ওখানে অপর্যাপ্ত। মেসের বাস যখন তুলে দেন তখন তার কিছু জিনিস উনি পাঠিয়ে দেন ঘাটশিলায়, কিছু আমাদের দেশের বাড়ি গোপালনগর বারাকপুরে।

ঘাটশিলার যে ঘরে আমি শূতাম তার পায়ের দিকের দেওয়ালে টাঙানো ছিল ভারি সুন্দর একটি শিশুর ছবি, অপূর্ব ছবিটি। খয়েরী রংয়ের সঙ্গে সাদা মেশানো বিলিতি ছবি। নিচে ইংরেজিতে ছবিটির নাম লেখা ছিল—‘বাবলাস’। ছেলেটির কোলের উপর একটি বাটিতে কিছু সারানগোলা জল। একটি কাঠিতে ফু দিয়ে ছেলেটি বুদবুদ তৈরি করছে।

ওঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, কোনও বিলাতি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ক্যালেন্ডার ওটা। উনি ছবিটি আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন ঐ ছবি দেখেই নাকি উনি কাজলের চরিত্র কল্পনা করেছিলেন। অমন নিম্পাপ, দেবদুর্লভ কৃপবান, কোমল, সুন্দর ছেলেটি-কাজল নাকি ওঁর কল্পনায় ঐ রূপেই ছিল।

উনি নিজে আমাকে বহুদিন বলেছেন, একসময়ে নাকি উনি সস্তান-সস্তান করে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। বহু লোকের কাছে শুনেছি, অনেককে উনি নাকি বলতেন—আমাকে বাবা ডাকবি?—ডাক্‌না।

আরও শুনেছি, এই পিতৃ-সম্বোধন শুনবার জন্য নানাপ্রকার ঘুষও দিতেন। কাউকে কাউকে।

আজ আরও অনেক কথাই মনে পড়ছে। ওঁর ধর্ম মেয়ে, নাম তার রেণু। রেণুর উল্লেখ আছে ওঁর অনেক বইতে, ওঁর দিনপঞ্জিগুলিতে। ওঁর ‘বিচিত্র জগৎ’। বইখানা রেণুকে উৎসর্গ করেছিলেন। রেণুর সঙ্গে ওঁর মেহের সম্পর্ক গভীর ছিল। রেণুকে নিয়েই ওদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর গভীর পরিণতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরবতী কালে ওদের সকলের সঙ্গেই ওঁর আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।

আমার বিয়ের পরে রেণু এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে।

রেণু আমাকে ডাকত মা-মণি বলে, ওঁকে বলত বাবা। রেণুর সঙ্গে ওঁর মাঝে মাঝে দেখা হত কলকাতায়। রেণু তখন কলকাতাতেই ছিল।

বাবলু যখন একবছরের, সে সময় একদিন একটি নিরেট লোহার সুন্দর মোটরগাড়ি এনে বাবলুকে দেন। উনি বলেন, তোর দিদি দিয়েছে-রেণুদিদি।

কাজল সম্বন্ধে উনি কী লিখবেন, তার কিছু কিছু আভাস অপরাজিত বইতে পাওয়া যায়। ওতেই বীজাকারে কাজল সম্বন্ধে সকল কথাই প্রায় বলা আছে। তারপর যে তঁর কল্পনার কাজলকে বাস্তবে রূপ দেবে, প্রতিমার কাঠামোর ওপর খড়-বিচালি বেঁধে মাটি ধরিয়ে রং-তুলির স্পর্শে সেই প্রতিমাকে সঞ্জীবিত করবে, সে দায়িত্ব তার। গল্পকে টেনে নিয়ে যাবার, উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব লেখকের, বিভূতিভূষণের অসমাপ্ত রচনা যে সমাপ্ত করবে তার। তিনি জানতেন না ভবিষ্যতে এই কাজ করবে তারই পুত্র।

কাজল উপন্যাস সম্পর্কে কত নিভৃত মধ্যাহ্নে আকাশের নব নব ছায়াবুপ দেখতে দেখতে, সন্ধ্যাবেলায় বিলবিলের ধাবে ঠেস দেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে করতে আলোচনা করেছেন। কাজল এখন কত বড় হয়েছে, কী করছে, কী ভাবছে, এসব আলোচনা করতেন। বাবলু (তারাদাস) হওযার পরে মুহূর্তে মুহূর্তে বাবলুকে দেখা চাই। বাবলু কী করছে, কেমন অঙ্গভঙ্গি করছে।–সর্বদা বাড়ির সকলকে ডেকে দেখাতে ভালোবাসতেন। সর্দার খেলুড়ের সঙ্গে বাবলু যেন ছিল শিশুখেলুড়ে। বুঝতে পাবতাম, কাজল উপন্যাসের পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে। কাজল উপন্যাস সম্বন্ধে বহু নোট নিতেন। কিছু কিছু লিখেও ছিলেন। ওঁর আকস্মিক মৃত্যুর জন্য, এবং এই উনিশ-কুড়ি বছরের ব্যবধানে বিশেষ কিছু বক্ষণ করতে পারি নি।

বাবলু যখন একটু বড় হল এবং স্কুলে যেতে শুরু করল, তখন সে বাবার কথা শুনতে চাইত। তার লেখার বিষয়, তঁরা ভালো-লাগা, তার জীবনচর্চা ও জানতে চাইত। তন্ময় হয়ে শূনত এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইত সব কিছু। দীর্ঘদিন বাবলুর সঙ্গে ওঁর স্মৃতিতর্পণ করতে করতে কাজল উপন্যাস সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছি। বাবলুর তখন থেকেই আগ্রহ ছিল “কাজিল’ লিখবার। অস্তরে অস্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। তার হাযার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে একেবারে একটানা অবসব, সে অবসর কী করে কাটবে এই ভাবনায় যখন অস্থির হয়ে উঠেছিল, তখন নিজেই একদিন আমায বলল–মা, কাজল’ লিখতে শুরু করি। তুমি কী বল? আমি সেদিন ওকে মুখে উৎসাহ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, লেখ, চেষ্টা কর। চেষ্টার অসাধ্য কী আছে।

সেই শুরু, তারপর তিনবছর পার হয়ে চারবছর চলছে। আজ কাজল সত্যিই শেষ হল।

আমার শ্বশুরমশাই-এবা অসমাপ্ত কাৰ্যভার তুলে নিয়েছিলেন তার পুত্র অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে। আজ তাদের পায়েব তলায়, বঙ্গবাণীর পায়ের তলায় বাবলু কুষ্ঠিত অক্ষম পদক্ষেপে পূজার থালা নিয়ে দাঁড়াল। সামান্য উপচার, অতিসামান্য ওঁর পুজি। কিন্তু পূজায যার যেটুকু ক্ষমতা সে তাই নিয়েই সাঙ্গ করে, এও তাই। তার নির্মল পূজাব আগ্রহটুকুই ভগবান গ্ৰহণ করুন।

১৩৫৭ সালের ২৮শে ভাদ্র ওঁর জীবিতাবস্থায় শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল আমার মামাব বাসারাড়ি সুইনহো স্ট্রীটে। এই অনুষ্ঠানে বহু সাহিত্যিক বন্ধুবা এসেছিলেন ওঁর। শ্রদ্ধেয় উপেন-দা, বন্ধুবান্ধব মনোজ বসু, ডাঃ নলিনাক্ষ সান্যাল, বেগম জাহান-আরা খান স্বামী সহ, গজেন ঠাকুরপো, সুমথ ঠাকুরপো ইত্যাদি।

এই জন্মদিনে গজেন ঠাকুরপোরা ওঁকে একখানা খাতা উপহার দেন– তার ওপর একটি কালো কীভাব লাগানো ছিল। সুন্দর করে বাঁধানো, তাতে সোনালী অক্ষবে ইংরাজীতে লেখা ছিল—’কাজল’। এ খাতাখানা আজও আমার কাছে আছে। সেই সময়েই ঠিক হয়ে যায়, ‘কাজল’ উনি লিখতে শুরু করবেন অবিলম্বে এবং তা ধারাবাহিকভাবে বেবুবে কোন পত্রিকায়। আমি জানতাম ‘কাজল’ উনি লিখবেন, যেমন জানতাম ‘ইছামতী’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড উনি লিখবেন, ‘অথৈ জল’ ও দ্বিতীয় খণ্ড লিখবার ইচ্ছে ছিল ওঁর। ওঁরই কাছে আরও শুনেছি ওঁর ‘দেবযান’ লিখবার ইচ্ছা ছিল পথের পাঁচালী লিখবারও আগে। কিন্তু লিখেছেন অনেক পরে। একটা খাতায় উনি দেৱ্যানের খানিকটা লিখে রেখেছিলেন বহুদিন পর্যন্ত। এ লেখার বহু পরে উনি ‘দেবযান’ শেষ করেন–আমার বিয়েরও দু-তিন বছর পরে। তখন দেবযানের নাম ছিল “দেবতার ব্যথা’। ওঁর রচনার প্লট লেখা থাকত ছোট ছোট বইতে। তাতে উনি কী লিখবেন সামান্য কথায় তার স্কেচ করে রাখতেন। পরে ঐ স্কেচ দেখলেই ওঁর মনে পড়ত। উনি কী লিখবেন। ঐ সব বিভিন্ন চরিত্রের বহু ঘটনার সামান্য টুকরো ও নানা লেখার খসড়া আজও আমি রেখে দিয়েছি যত্ন করে আমার কাছে। তাতে কত কী লিখবার, কত কী জানিবার আগ্রহ ছিল ওঁর, তার পরিচয় পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায়, কত কী পড়েছিলেন উনি তার আভাস। উনি যেন ছিলেন চিরদিনের ছাত্র-প্রকৃতির এই মহিমময় অনন্ত ঐশ্বর্যভরা পরিবেশ, এর ভিতরে আত্মহারা ছিলেন তিনি। প্রকৃতিপাগল বিভূতিভূষণ। ঘাটশিলায় ওঁর মৃত্যুর পাঁচ-ছ দিন আগে বেলাশেষে আমি বসেছিলাম আমাদের বারান্দার চওড়া সিঁড়ির ওপর। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনে। বাবলু উঠোনের ঘাসের ওপর ওর বাবাকে নিয়ে খেলছিল। আজও বড় বেশি করে সেই দিনটির কথা, সেই অপরাহ্ন। বেলাটির কথা আমার মনে পড়ে।

উনি সেসময়ে আমাকে বললেন-তুমি আমার দিকে একদম নজর দাও না। আমি কখন কী করি বল তো? এদিকে আমার কাজল’ শুরু করতে হবে। বাবলুকে নিয়ে কী যে করি! তুমি শুধু শুধু বাবলুকে আমার কাছে দাও।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! সে কী গো, আমিই বরং ছেলেটাকে কাছে পাই নে, শুধু তুমি ওকে নিয়ে ঘুরছে কোথায় কোথায়। ওরা দুর্বল স্বাস্থ্য-কোথায় আমি ভাবছি, ওরা কী স্বাস্থ্য টিকবে।

চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন উনি।–আর বেড়ানো নয়, কী বল? খুবই বেড়ানো হযেছে। পুজোর ভেতর অত্যন্ত বেড়ালাম, কী বল? বেড়ালাম না?

আমি চুপ করে রইলাম। এমন ভ্ৰমণ-বাতিকগ্রস্ত লোক আমি জীবনে দেখিনি। ছেলেপুলেদের যেমন মিষ্টি ও খেলনার লোভ দেখিয়ে বশীভূত করা যায়, এই বালকস্বভাব। ভদ্রলোকটিকে বেড়ানোর নামে যেখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত, যদি জানতে পারতেন সেখানে দেখবার কিছু আছে।

উনি নিজেই আবার বললেন–এইবার লেখা শুরু করি, কী বল? পুজোতে ওরকম সবাই একটু-বুঝলে না? সব বন্ধুবান্ধব এক জায়গায় হওয়া, আমোদ হয় না? কী বল? কাল আমাকে খুব ভোরে তুলে দেবে, বুঝলে?

আমি হাসলাম। তোমার চাইতে ভোরে উঠাব আমি? তোমার চোখে কী ঘুম আছে? আমার তো মনে হয় না।

ওঁরই ডাকে ঘুম ভাঙল সেদিন আমার-ওঠে, ওঠে। গেট খুলে দাও। আমি ‘কাজলে’ব ছক তৈরি করব না। আজ? মনে নেই? ওঠে, দেরি হয়ে যাবে।

আমি ঘুম-জড়ানো চোখে বাইরের দিকে তোকালাম।–রাত রয়েছে যে, আর একটু পরে যাও। যাবে বনে পাহাড়ে, ওখানে তো সদাই নির্জন।

উনি বললেন-না, উপাসনা সেরে নেব না। আমার সেই শিলাসনে? তারপরে লেখা।

আমি জানতাম, উনি ‘ফুলডুংরি’র পেছনে বনের ভেতর একটি বিরাট পাথরেব ওপর বসে লিখতেন। আমাকেও নিয়ে যেতেন ওখানে মাঝে মাঝে, উপাসনা করতেন। সে সব কত কথা, কত স্মৃতি।

তখনও জানি না, কী করাল মেঘ ঝুলছে আমার মাথার ওপর-গর্ভে তার বজ্রাগ্নি লুকিয়ে নিয়ে। সেইদিনই যে আমার জীবনের চরম দিন, তার কিছুমাত্র আভাস পাইনি। আমি।

সকাল সকাল ফেরা ওঁর হল না। উনি ফিরলেন একেবারে বেলা সাড়ে-দশটা এগারোটায়। আমি তখন রান্নায় ব্যস্ত।। ওঁকে দোর খুলে দিলাম। উনি বললেন-প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে আমার।

ওঁর খাবার করাই ছিল। বিছানার উপর বসলে ওঁকে খাবার এনে দিলাম।

উনি সেই খাবারটুকু খেয়ে আমাকে বললেন-আবও কিছু দাও। কী আছে তোমার?

আমি বললাম-নারকেল-চিড়ে খাও। তুমি ভালোবাস।

নারকেল-চিঁড়ে দিয়ে আমি আবার রান্নায় ফিরে গেলাম।

একটু বাদে ওঁর ডাক আবার কানে গেল-শুনে যাও।

আমি রান্নাঘর থেকে ছুটে গেলাম ওঁর কাছে।

এমন করে তো উনি ডাকেন না। আমাকে! আমি যেতেই উনি বললেন-দেখ, আমার বুকে যেন চিড়ে আটকে গেছে।

আমি বললাম, শূকনো চিড়ে খেলে এমনিই হয়। ভিজিয়ে খেতে চাও না। আম কলা না থাকলে। কত ঘুরে এসেছ, গলা শুকিয়ে আছে না?

আমি ওঁর গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।

উনি বললেন, একটু কোরামিন দাও আমাকে।

আমার ঘরে কোরামিন থাকত। আমার দেওর নুট্রবিহারী ডাক্তার ছিলেন। আমি ওঁকে ধরে আছি-আমার জা, যমুনাকে ডেকে বললাম-দশ ফোঁটা কোরামিন দে তো।

আমি জীবনে ওঁকে খুব সামান্যই ওষুধ খেতে দেখেছি। কোরামিন চাওয়ায় আমি ঘাবড়ে গেলাম খুব। সেই সূচনা। তখন বুঝিনি। আমি। স্বাস্থ্যবান লোক ছিলেন। একটু পরেই সামলে উঠলেন কিছুটা। আমিও তখন অনভিজ্ঞা। বুঝতে পারিনি কী কঠোর নিয়তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

উনি স্নান করতে যাবেন বললেন। বাড়িতে স্নান করতেন না কখনও। দেশে থাকলে নদীতে, ঘাটশিলায় নানা পুকুরে। আমাকেও মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। ইদানীং বাবলুকে নিয়ে যেতেন রোজ-আমি না গেলেও।

সেদিন বললেন-আজ আর বাবলুকে নেব না, শরীরটা ভালো নেই।

অনেক বাধা দিলাম। শরীর ভালো নেই, বাইরে স্নান কবতে যেও না তুমি।

কিছুতেই শুনলেন না।

আমি বললাম-উঠোনের ধারে জল দিই তোমায়। বাথরুমে নাই বা নাইলে। বাথরুমে স্নান করতে একদম ভালবাসতেন না। উনি। আমাদের ঘরের সামনের চওড়া সিঁড়িগুলিতে বসে স্নান করতে বলেছিলাম। আমি।

উনি বললেন–কিছু হবে না। যাব। আর আসব।

তখন কিছু হল না।

দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন, তখন ধলভূমগড় বাজবাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ কবে গেল টি-পার্টির। উনি খুশী হয়ে বললেন-যাব ঠিক, বঙ্কিমবাবুকে গিয়ে বল। দু-একজন কাকে আরও নিমন্ত্রণ করতে বললেন। তখনও জানি না, কী আছে আমাদের কপালে।

একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ঠাকুরপোর ডাকে ঘুম ভাঙল–দাদা কী সাজে যাচ্ছে উঠে দেখ বৌদি।

আমার দুরন্ত অভিমান হল। আমার কী একটুও ইচ্ছে করে না। উনি একটু সাজুন?

আমি চুপ করে রইলাম। উনি হয়তো বুঝলেন আমার অস্তরের অভিমান। তাই বললেনদাও কী দেবে। কী হবে সাজলে-গুজলে? দুখানা হাত বেবুবে আমার?

সেইদিন-আর তারপর তিনদিনের দিন ওকে মহাযাত্রায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম।

আপনাদের আশীর্বাদে বাবলু ‘কাজল’ লিখেছে। আজ সকলের সঙ্গে ওঁর আশীর্বাদও বাবলুর মাথায় ঝরে পড়ুক।

বাণভট্টের পুত্ৰ ভূষণভট্ট অসমাপ্ত ‘কাদম্বরী’ শেষ করেছিলেন। বাবলুর হাতে বিভূতিভূষণ পরিকল্পিত ‘কাজল’ প্ৰাণময় হয়ে উঠক এই আমার মঙ্গলময়ের প্রতি প্রার্থনা।

রমা বন্দ্যোপাধ্যায়

(বিভূতিভূষণ ‘কাজল’ উপন্যাস শুরু করার পূর্বেই লোকান্তরিত হন। এই গ্রন্থের সমগ্ৰ আখ্যানভাগই বিভূতিভূষণ-তনয় তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত।)

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17
Pages ( 1 of 17 ): 1 23 ... 17পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *