আল্পস্ অথবা আদিগঙ্গা
রাতের খাওয়া দাওয়া, সংসারের এটা সেটা সারতে সারতেই রাত্রি সাড়ে এগারোটা। সুগন্ধার মন একটু চঞ্চল সন্ধ্যের পর থেকে। তারই মধ্যে বর এবং ছেলের শোওয়ার আয়োজন করতে হয়েছে প্রতিদিনের মতো। তবে নির্মাল্য সব কাজেই হাত লাগায় কাছে থাকলেই।
বর ভাগ্য খুবই ভালো সুগন্ধার। নির্মাল্য একেবারে নিপাট ভালোমানুষ। বরং সুগন্ধাই একটু রগচটা। নির্মাল্যর সাতচড়ে রা নেই। তবে বড্ডো ব্যস্ত থাকে বেচারা। একটা বনেদি পেপার মিলের পারচেজ হেড সে।একশো শতাংশ সততার সঙ্গে কাজ করে, যা অতি দুর্লভ। একদা কবিতা লেখক এবং সু -অভিনেতা সৎ মানুষ নির্মাল্য এখন এক অতিব্যস্ত পারচেজ ম্যানেজার।
সুগন্ধার ছড়া লেখার হাতেখড়ি বলতে গেলে ক্লাস ফোর থেকেই। খুবই ভালো তাল জ্ঞান। ছন্দ খেলা করে তার ছড়া পদ্যে কবিতায়। এবং যেহেতু নির্মাল্যর মতো নেশা কাটানোর পেশায় যুক্ত হতে হয়নি সুগন্ধাকে, ও ধরে রাখতে পেরেছে তার অতি ভালবাসার ধন কবিতাকে এখনো এই পঁয়তাল্লিশেও।
একমাত্র ছেলে সৌম্যও কিছুটা পেয়েছে এই ধাত্।পাশের ঘরেই তার নিজস্ব রাজ্যপাট। পড়াশুনার আধুনিক চাপে
মাধ্যমিকের সামনে তার এখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। পদ্য ভুলে এখন তার লড়াই চলছে আগামী পরীক্ষার প্রস্তুতির সঙ্গে।
ফিরে যাই আবার রাত্রি সাড়ে এগারোটার কাছে। অনিয়মিত হলেও
সুগন্ধা রোজনামচা লেখে সেই ক্লাস টেন থেকে। টেবল ল্যাম্প জ্বেলে, ভেতরের অস্থরিতা চেপে, সুগন্ধা সোজা চলে গেল কিশোরীবেলার স্মৃতির পৃষ্ঠায়।
কলকাতার কিছূটা দূরে চুঁচুড়ায় তাদের বাড়িতে ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, মা- বাবার সঙ্গে একমাত্র মেয়ে সুগন্ধা। সতেরো বছরের দূলদুল বেনী, কাঁচা সোনা রঙ, পানপাতা মুখ, টিয়ে পাখির মতো নাক, হাসিতে মুক্তো , সদ্য যৌবনা এক প্রকৃত সুন্দরী সুগন্ধা।
স্কুল বাড়ি থেকে দু’ কিলোমিটার দূরে উচ্চ মাধ্যমিক কো- এড স্কুল। তিতির, পাঞ্চালী ,সঙ্গীতা সবাই একসঙ্গে পড়ে।
একসঙ্গেই আসে যায় আনন্দে মশগুল হয়ে। স্কুলের কাছাকাছি থাকে চন্দ্রানী।
সে পড়ে দ্বাদশ শ্রেণীত। ওকে বাড়ি থেকে নিয়ে যেন রাজ্য জয় করে স্কুলে ঢোকে পাঁচ বীরাঙ্গনা পঞ্চপান্ডবী!
চন্দ্রানী খুব সুন্দর গান গায়। ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে, কোনো ক্লাস ফাঁকা যাচ্ছে, চলো কমনরুমে। আহা চন্দ্রানীর কন্ঠে রবীন্দ্র সংগীত ‘এমন দিনে তারে বলা যায়-‘ !
সকলেই ভক্ত চন্দ্রানীর। তবে সুগন্ধা যেন একটু বেশীই। তার ভেতরের যে কবি সত্ত্বা বোধহয় বেশি দোলা খায় রবীন্দ্র কথা সুরের মূর্চ্ছনায়। চন্দ্রানীর খুবই ভালো লাগে সুগন্ধার ছন্দ মিলে কবিতা। চন্দ্রানী ঈষৎ শ্যামবর্ণা কোঁকড়ানো চুলের ঢলে অনুপমা লাবণ্যময়ী। চন্দ্রানীর প্রেমে সুগন্ধা সত্যিই হাবুডুবু। এ এক আশ্চর্য রসায়ন তৈরি হয়েছে দুজনের মধ্যে। একে ওপরকে না দেখে থাকতে না পারার পরম ভালবাসা।
অন্যান্য বন্ধুরাও জানে। তবুও যৌবনের উচ্ছলতায় সবাই মিলে মিশে এক ঝাঁক বিশ্বস্ত সরিয়াল পাখি।
সবকিছুই সমতালে লয়ে চললে গল্প এগোয় না।তাই কোনও না কোনও ঘটনা ঘটতেই হয় সমস্ত গল্পে।
এই স্কুল থেকেই পাশ করেছে ন্যাশনাল স্কলার অনির্বাণ বছর দেড়েক আগে।
সুদর্শন,ছিপছিপে লম্বা, চোখে একটূ হাই পাওয়ারের চশমার জন্য আর বুদ্ধিদীপ্ত দেখায়। মেধাবী ছেলেমেয়েদের সামাজিক পরিচিতি সকলেই জেনে যায়।
অনির্বাণ পড়াশুনা করেছে স্কুলের থেকে একটু দূরে তার মামাবাড়ির থেকে।
এখন পড়ে খড়গপুর আইআইটিতে।
অনির্বাণের ছুটি পড়লেই চলে আসে মামাবাড়ি। স্কুলে আসে মাস্টারমশাইদের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরাও খুশি হন, তাঁদের কৃতিবান ছাত্রকে কাছে পেয়ে।
একদিন সুগন্ধারা দল বেঁধে ঢুকছিল স্কুলে। হঠাৎই দেখে ডাকছে চন্দ্রানীকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো চন্দ্রানী হাসতে হাসতে। বলল- জানিস্ তো সুগন্ধাকে ভাল লেগে গেছে অনির্বাণদার।
সুগন্ধাকে নিয়ে ‘পদ্মগন্ধা ‘ নামে একটা কবিতাও লিখেছে, এই দ্যাখ্।
শুনে হুল্লোড়ের মধ্যেই একবার মুখ তুলে দেখল সুগন্ধা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অনির্বাণকে। ফুটে গেল প্রেমের প্রথম কদমফুল ফুল!
শ্রীরাধার ললিতার ভূমিকায় এগিয়ে এলো সাহসিনী পাঞ্চালী। চন্দ্রানীর ঠিকানায় চিঠি আসে খড়গপুর থেকে। দিয়ে যায় পাঞ্চালী সুগন্ধাকে।
সুগন্ধার চিঠি পৌঁছে দেয় ডাকবাক্সে পাঞ্চালী, পৌঁছে যায় খড়গপুরের হোষ্টেলে। চিঠি তো নয়, পারস্পরিক প্রেমের কবিতা ছন্দে- মুক্ত গদ্যে।
কেটে গেল একটা বছর। পঞ্চপান্ডবীদের সকলেই ভালোভাবে পাশ্ করেছে।
সবচেয়ে ভাল ফল করেছে সুগন্ধা।
চন্দ্রানীর দ্বাদশ শ্রেণীর পরে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি চলছে।
একদিন চন্দ্রানী এলো সুগন্ধার বাড়িতে।
সুগন্ধার ঘরে বসে বলল- একটা খারাপ খবর আছে । আমার পিসীর বাড়ি খড়গপুরের কাছেই জানিস্ তো।
সঞ্জীবদাকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম অনির্বাণ সম্পর্কে। শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! এ হেন কোনও গুণ নেই যা নেই, ওই গুণধর অনির্বাণদার।
মদ গাঁজা জুয়ো থেকে বিভিন্ন নারী সংসর্গে লিপ্ত। দেখতেই ওমনি ভেজা বেড়াল!
চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলো সুগন্ধার।
ঝন্ ঝন্ করছে কান। এ যে অবিশ্বাস্য।
যে এতো অপূর্ব প্রেমের কবিতা লিখতে পারে শুধুমাত্র তার পদ্মগন্ধাকে নিয়ে,
সে যেতে পারে অন্য মেয়ের কাছে!
রাতে ঘুম হলো না সুগন্ধার। পরের দিন স্কুল গেল না শরীর ভাল নেই ব’লে।
লিখল চিঠি অনির্বাণকে। এবার ছন্দে নয় ,কড়া গদ্যে চড়া স্বরে কৈফিয়ত চেয়ে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ যায়। চন্দ্রানী বলে- কোনও চিঠি আসেনি। তুই কি মনে করিস্, অনির্বাণ আর চিঠির জবাব দিতে পারবে? ভুলে যা সবকিছু, খুব বাঁচা বেঁচে গেছিস্। ভাগ্যিস্, তোর বাড়ির কেউ কিছু জানতে পারেননি।
কেটে গেছে সুদীর্ঘ উনত্রিশ বছর, এসেছে আজকের রাত্রি টেবিল ল্যাম্পের সামনে স্মার্ট ফোন হাতে সুগন্ধা একা!
সন্ধ্যাবেলা হঠাৎই উৎসুক খুঁজতে খুঁজতে ফেসবুকে পেয়েছে চন্দ্রানীকে। পাওয়ার কথা নয়। হাজারো চন্দ্রানী ঘোরা ফেরা করছে নিজস্ব -ফেক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সঙ্গে নিয়ে।
তবুও কি জানি কিভাবে পেয়ে গেলো চন্দ্রানীকে শুধু ধর থেকে ধর -আচার্য হওয়ার সুবাদে হয়তো। এতো বছর পরে চেনা বেশ মুশকিল হতো। কিন্তু নাম আর কোঁকড়ানো চুল!
জার্মানিতে থাকে। সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে এসেছে। জেনেভায় বিশ্বের পরপর প্রায় সমস্ত সুবিখ্যাত দফতরের ছবি পোস্ট করেছে। আল্পসের উপরে ঘুরন্ত ফ্রেঞ্চ রেঁস্তোরা ‘ লা রাসটিকে ‘ ব’সে ভূস্বর্গের দৃশ্য দেখতে দেখতে সুইস চকোলেট খাচ্ছে স্বামী সোহাগিনী চন্দ্রানী, সঙ্গে সদ্য যৌবনা ফুটফুটে মেয়ে সোহিনী।
ঠিক পাশেই বসে মা মেয়েকে একসঙ্গে জড়িয়ে অনির্বাণ আচার্য।
সুগন্ধা আস্তে আস্তে জানালা খুলে তাকিয়ে রইলো অদূরেই বয়ে যাওয়া কালীঘাটের আদিগঙ্গার দিকে।