Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দোলনা || Ashapurna Devi

দোলনা || Ashapurna Devi

কুমারী মেয়ে

কুমারী মেয়ের পক্ষে এহেন কাজ শুধু যে অস্বাভাবিকই তা নয়, রীতিমত গর্হিতও। অথচ সুমনা সেই গর্হিত আর অস্বাভাবিক কাজটাই করে বসেছে। আর তার জের চালিয়ে যাবার জন্যে মরণপণ করেছে।

মাথায় হাত দিয়ে পড়েছে বাড়ির সবাই। ভেবে পাচ্ছে না কী উপায়ে ওকে এই বিপজ্জনক খেয়াল থেকে মুক্ত করা যাবে। শুধু খেয়াল বললেও বোধহয় ঠিক হয় না। এ তো একেবারে পাগলামি। পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নাকি আছে একথা, সাময়িকভাবে কখনও কখনও কাউকে উন্মাদরোগ আশ্রয় করে, কিন্তু সুমনাদের সংসার কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের সবচেয়ে দামি মেয়েটাই তেমন একটা আশ্রয়স্থল হবে।

.

সুমনার মা সুজাতা প্রথমটা তো সুমনার এই অসম সাহসিক কীর্তিতে হইচই, রইরই করে উঠেছিল, আর সুমনার বাবা কান্তিকুমার ভ্রূকুটি করে বলেছিলেন, পাগল নাকি?

কিন্তু অতঃপর যখন দেখা গেল পাগলের আচরণই করছে সুমনা, তখন কান্তিকুমার ধরলেন ধমক, আর সুজাতা সদুপদেশ।

প্রথমে রঙ্গমঞ্চে ছিল মাত্র ওই দুটি কুশীলব। কারণ এখানে সাঁওতাল পরগনার এই স্বাস্থ্যের জন্যে বিখ্যাত গ্রামটিতে মাত্র তিনজনই এসেছিলেন ওঁরা। মা বাপ আর মেয়ে।

কলকাতায় একান্নবর্তী বড় পরিবার, সেখানে বাকি ছেলেমেয়েদের রেখে আসতে অসুবিধে হয়নি। সুমনার জন্যে আসা। কিছুদিন যাবৎ লিভার-দোষে ভুগছিল সুমনা। তাই বি. এ. পরীক্ষাটা শেষ হতেই মেয়ে নিয়ে স্বাস্থ্যোদ্বারে এসেছিলেন কান্তিকুমার। কে জানত শারীরিক স্বাস্থ্য-অর্জন করে ফেরার মুখে সে হঠাৎ এমন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

ব্যাধিগ্রস্ত ছাড়া আর কী!

হিতাহিতজ্ঞান হারানো মানেই ব্যাধি।

সুজাতা বলে, সুমি, একবার খোলা বুদ্ধি আর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ, তুই যা করতে চাইছিস, সেটা সঙ্গত কিনা। আমি কিছু বলছি না, তুই নিজেই ভেবে দেখ। ওই জীবটার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে, সেন্টিমেন্টকে সরিয়ে রেখে চিন্তা কর। কলকাতার বাড়িটা আর সেখানের সকলের মুখ মনে কর, তারপর ভাব তুই কী করতে চাইছিস।

সুমনা নিচু করে রাখা মাথাটা উঁচু করে বলে, ভেবেছি, অনেক ভেবেছি।

ভেবেছিস! ভেবে তুই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিস!সুজাতা ক্ষোভ আর হতাশাজড়িত কণ্ঠে বলে, তা হলে তোর বাপ যা বলেছে, তাই ঠিক। তুই পাগলই হয়ে গেছিস।

সুমনা উত্তর দেয় না, জানলার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কান্তিকুমার গম্ভীরমুখে বলেন,তুমি কি চাও সমাজে আর আমাদের মুখ তুলে দাঁড়াবার উপায় না থাকে?

সুমনার চোখটা ছলছল করে আসে।

বাবার কাছে এমন বকুনি খাওয়াটা বোধহয় তার এই প্রথম। নিষ্ঠুর কঠিন বকুনি। বাবার কাছে বকুনি খাওয়ার বিষয়বস্তুটা প্রায়শই থাকে স্বাস্থ্য-বিধি মেনে না চলা।

সুমি, ওষুধ খাসনি?…সুমি, এই জোলো হাওয়ায় ওই পাতলা জামা পরে বেড়াচ্ছিস?… সুমি, তোমার মার কাছে শুনলাম তুমি নাকি ফলের রস খেতে চাও না! সাধারণত এই হচ্ছে বাবার বকুনির ভাষা।

কিন্তু সুমনার এই দুঃসহ জেদের নির্লজ্জতায় কান্তিকুমারের সেই স্নেহপ্রবাহ শুকিয়ে গেছে। আজ তিনি মেয়ের মুখ শুকনোর কথা ভাবছেন না, সমাজে নিজের মুখ না থাকার কথা ভাবছেন।

বাবার কথায় সুমনার চোখে জল এলেও কষ্টে সে জল চোখে আটকে রেখে বলে সুমনা, এতে আর তোমাদের দোষ কী? তোমাদের কেন–

কান্তিকুমার ভুরু কুঁচকে বলেন,তুমি শিশু নও সুমনা! আমাদের কেন, সেটুকু বোঝবার ক্ষমতা তোমার আছে। তোমার অসুস্থতা নিয়ে আমরা দুমাসের জন্যে চেঞ্জে এসেছি, এটাই সকলের জানা, হঠাৎ যদি এরকম একটা ব্যাপার নিয়ে ফেরা হয়, তা হলে

চুপ করে যান কান্তিকুমার।

আর বেশি বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলেই চুপ করে যান, কিন্তু আর বেশি বলার কি দরকারই ছিল? যথেষ্ট কি বলা হয়নি?

সুমনার গলা বুজে আসে।

যে তর্ক মায়ের সঙ্গে করেছে, সে তর্ক বাবার সঙ্গে চালাতে পারে না। বাষ্পভরা কণ্ঠে বলে, বেশ, আমার জন্যে যদি তোমাদের মুখ নিচু হয়, তোকসমাজে অপমানিত হতে হয়, আমাকে তোমরা ত্যাগ করো।

কান্তিকুমার স্তব্ধ।

কান্তিকুমার বিমূঢ়।

অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমরা তোমায় ত্যাগ করব!

তা ছাড়া যখন উপায় নেই

সুমনা গলাটা পরিষ্কার করে নেয়।

তা ছাড়া উপায় নেই? চমৎকার!কান্তিকুমার ক্ষুব্ধ বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন, এ ছাড়া সমাধানের আর কোনও পথ তোমার মাথায় এল না, কেমন? আশ্চর্য!

সুমনা কথা বলে না। সুমনা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সুমনা কি ওই আকাশের কাছে আশ্রয় খোঁজে? সুমনা কি আকাশের কাছে শক্তি খোঁজে?

কান্তিকুমার উত্তর সম্পর্কে একটু অপেক্ষা করে তারপর আবার বলেন, তোমার পক্ষে ওটাকে ত্যাগ করা সম্ভব নয় তা হলে। তার বদলে বরং আমাদেরও ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সুমনা, আমি কি তা হলে সত্যিই বিশ্বাস করব, তুমি পাগল হয়ে গেছ?

সুমনা মাথা নিচু করে বলে, বাবা! বুঝতে পারছি তোমাদের খুব একটা বিপদে আমি ফেলছি। তাই ওকথা বলতে পেরেছি। কিন্তু সত্যি এও ভাবছি, এটা মেনে নেওয়া কি এতই অসম্ভব তোমাদের পক্ষে? ইচ্ছে করলে কি

হয় না সুমি, হয় না,কান্তিকুমার আবেগভরে বলেন, তা যদি সম্ভব হত, তোমাকে এত করে বলতে হত না। তোমার বোধশক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে বলেই বুঝতে পারছ না এটা কতখানি অসম্ভব।

কিন্তু বাবা

বলতে গিয়ে থেমে যায় সুমনা।

যা বলতে যায়, পারে না।

কান্তিকুমার মেয়ের ওই রুদ্ধ অভিমানে ভরা যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন, মনটা পীড়িত হয়, বিগলিত হয় না। না, কেউ যদি আপন দুর্মতিতে কষ্ট পায়, সে যতই স্নেহভাজন হোক, তার জন্যে মন গলে না। তাই স্থির স্বরে বলেন, বলো, কী বলতে চাও। থামবার দরকার নেই।

বাবা!

জলভরা দু চোখ বাবার মুখের দিকে তুলে সুমনাও স্থির স্বরে বলে, আমায় তোমরা ক্ষমা করো। আমাকে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিতে দাও। মাঝে মাঝে তোমাদের আদর করে উপহার দেওয়া টাকা তো অনেকগুলো জমেছে আমার, আর কতগুলো গয়নাও রয়েছে–

ধৈর্যের বাঁধ আর থাকে না।

কান্তিকুমার সংযত সভ্য মার্জিত। কান্তিকুমার পরিজনের কাউকে কখনও উঁচু কথাটি বলেন না। তবু কান্তিকুমার রক্তমাংসের মানুষ। তাই মেয়েকে কথা শেষ করতে দেন না। প্রচণ্ড একটা ধমকে থামিয়ে দেন তাকে। সেই ধমকের চেহারাটা এই, সুমনা, ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকে। আমি তোমার এই বিদঘুটে খেয়ালকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেব না। ভেবেছিলাম, বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরিয়ে আনতে পারব। দেখছি তা হচ্ছে না। ঠিক আছে, জোরই খাটাতে হবে। কালই তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে। আর একলাই যাবে।

সুমনা বোধ করি ধমক খেয়েই কঠিন হয়ে যায়। সেই জলভরা চোখ শুকিয়ে ওঠে মুহূর্তে। বলে, আর ও?

ওর যা উপযুক্ত ব্যবস্থা, আমি যে করে পারি করব।

সুমনা বাপকে আঘাত করবে বলেই কি আঘাত করে? না, এ তার অসতর্কতা? কিন্তু চোখের কোণে তার আগুন ঝলসে ওঠে, ওর পক্ষে যা সবচেয়ে উপযুক্ত সেটাই তো সব চেয়ে সোজা বাবা! তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের একটা ছুরি সুমনার অমন নরম গড়নের ঠোঁটের রেখায় উঁকি মারে, সেটাই বোধ করি ভেবে ঠিক করে রেখেছ?

কান্তিকুমার স্তব্ধ হয়ে যান।

ওই আগুন ছিটকানো চোখ, আর ওই ব্যঙ্গের ছুরি উঁচনো ঠোঁট, এ কি বুদ্ধিভ্রংশের? সুমনা পাগল হয়ে গেছে, এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেবার পথ আছে?

না।

মনকে সান্ত্বনা দেবার নেই।

তাই মনকে স্থির করে ফেলেন কান্তিকুমার। স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলেন,ঠিক আছে। একথা যখন বলতে পারলে তখন তোমার স্বেচ্ছাচারিতায় আর বাধা দেব না। যা কিছু ঘটতে থাকবে, অবশ্যম্ভাবী বলেই মেনে নেবার জন্যে মনকে প্রস্তুত করে নেব। একটু আগে পর্যন্তও মনে হচ্ছিল, তুমি আমাদের সম্পত্তি, তুমি আমাদের সেই ছোট্ট সুমনা। বুঝতে না পেরে একটা ভুল করতে চাইছ, তাই চেষ্টা করছিলাম বোঝাতে। নিজেই বুঝতে পারছিলাম না তুমি আস্ত একটা মানুষ। বুঝতে পেরেছি। আর ভুল হবে না।

স্ত্রীর কাছে এসে বলেন, ও যা করতে চাইছে করতে দাও। তারপর দেখা যাবে ভাগ্য কী বলে।

ও যা করতে চাচ্ছে তাই করতে দেব? সুজাতা ঝংকার দিয়ে ওঠে, জীবনভর মেয়ের যথেচ্ছাচার আর যাবতীয় আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে এইটি করে তুলেছ। আরও তিনটে ছেলেমেয়ে আছে তোমার, কই, তাদের তো এত আদর দাও না!

কান্তিকুমার এত দুঃখেও একটু হাসেন।

বলেন,ঠিক এই কথাটা আমিও তোমাকে বলতে পারতাম, কিন্তু বলব না। পুরুষ জাতটা যতই অত্যাচারী হোক, নিষ্ঠুর নয়। সুমনা আমাদের প্রথম সন্তান, আর অনেকদিন পর্যন্ত একটিমাত্রই সন্তান ছিল, সেই থাকার সুযোগ ও শুধু আমার কাছ থেকেই নয়, বাড়িসুষ্ঠু সকলের কাছ থেকেই পেয়েছে। সেই অতিরিক্ত পাওয়াটা যদি ওকে বিকৃত করে থাকে, জেদি করে তুলে থাকে, সকলকেই তার ফল ভোগ করতে হবে। কাল যাবার ব্যবস্থা করো।

ওই আঁস্তাকুড়টাকে নিয়েই?

হ্যাঁ!

কান্তিকুমারের ফেরবার কথা ছিল আরও কিছুদিন পরে। কিন্তু পরিস্থিতিটা এমন অদ্ভুত ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যা ভাবছিলেন তা হল না।

ভেবেছিলেন, এখান থেকে পালাতে পারলেই সুমনার মনকে ঠিক করে ফেলতে পারবেন। সহসা যাতে বিভ্রান্তি এসেছে সুমনার, সেটা থেকে সরে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু সুমনা সব ভেস্তে দিচ্ছে।

অতএব

কান্তিকুমার বলেন, আমার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে চলার পথে কোনওদিন তো ঠেক খাইনি, সুমসৃণ বাঁধা রাস্তায় জীবনের রথ চালিয়ে নিয়ে চলেছি, কোনওদিন পথ আড়াল করে দাঁড়ায়নি ভাগ্যের প্রতিকূলতা, দুঃখ দুশ্চিন্তার ঝড়। এখন যদি আসেই সে সব, সইতে হবে। রাগ করলে চলবে কেন? অসহিষ্ণু হলে চলবে কেন? জীবনের প্রাপ্য পাওনা বলে মেনে নিতে হবে।

অতএব

চলুক সুমনার সঙ্গে তার সাধের শৃঙ্খল।

অতএব কলকাতায় ছোট ভাইকে টেলিগ্রাম করে দিলেন কান্তিকুমার, আমাদের মেয়াদের আগেই ফিরে যাচ্ছি। হয়তো একরকম বাধ্য হয়েই। আমাদের সঙ্গে আরও একটি প্রাণী যাচ্ছে। তার জন্যে হয়তো সংসারে কিছু সংঘর্ষ উঠবে, কিন্তু উপায় নেই।

সুজাতা তবু হাল ছাড়ে না।

আবার আসে মেয়ের কাছে।

তার দুর্বলতার জায়গাটা নাড়া দেয়। বলে, তুই যে এম. এ. পড়বার জন্যে এত উৎসাহ করছিলি, জলাঞ্জলি দিবি তাতে?

সুমনা ফিকে হাসি হেসে বলে, বি, এর রেজাল্টই বেরোক আগে।

এটা অবশ্য উত্তর নয়, উত্তর এড়ানো। সুজাতা বলেন, রেজাল্ট বেরোবেই না, না পাস করবি না, কোনটা ভাবছিস?

কোনও কিছুই এখন ভাবছি না মা আমি। ভাবতে পারছি না।

তা পারবি কী করে?সুজাতা তীব্র স্বরে বলে, ভূতে আশ্রয় করলে কি আর চিন্তাশক্তি থাকে? ভূত যে সেইখানেই আশ্রয় করে। কিন্তু সুমি, আমি তোর মা, আমার কথা শোনা উচিত, এই ভেবেই শোন। বুদ্ধি একটু ঠিক করে, দৃষ্টিশক্তি একটু পরিষ্কার করে ভেবে দেখ, মেয়েমানুষ তুই, অকারণ যেচে একটা নিন্দে কলঙ্ক মাথায় তুলে নিবি কেন?

সুমনা মায়ের মুখের দিকে তাকায়, মার প্রত্যাশাপূর্ণ কাতর মুখের দিকে। দেখে মায়াও হয়। বুঝতে পারে, তার অল্পবুদ্ধি ভালমানুষ মা মনে করছে, এই অস্ত্রে মেয়েকে কাবু করে ফেলতে পেরেছে, তাই মুখে ওই প্রত্যাশার ছাপ।

কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণের উপায় সুমনার হাতে নেই। তাই সুমনা মার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, কিন্তু আমি শুধু মেয়েমানুষইনই মা, মানুষও। মানুষের ধর্মে মানুষের নীতিতে যদি মেয়েমানুষের নীতি-ধর্মে সংঘর্ষ হয়, মানুষের নীতিটাই গ্রহণ করতে হবে।

সুজাতা স্বামীর মতো মেয়ের মতো অত ভাল ভাল কথা বলতে জানে না। সোজা কথাই সতেজে বলে, তা রাজ্যিসুদু মানুষ তোর মতো করছে?

সকলের জীবনে একই সমস্যা এসে পড়ে না মা!

সুজাতা এইবার নিজের চিন্তার কথাই খোলাখুলি বলে, সংসারটি তো শুধু আমার নয় সুমি যে, সেখানে মানুষের ধর্ম, দয়া ধর্ম, সব কিছু চালাতে বসব? পাঁচজনে যখন পাঁচ কথা বলবে?

কথা তো একটা অদৃশ্য পদার্থ মা! সুমনা হেসে ওঠে,ওকে বস্তু মনে করে কষ্ট না পেলেই হল। বলুক না পাঁচজনে পাঁচশো কথা!

সুজাতা তীব্র স্বরে বলে, বাতাসও একটা অদৃশ্য পদার্থ সুমি! কিন্তু সেই অদৃশ্যটা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সেটা ঝড়, তাকে আর অদৃশ্য বলে অগ্রাহ্য করা যায় না, বুঝলি?

সুমনা এক মিনিট চুপ করে থেকে বলে,আমি তো বাবাকে বলছি মা, আমায় তোমরা ত্যাগ করো!

বাবাকে বলছি, আমায় ত্যাগ করো!

সুজাতা স্তম্ভিত হয়ে বলে, এই কথা বলেছিস তুই ওঁকে?

তা আর যখন পথ দেখছি না। সংসারের পাঁচজনের কাছে মুখ থাকাটাই যখন তোমাদের কাছে প্রধান প্রশ্ন, তখন

বুঝেছি! তাই মানুষটা অমন কাঠ হয়ে গেছে। দয়া ধর্মের কথা বলছিস সুমি, ওঁর মুখের উপর ওই কথাটা বলতে তোর দয়া ধর্মে বাধল না?

সুমনা চুপ করে থাকে।

সুজাতা গম্ভীর ভাবে বলে, এতবড় কথাটাই যখন বলতে পেরেছিস সুমি, তখন আমিও বলি, ত্যাগ করলে তোর ওই ওটাকে নিয়ে এত আদর আদিখ্যেতা চলবে কীসের উপর?

ভাবছি ভাগ্যটাকে একবার দেখি না?

ও! তা সেটা দেখবি একটা পথে-পড়ে-থাকা হতভাগার সঙ্গে ভাগ্যকে জুড়ে?ভালমানুষ হলেও, সরল হলেও, মরিয়া বলে একটা কথা আছে। সুজাতা মরিয়া হয়ে উঠেছে বলেই ওর মুখে তীব্র ব্যঙ্গের ভাষা ফোটে। তার ভাগ্য তো চোখের উপরই দেখলে? সেই অবস্থাটা নিজেরও চাও? তোমার মতন বয়েসের একটা মেয়ে ওইরকম একটা বোঝা কাঁধে নিয়ে, ঘরবাড়ি মা বাপের আশ্রয় ত্যাগ করলে, তার বি. এ., এম. এ. পাস খুব বেশি কাজে লাগে না সুমি! পথ থেকে রসাতলের পথে যেতে হয়।

তা বুঝব, সেটাও ভাগ্য!

তবু নিজের গোঁ ছাড়বি না? লক্ষ্মীছাড়া মুখ মেয়ে।

গালাগাল দিচ্ছ? সুমনা হেসে ওঠে, তা দাও, মস্ত একটা লাভও আমার হচ্ছে মা। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। ধরতে পারছি, স্নেহ কী, ভালবাসা কী, কোথায় তার শিকড়, কী তার মূল্য।

অদ্ভুত কঠিন দেখায় সুমনার ওই হাসিমাখা মুখটা।

সুজাতা মেয়ের ওই পরিচিত কঠিন মুখটার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠে যায়।

মা চলে যেতে সুমনাও আস্তে আস্তে ঘরের কোণের দিকে সরে আসে। দেখে, যে প্রাণীটাকে নিয়ে এত সমস্যা, এত সংঘর্ষ, এত হৃদয়-দ্বন্দ্ব, সে ঘুমিয়ে আছে অঘোরে; পৃথিবীর সমস্ত ধূলি মালিন্যের অতীত দেবতার মতো মুখখানি নিয়ে।

আশ্চর্য!

মানুষ কী ছোট!

বুদ্ধি পাণ্ডিত্য শিক্ষা সভ্যতা, দয়া ধর্ম মনুষ্যত্ব, কত কিছুরই বড়াই তার!

তবু কী ছোট!

এত ছোট যে, এতটুকু এটুকু ছোট্ট জিনিস সহ্য করে নেবার শক্তি নেই তার।

.

সুজাতা এই দেড় মাসের পাতানো সংসারটাকে গুটিয়ে তুলতে তুলতে চোখের জলে ভাসছিল।

কী কুক্ষণেই এসেছিল সে এই শিমুলতলিতে মেয়ের শরীর সারাতে। বলতে গেলে একরকম জোর করেই এসেছিল।

ছোট মেয়ে অঞ্জনার স্কুল পরীক্ষা সামনে, অভীক অজীন দুই দুরন্ত ছেলে, তাদের দায়িত্ব জা-শাশুড়ির ওপর চাপিয়ে চলে আসতে চাওয়ায় খুব একটা প্রসন্নও ছিল না কেউ; কান্তিকুমারও বলেছিলেন,ওদের রেখে যাওয়া–তার চাইতে সুমিকে নিয়ে আমিই বরং একা কোথাও।

সুজাতা ঝংকার দিয়ে বলেছিল, তুমি একা কোথায় নিয়ে যাবে শুনি? যেখানেই যাও, উঠবে তো সেই হোটেলে? সেখানের রান্না ওর সহ্য হবে? রোগ ধরার মূল কারণটিই তো ওই। ভুলে যাচ্ছ বুঝি?

ভুলেই গিয়েছিলেন।

মনে পড়ল কান্তিকুমারের।

গত পুজোর সময় দুই মেয়ে আর দুই ভাইঝিকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে রাঁচি বেড়াতে গিয়েছিলেন। অতএব হোটেল ছাড়া আর গতি কী।

তা সেই হোটেলের ঝালমসলা সংযুক্ত রান্না আর শক্ত ভাতই নাকি সুমনার স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণ। অন্তত সুজাতার তাই ধারণা। কান্তিকুমার অতএব চুপ।

সুজাতা নিজের স্বপক্ষে আরও যুক্তি খাড়া করেছিল, ছেলেমেয়ে তিনটিকে রেখে যেতে তোমার তো ভাবনার শেষ নেই, একান্নবর্তীতে থাকার আর সুখটা কী তা হলে? আমাকে বারোমাস অন্যের দায় পোহাতে হচ্ছে না? এই যে ছোটবউ যখন-তখন বাপের বাড়ি চলে যায়, থাকে না ওর মেয়ে? স্কুলের ছুটি-অছুটি বাছে ছোটবউ? দিদি যে সমস্ত পালা পার্বণে গুরু আশ্রমে যাচ্ছেন, থাকে না ওঁর ছেলেটি?

কান্তিকুমার এত খোলাখুলি এইসব স্কুল কথা আদৌ সহ্য করতে পারেন না, অথচ সুজাতার কথার এই-ই ধরন।

ও স্বামীর কাছে যা বলে স্পষ্ট বলে।

আর সত্যি, সকলের কাছেই তো রেখে ঢেকে কথা বলতে হয়, স্বামীর কাছেও যদি মনের কথা খুলে না বলতে পারে, বাঁচবে কী করে?

আসলে শাশুড়ি জায়েদের অপছন্দ ভাবটাই সুজাতার জেদকে উসকে দিয়েছিল। কেন যাবে না সে? যাবার জন্যে উপযুক্ত একটা কারণ যখন উপস্থিত হয়েছে। স্বামীর এত রোজগার, ইচ্ছে করলে কত কীই তো করতে পারে সুজাতা। কিন্তু কে কী ভাববে ভেবে করতে পারে না।

এবার মনের জোর করে এসেছিল।

কিন্তু ভগবান এমন বাদী যে, সেই কে কী ভাবারই মস্ত একটা কারণ নিয়ে ফিরতে হচ্ছে তাকে।

এই যদি শুধু স্বাস্থ্যে টলমল মেয়েকে নিয়ে ফিরতে পারত সে, সবাইকে তো বড় মুখ করে দেখাতে পারত! বলতে পারত, পাঁচজনের মুখ না চেয়ে, জোর করে চলে গেলাম বলেই না এইটি হল।

এই একমাসেই তো যথেষ্ট কাজ হয়েছিল। সেরে উঠেছিল সুমনা। মুখের সেই পাণ্ডুর ভাব, শরীরের সেই ক্লান্ত ঢিলে ভাব, সব দূর হয়ে গিয়েছিল। ইদানীং কতখানি করে হাঁটতে পারছিল।

হাঁটতে পারছিল!

অনেকখানি করেই পারছিল।

ভাবতে গিয়ে থমকে গেল সুজাতা।

যেন হোঁচট খেল।

অতটা না পারলেই বুঝি ভাল ছিল। যদি না পারত, তা হলে তো চলে যেত না না সেই সাঁওতাল বস্তি ছাড়িয়ে জঙ্গলের ধারে।

অবাক হয়ে যাচ্ছে সুজাতা, কদিন ধরেই ভাবছে আর অবাক হচ্ছে, সুজাতার ভাগ্যেই ঠিক সেই সময়, ঠিক সুমনার চলার পথের ধারে, পড়ে থাকতে হয় সুজাতার শাস্তির শনি?

একদিনই তো মাত্র অতটা হেঁটে গিয়েছিল সুমনা।

সুজাতা কেন একা ছেড়েছিল মেয়েকে?

ভাবল সুজাতা। মনের কপালে করাঘাত করল। সুজাতা যদি সঙ্গে থাকত, তা হলে কি সুমনা এই অঘটনটা ঘটিয়ে তুলতে পারত? পারত না, ছুঁতেই দিত না সুজাতা।

এখানেও একবার হোঁচট খেতে হল সুজাতাকে। দিত না! সে জোর কি আছে সুজাতার? ছোট থেকে কখনও পেরেছে মেয়ের কোনও খেয়ালকে নিবৃত্ত করতে? সেই কোন ছোটবেলা থেকে পথের জিনিস কুড়িয়ে কুড়িয়ে ঘরে এনে তোলেনি সুমনা!

মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো রাস্তার কুকুরছানা নিয়ে এসেছে তিন-তিনবার। যখন-তখন কোথা থেকে না কোথা থেকে এনেছে কুচি কুচি বেড়ালছানা।

সবাই ঘিন ঘিন করেছে, ছি ছি করেছে, সুজাতা পর্যন্ত ছাড়েনি দুর দুর করতে, কিন্তু সুমনাকে টলাতে পারা যায়নি। তাদের বুকে করে বসে থেকেছে, নিজের দুধ থেকে দুধ খাইয়েছে, নিজের জামা ফ্রক পেতে শুইয়েছে। তাদের মানুষ করে তুলতে জীবন পণ করেছে।

আজও রাস্তার জিনিস কুড়িয়ে এনে ঘরে তুলেছে সুমনা। শুধু এটা কুকুর বেড়ালের ছানা নয়, মানুষ ছানা। কিন্তু কুকুর বেড়ালের চাইতে কি উচ্চ পদ দেবে কেউ তাকে? মানুষ বলে গণ্য করবে?

সুজাতা নিজেই কি তা করছে?

করছে না।

সুজাতা সবসময় সিটিয়ে আছে। আর ভাবছে, ওই জঙ্গলের ধারে, শেয়াল কুকুরের মুখ থেকে রক্ষা পেল কী করে জীবটা? নিদেনপক্ষে সাঁওতালিরাও তো নিয়ে যেতে পারত।

তা নয়, সুজাতার সংসারের শান্তি নষ্ট করতে সমস্ত কিছুর চোখ এড়িয়ে বেঁচে রইল হতভাগাটা।

রাক্ষস! রাহু! শনি!

কুকুর বেড়ালের মতোই ঘৃণ্য, অথচ তাদের মতো সমস্যাহীন নয়।

ডাস্টবিনের কুকুরকেও কেউ অপবিত্র বলে না। তাদের জন্মের শুচিতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সাবান দিয়ে ধুয়ে তুলে নিয়েই বিছানায় বসায়, কোলে বসায়।

হঠাৎ স্বামীর ওপর রাগে সর্বশরীর জ্বালা করে উঠল সুজাতার। হাতের কাজ ফেলে বসে পড়ল সে। উনি, ওই উনিই এর কারণ। ছোটবেলায় যখন মেয়ে পথ থেকে কুকুর বেড়ালের ছানা কুড়িয়ে এনেছে, বাড়ির সবাই মারমুখী হয়ে দুর দুর করেছে, কান্তিকুমারই মেয়েকে আহ্লাদ দিয়ে বলেছেন,আহা থাক না! কচি মনের মায়াটাকে অমন করে মরিয়ে দিও না।

এখন?

এখন নিজেই কেন অমন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন কান্তিকুমার? কই, মেয়ের কোমল মায়াটুকুকে তো আদর করে আহা বলতে পারছেন না? গুম হয়ে গেছেন কেন?

সুজাতা ভাবল, জীবনে মানুষ বহু যন্ত্রণা সহ্য করে নেয়। অনিবার্য বলেই নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু যা অনিবার্য নয়, সম্পূর্ণ উড়ো আপদ, তাকে মেনে নেওয়া যায় কী করে? মন যে বিদ্রোহী হয়েই থাকে। না না, সুমনার খেয়ালে সৃষ্ট এই বিপদের যন্ত্রণা সহ্য করে নেওয়া হবে না।

উঃ, সেদিনটাকে যদি স্লেটের লেখার মতো হাত দিয়ে মুছে দিতে পারত সুজাতা।

সেই ক্রুর কুটিল দিনটাকে।

অথচ সেদিনটা তার দুমিনিট আগে পর্যন্তও ভারী মনোরম একটি চেহারা নিয়েই প্রকাশিত ছিল। বড় সংসারের অন্তরালে বড় রোজগেরে স্বামীকে তো চক্ষে দেখতেই পায় না সুজাতা। অথচ কোন ফাঁকে যে বেড়ে গেল বয়েস, চল্লিশে পা ফেলল!

পুজোয় কোর্ট অনেকদিন করে বন্ধ থাকে, অনেকদিন ধরেই তো বেড়িয়ে বেড়াতে পারে সুজাতা নিজের ছেলেমেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে। কিন্তু তা হয় না। বাড়ির আরও অনেক সমস্যাকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে, অনেক সমারোহ করে হয়তো বারোটা পনেরোটা দিন বেড়িয়ে আসেন কান্তিকুমার। পনেরো দিনেই টাকার ঘন্ট হয়ে যায়।

হয়তো বা এমনও হয়, সুজাতাই সে যাত্রায় নেই। সংসারে অসুবিধে, মায়ের শরীর খারাপ, ছোটবউ বাপের বাড়ি, এসব নানা প্রতিবন্ধকে বড়রা থেকে গেল, কান্তিকুমার ছেলেমেয়ে ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নে ভাগ্নীর একটি শোভাযাত্রা করে বেড়াতে গেলেন।

বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে সুমনাই বড়।

আর সুমনাই ভরসাই।

সুমনার ভরসাতেই ওইসব কুচোকাঁচাও যাত্রার পারমিট পায়। আর এ যাবৎ সুমনার ভিতরকার ওই মাতৃস্নেহটুকু সুমনার সদ্গুণ বলেই কীর্তিত হয়েছে।

কিন্তু সবেরই তো একটা সীমা আছে।

সেদিন তাই স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুজাতা। সুমনার সীমাহীন সাহসিকতায়।

যখন সুমনা বুকের কাছে ওটাকে জাপটে ধরে সামনে এসে দাঁড়াল, সুজাতা তখন নিজে হাতে রাত্রের রান্না করছিল। মেয়ে যেটি ভালবাসে। স্বামী যেটি ভালবাসে। মনটা খুশিতে ভরা।

এতদিনে মেয়ের খিদে হয়েছে, রুচি হয়েছে, সুজাতা যেদিন যেটি রাঁধছে, মহোৎসাহে খাচ্ছে। এমনকী চির উদাসীন স্বামী পর্যন্ত মাঝে মাঝে বলে ফেলেন, তা এইসব ভাল ভাল রান্নাগুলো কলকাতার বাড়ির ঠাকুরকে শিখিয়ে দিতে পারো না? এতসব জানো৷

সুজাতা মুখে বলে, হ্যাঁ, শেখালেই শিখছে যে! যে আসে সেই তো নিজেকে মস্ত একটি পাকা রাঁধুনি বলে জাহির করে। যে খুন্তি ধরতে জানে না, সেই বলে, সায়েব বাড়ি কাজ করে এসেছি।

কিন্তু মনে মনে বলে, সেই বারো ভূতের বাড়িতে এইসব শৌখিন রান্না! আর জানো না তো ফৈজৎ কত। তোমার মায়ের এক আতপ চালের হেঁসেল, তোমার বোষ্টম দাদা বউদির এক পিয়াজ মাংস বর্জিত আমিষ হেঁসেল, আবার অমেধ্য ভোজনকারীদের আর এক হেঁসেল। আর তারাই তো জাতিচ্যুত। যারা মাংস খায় তারা তো পতিত। তাদের জন্যে বরাদ্দর ব্যবস্থাও নগণ্য।

মনের কথা মুখ ফুটে বললে কান্তিকুমার বিরক্ত হবেন, সেকথা হাড়ে হাড়ে জানা সুজাতার। কখনও কখনও অন্য বিষয়ে বলে ফেলে, কিন্তু খাওয়াদাওয়ার ব্যপারে নৈব নৈব চ। কে জানে বা স্বামী কী মেজাজে ঝপ করে বলে বসবেন, এসব খেয়ে আর সহ্য হচ্ছে না আমার।

সুজাতার নিজের হাতে গড়া এই দেড় মাসের সংসারটিই এখন সুজাতার জীবনের অক্ষয় সঞ্চয়।

সুমনা অবশ্য মাঝে মাঝে বলে, বাবাঃ সারাদিন কী এত কাজ! এত খাটতেই পারো তুমি মা।

কিন্তু সুজাতা সেকথা হেসে ওড়ায়। এইটুকু সংসারের কাজ আবার কাজ! কলকাতার সেই মস্ত সংসারের শুধু দুধ জলখাবারও যে এ খাটুনির চতুগুণ! নাঃ! এবার থেকে জোর করেই প্রত্যেক বছর বেরিয়ে পড়বে সুজাতা!

সেই সেদিন রান্না করতে করতে এই কথাই ভাবছিল সুজাতা। যে দিনটাকে এখন তার স্লেটের লেখার মতো মুছে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

সুমনা এসে দাঁড়িয়েছিল।

সুজাতা চমকে আর শিউরে বলে উঠেছিল, ও কী?

সুমনা দ্রুত ব্যস্ততায় বলে উঠেছিল, একটা বাচ্চা! রাস্তায় পড়ে ছিল। শিগগির একটু গরম দুধ আর অনেকটা ঘেঁড়া ন্যাকড়া আনো না মা, দেরি করলে নিশ্চয় মরে যাবে।

সুজাতা কিন্তু নির্দেশ পালনের লক্ষণ দেখায়নি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কটু কণ্ঠে বলেছিল, মানুষের বাচ্চা না কুকুর বেড়ালের?

বলেছিল অবশ্য সত্য নির্ণয়ের জন্যে নয়, বাচ্চাটা যে মানুষের, তা তার দেখা হয়ে গিয়েছিল। এটা নিতান্তই মেয়ের নির্বোধ দুঃসাহসকে ধিক্কার।

সুমনা আরও দ্রুততায় বলেছিল, কী আশ্চর্য! দেখতে পাচ্ছ না? দোহাই তোমার মা, রাগটা পরে দেখিও, আগে একটা ছেঁড়া শাড়ি কি চাদর দাও। এর গায়ে জড়ানো ন্যাকড়াগুলো বড় বড় কাঠপিঁপড়েয় ভর্তি।

সুজাতা তবু কঠিন মুখে বলেছিল,ছেলেকে যারা কাঠপিঁপড়ের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে চলে যায়, তারা কী, তা অবশ্য বোঝবার বয়েস হয়েছে তোমার? সেইটা তুমি নিজে হাতে করে কুড়িয়ে আনলে?

বাঃ নিজের হাত ছাড়া পরের হাত তখন পাচ্ছি কোথাও বেড়াতে বেড়াতে সেই কোথায় চলে গিয়েছিলাম জানো? যাকগে তুমি আগে দুধ আর ন্যাকড়া দাও বাবা, মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষে পাক এটা। তারপর যত পারো বোকো। জলদি জলদি মা।

বাধ্য হয়েই সুজাতাকে তখন মেয়ের আদেশ পালন করতে হয়েছিল। যেরকম করছিল সুমনা, ভয় হচ্ছিল সত্যি না ওর বুকের মধ্যেই মরেটরে যায় বাচ্চাটা। ফরসা দুখানা শাড়ি, আর একটু গরম দুধ এনেছিল সুজাতা।

কিন্তু সুমনা যখন বাচ্চাটার গায়ে কাপড়-চোপড়গুলো ফেলে দিয়ে পিঁপড়ে ঝেড়ে মায়ের সেই পুরনো শাড়ি দুখানা দিয়ে জড়িয়ে বাগিয়ে ধরে মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দুধটা তো বাপু তোমাকেই খাইয়ে দিতে হবে। আমার সাহস হচ্ছে না–

তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না সুজাতা। তীব্র স্বরে বলে উঠল,আমি খাইয়ে দেব? এই সন্ধেবেলা রাঁধতে রাঁধতে ছোঁব ওকে?

ছোঁবে না!

ছোঁব? বললি কী বলে?

বাঃ এখানে তো আর ঠাকুমা জেঠিমা নেই—

ঠিক এই কথাটাই সুজাতা কেবলই বলেছে মেয়েকে।

এখানে আর মুরগির ডিম সেদ্ধ করে দেব না কেন? এখানে তো আর তোর ঠাকুমা জেঠিমা নেই। কিন্তু এখন সেই সুযোগের উল্লেখে জ্বলে উঠে বলে, তা না হয় নেই। তা বলে আমিই কি একেবারে হাড়ি ডোম? একে তো ওটি কী নিধি তার ঠিক নেই, তা ছাড়া আঁতুড়ে ছেলে তো বটে–

থাক, তবে থাক! সুমনা বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিল, সব সমান! একটা প্রাণী মরছে, সে কথা চুলোয় গেল, ছোঁয়া, নাওয়া এইটাই বড় হল। বেশ, ঠিক আছে, আমিই যা পারি করছি। দুধটা দেবে তো, না কি ও কী নিধি তার বিচার করতে বসবে?

হ্যাঁ, সেদিন এইরকম ঝংকারই দিয়েছিল সুমনা। যা তার চিরকালের স্বভাব। বাড়িসুদ্ধ সকলের আদরের মেয়ে, কথাবার্তায় একটু বেপরোয়া বরাবরই। এখন সে সুমনা বদলে গেছে।

কিন্তু তখনও বদলায়নি।

তাই মাকে বেশ দুকথা শুনিয়ে দিয়ে রাগ করে দুধটা আর পলতেটা নিয়ে সরে গিয়েছিল সে। যা পারে মায়ের আড়ালেই করবে।

সুজাতা মিনিট গুনছিল কখন কান্তিকুমার আসেন।

কিন্তু কান্তিকুমার এসেই বা কী করতে পারলেন? বলতে পারলেন কি দূর করে ফেলে দে ওটাকে? তখনই যদি বলতেন, হয়তো কাজ হত।

এখন ওর মায়া পড়ে গেছে।

এখন শেকড় বসে গেছে।

এখন সুমনা বলছে, তোমরা বরং আমাকে ত্যাগ করো, আমি ওকে ফেলতে পারব না।

হ্যাঁ, সেদিন কান্তিকুমার ছিলেন না।

কান্তিকুমার ফিরে এসে শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।

তারপর বলেছিলেন, কাজটা ভাল করোনি সুমনা!

বলেছিলেন, তবু কি সেই অখাদ্যটার জন্যে ডাক্তারবাড়ি যেতে কসুর করেছিলেন?

কসুর করেননি, হয়তো হঠাৎ বাড়িতে একটা জীবহত্যে ঘটে গেলে বিপদ আসবে বলেই হয়তো বা সুমনার নির্বেদে।

কান্তিকুমারের দিক থেকে ভাবতে গেলে প্রথমটাই।

মেয়ের কীর্তিতে বিচলিত কান্তিকুমার ভেবেছিলেন ডাক্তারের কাছে যাওয়াই ভাল। এই বেলা সবিশেষ বলে লোকটাকে সাক্ষী রাখতে। বাচ্চাটা মরে গেলে, মানে মরে তো যাবেই, তখন অনেক। ফ্যাসাদে পড়তে হবে।

গিয়েছিলেন। পরিচিত ডাক্তার।

এখানে এসেই তো সর্বপ্রথম কাজ হয়েছিল ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা।

ডাক্তার শুনে বললেন, বলেন কী? কোথায়?

জানি না কোন দিকে বেড়াতে গিয়েছিল। ভাল করে জিজ্ঞেস করা হয়নি। বলল তো জঙ্গলের ধারে।

একা বেড়াতে গিয়েছিল নাকি? ওষুধপত্র গোছাতে গোছাতে ডাক্তার বলেন, আপনারা সঙ্গে যাননি?

না। আমি একটু স্টেশনের দিকে গিয়েছিলাম। ও বলল, ডাক্তারবাবু আমায় হাঁটতে বলেছেন।

ডাক্তার একটু হাসেন।

হ্যাঁ, তা বলেছিলাম বটে। নিন, এখন কী মুশকিল বাধালো দেখি। অনেকদিন আগে আর একবার এধরনের একটা কেস হয়েছিল এখানে। নইলে এই ঘুমন্ত গ্রামে চাঞ্চল্যকর কিছু তো কখনও ঘটে না মশাই। বড়জোর একটা নেকড়ে বেরোল তো ঢের। ছুটিছাটায় চেঞ্জাররা আসে, স্থায়ী কোনও রোগী থাকলে বাড়িভাড়া করে থাকে কেউ কেউ। এখানকার সস্তা হাঁস মুরগি কিছু ধ্বংস করে চলে যায়। ঘুমন্ত দেশ আবার ঘুমোয়।

পথে চলতে চলতে কান্তিকুমার বলেন, সেই যে এরকম একটা কেসের কথা বলছিলেন, কী হল তার?

ডাক্তার বলেন, হল আর কী। একটা কেলেঙ্কারিই হল। সে এমনই এক চেঞ্জার ভদ্রলোক বললেন তাঁর বোন একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছেন, এখন কী হয়, কেষ্টর জীব! আমরা আর কী করব মশাই, বললাম, দেওঘরে একটা অনাথ আশ্রম আছে, দিয়ে দেবার চেষ্টা করুন। ভদ্রলোক হাত পা ছেড়ে দিয়ে বললেন, খোঁজ করেছিলাম, তারা বলেছে অত ছোট্ট বাচ্চা নেয় না। তারপর মশাই বোনের নির্বুদ্ধিতার কথা বলে অনেক হাত পা ছুঁড়লেন, অনেক গালিগালাজ করলেন, বললেন, রাস্তা থেকে ছেলে কুড়িয়ে আনল কী বলে! একেই বলে স্ত্রী বুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। শেষে মশাই লজ্জার কথা কী বলব, প্রকাশ হয়ে গেল, বোনেরই ব্যাপার! বিধবা বোন।

চলতে চলতে থেমে পড়লেন কান্তিকুমার। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, এ কাহিনীটা আমাকে শোনানোর আপনার কোনও উদ্দেশ্য আছে ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার থতমত খেলেন।

বললেন, না না, সে কী কথা! কী আশ্চর্য! আপনি তো মশাই সাংঘাতিক লোক!

.

এ তো দেখছি রীতিমত হেলদি চাইল্ড! ডাক্তার মন্তব্য করেন, কে বললে মশাই, এক্ষুনি মারা যাবে? মারা যাবার কোনও লক্ষণই দেখছি না–হাসলেন ডাক্তার, বুঝতেই পারছেন ঝড় খেয়ে বেঁচে ওঠা চারা। সতেজ বেশি। পৃথিবীর আলো দেখবার আগে থেকেই ওকে পৃথিবী থেকে সরাবার কী ষড়যন্ত্র না চলেছিল! শেষ অবধি ফেলিওর হয়েই

সমাজের অধঃপতন সম্পর্কে বেশ খানিকটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন ডাক্তারবাবু। বাচ্চাটা সম্পর্কে নির্দেশ দিলেন কিছু কিছু ওষুধ দিলেন এবং জানিয়ে গেলেন, অনাথ আশ্রমে দিতে গেলে অনেক ঝামেলা, পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়, তার থেকে সবচেয়ে ভাল যদি স্বেচ্ছায় কেউ পালন করতে চায়। বললেন, সাঁওতাল মাগীফাগিগুলো কেউ কেউ আছে–ছেলে ক্যাঙলা। সন্ধানে থাকব, নিতেও পারে। সেই ভদ্রলোকের বোনেরটিকে তো ওই একটা সাঁওতালনি এসেই মহোৎসাহে তুলে নিয়ে গেল।

ডাক্তারকে হ্যারিকেন ধরে পৌঁছে দিয়ে আসে এদের চাকর।

সেই সন্ধ্যার কথাটা আবার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করতে থাকে সুজাতা।

মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি, কিন্তু নিজে সে লক্ষ করেছিল, ডাক্তার বারবার কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল সুমনার দিকে। কেমন একটা গূঢ় মর্মভেদী লক্ষ্যে। অথচ ওই ডাক্তারই দেখেছে এতদিন সুমনাকে। তবু, মানুষের স্বধর্ম! সন্দেহ বস্তুটাই তার মজ্জাগত।

ডাক্তারের সেই দৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে সুজাতা, তার জায়েদের চোখে, দেওর-ভাশুরের চোখে, শাশুড়ি-ননদের চোখে, নিজের ভাই ভাজ বোন ভগ্নীপতির চোখে, আত্মীয় অনাত্মী; পাড়া-প্রতিবেশী ঘর পর সকলের চোখে।

গূঢ় মর্মভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

সেই দৃষ্টির শরশয্যার মধ্যে গিয়ে পড়তে হবে তাকে।

আর অকারণ।

শখের খেয়ালে মায়ের জন্যে এই শরশয্যা পাততে চাইছে সুমনা।

চাইছে কেন, পাতলই তো।

.

সুজাতার চালে ভুল ছিল।

সুজাতা যদি ওই অসহায় জীবটাকে কেবলমাত্র বিপদ বলে গণ্য না করত, যদি ওটাকে বিদেয় করে দিয়ে বিপদ-মুক্ত হবার জন্যে অত হইহই না করত, যদি কেষ্টর জীব বলে একটু করুণা করত, তা হলে হয়তো সুমনা বাঘিনীর শাবক আগলাবার মতো অমন করে আগলাত না সেটাকে। আর হয়তো বা অত মায়াও পড়ত না ওর।

অপটু হাতে দুধ খাইয়ে অসাব্যস্ত হাতে নাইয়ে পটু আর সাব্যস্ত হয়ে উঠল সুমনা। বুকে তার সত্যকার সুধাঁধারা সঞ্চিত হয়ে না উঠুক, স্নেহের সুধা জমে উঠল বুকভরে।

আর সকলের উপর আরও একটা জিনিস তীব্র হয়ে উঠল, সেটা হচ্ছে জেদ।

জেদ আর মমতা।

কঠিন আর কোমল।

এই দুটো হৃদয়বৃত্তি সুমনাকে অন্ধ করে রেখেছে। কাজেই কান্তিকুমার যে ভাবছিলেন হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা কিছু পরিবর্তন হবে, তা আর হয় না। যথানিয়মে বাক্স-বিছানা গোছানো হয়। এখানকার লেনদেন চোকানো হয়, ট্রেনের টিকিট কাটা হয়।

হয় না শুধু একটা কাজ।

সুজাতার বাজার করা হয় না।

এখানকার লোহার বাসন সস্তা, এখানকার বঁটি কাটারি ভাল, তাই সুজাতা মনে মনে সংকল্প করে রেখেছিল যাবার আগে একপ্রস্থ ঘর-সংসারী বাসন কিনে নেবে। না, তাদের সেই বৃহৎ গুষ্ঠির উপযুক্ত বিরাট বাসন-কোসন নয়। ছোট্ট সংসারের মতো। সেই সরঞ্জামগুলি নিয়ে বছরে বছরে বেড়াতে বেরোবে সুজাতা। সব ছেলেমেয়ে কটিকে সঙ্গে নেবে, এখানে সেখানে ডেরা বাঁধবে আর মনের মতো করে, মনের সাধ মিটিয়ে যত্ন করবে তাদের।

কিন্তু আর কী দরকার দোকানে বাজারে? ভবিষ্যতের সেই উজ্জ্বল ছবি তো কালি ধেবড়ে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে।

তবু কান্তিকুমার একবার বললেন, তুমি যে সেই একদিন কীসব কিনবে টিনবে বলেছিলে?

সুজাতা রুদ্ধ কণ্ঠ আর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বলেছিল, ঠাট্টা করছ?

ঠাট্টা!

তা ছাড়া আর কী? ভেবেছিলাম আবার যদি কখনও–তা আর আমি কখনও কোথাও বেরোব?

আহা তা একেবারে অত হতাশ্বাস হবার কী আছে? সংসারে কত ভাঙাগড়া হয়, কত বদল হয়–

এরপর যা বদল হবে, দুঃখের দিকে যন্ত্রণার দিকে, বেশ বুঝতে পারছি।

অতটা ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক নয়। যাবে তো চলো।

নাঃ। আমার আর মন নেই। সুমির দুর্মতি আমার মন ভেঙে দিয়েছে।

তবে থাক। কী করছে সে?

কী আবার? সেই কুড়নো মানিক বুকে করে বসে আছে! আশ্চয্যি আমার কপাল! জগতে এত মেয়ে আছে, কারও জীবনে কোনও সমস্যা নেই।

কান্তিকুমার তর্ক করলেন না।

বললেন না, এ তোমার ভুল ধারণা সুজাতা, সমস্যা অনন্ত। সবাইয়ের ভাগ্যেই কিছু না-কিছু এসে জোটে।

বললেন না, কারণ তাঁর নিজের মনও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তিনিও এই বিদঘুটে সমস্যাটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। লোকনিন্দের ভয়ে নয়, সে ভয়কে কান্তিকুমার মনের জোর দিয়ে কাটিয়ে উঠছিলেন; কিন্তু সুমনা যে বদলে গেল। সুমনা যে হারিয়ে গেল।

কান্তিকুমারের একান্ত আদরের একান্ত আশার সুমনার মৃত্যু ঘটেছে। সেই শোকস্তব্ধ করে দিয়েছে কান্তিকুমারকে।

আর কি কোনওদিন বেঁচে উঠবে সুমনা?

আগেকার সেই হাসিতে উজ্জ্বল, খুশিতে উচ্ছল মুখর মূর্তি নিয়ে?

.

শোকাচ্ছন্ন তিনটি মূর্তি নিঃশব্দে তাদের এই কয়েক সপ্তাহের বাসস্থান ছেড়ে ট্রেনে গিয়ে ওঠে।

কান্তিকুমার শুধু বলেন,মেঘ করেছে, বৃষ্টি আসতে পারে।

আর কিছু না।

যেন এই খবরটা খুব জরুরি। সুজাতা বলে, স্টেশনে বাড়ি থেকে গাড়ি আসবে কিনা কে জানে। জানে নিশ্চিত আসবে, তবু বলে।

সুমনা কিছু বলে না।

.

ট্রেন চলতে থাকে।

সুজাতা জানলায় মুখ রেখে বসে থাকে নির্বাক। কান্তিকুমার একখানা বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছেন ট্রেন চলার সঙ্গে সঙ্গে।

সুমনা বসে আছে নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে। অনেক দুঃখ, অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটা প্রসন্ন কৌতূহলের দীপ্তি মুখে মেখে।

জানলা দিয়ে এসে পড়া আলোর দিকে নীল কাঁচের মতো চোখ দুটিতে কী অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটা! অন্য আর সব শিশুর মতোই তো ওরও সমস্ত চেতনায় আলোর পিপাসা।

দু হাতের মুঠি পাকিয়ে অত লড়ালড়িই বা কেন ওর? যতক্ষণ জেগে আছে ততক্ষণ আর ওই লড়াইয়ের আস্ফালনের শেষ নেই!.. মনে মনে হাসে সুমনা।

ভাবে, এটা কি শিশুমাত্রেরই স্বভাব?

পৃথিবীতে এসে যে সব-কিছুর জন্যেই লড়ালড়ি করতে হবে, তা শিখে এসেছে বলেই তার মহলা দিচ্ছে?

না কি শুধু এই ছেলেটাই?

ও বুঝে ফেলেছে ওকে লড়াইয়ের জোরে জায়গা করে নিতে হবে।

এর আগে কি সুমনা এত ছোট শিশু দেখেনি আর কোথাও? তাই জানে না তারা কোন বয়েসে কী কী করে!

কোন বয়েস!

কী জানি এর কত বয়েস।

ডাক্তার পরে বোধ করি সন্দেহটা ঝেড়ে ফেলেছিল। হয়তো ভেবেছিল সন্দেহটা পোষণ করতে হলে তো তার নিজের বিদ্যাটাই মিথ্যে হয়ে দাঁড়ায়। এতদিন ধরে দেখছে সে সুমনাকে। তাই আবার স্বেচ্ছায় এসেছিল। বলেছিল, সদ্যোজাত নয়, কয়েকদিনের। সেই কয়েকদিনটা কদিন? এই কুসুমসুকুমার অসহায় শিশুটার ওপর মায়া পড়বার উপযুক্ত সময় নয় সেটা? সুমনা কদিন দেখছে? মাত্র নদিন। এই ন দিনেই তো সে ভাবতে পারছে না এটাকে অনিশ্চিত অন্ধকারে ফেলে দেওয়া যায়। কী পেলব-কোমল মুঠি দুটি! কী অদ্ভুত রকমের নরম ভঙ্গিমাময় ঠোঁট! কী উজ্জ্বল নীল চোখ।

ওই চোখ দিয়ে ও হয়তো সুমনার দিকে তাকিয়ে দেখছে। দেখছে সেখানে আশ্রয় আছে, না, স্বার্থপরতা আছে।

লোকে বলে শিশু নাকি অন্তর্যামী!

.

আর সুজাতা ভাবছিল অনেকদিন আগের কথা; তখনও অঞ্জনা জন্মায়নি, জন্মায়নি অভীক, অজীন। সুজাতা তার দিদির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল হাজারিবাগে।

ট্রেনে চেপে সুজাতা জানলা থেকে নড়েনি, পাছে এককণাও সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। কান্তিকুমার অমনি বইয়ের মধ্যে ডুবে বসে ছিলেন, আর সুমনা একটা বড় ডলকে কোলে বসিয়ে সারাক্ষণ একা একা বকবক করতে করতে চলেছিল।

সেই বকুনিটা অবশ্য তার খুকুর প্রতি। মাতৃজনোচিত সমস্ত বকুনিগুলিই সেই শৈশবেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিল সুমনা।

এমনকী তার খুকু চোখে কয়লার গুঁড়ো লেগে কেঁদে ওঠায় বকতে কসুর করেনি–একটু কয়লার গুঁড়ো লেগেছে তো কী হয়েছে? কাঁদবার কিছু নেই এতে। রেলে চড়বার শখ কেন তা হলে? রেলে তো কয়লার গুঁড়ো থাকবেই।

তার একটু পরেই কিন্তু সুজাতাকে উঠতে হয়েছিল সুমনার চোখে জলের ঝাঁপটা দিতে, আর তাকে কোলে নিয়ে ভোলাতে।

আজ আর সুমনা পাখির মতো কলকাকলি তুলছে না। আজ সুজাতাকে উঠতে হবে না সুমনাকে ভোলাতে।

জিজ্ঞেস করাও চলবে না, হ্যাঁ রে চোখে জল পড়ছে কেন? কয়লার গুঁড়ো পড়েছে?

অথচ লাল লাল চোখটা বারবার জানলার দিকে ফেরাচ্ছে সুমনা।

গত দুদিন থেকে মার সঙ্গে কথা বন্ধ।

সুজাতার অপরাধ, ও শেষ মুহূর্তে শেষ চেষ্টা হিসেবে ওখানকার বাসন-মাজা দাইটার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে সাঁওতালদেরই একটা বাঁজা মেয়েকে আনিয়েছিল। মনে করেছিল বন্ধ্যার দুঃখ বর্ণনা করে, আর বন্ধ্যার হৃদয়ের আকুলতা আকুতির কথা তুলে, মন গলিয়ে ফেলবে সুমনার। কিন্তু ঝিয়ের সামনে অপদস্থ করেছে সুমনা সুজাতাকে। দেয়নি।

ঘরে এসে বলেছে, মা, আর যাই করো করো, ছোটোমি কোরো না।

সুজাতা ছোটোমি করেছে!

এই কথা বলেছে তার পেটের মেয়ে!

সুমনা!

যে মেয়েকে সে রক্ষণশীল বাড়ির মধ্যে থেকেও সংগ্রাম করে করে সমস্ত আধুনিকতা আর উদারতার সুযোগ দিয়ে মানুষ করেছে!

তবে আর কথা বলবে কেন সুজাতা।

.

ঝনাৎ করে থেমে গেল গাড়ি।

এসে পড়েছে বর্ধমান। কী আশ্চর্য, কখন চলে গেছে সময়, কখন বাংলার মাটিতে এসে ঢুকেছে অজগর গাড়িটা?

দিনের গাড়ি!

অতএব নিভৃত শান্তির আশা বাতুলতা। তবু যে এতক্ষণ ছিল সে শান্তি, এই আশ্চর্য!

হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লেন এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা, আর তাঁর সঙ্গে একটি তরুণী বউ। বউটির কোলে কাঁথায় মোড়া একটি পুঁটুলি।

কাঁথায় মোড়া পুঁটুলি নিয়ে কমবয়েসী মেয়ে বউদের তো কতই গাড়িতে উঠতে দেখেছে, তবু কেন যেন দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে সুজাতার।

ওই একবার মাত্র দৃকপাত করেই ও আবার জানলার বাইরে মুখ ফেরাল।

কিন্তু সেটাই তো ভুল। কেন তাকিয়ে রইল না তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে?

বারেবারে এই ভুলের বোকামিই করে বসছে সুজাতা।

বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, যখন একসময় অন্যমনস্কতার অতলে তলিয়ে গেছে ও, তখন হঠাৎ কানে আসে সেই কর্ণবিদারী প্রশ্ন।

যে প্রশ্নের ভয়ে তখন বুক কেঁপে উঠেছিল তার।

এইটি বুঝি প্রথম?

নিজের ভুল বুঝতে পারে সুজাতা। বুঝতে পারে নিজেই ঘাঁটি আগলে বসা উচিত ছিল তার। এমন কথাও তো বলতে পারত, শিশুটা সুজাতারই। প্রথম নয়, শেষ। হতে পারে না সুজাতার?

চল্লিশ বছর বয়সে কি এমন ঘটনা ঘটে না কোনও মেয়ের?

হ্যাঁ, তাই বলতে পারত! বলত–শেষ কুড়োনো বলেই অগ্রাহ্য করে আর তাকিয়ে দেখি না। তাই বড় মেয়েই দেখেশোনে ওকে। এ সবই বলতে পারত সুজাতা।

কিন্তু এখন আর হয় না।

এখন সেই প্রশ্নটি উচ্চারিত হয়ে গেছে! সুজাতার কানে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে সে শব্দ।

এইটি বুঝি প্রথম?

সুজাতা তাকিয়ে দেখে তীক্ষ্ণ কঠোর দৃষ্টিতে।

ওদের দিকে নয়, মেয়ের দিকে।

সুমনা দেখতে পায় না সে দৃষ্টি।

তাই সুমনা মৃদু হেসে বলে, কী যে বলেন! এটা হচ্ছে কুড়িয়ে পাওয়া!

প্রশ্নকর্তী অবশ্য এ উত্তরকে রহস্য ভেবেই হেসে ওঠে। বলে, কোথায়? বনে জঙ্গলে?

হাঁসুমনা বলে, বেড়াতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি জঙ্গলের ধারে পড়ে পড়ে কাঁদছে।

সুজাতা তীব্র দৃষ্টিতে কান্তিকুমারের দিকে তাকায়।

বইয়ের মধ্যে কি সত্যি সমাধিস্থ হয়ে গেছে লোকটা। একটা কিছু করুক। একটা কিছু বলে উঠুক! এ প্রসঙ্গটা যাতে বন্ধ হয়, তার ব্যবস্থা করুক! কিন্তু লোকটা কিছুই করে না।

সত্যি শুনতে পাচ্ছে না, না, শুনতে না পাওয়ার ভান করছে?

বউটি কিন্তু সেটাও পরিহাস ভেবে ইত্যবসরে নিজের কথা শুরু করে দিয়েছে!

তাই তো দেয় লোকে।

নিজের কথা কইতেই তো ভালবাসে। নিজের কথা কইবে বলেই বৃথা দু-একটা প্রশ্ন করে পরকে।

ওটা হচ্ছে কথা তোলার ঘর!

ওই ঘরের পিঠে ঘর তুলে তুলে বুনে তুলবে নিজের মহিমা, নিজের পরিচয়।

সে যা কষ্ট পেয়েছি ভাই! ওই যে সঙ্গে আমার শাশুড়ি রয়েছেন। খুব ভাল। কী যত্নই করেছেন আমায়! আমি বলি, বাবাঃ, এত কষ্ট! এই কাণ্ডকারখানা করে এক-একটা মানুষ পৃথিবীতে আসে? তবু পৃথিবীতে এত কোটি কোটি লোক!… ভাবলে আশ্চয্যি লাগে না ভাই? যাই বলুন ভগবান খুব একচোখা, তাই না? যত যন্ত্রণা মেয়েদের ভাগে। ভগবান নিজে পুরুষ বলে,..বলুন? সত্যি বলছি। কিনা?

সুজাতার মুখে আসে,ওগো বাছা, একটু সভ্যতা-ভব্যতা বজায় রেখে কথা বলো, গাড়িতে একটা পুরুষ বসে রয়েছে

কিন্তু পারে না।

বলতে গিয়ে থেমে যায়।

কে বলতে পারে সেই কথাটুকু থেকেই বচসা হয়ে যাবে কিনা। যে মেয়ে বিগলিত আনন্দে হেসে হেসে কথা বলছে, সে এক্ষুনি সাপিনীর মতো ফোঁস করে উঠবে কি না।

অতএব কিছু না বলাই ভাল। মেয়েটা কথার গাড়ি চালিয়েই যায়।

.

ওমা, ও কী, শাড়ি পেতে শুইয়েছেন কেন? কাঁথা করতে পারেন না? অবিশ্যি প্রথমবার আর নিজে কে করে, তা নয়। পাঁচজনেই করে দেয়। তবে বেশি সভ্যরা আবার কাঁথা করে না, তোয়ালেয় শোয়ায়। যাই বলুন, কিন্তু শাড়িতে!..ইস আমি কি বোকা! সব বোধহয় বাক্সে তুলে ফেলেছেন। শুধু ট্রেনের মধ্যে যা হোক করে! কিন্তু ভাই ছোটদের তোয়ালের থেকে কাঁথাই মানায়, তাই না? বেশ আদর আদর ভাব থাকে।

মেয়েটি বহু কারুকার্য করা একখানি কাঁথা বিছিয়ে টানটান করে ঘুমন্ত শিশুটির গায়ে ঢেকে দেয়। ঢাকা দিয়ে অপরিসীম তৃপ্ততা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে।

সুমনার কোলের কাছে শুয়ে থাকা জীবটাও এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আলোর তৃষ্ণায় আকুলতা করবার ক্ষমতা আর এখন নেই।

কিন্তু সুমনাও কি ঘুমিয়ে পড়বে?

ওইরকম সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত হয়ে, নিশ্চিন্ত শান্তিতে! ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে তার শরীর। না কি প্রশ্নোত্তরের কাঁটাবনের হাত থেকে রক্ষা পেতেই তার শোয়ার আকুলতা?

কে জানে কী জন্যে, গুটিগুটি হয়ে শুয়েই পড়ে সুমনা। শিশুটাকে হাতের আড়ালে আগলে। বালিশ নেই, কাঁথা নেই, যদি পড়ে যায়।

অতঃপর শাশুড়ি বউয়ের মধ্যে নিম্নস্বরে কথা হতে থাকে।

কী ফ্যাশানই হয়েছে আজকাল! এয়োস্ত্রী মানুষ, কোলে কচি ছেলে, মাথায় একটু সিঁদুর নেই, হাতে নোয়া নেই, ছিঃ!

বউ বলে, কতজনই তো পরে না। ওই হয়েছে এখন।

ছিঃ, দেখে ঘেন্না করে।

শ্রীরামপুরে নেমে গেল ওরা।

আর হঠাৎ সেই সময় বই থেকে মুখ তুললেন কান্তিকুমার। বললেন, সুজাতা, তুমি অনায়াসে জানলার কাছ থেকে সরে এসে এদিকে বসতে পারতে!

.

আগে থেকে খবর দিয়ে এসেছিলেন কান্তিকুমার। স্টেশনে গাড়ি ছিল।

ড্রাইভার সেলাম করে দাঁড়িয়েই, হতচকিত হয়ে তাকাল সুমনার দিকে।

সুমনার মুখ অন্যদিকে ফেরানো।

সুমনার বুকের কাছে আঁকড়ানো শাড়ি দিয়ে মোড়া একটা রহস্যময় বস্তু।

ড্রাইভার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেবার অবসরে কান্তিকুমার আর একবার বলেন, সুজাতা, ওটাকে তোমার কাছে রাখা কি একেবারেই অসম্ভব?

সুমনা চমকে তাকায়।

আর সুজাতা চাপা আক্রোশের গলায় বলে ওঠে, অসম্ভব তো নিশ্চয়! কাছে নিয়ে যদি আমি গলা টিপে দিই।

অদ্ভুত!

সুমনাকে উপলক্ষ করেও এমন বিষাক্ত কথা বলতে পারছে সুজাতা! কান্তিকুমার চুপ করে যান।

ড্রাইভারটা কী ভেবে কোনও প্রশ্ন করল না।

.

এরা এসে পড়ায় হইহই পড়া উচিত ছিল। কিন্তু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল সবাই! দিদি দিদিকরে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল না কেউ। সভয়ে সরে সরে বেড়াতে লাগল সুমনার নিজের ভাইবোনেরা, খুড়তুতো ভাইবোনেরা।

আর সুমনা?

সেও তো কেমন নিথর হয়ে গেছে। আগের সুমনা তো আর নেই। তার কথার সমুদ্র শুকিয়ে গেছে। যেন।

ধীরে ধীরে গিয়ে নিজের খাটের একপাশে শুইয়ে দেয় শাড়ি-জড়ানো বস্তুটাকে। বসে থাকে ঘরের মধ্যে।

অনেকক্ষণ পরে ছোটখুড়ির মেয়ে অরুণা এসে ডাকে,দিদি, মা বললে, হাতমুখ ধোও। চা হয়ে গেছে।

হাতমুখ ধুতে গিয়ে জলের কলটা খুলে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে অনেকক্ষণ কিছু না ভেবে দাঁড়িয়ে রইল সুমনা।

তারপর ভাবল, আমি এমন বোকার মতো চুপ করে আছি কেন। এমন অপরাধী-অপরাধী ভাবের কী দরকার? তারপর ভাবল, ওদের অনুচ্চারিত প্রশ্নভরা চোখই আমার বল হরণ করছে। ওরা চিৎকার করে প্রশ্ন করুক না! বলুক না–সুমনা, এ কী?

তখন সুমনা তর্ক করবে, প্রশ্ন করবে, মানুষের সংজ্ঞা কী, তা জানতে চাইবে।

কিন্তু ওরা কথা বলছে না।

বললও না!

শুধু সুমনা যখন চা খেয়ে উঠে যাচ্ছে, তখন জেঠি জপের মালা হাতে করে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, তোর মা তো চিঠিতে লিখেছিল শরীর বেশ সারছে, তা কই? দেখছি না তো কিছু?

অনেকক্ষণ–না না, অনেকদিন যেন কথা কয়নি সুমনা; তাই সুমনার গলার স্বর বুজে আছে। তাই খোলা গলায় কথার উত্তর দিতে পারে না সে।

শুধু অস্ফুটে বলে, ভালই তো আছি।

কী জানি বাছা, ভাল থাকার তো কিছু দেখছি না। জেঠি মন্তব্য করেন, গাল দুটো তো চড়িয়ে ভাঙা, চোখের কোলে কালি।

যতটা নয় তার বেশি করে বলেন জেঠি।

.

ভাল আছি, ভালই আছি–এ কথা কে শুনতে চায়? চায় না। তাই ভাল থাকা–দেখলে ভাল লাগে না। আর অন্যের আপন নিভৃতির ভাললাগাটুকুকে টেনে হিঁচড়ে উপড়ে ফেলতে পারলেই বুঝি বাঁচে মানুষ!

তাই সুমনার একটা কুড়িয়ে পাওয়া পুতুল নিয়ে খেলার ভাললাগাটুকু কেটে ছিঁড়ে তছনছ করে দিতে চায় সবাই।

.

অজস্র কৌতূহলের মন সজাগ হয়ে উঠেছে কান্তিকুমারদের বাড়ির নতুন খবরে। আশে-পাশে ধারে কাছে যেসব মন ও-বাড়ি সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে বসে থাকত, সেইসব মন।

কিন্তু যারা ধারে কাছের নয়? যারা কান্তিকুমারদের নিজের বাড়ির?

সেখানেও সেই স্তব্ধতাই রয়ে গেল নাকি?

চুপ হয়েই থাকল সবাই?

কেউ কোনও প্রশ্ন নয়?

কেউ কোনও প্রতিবাদ নয়!

যেমন প্রথম মুহূর্তে করেছিল। প্রশ্নহীন অবাক দৃষ্টি নিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকা।

না, তাই কি হয়?

অপ্রতিবাদে কেউ এতটুকু এদিক ওদিক মেনে নেয় না, আর এ তো একটা বিরাট অনাচার। সুমনার কাছে পুতুলের মতো বলেই তো আর সেই ভয়ংকর জিনিসটা পুতুল হয়ে গেল না?

অতএব গুমোট ভেঙে ঝড় ওঠে।

প্রশ্নে আর প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে সংসার। কেন…কেন..কী বলে…কোন্ সাহসে…?

.

ব্যাপারটা নিতান্ত গুরুতর, তাই প্রথম নান্দীপাঠ করেন কান্তিকুমারের দাদা শান্তিকুমার। খুব গম্ভীর আর ভারী গলায় বলেন, মেয়েরা অনেক বিষয়েই শৈশব অতিক্রম করে না। জানা কথা! কিন্তু তুমি? তোমার বিবেচনা বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল কী করে বলে দিকি কান্তি?

বৈষ্ণবচরণাশ্রিত ভক্তিমান্ মানুষ, কখনও চেঁচিয়ে কথা বলেন না, তুমি ছাড়া কাউকে তুই বলেন না।

কান্তি ক্লান্তকণ্ঠে বলেন, কী করব, এমন জেদ ধরল।

জেদ ধরল বলে যথেচ্ছাচারের প্রশ্রয় দেওয়া যায় না কান্তি, শান্তিকুমার বলেন, স্নেহে অন্ধ হলে উভয় পক্ষের কারও মঙ্গল নেই।

কান্তিকুমার খুব স্থির স্বরে বলেন,বেশ, আমি তোমায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছি দাদা, তুমি এ বিষয়ে যা পারো করো।

শান্তিকুমার ভুরু কুঁচকে বলেন, আমি কী করব?

বোঝাও ওকে। তোমাকে ভয় করে, ভক্তি করে।

শান্তিকুমার কিছু বলার আগেই জেঠি রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন। বলে ওঠেন, এখন আবার বোঝানোর কথা! গোড়া কেটে আগায় জল! বলছ তো, কুড়িয়ে এনেছে। বেশ,বলি–তক্ষুনি দূর দূর করে ফেলিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে চান করিয়ে ঘরে তোলালে তবে না হত। এ এখন পরের পাপ ঘরে তুলে ফেলেছ। এখন কিছু করা শক্ত।

কান্তিকুমার গম্ভীর ভাবে বলেন, গোড়াতেই গোড়া শক্ত থাকে, এমন প্রকৃতিরও অভাব নেই সংসারে। সুমিকে তো তোমরা জানোই।

জানি বলেই তো জানি মেজ ঠাকুরপো, বলতে যাওয়া মুখমি। কথা থাকবে না। তবে এই ঠাকুর দেবতার বাড়িতে অতবড় একটা অনাচার সহ্য করাও তো শক্ত।

কান্তিকুমার এবার একটু হাসেন, তা এ অনাচার তো তোমার ঠাকুর দেবতার গায়ে গিয়ে লাগছে না বউদি।

লাগছে না–তাই বা বলি কী করে বলো? বাতাসেই অনাচার। রাস্তায় যারা ছেলে ফেলে দিয়ে যায়, তারা নিজেরা কী, আর তাদের ছেলে কী, তা তো আর তোমাকে বোঝাতে হবে না!

নাঃ, তা হবে না বটে।

আর একটু হাসির মতো করে চুপ করে যান কান্তিকুমার।

শান্তি আর একবার বলেন, যাই হোক, তোমাকে একটু মনে করিয়ে দিলাম কান্তি, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে স্বেচ্ছাচার চলে না। সকলের মুখই চাইতে হয়।

হ্যাঁ, সকলের মুখ চাইতে হয়।

এ দাবি ছোটভাই জয়ন্তীকুমারও তোলে। সেও এসে জানতে চায় ওই বিদঘুটে জীবটাকে কোথায় চালান করবে ঠিক করেছে মেজদা।

বলা বাহুল্য, সদুত্তর মেলে না।

উত্তরের বদলে প্রশ্নই করেন কান্তিকুমার, ঠিক আর করলাম কই?

জয়ন্তীকুমার ক্ষুব্ধ হাস্যে বলে,সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে আমার মতে ওখানেই কোনও অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসা উচিত ছিল তোমাদের। পাঁচজনের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে, তারপর ব্যবস্থা করতে যাওয়াটা বোকামি।

কান্তিকুমার এই ছোট ভাইটির সঙ্গে কখনওই কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না, কারণ বড় বেশি উত্তেজনাপ্রবণ জয়ন্তী, কথার পিঠে কথা কইতে হলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

কিন্তু এখন আর আলোচনা করার প্রশ্ন কান্তিকুমারের দিক থেকে নয়, এখন সে নিজেই আলোচনার সূত্র তুলেছে। অথবা সে অপর পক্ষীয় উকিল, আর কান্তিকুমার অভিযুক্ত আসামি।

হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট কান্তিকুমার সেন।

তাই কান্তিকুমার গম্ভীর হাস্যে বলেন, সন্দেহটা কীসের?

কীসের, তা বিশদ করে বোঝাতে হবে ভাবিনি।

ঠিক আছে। কিন্তু সন্দেহটা বাইরের পাঁচজনের মধ্যেই ধূমায়িত হচ্ছে, না নিজেদের ঘরও জ্বালাচ্ছে?

জয়ন্তীকুমার উত্তেজিত ভাবে বলে, কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেসব জানি না। তবে যেটা স্বাভাবিক সেটাই বোঝাতে এসেছি তোমাকে।

বোঝাতে এসেছে।

জয়ন্তী কান্তিকুমারকে!

হ্যাঁ, এমনিই হয়।

হাতি দিয়ে পড়েছে দেখলে ব্যাঙের পা নিসপিস করে।

অবাক হবার কিছু নেই কান্তিকুমারের।

অবাক হনও না।

মনুষ্য চরিত্রের বিচিত্র রহস্য দেখাই তো পেশা তাঁর।

তিন ভাইয়ের মধ্যে কান্তিকুমারই সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত, কান্তিকুমারই সকলের থেকে বেশি রোজগারি। কান্তিকুমার স্বভাবে রাশভারী, অথচ সদাপ্রসন্ন শান্ত স্নেহশীল। তাই কান্তিকুমার বাড়িতে সকলেরই একটু বিশেষ সমীহের বস্তু।

কান্তিকুমার সকলের সব সুবিধে অসুবিধে অভাব অভিযোগের দায় পোহান, তাই কান্তিকুমার সকলের কৃতজ্ঞতার পাত্র।

কিন্তু অবিরত সমীহ করতে করতে আর কৃতজ্ঞ হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে না মানুষ?

পড়ে।

তাই সেই উচ্চস্তরের মানুষটার কোথাও কোনওখানে দুর্বলতা ধরা পড়লে আহ্লাদের আর সীমা থাকে না লোকের। খানিকটা ক্লান্তি দূর করে বাঁচে।

কান্তিকুমারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারা গেছে এ একটা ভারী মজার ব্যাপার। তাই কারণটাকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বিরাট থেকে বিরাটতর করে তুলছে সবাই।

কিন্তু অপরপক্ষে যে একেবারেই কেউ নেই, তাও বলা যায় না। আছে। যে আছে, সে হচ্ছে ছোটবউ মালবিকা। মালবিকা অবশ্য বরাবর মুখরা বলেই খ্যাত, তাই যা বলে স্পষ্ট প্রখর।

বলে শাশুড়ি আর বড় জায়ের মুখের উপরেই।

বাবাঃ! শুনে শুনে আর না বলে পারছি না। কদিন ধরে কি তিলকে তাল করছেন আপনারা! একটা সদ্যোজাত শিশু, তার জাত আছে না ধর্ম আছে? না সে নিজে কোনও পাপের পাপী? তাকে একটু আশ্রয় দিলে জাত ধর্ম সব রসাতলে যাবে? এতবড় বাড়িতে এত ছেলে-পুলে মানুষ হল, হচ্ছে, আর ওই একমুঠো ফুলের মতন ছেলেটা, এত ভার লাগছে আপনাদের? কুড়োনো ছেলে বলে একটা কথা তো আছেও জগতে!

শাশুড়ি যোগমায়া বিরক্ত কণ্ঠে বলেন,তোমার বুদ্ধিকে বলিহারি দিই ছোটবউমা! বাড়িতে এত ছেলে মানুষ হচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনা করছ? আমাদের ঘরের ছেলে আর ওইটা? কোন্ পাণ্ডির পাপের ফল তার ঠিক নেই।

মালবিকা ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, এই আমাদের বাড়ির মতো পুণ্যবতীদের বাড়িরই কোনও পাষণ্ডির বোধহয়। ওই ছোট্ট বাচ্চাটার পাপ-নিশ্বাসে পাছে সেই পুণ্যবতীদের পুণ্যের ভরা উপে যায় তাই ওটাকে শেয়াল কুকুরের মুখে ফেলে দিয়ে, নিজেরা গঙ্গাস্নান করে পুজোর চন্দন ঘষতে গেছে।

তুই থাম ছোটবউ! বড় জা স্বর্ণপ্রভা হাতের মালাগাছটা থলিতে ঢুকিয়ে বলেন,যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে বসিস তুই, বুদ্ধি তো আর পাকবে না কোনওকালে?গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলেন, ওই কুড়িয়ে পাওয়াটা গল্পকথা কিনা কে জানে!

গল্পকথা!

তা আশ্চয্যি কী! ওই সাঁওতালদের দেশে অমন ফুলের মতন ছেলে আসবে কোথা থেকে রে?

মালবিকা ঠোঁট উলটে বলে, আসতে আবার বাধা কী। কোনও সাহেবসুবোর দয়ার দান হতে পারে।

সংসার-অভিজ্ঞ স্বর্ণপ্রভা আরও ফিসফিস করে বলেন, বকিস কেন, বুনো মুনোরা অমন ফেলে ছড়ে দেয় না। দেবেই বা কেন। ধর্ম সমাজ এসবের তো আর বালাই নেই তাদের, সাহেব ছেলেয় নিলেও নেই। ওদের নয়। আরও নিচু গলায় কী একটু বলেন তিনি।

কিন্তু নতুন কিছু কি বলেন?

সুজাতা কি এই ফিসফিস সম্বন্ধে ধারণা করেনি? দেখেনি কি সবই তার প্রতিকূল? রাঁচি থেকে ফেরা অবধি এই সাত আট মাস ভুগছে না সুমনা জ্বর বমি হজমের গোলমালে? খিদে আর খাদ্যে রুচি নষ্ট হয়ে যায়নি তার? তার ওপরেই কষ্ট করে পরীক্ষার পড়া তৈরি আর পরীক্ষা দেওয়ার চাপে চোখমুখ বসে যায়নি বেচারার? আর পরীক্ষার পর একেবারে ঘরের কোণে বিছানা আশ্রয় করে পড়েনি?

সেইজন্যেই না সুজাতা মেয়ে নিয়ে অমন অস্থির হয়ে চেঞ্জে গিয়েছিল।

হায় ভগবান, যদি না যেত!

যদি ঠিক সেই সময় ভয়ানক একটা প্রতিবন্ধকতা আসত। যদি এই দেড় দেড়টা মাস এদের চোখের বাইরে না কাটাত।

যে ঘটনাগুলো নিতান্ত সহজ চেহারায় ছিল, সে ঘটনাগুলোই যেন এখন দাঁত খিঁচিয়ে উঠছে।

সুমনার যে অসুখটা এতদিন বাড়িসুষ্ঠু সকলের দুশ্চিন্তার ব্যাপার ছিল, সেটাই কুৎসিত সন্দেহের কালিতে কালো হয়ে উঠছে।

সুজাতা আসছিল কী একটা দরকারে ছোট জার কাছাকাছিবড় জার ফিসফিস দেখে সরে যায়।

সরে যায়, কিন্তু চলে যায় না।

চলে যায় না, সে কি কৌতূহলের বশে? না হাত পা বুক বড্ড বেশি কেঁপে ওঠার দরুন অক্ষমতায়?

কে জানে কী!

তবু দাঁড়িয়ে তো পড়ে।

আর দাঁড়িয়ে পড়ে বলেই মৃত্যুদণ্ডাদেশটা স্বকর্ণেই শুনতে পায়।

শুনে ছিটকে ওঠে না। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মালবিকা কিন্তু ছিটকে ওঠে।

বলে,ছি ছি দিদি! আপনার হাতে না জপের মালা!

জপের মালা তার কী–সদর্পে বলেন স্বর্ণপ্রভা, হ কথা বলব, গুরুর চরণ ছুঁয়ে বলব। মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখিস দিকিনি।

না দিদি, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না।

না পারলে আর কী করব। পরে সবই টের পাবি। এতবড় কাণ্ড কি আর লুকোনো থাকে! এই মতলব এঁটেই হাওয়া বদলের ছুতো। নইলে জগৎ সংসারে এত লোক হাওয়া খেতে যায়, কে কবে জঙ্গলের ধারে খোকা কুড়িয়ে পায় রে?

মেয়ের কাছে এসে আপসে পড়ে সুজাতা।

যে সর্বনাশের আশঙ্কা করছিল সেই সর্বনাশই যে ঘটল, সেই কথাই ব্যক্ত করে বলল, তবু বলব, তোর জেঠিকে আমি দোষ দিতে পারিনে। অন্যের হলে হয়তো আমরাও এই সন্দেহ করতাম।

করতে?

অদ্ভুত একটা বিদ্যুৎ ঝলসানো মুখে বলে সুমনা।

করতাম বইকী! কেন করব না? জগতে এমন কি ঘটে না? কতই ঘটছে। আমরা না হয় তাকে জানি, লোকে তো–

না, তোমরা আমার কিছুই জানো না। সুমনা স্থির স্বরে বলে, জানলে এখনও চেষ্টা করতে না আমার মন ফেরাবার। জেনে রেখো মা, আমি যে অসহায় প্রাণীটাকে আশ্রয় দিয়েছি, তাকে রক্ষা করবার জন্যে পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যদি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও, সে শাস্তিও মাথা পেতে নেব।

প্রতিকূলতাই শক্তির জন্মদাতা।

প্রতিকূলতা না এলে হয়তো এত জেদের শক্তি সঞ্চয় হত না সুমনার। অপরপক্ষের শিবিরে রণসজ্জা হচ্ছে অনুমান করে ও নিজের তূণে বাণ ভরে।

আর যতই ভাবতে থাকে এই এক মুঠো হাড়মাংস, এই এক কণা প্রাণ, এর বিরুদ্ধেই ওদের শিবিরে এত সজ্জা, ততই ভয়ংকরী হয়ে ওঠে সন্দেহে, অবিশ্বাসে, ঘৃণায়।

বড়রা কেউ কোনও দরকারে একবার ওর ঘরে ঢুকলে, বিদ্যুদ্বেগে গিয়ে ছেলেটাকে বিছানা থেকে তুলে কোলে চেপে নেয়, ঘোটরা এসে দাঁড়ালে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে তাদের গতিবিধির দিকে।

যদি বড়রা কিছু শিখিয়ে দিয়ে থাকে।

যদি এমনই কৌতূহলের বশে কোলে তুলতে গিয়ে ফেলে দেয়!

ঘর থেকে বেরোনো প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। নিতান্ত স্নান আহারের সময় ব্যতীত ঘর থেকে নড়ে না সুমনা। আর সেই সময়টুকু, এখনও জগতে যাকে এক কণা বিশ্বাস করে, সেই মানুষটাকে বসিয়ে রেখে যায়।

মানুষ বলেই যদি গণ্য করা যায় তাকে।

সে হচ্ছে তার সব ছোটভাই অজীন।

প্রথম দিন একমাত্র অজীনই দিদির ঘরে এসে অসীম কৌতূহলে ছোট্ট ছেলেটার রক্তাভ হাতের মুঠি আর পায়ের পাতা দুটিতে আলতো হাত রেখে প্রশ্ন করেছিল, রাস্তায় পড়ে ছিল?

সুমনা ছোটভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ রে, একেবারে জঙ্গলের ধারে। ওঁয়া ওঁয়া করে কান্না কোথা থেকে আসে, বলে ছুটে গিয়ে দেখি এই কাণ্ড! গায়ে কাঠপিঁপড়ে ধরেছে, তাই কাঁদছে।

অজীন বোধ করি তার কোনও একটি জানা গল্পের কাহিনী স্মরণ করে বলেছিল,নিশ্চয় ওকে নেকড়ে বাঘে চুরি করে এনেছিল। তাই না দিদি?

সুমনা অন্যমনা হয়ে বলেছিল, নেকড়ে বাঘে চুরি করে এনেছিল, না নেকড়ে বাঘেই ফেলে দিয়ে গিয়েছিল কে জানে!

বাঃ, ওরা মানুষখেকো কোথায় পাবে? তবে চুরি করে নিয়ে গিয়ে, খেয়ে না ফেলে মানুষ করে ওরা। তুমি যদি তুলে নিয়ে না আসতে, ও নিশ্চয় নেকড়ে-মানুষ হয়ে যেত দিদি।

ছেলেটা বালক।

তার উপযুক্ত উত্তরটা নয়।

তবু উত্তরে বলেছিল সুমনা, তা হোক, তা হলেই ভাল হত। পৃথিবীতে তো অনেক মানুষ-নেকড়ে আছে, দু-একটা নেকড়ে-মানুষ থাকলই বা!

অজীন বলে ওঠে, বাঃ তুমি তা হলে কী পুষতে?

সুমনা চমৎকৃত হয়ে বলে, আমি এটা পুষছি, একথা তোকে কে বললে রে অজি?

অজীন বলে ওঠে, বাঃ, ঠাকুমা বলেছিল না বুঝি বাবাকে?

বলেছিল! কী বলেছিল?

বলেছিল, হ্যাঁ রে কান্তি, তোর মেয়ে তা হলে ওই রাস্তা থেকে একটা ছেলে কুড়িয়ে এনে পুষবে!

বাবা বললে, হ্যাঁ, এতকাল কুকুর বেড়ালের ছানা কুড়িয়ে এনে পুষেছে, এইবার মানুষের ছানা এনেছে। তা ঠাকুমা বলল কী, বিদেয় করে দে। বিদেয় করে দে। কুকুরছানা পুষলে তো আর খাজনা লাগে না। মানুষের ছানা পুষতে যে খাজনা লাগে।–হ্যাঁ দিদি, সত্যি?

সত্যি বইকী অজু! ঠাকুমা কি আর ভুল বলেছেন?

মনে মনে বলে, ভুল? বোধ করি এর চাইতে বড় সত্য আর নেই, কিন্তু সুমনা একবার দেখবে কত অঙ্ক সেই খাজনার।

অজীন ততক্ষণে অন্য প্রসঙ্গে এসে পড়েছে।

দিদি, এর নাম কী?

নাম!

সুমনা ভাবে, কই, এর তো কোনও নাম ঠিক হয়নি এখনও! সুমনা মনে মনে, নিতান্ত নিভৃতে কত অজস্র নামে ডাকে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সেই বিশেষণ কোথায়, যা দিয়ে তাকে বিশ্বসংসারে অভিহিত করা যাবে?

দরকার পড়েনি।

ওর সম্পর্কে কারও কোনও কথা তো হয় না। তর্কের সময়, উপদেশের সময়, সকলেই বলে ওটা, ও!

সুমনা হেসে বলে, ওর মা বাপ তো ওকে নাম দেয়নি, তুই দে না একটা নাম।

আমি?

মহোৎসাহে প্রায় ফুটখানেক উঁচু হয়ে ওঠে অজীন, আমার নাম তুমি নেবে?

ওমা কেন নেব না? তুই বেশ ভাল দেখে–

আচ্ছা দাঁড়াও, রোসো রোসো, আমি ওর নাম দিলাম অচিনকুমার।

সুমনা বিস্মিতকণ্ঠে বলে,ওরে বাবা, এত সুন্দর নাম, তুই কোথায় পেলি রে? আগে ভেবে রেখেছিলি বুঝি?

কক্ষনো না! আমি তো এইমাত্তর বানালাম।

সত্যি!

সত্যি সত্যি সত্যি। এই তিন সত্যি। আমি তো ওর মামা হই, তাই আমি ভাবলাম আমি অজীনকুমার, ও অচিনকুমার।

সুমনা নিষ্পলকে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,তুই ওর মামা হোস, একথা কে বললে?

বাঃ বলবে আবার কে! আমার বুঝি বুদ্ধি নেই? আমি তো তোমার ভাই হই। তোমার পোষা ছেলের আমি মামা হব না তা হলে?

সুমনা শান্তহাসি হেসে বলে, তা হলে শুধু মামা নয়, পোষা মামা!

পোষা মামা? তাই বলে ডাকবে ও আমাকে?

ডাকতেও পারে। যদি জগতের লোক ওকে কথা বলতে দেয়।

বলতে দেবে? কী করে বলতে দেবে?অজীন একটু ধাঁধায় পড়ে বলে,ও তো এতটুকু, ও কি কথা বলতে পারে? আগে কথা বলতে শিখুক।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো সত্যি!

সুমনা মনে মনে লজ্জিত হয়।

ছোট্ট ছেলেটার কাছে অসতর্ক কথা বলে ফেলার জন্যে।

অবশ্য অজীন আর একবার প্রসঙ্গ বদলেছে ততক্ষণে, দিদি, ওর দোলনা নেই?

নাঃ! শুনছিস রাস্তায় পড়ে ছিল। আবার দোলনা!

তা এখন তো আর রাস্তায় পড়ে নেই, অজীন বিজ্ঞভাবে বলে, এখন তো সব কিনতে হবে। দিদি, ও আর একটু বড় হলে আমি গাড়ি ঠেলব ওকে।

সুমনার চোখে জল এসে যায়।

শিশুর সরলতায়।

শিশুর পবিত্রতায়।

ইস! কী লাল পা!

অজীন সেই লাল পা-টি তুলে ধরে টিপে টিপে আহ্লাদে বিগলিত হয়। চুলে হাত বুলোয়, আঙুলগুলি তুলে তুলে দেখে মোহিত হয়, তারপর সহসা বলে ওঠে, ইঃ এর মার কী কষ্ট! হারিয়ে ফেলে কত কাঁদছে হয়তো!

.

ছোট ছেলের নির্মল মনের এই সহজ চিন্তার কথাটা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে ভেবেছিল সুমনা।

ইস্ এর মার কী কষ্ট!

কত কাঁদছে হয়তো।

ঠিক ঠিক!

ছোট শিশুই সত্য নির্ণয় করতে পারে।

যাকে মনে মনে এ-যাবৎ সুমনা নিষ্ঠুর জঘন্য রাক্ষসী পিশাচী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে এসেছে, অদেখা সেই মায়ের উপর হঠাৎ সহানুভূতিতে মন ভরে যায় তার।

মনে পড়ে যায় রেলগাড়ির সেই বউটার কথা, বাবাঃ যা কষ্ট! ভাবলে অবাক লাগে এত কাণ্ডকারখানায় এক-একটা মানুষের পৃথিবীতে আসা

সেই কষ্টের ধন!

সেই দুঃখের নিধি!

তাকে ফেলে দিয়ে যেতে কত কান্না কেঁদেছে সে। তবু ফেলে দিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের পরম পবিত্র মহৎ সংসারে ওইটুকুর জায়গা হবে না বলে।

ওই কাচ কাচ চোখ, কী লাল হাত-পাওলা ছেলেটার দুরন্ত হাত-পা নাড়া দেখতে দেখতে বহুবার ভেবেছে সুমনা, উঃ কোন্ প্রাণে ফেলে দিয়ে গেছে!

আজ ভাবল, আহা কোন্ প্রাণেই ফেলে দিয়ে গেছে।

অজীনই একমাত্র।

অজীনকেই হয়তো কেউ এখনও জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ায়নি।

তাই ও যখন-তখন এ ঘরে ছুটে আসে, পোষা-ভাগ্নের অলৌকিক খেলাটুকু দেখতে।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *