বর্ষামঙ্গল
ভূমিকা
যত সুখের স্মৃতি এত দুঃখের স্মৃতি আমার মনের এই দুই তারে যা দিয়ে দিয়ে এইসব কথা আমার শ্রুতিধরই শ্রীমতী রানী চন্দ এই লেখায় ধরে নিয়েছেন, সুতরাং এর জন্যে যা কিছু পাওনা তাঁরই প্রাপ্য।
মুখের কথা লেখার টানে ধরে রাখা সহজ নয়, প্রায় বাতাসে ফাঁদ পাতার মতও কঠিন ব্যাপার সুতরাং যদি কিছু দোষ থাকে এই বইখানিতে সেটা আমি নিতে রাজি হলেম ইতি
শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জন্মাষ্টমী
১৩৫১
————–
১
তোমাদের এখানে আজ বর্ষামঙ্গল হবে? আমাদেরও ছেলেবেলা বর্ষামঙ্গল হত। আমরা কি করতুম জানো? আমরা বর্ষাকালে রথের সময়ে তালপাতার ভেঁপু কিনে বাজাতুম; আর টিনের রথে মাটির জগন্নাথ চাপিয়ে টানতুম, রথের চাকা শব্দ দিত ঝন্ ঝন্; যেন সেতার নূপুর সব একসঙ্গে বাজছে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ত দেখতে পেতুম, থেকে থেকে মেঘলা আলোকে রোদ পরাত চাপাই শাড়ি—কি বাহার খুলত! তবে শোনো বলি একটা বাদলার কথা। সন্ধ্যে হতে ঝড়জল আরম্ভ হল, সে কি জল, কি ঝড়! হাওয়ার ঠেলায় জোড়াসাঁকোর তেতালা বাড়ি যেন কাঁপছে, পাকা ছাত ফুটো হয়ে জল পড়ছে সব শোবার ঘরে। পিদিম জ্বালায় দাসীরা, নিবে নিবে যায় বাতাসের জোরে। বিছানাপত্তর গুটিয়ে নিয়ে দাসীরা আমাদের কোলে করে দোতলায় নাচঘরে এনে শোয়ালে। বাবা মা, পিসি পিসে, চাকর দাসী, ছেলেপুলে, সব এক ঘরে। এক কোণে আমাকে নিয়ে আমার পদ্ম দাসী কটর কটর কলাই ভাজা চিবোচ্ছে, আমাকেও দু-একটা দিচ্ছে আর ঘুম পাড়াচ্ছে, চুপি চুপি ছড়া কাটছে—ঘুমতা ঘুমায়; গাল চাপড়াচ্ছে আমার, পা নাচাচ্ছে নিজের ছড়া কাটার তালে তালে।
ওদিকে শোঁ-শোঁ শব্দ করছে বাইরের বাতাস; এক-একবার নড়েচড়ে উঠছে বড় ঘরের বড় বড় কাঠের দরজাগুলো। খানিক ঘুমিয়ে খানিক জেগে কাটল ঝড়ের রাত। সকালে কাক পাখি ডাকে না, আকাশ ফরশা হয় না। মাছের বাজারে মাছ আসেনি, পানবারুই পান আনেনি। শশী পরামানিক এসে খবর দেয়, শহরের রাস্তায় হয়েছে এককোমর জল।
ও দিব্য ঠাকুর, আজ কি রান্না?—‘ভাতে ভাত খিচুড়ি’ বলে খুন্তি হাতে চলে যায় রান্নাবাড়ির দিকে। কেরঞ্চি গাড়ি? গাড়ি চলল না আপিসের দিকে, গোরুর গাড়িতে ব্যাঙের ছাতার নিচে বসে ব্যাঙ্কের বড়বাবুরা সরকারি কাজে যাচ্ছেন। সিংগিদের পুকুর ভেসে মাছ পালিয়েছে। পাড়ার লোক ধরে ধরে ভেজে খাচ্ছে। হিরু মেথর এসে খবর দিতেই, বেরিয়ে পড়ল বিপনে চাকর ছোট ডিঙি বেয়ে শহরের অলিগলিতে ফিরতে। কাগজের নৌকো চলল আমাদের ভেসে—এ গাছ ঘুরে, ও বাগানে ডুবে-যাওয়া গোল চক্কর ঘুরে, একটানা স্রোতে পড়ে-চলতে চলতে, ফটকের লোহার শিকে ঠেকে উলটে পড়ল কাদায় জলে লট্পট্ একগোছা বিচিলির লঙর ফেলে।
ঈশ্বর দাদা খোঁড়াতে খোঁড়াতে লাঠি ঠকঠকিয়ে ভিস্তিখানায় এসে হাঁকলেন ‘বিশ্বেশ্বর!’ যাই—বলে বিশ্বেশ্বর হুঁকো কল্কে হাতে দিতেই—“শনি সাত, মঙ্গলে তিন, আর সব দিন দিন’ বলতেই হুঁকো শব্দ দিতে থাকল—চুপ চুপ—ছুপ ছুপ —কুর্র্—ঝুপ ঝুপ। তখন বর্ষাকাল পড়লে সত্যি সত্যি বৃষ্টি ঝড় আকাশ ভেঙে খড়ের চাল খোলার চাল ফুটাে করে আসত। এ দেখেছি। ডালে চালে খিচুড়ি চেপে যেত। মেঘ করলেই শহর বাজার ডুবত জলে, পুকুরের মাছ উঠে আসত রান্নাবাড়ির উঠানে খেলা করতে করতে—ধরা পড়ে ভাজা হয়ে যেত কখন বুঝতেই পারত না।
ফুটে ছাত—ভাতে ভাত
ভাজ্ মাছ।
সারারাত সাতদিন ঝমাঝম্। মটর ভাজি কড়াই ভাজি ভিজে ছাতি। যেদিকে চাও ভিজে শাড়ি ভিজে কাপড় পরদা টেনে হাওয়ায় দুলছে, তারই তলায় তলায় খেলে বেড়ানো সারাদিন, সন্ধ্যে থেকে কোলা ব্যাঙে বাদ্যি বাজায়, রাজ্যের মশা ঘরে সেঁধোয় টাকাংদিং টাকাংদিং মশারি ঘিরে। দাসী চাকর সরকার বরকার সবার মাথায় চড়ে গোলপাতার ছাতা; শোলার টুপি, ওয়াটারপ্রুভ, রেনকোট ছিল না; ছিল ছেলেবুড়ো মিলে গান গল্প, বাবু ভায়ে মিলে খোস গল্প—আর কত কি মজা আঠারো ভাজা জিবেগজা। গুড়গুড়ি ফরসী দাদুরীর বোল ধরত গুড়ুক ভুড়ুক।