প্রেম আমার
আমি শুভ।প্রত্যহ নাতিকে নিয়ে বিকেলে পার্কে আসি। তাছাড়া পত্নী বিয়োগের পর একদম সময় ও কাটতে চাই না।তবে কথায় বলে না আসলের চেয়ে সুদের দাম বেশী।তাই নাতির সঙ্গে বহাল তবিয়তে আছি।
প্রতিদিন পার্কে আসলেই লক্ষ্য পড়ে নানান সাইজের বাচ্চার দুরন্তপনা।
একটি ছোট্ট মেয়ে খুব দুরন্ত ,পার্কে এলে প্রচণ্ড হুটোপুটি করে ।প্রতিদিন ঠাকমার সাথে আসে।
এক এক সময় মনে হয় বাড়ির লোকেরা কি করে যে বাচ্চাকে বুড়িদের সাথে পাঠায়!!!
বাচ্চাটি বেশ কয়েকদিন আমার নাতির সাথেই খেলছে।আমার নাতি অবশ্য খুব শান্ত।ওই পুচকির সংস্পর্শে এসে একটু চঞ্চলতা বেড়েছে।
নাতির মুখে শুনেছি ঐ পুচকির নাম তিতলি।
হঠাৎ ইচ্ছা হল তিতলির সাথে কথা বলার।হাত নেড়ে ডাকতেই খেলতে খেলতে তিতলি আর আমার নাতি তিতাস আমার কাছে আসে।
তিতলিকে দেখে আমি কার সাথে যেন মুখের খুব মিল পাচ্ছিলাম।
আমি তিতলিকে এমনি সাধারণ ভাবে জিজ্ঞেস করি আচ্ছা তিতলি তোমাকে কার মতো দেখতে ?
বাবা না মা?
দাদু জানো আমি হুবহু ঠাম্মার মতো
দেখতে।
তিতলি হঠাৎ ঠাকমাকে ডাকে,ও ঠাম এদিকে এসো শুনে যাও।
আমার হাত থেকে আচমকা লাঠি পড়ে যায়।
আমি এ কাকে দেখছি!!!
তিতলি বলে ও ঠাম্মা শুনছ তুমি এই দাদুর সাথে গল্প করো আমরা খেলে আসি।
আমি গলাটা শক্ত করে গম্ভীর ভাবে বলি সুমি চিনতে পারছ??
সুমিতা মাথা তুলে বলে আমার নাতনি জানেন খুব চঞ্চল।
চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে আবার বলি
সুমি চিনতে পারছ??
সেই ব্যারাকপুরের সি রোডের লাল ফ্রক পরা মেয়ে সুমিতো?
সুমি পাঁচবার হোঁচট খেয়ে আমতা আমতা করে বলে –আরিব্বাস শুভঙ্কর!!!
সুমি বলে আমি তাড়াহুড়ো করে পার্কে এসেছি শুভ , তাই আজ দাঁত পরে আসতে ভুলে গেছি।
এরপর দুজনের হালকা কথাবার্তা হয়।
সুমি বলে পুরো চল্লিশ বছর পাঁচ মাস সতেরো দিন বাদে দেখা হলো।
বরাবর সুমি অঙ্কতে তুখর ছিল।তাবলে আমাদের জীবনের অঙ্ক এত সহজে হিসাব করে ফেললে তুমি!আরে শুভ সবেতো পয়ষট্টি বছর।জীবনের প্রথম শিহরণ ওই কিশোরী বেলার প্রেম কি ভোলা যায়!!!
বলেই সুমি হাহা হা করে হাসতে হাসতে প্রায় কেঁদে দেয়।
মনে হচ্ছে কোন এক সুপ্ত ব্যথা…বরফ হয়েছিল ..আজ যেন গলে গলে অশ্রু দিয়ে নির্গত হচ্ছে।
কি যে বলো সুমি আমাদের বিরহাতুর প্রেম খাঁটি সোনা ।
সুমি এবার বলে জানো শুভ
আমার কর্তা জানতেন আমাদের বন্ধুত্বের কথা…
তোমাকে নিয়ে রোজ একবার কথা হতো।ঠিক চায়ের পাশে বিস্কুটের মতো।উনি গতবছর চলে গেছেন।
জানো শুভ কি কপাল দেখো! দীর্ঘ দিন বাদে দেখা হলো কিন্তু ছেলের বদলির চাকরি পরশু ভোরে দিল্লি চলে যাচ্ছি।সুমি বলে আমি তো একা বকবক করে যাচ্ছি
শুভঙ্কর এবার তোমার খবর বলো ?
আর সন্ধ্যা হয়ে আসছে উঠতে হবে।বা চোখ টাতে ছানি পড়েছে।
আমার স্ত্রী পাঁচ বছর আগে চলে গেছে।একমাত্র ছেলের ঐ নাতি।নাতি নিয়ে কিছুটা এগোতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
পিছন ফিরে বলি সুমি ফোন নম্বরটা দেবে?
সুমি বলে থাক শুভ আমাদের প্রেম আমাদের চোরা কুঠুরিতে থাক।
মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরে বৌমাকে বললাম আজ রাতে কিছু খাবনা।
মনে পরে চল্লিশ বছর আগের কথা।
বিশ্বকর্মা পূজার দিন বন্ধু রাজার বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম।ঘুড়িটা পাশের বাড়ির কার্নিশে লাগতেই লাল ফ্রক পড়া একটি মেয়ে ঘুড়িটি ছাড়িয়ে দেয়।তারপর চোখাচুখি,মিষ্টি হাসি বিনিময়।যতবার ঘুড়ি ওড়ায়,সব ভোকাট্টা।রাজা ঐ দিন ছাদ থেকে আমাদের আলাপ করায়।তখন জানতে পারি ও একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী।আমার সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা।তারপর মন জুড়ে শুধু সুমি।পরে সুমির মুখে শুনেছিলাম আমি ও ওর মন জুড়ে ছিলাম।
মাঝে মাঝে রাজার মারফৎ রাজাদের ছাদ থেকে সুমির সঙ্গে কথা হতো।রাজাদের বাড়ি ঘনঘন যাতায়াত শুরু হয়।চিঠির আদান প্রদান হয়।তিনমাস পর পরীক্ষা মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করি।একদিন আমাদের অঙ্ক কোচিং এ আমার দিনে অঙ্ক করতে আসে।ওদের ব্যাচ যেদিন ওর অন্য টিউশন পড়েছে।স্যার বলতেন শুভ ,সুমির অঙ্কে সাহায্য কর তোর ও অভ্যাস হয়ে যাবে।কোচিং এ চিঠি দেওয়া নেওয়া হতো।একদিন রাত নটা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি,আমরা এক ছাতায় বাড়ি ফিরছিলাম।সুমির মা বৃষ্টিতে আসতে পারেননি।হঠাৎ সজোরে বাজ পড়তেই সুমি আমায় জড়িয়ে ধরে।আমি গালে চুম্বন দিয়ে বলি ছাড়ো দূরে তোমার মা আসছেন।
সারাদিন পড়াশোনা করে একবার সাইকেল নিয়ে সুমিদের পাড়ায় যেতাম।সুমি জানলার ধারে গান গাইছে শুনতাম।ঐ এক ঝলক দেখা।সাইকেলের চেনটা ওর জানলার কাছে পড়ত।সুমি ও এক সেকেন্ডের জন্য গান থামাতো।
সুমির চিঠিগুলো বিজ্ঞান বই এর পাতায় পাতায় থাকত।
তিন-চার মাসের প্রথম প্রেম সামলে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ,তারপর শিলিগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়া।তারপর তার উচ্চ মাধ্যমিকের ব্যস্ততা।সেই কিশোরী প্রাজ্ঞ তখন ব্যস্ত নিজের জীবন নিয়ে তারপর জীবনের ঘুড়ি ভোকাট্টা যোগাযোগের অভাবে।তখনতো ফোন ছিল না।
আজ এতো বছর পর সুমিকে দেখে বুকের বাম দিকটা বেশ ব্যথা করছিল।পরদিন সকালে ছেলেকে বলতেই ছেলে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়।ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখছেন,হঠাৎ চেম্বারে তিতলি কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলবার চেষ্টা করছে।আমি তিতলিকে বলি কি হয়েছে?
ও দাদু আমার ঠাম কেমন করছেন?
আমি ও আমার ছেলে ডাক্তারের সঙ্গে যায়।দেখি সুমি বুকে ব্যথায় ছটফট করছে।বাচ্চাটির বাবা ,মা শপিং এ গেছে,কাল চলে যাবে বলে।
আমার হাতে জল খেতে খেতে সুমি বলে ফোন নম্বর লাগবে? চললাম বন্ধু। ঠিক চল্লিশ বছর পাঁচ মাস…কথা জড়িয়ে যাচ্ছে সুমির।
আমি তৎক্ষণাৎ বলি আমি ও আসছি বন্ধু …স্বর্গের উদ্দানে দেখা হবে।