Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দ্বিতীয় প্রকৃতি || Ashapurna Devi

দ্বিতীয় প্রকৃতি || Ashapurna Devi

প্রতিদিন একবার করে বিমল ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসা সত্যভূষণের একটা নেশার মত। কতকাল ধরে যে এই অভ্যাসটি চালিয়ে আসছেন হিসেব নেই। বোধহয় বিমলের বাপ নির্মলের ডাক্তার হয়ে এসে চেম্বার সাজিয়ে বসার প্রথম আমল থেকেই।

তখনও যা, এখনও তা।

সকালবেলা হাতমুখ ধুয়ে চা টুকু খেতে যা দেরি! তখনও ডেলি-প্যাসেঞ্জারবাবুদের মত তাড়াহুড়ো ছিল না সত্যভূষণের, জমিদারের কাছারীতে নায়েবের অধীনে কাজ করতেন। মোটামুটি কেরাণির কাজই বলা যায়, যা কিছু লেখাপড়ার কাজ, দলিল পত্র, খাজনা আদায় ইত্যাদির হিসেব, সবই তো মা সরস্বতীর কলমের ছোঁয়া ব্যতীত হবে না, অথচ নায়েবমশাই মা সরস্বতীর দরজা মাড়ান নি কখনও, অতএব সত্যভূষণ তার অবশ্য পোষ্য ছিলেন। বিশেষ করে সত্যভূষণের হাতের লেখার জন্যে। এ তল্লাটে এমন হাতের লেখা কারও ছিল না।

তাহলে কি হবে, কাছারীতে তো বেলা এগারোটা বারোটায় গেলেই চলে। অতএব সকাল বেলা অখণ্ড অবসর।

সত্যি বলতে, নির্মল ডাক্তারেরও প্রথমে তাই ছিল। অগাধ অবসর। ক্যাম্বেলে পাশ করা ডাক্তার, কলকাতায় পশার জমাতে পারেন না পারেন, তাই বাপের পরামর্শে দেশেই প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। তবে গোড়ায়-গোড়ায় পশারের বালাই ছিল না, তখনও গ্রামের গগন কবরেজ মধ্যগগনে।

পশার হতে থাকল গগন কবরেজের ভীমরতি হওয়ার পর থেকে। কিন্তু ওই প্রথম দিকে ভোঁ ভাঁ! সত্যভূষণ গিয়ে উদয় হলেই যেন নির্মল ডাক্তার হাতে চাঁদ পেতেন। বলতেন, এই যে এসো এসো, দেখোনা সেজে গুঁজে শ্মশান জাগিয়ে বসে আছি, মড়া নেই।

তারপর চেম্বারের ঝাড়পোঁছের জন্যে রাখা ছোকরা চাকরটাকে চা বানাতে হুকুম দিতেন। …চায়ের সরঞ্জামও তেমনি। একটা ইটপাতা উনুন ছিল ঘরের পিছনের দাওয়ায়, তাতেই চারটি কাঠকুটো কি শুকনো পাতা জ্বেলে মাটির তিজেলে চায়ের জল চাপিয়ে দিত কেষ্ট, এবং ধোঁয়ার গন্ধে ভর্তি হয়ে জলটা ফুটে উঠলে, কেষ্ট তাতে ন্যাকড়ার পুঁটুলী বাঁধা চা ফেলে দিত, দিত খামচা করে দু খামচা চিনি, আর আধঘটিটাক দুধ ঢেলে দিত হড় হড় করে। অতঃপর হাঁড়ির মুখে একটা পাতলা ন্যাকড়া বেঁধে কাঁসার ভারী ভারী দুটো গেলাসে ছেকে নিয়ে চলে আসত এঘরে।

এই চাটি নিত্য বরাদ্দ ছিল সত্যভূষণের, তবু বাড়িরটাও ছেড়ে আসতে রাজী ছিলেন না।

দুজনে কোঁচার খুঁটে গরম গেলাস ধরে তারিয়ে তারিয়ে খেতেন, আর বলাবলি করতেন চাটা ছোঁড়া বানায় ভালো।

ক্রমশই পশার হয়েছে, নির্মল ডাক্তারের চেম্বারের আসবাবপত্র বেড়েছে, ডাক্তারের সময় কমেছে, অতো তারিয়ে খাওয়া আর হত না। অথচ সরঞ্জাম টরঞ্জাম ভাল এসে গিয়েছিল। কেটলী, স্পিরিট, স্টোভ, ভাল পেয়ালা। নির্মল ডাক্তার নিজে খেতে সময় না পেলেও, সত্যভূষণের ঠিকই হত। তখন চেম্বারের পিছনের দিকে ঘর বানিয়ে বসত বাড়ির সঙ্গে এক করে নিয়ে সুখে সংসার করছেন নির্মল ডাক্তার।

বাড়ির মধ্যে থেকে চা আসত, তার সঙ্গে নানাবিধ খাবার টাবার। ভারী আদর ছিল সত্যভূষণের! শুধু নির্মলের একান্ত বন্ধু বলেই নয়, সংসারের উপকারী ব্যক্তি বলেও।

পসার হয়ে ওঠা ডাক্তার নির্মল ঘোষালের নিজের সংসারের দায় দায়িত্ব দেখার সময় নেই, অথচ টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের চাহিদা বাড়ছে বিস্তর। বাড়ি বানানো এবং বাড়ানোর জন্যে মিস্ত্রী খাটানো, সদর থেকে যেসব বস্তু কেনা কাটার দরকার, তা আনানো, নিত্য দিনের হাটবাজার, সমাজ সামাজিকতার করণ কারণ, নির্মলের করণীয় যা কিছু সবই যেন সত্যভূষণের দায়িত্ব।

হাটে যেই নতুন মুগকলাই উঠল, কি নতুন গুড় উঠল, সত্যভূষণ মাথায় সাপ বেঁধে ছুটলেন, তাকে ডাক্তারের ভাড়ারজাত করতে। মণ মণ মুগকলাই অড়র ছোলা আসছে, আসছে মটকী মটকী গুড়, তাকে কী ভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবে সারা বছরের মত, সে পরামর্শও ডাক্তার গিন্নীর সত্যভূষণের সঙ্গে।

বিমল তখন এতোটুকু ছেলে, ফুটফুটে চাঁদের মত মুখ, ছুটে ছুটে ডাকতে আসতো যখন তখন, জেতু, মা বলেছে দলকাল আতে।

বিগলিত জেতু সব কাজ ফেলে তাকে কোলে তুলে নিয়ে তখুনি রওনা দিতেন।

নির্মলের থেকে বয়েসে যৎসামান্য বড় সত্যভূষণ তাই নির্মলের ছেলের জেটু, অতএব নির্মলের বৌয়ের ভাসুরঠাকুর। তবে নির্মলের বৌয়ের তদুপযুক্ত লজ্জার বালাই ছিল না, ঘোমটা দিত বটে একগলা, আর ছেলেকে বা আর কাউকে মাধ্যম রেখেই কথা বলত, তবে বলত না এমন কথা নেই। না বলে উপায় কী? ওই ছেলেটাকে দিয়েই তো সংসারের সব কাজ করিয়ে নিতে হচ্ছে তাকে। বাজার দোকান, ছুতোর ম্যাথর, কোর্ট কাছারী, মজুর মুনিষ সব কিছুই তো এই দুটো মানুষেই চালিয়ে এসেছে নির্মল ডাক্তারের। বউ আর বন্ধু।

অপরিসীম গতরও ছিল ডাক্তারের বৌয়ের। অবলীলায় মণ মণ মুগকলাই ঝেড়ে তুলত, বছরের সব ডাল নিজের হাতে জাতায় ভাঙত, মুগ কড়াই ভাজত, ভাঙত, মুড়ি ভাজত মুহূর্তে চায়ের জল চাপিয়ে। সারা বছরের কাঠ শুকিয়ে মাচায় তুলত নিজে মইয়ে উঠে, শুধু একটা বাগদী ঝিয়ের সাহায্যে। তুলে ঘাটে চলে যেত চান করতে। দরকার পড়লে কাঠ কেটেও নিত।

লোকজনকে দিয়ে ভোলালে নাকি ছমাসের কাঠই মাচায় ধরবে না, এই ডাক্তার গিন্নীর অভিমত। কারণ তারা গুছিয়ে তুলতে জানে না।

নির্মল ডাক্তার কোনও কিছুতে তাকিয়ে না দেখলেও এদিকে কখনও চোখ পড়ে গেলে, বলতেন, তুমি দেখছি আমার মান মর্যাদা কিছু রাখলে না! লোকে দেখলে বলবে কি? নির্ঘাৎ ভাববে কিপটে ডাক্তার তোকজনকে মাইনা কড়ি দিতে নারাজ, তাই পরিবারকে দিয়ে ঝি খাটুনি খাটায়

পরিবার সে কথা নস্যাৎ করতো। বলতো, নিজের সংসারের খাটুনি খাটছি বই তো অপরের সংসারের খাটুনি খাটতে যাই নি। লোকের বলায় কান দিতে নেই। উল্টোটা হলে হয়তো বলবে–অমুক ডাক্তার পরিবারকে কাঁচের আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছে, হাত পা নাড়াতে দেয় না।

বন্ধুপত্নীর এই মনোভাবটি সত্যভূষণের কাছে বিশেষ প্রশংসনীয় ছিল। ওই অগাধ কর্মশক্তি এবং সদা প্রসন্নচিত্ত, সত্যভূষণের চিত্তকে শ্রদ্ধায় সমীহে বিগলিত করে রাখত।

কিন্তু এ সবই তো বন্ধুর সংসারের ব্যাপার, সত্যভূষণের নিজের সংসারের খবরটা কী?… তা, সে খবরটা বড় শাদা মাঠা বর্ণ-বৈচিত্রহীন।

বিধবা মা আর দুই দাদাবৌদি এবং তাদের ছানাপোনা এই নিয়ে সত্যভূষণের সংসার। নিজে, ওদিক দিয়ে যান নি। জ্ঞানোন্মেষ থেকে দেখে এসেছেন, সংসারের কাজ নিয়ে সারাক্ষণই সংসারের বাতাস উত্তাল। মহিলাকুলের মধ্যে কে কম কাজ করল, আর কে বেশি কাজ করল, এই প্রশ্নে সবাই মুখর। আগে দেখেছেন সংঘর্ষ মাতে কাকিমাতে, অতঃপর কাকা কাকিমা ভিন্ন হয়ে গেলে, মাতে বড়বৌদিতে, অতঃপর মা অশক্ত হয়ে যাওয়ায় বড়বৌদি আর ছোট বৌদিতে। ক্রমশ দেখেছেন আবার দাদার বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি এসে পড়া আঠারো বছরের মেয়েটাকেও সেই সম্মুখ সমরে যোগ দিতে।

এই দেখে দেখেই যে বিয়ের বাসনা চলে গিয়েছিল তার, একথা স্পষ্টই ঘোষণা করতেন সত্যভূষণ, বলতেন, রক্ষে করো মধূসুদন, তোমাদের সংসারলীলা দেখে দেখেই সংসার সাধ ঘুচে গেছে আমার।

ডাক্তার বৌয়ের প্রতি অত শ্রদ্ধা প্রীতি সম্মান স্নেহের কারণও হয়তো ওর ওই হাস্যবদনে পাহাড় ভাঙার ক্ষমতা দেখে। সর্বদাই তো তুলনামূলক ভাবে চিন্তা করেছেন, এত খাটে নির্মলের বৌ, কই কখনও তো ব্যাজার দেখি না। আর মন্তব্য করছেন, মানুষের মত মানুষ একটা।

অবোধ পুরুষ একথা চিন্তা করে দেখবার বুদ্ধি হয়নি, এই বিড়ালই বনে গেলে বনবিড়াল হত কিনা। জা শাশুড়ীর এক্তারে ভাগের কারবারে খাটতে হলে, আমার এত কী দায় বলে পা ছড়িয়ে বসে থাকত কিনা, সত্যভূষণের ছোট বৌদির মত। ভেবে দেখেন নি কোনদিন।

নির্মল ডাক্তার বসতবাড়ির ভাগ না নিয়ে সবটা ভাইদের দিয়ে দিয়ে মা ভাইয়ের কাছ থেকে সরে এসে আলাদা বাড়ি বানিয়ে পরিবারকে একছত্র সাম্রাজ্য দিয়ে মহারাণীর মত রেখে দিয়েছিলেন, অতএব তারও মনটা মহারাণীর মত হয়ে গিয়েছিল।

একথা কোনদিন বলতে শোনা যায় নি নির্মলের বৌকে, আমি শ্বশুরের ভিটের ভাগ পেলাম না। অথবা আমি শাশুড়ীর সংসারের বাসনকোসনের কিছু পেলাম না।

এমন কি তারই বাপের দেওয়া দান সামগ্রী, ঘরবসতের জিনিস, সব ও বাড়িতে খাটছে, সেদিকে তাকিয়ে দেখেনি।…নির্মল ডাক্তার বন্ধুকে সব কথাই বলতো, সব গল্পই করতো, শুধু এই গল্পটা করে নি কোনদিন, এইশর্তে যে বৌয়ের জন্যে আলাদা একখানা সংসার পাতিয়ে দিয়েছিল। ভাগভেন্নর কুশ্রীতা বড় বিশ্রী লাগত তার! অতএব নির্মলের বৌয়ের ওই উদারতাটিই সকলের চোখে পড়েছে, আর বৌ সুখ্যাতি কুড়িয়েছে পাড়ায়।

সুখ্যাতির মানুষও যে ছিল না তা নয়, ভাল ভাল রান্না করে ও বাড়িতে দিয়ে আসতে তো তাকে কেউ হুকুম করে নি? দ্বাদশীর দিন ভোরবেলায় উঠে চান করে শাশুড়ীর জন্যে থরে থরে জল খাবার গুছিয়ে দিয়ে আসতে বলে নি।

এসব তো সে নিজে থেকেই করতো। আর ধন্যি ধন্যি কুড়তো। সে ধন্যি ধন্যি নির্মলের কানে যত না আসুক, সত্যভূষণের কানে এসে ঢুকে পড়তো। কারণ নির্মল ডাক্তারদের ভিটেবাড়িটা সত্যভূষণদের বাড়ির প্রায় সংলগ্ন।

ডাক্তারের বৌয়ের ওই প্রশংসা লাভের পরিপ্রেক্ষিতে এবাড়ি ওবাড়ির বৌদের কী প্রতিক্রিয়া হত, অথবা নিজেদের আসরে কী আলোচনা চলতো তা সত্যভূষণের জানা ছিল না, ওঁর শুধু বন্ধুপত্নীর নামে ধন্যি ধন্যি শুনেই বুকটা দশহাত হয়ে উঠতো।

কিন্তু এ সব তো সেই কোন জন্মের কথা, যখন নির্মল ডাক্তারের পূর্ণ যৌবন, পূর্ণ জোয়ার। …কলকাতার নিতান্ত নিকটবর্তী এই গ্রামটার তখন উত্তরোত্তর উন্নতির কাল, ডাক্তারী শাস্ত্রেরও উন্নতি ঘটছে, ধূলোমুঠো ধরলে সোনামুঠো হচ্ছে নির্মল ডাক্তারের।

সকলেরই ধারণা এ সমস্তই ওই কালো কোলো লক্ষ্মীমন্ত চেহারার বৌটির পয়। নইলে অন্য ভায়েরা তো নির্মলের নেহাৎ ধুকে ধুকে বেঁচে আছে, নির্মল সাহায্য করে তাই চলে। বৌও শুধু পয়মন্তই নয়, মহানুভবও বলতে হয়। ওই সাহায্যদানে তো রাগ করতোই না, বরং বরকেও না জানিয়ে চুপি চুপি নিজের ভাড়ার থেকে চালটা ডালটা, নিজের প্যাটরা থেকে কোরা কাপড়ের জোড়াটা, নিয়ে গিয়ে ওবাড়ি দিয়ে আসতো।

এর সাক্ষী অবশ্য একজন ছিল, সে সত্যভূষণ। সত্যভূষণ যেন বাতাসে সব খবর পেতেন। আর পেয়ে মনে মনে সেলাম ঠুকতেন।

কিন্তু কোনও কিছুই চিরদিন একই চেহারায় থাকে না, একা চন্দ্র সূর্যেরই নয়, সমস্ত কিছুরই উদয় অস্ত আছে! জগৎ সংসারের তাবৎ বস্তুর। মানুষের জীবনেরও, তার গড়া সংসারেরও। কাজেই নির্মল ডাক্তারের সংসারের গড়ন চেহারা যে ক্রমশই পালটাতে থাকল এটা আশ্চর্যের নয়। উদয় হল, মধ্যাহ্ন সূর্য হল, অস্তও গেল।

প্রথম পালটালো নির্মলের সেই অটুট গতর গিন্নীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিছানায় পড়ার ঘটনায়। ওই মানুষ যে পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে বিছানা নেবে, একথা কে কবে ভেবেছিল?

তবু অভাবিত ঘটনাও ঘটে, আর লোকে ক্রমশ তা মেনেও নেয়!

প্রথম প্রথম সত্যভূষণ বন্ধুকে পাগল করে তুলেছিলেন, অন্য বড় বড় ডাক্তার আনবার জন্যে। বলতেন, তুমি বুঝছ না নির্মল, অন্য ডাক্তারকে দেখানো দরকার। নিজের লোকের চিকিচ্ছে করা ডাক্তার কবরেজের বারণ তা জানো তো? তার মানেই হচ্ছে ভুল হবার সম্ভাবনা। চিকিচ্ছে ঠিক হচ্ছে না।

নির্মল ডাক্তার বিষণ্ণ হাসি হেসে অথবা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলেছেন,–এ রোগের চিকিৎসা নেই সত্য! এ শুধু বসে বসে দিন গোনা। বরং দিন যত কম গুনতে হয় ততই ভাল, সেটাই ভগবানের কাছে প্রার্থনা কর। বিমলের মার এই জীবমৃত অবস্থা চোখে দেখা কষ্ট।

স্বামী হয়ে একথা বলেছেন ডাক্তার, কারণ তিনি বিচক্ষণ, বিজ্ঞাননির্ভর চিত্ত মানুষ, কিন্তু পান্তানো ভাসুর সত্যভূষণ এরকম কথাটাকে সহ্য করতে পারেন নি, তিনি অজ্ঞান অবোধের মত তাগা তাবিজ মাদুলি কবচ শেকড় বাকড়ের সন্ধানে ছুটোছুটি করে বেড়িয়েছেন, আর বলেছেন, বলং বলং দৈব বলং, বুঝলি বিমল? দৈবে কী না করতে পারে?

কিন্তু বিমলও তখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, বিমল গ্রাম-জীবনে অভ্যস্ত মনের চির সংস্কার বশে ওই দৈব সম্পর্কে মনে মনে ক্ষীণ আশা পোষণ করলেও, বাইরে কথাটাকে আমল দিত না। সত্যভূষণই কাকপাখির মুখে বার্তা পেলেও দৌড়তেন জটিল জটিল সব জায়গায়। ব্যবস্থাপত্রও জটিল, হয়তো ভরা অমাবস্যার রাত্রে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে ভোরবেলায় সেই শিকড় এনে রোগীর গলায় পরিয়ে দেওয়া, হয়তো শনি মঙ্গলে ভর হয় এমন দৈবশক্তি সম্পন্ন মহিলার কাছে গিয়ে সকাল থেকে বসে থাকতে হবে অস্নাত অভুক্ত, জল ছোঁওয়া বারণ, আরও কত রকম। একবার তো এক মন্ত্রপূত পানা পুকুরে স্নান করে ভিজে কাপড় গায়ে শুকিয়ে দু মাইল রাস্তা হেঁটে কোন মনসা মন্দিরের পূজারীর কাছ থেকে মাদুলী এনে প্রবল জ্বরে পড়ে গেলেন।

গ্রামের পুরুষরা নির্মল ডাক্তারের বন্ধুভাগ্যে ঈর্ষাবোধ করতো, আর মহিলারা আড়ালে মুখ বাঁকিয়ে হাসতো। তবে নির্মল ডাক্তারের কাছে সকলের টিকি বাঁধা, কাজেই হাসিটা মুখে মুখে ছড়াতো না।…তার উপর আবার ডাক্তারের ছেলে বড় ডাক্তার হয়ে উঠছে।

ডাক্তারের বৌ যখনি নতুন একটা দৈব ওষুধ দেখতো তখনই দুঃখের হাসি হেসে বলতো, কেন আর মিথ্যে খেটে মরেন আপনি দাদা, আমি আর বিছানা ছেড়ে উঠেছি! এই আমার শেষ শয্যে।

ক্রমশ আর মাধ্যমে কথার আদান প্রদান ছিল না, প্রায় মুখোমুখিই কথা। তবে এক ঘরের মধ্যে নয়। একজন ঘরে দেয়ালের ধারে চৌকিতে শুয়ে, অন্যজন ঘরের দরজার ঠিক বাইরেটায় টুলে বসে। বসা মানুষটা জোর দিয়ে বলতেন, উঠবেন না মানে? ওকথা বললে চলবে না বৌমা, বিমলের বিয়ে দিতে হবে না? বৌকে ঘর সংসার বুঝিয়ে দিতে হবে না? নাতি কোলে নিয়ে পাড়া বেড়াতে হবে না?

এই অবুঝ আশ্বাস মাঝে মাঝে নির্মল ডাক্তারও শুনতে পেতেন, গভীর নিশ্বাস ফেলে ভাবতেন, একটা অবোধ সরল বিশ্বাস মানুষের ইচ্ছাশক্তির জোরে অসম্ভব ঘটনাও সম্ভব হতে পারে কি না কে জানে।

ডাক্তারের বৌ এক একসময় স্বামীকে বলতো, বেঁচে থেকেও তো আমি মড়ার তুল্য, তবে দাও না বাপু এমন একটা ওষুধ, যাতে চটপট ভোগটা টুটে যায়।

ডাক্তার স্থির চোখে তাকিয়ে বলতেন, কী? বিষ?

তুমি হাতে করে দিলে অমৃত। দুঃখ নিবারণের ওষুধ।

আবার কখনও টুলে বসা মানুষটাকে বলতো, বাড়িঘর বোধহয় এখন আর তাকিয়ে দেখা যায় না, তাই না ভাসুরঠাকুর।

ভাসুরঠাকুর তাড়াতাড়ি বলে উঠতেন, না না, কে বললো? আপনার হাতে শিক্ষিত লোকজন, বাড়ি তো খুব পরিষ্কার রাখে।

বৌমা বলতো, ও আপনি স্তোক দিচ্ছেন আমি তো দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, বাড়ি। আঁস্তাকুড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সত্যভূষণের মুখে এসে যেত, তার থেকেও বেশি। বলতে হয় নরক কুণ্ডু! বিশ্বাস হয় না সেই বাড়ি কিন্তু মুখকে সামলে নিয়ে বলতেন, ও আপনার ভুল ধারণা বৌমা। বাগদীবৌ আপনাকে খুব ভালবাসে।

বাগদীবৌ যে তলে তলে সংসারের সর্বস্ব চুরি করে সাফ করে ফেলছে, এ খবর জানা থাকলেও, সে কথা বলে আর এই অনড় মানুষটাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করতো না সত্যভূষণের।

যাক অবশেষে একদিন সত্যভূষণের সব প্রবোধ বাক্য, সব সান্ত্বনাবাণী, সব ছুটোছুটি ফুরোল। নিরুপায় হয়ে পড়য়া ছেলের বিয়ে দিতে বাধ্য হলেন ডাক্তার, ছন্নছাড়া সংসারটাকে আবার দাঁড় করাতে। কিন্তু সে অন্তঃপুরে আর কোনও দিন সত্যভূষণের পা পড়ল না। সেই যে মৃতদেহটা বার করবার সময় খাট বইতে সাহায্য করেছিলেন বিমলকে, সেই শেষ।

কিন্তু নির্মলের চেম্বারে গিয়ে বসার ব্যতিক্রম ঘটেনি কোনদিন সত্যভূষণের। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত, শরৎ, হেমন্ত, ঋতুচক্রের এই আবর্তনের ফলে শুধু সাজ সজ্জার পরিবর্তন দেখা গেছে সত্যভূষণের, তাছাড়া কিছু নয়। সেই কাঁচা-পাকা চুলে ছাওয়া মাথা, সেই শক্ত খুঁটির মত বেঁটে খাটো মজবুত দেহখানি নিয়ে চেম্বারে গিয়ে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারখানিতে বসে থাকা।

এই চেয়ারখানি, ডাক্তারের বন্ধুপ্রীতির নিদর্শন। চন্দননগর থেকে করিয়ে এনেছিলেন বন্ধুর জন্যে। উঁচু পিঠ ভারী হাতল, সিংহাসনের আভাসবাহী এই চেয়ারখানায় সত্যভূষণ কতকাল বসছেন কে জানে!…বিমল ডাক্তারের চেম্বারে আসবাবপত্র অনেক বেড়েছে, ওটাকে বিদেয় করলে ভাল হয়, কিন্তু ভাল হয় বললেই কি সবসময় সেটা করা যায়? না করার সুবিধে হয়? চক্ষুলজ্জার বাড়া বালাই নেই!

তাছাড়া বছর দশেক ধরেই তো ভাবছে বিমল, বুড়ো মেরে খুনের দায়ে পড়ে লাভ কী? নিজে থেকেই তো চেয়ার খালি করে দিয়ে যাবে বুড়ো। কিন্তু কই?

বৌ মরার পরও নির্মল ডাক্তার অনেকদিন বেঁচেছিলেন, চেম্বারেও আসতেন। সত্যভূষণও নিয়মিত সময় এসে নিজস্ব চেয়ারটিতে বসে থাকতেন।

বুড়ো কেষ্ট কোথা থেকে যেন চা নিয়ে আসতো, ধরে দিত দুই বন্ধুর সামনে, আর অনেকক্ষণ পরে খালি পেয়ালা নিয়ে যেতে এসে তাড়া দিয়ে বলতো, কী বাবু, চা খান নি এখনও? পান্তো হয়ে গেল যে?

কতদিন হয়তো সত্যিই এমন পান্তো হয়ে যেত যে আর খাওয়াই হত না।

বিমল তখন নতুন ডাক্তার হয়ে হাউস সার্জেনের কাজ করেছে। দু-একটা সরকারি হাসপাতালে কিছু কিছুদিন চাকরী করেছে, তারপর দেশেই এসে গুছিয়ে বসেছে।

নির্মল প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন তখন, তবু চেম্বারে এসে বসে থাকতেন, সত্যভূষণও।

…তা এসবও তো বহুদিনের কথা।

এখন বিমল ডাক্তারেরই মাথার চুল বেশির ভাগই সাদা।..সত্যভূষণের সমসাময়িক আর কেউ নেই গ্রামে, নির্মল তো কবেই গিয়েছেন। কিন্তু সত্যভূষণের নিয়মের নড়চড় নেই।

তিনি যথা নিয়মে যথা সময়ে এসে নিজের চেয়ারটিতে বসে থাকেন, আশি বছরের জীর্ণ দেহটায় প্রায় ততটাই জীর্ণ এক গলাবন্ধ কোট আর একখানা মলিন ধুতি চাপিয়ে। এসে চুপচাপ বসে থাকেন, মাথাটা ঝুঁকিয়ে দু-হাঁটুর মধ্যে তালিমারা ছাতাটা চেপে ধরে।

চেয়ারটা অবশ্য আর আগের জায়গায় নেই, কোণঠাসা হয়ে গেছে, চায়েরও প্রশ্ন নেই এখন আর, তবু সেই সকাল বেলাই চলে আসা চাই।

দেখলেই মাথা জ্বলে ওঠে বিমল ডাক্তারের। কী কুদৃশ্য, কী অরুচিকর!…কত অভিজাত অভিজাত রোগী আসে তার কাছে, কত বড় বড় লোক। তাদের সামনে কিনা ওই একটা অর্থহীন অবাক কুশ্রী দৃশ্য।

ঘাড় ঝুঁকে পড়া ঘোলাটে চোখ, ময়লা নোংরা পোশাক পরা একটা জরাজীর্ণ বুড়ো, প্রতিদিন ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকে কেন? এ প্রশ্ন উঠবে না তাদের মনে?

কেউ কেউ বলাবলি করে পয়মন্ত ফয়মন্তর ব্যাপার নয় তো? কেউ কেউ বলে ওই বুড়োই চেম্বারের মালিক নয়তো? শেকড় গেড়ে বসে থাকে কমিশনের হিসেব ঠিক রাখতে?

যারা জানে তারা জানে লোকটার এটা স্রেফ নেশা। অদ্ভুত এক নেশা। মা এসে থাকতে পারে না। এই দরজা আর ওই চেয়ার ওকে টানে।

কিন্তু ক্রমশই সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে বিমল ডাক্তারের। সাদা তালিমারা কালো ছাতাটাকে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে আসতে দেখলেই সর্বাঙ্গে বিষ ছড়ায়, মাথা জ্বালা করে।…একটা লোক অকারণে পৃথিবীতে মৌরুসিপাট্টা নিয়ে বসে আছে এটাইতো অসহ্য, তার উপর সেই লোক যদি ঘাড়ে এসে বসে থাকে, তাহলে?

খাচ্ছে না পরছে না কিছুই করছে না ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টিশূল হয়ে বসেই বা থাকবে কেন?

আগে আগে তা কখনও সখনও সৌজন্য করে বলেছে বিমল, কী জেঠু, আছেন কেমন?

কিন্তু তার উত্তরে যদি বুড়ো বিগলিত মুখে এক গঙ্গা কথা বলতে শুরু করে, কার আর পুনর্বার সেই সৌজন্য করতে ইচ্ছে করে?

তবু ভাগ্যি বাল্যকালের জের টেনে তুই টুই বলতে আসে না। তুমিই বলে।

সব থেকে খারাপ লাগে, যখন কেউ জিগ্যেস করে, ভদ্রলোককে তো রোজই দেখি, ওনার অসুখটা কী?

রোগীই ভাবে তারা সত্যভূষণকে।

বিমল ডাক্তার বলে, অসুখ আর কিছুই নয়, বয়েস! ওর আর কী সারাবো বলুন?

বয়েস তো অনেক হয়েছে মনে হয়।

আমি তো জ্ঞানাবধিই এই রকম দেখছি। বলে, অবলীলায় বলে।

যেন জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সে ডাকতে আসতো না, জেতু, মা ডাকতে, দলকাল আতে।

যেন সত্যভূষণকে সেই অদম্য শক্তি নিয়ে চরকি পাক খেয়ে বেড়াতে দেখে নি বিমল। যেন, আইনের এক ফুঁয়ে জমিদারের কাছারি বাড়ি উপে গিয়ে শক্ত সামর্থ মানুষটাকে বেকার করে দেওয়ার দৃশ্য দেখে নি সে।..

কিন্তু অত কথা কে বলতে যায়?

আচ্ছা, বুড়ো হয়ে কি এতই অবোধ হয়ে গেছেন সত্যভূষণ যে, বিমলের এই জ্বলন্ত বিরক্তিটা বুঝতে পারেন না, এটা তো তার গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেবার মত!

এসে বসে থেকে নিঃশব্দে একসময় উঠে যাওয়া, এরমধ্যে কী সুখই বা পান? কতদিন আগে যেন বলতেন, কী বিমল কাজকর্ম কেমন চলছে?..বলতেন, ডাক্তারী একটা মহৎ প্রফেশন বিমল। তোমার বাবা বলতো, ডাক্তারীটা পেশা বটে, কিন্তু ব্যবসা নয়,–এর মূল মন্ত্র মানুষের সেবা।

তখন হয়তো সুখ ছিল, কিন্তু এখন? এখন তো আর বিমল বলে ডেকে কথা বলা যায় না ওই বিরক্ত বেজার আর দাম্ভিক লোকটাকে!

আর এখন এ প্রত্যাশাও তো নেই, ওই কর্মব্যস্ত গম্ভীর মানুষটা আর কোনদিনও চোখের কোণে একটু তাকিয়ে বা না তাকিয়ে যান্ত্রিক গলাতেও একবার বলবে, জেঠু যে! আছেন কেমন? অথবা আঃ আবার এভোটা রাস্তা হেঁটে এসেছেন? এত হাঁটাহাঁটির কী দরকার?

কিংবা ভুলেও একবার অনেকদিন আগের মত বলে ফেলছে না, চা খেতেন নাকি? হচ্ছিল।

তবে?

তবে কেন আসেন? এখন তো চোখের উপর জালচাপা, এখন তো আর বিমল ডাক্তারের চলন বলন, কথার ধরণ, দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে মিলিয়ে দেখতে বসতে পারেন না ওর ভঙ্গিটা বাপের মত, না মায়ের মত।

এখন তো শুধু নিশ্বাস ফেলে ভাবেন, ছেলেটা মা বাপ কারুর মত হল না কেন?

তবু আসা ছাড়া উপায় নেই।

রাত পোহাতে না পোহাতে কে যেন লক্ষ্যবাহু দিয়ে এই দিকে টানে। যেন এই জন্যেই এখনও পৃথিবীতে টিকে থাকা।

যেন এই আসাটাই সত্যভূষণ নামের মানুষটার বেঁচে থাকার একমাত্র মানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress