Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃত্যু-সায়রে ফ্রান্সিস || Anil Bhowmick

মৃত্যু-সায়রে ফ্রান্সিস || Anil Bhowmick

সেদিন গভীর রাত। একেবারে অন্ধকার রাত নয়। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে।

প্রায় দিন পনেরো হতে চলল–ডাঙার দেখা নেই। ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে। ফ্রান্সিস খুবই চিন্তায় পড়ল। তবে নিজের দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেতে দিল না। বন্ধুরা তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখলে তাদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।

রাত হলে ফ্রান্সিস জাহাজের ডেক-এ উঠে আসে। চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কখনও কখনও উঁচু গলায় পেড্রোকে ডেকে বলে–পেড্রো ঘুমিয়ে পড়ো না। ডাঙার দেখা পেতেই হবে। নজরদার পেড্রো মাস্তুলের ওপর নিজের জায়গায় রাত জেগে জেগে চারদিকে নজর রাখে। ও চেঁচিয়ে বলে কিছছু ভেবো না। আমি জেগে আছি। পেড্রোকে একই সঙ্গে দুটো কাজ করতে হয়। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ডাঙার খোঁজ করতে হয় আবার হঠাৎ জলদস্যুদের দ্বারা তাদের জাহাজ আক্রান্ত হতে না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হয় দু’বার ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে জলদস্যুদের পাল্লায় পড়তে হয়েছিল। কাজেই কড়া নজরদারি চালাতে হয় ওকে।

রাতে ফ্রান্সিস যখন একা একা ডেক-এ পায়চারি করে বেড়ায় হ্যারি উঠে আসে। একমাত্র হ্যারিকেই ফ্রান্সিস নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলে। হ্যারি অবশ্য সান্ত্বনা দেয়। বলে–

–কেন দুশ্চিন্তা করছো? এর আগেও আমরা কিছুদিনের মধ্যেই ডাঙা খুঁজে পেয়েছি। এবারও পাবো। তুমি হতাশ হয়ে পড়লে কার ওপর ভরসা করবো আমরা? তোমার মনের জোর আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। মনটা শান্ত রাখো।

–হ্যারি–আমার চিন্তা তো শুধু আমার নিরাপত্তা নিয়ে নয়। এত বন্ধু, মারিয়া সবার কথাই তো আমাকে ভাবতে হয়। যদি সত্যি বিপদজনক কিছু ঘটে তার দায় তো আমি এড়াতে পারি না। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

বিপদ তো যে কোন মুহূর্তে হতে পারে। তোমার নেতৃত্বে আমারা তো অনেক বিপদের মোকাবিলা করেছি। এখনও করবো। তা ছাড়া তোমার ভুলে তো আমরা দিক্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়িনি। বলা যায় এটা নিয়তি। এতে কারো হাত নেই। ডাঙার দেখা পাবোই। দেশে ফেরার পথ খুঁজে পাবই। অনুরোধ সকলের কথা ভেবে নিজের মন দুর্বল করে ফেলো না। হ্যারিও মৃদুস্বরে বলল। এসব কথা যাতে ভাইকিং বন্ধুদের কানে না যায় তাই দু’জনেই মৃদুস্বরে কথা বলছিল। এমন কি ফ্রান্সিস এই নিয়ে মারিয়াকেও কিছু বলেনি। মারিয়া থাকুক ওর মন-খুশি নিয়ে। ওকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে কী লাভ?

রাত বাড়ছে। দু’জনে ঘুমুতে চলে গেল।

ফ্রান্সিস নিজের কেবিন-ঘরে ঢুকল। বিছানায় শুয়ে পড়ল। ভেবেছিল মারিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। তখনই শুনল মারিয়া বলছে

–এত রাত পর্যন্ত ডেক-এ একা একা পায়চারি কর। কী ভাব এত?

–ভাবনার কি শেষ আছে? তাছাড়া রাতে ডেক-এ পায়চারি করা আমার অভ্যেস। তুমি ঘুমোও। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–তুমি ডেক থেকে না নামা পর্যন্ত আমি ঘুমাতে পারিনা মারিয়া বলল।

–এটা তোমার বাড়াবাড়ি। তাছাড়া প্রত্যেক দিন তো আমি ডেক-এ পায়চারি করি না। তুমি মিছিমিছি রাত জাগবে কেন? ফ্রান্সিস বলল।

-তোমার কোনরকম দুশ্চিন্তা হলে তুমি এটা করো। মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ–দুশ্চিন্তা তো হয়। ফ্রান্সিস বলল।

জানি তোমার দুশ্চিন্তা কি? মারিয়া বলল।

ফ্রান্সিস সাবধান হল। বলল–আরে বাবা দুশ্চিন্তা তো এক সময় কেটে যায়। কতবার কয়েদঘয় থেকে পালালাম, ক্রীতদাসের জীবন থেকে পালালাম। দুশ্চিন্তা একদিন কেটে যায়।

–তুমি অনেকদিন হল ডাঙ্গার দেখা পাচ্ছ না। এটাই তোমার দুশ্চিন্তা মারিয়া বলল।

–আরে না না। মাঝে মাঝে কতদিন ডাঙা খুঁজে পাই নি। পরে তো পেয়েছি। সেসব নয়–এমনি এটা ওটা ভাব নাও। তুমি ঘুমোও। তুমি খুশি থাকো এটাই আমি চাই। ফ্রান্সিস বলল।

-তোমাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখলে আমি খুশি থাকি কী করে? মারিয়া বলল।

ওসব পাগলামি ছাড়ো। ফ্রান্সিস হাল্কাসুরে বলল। মারিয়া আর কোন কথা বলল না। পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

আরও দিন সাতেক কাটল। কিন্তু ডাঙার দেখা নেই। এদিকে খাবার আর পানীয়, জল ফুরিয়ে এসেছে। শুরু হল কৃচ্ছসাধন। অর্থাৎ যথাসম্ভব জল কম খাওয়া খাবার কম খাওয়া। ভাইকিং বন্ধুদের চিন্তা শুরু হল। এভাবে কতদিন চলবে? ডাঙার দেখা না পেলে সবাইকে উপবাসী থাকতে হবে। উপোস করে তবু কিছুদিন থাকা যায় কিন্তু জল না খেয়ে থাকা তো মারাত্মক।

দিন কাটে। রাত কাটে। খাবার প্রায় শেষ। সবাই একটা করে রুটি আর গলা ভেজাবার মত জল খেতে লাগল। এভাবেই চলল। তারপর দুদিন না জল না খাবার। ফ্রান্সিস মারিয়াকে বুঝতে না দিয়ে নিজের রুটি জল মারিয়াকে দিতে লাগল। মারিয়া জিজ্ঞেস করে–তুমি কখন খেলে?

–আমি আগেই খেয়ে নিয়েছি। ফ্রান্সিস হেসে বলে। জাহাজে চরম খাদ্য জল ঘাটতির কথা মারিয়াকে বুঝতে দেয় না।

কিন্তু আর কতদিন? ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধে। ফ্রান্সিস রাতে ঘুমুতে পারে না। মারিয়া ঘুমিয়ে পড়লে ও ডেক-এ উঠে আসে। প্রায় সারারাত ডেক-এ পায়চারি করে আর ডাঙার খোঁজে চারিদিকে তাকায়। মাঝে মাঝে মাস্তুলের উপর উঠে যায়। পেড্রোর সঙ্গে বসে চারিদিকেতাকায়। ডাঙার দেখা পেতেইহবে। নইলে খাদ্যাভাব জলাভাবে সবাইকে মরতে হবে। তৃষ্ণা সহ্য করতে না পেরে কয়েকজন বন্ধু সমুদ্রের লবণাক্ত জলই খেয়ে রে ফেলেছিল। বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারা। এই ঘটনার পর বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়ল। ফ্রান্সিস তো নিজের চিন্তায় মগ্ন। বন্ধুদের অসন্তোষের কথা ওর জানার কথা নয়। তবে বন্ধুদের ব্যবহারে কিছুপরিবর্তন লক্ষ্য করছিল।

সেদিন রাতে ফ্রান্সিস ডেক-এ পায়চারি করছে আর চারিদিকে তাকাচ্ছে তখনই হারি এল। দু’এককথার পর বলল–ফ্রান্সিস কিছু মনে করো না। জাহাজে খাদ্য জল শেষ।

-জানি। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

–বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। ওদের বক্তব্য আমরা পথ হারিয়েছি। কোথায় চলেছি আমরা জানি না। এরজন্য তোমাকেই দোষী সাব্যস্ত করতে চলেছে। হ্যারি আস্তে আস্তে বলল।

–তাহলে ব্যাপার অনেকদূর গড়িয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। হ্যারি মাথা ওঠা নামা করল।

–ঠিক আছে। ডাকো সবাইকে। ফ্রান্সিস বলল।

–অনেকেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। হ্যারি বলল।

কই? আমি তো ঘুমোইনি। সবাইকে ডেকে এ আসতে হবে। ডেকে আনো সবাইকে। একে খাদ্যভাব জলাভাব এর মধ্যে ওদের অসন্তোষ বাড়তে দেওয়া যায় না। ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল।

হ্যারি চলে গেল। কিছু পরে বন্ধুরা একে একে জাহাজের ডেক-এ উঠে এল। কয়েকজন ডেক-এ ঘুমিয়ে ছিল। তারাও উঠে দাঁড়াল।

আকাশে চাঁদেরআলোঅনেকটা উজ্জ্বল। জোরহাওয়া ছুটছে। জড়ো হাওয়া বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব। এই অভিযানে বেরোবার সময় আমি বলেছিলাম অনেক সমস্যা আমাদের সামনে আসতে পারে। জল খাদ্য ফুরিয়ে যেতে পারে। আমরা দিক্‌ভ্রষ্ট হতে পারি। ভীষন বিপদে পড়তে পারি কিন্তু অধৈর্য হলে চলবে, না ভয় পাওয়া চলবে না। অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল– শুনলাম তোমাদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। আমার ওপর তোমরা বিশ্বাস হারাতে বসেছো। যদি তাই হয় আমি সরে দাঁড়াচ্ছি। তোমাদের মধ্যেই কেউ জাহাজের দায়িত্ব নাও। যেভাবে জাহাজ চালাতে চাও চালাও। যেভাবে পারো সমস্যার মোকাবিলা কর। ফ্রান্সিস। থামল। গত কয়েকদিন কিছুই খায়নি ও। শুধু গলা ভেজানোর মত জল খেয়ে আছে। বুঝতে পারছেশরীর বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস হাঁপাতে লাগল।

বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। শাঙ্কো ভিড়ের মধ্যে থেকে গলা চড়িয়ে বলল ফ্রান্সিস–আমরা তোমার ওপর বিশ্বাস হারাই নি। শুধু দুশ্চিন্তায় পড়ছি এই খাদ্যাভাব জলাভাবে আর কতদিন আমাদের চলবে? আসলে আমাদের সহ্য শক্তির পরীক্ষা চলছে। আমরা নিশ্চয়ই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হবো। আমাদের ধৈর্য হারালে চলবে না। শাঙ্কো থামল। কয়েকজন বন্ধু শাঙ্কোকে সমর্থন করল। এবার হ্যারি উচ্চস্বরে বলল ভাইসব–ফ্রান্সিস শাঙ্কোর বক্তব্য শুনলে। এবার তোমরাই বিচার কর আমাদের করণীয় কি? ফ্রান্সিসের ওপর বিশ্বাস হারালে আমাদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না। একমাত্র ফ্রান্সিসই আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। একটু থেমে হ্যারি বলল–খাদ্যাভাব জলাভাবের সমস্যা আমাদের কাছে খুব নতুন কিছু নয়। সেই সমস্যার সমাধানও হয়েছে। অনেকদিন জাহাজ চলছে। অচিরেই ডাঙার দেখা পাবো। সব সমস্যার সমাধান হবে। শুধু অনুরোধ-অধৈর্য হয়ো না।

বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। গুঞ্জন চলল। এবার কয়েকজন বন্ধু বলে উঠল–আমরা ধৈর্য হারাবো না। ফ্রান্সিস–তোমাকে আমরা অবিশ্বাস করবো না।

–ঠিক এই উত্তরই আমি তোমাদের কাছ থেকে আশা করেছিলাম। ফ্রান্সিস বলল। বন্ধুদের জটলা ভেঙে গেল। সবাই ঘুমুতে চলে গেল। সবাই জানে খালি পেটে জলের তৃষ্ণা নিয়ে ভাল ঘুম হয় না। তবু শুয়ে থাকা। শরীরের দুর্বলতা কাটাতে এছাড়া উপায় নেই।

সবাই চলে গেলে হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস আমি জানি তুমি না খেয়ে আছো।

–উপায় কি! মারিয়া উপবাস সহ্য করতে পারবে না। ওকে তো পেট পুরে খাওয়াতে হবে।

–ঠিক আছে। দুর্বল শরীরে তুমি রাত জেগে না। ঘুমুতে যাও। হ্যারি বলল।

–তুমিও তো দূর্বল হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস বলল।

–আমার শরীর তো জানো বরাবরই দূর্বল। এখন আরো দূর্বল হয়ে পড়েছি এই যা। হ্যারি বলল।

–ঠিক আছে। তুমি যাও। আমি পেড্রোর সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি চলে গেল। ফ্রান্সিস উচ্চস্বরে ডাকল। পেড্রো?

-বলো। মাস্তুলের ওপর থেকে পেড্রোর গলা শোনা গেল।

সাবধান। ঘুমিয়ে পড়বে না। আর একটা কথা-খাওয়া হয়েছে?

–না। না খেয়ে ভালো আছি। ঘুম আসবে না। পেড্রো বলল।

নেমে এসে একটু জল খেয়ে নাও। ফ্রান্সিস বলল।

–আমি ঠিক আছি। আমার কথা ভেবো না। পেড্রো বলল।

ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। সিঁড়িঘরের দিকে চলল।

শেষ রাতের দিকে হঠাৎ মাস্তুলের উপর থেকে পেড্রোর চিৎকার শোনা গেল– ভাইসব–ডাঙা দেখা যাচ্ছে–ডাঙা। ফ্রান্সিসের তন্দ্রামত এসেছিল। তা ভেঙে গেল। ও প্রায় ছুটে ডেক-এ উঠে এল। ডেক-এ যারা ঘুমোচ্ছিল, যারা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল সবাই উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়াল। বন্ধুরাও কাছে এসে দাঁড়াল। পেড্রো মাস্তুলের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল–ডানদিকে–পাহাড়-বাড়িঘরও দেখা যাচ্ছে।

ফ্রান্সিস চোখ কুঁচকে ডানদিকে তাকাল। মোটামুটি স্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখল সমুদ্রতীরে একটা ছোট বন্দর মত। খুব বড় বন্দর নয়। বন্দরে কোন জাহাজও নোঙর করা নেই। বাড়িঘরও কিছু দেখা গেল। একপাশে একটা পাহাড়।

ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। জাহাজ সমুদ্রতীরে ভেড়ানো হবে কিনা। জানা নেই এটা কোন দ্বীপ না দেশের অংশ। কিন্তু জাহাজে অনাহার চলছে। জলও প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। খাদ্য চাই, জল চাই। কাজেই নামতে হবে এখানে। কারা থাকে এখানে, নামলে কোন বিপদে পড়তে হবে কিনা এসব ভাবার সময় নেই।

হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়াল। বলল–কী করবে এখন?

নামতে হবে। আর এক্ষুণি। আটা-ময়দা-চিনি জল সব জোগাড় করতে হবে। খুব দ্রুত কাজ সারতে হবে। বিপদে পড়ার আগেই। ফ্রান্সিস বলল। তারপর শাঙ্কোকে ডাকল। শাঙ্কো কাছে এলে বলল–শাঙ্কো–আমি শরীরের দিক থেকে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছি। তুমি সিনাত্রা বিস্কো আর একজন বন্ধুকে নিয়ে যাও। বস্তা পীপে নিয়ে যাও। আটা-ময়দা জল যা পাও নিয়ে এসো। দেরি নয়। এখুনি। ভোর হয়েছে। তৈরি হয়ে এসো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শাঙ্কো সিনাত্রা বিস্কো আর এক বন্ধু তৈরি হয়ে এল। হালের দিকে দড়ির সিঁড়ি দিয়ে বস্তা পীপে নিয়ে একটা নৌকোয় নামাল। অন্যটায় দাঁড় হাতেবসল। সিনাত্রারাও বসল। দুটো নৌকো তীরের দিকে চলল।

নৌকো দু’টো তীরে ভিড়ল। তীরের বালির ওপর নৌকো ঠেলে তুলে চলল বাড়িঘরগুলোর দিকে। ওখানকার বাসিন্দাদের দেখল। বেঁটে মত। গায়ের রঙ কিছুটা তামাটে। মাথায় লম্বা লম্বা চুল। নাক একটু চ্যাপ্টা মত। ওরা বেশ অবাক হয়েই শাঙ্কোদের দেখছিল। এই বিদেশীরা কোত্থেকে এল?

সামনে যে লোকটাকে পেল শাঙ্কো তাকে বলল-আটা ময়দার দোকান কোথায়? বার কয়েক বলাতে হাত দিয়ে খাওয়ার ইঙ্গিত করাতে লোকটা বুঝল। হাত বাড়িয়ে একটা ঘর দেখাল। শাঙ্কোরা ঘরটার কাছে এল। এবড়োখেবড়ো কাঠের দরজা বন্ধ। শাঙ্কো দরজায় ধাক্কা দিল। ততক্ষণে রোদ উঠেছে। চারদিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাজার এলাকা। লোকজন বাজার হাট করতে আসছে। দড়াম করে দরজা খুলে গেল। একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। শাঙ্কো বলল–আটা ময়দা আছে? লোকটি বুঝল না। শাঙ্কো হাত বাড়িয়ে কয়েকটা কাপড়ের রাস্তা দেখাল। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে দুটো সোনার চাকতি বার করে লোকটির হাতে দিল। লোকটা খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠল। দ্রুত কী বলে গেল। বোধহয় আটা ময়দা নিয়ে যেতে বলল। শাঙ্কোরা কাপড়ের বস্তাসুদ্ধ আটা ময়দা কাঁধে তুলে নিয়ে জাহাজ ঘাটার দিকে চলল।

তখনই শাঙ্কো দেখল দু’জন পাহারাদার খোলা তরোয়াল হাতে বাজারে ঘুরছে। শাঙ্কো চাপাস্বরে বলল, –ছোট্টো। চারজনই বাজারের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটল। পাহারাদার দু’জন ঠিক বুঝল না। শাঙ্কোরা ততক্ষণে ভিড়ে মিশে গেছে।

ওরা বস্তাপঁধে নৌকার কাছে এল। একটা নৌকো ঠেলে জলে নামাল। বস্তাগুলো নৌকায় তুলল। সঙ্গী বন্দুটিকে শাঙ্কো বলল–তুমি নৌকা নিয়ে চলে যাও। আমরা পীপে নিয়ে জল আনতে যাচ্ছি। বন্ধুটি বস্তা বোঝাই নৌকা জাহাজের দিকে চালাল।

এবার অন্য নৌকা থেকে তিনজন তিনটে জলের পীপে কাঁধে নিয়ে বাজার এলাকায় ঢুকল। শাঙ্কো সেই দোকানদার কাছে এল। ইশারায় পীপে দেখিয়ে জলের কথা বলল। দোকানদার বুঝল। হেসে পাহাড়ের দিকে দেখাল।

তিনজনে পীপে কাঁধে পাহাড়টার দিকে চলল।

পাহাড়ের নিচে বনভূমি। গভীর বন নয়। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে দু’জন স্ত্রীলোক কাঠের বালতিমত নিয়ে আসছে। শাঙ্কো বুঝল ওরা জল আনছে। ততক্ষণে ওরা ঝর্ণার জলধারার মৃদুশব্দ শুনছে। শব্দ লক্ষ্য করে এগোতেই ঝর্নাটা পেল। তিনটে পীপেতে জল ভরল। তারপর তিনজনেই, আঁজলাভরে জল খেল। পেট ভরেই খেল। তারপর গায়ে মাথায় জল ছিটোলো। বেশ কয়েকদিন পরে তৃপ্তিভরে জল খাওয়া। তবে উপোসী পেটে এখনও খাবার পড়েনি। তবে নিশ্চিন্ত। সে ব্যবস্থা করেছে।

জলভরা পীপে কাঁধে নিয়ে ফিরে বাজার এলাকায় এল। এবার পাহারাদার দুজনের নজরে পড়ল। শাঙ্কো লক্ষ্য করল সেটা। চাপা স্বরে বলল–জোরে পা চালাও। তিনজনেই পীপে কাঁধে প্রায় ছুটে চলল। সমুদ্রতীরে পৌঁছোলোও। নৌকোয় পীপে তিনটে তুললও। টেনে নিয়ে নৌকো নামাচ্ছে তখনই পাহারাদাররা তরোয়াল তুলে ছুটে এল। শাঙ্কো বলে উঠল–তোমরা নৌকো চালাও। আমি সাঁতরে যাবো। কিন্তু তার আগেই একজন পাহারাদার শাঙ্কোর গায়ে তরোয়ালের ঘা বসাল। শাঙ্কোর আর জলে নামা হল না। ও বালির ওপর গড়িয়ে পড়ল। তারপর দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে জামার ভেতর থেকে ছোরা বের করল। এক ঝটকায় সরে এসে সেই পাহারাদারেরা হাতে ছোরা বসিয়ে দিল। তরোয়াল ফেলে পাহারাদারটি বালির ওপর বসে পড়ল। অন্য পাহারাদারটি তখন সতর্ক হয়ে গেছে। সে তরোয়ালের ডগাটা শাঙ্কোর বুকের ওপর ঠেকিয়েছে। শাঙ্কো দ্রুত ওর ছোরাটা ওদের নৌকোর ওপর ছুঁড়ে দিল। ছোরা নৌকোর গলুইয়ের মধ্যে পড়ল। শাঙ্কো আর এক পাহারাদার দু’জনেই আহত। অক্ষত পাহারাদারটি শাঙ্কোকে বাজারের দিকে হাঁটতে ইঙ্গিত করল। আহত শাঙ্কো কোন কথা না বলে চলল। ওর পেছনে অক্ষত পাহারাদারটি চলল। আহত পাহারাদারও চলল।

বাজারের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় অনেক লোক ওদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। পাহারাদাররা একটা বড় বাড়ির সামনে শাঙ্কোকে নিয়ে এল। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়ি। ছাউনি লম্বা লম্বা শুকনো ঘাস আর কাঠের। কাঠ সব এবড়োখেবড়ো। লম্বা বারান্দা পাথরের। শাঙ্কো দেখল আরও কয়েকজন পাহারাদার বারান্দায় কোমরে মোটা কাপড়ের ফেট্টিতে তরোয়াল গুঁজে বসে আছে। গত কয়েকদিন খাদ্য জল জোটে নি। শরীর এমনিতেই দুর্বল। তার ওপর পিঠ দিয়ে তখনও রক্ত গড়াচ্ছে। শাঙ্কো বেশ কাহিল হয়ে পড়ল। একটাই আশাবন্দী যখন করেছে খাদ্য জল তো খেতে দেবে। তখন যদি শরীরে কিছু জোর পায়।

এবড়ো-খেবড়ো কাঠের দরজায় একজুন পাহারাদার হাত ঠুকে শব্দ করল। দরজা খুলে গেল। বেশ লম্বা একজন বয়স্ক লোক দরজা খুলে দাঁড়াল। পাহারাদার মাথা একটু নিচু করে নিয়ে অনর্গল কিছু বলে গেল। আহত পাহারাদারকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। শাঙ্কো বুঝল ওর বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা বলল।

লম্বা লোকটি শাঙ্কোকে ভেতরে নিয়ে আসার ইঙ্গিত করল। পাহারাদার শাঙ্কোকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। ঘরের অন্ধকার ভাবটা চোখে সয়ে আসতে শাঙ্কো দেখল ঘরে একটা পাথর আর কাঠের তৈরি চৌকি মত। তাতে মোটা চাদর কাপড়চোপড় পাতা। লম্বা লোকটি বিছানায় গিয়ে বসল। শাঙ্কো বুঝল এই লোকটি এদের সর্দার। সর্দার স্পেনীয় ভাষায় ভাঙা ভাঙা শব্দ জুড়ে বলল–এখানে–এসেছো–কারণ?

–আমরা বিদেশী–ভাইকিং। জাহাজ চড়ে এখানে এসেছি। জাহাজঘাটায় আমাদের জাহাজ নোঙর করা আছে। আমাদের জাহাজে খাদ্য আর জল ফুরিয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন আগে। আমরা এখানে আটাময়দা চিনি জল নিতে নেমেছিলাম। আপনার পাহারাদার–এই দেখুন–কথা থামিয়ে শাঙ্কো পিঠ দেখাল। তখনও কাটা জায়গা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছিল। শাঙ্কো বলল–আপনার পাহারাদারই প্রথমে তরোয়াল চালিয়েছিল। তারপরে আমি-শাঙ্কোকে থামিয়ে দিয়ে সর্দার বলে উঠল তোমরা দস্যু। আগে–এসেছিলে–স্ত্রীপুরুষ ধরে নিয়ে গেছো–ক্রীতদাস।

না–আমরা দস্যু নই। শাঙ্কো বেশ জোর দিয়ে বলল। সর্দার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–না। শাঙ্কো তবুও তারা যে দস্যু নয় এটা বোঝাবার জন্যে অনেক কথা বল। কিন্তু সর্দারের এক কথা।

শাঙ্কো বুঝল সর্দারকে বোঝানো যাবে না। ওর এক গোঁ। কারা কবে এখানকার স্ত্রীপুরুষ জাহাজে তুলে নিয়ে পালিয়েছে সেই অভিজ্ঞতা সর্দার ভুলতে পারছে না। শাঙ্কো বলেছে–আমি একা আপনাদের কী ক্ষতি করতে পারবো?

–তোমার–দল–আসবে–ক্ষতি করবে। সর্দার বলল।

–আমার বন্ধুরা এখানে আসবে না। খাদ্য জলের ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। আমি গেলেই বন্ধুরা জাহাজ ছেড়ে দেবে।

–বিশ্বাস নেই–বন্দী– সর্দার পাহারাদারদের ইঙ্গিত করল। দু’জন পাহারাদার ঘরে ঢুকল। শাঙ্কোকে ঠেলে পাশের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিল। ছোট ঘর। মেঝেয় মোটা কাপড় পাতা। তার নিচে শুকনো ঘাস বিছোনো। ওপাশের দেয়ালে উঁচুতে একটা জানালামত। তাতে গাছের ডাল কেটে বসানো। ঘরে দু’জন বন্দী রয়েছে। একজন শুয়ে আছে। অন্যজন বসে আছে।

পাহারাদার দরজা বন্ধ করে দিল। কয়েদঘরনয়। তবে কয়েদঘরের মত ব্যবহার করা হয়। যে শুয়েছিল সে উঠে বসল। শাঙ্কো কোন কথা বলল না। বলে লাভ নেই। বন্দীরা বুঝবেনা।

শাঙ্কো কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। চিৎ হয়ে শোওয়ার উপায় নেই। পিঠে ক্ষত। ও ভাবল–প্রথম সুযোগেই পালাতে হবে। পিঠের ক্ষতের চিকিৎসা এখানে হবে না। সর্দারকে বলে লাভ নেই। ওষুধ না পড়লে দিন কয়েকের মধ্যেই ক্ষত বিষিয়ে উঠতে পারে। বেঘোরে মারা যেতে হবে। তার আগেই পালাতে হবে। একে বেশ কয়েকদিন খাবার জোটেনি। শুধু ঝর্ণার জল খেয়ে আছে। তার ওপর পিঠে ক্ষতের যন্ত্রণা। শাঙ্কো খুব কাহিল হয়ে পড়ল।

দুপুরে দড়াম্ করে দরজা খুলে গেল। একজন পাহারাদার মাটির হাঁড়িতে খাবার নিয়ে ঢুকল। বন্দীদের খেতে দিল। অন্য পাহারাদারটি খোলা তরোয়াল হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। ক্ষুধার্ত শাঙ্কো খাবারের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। পোড়া গোল রুটি আর সামুদ্রিক মাছের ঝোল। রুটি দিয়েছে চারটে। শাঙ্কো গোগ্রাসে গিলল। রুটি শেষ। শাঙ্কো ইশারায় আরো দুটো রুটি চাইল। পাহারাদার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তরোয়াল হাতে অন্যজন দরজায় দাঁড়িয়েই রইল। পাহারাদার আরও দু’টো রুটি নিয়ে এল। শাঙ্কো খেল। ক্ষুধা মিটল। ও ইঙ্গিতে জল খেতে চাইল। পাহারাদার ইঙ্গিতে ঘরের কোনার দিকটা দেখাল। শাঙ্কো উঠে এল। দেখল একটা কাঠের গামলামত। তাতে জল। একটা কাঠের গ্লাস ভাসছে। ও গ্লাস তুলে পরপর চার গ্লাশ জল খেল। বন্দী দু’জনও খাবার খেয়ে জল খেল। পাহারাদার দু’জন দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

শাঙ্কো কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। বন্দীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু ওরা শাঙ্কোর কোন কথাই বুঝল না। হাল ছেড়ে দিয়ে শাঙ্কো জানলার দিকে তাকাল। ঈস্ যদি ছোরাটা থাকত! ঐ ডালগুলো অনায়াসে কাটা যেত। তারপর ফোকর গলে বেরিয়ে পালানো যেত। কিন্তু সঙ্গে ছোরাটাই তো নেই।

শাঙ্কো জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে বুঝল বিকেল হয়ে এসেছে। ও পালাবার ছক কষতে লাগল।

হঠাৎ দড়াম করে দরজা খুলে গেল। শাঙ্কো দেখল ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ঢুকছে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। শাঙ্কো লাফিয়ে উঠে বসল। বলে উঠল–ফ্রান্সিস। তুমি ধরা। দিতে গেলে কেন? ফ্রান্সিস বিছানায় বসতে বসতে মৃদু হেসে বলল–আহত তুমি। এখানে পড়ে থাকবে আর আমি খাবো ঘুমুবো? এটা হয়?

–কিন্তু দুজনেই বন্দী হয়ে গেলাম যে। শাঙ্কো বলল।

তাতে পালাবার সুবিধেই হবে। যাক গে–খেয়েছো তো? কয়েকদিন তো কিছুই খাও নি। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ খেতে দিয়েছে। এখন অনেকটাই ভালো আছি। শাঙ্কো বলল।

–দু’পায়ে জোর পাচ্ছো? ফ্রান্সিস বলল।

–অনেকটা। শাঙ্কো ঘাড় কাত করে বলল।

–তাহলে ছুটে পালাতে পারবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হ্যাঁ হ্যাঁ। তোমরা খেয়েছে তো? শাঙ্কো বলল।

–হ্যাঁ। তোমার উপস্থিতবুদ্ধি আটাময়দার বস্তা জল বাঁচিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।

–পালাবার ছক কিছু ভেবেছো? শাঙ্কো বলল।

খাবার দিতে ক’জন পাহারাদার আসে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–দু’জন। শাঙ্কো বলল।

–তরোয়াল থাকে কারো হাতে? ফ্রান্সিস আবার জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ। একজন খাবার দিতে ঘরের মধ্যে আসে। অন্যজন খোলা তরোয়াল হাতে দরজায় পাহারা দেয়। শাঙ্কো বলল।

–হুঁ। ফ্রান্সিস একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল–ছক কষা হয়ে গেছে।

–বলো কি? তাহলে খাবার দেবার সময়ই পালাবে? শাঙ্কো বলল।

–হ্যাঁ। যে খাবার দিতে আসবে তাকে দরজার ধাক্কায় ফেলে দেয় তরোয়ালওয়ালাকে আমি সামলাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমার ছক কাজে লাগবে? শাঙ্কো বলল।

–সেটা নির্ভর করছে কত তাড়াতাড়ি আমরা কাজ সারতে পারি তার ওপর। খাবার দেবার সময় তৈরি থেকো। ফ্রান্সিস বলল।

বন্দী দুজন ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোর কথা শুনছিল। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–এদের সঙ্গে কথা বলেছো?

-বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই বোঝাতে পারিনি। শাঙ্কো বলল।

দরকার নেই। এদের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ফ্রান্সিস বলল।

রাত হল। রাত বাড়তে লাগল। কখন খাবার দিতে আসে তার জন্য ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল।

একসময় দড়াম করে দরজা খুলে গেল। একজন পাহারাদার পাতায় রাখা খাবার নিয়ে ঢুকল! ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। আকারে ইঙ্গিতে বোঝাল ও সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছে। ও যেন খাবার রেখে দেয়।

ফ্রান্সিস দরজা দিয়ে বেরুতে অন্য পাহারাদারটি ওর পেছনে পেছনে তরোয়াল হাতে চলল। ফ্রান্সিস দেখল সর্দার বিছানায় শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস বলল–একটুউঠুন। আপনাকে কয়েকটা কথা বলবো। সর্দার বিছানা থেকে উঠে বসল। বিরক্তির সঙ্গে বলল–কী? ফ্রান্সিস ইনিয়ে বিনিয়ে একই কথা বলতে লাগল আমাদের মুক্তি দিন। কথা বলার সময় ফ্রান্সিস আড়চোখে দেখল বাইরের বারান্দায় দুজন পাহারাদার রয়েছে। তরোয়াল কোমরের ফেট্টিতে গোঁজা। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে ডাকল––শাঙ্কো। শাঙ্কো তৈরিই ছিল। খাবার দিয়েছিল যে পাহারাদারটি সে তখন দরজার কাছে এসেছে। শাঙ্কো দ্রুত হাতে খাবারের পাতা ছুঁড়ে দিল পাহারাদারের মুখে। সে মুখ নিচুকরল। তখনই শাঙ্কো দরজার পাল্লা ধাক্কা দিল পাহারাদারের পিঠে। দরজার ধাক্কায় পাহারাদার ঘরের মেঝেয় উবুড় হয়ে পড়ল। দরজার ধাক্কায় পাহারাদারের পড়ে যাওয়ারশব্দ শুনে তরোয়াল হাতে পাহারাদারটি ঘরের দিকে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস এইসুযোগটাই চাইছিল। ও ছুটে এসে পাহারাদারটিকেএকধাক্কায় ঘরের মেঝেয় ফেলে দিল। পাহারাদারের হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। মশালের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল তরোয়ালটা কোনায় জলের জায়গারকাছেপড়েছে। ফ্রান্সিস একলাফে সেখানে গিয়ে তরোয়ালটা তুলে নিয়ে ছুটে বাইরের ঘরে চলে এল। সর্দারের বুকে তরোয়ালের ডগাটা ঠেকিয়ে বলল–উঠে দাঁড়ান। সর্দার তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এভাবে আক্রান্ত হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। সর্দার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।

ওদিকে এখানকার শব্দ শুনে বারান্দা থেকে দুই পাহারাদার তরোয়াল হাতে ছুটে বাইরের ঘরে ঢুকল। দেখল সর্দারের বুকে তরোয়াল ঠেকিয়ে ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনেই হতবাক। সর্দারের জীবন বিপন্ন। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা এক টান দিল। সর্দারের বুকের কাছে পোশাক কেটে গেল। দেখা গেল চিরে গিয়ে বুক থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।

পাহারাদাররা ফ্রান্সিসকে বাধা দিতে সাহস পেল না। ফ্রান্সিস গম্ভীর গলায় বলল– সর্দার আমাদের জাহাজে তুলে দেবেন চলুন।

–না–না। সর্দার বলে উঠল।

–তাহলে মরবেন। কথাটা বলে ফ্রান্সিস তরোয়ালের চাপ বাড়াল। সর্দার আর আপত্তি করতে সাহস পেল না।

–চলুন। ফ্রান্সিস তাড়া দিল।

সর্দার আস্তে আস্তে বাইরের বারান্দায় এল। ফ্রান্সিস বলল–আপনার পাহারাদারদের এখান থেকে চলে যেতে বলুন। সর্দার গলা চড়িয়ে কী বলল। পাহারাদার দুজন উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল।

ওদিকে দুই বন্দী দরজা খোলা পেয়ে এক ছুটে বাইরে চলে এল। তারপর ছুটল পাহাড়টার দিকে।

সামনে সর্দার। পেছনে সর্দারের পিঠে তরোয়াল ঠেকিয়ে ফ্রান্সিস। পেছনে শাঙ্কো। তিনজনে চলল জাহাজঘাটের দিকে।

বাজার এলাকা জনহীন। রাস্তা দিয়ে তিনজন চলল। জোৎস্না অনুজ্জ্বল হলেও চারদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল।

তিনজনে জাহাজঘাটে পৌঁছল। ফ্রান্সিস পেছনে তাকিয়ে দেখল দূরে পাহারাদাররা দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিসরা সমুদ্রতীরে জলের কাছে এল। হঠাৎ অনুচ্চস্বরে ফ্রান্সিস বলে। উঠল–শাঙ্কো-সাঁতরে। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্ষতস্থানে নোনা– জল লাগতে ভীষণ জ্বালা করে উঠল। ওর মুখ থেকে কাতর ধ্বনি উঠল–অ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলে উঠল–কী হল?

–কিছু না। এসো। শাঙ্কো জাহাজের দিকে সাঁতরাতে লাগল। এবার ফ্রান্সিস তরোয়ালটা দাঁতে চেপে ধরে জলে ঝাঁপ দিল। তারপর জাহাজের দিকে সাঁতরে চলল।

ওদিকে বেশ কিছু বন্ধু এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিসদের দেখছিল। সিনাত্রা দ্রুত হালের দিকে গেল। দড়ির মইটা খুলে নামিয়ে দিল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো মই বেয়ে বেয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–বিস্কো–নোঙর তোল। কয়েকজন দাঁড়ঘরে যাও। পাল খুলে দাও। আমরা এখান থেকে চলে যাবো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নোঙর তোলা হল পাল খোলা হল। দাঁড় বাওয়া শুরু হল। জাহাজ মাঝসমুদ্রের দিকে চলল।

ফ্রান্সিস তাকিয়ে দেখল সর্দার বালিয়াড়িতে বসে আছে। তাকে ঘিরে পাহারাদারদের ভিড়। ওরা অসহায় দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে তাকিয়ে আছে।

জাহাজ চলল মাঝসমুদ্রের দিকে।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে। বাতাস বেগবান। পালগুলো ফুলে উঠেছে। দাঁড় বাইতে হচ্ছে না। খুশির হাওয়া ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে। ডেক-এ ছক্কাপাঞ্জা খেলছে দল বেঁধে।

বিকেলের দিকে ফ্রান্সিস এল জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে। বলল–দিক ঠিক রাখতে পারছো?

–চেষ্টা করছি। রাতে আকাশে মেঘ জমলেই প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ি। ফ্লেজার বলল।

তার মানে ধ্রুবতারাটা দেখতে পাও না। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।

–হ্যাঁ। তখন কতকটা আন্দাজেই জাহাজ চালাতে হয়। ফ্লেজার বলল।

–অগত্যা তাই করো। এখনও তো ডাঙার দেখা পেলাম না। কাজেই বুঝতে পারছি না কোথায় এলাম। ফ্রান্সিস বলল।

–দেখি। জাহাজ তো চলুক। ফ্লেজার বলল।

ভাইকিংরা জেনেছে জাহাজ ওদের দেশের দিকেই চলেছে। সংবাদটা আনন্দের। তাই শাঙ্কো ছক্কাপাঞ্জা খেলার আসর ছেড়ে এসে গলা চড়িয়ে বলল-রাতের খাওয়া সেরে ডেক-এ এসে নাচগানের আসর বসাও। প্রায় সব বন্ধুরা হৈহৈ করে শাঙ্কোর কথা সমর্থন করল।

তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বরাবরের মত মারিয়া ডেক-এ এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছে। শাঙ্কো মারিয়ার কাছে এল। বলল–রাজকুমারী আমরা ঠিক করেছি আজ রাতে ডেক-এ নাচগানের আসর বসাবো। আপনি থাকবেন।

নিশ্চয়ই থাকবো। সবাই আনন্দ করবে আর আমি থাকবো না? মারিয়া হেসে বলল।

–খুব খুশি হলাম। শাঙ্কো হেসে বলল। সবাই রাতের নাচগানের আসরের কথা জানল। ফ্রান্সিসও জানল। কিন্তু ওর মন থেকে দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। জাহাজ কোথায় চলেছে? দিক ঠিক আছে কিনা। দিনে রাতে বার কয়েক ফ্লেজারের কাছে আসে। জানতে চায় জাহাজ ঠিক উত্তরমুখো যাচ্ছে কিনা। ফ্লেজার খুব নিশ্চিন্তভাবে বলতে পারছে না ঠিক কোনদিকে জাহাজ চলেছে। এই সংশয়ের কথা ফ্রান্সিস অবশ্য বন্ধুদের বলে না। এসব জানলে বন্ধুদের মধ্যে হতাশা আসবে। সেটা এই অবস্থায় বিপজ্জনক। তাই ফ্লেজারকে মৃদুস্বরে বলে–

–এসব কথা বন্ধুরা কেউ যেন না জানে।

–ঠিক আছে। এই নিয়ে তুমি ভেবো না। জাহাজে এখন খাদ্য জলের অভাব নেই। কাজেই বেশ কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। ফ্লেজার বলল।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকল। ভাইকিংরা সবাই ডেক-এ উঠল। পূর্ণিমার কাছাকাছি সময়। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ফ্রান্সিস আর মারিয়াও মাস্তুলের গা ঘেঁষে বসল। মাঝখানে গোল জায়গা রেখে সবাই গোল হয়ে বসল। শাঙ্কো কোত্থেকে একটা খালি পিপে নিয়ে এল। টন্ টন্ শব্দে খালি পিপে পিটিয়ে গলা চড়িয়ে বলে উঠল–গান শুরু হোক। ফ্রান্সিস হেসে জোরে বলল–সিনাত্রা-গান শোনাও। কয়েকজন বন্ধু সেনাত্রাকে ঠেলাদিয়ে বলল–যাও–গান শোনাও।

সিনাত্রা হাসল। তারপর উঠে গিয়ে গোল জায়গাটায় দাঁড়াল। শুরু করল গান। ওদের দেশের গান। বসন্ত এলে যখন ওদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন ঘাস গজায় তখন ভেড়াপালকরা ভেড়ার পাল নিয়ে আসে সেই ঘাস খাওয়াতে। তখন ওরা ভেড়ার পাল ছেড়ে দিয়ে ঘাসের ওপর বসে গান গায়–

সবুজঘাসে ঢাকল পাহাড়
দেখে যা রে কেমন বাহার
ফুটলো কলি
জুটলো অলি
এ দেশ তোমার আমার।

সুরেলা গলায় সিনেত্রা গাইতে লাগল ভেড়াপালকদের গান। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। মারিয়া রাজপ্রাসাদে মানুষ হয়েছে। ভেড়াপালকদের গান ও কখনও শোনেনি। তাই গভীর আগ্রহ নিয়ে মারিয়া গানটা শুনতে লাগল। ফ্রান্সিসেরও শুনতে ভালো লাগছিল। কিন্তু বন্ধুদের মন আনন্দের বদলে বিষাদে ছেয়ে গেল। কারণ গান শুনে নিজেদের মাতৃভূমির কথাই বেশি করে মনে পড়ল। সবাই চুপ করে বসে রইল। শাঙ্কো বুঝল সেটা। কোথায় নাচবে হৈ হৈ করবে তা নয় সবার মন ভারাক্রান্ত। গান শেষ হতে শাঙ্কো লাফিয়ে উঠে পীপে বাজাতে বাজাতে বলে উঠল–সিনাত্রা বিয়ের গান গাও। আনন্দের উল্লাসের।

সিনাত্রা হেসে বিয়ের চটুল গান ধরল। বর বিয়ে করতে যাওয়ার সময় যে গান গাওয়া হয়। ছন্দে তালে সুরে গান জমে উঠল। শাঙ্কোর পীপের বাজনার তালে তালে কয়েকজন উঠে ডেক-এর ওপর থপ্ থপ থপ্ পা ঠুকে নাচতে আরম্ভ করল।

একটা গান শেষ হতেই সিনাত্রা আর একটা তালের গান ধরল। চলল থপ্ থপ্ থপ্ নাচ। এবার প্রায় সবাই নাচতে লাগল। ফ্রান্সিস মারিয়াও বাদ গেল না। শুধু বয়েসে বড় ভেন হাসিমুখে নাচ দেখতে লাগল। মারিয়া রাজপ্রাসাদে ঢিমে লয়ে বাজনার সঙ্গে নাচতে অভ্যস্ত। এত দ্রুত তালের নাচ ও কোনদিন নাচে নি। আজকে নাচল। এই নাচে একটা উন্মাদনা আছে। মারিয়া ফ্রান্সিসের সঙ্গে নেচে উপভোগই করছিল নাচটা।

প্রায় দুঘণ্টা নাচ চলল। শেষের দিকে জাহাজ চালক ফ্লেজার কড়ার সঙ্গে হুইল আটকে রেখেনাচে যোগ দিল। নাচগানেরশব্দ জ্যোৎস্না ধোওয়া সমুদ্রের বুকেছড়িয়ে পড়তে লাগল।

একসময় সিনাত্রা গান থামাল। বাজনা নাচ বন্ধ হল। একঘেয়ে জাহাজী জীবনে এই বৈচিত্র্য ভালো লাগল সবার। একমাত্র পেড্রো এই আসরের মজা থেকে বঞ্চিত হল। ওকে। তো নজরদারি চালাতে হয়। এর পরে কয়েকদিন পরপরই রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ডেক এ নাচগানের আসর বসতে লাগল। এই আনন্দঘন সময় সবাই উপভোগ করতে লাগল। ফ্রান্সিস এই ব্যাপারে উৎসাহই দিল। ওরা আনন্দে থাকুক এটাইফ্রান্সিস চাইছিল।

দিন কুড়ি কাটল। জাহাজ দ্রুতই চলেছে। তবে ডাঙার দেখা নেই। ফ্রান্সিস একটু চিন্তায় পড়ে। কিন্তু উপায় নেই। ডাঙার দেখা পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতেই হবে।

পেড্রো মাস্তুলের মাথায় নিজের জায়গায় বসে চারদিক নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। তার জন্যে পেড্রোকে রাতও জাগতে হচ্ছে।

দিনরাত জাহাজ চলেছে। ডাঙার দেখা নেই। এই নিয়ে ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন হয়। তবে ফ্রান্সিসের ওপর ওদের অগাধ বিশ্বাস। ফ্রান্সিসের চিন্তা হয়। এতগুলো মানুষের জীবনের দায়িত্ব তো ওর কাঁধেই। বন্ধুরা হৈ হৈ করে। আনন্দ করে। নাচগানের আসর বসায়। আর ফ্রান্সিস থাকে নিজের চিন্তা নিয়ে। হ্যারি সান্ত্বনা দেয়-খাদ্য আছে। জল আছে। চলুক না জাহাজ। ডাঙার দেখা পাবই।

দিন পনেরো পরে ডাঙার দেখা মিলল। মাস্তুলের ওপর থেকে পেড্রোর চিৎকার শোনা গেল–ভাইসব–ডাঙা দেখা যাচ্ছে। হ্যারি ডেক-এই ছিল। গলা চড়িয়ে বলল–কোনদিকে?

–ডানদিকে। পেড্রো গলা চড়িয়ে বলে। কয়েকজন ভাইকিং পেড্রোর কথা শুনল। ওরা রেলিং ধরে দাঁড়াল। ডানদিকে তাকাল। দেখল জঙ্গল। জঙ্গল ঘন না ছাড়া ছাড়া গাছগাছালির সেটা বুঝল না।

হ্যারি ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসকে ডেকে আনল। ফ্রান্সিসের সঙ্গে মারিয়াও এল।

জাহাজটা ততক্ষণে জঙ্গলের অনেক কাছাকাছি এসেছে। বোঝা গেল জঙ্গলটা মোটামুটি ঘনই। বড় বড় গাছের জঙ্গল। বালিয়াড়ির পরেই জঙ্গলের শুরু। এখান থেকে সমুদ্র অনেকটা গভীর। সেটা বোঝা গেল জাহাজটা যখন তীরভূমির কাছাকাছি এল।

ফ্রান্সিস জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে এল। বলল–

–কী মনে হয় তোমার। জাহাজ তীরে ভেড়ানো যাবে?

–তা যাবে। জলে গভীরতা আছে। ফ্লেজার বলল।

–তাহলে জাহাজ তীরে ভেড়াও ফ্রান্সিস বলল।

–কী ভাবছো ফ্রান্সিস। এখানে নামবে? হ্যারি জানতে চাইল।

–হ্যাঁ। জাহাজঘাটটা ছোট। কোন জাহাজও নোঙর করা নেই। তবে বোঝা যাচ্ছে জাহাজঘাট হিসেবেই এটা ব্যবহার করা হয়।

–লোকজন কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। হ্যারি বলল।

–নেমে দেখতে হবে। হয়তো জঙ্গলের ওপারে বসত আছে। সেখানে গিয়েই খোঁজ করতে হবে। জানতে তো হবে কোথায় এলাম। ফ্রান্সিস বলল।

–এখন তো বিকেল হয়ে এসেছে। এখনই নামবে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

–হ্যাঁ। দিনে দিনেই খোঁজখবর নেওয়া ভাল। রাতে কিছু করা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ফ্লেজারের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল–জাহাজ তীরে ভেড়াও।

ফ্লেজার আস্তে আস্তে জাহাজ তীরে ভেড়াল। শাঙ্কো আর বিস্কো মিলে পাটাতন ফেলল। ফ্রান্সিস শাঙ্কো আর সিনাত্রাকে তৈরি হয়ে আসতে বলল। শাঙ্কো বলল তাহলে এখনই নামবে?

–হ্যাঁ। একটু পরেই নামবো। দেরি করবো না। ফ্রান্সিস বলল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই শাঙ্কো আর সিনাত্রা তৈরি হয়ে এল। তিনজনে পাটাতনের দিকে এগোল। হ্যারি মারিয়া আর অন্য কয়েকজন বন্ধু রেলিং ধরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসরা তবোয়াল নিল না।

ফ্রান্সিসরা জাহাজঘাটায় নেমে দেখল একটা রাস্তামত বনের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। তার মানে এই পথে লোকচলাচল করে। কাজেই নিশ্চয়ই বনের পরে লোকবসতি আছে।

তিনজনে বনের পথ ধরে পশ্চিমমুখো হাঁটতে লাগল। রাস্তার দুপাশে ঘন বন। এখানে ওখানে ভাঙা রোদ পড়েছে। তবে বনতল অন্ধকারই।

ওরা কিছুটা এগিয়েছে। হঠাৎ শুকনো পাতা ভাঙার জোর শব্দ। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলে উঠল–পালাও। ওরা ঘুরে দঁড়াতে যাবে তখনই হঠাৎ দেখল প্রায় অন্ধকারে পথের ওপর দাঁড়িয়ে তিনজন লোক। হাতে উদ্যত বর্শা। বনের অন্ধকারে মোটামুটি দেখা গেল ওদের পরনে মোটা কাপড়ের আঁটোসাটো পোশাক। গায়ের রং কালো। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–পেছনে ছোটো। ঘুরে দাঁড়িয়েই ওরা দেখল আরো তিনচারজন কালো মানুষ উদ্যত বর্শা হাতে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিসদের পালানো হল না। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–কোনরকম বাধা দিও না। আমাদের নিয়ে কী করে দেখি।

রাস্তার দুদিক থেকে দু’দল যোদ্ধা এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। একজন মোটামত যোদ্ধা এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসদের সামনের দিকে হাঁটুতে ইঙ্গিত করল। সবাই বনপথ দিয়ে চলল। সামনে তিনজন। পেছনে চারজন। সবার হাতেই লম্বা ডাল কেটে তৈরি ছুঁচোলোমুখ লোহা বাঁধানো বর্শা। সবাইচলল। বন শেষ। বিকেলের পড়ন্ত আলোয়। ফ্রান্সিস দেখল বাঁদিকে শুকনো লম্বা লম্বা ঘাস ঢাকা হল দূরবিস্তৃত। সম্মুখে বাড়িঘর দোর। ঘরগুলো ছাউনি ঘাসের। দেয়াল মাটি পাথরের। বসতি এলাকা। বাড়িঘরের মধ্যে বাইরে স্ত্রী-পুরুষ ছেলেমেয়ের ওরা অনেকেই বেশ অবাক হয়ে ফ্রান্সিসদের দেখছিল।

বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল একটা বেশ বড় উঠোনমত। উঠোনের মাঝখানে একটা খুঁটির মত আস্ত একটা শুকনো গাছ পোঁতা। ঐ পরিষ্কার উঠোন ঘিরেই বাড়িঘর।

সামনেই একটা বড় ঘর। তার মাটির বালিপাথরে তৈরি বারান্দায় একটা কাঠের আসনে বসে আছে এক যুবক। মাথায় লম্বা চুল পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে। গায়ের রং। তামাটে। পরনে আঁটো সাটো মোটা কাপড়ের পোশাক। কাঠের গ্লাস করে কিছু খাচ্ছে। টকটকে লাল চোখ ক্রুর দৃষ্টি। তার সামনে এসে ফ্রান্সিসদের দাঁড় করানো হল। মোটা যোদ্ধাটি মাথা একটু নুইয়ে এক নাগাড়ে কিছু বলে গেল। বোঝাই গেল ফ্রান্সিসদের বন্দী করার ঘটনা বলল। আরো বোঝা গেল যুবকটি এখানকার সর্দার।

যুবক সর্দার এবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল–কে তোমরা?

–আমরা বিদেশী। য়ুরোপ থেকে জাহাজ চড়ে এখানে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।

–কীভাবে? সর্দার জানতে চাইল।

জাহাজে চড়ে। ফ্রান্সিস বলল।

সর্দার একটু চুপ করে থেকে গ্লাসের পানীয় সবটা খেয়ে গ্লাসটা পাশে রাখল। তারপর সরাসরি বলে বসল-না–তোমরা–রাজা প্রোফেনের-গুপ্তচর আমাদের যোদ্ধাসংখ্যা–খবর।

–আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। রাজা প্রোফেন নামে কাউকে আমরা চিনি না। কোথায় তার রাজত্ব তাও জানি না। ফ্রান্সিস বলল।

–বিশ্বাস–নেই। বন্দী-হত্যা। সর্দার বলল।

ফ্রান্সিস ভীষনভাবে চমকে উঠল। বুঝল চরম বিপদের মুখে ওরা। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–আমাদের কেন হত্যা করবেন? কী অপরাধ করেছি আমরা?

–রাজা প্রোফেনের গুপ্তচররাতে—দেখবে–শাস্তি।

ফ্রান্সিস বুঝল রাজা প্রোফেনের যোদ্ধাকে শাস্তি দেওয়া হবে। তবে ওদের মুক্তি নেই। পরে ওদেরও শাস্তি দেওয়া হবে। আজ রাতেই ঐ যোদ্ধাকে শাস্তি দেওয়া হবে। কীরকম শাস্তি সেটা দেখে বোঝা যাবে ওদেরও ভাগ্যে কীরকম শাস্তি জুটবে। সদার বলছে হত্যা। ওদেরও হত্যা করা হবে। এই চিন্তাটাই ফ্রান্সিসকে উদ্বিগ্ন করল। ফ্রান্সিস অবার বলল– আমাদের শাস্তি দেওয়া হবে কেন? আমরা তো আপনাদের কোন ক্ষতি করিনি।

কথা নয়-যাও–বন্দী। সর্দার গভীরস্বরে বলল। ফ্রান্সিস বুঝল এই সদারের মনে কোন দয়ামায়ার লেশমাত্র নেই। নরহত্যা এর কাছে কোন অন্যায়ইনয়। ফ্রান্সিস ক্রুদ্ধ হল। চিৎকার করে বলে উঠল–আমাদের হত্যা করার চেষ্টা করলে আপনিও রেহাই পাবেন না। সর্দার একলাফে উঠে দাঁড়াল। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে কী বলে উঠল। যোদ্ধারা ছুটে এসে তিনজনের পিঠে বর্শা খোঁচা দিয়ে হাঁটতে ইঙ্গিত করল। তিনজনকে নিয়ে যোদ্ধারা উঠোনের মাঝখানে লম্বা খুঁটির কাছে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস দেখল দু’জন বন্দীকে খুঁটির সঙ্গে হাত পা বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়েছে। শক্ত বুনো লতা দিয়ে ফ্রান্সিসদেরও খুঁটর সঙ্গে বাঁধা হল। পা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হল। বাঁধা হাত আর খুঁটির সঙ্গে বাধা হল না। একজন যোদ্ধা ওদের সামনে পাহারায় রইল। অন্য যোদ্ধারা চলে গেল।

–ফ্রান্সিস–যে করেই হোক পালাতে হবে। শাঙ্কো বলল।

–ছক কষেছি। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

—তুমি মাথা গরম করে ফেললে–শাঙ্কো অনুযোগের সুরে বলল।

–কোন কারন নেই–আমাদের হত্যা করা হবে? এসব শুনলে কারো মাথার ঠিক থাকে। ফ্রান্সিস বলল। বেশ ভয়ার্তস্বরে সিনাত্রা বললতাহলে আমরা আর বাঁচবোনা?

নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবো সিনাত্রা। ইচ্ছে করলে তুমি এখন গান গাইতে পারো।

–কী পাগলের মত কথা বলছো? মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে

–অত সহজে ফ্রান্সিস মৃত্যু মেনে নেয় না। শুধুসময় সুযোগেরঅপেক্ষা। ফ্রান্সিস বলল।

–সত্যি কি সর্দার আমাদের মেরে ফেলবে? সিনাত্রা বলল।

–ওর চোখের দৃষ্টিই বলছে। ও নরঘাতক। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে–সিনাত্রা বলতে গেল। ফ্রান্সিস ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল –ভয় পেওনা। মনে সাহস রাখো। সাহস হারিও না।

তারপর ওরা আর কোন কথা বলল না। ফ্রান্সিস পালানোর উপায় ভেবে চলল। শাঙ্কোর কেমন মনে হল বন্দী দু’জন নিশ্চয়ই রাজা প্রোফেনের যোদ্ধা। ধরা পড়ে এখন শাস্তির মুখে। শাঙ্কো নিশ্চিত হতে বলল–ভাই তোমরা কি রাজা প্রোফেনের দেশের যোদ্ধা? শাঙ্কোর সব কথা ওরা বুঝল না। কিন্তু রাজা প্রোফেন শুনে একজন মাথা ওঠা নামা করল। শাঙ্কো বুঝল ওর অনুমান ঠিক। এবার শাঙ্কো বলল–তোমাদের দেশ কোনদিকে? বার কয়েক বলার পর ওরা বুঝল। একজন দু’হাত তুলে শুকনো ঘাসের বনের দিকে দেখাল। ফ্রান্সিস এসব দেখছিল। বুঝল ঐ ঘাসের বনেরও পাশেই রাজা প্রোফেনের রাজত্ব। সন্দেহ নেই এই সর্দার রাজা প্রোফেনের শত্রু।

সন্ধ্যে হয়ে এল। ফ্রান্সিসরা দেখল যোদ্ধারা জঙ্গল থেকে শুকনো গাছডাল নিয়ে আসছে। আর একদল বড় বড় আঁটি বেঁধে শুকনো ঘাস নিয়ে আসছে। উঠোনের ওপাশে একটা গাছের নীচে সব জড়ো করছে। ঘাস ডালপাতার স্তূপ গাছটার নিচে কান্ডের চারিদিকে জড়ো করা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ উঁচু হয়ে গেল শুকনো ঘাস গাছ ডালের স্তূপ। সিনাত্রা এসব দেখে বলল–এরা বোধহয় আগুন জ্বেলে নাচ গান করবে। শুধু ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–সিনাত্রা এখন এই সর্দারকে চেনোনি। শাস্তির ব্যবস্থা হচ্ছে।

বলো কি! শাঙ্কো বলে উঠল–তার মানে এই বন্দী দুজনকে–ফ্রান্সিস ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল–হ্যাঁ পুড়িয়ে মারা হবে।

–কী সাংঘাতিক! সিনাত্রা আঁৎকে উঠল।

এর আগেও কতজনকে এভাবে শাস্তি দিয়েছে কে জানে। কাজেই এই সর্দারের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। শুধু ভাবছি যা সন্দেহ করছি তা ঘটে কি না। ফ্রান্সিস মৃদু স্বরে বলল।

সন্ধ্যের পরেই ফ্রান্সিসদের, বন্দীদের খেতে দেওয়া হল। গোল গোল পাতায় পোড়া পোড়া রুটি আর আনাজের ঝোল।

একটু রাত হতেই সব নারীপুরুষ খেয়ে নিল। উঠোনে এসে সবাই জড়ো হতে লাগল। গাছটা ঘিরে লোকজন দাঁড়িয়ে গেল।

এবার বন্দী দুজনকে যোদ্ধারা বন্দী পায়ের বাঁধন খুলে গাছটার দিকে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিস যা আশঙ্কা করছিল তাই ঘটতে চলল। বন্দী দু’জনকে সেই কাঠের স্কুপের ওপরে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে তোলা হল। বুনো লতা দিয়ে গাছের সঙ্গে তাদের বেঁধে দেওয়া হল। উপস্থিত লোকজনরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। বন্দী দু’জনে যোদ্ধাদের হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ওদের হাত এড়াতে পারল না। দু’জনে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

তখনই সর্দার ডানপাশের একটা বড় ঘর থেকে বেরিয়ে এল। যোদ্ধা কয়েকজন সর্দারের কাঠের আসনটা পেতে দিল। সর্দার গ্লাসে নেশার তরল পদার্থ নিয়ে আসনে বসল। যোদ্ধারা সর্দারের নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগল। একসময় গ্লাসে চুমুক দিয়ে সর্দার ডানহাত উঁচু করল। একজন যোদ্ধা চকমকি পাথর ঠুকে গাছের নীচে শুকনো ঘাসে আগুন জ্বালিয়ে দিল। আগুন দ্রুত জ্বলে উঠে ছড়িয়ে গেল। শুকনো কাঠে আগুন লেগে গেল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। বন্দী দু’জনকে আগুন আচিরেই স্পর্শ, করল। বন্দী দু’জন উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল। আর্ত চিৎকার শোনা গেল।

ফ্রান্সিস আর তাকিয়ে দেখতে পারল না। মুখ নিচু করে চুপ করে বসে রইল। মর্মান্তিক আর্তনাদ শুনতে শুনতে ফ্রান্সিসের চোখে জল এল। শাঙ্কো সিনাত্রাও মুখ নিচু করে বসে রইল। ওদিকে জড়ো হওয়া মানুষের মধ্যে উল্লাসের ধ্বনি উঠল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–কী নিষ্ঠুর এই মানুষেরা। বোঝাই যাচ্ছে এখানকার মানুষেরা এরকম দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত।

শাস্তি শেষ। ভোর হয়ে এল। সর্দার নিজের বড় ঘরটায় ঢুকে পড়ল। লোকজন নিজেদের ঘরে ফিরে গেল।

সেদিন দুপুরে দু’জন যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের খাবার দিতে এল। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে বলল–আমি খাব না। যোদ্ধা দু’জন অবাক। বার বার খাবারের পাতা এগিয়ে দিল। ফ্রান্সিস সরিয়ে দিল। শাঙ্কো আর সিনাত্রাও মাথা নেড়ে খেতে অস্বীকার করল। যোদ্ধারা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ওরা খাবার নিয়ে ফিরে গেল। বোধহয় সর্দারকে গিয়ে সেকথা বলল।

কিছু পরে সর্দার এল। হাত নেড়ে বলল–খাও। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। সর্দার কিছুক্ষণ চাপাচাপি করল। তারপর আর কিছু না বলে চলে গেল। তারপর থেকে ফ্রান্সিস একটি কথাও বলল না।

রাত হল। শাঙ্কো ডাকল ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস ওর দিকে ফিরে তাকাল।

–রাতেও খাবে না। শাঙ্কো জানতে চাইল।

রাতে খাব। পালাতে গেলে উপবাসী পেটে থাকা চলবে না।

রাতের খাবার যোদ্ধা দু’জন দিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা পেট পুরে খেল। সারা দিন উপোবাসী থেকে বেশ দূর্বল লাগচ্ছিল শরীর। রাতে খেয়ে গায়ে একটু জোর পেল। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বলল–একটু ঘুমিয়ে নাও। কয়েদঘরে কখনও কখনও হাত পা বাঁধা অবস্থায় থেকে ঘুমোন ফ্রান্সিসদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। তিনজনে ঐ অবস্থায় কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিল। ঘুম ভেঙে দেখল একজন পাহারাদার বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছে। — তখন শেষ রাত। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এগিয়ে এল। পাহারাদারদের চোখ এড়িয়ে ফ্রান্সিস শাঙ্কোর গলার কাছ দিয়ে বাঁধা দু’হাত ঢোকাল। তারপর আস্তে আস্তে ছোরাটা তুলল। শাঙ্কোর বাঁধা হাতে দিল। শাঙ্কো আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের হাতের বাঁধা লতা কাটতে লাগল। একটু সময় লাগল। বুনো লতাটা বেশ শক্ত। ফ্রান্সিসের হাতের লতা কেটে গেল। এবার ছোরাটা নিয়ে শাঙ্কোর হাতের বাঁধন কাটল। শাঙ্কো ছোরা নিল। সিনাত্রার হাতের বাঁধন কাটল। তারপর সকলেই পায়ের বাঁধন কাটল। সিনাত্রা চাপা স্বরে বলে উঠল-সাবাস শাঙ্কো।

তিনজনের খোলা হাত পা নিয়ে একটু বসে রইল। ফ্রান্সিস চোরা দৃষ্টিতে পাহারাদারদের দেখতে লাগল। পাহারাদাররা পায়চারি করছিল। একবার ঘুরে দাঁড়াতেই ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে একলাফে পাহারাদারের ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়ল। পাহারাদার চিৎ হয়ে পড়ে গেল। হাত থেকে বর্শাটা ছিটকে গেল। ফ্রান্সিস একলাফে গিয়ে বর্শা তুলে নিল। ওদিকে শাঙ্কো হাতের ছোরাটা পাহারাদারের। পেটে ঢুকিয়ে দিল। পাহারাদারের মুখে মৃদু শব্দ উঠল–ওঃ। ততক্ষণে ফ্রান্সিস সর্দারের ঘরের দরজার কাছে ছুটে এসেছে। জোরে লাথি মেরে দরজা ভেঙে ফেলল। ঘরে মশালের আলোয় দেখল দরজা ভাঙার শব্দে সর্দার বিছানায় উঠে বসেছে। সর্দার আগে বুঝে ওঠার আগে ফ্রান্সিস বর্শাটা সর্দারের বুকে ঢুকিয়ে দিল। সর্দার দু’হাতে বেঁধা বর্শাটা ধরে চিৎ হয়ে বিছানায় পড়ে গেল। চিৎকার করে উঠল—আঁ–আঁ–।

ফ্রান্সিস এক লাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে চাপা স্বরে বলে উঠল–উত্তর দিকের বনের দিকে ছোটো। তিনজনে ঘাসের বনের দিকে ছুটল। কিন্তু দরজা ভাঙার শব্দে সর্দারের চিৎকারে অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেল। যোদ্ধারা কয়েকজন সঙ্গে সঙ্গে বর্শা হাতে বেরিয়ে এল। এরা যোদ্ধার জাত। লড়াই করতে অভ্যস্ত। ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। কিন্তু কয়েক মূহুর্ত। চাঁদের অনুজ্জ্বল আলোতে ফ্রান্সিসদের ঘাসবনের দিকে ছুটতে দেখল। বন্দীরা পালাচ্ছে। মুখে থাবড়া দিয়ে উ–উশব্দতুলল। আরো যোদ্ধা বর্শা হাতে ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে এল। সবাই ছুটল ফ্রান্সিসদের দিকে।

ততক্ষণে ফ্রান্সিসরা ঘাসের বনে ঢুকে পড়েছে। ঘাসের উচ্চতা বুক পর্যন্ত। তাও ফ্রান্সিসদের মাথা ঢাকা পড়ল না। ওদের মাথা দেখে যোদ্ধারা বর্শা হাতে ছুটে এল। শুকনো ঘাসের বনে ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সিসদের ধাওয়া করল। ফ্রান্সিসরা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটল। কিন্তু ঘাসের গোড়ায় পা জড়িয়ে যেতে লাগল। ফ্রান্সিসদের গতি কমে আসতে লাগল। অনেকটা কাছে এসে পড়ল যোদ্ধার দল। ফ্রান্সিস পিছনে ফিরে দেখল সেটা। ফ্রান্সিস হঠাৎ নিচু হয়ে এক মুঠো ধূলো তুলল। উড়িয়ে দেখল বাতাস দক্ষিণমুখী। অর্থাৎ যেদিক থেকে যোদ্ধারা ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল– সিনাত্রা চকমকি পাথর লোহা আছে তো।

–কোমরে ফেট্টি তে গোঁজা। সিনাত্রা বলল।

ঘাসে আগুন লাগাও। জলদি। ফ্রান্সিস বলল।

সিনাত্রা বসে পড়ল। কোমর থেকে চকমকি পাথর লোহা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে ঠুকতে লাগল। চকমকি পাথর থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে শুকনো ঘাসে লাগল। দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শুকনো ঘাসে আগুন লেগে গেল। উত্তরমুখী হাওয়া। ওদিক থেকে যোদ্ধারা ছুটে আসছিল। আগুনের ধোঁয়া ছুটল যোদ্ধাদের দিকে। যোদ্ধারা মরিয়া হয়ে বর্শা ছুঁড়ল। কিন্তু সে সব বর্শা আগুনের মধ্যে পড়ল। আগুন তখন হাওয়ায় ভর করে ওদের দিকে ছুটে আসছে। ওরা চিৎকার করতে করতে পিছনে ফিরে ছুটল। ফ্রান্সিসের সঙ্গে তখন ওদের আগুনের ব্যবধান। ফ্রান্সিসরা ততক্ষণ হাঁপাতে হাঁপাতে ঘাসের বনের বাইরে চলে এসেছে। সামনেই একটা জলাশয় মত। ওরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জল গভীর নয়। কোমর পর্যন্ত। ওরা জল ঠেলে চলল। চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট কিছু বাড়িঘর দেখল। ফ্রান্সিস পেছনে ফিরে দেখল সারা ঘাসের বনে আগুন আর ধোঁয়া। সামনের বাড়িঘর দেখে ফ্রান্সিস বলল–ওটা নিশ্চয়ই রাজা প্রোফেনের রাজত্ব। সর্দারের শত্রু রাজ্য। ওখানেই আশ্রয় নিতে হবে।

জলাশয়টার মাঝামাঝি এসে ফ্রান্সিস বাঁদিকে তাকাল। অনেক দুরের সমুদ্রের বিস্তার দেখে বুঝল এটা জলাশয় নয়। সমুদ্রের খাঁড়ি। এখানে নিশ্চয়ই জোয়ার ভাটা খেলে।

জল ঠেলে এগোতে সময় লাগছিল। ততক্ষণে চাঁদ নিভে গেছে। পূর্বদিকের আকাশে কমলা রং ধরেছে। ফ্রান্সিসরা ওপারে পৌঁছাল। তিনজনই বালির পারে বসে পড়ল। হাঁপাতে লাগল।

সূর্য উঠল। ফ্রান্সিস দেখল অনেক বাড়ি ঘরদোর। পশ্চিমদিকে তাকিয়ে দেখল, খাঁড়ি থেকে একটা উঁচু পাহাড় উঠে গেছে। পাহাড়টার নিচে বিস্তৃত বনভূমি।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–চলো। দেখি কোথায় এলাম।

শাঙ্কো সিনাত্রা উঠে দাঁড়াল। তিনজনে হেঁটে চলল বাড়িঘরগুলোর দিকে। দু’পাশের বাড়ির পুরুষ স্ত্রী লোক বাচ্চারা বেশ অবাক চোখে ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল। সবারই বোধহয় জিজ্ঞাসা এই বিদেশীরা কোত্থেকে এল? কার কাছেই বা যাচ্ছে। ফ্রান্সিসরা এসব দেখে অভ্যস্থ। ওরা হেঁটে চলল। বাড়িগুলোর পরেই একটা ঘাসে ঢাকা প্রান্তর। তারপরই একটা বড় বাড়ি। কাঠ পাথর বালি দিয়ে তৈরী বাড়ি। মাথায় শুকনো ঘাসের ছাউনি।

প্রান্তর পার হয়ে বাড়িটার কাছাকাছি আসতে কয়েকজন প্রহরী ছুটে এল। ওদের কোমর বন্ধনীতে তরোয়াল ঝুলছে। শুধু দু’জনের হাতে বর্শা। ওরা এসে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। কোমরে তরোয়াল ঝোলা একজন এসে ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল–তোমরা কে? কোথায়?

–এটা কি রাজা প্রাফেনের দেশ?

প্রহরী কোন কথা না বলে মাথা ওঠা নামা করল। তারপর বলল–তোমরা কোত্থেকে এসেছো? ফ্রান্সিস আঙুল তুলে পোড়া ঘাসবন দেখাল।

-ও–এলুডা দেশ থেকে। কোথায় যাবে? প্রহরী জিজ্ঞেস করল।

–এখানেই কোন সরাইখানায় থাকব। কয়েকদিন বিশ্রাম নেব। তারপর চলে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

তখনই ফ্রান্সিস দেখল–বড় ঘরটার পেছন থেকে একজন লোক আসছে। পেছনে আট দশ জন যোদ্ধা। লোকটির পরনে আটসাটো মোটা কাপড়ের পোশাক। কোমরে চামড়ার কোমরবন্ধনী। তাতে পেতলের বৃটওয়ালা তরোয়াল ঝুলছে। লোকটি প্রান্তরে এসে দাঁড়াল। লোকটিকে দেখে ফ্রান্সিসের কেমন মনে হল লোকটি এদেশীয় নয়। যুরোপীয়। ধাঁধা কাটাতে ফ্রান্সিস প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলে–ঐ লোকটি কে?

উনি মন্ত্রী স্তিফানো৷ প্রহরী বলল।

–রাজা প্রোফেনের মন্ত্রী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হ্যাঁ।

–আমি ভেবেছিলাম সেনাপতি। ফ্রান্সিস বলল।

–না। প্রহরী বলল।

স্তিফানো ততক্ষণে তরোয়াল কোষমুক্ত করেছে। যোদ্ধারাও তরোয়াল খুলে স্তিফানোকে ঘিরে দাঁড়াল। শুরু হল তরোয়ালের খেলা। স্তিফানো ঘুরে ঘুরে যোদ্ধাদের তরোয়ালের মার ঠেকাতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন যোদ্ধা অল্প আঘাত নিয়ে খেলা থেকে সরে দাঁড়াল। স্তিফানোর অভিজ্ঞ হাতে তরোয়াল চালানো দেখে মৃদুস্বরে ফ্রান্সিস বলল–পোড় খাওয়া লড়িয়ে। তারপর চাপাস্বরে বলল–শাঙ্কো –আমি নিশ্চিত মন্ত্রী স্তিফানো যুরোপীয় জলদস্যু।

-বলো কি? শাঙ্কো একটু অবাকই হল। তখন নকল লড়াই চলছে। আরো তিনজন যোদ্ধা লড়াই থেকে সরে দাঁড়াল। এবার ফ্রান্সিস প্রহরিটিকে জিজ্ঞেস করল উনি কি এদেশের লোক?

–না-স্পেন দেশের লোক।

–তাহলে রাজা প্রোফেনের মন্ত্রী বিদেশী। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। উনি নিয়মিত যোদ্ধাদের অস্ত্র শিক্ষা দেন। প্রহরীটি বলল।

–আর সেনাপতি? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–শুধু সেনাপতি নয় রাজা পোফেন ও মন্ত্রীমশাইয়ের নির্দেশে চলেন। এখানে মন্ত্রী স্তিফানোর কথাই শেষ কথা। তাঁর ওপরে কথা বলার কেউ নেই। প্রহরী বলল।

নকল লড়াই শেষ। মন্ত্রী স্তিফানো তরোয়াল কোষবদ্ধ করল। তারপর কোমরে গোঁজা একটা রুমাল বের করে মুখের কপালের ঘাম মুছতে লাগল। প্রহরী ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল

–মন্ত্রী মশাইয়ের কাছে চল।

-বেশ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর প্রহরীর পেছন পেছন স্তিফানোর কাছে এল। স্তিফানো ফ্রান্সিসদের দেখে সামান্য চমকাল। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল তোমরা তো দেখছি বিদেশী।

–হ্যাঁ। আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।

–ও। তোমরা তো জলদস্যুতা কর। স্তিফানো বলল।

–এসব অভিযোগ আমরা এর আগেও শুনেছি। আমরা এসব গায়ে মাখি না। তবু বলি–আমরা জলদস্যু নই। ফ্রান্সিস বলল।

তোমরা কোত্থেকে কেন এখানে এলে? স্তিফানো জিজ্ঞেস করল। ফ্রান্সিস এলুডায় কী ঘটেছে সব বলল।

–হুঁ। এলুডার সর্দার নিজেকে রাজা মনে করতো। দু’দুবার ওরা এদেশে আক্রমণ করেছিল। দু’বারই ওদের তাড়িয়ে দিয়েছি। যাক গে। স্তিফানো প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে, বলল–এদের রাজসভায় নিয়ে এসো। স্তিফানো চলে গেল।

-যাক–কয়েদঘরের হাত থেকে বাঁচলাম। শাঙ্কো শ্বাস ফেলে বলল।

–এখনই অতটা নিশ্চিত হয়ো না। স্তিফানো খুব ধুরন্ধর পুরুষ। ও বুঝেছে আমি ওকে সহজেই চিনে ফেলেছি। কাজেই আমাদের মুক্ত রাখবে সে ভরসা কম। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।

প্রহরী ওদের চলার ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা প্রহরীটির পেছন পেছন চলল।

সদর প্রবেশ পথ দিয়ে ওরা রাজবাড়িতে ঢুকল। একটা ছোট দরজা পার হয়ে ওরা রাজসভায় এল। প্রজাদের বেশ ভিড়। রাজা প্রোফেন প্রবীন পুরুষ। মুখে কাঁচা পাকা দাঁড়ি গোঁফ। একটু রোগাটে। মাথায় হীরে বসানো সোনার মুকুট। গায়ে মোটা চকচকে কাপড়ের ঢোলা হাতা জামা। রাজাপ্রজাদের দিকে তাকিয়ে দেশীয় ভাষায় কিছু বলছিলেন। সিংহাসনে কাঠের চকে কাপড়ের গদি পাতা। সিংহাসনের গায়ে রুপোর গিল্টি। দুপাশে দুটি আসন। মন্ত্রী স্তিফানো আর সেনাপতি বসে আছে।

রাজা প্রোফেনের বক্তৃতা শেষ হল। প্রজারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল। ভিড় কমল।

মন্ত্রী স্তিফানো রাজাকে কিছু বলল। রাজা ফ্রান্সিসদের দেখলেন। হাত নেড়ে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করলেন। ফ্রান্সিসরা এগিয়ে এল। রাজা স্পেনীয় ভাষায় কথা বলতে লাগলেন-তোমাদের কথা বলো। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে এলুডায় যা ঘটেছে সব বলল। পরে বলল–আপনার রাজত্বে আত্মরক্ষার জন্যে এসেছি। কোন সরাইখানায় আশ্রয় নেব। কয়েকদিন থেকে জাহাজে ফিরে যাব। মন্ত্রী স্তিফানো এবার গলা চড়িয়ে বলল– সব শুনলাম। কিন্তু এদেশের নিয়ম হচ্ছে বিদেশী দেখলেই তাকে বন্দী করা।

–আপনিও তো বিদেশী। ফ্রান্সিস বলল।

–আমিও প্রথমে বন্দী হয়েছিলাম। পরে নিজের যোগ্যতা প্রমান করে মন্ত্রী হয়েছি। স্তিফানো বেশ গর্বের সঙ্গে বলল।

–আমরাও আমাদের যোগ্যতা প্রমান করতে

–প্রয়োজন নেই। স্তিফানো ফ্রান্সিসকে থামিয়ে দিল। তারপর বলল–তোমাদের কয়েদঘরে ঢোকানো হবে। কথাটা বলে স্তিফানো রাজার মুখের দিকে তাকাল। রাজা আমতা আমতা করে বললেন এখানকার নিয়ম, কী করা যাবে। এখানে এটাই নিয়ম। বোঝা গেল স্তিফানোর ওপর কথা বলার ক্ষমতা রাজার নেই।

–কিন্তু আমাদের অপরাধ? ফ্রান্সিস বলল।

–অপরাধ নিয়ে কোন কথা নেই। বিদেশী হলেই হল। স্তিফানো হাত ঘুরিয়ে বলল–ফ্রান্সিস বুঝল-কয়েদঘরের বাস থেকে মুক্তি নেই। আবার পালাবার উপায় ভাবতে হবে। স্তিফানো প্রহরীদের ইঙ্গিত করল। একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের হাত ধরল। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। তারপর দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। তিনজন প্রহরী ফ্রান্সিসদের নিয়ে রাজবাড়ির বাইরে এল। ওদের নিয়ে চলল রাজবাড়ির পিছন দিকে।

রাজবাড়ির পূর্ব কোণায় কয়েদঘর। ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সবাই। একজন প্রহরী কোমরে ঝোলানো চাবির বড় রিং বের করল। কয়েদঘরের তালা খুলল। টং টং শব্দে লোহার দরজা খুলল। ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। কয়েদঘরে ঢুকে দেখা গেল মেঝেয় শুকনো ঘাসপাতা ছড়ানো। ফ্রান্সিস বস। তারপর শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো বসতে গিয়ে দেখল এক রোগাটে চেহারার বন্দী দেয়ালে ঠেসান দিয়ে চোখ বুজে বসে আছে। ততক্ষণে শাঙ্কোর চোখে ঘরের অন্ধকার সয়ে এল। এবার ভালো করে দেখল লোকটাকে। মুখে কঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ। পরনের পোশাক শতচ্ছিন্ন। শুকনো চোখমুখ।

শাঙ্কো লোকটার কাছে গেল। বলল–ভাই তুমি কতদিন বন্দী হয়ে আছো?

–হিসেব রাখি নি। লোকটি স্পেনীয় ভাষায় বলল। শাঙ্কো বেশ অবাক হল। বলল–তুমি স্পেনদেশী? লোকটি মাথা ওঠানামা করল।

–তোমাকে রাজা প্রোফেন বন্দী করেছেন কেন? শাঙ্কো বলল।

–রাজা নয়। স্তিফানো–স্তিফানো। আমার সাথী-সঙ্গী। লোকটি বলল।

–তোমার সঙ্গী হয়ে তোমাকে বন্দী করল? অবাক কান্ড। শাঙ্কো বলল।

–স্তিফানোর সব কান্ডই অবাক হওয়ার মত। লোকটি বলল।

–তোমার নাম কী? শাঙ্কো জানতে চাইল।

সার্ভো। লোকটি বলল।

মনে হচ্ছে স্তিফানোর ওপরে তোমার বেশ রাগ। শাঙ্কো বলল।

–সব শুনলে বুঝবে স্তিফানো কী সাংঘাতিক লোক। সার্ভো বলল।

-কী ব্যাপার বলো তো। বলছো স্তিফানো তোমার সঙ্গী সাথী আবার বলছো, সাংঘাতিক লোক। শাঙ্কো বলল।

যাক গে। সে সব শুনে কী হবে। তোমরা তো স্তিফানোকে শায়েস্তা করতে পারবে না। সার্ভো কাশতে লাগল। কাশি আর থামে না।

-তুমি তো বেশ অসুস্থ দেখছি। শাঙ্কো বলল।

বেঁচে আছি এটাই আমার ভাগ্য। তবে স্তিফানো যে কোনদিন আমাকে ফাঁসিতে লটকাতে পারে। আমার সঙ্গী হয়েও আমাকে মেরে ফেলতে ওর হাত কাঁপবে না। সার্ভো বলল।

কী ভাবে তোমরা সঙ্গী ছিলে? শাঙ্কো জানতে চাইল।

সার্ভো আবার কাশতে লাগল। কাশির শব্দে ফ্রান্সিস বিরক্ত হল। সার্ভোর দিকে তাকিয়ে বলল–এত কাশছো কেন? শরীর ভালো নেই? কাশি থামল। সার্ভো বলল দিনের পর দিন এই কয়েদঘরে পড়ে থাকলে শরীর সুস্থ থাকে? বোকার মত কথা বলছো। ফ্রান্সিস আর কথা বলল না। বুঝল রোগার্ত মানুষটা বেশিদিন বাঁচবে না।

–ঠিক আছে। সবকিছু খুলে বলল তো। শাঙ্কো বলল।

–সে অনেক কথা। তুমি শুনে কী করবে? সার্ভো বলল।

–কিছু করতে পারি কিনা ভেবে দেখবো। শাঙ্কো বলল।

–আমরা দুজনে ছিলাম এক জাঁদরেল জলদস্যুর দলে। তুমি তো জানো না একবার জলদস্যুদের দলে ঢুকলে পালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। দস্যু সর্দার তার সঙ্গীদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে। নিরীহ নিরস্ত্র জাহাজযাত্রীদের ধনসম্পদ লুঠ করে ভাগ পেতাম। আমাদের সুখে থাকারই কথা। কিন্তু ভয়ও ছিল। য়ুরোপের কোন কোন রাজা দক্ষ সেনাপতির অধীনে সশস্ত্র সৈন্যসহ জাহাজ সমুদ্রে পাঠাতো। জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের হারিয়ে নিজেদের দেশে নিয়ে যেতো। তারপর ফাঁসি দিতো। এই ভয় ছিল। তাই পালাবার তালে ছিলাম। স্তিফানো ছিল আমার দলের সঙ্গী। এই দেশের কাছ দিয়ে সেই রাতে আমাদের ক্যারাভেল জাহাজ যাচ্ছিল। একদিন গভীর রাতে জাহাজের গায়ে বাঁধা নৌকো খুলে নিয়ে পালালাম। এই দেশে এলাম।

সার্ভো আবার কাশতে লাগল। কাশি থামলে শাঙ্কো বলল

-তারপর?

–এই দেশে আশ্রয় নিয়ে কিছুদিন সুখেই কাটল। স্তিফানো আমাকে বারবার বোঝালো রাজা প্রোফেন কোনভাবেই যেন জানতে না পারেন যে আমরা জলদস্যু ছিলাম। আস্তে আস্তে স্তিফান যোদ্ধাদের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে লাগলো। স্তিফান তরোয়ালের লড়াই ভালোই জানতো। ওর নিপুণহাতে তরোয়াল চালানো দেখে এদেশের যোদ্ধারা অবাক। স্তিফান ওদের তরোয়াল চালানো শেখাতে শেখাতে যোদ্ধাদের নিজের দলে টানতে লাগল। যোদ্ধাদের ওপর সেনাপতির আর কোনও প্রভাবই রইল না। স্তিফান সর্বশক্তিমান হয়ে উঠল। এবার স্তিফান রাজাকে মৃত্যুভয় দেখাতে লাগল। রাজাও দেখলেন যোদ্ধারা স্তিফানের কথায় ওঠে বসে। স্তিফান যে কোন মুহূর্তে তাকে হত্যা করতে পারে। অসহায় রাজা স্তিফানের আধিপত্য মেনে নিলেন। সার্ভো থামল। একটু কাশতে লাগল।

–পরের ঘটনা বলল। শাঙ্কো বলল।

এবার স্তিফানোর নজর পড়ল আমার ওপর। স্তিফানের আসল পরিচয় একমাত্র আমিই জানি। আমার ওপর রাজাকে বিরূপ করে তুলল। বলল–এক, আমি বিদেশী। দুই আমি জলদস্যু ছিলাম। অনেক নিরীহ মানুষ হত্যা করেছি। স্তিফানের পরামর্শে রাজা আমাকে কয়েদঘরে বন্দী করলেন। সার্ভো থামল।

–আমার মনে হয় রাজা বাধ্য হয়ে তোমাকে বন্দী করেছেন। শাঙ্কো বলল।

–ঠিক তাই। তবে রাজা আমাকে দেশত্যাগ করার শাস্তি দিতে পারতেন। তাহলে এই। কয়েদঘরে আমাকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হত না। সার্ভো বলল।

–ঠিক আছে। ভাই সার্ভো–পরে কথা হবে। শাঙ্কো বলল।

তারপর ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল ফ্রান্সিস–তোমার অনুমানই ঠিক। স্তিফানো জলদস্যুদের দলে ছিল। সার্ভোকে দেখিয়ে বলল

–ও সার্ভো। ও নিজেও সেই জলদস্যুদের দলে ছিল। তারপর শাঙ্কো আস্তে আস্তে সার্ভোর কাছে যা শুনেছে সব বলল। সব শুনে ফ্রান্সিস বলল

–স্তিফানোকে দেখে ওর সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছি ও সাংঘাতিক মানুষ।

সার্ভোকে যে এতদিনে মেরে ফেলেনি এটা সার্ভোর সৌভাগ্য। তারপর ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল–দেখবে–স্তিফানো সার্ভোকে এখান থেকে সরাবে।

-কেন? শাঙ্কো বলল।

–কারণ স্তিফানো জানে ওর আসল পরিচয় জানে একমাত্র সার্ভো। এখন এই ঘরেই ও আছে। আমরাও আছি। ও নিশ্চয়ই কথাপ্রসঙ্গে স্তিফানোর আসল পরিচয় আমাদের কাছে বলবে। এটা স্তিফানো চাইবে না। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।

ফ্রান্সিসের অনুমান যে সঠিক সেটা কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেল। একজন প্রহরী লোহার দরজায় ঢং ঢং শব্দ করে বলল–সার্ভো–তুমি বেরিয়ে এসো।

-কেন? বেশ তো আছি। সার্ভো বলল।

–না। মন্ত্রীর আদেশ–তুমি অন্য জায়গায় থাকবে। প্রহরী বলল।

–না। আমি অন্য কোথাও যাবো না। সার্ভো মাথা নেড়ে বলল।

–মন্ত্রীমশাই ডেকেছেন। তোমাকে যেতেই হবে। প্রহরী চেঁচিয়ে বলল।

ফ্রান্সিস বলে উঠল–মন্ত্রীমশাইকে এখানে আসতে বলো।

–কী বলছো? মন্ত্রীমশাই এলে তোমাদের দুজনেরই প্রাণ যাবে। প্রহরী বলল।

–ঠিক আছে। তুমি গিয়ে বলো তো। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। তোমাদের মরতে হবে। প্রহরী বলল। তারপর চলে গেল।

শাঙ্কো বলল–এটা কি ভালো হল? স্তিফানো চটে গেলে আমাদের বিপদই বাড়বে।

–আমি নিশ্চিত স্তিফানো সার্ভোকে মেরে ফেলবে। ফ্রান্সিস বলল।

–ওদের ব্যাপার ওরা বুঝুক। সিনাত্রা বলল।

–তা হয় না। একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করবে–এটা নির্দ্বিধায় মেনে নেবো? ফ্রান্সিস বলল।

-তুমি সার্ভোকে বাঁচাতে পারবে? শাঙ্কো বলল।

–এখানে থাকলে ওর জীবন বিপন্ন হবে না। ফ্রান্সিস বলল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই স্তিফানো এসে হাজির। ঢং ঢং শব্দে দরজা খুলে গেল। স্তিফান কয়েদঘরে ঢুকল।

সার্ভো–স্তিফানো প্রায় গর্জন করে উঠল–তোমার এত সাহস আমার হুকুম অমান্য করো।

সার্ভো ভয়ে কুকঁড়ে গেল। ভীতস্বরে বলল–আমি তো যেতেই চেয়েছিলাম। ফ্রান্সিসসকে দেখিয়ে বলল–ও আমাকে যেতে দিল না। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে স্তিফানো বলল–তুমি সার্ভোকে যেতে দাও নি?

–হ্যাঁ। ও এখানেই থাকবে। ফ্রান্সিস শান্তভঙ্গীতে বলল।

সার্ভো আমার সম্পর্কে তোমাদের কিছু বলেছে? স্তিফানো জানতে চাইল।

—হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।

কী বলেছে? স্তিফানো বলল।

–বলেছে–ও আর আপনি একসঙ্গে এক জলদস্যুর দলে ছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।

–মিথ্যে কথা। স্তিফানো বলল।

–আমি সত্যি কথাটাই বললাম। ফ্রান্সিস বলল।

কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তিফোনো তরোয়াল কোষমুক্ত করল। দাঁত চাপাস্বরে বলল–এই পাহারাদারদের সামনে আমাকে অপমান করছো। জানো তোমাদের দু’জনকে এক্ষণি আমি হত্যা করতে পারি।

–নিশ্চয়ই পারেন। আমরা নিরস্ত্র। ফ্রান্সিস বলল।

–অস্ত্র থাকলে কী করতে। স্তিফানো বলল।

বাঁচবার চেষ্টা করতাম। ফ্রান্সিস বলল।

-বেশ। তোমাকে তরোয়াল দেওয়া হবে। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি। স্তিফানো দাঁতচাপাস্বরে বলল।

–মিছিমিছি লড়াই–ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে দিল না।

কাপুরুষ। স্তিফানো সেঁতো হাসি হেসে বলে উঠল।

–ঠিকআছে। আমি রাজি। ফ্রান্সিস বলল।

–কাল সকালে তোমাকে ডাকা হবে। স্তিফানো বলল।

–বেশ তবে লড়াইয়ের জায়গায় আমার বন্ধুরা আর সাভো থাকবে। ফ্রান্সিস বলল।

–হুঁ। পাহারায় থাকতে হবে। স্তিফানো কটমট করে একবার সার্ভোর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। তরোয়াল কোষবদ্ধ করল। তারপর চলে গেল। শাঙ্কো বলল

ফ্রান্সিস–এটা কী করলে? স্তিফান তোমাকে হত্যা করবে। তারপর সার্ভোকেও– শাঙ্কোর কথা শেষ হল না। ফ্রান্সিস বলল–

–জানি। জেনেশুনেই আমি রাজি হয়েছি। শোন–স্তিফানোকে তরোয়াল চালাতে দেখেছি। আক্রমন করার সময় ও বাঁদিকটা অরক্ষিত রাখে। ওখান দিয়েই আমি আক্রমন করবো। ফ্রান্সিস বলল।

রাতে খেতে বসে সার্ভো ফ্রান্সিসকেবলল

–ভাই–তুমি আমার জন্যে তোমার জীবন বিপন্ন করছো। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে। সার্ভোর পিঠ চাপড়াল।

জানো না স্তিফানো কত বড় যোদ্ধা! তরোয়ালের লড়াইয়ে ওকে কখনও হারতে দেখিনি। সার্ভো বলল।

–দেখা যাক। ফ্রান্সিস খেতে খেতে মাথা ওঠা নামা করল।

পরদিন সকালের খাবার দিতে এসে প্রহরী বলল–

–খেয়ে দেয়ে তৈরী হয়ে নাও। তোমাদের সবাইকে যেতে হবে।

প্রান্তরের একপাশে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। তার নীচে একটা কাঠের আসন পাতা হয়েছে। দ্বন্দ্বযুদ্ধের খবর রটে গেছে। দলে দলে লোক ভিড় করল। যোদ্ধারাও ভিড় করল এসে।

এক সময় রাজা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে স্তিফানো। রাজা এসে আসনে বসলেন। পাশে সেনাপতি।

কড়া পাহারায় ফ্রান্সিস ও শাঙ্কোরা এল। একজন যোদ্ধা ফ্রান্সিসকে একটা তরোয়াল দিল। তরোয়াল নিয়ে ফ্রান্সিস রাজার সামনে গোল ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়াল। এবার স্তিফানো এসে ফ্রান্সিসের সামনে দাঁড়াল। ঝনাৎশব্দে তারবারি কোষমুক্ত করল। বলল–

–আমাকে যে অপবাদ দিয়েছে। তার জন্যে সর্বসমক্ষে মাপ চাও।

–আমি মিথ্যে অপবাদ দিই না। যা বলেছি সত্যি বলেছি। ফ্রান্সিস বলল।

—তাহলে মরো। স্তিফানো বলল।

স্তিফানো তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দ্রুত মার ঠেকাল। দু’জনেই তরোয়াল চালাতে লাগল ঠং ঠং ধাতব শব্দ হতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই লড়াই জমে উঠল। স্তিফানো ভেবেছিল সহজেই ফ্রান্সিসকে কাবু করা যাবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের নিপুণ তরোয়াল চালানো দেখে বুঝল এ বড় কঠিন ঠাঁই। সহজে হারানো যাবে না। দু’জনেই তীক্ষ্ণ চোখে পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। তরোয়ালের মার কোনদিক থেকে আসছে আন্দাজ করে নিচ্ছে। দু’জনেই ঘন ঘন শ্বাস ফেলেছে। উপস্থিত রাজা প্রজারা, শাঙ্কোরা দুই যোদ্ধার দ্বন্দযুদ্ধ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে। ফ্রান্সিস খুব বেশি আক্রমন করছিল না। ও স্তিফানোকে বেশি নড়া চড়া করতে বাধ্য করল। এতে স্তিফানো বেশি পরিশ্রান্ত হল। ফ্রান্সিস সেই সুযোগটা নিল। এবার স্তিফানোর মার ঠেকিয়ে এক লাফে এগিয়ে বাঁ দিক দিয়ে স্তিফানোর তরোয়ল প্রানপনে এক ঘা মারল। স্তিফানোর হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। স্তিফানো বসে পড়ল। নিরস্ত্র স্তিফানে মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। চোখে মুখে মৃত্যু-ভীতি। ফ্রান্সিস স্তিফানোর বুকের ওপর দিয়ে তরোয়ালের ডগা টেনে নিল। স্তিফানোর জামা বুকের দিকে কেটে গেল। দেখা গেল বুকে তরোয়ালের ঘা-এর ক্ষত। গভীর ক্ষত চিহ্ন। স্তিফানো তাড়াতাড়ি জামা টেনে বুক ঢাকল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–এবার তো বলবেন আমি মিথ্যে অপবাদ দিইনি। স্তিফানো কোন কথা বলল না। মাথা নিচু করে হাঁপাতে লাগল। ওর আশঙ্কা ছিল হয়ত ফ্রান্সিস ওর বুকে তরোয়াল বসিয়ে দেবে। ফ্রান্সিস তা করল না দেখে ওর মৃত্যু ভয়ে কেটে গেল। ও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।

উপস্থিত লোকেদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। ওরা কল্পনাও করেনি এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে স্তিফানো হেরে যাবে। সার্ভো ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল।

রাজা আসন থেকে উঠে রাজবাড়ির দিকেচললেন। দর্শকদের ভিড় পাতলা হতে লাগল। স্তিফানোমাটি থেকে তরোয়াল তুলে কোষবদ্ধকরল। তারপর কোন কথা না বলে রাজবাড়ির, পেছন দিকে চলল। বোধহয় ওদিকেই মন্ত্রীর আবাস। ফ্রান্সিস শাঙ্কোদের কাছে এল।

চার পাঁচজন প্রহরী ছুটে এসে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। ওদের কয়েদঘরের দিকে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিসের শরীরও অক্ষত ছিল না। বাঁ বাহুতে তরোয়ালের খোঁচা লেগেছিল। রক্ত পড়ছিল। ক্ষতস্থান ডানহাতের চেটো দিয়ে চেপে ধরে হাঁটতে লাগল। একজন প্রহরী ফ্রান্সিসের হাত থেকেও তরোয়ালটা নিয়ে নিল।

কয়েদঘরের সামনে এল ওরা। প্রহরী ঢং ঢং শব্দে দরজা খুলল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। একজন প্রহরীকে ডাকল।

প্রহরী ওর কাছে এল। শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল

–ওর হাত কেটে গেছে। একজন বৈদ্যি ডাকো।

–মন্ত্রীমশায়ের হুকুম ছাড়া বৈদ্যি ডাকা যাবে না। প্রহরী বলল।

–ওর হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে। ওর কষ্ট হচ্ছে। অথচ মন্ত্রীর হুকুম ছাড়া বৈদি আনাবে না। শাঙ্কো বেশ গলা চড়িয়ে বলল।

নিয়ম নেই। প্রহরীরও এক কথা।

বেশ মন্ত্রীকে গিয়ে ওর অবস্থার কথা বল। দেখা যাক মন্ত্রী কী বলে। শাঙ্কো বলল। প্রহরী কিছুক্ষণ পরে গেল।

কিছুক্ষণ পরে একজন বৃদ্ধকে নিয়ে এল। বৃদ্ধের হাতে কাপড়ের ঝোলা। বোঝা গেল বৈদ্যি। বৈদ্যি কয়েদঘরে ঢুকল। শায়িত ফ্রান্সিসকে ইঙ্গিতে উঠে বসতে বলল। ফ্রান্সিস উঠে বসল। একটু ক্লান্ত স্বরে বলল–ওষুধের দরকার নেই। এমনিতেই সেরে যাবে।

—-দেখছি। বৈদ্যি বিড় বিড় করে বলল।

বৈদ্যি ফ্রান্সিসদের জামার হাত সরিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে কাটা জায়গাটা দেখলো। আস্তে আস্তে বলল–ঘা বিষিয়ে উঠতে পারে। শুনলাম তরোয়াল লড়াইয়ে তুমি মন্ত্রীমশাইকে হারিয়েছে। তুমি বাহাদুর–এটা বলতেই হবে।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। বৈদ্যি কাপড়ের ঝোলা থেকে কয়েকটা কাঠের বোয়াম বের করল। বোয়ামগুলো থেকে আঙ্গুলের ডগায় কালো হলুদ সবুজ রঙের গলা কিছু বের করল। তারপর সব মিশিয়ে হাতের তালুতে ঘষে বড়ি বানাল। একটা হাতে পিষে ক্ষতস্থানে লাগাল। উঃ ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। বোধহয় জ্বালা করে উঠেছে। একটু পরেই বোধহয় জ্বালা কমল। বৈদ্যি বড়ি গুলো হাতে নিয়ে শাঙ্কোর দিকে বাড়িয়ে ধরল। বলল–প্রতিদিন একটা বড়ি খাওয়াবে। ভয় নেই। সেরে যাবে।

বৈদ্যি কাঠের বোয়ামগুলো ঝোলায় ভরল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর উঠে। দাঁড়াল। দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীদের দেখে নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল–মন্ত্রীমশাই লোক ভালো না। সাবধান। ফ্রান্সিসের ক্ষতস্থান দেখল। যাক্‌–রক্ত। পড়া বন্ধ হয়েছে। বৈদ্যিবুড়ো চলে গেল।

একটু বেলায় দু’জন প্রহরী খাবার নিয়ে এল। গোল একটা পোড়া রুটি। আর সামুদ্রিক মাছের ঝোল। খেতে খেতে শাঙ্কো বলল–এখন কেমন বোধ করছো?

–ভালো। জ্বালা যন্ত্রনা অনেকটা কমেছে ফ্রান্সিস বলল।

–স্তিফানো আমার ওপর এত সদয় হল–বৈদ্যি পাঠাল। সিনাত্রা বলল।

–স্তিফানো ধুরন্ধর পুরুষ। সময় সুয়োগ বুঝে ঠিক আমাদের ক্ষতি করতে চাইবে। ওকে বিশ্বাস নেই। দীর্ঘদিন নিরস্ত্র নিরীহ জাহাজ যাত্রীদের হত্যা করেছে। দয়া মায়া বলে ওর মনে কিছু নেই। ফ্রান্সিস বলল।

— আমারও তাই মনে হয়। তার ওপরে রাজার সামনে প্রজাদের সামনে যোদ্ধাদের সামনে ওভাবে তোমার কাছে হেরে গেল। শোধ তুলতে ও তক্কে তক্কে থাকবেই। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। শাঙ্কো বলল।

–ঠিক বলেছো। আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। সার্ভো ফ্রান্সিসদের কথা শুনছিল। এবার বলল–স্তিফানো অনেক বড়কিছুর জন্যে এখানে ঘাঁটি গেড়েছে।

-বড় কিছু মানে? ফ্রান্সিস সার্ভোর দিকে তাকাল।

–তাহলে তো তোমাদের এখানকার এক অতীত ইতিহাস বলতে হয়। সার্ভো বলল।

বেশ বলো।

–খেয়ে নিয়ে বলছি। সাভো বলল।

দুপুরেখাওয়ার পাটকল। এবারফ্রান্সিস বলল–এখানকারঅতীতইতিহাসকী বলছিলে।

–এখানে এসেই জেনেছি সেই ইতিহাস। একটু থেমে সার্ভো বলতে লাগলপ্রায় শ’দড়েক বছর আগে এখনকার রাজা প্রোফেনের এক পূর্বপুরুষ রাজা ছিলেন মুস্তাকিন। প্রচুর ধনসম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। সোনা হীরেমনি মুক্তোর ভান্ডার ছিল তার। কীভাবে তিনি সেসব সংগ্রহ করেছিলেন তা কেউ জানে না। এই নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলে। তিনি সেসব কোথায় গোপনে রাখতেন তা তার রানিও জানতেন না। সার্ভো থামল।

–তাহলে রাজা মুত্তাকিনের ধনসম্পদেরহদিশ কেউ জানেনা? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হ্যাঁ। রাজা প্রোফেনও কিছু জানে না?

–রাজা প্রোফেন সেই ধনভান্ডার উদ্ধার করার চেষ্টাও করেন নি?

–শুনেছি রাজা হয়ে পোফেন অনেক চেষ্টা করেছিলেন ঐ ধনভান্ডার উদ্ধার করতে কিন্তু পারেন নি। সার্ভো বলল।

–স্তিফানো? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

–সেটাই তো আমার বলার। ঐ ধনভান্ডার খুঁজে বেড়িয়েছে। তখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল। আমাকেও বার কয়েক সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল।

-কোথায়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–ঐ লুভিনা পাহাড়ে। পাহাড়ের নিচে জঙ্গলে। সার্ভো বলল।

রাজবাড়িতে খোঁজে নি? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হ্যাঁ-হ্যাঁ। রাজবাড়িতেও খুঁজেছে। কিন্তু কোন হদিশ পায়নি। তখনই আমাকে ও বলেছিল–ঐ ধনভান্ডার খুঁজে বের করে সব নিয়ে এই রাজত্ব থেকে পালিয়ে যাবো। ওর লোভের শেষ নেই। সার্ভো বলল।

–তাই স্তিফানো এখানে ঘাঁটি গেড়েছে। ওরলক্ষ্য ঐ ধনভান্ডার চুরি। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক বলেছো। সার্ভো বলল।

–কিন্তু আমি তা হতে দেব না। ঐ ধনভান্ডার আমিই উদ্ধার করবো। ফ্রান্সিস বলল।

–বল কি! পারবে? সার্ভো অবাক হয়ে বলল–কেউ পারছে না তুমি পারবে? এবার শাঙ্কো বলল–ওর নাম ফ্রান্সিস এর আগে অনেক গুপ্ত ধনভান্ডার ও আবিষ্কার করেছে চিন্তা বুদ্ধি আর পরিশ্রমের সাহায্যে। কাজেই নিশিন্ত থাকো ফ্রান্সিস ঠিক ঐ ধনভান্ডারের হদিশ বের করতে পারবে।

তাহলে তো খুবই ভালো হয়। কিন্তু গুপ্ত ধনভান্ডার আবিষ্কৃত হলে স্তিফানো। আসল চেহারা ধরবে। তোমাদের খুন করতেও পেছপা হবে না। নরহত্যা করেও ও নিবিঘ্নে ঘুমোয়। ও কী নির্মম কী নিষ্ঠুর তা কল্পনাও করতে পারবে না। সাভো বলল।

— সে সব সময়মত ভাববো। এখন রাজা প্রোফেনের সঙ্গে দেখা করা দরকার। ফ্রান্সিস বলল। সিনাত্রা সব শুনছিল। এবার একটু ভীত স্বরে বলল–রাজাকে চটিও না যেন।

–না-না। ফ্রান্সিস মাথা নাড়িয়ে হেসে বলল–আমি শুধু জানতে চাইবো এই গুপ্ত ধনভান্ডার সম্পকে উনি কী জানেন। দেখি রাজা কী বলেন? দেখি রাজার কথা থেকে কোন সূত্র পাই কিনা। তারপর শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল–প্রহরীকে বলো তো আমরা রাজার সঙ্গে দেখা করব।

–বলছি। শাঙ্কো দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে ইশারায় ডাকল। প্রহরী কাছে। এলে বলল–রাজা প্রোফেনকে গিয়ে বললো যে আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

মন্ত্রীমশাই-এরহুকুমনাহলে রাজারসঙ্গে দেখাকরা যাবেনা। প্রহরী ঘাড় নেড়ে বলল।

মজা মন্দ না–শাঙ্কো হেসে বলল–সব ব্যাপারেই মন্ত্রীমশাইয়ের অনুমতি নিতে হবে। প্রহরী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কোন কথা বলল না।

–যাও। শাঙ্কো তাড়া লাগল।

–মন্ত্রী মশাইকে বলছি। এই বলে প্রহরীটি চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে স্তিফানো এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–কী ব্যাপার? রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাইছো কেন? ফ্রান্সিস দরজার দিকে যেতে যেতে বলল–যা বলার রাজাকেই বলবো।

–উঁহু–তার আগে আমাকে বলো।

-বেশ। শুনলাম রাজা প্রোফেনের এক পূর্বপুরুষ রাজা মুস্তাকিম তার প্রচুর ধনসম্পদ গোপনে এই রাজ্যের কোথাও রেখে গেছেন। ফ্রান্সিস বলল।

-তুমি কী ভাবে শুনলে? স্তিফানো জানতে চাইল।

–সার্ভো বলেছে। ফ্রান্সিস বলল। স্তিফানো গলা চড়িয়ে বলল সার্ভেমি এসব বলেছো?

–এটা গোপনে রাখার ব্যাপার নয়। প্রজাদের জিজ্ঞেস করুন। বোধহয় তারাও জানে। তবে কেউ জানে না সেই ধনসম্পদ গোপনে কোথায় রাখা আছে। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। এসব জেনে তোমার লাভ? স্তিফানো বলল।

–আমি সেই ধনসম্পদ উদ্ধার করবো। ফ্রান্সিস বলল।

স্তিফানো হো হো করে হেসে উঠল। বলল–রাজা প্রেফেনের পূর্বপুরুষরা কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন রাজা প্রাফেনও কম চেষ্টা করেননি–কেউ সেই ধনভান্ডারের হদিশ পেল না আর তুমি কোত্থেকে এলে সেসব উদ্ধার করতে। এসব পাগলামি ছাড়ো।

–ঠিক আছে। ধরে নিন না এটা আমার পাগলামি। রাজার সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। কাল সকালে রাজসভায় এসো। তবে এটাও জেনো রাজার পূর্বপুরুষ রাজা এবং আমিও তোমার চাইতে কম বুদ্ধিমান নই। স্তিফানা বলল।

–তাহলে কাল সকালে আমরা রাজসভায় যাবো? শাঙ্কো বলল।

–এসো। দেখ কথা বলে। তবে গুপ্ত ধনভান্ডার খুঁজতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেবে। যেমন অনেকেই অনেকদিন আগেইহাল ছেড়ে দিয়েছে। স্তিফানো বলল

–দেখা যাক। শাঙ্কো বলল।

স্তিফানো হাসতে হাসতে চলে গেল।

পরদিন ফ্রান্সিসরা সবে সকালের খাবার খাওয়া শেষ করেছে একজন প্রহরী কয়েদঘরের দরজার কাছে এল। বলল–চলোতোমাদের রাজসভায় নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছে। কিন্তু সার্ভো নামে যে আছে সে যেতে পারবে না। শাঙ্কো সার্ভোকে বলল–তুমি ভাই থাকো। আমরাই যাচ্ছি।

ফ্রান্সিসদের কয়েদঘর থেকে বের করা হল। তিনজন প্রহরী খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল।

ফ্রান্সিসরা যখন রাজসভায় পৌঁছল তখন বিচারের কাজ চলছিল। ফ্রান্সিসদের অপেক্ষা করতে হল।

বিচার শেষ। বিচার প্রার্থী চলে গেল। ফ্রান্সিস একটা জিনিস লক্ষ্য করল বিচারের। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ও রাজা স্তিফানোর সঙ্গে পরামর্শ করে নিচ্ছেন। বোঝাই গেল। স্তিফানো রাজাকে বেশ ভালো ভাবে কজা করেছে।

এবার রাজা ফ্রান্সিসদের দিকে তাকালেন। কাছে যেতে ইঙ্গিত করলেন।

ফ্রান্সিস এগিয়ে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–মহামান্য রাজা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি।

-কী প্রয়োজন?

ফ্রান্সিস রাজা মুস্তাকিমের গুপ্ত ধনের কথা বলে বলল–আপনার কাছে জানতে এসেছি এ ব্যাপারে আপনি কী জানেন?

–কেন বলো তো? রাজা বললেন।

–আমরা সেই গুপ্তধন খুঁজে বের করব। ফ্রান্সিস বললেন।

–অসম্ভব। পারবেনা। রাজা বললেন।

–আমি ওদের সেকথা বলেছি। স্তিফানো হেসে বলল।

-ঠিক আছে। মান্যবর রাজা–তবু আপনাকে অনুরোধ করি–এ ব্যাপারে আপনি যা জানেন বা শুনেছেন বলুন। ফ্রান্সিস বলল।

–সত্যি বলতে কি আমাদের পূর্বপুরুষ রাজা মুস্তাকিম বেশ খেয়ালি ধরনের মানুষ ছিলেন। সময় নেই অসময় নেই মাঝে মাঝেই ঐ লুভিনা পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তখন তিনি তাঁর দেহরক্ষীদেরও সঙ্গে নিতেন না। রাজা বললেন।

–আচ্ছা–এইরাজবাড়িতেও খোঁজা হয়েছে? ফ্রান্সিস জানতেচাইল। রাজাস্তিফানোর দিকে তাকালেন। স্তিফানো বলল–ন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। কোন হদিশ মেলেনি।

-ঠিক আছে। এবার আমার একটা অনুরোধ। ফ্রান্সিস বলল।

–বলো। রাজা বললেন।

–পাশের রাজ্য এলুডায় নিরপরাধকেও পুড়িয়ে মারা হয়। এই পাশবিক শাস্তি বন্ধ হোক এটাই আমি চাই। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে এলুডা জয় করতে হয়। রাজা বললেন।

–আমি তাই করতে আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি। ওখানকার সর্দারকে আমরা হত্যা করেছি। কিন্তু আবার কেউ না কেউ সররাদ্র হয়েছে আর ঐ অমানবিক শাস্তির নিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা ঐ ব্যবস্থা বন্ধ করতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু তোমরা তো মাত্র তিনজন। রাজা বললেন।

-না। আমাদের জাহাজে আরোও পঁচিশ তিরিশ জন বন্ধু রয়েছে। সবাই মিলে আমরা এলুডা আক্রমন করবো। আমাদের জয় হবেই। ফ্রান্সিস বলল।

রাজা পোফেন স্তিফানোর দিকে তাকালেন। স্তিফানো কিন্তু ফ্রান্সিসের অনুরোধে রাজি হল। ফ্রান্সিস একটু অবাকই হল যখন স্তিফানো বলল–এ তো ভাল কথা। এলুডা জয় করতে পারলেই আমরা ঐ শাস্তির ব্যবস্থা বন্ধ করতে পারবো।

–আর একটা অনুরোধ। ফ্রান্সিস বলল।

–বলো। রাজা বললেন।

আমাদের বন্ধুদের এখানে নিয়ে আসতে হবে। তাদের তো এনে কয়েদঘরে তোলা যায় না। আপনি একটা বড় ঘরের ব্যবস্থা করুন। কথা দিচ্ছি-আমরা পালাবো না। ফ্রান্সিস আরো বলল–তাছাড়া গুপ্ত ধনসম্পদ খুঁজতে গেলে আমাদের তিনচারজনকে স্বাধীনভাবে চলা ফেরার সুযোগ তো দিতে হবে। রাজা স্তি ফানোর দিকে তাকালেন।

এ ব্যাপারে আমার একটা নিয়ম তোমাদের মানতে হবে। স্তিফানো বলল–

–বলুন–কী নিয়ম? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–এক–তোমরা জঙ্গল পাহাড় থেকে পালাতে পারবে না। দুই–গুপ্তধন উদ্ধার, করে সেসব নিয়ে পালাতে পারবে না। স্তিফানো বলল।

–বেশ–আপনার নিয়মে আমরা রাজি। তবে এই সঙ্গে বলে রাখি গুপ্ত ধনভান্ডার উদ্ধার করতে পারলে একটা রুপোর মুদ্রাও আমরা নেবনা। রাজাকেইসব দেব। কারণ গুপ্তধনের উপর একমাত্র তারই অধিকার আছে। ফ্রান্সিস বলল।

স্তিফানো হেসে বলল–এমন ভাবে বলছ যেন এরমধ্যেই গুপ্তধন আবিষ্কার করে ফেলেছো।

–এখনই সে কথা বলার সময় যে আসেনি–সেটা আমি জানি। গুপ্তধন আবিষ্কার করার পর আমরা কি করব সেটাই বলে রাখলাম। এবার আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিন। ফ্রান্সিস বলল।

স্তিফানো সেনাপতিরদিকেতাকিয়ে বলল–যান–সৈন্যাবাসের একটা ঘর ওদের ছেড়ে দিন। সেনাপতি আসন থেকে উঠে ফ্রান্সিসদের তার সঙ্গে আসার জন্যে ইঙ্গিত করল।

ফ্রান্সিসরা ফিরে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখনই স্তিফানো বলে উঠল–কিন্তু সার্ভো কয়েদঘরে থাকবে। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। বলল–মান্যবর রাজা-সার্ভোকেও আমাদের সঙ্গে থাকতে দিন। সার্ভো এখানকার সব জায়গা ভালোভাবে চেনে জানে। ওকে নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে আমাদের সুবিধে হবে। রাজা একবার স্তিফানোর দিকে নিয়ে তাকিয়ে বলল–সার্ভোর দায়িত্ব তুমি নিচ্ছো?

–হ্যাঁ। সার্ভো পালালে আমাকে যা শাস্তি দেবার দেবেন। ফ্রান্সিস বলল। স্তিফানো আর কোন আপত্তি করলো না। বোধহয়, ভাবল সার্ভো পালালে ফ্রান্সিসকে চিরদিনের জন্যে কয়েদঘরে আটকে রাখা যাবে। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।

ফ্রান্সিসরা সেনাপতির সঙ্গে সঙ্গে রাজবাড়ির বাইরে চলে এল। সেনাপতি সৈন্যবাসের দিকে চলল। সৈন্যবাসের কাছে এসে কয়েকটা ঘর পার হয়ে একটা বড় লম্বাটে ঘরের সামনে এল। দরজা ভেজানো ছিল। সেনাপতি দরজা খুলল। খালি ঘর। বলল–এই ঘরে তোমরা থাকবে। কিন্তু পালাবেনা। পালাবার চেষ্টা করলে বাঁচবেনা।

জানি। আর একটা অনুরোধ–আমাদের একজন বন্ধু আপনার সঙ্গে যাবে। কয়েদঘরে সার্ভে নামে একজন বন্দী হয়ে আছে। তাকে মুক্ত করে এই ঘরে পাঠিয়ে দিন। ফ্রান্সিস বলল।

-বেশ। আমার সঙ্গে কে আসবে এসো। সেনাপতি বলল।

–চলুন। শাঙ্কো এগিয়ে এল।

দু’জনে কয়েদঘরের দিকে চলল। কয়েদঘরের সামনে এসে সেনাপতি প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বলল–একজন বন্দী আছে। ওকে ছেড়ে দাও। প্রহরীদের মধ্যে একজন লোহার দরজা ঢং ঢংশব্দ খুলে ডাকল–ওহে–বাইরে এসো। তোমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

সার্ভো দু’লাফে কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এল। শাঙ্কো বলল–আমার সঙ্গে চলো। সেনাপতি চলে গেল। সার্ভো দাঁড়িয়ে রইল। ও তখনও ওর মুক্তির ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। শাঙ্কো হেসে বলল–আবার কয়েদঘরে ঢোকার ইচ্ছে নাকি?

না না– সার্ভো বলল–ভাই তোমরা আমার মুক্তির ব্যবস্থা করে দিলে। আমি তোমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।

ঠিক আছে। এখন চলল। শাঙ্কো বলল।

সার্ভোকে নিয়ে শাঙ্কো ওদের ঘরে নিয়ে এল। সার্ভো প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল–ভাই তোমার জন্যেই আমি মুক্তি পেলাম। ফ্রান্সিস বলল

–এখনও তুমি সম্পূর্ন মুক্ত নও। তবে আমি তোমাকে সম্পূর্ন মুক্ত করবো। কিন্তু একটা কথা। তোমার পক্ষে এখন পালানো খুব সহজ। কিন্তু আমার অনুরোধ পালাবার চেষ্টা কর না। যদি তুমি পালিয়ে যাও আমাদের সারা জীবন ঐ কয়েদঘরে পচতে হবে। আশা করি তুমি সেটা করবে না।

না-না। ফ্রান্সিস–ভাই তুমি আমাকে যা বলবে আমি তাই করবো। সার্ভো বলল।

–কথাটা মনে থাকে যেন। ফ্রান্সিস বলল।

ঘরের মেঝেতে শুকনো ঘাস পাতারই বিছানা। তবে সেসব দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। তার ওপর পরিষ্কার মোটা কাপড়ের বিছানা পেতে দিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস শুয়ে– পড়তে পড়তে বলল–একটু আরাম করা যাক। কয়েদঘরে যেভাবে দিনরাত কেটেছে। শাঙ্কোও আধশোয়া হল। সিনাত্রা আর সার্ভো বসে রইল।

তখন দুপুর। সৈন্যবাসের রাঁধুনি ওদের খেয়ে নিতে ডাকল। সৈন্যবাসের লাগোয়া। খাবার ঘরে ফ্রান্সিসরা খেতে গেল। মেঝেয় টানা খাবারের জায়গা করা হয়েছে। সৈন্যদের সঙ্গে ফ্রান্সিসরাও.খেতে বসল। খেতে দেওয়া হল তেলে ভাজা রুটি আর পাখির মাংস। ফ্রান্সিস হেসে বলল–আমরা তাহলে জাতে উঠেছি। ঐরকম মাংস খেয়ে বুদ্ধি আর শক্তি দুটোকেই কাজে লাগানো যায়।

-যা বলেছো। শাঙ্কোও হেসে বলল। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বলল

–এখন চিন্তা হল বন্ধুদের কী করে এখানে আনা যায়। ফ্রান্সিস বলল।

–এটা তো সমস্যাই। এলুডা রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যাবেনা। ওরা আমাদের কাউকে পেলে পুড়িয়ে মারবে। ওদেরনজর এড়িয়েও যাওয়া আসা করা যাবেনা। শাঙ্কো বলল।

একমাত্র উপায় খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে সমুদ্রে পৌঁছানো কিন্তু তার জন্যে নৌকা তো চাই। নৌকা পাবো কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।

সার্ভো খেতে খেতে ওদের কথা শুনছিল। এবার বলল–তোমাদের নৌকা চাই?

–হ্যাঁ। তুমি জানো এখানে কোথায় নৌকা পাবো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–লুভিনা পাহাড়ের এপারে জেলেদের নৌকার ঘাট আছে। সেখানে নৌকা পাবে। এপারেই জেলেদের নৌকা রাখার ঘাট।

–তুমি শাঙ্কোকে নিয়ে যেতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল।

–কেন পারবো না। আমি এই রাজ্যের সব জায়গা ভালভাবেই চিনি। সার্ভো বলল।

–তাহলে খাওয়া সেরে শাঙ্কোকে ওখানে নিয়ে যাও।

বেশ তো। সাভো বলল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল—

–শাঙ্কো-খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে নৌকা চালিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়বে। ওখান থেকে সমুদ্রের ধারে ধারে গিয়ে জাহাজ ঘাটায় আমাদের জাহাজে যেতে পারবে।

খুব সহজেই যাওয়া যাবে। এলুডা রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হবেনা। শাঙ্কো বলল।

–তিনটে নৌকা নিয়ে যেও। আমাদের দুটো নৌকা রয়েছে। মারিয়া আর ভেন বাদে সবাইকে এক ভাবে নিয়ে আসতে পারবে। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক আছে। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। বলল–সার্ভো চলো। সার্ভোও উঠে দাঁড়াল।

খাওয়া শেষ। শাঙ্কোদের ফ্রান্সিস বলল–চেষ্টা করবে সন্ধ্যের আগেই চলে আসতে। আমি বেশি দেরি করতে রাজি নই।

শাঙ্কো আর সার্ভো সৈন্যবাস থেকে সামনের প্রান্তরে নামল। সার্ভো আগে আগে চলল। পেছনে শাঙ্কো।

বসতি এলাকায় এল। এপথ সেপথ দিয়ে ওরা খাঁড়ির কাছে এল। সার্ভো আগে আগে চলল। পেছনে শাঙ্কো।

দূর থেকে শাঙ্কো বেশ কয়েটা দেশি নৌকা তীরে বাঁধা। ওরা ঘাটে এল। দেখল কিছু জেলেদের বাড়ি ঘর। কয়েকজন জেলে ঘরের বাইরে বসেছিল। সার্ভো ওদের একজনকে দেশীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করল–

–তোমাদের কর্তা কোথায়? একজন আঙুল তুলে একটা ঘর দেখাল। সার্ভো আর শাঙ্কো সেই ঘরে ঢুকল। দেখল একজন কালো মানুষ মেঝের ঘাসপাতার বিছানার ওপর বসে আছে। সার্ভো বলল–কর্তা– তিনটে নৌকা চাই।

–নৌকা নিয়ে কী করবেন? কর্তা জানতে চাইল।

–এলুডার জাহাজ ঘাটায় একটা জাহাজ আছে। সেই জাহাজে যাবো।

—ভোরে মাছ ধরতে যাবো আমরা। তার আগেই নৌকা নিয়ে ফিরে আসা চাই। জেলে কর্তা বলল।

–আমরা সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসবো। শার্ভো বলল।

–বেশ। কিন্তু ভাড়া লাগবে। জেলে কর্তা বলল।

সার্ভো শাঙ্কোর দিকে তাকাল। ভাড়ার কথা বলল। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা সোনার চাকতি বের করে কর্তাকেদিল। সোনা দেখে কর্তা খুব খুশি। বলল নৌকা চালানোর লোক লাগবে? সার্ভো শাঙ্কোকে সেই কথা বলল। শাঙ্কো বলল– বলো যে আমি একাই নৌকা বেঁধে নিয়ে যাবো। সার্ভো কর্তাকে বলল–সে কথা। কর্তা আপত্তি করল না। শুধু বলল–আজ রাতে জোয়ার আসবে? তার আগেই চলে আসে যেন। জোয়ারের সময় নৌকা চালানো কঠিন। সার্ভো শাঙ্কোকে সে কথা বলল। শাঙ্কো বলল- বলো যে আমরা ভাইকিং। নৌকা চালানোয় দক্ষ। সার্ভো কর্তা সে কথা বলল। কর্তা আর কিছু বলল না। শাঙ্কো সার্ভোকে বলল–কর্তাকে বল একগাছি দড়ি দিতে। সার্ভো তা বলল। কর্তা ঘরের কোনা থেকে দড়ি বের করে আনল।

সবাই ঘরের বাইরে এল। কর্তা ঘাটের দিকে চলল। পেছনে শাঙ্কোরা। কর্তা তিনটে নৌকা দেখাল। তার মধ্যে একটা নতুন নৌকা। শাঙ্কো সেই নৌকাটায় উঠল। পেছনে আরো দু’টো নৌকা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিল। তারপর নৌকাগুলোর ঘাটে বাঁধা দড়ি খুলে দাঁড় হাতে নিল। সার্ভো দুটো নৌকা পেছনে বেঁধে নিল শাঙ্কো দাঁড় বাইতে লাগল। ও দ্রুত দাঁড় বাইতে লাগল। নৌকাগুলো দ্রুতই চলল। ফেরার তাড়া রয়েছে। কাজেই শাঙ্কো দ্রুত দাঁড় বইতে লাগল।

খাঁড়ির জলে ঢেউ কম। খাঁড়ি পার হতেই সমুদ্রের বড় বড় ঢেউয়ের মুখোমুখি হল। নৌকার ওঠাপড়া শুরু হল। সমুদ্রতীরের কাছ দিয়ে দিয়ে শাঙ্কো নৌকা বেয়ে চলল।

ওদের জাহাজের কাছাকাছিযখন পৌঁছাল তখন বিকেল হয়ে গেছে। মারিয়া তখন সূর্যাস্ত দেখার জন্যে জাহাজের রেলিং ধরেদাঁড়িয়েছিল। মারিয়া প্রথম শাঙ্কোকে দেখল। মারিয়া গলা চড়িয়ে বলে উঠল–দেখ-শাঙ্কো আসছে। ডেক-এর ওপর শুয়ে বসে থাকা কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু শুনল কথাটা। রেলিংয়ের কাছে ভিড় করল সবাই। বিস্কো ছুটে গিয়ে দড়ি মই ঝুলিয়ে দিল। শাঙ্কো নৌকাগুলো জাহাজের গায়ে ভেড়াল। বিস্কো চেঁচিয়ে বলল–

–শাঙ্কো–ফ্রান্সিসরা ভালো আছে তো?

সবাই ভালো আছে। চিন্তার কোন কারণ নেই। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল। এতক্ষণে মারিয়া হাসল–যা–ফ্রান্সিসের কোন বিপদ হয় নি।

শাঙ্কো দড়ির মই বেয়ে ডেক-এ উঠে এল। সবাই ওকে ঘিরে ধরল। শাঙ্কো তখন হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সব ঘটনা বলল। তারপর বলল–তোমরা এখনই তৈরি হয়ে নাও। এক্ষুণি ফিরে যাবো। সন্ধ্যের আগেই রাজা প্রোফেনের দেশে পৌঁছতে হবে। ফ্রান্সিস আর দেরি করতে চাইছে না। আবার লড়াইয়ের ময়দানে নামব এই ভেবেই ওরা। খুশি। এভাবে জাহাজে অলস জীবন ওদের ভালো লাগে না। হাজার হোক-বীরের জাত। লড়াইটা ওরা ভালোবাসে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই পোশাক পাল্টে কোমরে তরোয়াল গুঁজে ভাইকিং দল বেঁধে ডেক এ উঠে এল। তারপর একে একে দড়ির মই বেয়ে নৌকোগুলোয় উঠতে লাগল। নিজেদের নৌকাতেও অনেকে বসল। শুরু হল দাঁড় বাওয়া। একেবারে সামনে রইল শাঙ্কোর নৌকো। তার পেছনে পেছনে অন্য নৌকাগুলো চলল।

তখন সূর্যঅস্ত যায় যায়। পশ্চিম আকাশ জুড়ে লালচে আভাছড়িয়েছে। মারিয়া জাহাজের রেলিং ধরে একবার সূর্যাস্ত দেখছেআর একবারশাঙ্কোদেরচলন্ত নৌকাগুলো দেখছে।

সমুদ্রের তীরের কাছ দিয়ে এসে নৌকাগুলো খাঁড়িতে এল। বাঁক ঘুরে চলল রাজা প্রোফেনের দেশের দিকে।

জেলেদের নৌকার ঘাটে যখন নৌকাগুলো পৌঁছালো তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। তবে চারদিকে মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল জ্যোৎস্না পড়েছে জেলে পাড়ায় খাঁ ড়িতে ওপারের লুভিনা পাহাড়ে।

কর্তার ঘর থেকে সার্ভো বেরিয়ে এল। এতক্ষণ সার্ভো শাঙ্কোর ফিরে আসার জন্যে ঐ ঘরেই অপেক্ষা করছিল। ওর চিন্তা ছিল এই কাজটা শাঙ্কো একা পারবে কিনা। দেখল শাঙ্কো পেরেছে। এর থেকেই প্রমাণ হয় ভাইকিংরা বীরের জাত। সমুদ্রের নাড়ি নক্ষত্র ওরা চেনে।

ভাইকিংরা দল বেঁধে নৌকা থেকে নেমে এল। সবাই চলল সৈন্যবাসের দিকে। সবচেয়ে আগে শঙ্কো। তারপরে বন্ধুরা। বসতির পাশ দিয়ে যাচ্ছে তখন লোজন। ওদের দেখছে। এত বিদেশি দল বেঁধে কোথায় চলেছে?

তারপরই সবুজ ঘাসের প্রান্তর। প্রান্তর পার হয়ে ভাইকিংরা ফ্রান্সিসদের ঘরের সামনে এল। বিস্কো গলা চড়িয়ে বলল–ফ্রান্সিস আমরা এসেছি।

সবাই ঘরে ঢুকল। বেশ বড় ঘর। সবাই এঁটে গেল। ভাইকিংরা বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল।

ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল-ভাইসব–শাঙ্কোর কাছে নিশ্চয়ই সব শুনেছো। আমরা কালকেই এক সর্দারের দেশ এলুডা আক্রমন করবো। রাজা প্রোফেনের সৈন্যরাও আমাদের সঙ্গে থাকবে। আক্রমন করবো শেষ রাতে। এবার সার্ভো বলবে আমরা কোথা দিয়ে অক্রমণ করবো। সার্ভো বলল–লুভিনা পাহাড় তোমরা আসার সময় দেখেছো। ঐ পাহাড়ের নিচেই গভীর জঙ্গল। খাঁড়ি পার হবো আমরা ওপারে যাবো। ওখানে তখন ভাঁটা চলবে। জল বড় জোর কোমর পর্যন্ত থাকবে। খাঁড়ি পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকব। জঙ্গল এলুডার বসতি এলাকার খুব কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বসতি এলাকায় ঢুকে পড়তে পারব। তারপর লড়াই কীভাবে করবে সেটা তোমরাই ঠিক করো। ফ্রান্সিস বলল–এবার একটু অন্যরকম ভাবে লড়াই করবো। এলুডাবাসী যোদ্ধারা বর্শা দিয়ে লড়াই করে। আমরাও প্রথমে বর্শা দিয়ে লড়াই করবো। তারপর তরোয়ালের লড়াই চালাবো।

তার জন্যে আমাদের তো বর্শা চাই। শাঙ্কো বলল।

–হ্যাঁ। আমি কাল সকালে রাজসভায় যাচ্ছি। আমরা আমাদের জন্যে বর্শা চাইবো। কীভাবে আমরা লড়াই করতে চাই সেটা সেনাপতিকে বুঝিয়ে বলবো। কেউ কিছু বলবে? কেউ কোন কথা বলল না। বোঝা গেল লড়াইয়ের জন্যে ফ্রান্সিসের পরিকল্পাই মেনে নিল সবাই।

পরদিন ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে রাজদরবারে গেল। তখন রাজদরবারের কাজকর্ম চলছিল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি একপাশে অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে কাজকর্ম শেষ হল। উপস্থিত প্রজারা বেরিয়ে গেল। রাজা প্রোফেন ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসকে ডাকল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। একটু মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–মান্যবর রাজা–আমরা কাল গভীর রাতে খাঁড়ি পার হয়ে এলুডা আক্রমন করবো স্থির করেছি। আমার বন্ধুরা এসে গেছে। এবার আপনার সেনাপতিকে দয়া করে নির্দেশ দিন তিনি যেন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমাদের সঙ্গে যান।

রাজা প্রোফেন যথারীতি স্তিফানোর দিকে তাকালেন। স্তিফানো বলল–ঠিক আছে সেনাপতি প্রান্তরে সৈন্য সামাবেশ করবেন। তখন তোমরা যাবে। সেনাপতি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তোমাদের পেছনে পেছনে যাবে।

-বেশ। তবে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।

–কী সমস্যা? রাজা জানতে চাইলেন।

–আমাদের তো বর্শা নেই। আমাদের সবাইকে বর্শা দিতে হবে।

–কেন? স্তিফানো একটু বিরক্তির ভঙ্গীতে বলল। ফ্রান্সিস সেই বিরক্তি গায়ে মাখল না। বলল–এলুডার যোদ্ধারা বর্শা দিয়ে লড়াই করবে। ওদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে বর্শাও চাই।

–তোমরা কীভাবে লড়াই করতে চাও? সেনাপতি জিজ্ঞেস করল।

–আমরা প্রথমে বর্শা দিয়ে লড়াই করে ওদের আহত করবো। আমরা হত্যাটা যথাসাধ্য এড়িয়ে চলি। তারপর তরোয়াল দিয়ে লড়াই করবো। ফ্রান্সিস বলল। সেনাপতির সঙ্গে কথা বলে।

নিজেদের ঘরে ফিরল ফ্রান্সিস আর হ্যারি। বন্ধুরা সব জানতে চাইল। ফ্রান্সিস রাজা ও স্তিফানের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সেসব বলল। আর বলল সন্ধ্যের সময় আমরা বর্শাগুলো পেয়ে যাবো।

দুপুরে সৈন্যবাসের খাবার ঘরে ফ্রান্সিসরা যখন খাচ্ছে তখনই সেনাপতি এল। ফ্রান্সিসের কাছে এসে বলল–

কী? তোমরা তৈরি তো?

–হ্যাঁ-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা কাত করে বলল।

–কখন রওনা হবে তোমরা? সেনাপতি জানতে চাইল।

–একটু বেশি রাতে। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমরা আগে প্রান্তরে জমায়েত হবে। তোমরা এলে আমাদের সৈন্যরা আসবে। সেনাপতি বলল।

–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস বলল।

–ঐ, বন্দী ছিল–সার্ভো–ও-ও কি যাবে? সেনাপতি জানতে চাইল।

–হ্যাঁ–ওকে দরকার পড়বে। আমার কিছু বলার থাকলে সার্ভো এদেশীয় ভাষায় আপনার সৈন্যদের বোঝাতে পারবে। ফ্রান্সিস বলল।

–সব নির্দেশ আমিই দেব। সেনাপতি গলায় একটু জোর দিয়েই বলল।

–সে অধিকার আপনার নিশ্চয়ই আছে। তবে সময় বিশেষে আমার নির্দেশও আপনার সৈন্যদের মানতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–না। শুধু আমার নির্দেশই সবাইকে মানতে হবে। সেনাপতি বলল।

তখন হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস উনি সেনাপতি। কী ভাবে আমরা লড়াই করবো সেটা তো উনিই বলবেন।

–বেশ। ও কথাই রইল। তবে কখনো আমি কোন নির্দেশ দিলে আপনার অনুমতি নিয়েই সেই নির্দেশ দেব। এতে আপনি রাজি তো? ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। এতে আমার আপত্তি নেই! সেনাপতি বলল। তারপর চলে গেল।

সন্ধ্যের কিছু আগে। ফ্রান্সিস নিজেদের ঘরে শুয়ে বসে আছে এমন সময় কয়েকজন যোদ্ধা বর্শা নিয়ে এল। বর্শা রেখে ওরা চলে গেল। ফ্রান্সিসদের পাঁচটা বর্শা কম পড়ল। ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে যা পেয়েছি তাই নিয়ে লড়বো।

রাতের খাবার বেশ তাড়াতাড়িই খাওয়া হল।

ফ্রান্সিসরা সবাই শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–কেউ ঘুমুবে না। বিশ্রাম নাও।

রাত বেড়ে চলল। এক সময় ফ্রান্সিস উঠে বসল। গলা চড়িয়ে বলল–সবাই উঠে পড়। বাইরের প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়াও। রাজার সৈন্যরা ওখানেই আসবে।

সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সার্ভো বলল

–ফ্রান্সিস–আমি আর যাবো না।

–না। তুমিও চলো। তোমাকে লড়াই করতে হবে না। আমাদের সঙ্গে থাকবে শুধু। ফ্রান্সিস বলল।

সবাই তৈরি হয়ে প্রান্তরে এসে দাঁড়াল। আজকে চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। চারিদিকভালোই দেখা যাচ্ছে।

কিছু পরে রাজা প্রোফেনের সৈন্যরা দল বেঁধে এল। সেনাপতি এল। উঁচু গলায় বলল–সবাই জেলেপাড়ার দিকে চলো। ওখান দিয়েই আমরা খাঁড়ি পার হবো।

ফ্রান্সিসরা আগে পেছনে চলুল রাজার সৈন্যরা। তাদের সঙ্গে সেনাপতি।

এত লোকেরা যাচ্ছে। শব্দ হল। জেলেপাড়ার লোকেদের কারো কারো ঘুম ভেঙে গেল। জানালা দিয়ে সৈন্যদের যেতে দেখে বুঝল ওরা লড়াই করতে যাচ্ছে। ফ্রান্সিসদের দেখে ভাবল তাহলে এই বিদেশীরাও সৈন্যদের সঙ্গে চলেছে লড়াই করতে।

জেলেপাড়ায় ঘাট দিয়ে সবাই জলে নামল। অগভীর খাঁড়ি। জল হাঁটুর ওপর উঠল না। কিন্তু জল ঠেলে যাওয়ার শব্দ হতে লাগল। ফ্রান্সিস জল ঠেলে সেনাপতির কাছে এল। বলল

–জলে যাতে বেশি শব্দ না হয় সেটা আপনার সৈন্যদের বলুন। সেনাপতি একটু গলা চড়িয়ে দেশীয় ভাষায় বলল সে কথা। এবার জলে কম শব্দ হতে লাগল।

খাঁড়ি পার হল সবাই। জনা পাঁচেক বাদে ফ্রান্সিসদের সবার হাতে বর্শা। সেনাপতি ও সৈন্যদের কোমরে তরোয়াল। খাঁড়ি থেকে উঠে সামনেই বনভূমি। খুব ঘন বন নয়। ছাড়া ছাড়া গাছ গাছালি। সবাই বনের মধ্যে দিয়ে চলল। ভাঙা ভাঙা জ্যোৎস্না পড়েছে। বনের এখানে ওখানে। গাছের গুঁড়ি এড়িয়ে সবাই চলল।

কিছু পরে বন শেষ। হাত পঞ্চাশেক দুরে এলুডার বসতি এলাকা শুরু হয়েছে। বন থেকে বেরিয়ে ফ্রান্সিস আক্রমনের জন্যে তৈরি। হঠাৎ পেছনে সেনাপতি উঁচু গলায় দেশীয় ভাষায় কী বলে উঠল। ফ্রান্সিস বুঝল না সেটা। ভাবল সার্ভোকে জিজ্ঞেস করবে সেনাপতি কী আদেশ দিল। পেছন ফিরে দেখল সার্ভোরা তখনও জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেনি। ওদিকে নিস্তদ্ধ রাতে সেনাপতির নির্দেশের শব্দ বেশ জোরালো হল। কাছেই বসতি এলাকার লোকদের কানে পৌঁছাল সেই কথা। সঙ্গে সঙ্গে এসব ঘর থেকে কোন যোদ্ধার তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল-কু-উ-উ-উ। সঙ্গে সঙ্গে আশে পাশে ঘর গুলো থেকে বর্শা হাতে যোদ্ধারা বেরিয়ে আসতে লাগল। এরা যোদ্ধার জাত। সবসময় লড়াই-এর জন্যে তৈরী থাকে। কু-উ-উ ধ্বনি চলল।

ফ্রান্সিস বুঝল এখন লড়াই ছাড়া উপায় নেই। ও পেছনে ফিরে তাকাল। সেনাপতি বা তার সৈন্যদের চিহ্নমাত্র নেই। ও ভাবল হয় তো আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু এক্ষণি তো লড়াই শুরু করতে হবে। তখনই সার্ভো ছুটে ফ্রান্সিসসের কাছে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–সেনাপতি তার সৈন্যদের পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

-বলো কি। ফ্রান্সিস ভীষনভাবে চমকে উঠল। কিন্তু এখন আর পিছু ফেরা যাবে না। এলুডার যোদ্ধারা অনেক কাছে চলে এসেছে। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল– আক্রমন কর। ভাইকিংরা ছুটে গেল এলুডার যোদ্ধাদের দিকে। মুহূর্তে লড়াই শুরু হল।

প্রথম সংঘর্ষেই দুতিনজন ভাইকিং যোদ্ধা অল্পবিস্তর আহত হল বর্শার ঘায়ে। অন্যেরা আগুপিছু বর্শা চালাতে লাগল। এলুডার যোদ্ধারা বর্শা ছুঁড়তে লাগল। একটা বর্শা উড়ে এসে সার্ভোর বুকে বিঁধে গেল। ফ্রান্সিস দেখল সেটা। ও ছুটে গিয়ে বর্শাটা সার্ভোর বুক থেকে টেনে বের করল। রক্ত পড়তে লাগল। সার্ভো ম্লান হাসল। তারপর আস্তে আস্তে চোখ বুজল। সার্ভো মারা গেল। তখনই একটা বর্শা উড়ে এসে ফ্রান্সিসের মাথার ওপর দিয়ে সামনে মাটিতে গেঁথে গেল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। তারপর বর্শা ছুঁড়ে মারল এলুডার যোদ্ধার দিকে। একজন যোদ্ধার কাঁধে গেঁথে গেল সেই বর্শা।

ততক্ষণে এলুডার অনেক যোদ্ধার হাতে বর্শা ছুঁড়ে মারার আর কোন অস্ত্র নেই। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল

–তরোয়াল-আক্রমন। বর্শা ফেলে ভাইকিংরা তরোয়াল বের করে ছুটল নিরস্ত্র যোদ্ধাদের দিকে। নিরস্ত্র যোদ্ধারা তখন অসহায়। প্রাণভয়ে ওরা পালাতে করল। যাদের হাতে বর্শা ছিল তাদেরও পরাস্ত করল ভাইকিংরা।

কিছুক্ষণের মধ্যে মাঠের মধ্যে পড়ে রইল আহত এলুডার যোদ্ধারা। ফ্রান্সিসের নির্দেশে আহত ভাইকিং কজন বনের আড়ালে চলে গেল।

ফ্রান্সিস এবার নিরস্ত্র যোদ্ধাদের তাড়া করল। বাকিযেযাদ্ধারা পালাতে লাগল। ফ্রান্সিস বসতি এলাকায় ঢুকে পড়ল।

বাড়ি ঘরে আড়াল পড়ে যাওয়ায় বিস্কো একা পড়ে গেল। এপথ ওপথ ঘুরে ও সেই উঠোনের মত জায়গাটায় এল। এক কোণে দুটো মশাল জ্বলছে। মশালের আলোয় দেখল উঠোনের মাঝখানে একটা বড় কাঠের খুঁটি। খুঁটির সঙ্গে পা বাঁধা তিনজনের দু’জন পুরুষ আর একটি মেয়ে। বিস্কো ঠিক করল ওদের মুক্তি দেবে। বিস্কো আস্তে আস্তে ওদের কাছে গেল। বিস্কোকে খোলা তরোয়াল হাতে ওদের দিকে আসতে দেখে মেয়েটি ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল। বিস্কো হেসে হাতের তেলো দেখিয়ে মেয়েটিকে আশস্ত করল। তারপর নিচু হয়ে তরোয়াল দিয়ে পোঁচ দিয়ে দিয়ে ওদের পায়ে বাঁধা শুকনো লতার বাঁধন কেটে দিল। বাঁধন কাটতেই পুরুষ দু’জন ছুটে পালিয়ে গেল। মেয়েটিও পালাত। কিন্তু পালাল না যখন দেখল একটা ঘরের আড়াল থেকে একজন সি এলুডার যোদ্ধা একটা বর্শা ছুঁড়ে মারছে আর বিস্কো সাবধান হবার আগেই বর্শা বিস্কোর বাঁ কাঁধে কেটে দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। বিস্কো উঃ শব্দ করে বাঁ কাধ চেপে ধরল। রক্ত বেরিয়ে এল। বিস্কো উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে যোদ্ধাটি পালিয়ে গেছে। মেয়েটির শুকনো মুখ। মাথার চুল অবিন্যস্ত। ওর আর পালানো হল না। ও বিস্কোর ডান হাত ধরল। ইঙ্গিত করল ওর সঙ্গে হাঁটার জন্যে। বিস্কো মাথা নাড়ল। মেয়েটি করুণ চোখে বিস্কোর দিকে তাকিয়ে দেশীয় ভাষায় কিছু বলল। বিস্কো কিছু বুঝল না। মেয়েটি বার বার ওর কাটা জায়গাটা দেখতে লাগল। বিস্কো বুঝল যে ও যে আহত সেটাই মেয়েটা বোঝাতে চাইছে। দেখা যাক মেয়েটি ওকে কোথায় নিয়ে যায়। বিস্কো ওর পাশে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি একসঙ্গে হাঁটার জন্যে ইঙ্গিত করল। তারপর হাঁটতে লাগল।

তখন লড়াই শেষ। এলুডার যোদ্ধারা হেরে গেছে। বিস্কো তার কিছুই জানে না। ও মেয়েটির পেছনে পেছনে হেঁটে চলল। বসতি এলাকায় এসে একটা ঘরের সামনে মেয়েটি এসে দাঁড়াল। পাথর বালি মাটির ঘর। ছাউনি শুকনো ঘাসপাতার। ঘরের এড়ো খেবড়ো কাঠের দরজা। মেয়েটি দরজা খুলে ফেলল। ঘরে একজন বয়স্ক লোক মেঝের বিছানায় শুয়ে ছিল। মেয়েটিকে দেখে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে এসে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বিস্কো তো জানেনা কী ভয়ানক শাস্তি থেকে ও মেয়েটিকে বাঁচিয়েছে।

মেয়েটি ঐ অবস্থায়ই বিস্কোকে দেখিয়ে বার বার কী বলল। বয়স্ক লোকটি বিস্কোকেও জড়িয়ে ধরল। তখন লোকটি কাঁদছে। এবার কান্না থামিয়ে বিস্কোকে ঘাসের বিছানায় বসতে ইঙ্গিত করল। বিস্কো বিছানায় করল। রক্ত পড়ায় বিস্কো নিজেকে বেশ দুর্বল মনে করছিল। ও একটু বসে থেকে শুয়ে পড়ল। লোকটি পাশের ছোট ঘরটায় ঢুকল। একটা হলুদ রঙের গলা ডেলা নিয়ে এল। বিস্কোর কাঁধের জায়গায়টায় ঐ ডেলাটা চেপে ধরল। ক্ষতস্থানটা যেন জ্বলে উঠল। বিস্কোর মুখ থেকে কাতরোক্তি বেরিয়ে এল– আহ। মেয়েটি একটু হেসে হাতের তেলো দেখিয়ে ওকে অপেক্ষা করতে ইঙ্গিত করল। এবার মেয়েটির সঙ্গে লোকটির কিছু কথাবার্তা চলল। বিস্কো কিছুই বুঝল না। তবে এটা বুঝল লোকটি মেয়েটির বাবা। বোধহয় মা নেই।

আস্তে আস্তে কাটা জায়গার জ্বালা কমল। রক্ত পড়া বন্ধ হল। মেয়েটি তখন একটা মোটা কাপড়ের ন্যাকড়া নিয়ে এল। কাটা জায়গাটা বেঁধে দিল। বিস্কো অনেকটা আরাম বোধ করল।

মেয়েটি বয়স্ক লোকটিকে কী বলল, লোকটি বেরিয়ে গেল। মেয়েটি হাত নেড়ে বিস্কোকে অপেক্ষা করতে বলে পাশের ঘরে ঢুকে গেল। বিস্কো শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল ও তো দলছাড়া হয়ে গেল। চারপাশের শান্ত অবস্থা দেখে বুঝল লড়াই শেষ। আর এলুডা যোদ্ধাদের কু উ উ ডাক শোনা যাচ্ছে না। ওরা নিশ্চয়ই হেরে গেছে। ফ্রান্সিসরা ওর খোঁজ না পেয়ে নিশ্চয়ই চিন্তায় পড়েছে। বিস্কো ভাবল–এখানেই থাকি। সুস্থ হয়ে রাজা প্রোফেনের দেশে গিয়ে ফ্রান্সিসদের সঙ্গে যোগ দেব।

অল্প পরে মেয়েটি পাশের ঘর থেকে এ ঘরে এল। হাতে দুটো কাঠের বাটি। একটা বাটি বিস্কোর দিকে এগিয়ে ধরল। বিস্কো বাটিটা নিল। দেখল বাটিতে আনাজপত্রের ঝোলমত। মেয়েটি নিজেও একটা বাটি নিয়ে চুমুক দিয়ে খেতে লাগল। বিস্কোও খেতে লাগল। বেশ সুস্বাদু। খেতে খেতে বিস্কো বলল–তোমার নাম কি? প্রোমা। মেয়েটি হেসে বলল।

তখন সকাল হয়ে গেছে। বাইরে লোকজনদের কথাবর্তা শোনা যাচ্ছে। প্রোমা বাটি নিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল।

ওদিকে ফ্রান্সিসরা খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। বিস্কোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি বিস্কো লড়াইএ মরে গেল? তিনচারজন ছুটল বিস্কোকেখুঁজতে। ওরা নিরাশ হয়ে ফিরে এল।

ভোরের আলো ফুটল। ফ্রান্সিস সর্দারের বাড়ির সামনে এল। মোটামুটি কাঠের ভালো দরজা জানালা।

–সিনাত্রা–দরজায় ধাক্কা দাও তো। ফ্রান্সিস বলল। সিনাত্রা এগিয়ে গিয়ে দরজায় জোরে ধাক্কা দিল। বার কয়েক ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। সেই মোটামত লোটা এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসকে দেখেই চিনল। বলল–তোমরা-হত্যা-সর্দার। ফ্রান্সিসও লোকটাকে আগে দেখেছিল।

তাই তো তুমি সর্দার হতে পারলে। যাগে–তোমরা হেরে গেছ। এই এলুডা দেশ এখন আমাদের দখলে। তবে আমরা এখানে থাকবো না। তোমাদের দেশ এখন তোমরাই রাজত্ব করবে। কিন্তু এই দেশ জয় করার পিছনে আমাদের একটা উদ্দেশ্য আছে। ফ্রান্সিস বলল।

–কী? নতুন সর্দার বলল।

–এখানে অপরাধী যে কোন রকম অপরাধ করুন না কেন তাকে জ্যান্ত পোড়াননা চলবে না। এই প্রথা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। এই শর্তে তোমাকে সর্দার রেখে এ দেশ ছেড়ে আমরা চলে যাব। কী–রাজি? ফ্রান্সিস বলল।

–এবার তোমাদের একটা উঠোনমত আছে যেখানে খুঁটির সঙ্গে তোমাদের বিবেচনায় যে বা যারা অপরাধী তাদের বেঁধে রাখো। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। রেজাম। সর্দার বলল।

তার মানে ঐ উঠোনের নাম। সর্দার মাথা ওঠা নামা করল।

–কিছুক্ষণের মধ্যে ঐ রেজামে দেশবাসীদের যোদ্ধাদের একত্র কর। তাদের উদ্দেশে আমার কিছু বলার আছে। ফ্রান্সিস বলল।

-বেশ। খবর-হবে। সর্দার বলল।

–তাহলে আমরা রেজামে যাচ্ছি। তুমি এর মধ্যে খবর দাও। সবাইকে একথাও বলল যে আমরা কারোও কোন ক্ষতি করবো না। ফ্রান্সিস বলল।

-বেশ। তবে–পুড়িয়ে মারা–বিরোধী–আমি–সর্দার তাড়িয়ে আমাকে–মাপ–ফিরেছিলাম। সদার বলল।

–হুঁ। ঠিক আছে। তুমি সবাইকে ডাকো। আমি তোমাদের কিছু বলতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।

সর্দার চলে গেল।

দুপুরের আগে থেকেই রেজামে লোক জড়ো হতে লাগল। অনেক যোদ্ধাও এল। রেজাম ভরে গেল লোকে।

ফ্রান্সিস সেই জমায়েতের সামনে এসে দাঁড়াল। সর্দারকে ওর কাছে ডাকল। বলল আমার সব কথা তো সবাই বুঝবেনা। তুমি আমার কথা ওদের ভাষায় বুঝিয়ে দাও। সর্দার ফ্রান্সিসের পাশে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–এলুডার-ভাই বোনেরা–আমরা এদেশ জয় করেছি। কিন্তু আমরা এখানে থাকব না। তোমাদের দেশ তোমাদের সর্দারই শাসন করবে। স্বাধীন ভাবে। মাত্র একটা উদ্দেশ্যেই আমরা এই দেশ জয় করেছি। এখানে অপরাধীকে পুড়িয়ে মারার প্রথা প্রচলিত আছে। আমাদেরও বন্দী করে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল। এখানে এই অমানবিক ভয়াবহ প্রথা বন্ধ করতে হবে। তোমাদের সর্দারকে সেই নির্দেশ দিয়েছি। আমাদের কাজ শেষ। আমরা আমাদের এক মৃত বন্ধুকে কবর দিয়ে রাজা প্রোফেনের দেশে ফিরে যাব। রাজা প্রোফেনকে অনুরোধ করব তিনি যেন তোমাদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখেন। তোমরাও রাজা প্রোফেনের দেশের সঙ্গে সদ্ভাব রাখবে–এইঅনুরোধ। আমার আর কিছু বলার নেই। ফ্রান্সিস থামল। সর্দার দেশীয় ভাষায় ফ্রান্সিসের বক্তৃতা গলা চড়িয়ে বলল। উপস্থিত জনতা বেশ সমর্থন জানাল। সভা ভেঙে গেল। সবাই চলে যেতে লাগল।

তখনই শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে ছুটে এল। বলল–ফ্রান্সিস আমাদের এক আহত বন্ধু মারা গেল। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করল। সখেদে বলে উঠল–ওদের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারলাম না। যাক গে–চল–ওদের কবরের ব্যবস্থাটা আগে করি।

কিন্তু ফ্রান্সিস–আমরা সবাই খুব ক্ষুর্ধাত। সিনাত্রা বলল।

–না। ওদের কবর না দিয়ে আমরা কেউ খাবো না। ফ্রান্সিস বলল।

—পরে খাবারের ব্যবস্থা করি। শাঙ্কো বলল।

–বেশ সর্দারকে বলো আমাদের এখানেই খাবারের বন্দোবস্ত করুক। ফ্রান্সিস বলল।

–কোথায় কবর দেবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।

–ঐ এলুডা পাহাড়ের নীচের বনভূমিতে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বলল–মাটিতে গর্ত খোঁড়ার জন্য বেলচা জাতীয় কিছু জোগাড় কর। শাঙ্কো চলে গেল। সঙ্গে দু’তিনজন … বন্ধুও গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যে শাঙ্কোরা বেলচা জাতীয় জিনিস নিয়ে ফিরে এল। সবাই দল বেঁধে বনভূমির দিকে চলল। বনভূমির কাছে পৌঁছে ওরা দেখল মৃতদেহ দুটিকে ঘিরে কয়েকজন বন্ধু বসে আছে। ফ্রান্সিসরা যেতেই ওরা উঠে দাঁড়াল।

ফ্রান্সিস মৃত সার্ভো আর বন্ধুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ওর দু’চোখ জলে ভরে উঠল। হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল–বনের ভিতর মৃতদেহ নিয়ে চলো। কয়েক জন বন্ধু মৃতদেহ দুটি কাঁধে নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। বনের মধ্যে ঢুকে ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চলল। কিছুদুর যেতেই দেখল একটা বড় গাছে অজস্র ফুল ফুটে আছে। জংলা গাছ। কিন্তু বেগুনি রঙের ফুলগুলি দেখতে বড় সুন্দর। ফ্রান্সিস ডাক–শাঙ্কো। শাঙ্কো এগিয়ে এল।

–এই গাছের নীচেই কবর দেওয়া হবে। গর্ত কর। ফ্রান্সিস বলল। বন্ধুরা সেই জায়গা ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। সিনাত্রা মৃদুস্বরে দেশের গান গাইতে লাগল। শোকের গান, দুঃখের গান।

খুব বেশি সময় লাগল না। দুটো কবর খোঁড়া দেওয়া হল। মৃতদেহ দুটি আস্তে আস্তে কররে নামিয়ে দেওয়া হল। বন্দুরা সেই গাছে আর ধারে কাছের গাছগুলোয় উঠে দু’হাত ভরে ফুল নিয়ে এল। মৃতদেহের ওপর ছড়িয়ে দিল। ফ্রান্সিস গর্তে নামল। দুটো তরোয়াল নিয়ে মৃতদেহের বুকের ওপর রেখে দিল। বন্ধুরা হাত বাড়িয়ে ফ্রান্সিসকে ওপরে তুলে নিল। ভাইকিং বন্ধুরা মারা গেলে ভেনই শেষকৃত্য করে। কিন্তু ভেন জাহাজে। কাজেই শেষকৃত্য কিছু হল না। ফ্রান্সিস এক মুঠো মাটি মৃতদেহের ওপর ছড়িয়ে দিল। এবার সবাই মাটি ঢেলে কবর ভরাট করতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটিতে কবর ভরাট হয়ে গেল। ফ্রান্সিস ফিরে দাঁড়িয়ে বলল– চলো। বসতি এলাকার দিকে ফ্রান্সিস হাঁটতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরাও চলল। তখন সেই জংলা গাছ থেকে টুপটুপ ফুল ঝরে পড়ছে কবরের ওপর।

ওরা রেজামে যখন এল তখন বিকেল হয়ে এসেছে। সেই খুঁটির কাছে সর্দার দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্রান্সিসকে দেখে বলল–রান্না হয়ে এসেছে। একটু পরেই খাওয়া।

ভাইকিংরা রেজাম চত্বরে বসে পড়ল। সবাই ক্ষুধাত। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার সামনে লম্বাটে পাতা পেতে দেওয়া হল। পরিবেশন করা হল একটু পোড়া রুটি আর আনাজের ঝোল। তারপর মাংস। ক্ষুধাত ভাইকিংরা চেটে পুটে খেতে লাগল। খাওয়া শেষ হল।

সন্ধ্যে হয়ে এল। ফ্রান্সিস চত্বরে বসেছিল। এবার উঠে দাঁড়াল। বলল–হ্যারি–সবাই কে বলো। আর এখানেনয়। আমরা এখন ফিরে যাব। এখনোবিস্কোর খোঁজ পেলাম না। ও নিশ্চয়ই একাই ফিরে গেছে। এখানে আর দেরি করবো না। হ্যারি উঠে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–উঠে পড়ো। আমরা এখন ফিরে যাবো। এখানে আর নয়।

সব ভাইকিংরা উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বনভূমির দিকে হাঁটতে শুরু করল। পেছনে ভাইকিং বন্ধুরাও চলল। বন পার হয়ে খাঁড়ির কাছে এল। বোধহয় জোয়ার শুরু হয়েছে। জল একটু বেড়েছে। জলে নামল সবাই। জলের মধ্যে পা টেনে টেনে পার হল সবাই।

বসতি এলাকা পার হয়ে প্রান্তর আর রাজবাড়ির কাছে যখন এলো তখন হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস–রাজার সঙ্গে এখন দেখা করবে না?

-না। আগে দেখিবিস্কো ফিরল কিনা। ফ্রান্সিস বলল।

প্রান্তর পার হয়ে ফ্রান্সিস দ্রুত এসে ওদের ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়াল। ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। বিস্কো ফিরে আসে নি। ফ্রান্সিস চিন্তা হল। ও বিছানায় বসল। হ্যারি ওর কাছে এল। বলল–তাহলে বিস্কো ফিরে আসেনি।

তাইতো দেখছি। ওর কি হল কিছুই বুঝতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে হয়তো জাহাজে ফিরে গেছে। হ্যারি বলল।

–কিন্তু এভাবে না বলে কয়ে? ফ্রান্সিস একটু অবাক হয়েই বলল।

-বলার মত কাউকে কাছে পায়নি হয়তো। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। ও নিশ্চয়ই আসবে। হ্যারি বলল।

তখনই সেনাপতি এসে হাজির। দু’হাতে দুটো মশাল। মশাল দুটো ঘরের দেওয়ালের খাঁজে বসিয়ে দিল। হেসে বলল–

–অন্ধকারে বসে আছে। তাই মশাল নিয়ে এলাম।

—আপনি আনলেন কেন? শাঙ্কো বলল।

-না-না। তাতে কি। তা শুনলাম তোমরা লড়াইয়ে জিতেছো। সেনাপতি বলল।

–হ্যাঁ। আপনাদের কোন রকম সাহায্য ছাড়াই। হ্যারি বলল।

—আপনি তোআপনার সৈন্যদের পালিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।

-না। আমি আপনাদের পেছনে পেছনে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। সেনাপতি বলল।

–না। পালিয়ে আসতে বলেছিলেন। ফ্রান্সিস গলায় জোর দিয়ে বলল।

–আমি তো এদেশীয় ভাষায় নির্দেশ দিয়েছিলাম। তুমি বুঝলে কী করে? সেনাপতি বলল।

সেনাপতি এবার দরজার দিকে দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল–আসলে সৈন্যরা সব মন্ত্রীর নির্দেশ মানে। আমার নির্দেশ মানে না। হয়ত মন্ত্রীমশাই সেরকম কোন নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন।

–যাক এসব কথা। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। হ্যারি বলল।

সেনাপতিআরোও কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ফ্রান্সিসদের অনাগ্রহী দেখে আস্তে আস্তে চলে গেল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল হ্যারি–সবকিছুর মূলে ঐ মন্ত্রী স্তিফানো।

–আমারও তাই মনে হয়। হ্যারি বলল।

পরদিন সকালের খাবার খাওয়া হল। হ্যারি বলল

–ফ্রান্সিস রাজার কাছে তোমার একবার যাওয়া উচিত।

–কী আর বলবো রাজাকে গিয়ে। ফ্রান্সিস বলল।

–অন্তত বিশ্বাসঘাতকস্তিফানোর ব্যাপারটা যাচাই করতে পারবে। হ্যারি বলল।

কী হবে? স্তিফানো যেভাবে রাজাকে কৰ্জা করেছে তা থেকে রাজার মুক্তি নেই। ফ্রান্সিস বলল।

–তবু ব্যাপারটা কী তা তো বোঝা যাবে। হ্যারি বলল।

–বলছো যখন–চলো। ফ্রান্সিস যেতে রাজি হল।

দু’জনে রাজসভায় গেল। আজকে স্তিফানো আসন ছেড়ে উঠে উপস্থিত প্রজাদের স্পেনীয় এদেশী দুই ভাষা মিশিয়েই কিছু বলছিল। ফ্রান্সিসদের দেখেই বোধহয় তাড়াতাড়ি বক্তৃতা থামিয়ে বসে পড়ল।

উপস্থিত প্রজারা চলে গেল। রাজা ইশারায় ফ্রান্সিসদের কাছে ডাকল। ফ্রান্সিস কাছে আসতেই হেসে বলল–তোমরা সত্যিই বীরের জাতি। ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। তারপর বলল–হ্যাঁ মাননীয় রাজা–আপনার যোদ্ধাদের সাহায্য ছাড়াই আমরা লড়াইয়ে জিতেছি।

–তার মানে? রাজা বেশ আশ্চর্য হলেন।

–আপনার মন্ত্রী মশাই বোধহয় জানেন ব্যাপারটা। ফ্রান্সিস বলল।

–আমি কিছু জানি না। স্তিফানো সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল।

-তাহলে আর জেনে দরকার নেই। লড়াইয়ে আমরা দু’জন বন্ধুকে হারিয়েছি। একজন এখনও নিখোঁজ। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমরা লড়াই করতে চেয়েছিল। স্তিকানো বলল।

-তা ঠিক। যাহোক এলুডাবাসীকে বলে এসেছি তারা যেন আপনাদের সঙ্গে সভাব রাখে। আপনার ও তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখবেন এই অনুরোধ। আর কিছুই বলার নেই। ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু তুমি বলেছিলে–রাজা মুস্তাকিমের গুপ্তধন উদ্ধার করবে। রাজা বললেন।

-হ্যাঁ। কিন্তু সবার আগে নিখোঁজ বন্ধুর হদিশ পাই। তারপর কাজে নামবো। ফ্রান্সিস বলল।

-বেশ। রাজা বললেন। তারপর বললেন–হয়তো তোমার বন্ধু আহত হয়ে ঐ এ এলুডাতেই আছে।

–হ্যাঁ। কয়েকদিন অপেক্ষা করে বন্ধুর খোঁজে এলুডাতে যাবো। খোঁজ পেলে কাজে নামবো। ফ্রান্সিস বলল।

তাড়া কিছু নেই। তোমার সুবিধে মতো যা কিছু করার করো। রাজা বললেন।

–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস মাথা ওঠা নামা করে চলল। দু’জনে রাজসভা থেকে ফিরে এল।

ওদিকে বিস্কো তিন চারদিন যাবৎ পোমাদের সংসারে আছে। এখন অনেকটা সুস্থ। পোমা নিয়মিত ওর কাঁধের ঘায়ে ওষুধ দেয়। ওর সেবা শুষা করে। বিস্কোর যাতে .কোন কষ্ট না হয় তার জন্যে ওর চেষ্টার অন্ত নেই। প্রোমা ঘরে ঢুকলে বিস্কো পোমার দিকে তাকিয়ে হাসে। প্রোমাও হাসে। আকার ইঙ্গিতে দু’জনেই এখন দু’জনের কথা বোঝে। বিস্কো কয়েকটা দেশীয় শব্দও শিখেছে। যেমন–জল–ওষুধ খিদে। প্রোমার বাবাও বিস্কোকে খুব স্নেহ করে। দেশীয় ভাষায় বলে বিস্কো কী খেতে চায়? বিস্কো বোঝে না। পোমা বুঝিয়ে দেয় বিস্কো মাংস খেতে চায়। প্রোমার বাবা পাখির মাংস নিয়ে আসে। বিস্কো তৃপ্তি করে খায়। এই কয়েকদিনের মধ্যেই বিস্কো পোমার ওপর একটা টান অনুভব করে। পোমা ওর পাশে এসে বসে। আকার ইঙ্গিতে নানা কথা বলে। বিস্কো কোনটা বোঝে কোনটা বোঝে না। তবু সব কথা বোঝার চেষ্টা করে। পরস্পরের সঙ্গ ভালোবাসে। পোমার বান্ধবীরা আসে। বিস্কোকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করে। বিস্কো সেসবের কিছুই বোঝে না। পোমা আকার ইঙ্গিতে বোঝয় বান্ধবীরা কী বলে গেল।

চার পাঁচ দিন কেটে গেল। বিস্কোর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। ফ্রান্সিস ভীষণ চিন্তায় পড়ে। বন্ধুদের মনও ভালো নেই। বিস্কো এভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল।

তবে কি বিস্কো মারা গেছে? ফ্রান্সিস চিন্তিতস্বরে একদিন হ্যারিকে বলল।

–তাহলে তো ওর মৃতদেহ আমরা পেতাম। হ্যারি বলল।

–হয়তো বনের মধ্যে কোথাও। ফ্রান্সিসকে থামিয়ে দিয়ে হ্যারি বলল–বড় বেশি ভাবছো। শান বিস্কোর কিছুই হয়নি। ও ভালোই আছো। কালকে এলুডায় চলো। ওখানে ভালোভাবে খোঁজ করতে হবে।

–আমি জাহাজে খোঁজ করতে যাবো? শাঙ্কো বলল।

তার আগে এলুডায় যাবো। হ্যারি বলল।

পরদিন সকালে খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস আর হ্যারি এলুডার দিকে চলল। প্রান্তর আর খাঁড়ি বনভূমি পার হয়ে এলুডায় এসে পৌঁছাল। প্রথমেই গেল সর্দারের বাড়িতে। সর্দার ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্রান্সিসদের দেখে হাসল। বলল কী ব্যাপার?

–আমাদের এক বন্ধু এখানে কোথাও আছেন্নি খুঁজতে এসেছি। দু’জন লোকদাও।

বেশ তো। সর্দার বলল। তারপর হাততালি দিল। তিনচারজন যোদ্ধা আশপাশের বাড়ি থেকে ছুটে এল। সর্দার তাদের বুঝিয়ে বলল। দু’জন যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের ইঙ্গিত করল ওদের সঙ্গে আসার জন্যে।

ফ্রান্সিসরা যোদ্ধা দু’জনের পেছনে পেছনে চলল। দু’জন যোদ্ধা এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ ঘোবাঘুরি করেও বিস্কোর কোন হদিশ, করা গেল না। রেজাম চত্বরের কাছে একজনকে কি জিজ্ঞেস করল যোদ্ধারা। লোকটি আঙ্গুল তুলে পোমাদের ঘরটা দেখাল। ফ্রান্সিস ছুটে গেল সেই ঘরের দিকে। যোদ্ধারা ডেকে কী বলল। পোমা বেরিয়ে এল। যোদ্ধারা বোধহয় জিজ্ঞেস করল কোন বিদেশী ওখানে আশ্রয় দিয়েছে কিনা। প্রোমা ঘাড় কাত করল। ফ্রান্সিস প্রোমাকে সরিয়ে ঘরটায় ঢুকে পড়ল। দেখল–বিস্কো বিছানায় বসে আছে। ফ্রান্সিস বিস্কোকে জড়িয়ে ধরল। বিস্কো উঃকরে বলে উঠল-কাঁধে ঘা। এখনও সারেনি। হ্যারিও ছুটে এল। বলল–কী চিন্তায় ফেলেছে আমাদের। কী হয়েছিল? ফ্রান্সিস জানতে চাইল। বিস্কো আস্তে আস্তে সব ঘটনা বলল। ততক্ষণে প্রামা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রোমাকে দেখিয়ে বিস্কো বলল–এই মেয়েটির নাম প্রোমা। ওর বাবার চিকিৎসায় আর ওর সেবা শুশ্রূষায় আমি বেঁচে গেছি। নয়তো ঘা বিষিয়ে উঠে মরেই যেতাম। ফ্রান্সিস প্রোমার দিকে ফিরে তাকাল। এ দেশীয় মেয়ে। গায়ের রং তামাটে। তবে চেহারায় লাবণ্য আছে। ফ্রান্সিস বার বার পোমাকে ধন্যবাদ জানাল। বিস্কো ইঙ্গিতে বোঝাল সেকথা। প্রোমা হেসে মাথা নিচু করল। মেয়েটিকে বড় ভালো লাগলো ফ্রান্সিসের।

এবার ফ্রান্সিস বলল–এখানে আর থাকা নয় আমাদের সঙ্গে ফিরে চলো।

–না ফ্রান্সিস–আমি আর ফিরে যাবো নাবিস্কো বলল।

–সে কি? এখানে পড়ে থাকবে? তুমি তো এখনও সম্পূর্ণ সুস্থনও। হ্যারি বলল।

না। আমি পোমাকে বিয়ে করবো। বিস্কো বলল।

–সর্বনাশ। ফ্রান্সিস আঁৎকে উঠল।

এতে সর্বনাশের কিছু নেই। পোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। বিস্কো বলল।

তাহলে ব্যাপার অনেকদূর গড়িয়েছে। ঠিক আছে বিয়ে করে জাহাজে নিয়ে চলো। ফ্রান্সিস বলল।

না। আমি এখানেই থাকবো। বিস্কো বলল।

–দেশে ফিরলে তোমার বাবা মা যখন জানতে চাইবে তুমি ফিরলে না কেন আমি কী বলবো তখন? ফ্রান্সিস বলল।

–এখানে যা ঘটল আর যা ঘটবে সব বলবে। বিস্কো বলল।

–কিন্তু তোমার জীবনের মরণের দায়িত্ব নিয়েছি আমি। ফ্রান্সিস বলল।

–আর তোমার কোন দায়িত্ব রইল না। আমি যা করছি স্বেচ্ছায় করছি। বিস্কো বলল।

–তাহলে তুমি ফিরে যাবে না? হ্যারি বলল।

–না। এটাই আমার সিদ্ধান্ত। বিস্কো বলল।

–কিন্তু একটা বিদেশী মেয়ে–হ্যারি বলতে গেল।

–আমরা আকার ইঙ্গিতে সব কথাই বলি। ওদের কথাও আমি কিছু কিছু শিখেছি। বিস্কো বলল।

হ্যারি মাথা দুলিয়ে বলল–ফ্রান্সিস কিছু বলে লাভ নেই। বিস্কো আর ফিরবে না।

তখনই পোমার বাবা ঘরে ঢুকল? ফ্রান্সিস তাকে জিজ্ঞেস করল–আপনি কে?

–উনি প্রামার বাবা। বিস্কো বলল।

–আপনি কি জানেন ওরা বিয়ে করবে? ফ্রান্সিস বলল। প্রোমার বাবা কিছুই বুঝল না। ফ্রান্সিস বুঝল প্রোমার বাবা রাজি। আরকী বলার আছে। বিস্কোর আর ফেরার আশা নেই।

–তাহলে এখানেই বিয়ে হবে? হ্যরি বলল।

–হ্যাঁ। বিস্কো বলল।

–কবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–এখনও দিনঠিকহয়নি। তোমরাই বলো কবেহলে তোমাদেরসুবিধেহয়। বিস্কো বলল।

পরশু বিয়ের দিন স্থির করেছি। মারিয়া আর ভেনকে জাহাজ থেকে এখানে আনতে হবে তো। ফ্রান্সিস বলল।

রাজকুমারী আসবেন? বিস্কো সাগ্রহে বলল।

নিশ্চয়ই আসবেন। তোমার বিয়ে। আমাদের সবার কাছে কত আনন্দের দিন আর মারিয়া আসবে না? ফ্রান্সিস বলল।

দুপুরের দিকে ফ্রান্সিস আর হ্যারি ফিরে এল। বন্ধুরা সবাই ছুটে এল। হ্যারি বলল–বিস্কোকে পাওয়া গেছে। তবে কাঁধে একটা বর্শার ঘায়ের ক্ষত হয়েছে। এখন ভালোর দিকে। ফ্রান্সিস একবার বন্ধুদের মুখের দিকে তাকাল। দেখল। তারপর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল–পরশু বিস্কোর বিয়ে? দু’তিনজন চেঁচিয়ে বলে উঠল–বিয়ে?

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বিছানায় বসতে বসতে আস্তে আস্তে সব কথা বলতে শুরু করল। কথা শেষ হতে বন্ধুরা অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কারো মুখে কথা নেই। ফ্রান্সিস হেসে বলল–সবাই বোবা হয়ে গেলে যে। বিস্কোর বিয়ে বলে কথা। আনন্দ কর। হৈ হৈ কর।

–এটা আমাদের কাছে খুবই আনন্দের সংবাদ সন্দেহ নেই। কিন্তু আর এক বন্ধুকে আমরা হারালাম এটা দুঃখের। শাঙ্কো বলল।

–তোমরা বিস্কোকে বোঝাতে পারতে। সিনাত্রা বলল।

–অসম্ভব। বিস্কোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। হ্যারি বলল।

–যা হবার হবে। দুঃখ নয়-খুশির হাওয়া তোল। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

এবার সব বন্ধু ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।

ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল–তোমাদের তো খাওয়া হয়ে আছে?

–হ্যাঁ। শাঙ্কো ঘাড়কাত করে বলল।

–তাহলে শাঙ্কো–তোমাকে একবার জাহাজে যেতে হবে। মারিয়া আর ভেনকে আনতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

নিশ্চয়ই যাবো। শাঙ্কো বলল-সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছবো। আজকে রাতটা জাহাজে কাটিয়ে কালকে দুপুরের মধ্যে রাজকুমারী আর ভেনকে নিয়ে আসবো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই শাঙ্কো তৈরী হয়ে নিল। ওদের দুটো নৌকা জেলেদের ঘাটে বাঁধা ছিল। শাঙ্কো সেই ঘাটে গেল। বাঁধা দড়ি খুলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে দাঁড় তুলে নিল। নৌকা চালাল খাঁড়ির মুখের দিকে। কিছু পরে নৌকা সমুদ্রে পড়ল।

পরের দিন দুপুরেই মারিয়া আর ভেন এল। ফ্রান্সিস ওদের আসার পথ চেয়ে ঘরের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। দূরে প্রান্তরের ওপরে মারিয়াদের আসতে দেখল। প্রান্তরে মাঝামাঝি আসতে শাঙ্কো আঙ্গুল তুলে ফ্রান্সিসকে দেখাল। মারিয়া প্রায় ছুটতে ছুটতে আসতে লাগল। প্রান্তরের হাওয়ার মারিয়ার মাথার চুল উড়ছে। পোশাকের প্রান্ত দেশ উড়ছে। মারিয়া হাসছিলও। মারিয়ার এই উচ্ছল রূপ দেখে ফ্রান্সিসের মন খুশিতে ভরে গেল। মারিয়ার এক নতুন রূপ দেখল।

মারিয়া ফ্রান্সিসের সামনে এসে দাঁড়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–বিস্কোর বিয়ে। আমি না এসে পারি।

তাই তো শাঙ্কোকে পাঠালাম। শাঙ্কোর কাছে মারিয়া সবই শুনেছে। বলল বিস্কো আর আমাদের সঙ্গে থাকবে না এটা জেনে কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেছে।

–কী আর করা যাবে। মানুষের মন। ফ্রান্সিস হাসল। বলল–ঘরে এসো।

ঘরে ঢুকে মারিয়া এক পাশে বসল। প্রায় সকলেই এসে এসে মারিয়াকে কেমন আছে জানতে চাইল। মারিয়াও বার বার বলল–আমি আর ভেন ভালো আছি। তোমরাও ভালো আছো নিশ্চয়ই।

–আমাদের দু’জন বন্ধু মারা গেছে। একজন অবশ্য এখানকার বন্ধু। শাঙ্কো বলল। মারিয়া একটু বিষণ্ণ হলো। ফ্রান্সিস প্রসঙ্গটা পাল্টাতে বলল–

শাঙ্কো মরিয়াদের খাওয়ার ব্যবস্থাটা কর।

শাঙ্কো চলে গেল।

সন্ধ্যেবেলা ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেল। রাজা মন্ত্রণাকক্ষে ফ্রান্সিসদের সঙ্গে দেখা করলেন। ফ্রান্সিসেরঅনুরোধেমারিয়ারঅন্তঃপুরে থাকার ব্যবস্থা হল।

রাতের খাবার খেয়ে মারিয়া ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল–বিস্কোর বিয়ে হয়ে গেলেই তো তোমরা জাহাজে ফিরে যাবে।

–এই বার আসল কথা। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–আবার গুপ্তধন–তাইনা? মারিয়া বলে উঠল।

–ঠিক ধরেছো। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–শাঙ্কোর কাছে কিছু কিছু শুনলাম। মারিয়া বলল। ফ্রান্সিস গুপ্তধনের সমস্ত ব্যাপারটা বলল।

-আমি গুপ্তধন খোঁজার সময় তোমার সঙ্গে থাকবো। মারিয়া বলল।

–দেখি। ফ্রান্সিস বলল।

–দেখি না। আমাকে সঙ্গে নিতেই হবে। মারিয়া গলায় জোর দিয়ে বলল।

বেশ–যে সব জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এবার একটা কথা বলি। তুমি রানিকে বলো রাজবাড়ির অন্তঃপুরে কোথাও গুপ্তধন থাকার মত জায়গা আছে কি না। ফ্রান্সিস বলল।

–রানি কি সেরকম কোন হদিশ দিতে পারবে? মারিয়া বলল।

–তা পারবেন না। তবে কোন গোপন জায়গার কথা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন। তুমি একবার কথার কথা বল তো। ফ্রান্সিস বলল।

–আচ্ছা। বলবো। মারিয়া বলল।

একটু পরেই হ্যারি রাজকুমারীকে নিয়ে রাজবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এল।

ওদিকে শাঙ্কো পাঁচজন বন্ধুকে নিয়ে জেলেপাড়ার ঘাটে চলে গেছে। নৌকা থেকে একটা বড় গাঠারি নিয়ে এল সবাই মিলে। শাঙ্কো গাঠারিতে ভরে এনেছে সকলের। নতুন পোশাক। বিস্কোর বিয়ে বলে কথা। সবাই নতুন পোশাক পরবে বিয়ের রাতে। বন্ধুরা শাঙ্কোকে বাহবা দিল। এতে বন্ধুরা আরোও খুশি হল।

পরদিন সকালেই মারিয়া রাজবাড়ি থেকে চলে এল ফ্রান্সিসদের ঘরে। ফ্রান্সিস বলল–রানির সঙ্গে কিছু কথা হল?

–হ্যাঁ। উনি বললেন এর আগে নাকি রাজবাড়িতে খোঁজাখুঁজি হয়েছে। কিন্তু কেউ। ঐ গুপ্তধনের হদিশ করতে পারেননি। মারিয়া বলল।

–হুঁ। কিন্তু কোন গোপন জায়গার কথা কিছু বলেছেন। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–একটা গর্ভ গৃহের কথা বলেছেন। রাজবাড়ির পূর্বকোণায় নাকি মেঝের নিচে একটা ঘর আছে। মারিয়া বলল।

-ঘরটা কি পরিত্যক্ত? ফ্রান্সিস বলল।

–এখন পরিত্যক্তই। রানির বক্তব্য ঐ ঘরটা নাকি অতীতে কয়েদঘর হিসাবে ব্যবহৃত হত। মারিয়া বলল।

–হুঁ। ঘরটা দেখতে হবে। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই শুয়ে বসে বিশ্রাম নিল। মারিয়াও রাজবাড়িতে গেল না। ফ্রান্সিসদের সঙ্গে খেল। ঐ ঘরেই থাকল।

ফ্রান্সিস শুয়ে শুয়ে রাজা মুন্ডাকিমের গুপ্ত ধনভান্ডারের উদ্ধারের কথাই ভাবছিল।

বিকেল হল। ফ্রান্সিস উঠে বসল। গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–তৈরি হও। আজ যুদ্ধ নয়–বিয়ে। শাঙ্কো সবার নতুন পোশাক নিয়ে এসেছে। পরে টরে তৈরি হও।

মারিয়া নিজের ভালো পোশাকটা একটা চমড়ার থলিতে ভরে নিয়ে এসেছিল। বিয়ের কথা শুনে রানি বলেছিলেন উনিই তো সাজিয়ে দেবেন।

বেশ তো। তুমি এলে আমরা রওনা হবো। ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া চামড়ার থলিটা নিয়ে রাজবাড়িতে চলে গেল।

সন্ধ্যের আগেই মারিয়া চলে এল। রানি মারিয়াকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন। ফ্রান্সিস আর বন্ধুরা অবাক হয়ে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। রাজকুমারীর মতই। দেখাচ্ছে মারিয়াকে। এই রূপসজ্জায় মারিয়াকে দেখে ফ্রান্সিসেরও ভালো লাগল। মারিয়ার সেই দুধে আলতায় গায়ের রংটা তামাটে হয়ে গেছে। তবু এখনও মারিয়া সাজগোজ করলে অতি সুন্দরী। মারিয়া তখন হাসিখুশিতে উজ্জ্বল।

ওদিকে ভাইকিং বন্ধুরাও নতুন পোশাক পরে নিয়েছে। সবাই খুশি। মারিয়া। ফ্রান্সিসকে নতুন পোশাক পরিয়ে দিল।

সবাই তৈরি হলে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–চলো সব।

দল বেঁধে ওরা প্রান্তর পার হল। বসতি এলাকায় এল। আশপাশের ঘর থেকে স্থানীয় লোকজন ফ্রান্সিসদের দেখে বেশ অবাক হল। নতুন পোশাক পরে বিদেশীরা কোথায় যাচ্ছে? আবার লড়াই করতে? কিন্তু কারো হাতে হোতরোয়াল নেই? খুশিতে হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে সবাই।

ওরা যখন জেলেপাড়ার ঘাটে পৌঁছল তখন আকাশের নিষ্প্রভ চাঁদ উজ্জ্বল হয়েছে। জ্যোৎস্না পড়েছে জেলেপাড়ায় খাড়ির জলে লুভিনা পাহাড়ে নিচের বনভূমিতে।

একটা নৌকোয় মারিয়াকে নিয়ে ফ্রান্সিস উঠল। ওদের বৈদ্যি ভেনকেও তুলে নিল। ফ্রান্সিস নৌকো বেয়ে চলল ওপারে। অন্য ভাইকিং বন্ধুরা খাঁড়ির জলে নামল। জলে, শব্দ তুলে হেঁটে চলল ওপারের দিকে।

ফাঁড়ি পার হল সবাই। তারপর বনভূমিতে ঢুকল। প্রায় অন্ধকার বনতল দিয়ে মাঠমত জায়গাটায় যখন বসতি এলাকার মধ্যে দিয়ে রেজাম চত্বরে এসে পৌঁছল তখন রাত হয়েছে।

দেখা গেল রেজাম চত্বরেই বিয়ের আয়োজন হয়েছে। ফ্রান্সিস একটা জিনিস দেখে খুশি হল যে চত্বরের মাঝখানের খুঁটিটা তুলে ফেলা হয়েছে। দেখা গেল ফুল পাতা দিয়ে। চত্বরময় ঝালরের মত টাঙানো হয়েছে। চারদিকে বেশ কিছু মশাল জ্বলছে। তার ওপর চাঁদের আলোও রয়েছে। জায়গাটা আলোকিত।

ফ্রান্সিস দেখল সর্দার ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখাশুনো করছে। চড়য়ের মাঝখানে চারকোণে গাছের ডাল পোঁতা হয়েছে। মাঝখানে একটা কাঠের লম্বা পাটাতন। তাতে হলুদ রঙের ফুলপাতা আঁকা। ওটা বোধহয় রবকনের বসার আসন।

সর্দারের নির্দেশে চত্বরে মোটা কাপড় পেতে দেওয়া হল। ফ্রান্সিসরা বসল তাতে। শাঙ্কো এসে মারিয়াকে বিস্কোর নতুন পোশাক দিয়ে গেল। মারিয়া পোশাক নিয়ে হ্যারিকে বলল–চল–বিস্কোকে তো সাজিয়ে গুজিয়ে দিতে হবে।

হ্যারি মারিয়াকে নিয়ে প্রোমাদের ঘরে নিয়ে এল। মারিয়াকে দেখে বিস্কো হেসে উঠে দাঁড়াল। বলল–আপনি এসেছেন। খুব খুশি হলাম। পাশের ঘর থেকে প্রামা এই ঘরে এল। মারিয়া দেখিয়ে বলল–উনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। বিস্কো আকার ইঙ্গিতেও সেটা বোঝাল। পোমা মোটামুটি বুঝল। খুশির হাসি হাসল। মারিয়া বলল বিস্কো–এবার তোমাকে সাজিয়েগুছিয়ে দিচ্ছি। মারিয়া নতুন পোশাক নিয়ে কাজে নেমে পড়ল। মারিয়া পোমাকেও সাজিয়ে গুজিয়ে দিল। কিছু প্রসাধনী সঙ্গে করে এনেছিল। সেসব কাজে লাগল।

তখনই প্রোমার বাবা ঘরে ঢুকল। প্রোমাকে কিছু বলল। প্রোমা বিস্কোকে আকার ইঙ্গিতে বোঝাল-তলব এসেছে। এখন যেতে হবে। কয়েকজন স্ত্রীলোক ঘরে ঢুকল। ওদের পেছনে পেছনে বিস্কো আর প্রোমা রেজাম-চত্বরের দিকে চলল। সঙ্গে মারিয়া আরহ্যারি।

ততক্ষণে চত্বর লোকজনে ভরে গেছে। বিদেশীর সঙ্গে বিয়ে। কাজেই তাদের ঔৎসুক্য সীমাহীন। কয়েকজন যোদ্ধা ধ্বনি তুললকু-উ-উ-। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল–কু-উ-উ-টা লড়াইয়ের ডাক আবার আনন্দেরও ধ্বনি। শাঙ্কোও হাসল।

বিস্কো আর থোমাকে কাঠের পাটাতনে বসানো হল। একজন ভীষণ রোগামত লোক ওদের সামনে দাঁড়িয়ে নাকিসুরে কিছুক্ষণ কী আউড়ে গেল। তারপর দুজনের গলায় ফুলপাতার মালা পরিয়ে দিল।

মারিয়া ফ্রান্সিসের পাশে এসে বসল। ফিসফিস করে বলল–আমার এতভালো লাগছে।

–তুমি খুশি থাকলে আমিও খুশি। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এলুডার নিয়মরীতি মেনে বিয়ে শেষ হল। বিস্কো আর পোমা হাত ধরাধরি করে চলে গেল। পেছনে একদল স্ত্রীলোক।

এবার খাওয়া দাওয়া। সর্দার এসে ফ্রান্সিসদের ওখানেই খেয়ে যেতে অনুরোধ করল। ফ্রান্সিসরা মোটামুটি সারি দিয়ে বসল। পাত পাতা হল। খেতে দেওয়া হল আনাজের মোটা রুটি আর মাংস। সবাই তৃপ্তি করে খেল। কেউ কেউ দুতিনবারও খাবার চাইল। উপস্থিত দেশীয় লোকজনের সঙ্গেই ওরা খেল।

তারপরই হল বিপত্তি। দেশীয় এক ধরনের ফলের রস কাঠের গ্লাসে করে খেতে দেওয়া হলা। সর্দার দ্রুত ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল-ফলরস–খুব নেশা–কম– বলুন। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–এই ফলের রসে ভীষণ নেশা হয়। কম করে খাও। ফ্রান্সিস মারিয়া হ্যারি ভেন সেই রস খেল না। বন্ধু ভাইকিংরা ততক্ষণে দু’এক গ্লাশ খেয়ে ফেলেছে। সবচেয়ে বেশি খেয়েছে শাঙ্কো। ফলের রসের প্রতিক্রিয়া শুরু হল। ভাইকিংদের মাথা ঘুরতে লাগল। শাঙ্কো তো শুয়েই পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কয়েকজন শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস একটু অবাক হয়েই দেখল ঐ দেশীয় লোকেদের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া হল না। তার কারণ বোধহয় ওরা এই ফলের রস খেয়ে অভ্যস্ত।

ফ্রান্সিসরা ওখানেই শুয়ে পড়ল। ঘুম তেমন হল না। মারিয়া তো ঘুমুতেই পারল না।

ভোর হল। সিনাত্রা আর কয়েকজন উঠে বসল। বাকিরা উঠতেই পারল না।

সকালে সবাইকে সকালের খাবার দেওয়া হল। যাদের একটু বেশি নেশা হয়েছিল তারা শুয়েই রইল। উঠে বসে খেতে পারল না। শাঙ্কো একেবারে অসাড়।

ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। সবাইকে নিয়ে কীভাবে ফিরবে?

বেলা বাড়ছে দেখে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ওঠো সবাই। ফিরতে হবে।

যারা উঠে দাঁড়াতে পারছিল তারা উঠল। শাঙ্কো উঠতেই পারল না। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে টেনে তুলল। বলল–যাও–বিস্কোকে ডেকে নিয়ে এসো। আমরা এখান যাবো।

–আমি দাঁড়াতেই পারছি না। শাঙ্কো ধরা গলায় বলল।

–বলো কি! ঠিক আছে। আমাকে ভর দিয়ে দাঁড়াও। শাঙ্কো প্রায় ফ্রান্সিসের গায়ে গা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি–্যও বিস্কোকে ডেকে নিয়ে এসো। ওকে বলো আমরা ফিরবো।

হ্যারি বিস্কোকে ডেকে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো আমরা এবার যাচ্ছি। আরো কয়েকটা দিন আমরা কয়েকজন রাজা প্রোফেনের রাজত্বে থাকবো। তুমি যদি এর মধ্যে প্রোমাকে নিয়ে জাহাজে যেতে চাও যেও।

–দেখি। বিস্কো বলল।

বন্ধুরা একে একে বিস্কোর কাছে বিদায় নিল। এবার সবাই চলল বনভূমির দিকে। কয়েকজন বন্ধু এলেমেলো পা ফেলে হাঁটছিল। ফ্রান্সিস ধমক দিয়ে বলল–ঠিক করে হাঁটো। টাল খাওয়া শরীর সামলে কোনরকমে হেঁটে চলল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে প্রায় জড়িয়ে ধরে নিয়ে চলল।

বন পার হয়ে খাঁড়ির ঘাটে আসতে বেশ সময় লাগল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ধরে ধরে নৌকোয় বসালো। মারিয়া ভেনও নৌকোয় উঠল। যাদের হাত-পা টলছিল ফ্রান্সিস তাদের বলল–আমি ওপারে গিয়ে নৌকো নিয়ে আসছি। তোমরা জলে নামবে না। বাকিরা জলে নেমে পার হও।

নৌকো চালিয়ে ফ্রান্সিস ওপারে গেল। আবার নৌকো নিয়ে ফিরে এল। হাত-পা টলা বন্ধুদের নৌকোয় তুলে পার করে দিল। শাঙ্কো তখনও পারে বসে আছে। ফ্রান্সিস ওকে ধরে ধরে প্রান্তর পার হয়ে ঘরে নিয়ে এল।

রাতে ফ্রান্সিস মাথার নিচে দুহাত রেখে চোখ বুজে শুয়েছিল। ভাবছিল রাজা মুন্ডাকিমের গুপ্ত ধনভান্ডার কোথায় থাকতে পারে? রাজবাড়িতে বনভূমিতে লুভিনা পাহাড়ে–এসবের মধ্যে যে কোন জায়গায় থাকতে পারে। সব তন্ন তন্ন করে খুঁজতে হবে। হ্যারি পাশেই শুয়ে ছিল। বলল–ফ্রান্সিস কী ভাবছো?

রাজা মুন্ডাকিমের গুপ্তধনের কথা। ফ্রান্সিস বলল।

রাত হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ো। হরি বলল।

ভেবে কী ঠিক করলে? হ্যারি বলল।

কাল রাজসভায় যাবো। রাজার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলবো। ফ্রান্সিস বলল।

–কী লাভ? রাজা তো কিছুই জানেন না। হ্যারি বলল।

–উঁহু। ওঁর একটা কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্সিস বলল।

–কোন কথা? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

–খেয়ালি রাজা মুস্তাকিম একা একা পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। ফ্রান্সিস বলল।

–সেটা উনি খেয়ালি ছিলেন বলে। হ্যারি বলল।

উঁহু–ব্যাপারটা ভাববার মত। ফ্রান্সিস বলল।

–দেখ আর কী জানতে পারো। কথাটা বলে হ্যারি পাশ ফিরে শুল।

পরদিন সকালে খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস আর হ্যারি তৈরি হল। রাজসভায় যাবে। কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু এগিয়ে এল। বলল–ফ্রান্সিস আমরা এখন কী করবো? লড়াই তো হয়ে গেছে। আমরা এখানে থেকে কী করবো? আমরা জাহাজে চলে যাই।

–বেশ। ফ্রান্সিস বলল।

–আজকে দুপুরেই চলে যাই। তাহলে সন্ধ্যের আগেই জাহাজে পৌঁছতে পারবো। ভাইকিং বন্ধু ক’জন বলল।

–শোন। আমাদের এখানে একটা কাজ বাকি আছে। আমি হ্যারি শাঙ্কো আর মারিয়া এখানে থাকবো। কাজ সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজে চলে যাবো। শাঙ্কো তোমাদের নিয়ে যাবে। তোমাদের পৌঁছে দিয়ে জেলেদের নৌকোগুলি নিয়ে আসবে। ও তোমাদের পৌঁছে দিয়ে জেলেদের নৌকোগুলি নিয়ে আসবে। ফ্রান্সিস বলল।

-শাঙ্কো–তাহলে দুপুরের খাবার খেয়েই চলো। ওরা শাঙ্কোকে বলল।

-ঠিক আছে। শাঙ্কো বলল। ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল–দেখ এখানে আমাদের বিপদের সম্ভাবনা আছে। তখন হয়তো তোমাদের আবার আসতে হতে পারে। তবে আমরা সাবধানে থাকবো।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি রাজবাড়ির দিকে চলল। রাজসভায় পৌঁছল। দেখল আজকে প্রজাদের ভিড় কম। একটা বিচার চলছিল। রাজার দু’পাশের আসনে মন্ত্রী স্তিফানো আর সেনাপতি বসে আছে।

বিচার শেষ হল। বিচারপ্রার্থীরা চলে গেল। প্রজাদের অনেকেই চলে গেল।

ফ্রান্সিসদের দেখে রাজা ওদের এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করলেন। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–মান্যবর রাজা–আমরা আপনার পূর্বপুরুষের গুপ্ত ধনভান্ডারের সন্ধান আজ থেকে শুরু করছি। এখন আপনার কাছে ধনভান্ডার সম্পর্কে কিছু কথা জানতে এসেছি।

–আমি তো যা জানি বলেছি। রাজা বললেন।

–আপনার কী মনে হয়? ঐ ধনভান্ডার কোথায় থাকতে পারে? ফ্রান্সিস বলল।

–দেখ–রাজা মুণ্ডাকিমের পরের বংশধরেরা সন্ধান চালিয়েছিল। আমিও অনেক সন্ধান করেছি। আমার মন্ত্রীও চেষ্টা করেছেন। ধনভান্ডার কোথায় গোপনে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে সবাই অন্ধকারে। এবার তুমি চেষ্টা করে দেখ। রাজা বললেন।

–চেষ্টা তো করবোই। আমি জেনেছি যে আপনার বাড়িতে একটা গর্ভগৃহ আছে। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ হ্যাঁ। বহুদিন আগে থেকেই নাকি ছিল। হয়তো অবাধ্য প্রজাদের ওপর অত্যাচারের জন্যই ঐ গর্ভগৃহ তৈরি করা হয়েছিল। প্রজা সন্তানের মত। তারা যে অপরাধই করুক তাদের এভাবে শাস্তি দেওয়ার বিরোধী আমি। যা হোক–সেই গর্ভগৃহ আমি পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। রাজা বললেন।

–কেউ কি সেই গর্ভগৃহে নেমে সন্ধান চালিয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল। রাজা এবার স্তিফানোর দিকে তাকালেন। স্তিফানো উঠল–হ্যাঁ–আমি ঐ গর্ভগৃহ তন্নতন্ন করে দেখেছি। গুপ্তধনের কোন হদিশ পাই নি। তুমিও দেখবে নাকি?

নিশ্চয়ই।

–ওখানে একঝাঁক চামচিকে পাবে। সাপটাপও পেতে পারো। স্তিফানো হেসে বলল।

তবু দেখবো। ফ্রান্সিসরাজারদিকেতাকিয়ে বলল–আপনিঅনুমতিদিন। ফ্রান্সিস বলল।

–সানন্দে অনুমতি দিলাম। তবে তুমি মারা গেলে তার দায় আমার ওপর চাপানো চলবে না। রাজা বললেন।

কক্ষণো তা করা হবেনা। তবে জেনে রাখুন–আমি মারা যাবোনা। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে তো ভালোই। রাজা বললেন।

লুভিনা পাহাড়ের নিচে যে জঙ্গল আছে সেটাও আমরা দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।

বেশ তো। রাজা বললেন।

–সেই জঙ্গলে দেখার কী আছে? স্তিকানো বলল

জঙ্গল বনভূমি যেমন হয়। ঘন গাছ লতাপাতা। পাখি।

–আর অন্য কিছু।

–অন্য কিছুই নেই। হ্যাঁ ভালুক বুনো শুওর আছে। স্তিফানো বলল।

–লুভিনা পাহাড়ে কী দেখার আছে? ফ্রান্সিস বলল।

–পাহাড়-টাহাড় যেমন হয়। রাজা বললেন।

–তবু–সেই পাহাড়ে কী আছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

গিয়ে দেখো। স্তিফানো বলল।

–আপনার কাছে জানতে চাইছি। ফ্রান্সিস রাজাকে বলল।

রাজার যেন মনে পড়ল। বললেন–হ্যালুভিনা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একটা গুহা আছে।

–গুহাটা কত বড়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–বেশ বড়। এপার থেকে ওপার পর্যন্ত চলে গেছে। রাজা বললেন। এবার স্তিফানো বলল-পাহাড়ের মাথার দিকে আছে একটা সরোবর।

সরোবর? ফ্রান্সিস বলে উঠল।

–হ্যাঁ-হ্যাঁ। রাজা মাথা ঝাঁকালেন। বললেন–কোন সময় ওখানে হয়তো আগ্নেয়গিরি ছিল। এখন মৃত। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখেই জল জমে ঐ সরোবর হয়েছে। তার নাম শুনলে বেশ ভয় পাবে?

-কী নাম? ফ্রান্সিস বলল।

–মৃত্যু-সায়র। রাজা বললেন।

–এরকম একটা নাম কেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–শোন্ সায়র বলা হলেও তেমন বড় কিছুনয়। একটা ছোট পুকুরের মত। তবে তার জল এত বিষাক্ত যে প্রাণী পাখি তার মধ্যে পড়লে মুহূর্তে মৃত্যু হয়। রাজা বললেন।

–মানুষ পড়লে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–তার চিহ্নও পাওয়া যাবে না। তাই তো নাম মৃত্যু-সায়র। রাজা বললেন।

–তুমি মৃত্যু-সায়রে নামবে নাকি? স্তিফানো ঠাট্টার সুরে বলল।

-আমি অত সহজে মৃত্যু মেনে নিতে রাজী নই। যাহোক মৃত্যু–সায়র তো দেখতে হবেই। ফ্রান্সিস বলল।

-কেউ ওর ত্রিসীমানায় যায় না। রাজা বললেন।

–আমরা সাবধানে দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।

যাহোক–একটা মজার খবর পেলাম। স্তিফানো বলল।

–কী খবর? ফ্রান্সিস বলল।

–তোমাদের এক বন্ধু নাকি এক এদেশী মেয়ে বিয়ে করেছে? স্তিফানো বলল।

–হ্যাঁ। মানুষের মন বিশেষ করে যুবকের মন। ফ্রান্সিস বলল।

–সে কি? এই বিদেশে পড়ে থাকবে? রাজা বেশ অবাক হয়ে বললেন।

–তোমার বন্ধুকে এলুডার সর্দার করে দাও। ঠাট্টার সুরে স্তিফানো বলল।

–সে তার যোগ্যতায় যদি সর্দার হতে পারে হবে যেমন আপনি এখানকার মন্ত্রী হয়েছেন। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

স্তিফানো আর কিছু বলতে পারল না। মুখের মত জবাব ফ্রান্সিসের।

-যা হোক–আশা করি তোমরা সফল হবে। রাজা বললেন।

–দেখবো চেষ্টা করে। মাননীয় রাজা–কালকে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে আপনার বাড়ির অন্দরমহল গর্ভগৃহ দেখতে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ এসো। রাজা বললেন।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি ফিরে এল। মারিয়া এগিয়ে এল। বলল–রাজার সঙ্গে কী কথা হল তোমাদের? ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সব বলল। মারিয়া বলল–সেই মৃত্যুসায়র তাহলে ঐ লুভিনা পাহাড়েই আছে?

–হ্যাঁ সব দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবো। মারিয়া বলল।

–বেশ। যেও। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করে বলল।

–এখন কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল।

–দেরি করবো না। দুপুরেই চলো। আগে বনাঞ্চলটা দেখে আসি। ফ্রান্সিস বলল।

বনাঞ্চলটা দেখবে কেন? হ্যারি বলল।

রাজা প্রোফেন বলেছিল অতীতের রাজা মুণ্ডাকিম কখনও কখনও একা একা ঐ বনে লুভিনা পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। উনি খেয়ালি রাজা ছিলেন। হ্যারি বলল।

ব্যাপারটার গুরুত্ব আছে। কেন একা একা ঘুরে বেড়াতেন? কোন উদ্দেশ্যই কি তার ছিল না? ফ্রান্সিস বলল।

-কী উদ্দেশে ঘুরে বেড়াতেন? হ্যারি বলল।

–সেটাই জানতে হবে। তাই প্রথমে বনভূমিটা দেখবো। দুপুরের খাওয়া সেরে তৈরি হয়ে নিও। ফ্রান্সিস বলল।

দুপুর হল। খাওয়াদাওয়া শেষ।

হ্যারি শাঙ্কো মারিয়াকে নিয়ে ফ্রান্সিস প্রান্তরে নামল। প্রান্তর পার হচ্ছে তখনই দেখল সেনাপতি ছুটে আসছে ওদের দিকে। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে এসে সেনাপতি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–তোমরা কোথায় যাচ্ছো?

–ওপারের বনে। হ্যারি বলল।

–কেন? সেনাপতি জিজ্ঞেস করল।

–দেখি গুপ্ত ধনভান্ডারের কোন হদিশ করতে পারি কিনা। ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু কথা ছিল গুপ্ত ধনভান্ডার খোঁজার সময় আমাকে সঙ্গে রাখতে হবে। সেনাপতি বলল।

–হ্যাঁ। চলুন তাহলে। ফ্রান্সিস বলল।

সবাই জেলেপাড়ার ঘাটের দিকে চলল। দু’টো নৌকোয় চড়ে খাঁড়ি পার হল। বনের মধ্যে ঢুকল। খুব গভীর বন নয়। ফ্রান্সিসরা বনে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ফ্রান্সিস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে লাগল। গাছগাছালি লতা ফুল। ঘুরতে ঘুরতে সার্ভো আর বন্ধুর কবরের কাছে এল। ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে দাঁড় করালো। তারপর ফুলে ঢাকা গাছটা থেকে ফুল পাড়ল। কবরের ওপর ছড়িয়ে দিল। হ্যারিরাও এদিক ওদিক থেকে ফুল তুলে এনে কবরের ওপর ছড়িয়ে দিল।

সারা বনেই ফ্রান্সিসরা ঘুরে বেড়াল। কিন্তু গুপ্ত ধনভান্ডারের হদিশ পাওয়া যায় এমন কিছু পেল না। একটা কালো রোমশ ভালুকের দেখা পেয়েছিল। তবে ভালুকটা ওদের আক্রমণ করেনি। দেখা দিয়েই বনের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল।

বেশ ক্লান্ত হয়েই ফ্রান্সিসরা খাঁড়ির ঘাটে এল। নৌকোয় উঠতে উঠতে সেনাপতি মন্তব্য করল–ঘোরাই সার।

–হ্যাঁ। তবু সবকিছুই দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিসরা যখন প্রান্তর পার হয়ে ওদের ঘরে ফিরল তখন বিকেল হয়ে গেছে।

ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়ল। হ্যারি এসে পাশে বসল। বলল–ঐ বনে তো কিছু হদিশ করা গেল না।

–না–এবার বাকি জায়গাগুলো দেখবো।

তখনই সেনাপতি এসে দরজায় দাঁড়াল। হেসে বলল–ভূতের বেগার খাটছেন। ফ্রান্সিস সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বলল–আপনার সঙ্গে লোক দিচ্ছি। তিনটে মশাল পাঠিয়ে দেবেন।

–মশাল নিয়ে কী করবে? সেনাপতি বলল।

রাজবাড়িতে তল্লাশী চালাবো। ফ্রান্সিস বলল।

এবার তাহলে রাজবাড়ি। সেনাপতি হেসে বলল।

-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।

–গুপ্তধন উদ্ধারের আশা ছেড়ে দাও। সেনাপতি হেসে বলল।

–সে যখন আশা ছাড়ার ছাড়বো। ফ্রান্সিস বলল।

যাকগে–তোমাদের বেগার খাটার সঙ্গী হবনা আর। দু’জন যোদ্ধাকে দেব। তারাই তোমাদের ওপর নজর রাখবে যাতে তোমরা পালাতে না পারো। সেনাপতি বলল।

–বেশ তো। ওদের হাতেই মশাল পাঠিয়ে দিন। হ্যারি বলল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ বলিষ্ঠদু’জন যোদ্ধা মশাল নিয়ে এল। শাঙ্কো মশালগুলো নিল।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–হ্যারি তুমি থাকো। অন্দরমহলেই যাবো। তাই মারিয়াকে সঙ্গে নিচ্ছি। শুধু শাঙ্কোকে নিয়ে যাচ্ছি। হ্যারি কিছু বলল না।

যোদ্ধা দু’জনের পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসরা রাজবাড়ির দিকে চলল। বর্শা হাতে প্রহরী দরজা ছেড়ে দিল। মন্ত্রণাকক্ষের পাশ দিয়ে ফ্রান্সিসরা অন্দরমহলে ঢুকল। ফ্রান্সিস যোদ্ধা দু’জনকে বলল–তোমরা অন্দরমহলে যেতে পারবে না। এখানে থেকেই আমাদের ওপর নজর রাখো।

ফ্রান্সিস অন্তঃপুরের প্রহরীকে বলল

–একজন রাণির পরিচারিকাকে ডাকো। প্রহরী ভেতরে চলে গেল। একটু পরে একজন পরিচারিকা নিয়ে এল।

–আমরা অন্দরমহলে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–জানি। রাণিমা বলেছেন আপনারা আসবেন। পরিচারিকা বলল।

ফ্রান্সিসরা অন্তঃপুরে ঢুকল। ফ্রান্সিসরা চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। সুন্দর সাজানোগোছানো সবকিছু। ফ্রান্সিস পাথরের দেয়ালগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল যদি কোন চিহ্ন পাওয়া যায়। কিন্তু তেমন কিছুনজরে পড়ল না। পরিচারিকা ওদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব ঘরই দেখাল। একসময় রাণি হেসে মারিয়ার সঙ্গে কিছু কথাও বললেন।

এবার পরিচারিকা বলল–আর কী দেখবেন?

–গর্ভগৃহ। ফ্রান্সিস বলল–পূবদিকে।

–সেতো সাংঘাতিক জায়গা। পরিচারিকা বেশ ভীতস্বরে বলে উঠল।

–ঠিক আছে। তুমি নিয়ে চলো৷ ফ্রান্সিস বলল।

পরিচারিকা ফ্রান্সিসদের রাজবাড়ির পূর্ব অংশে নিয়ে এল। একটা ভেঙে পড়া ঘরের কাছে এসে মেঝের দিকে দেখাল। দেখা গেল একটা পাথরের চৌকোনো পাটাতন। তাতে একটা বড় লোহার কড়া গাঁথা।

–এটাই গর্ভগৃহ। পাটাতনের নিচে। পরিচারিকা বলল।

ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে কড়াটা ধরে টানল। পাটাতনটা ভারি।

শাঙ্কো-পাটাতন তুলতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো এগিয়ে এল। দুজনে উবু হয়ে বসল। তারপর একসঙ্গে কড়াটা ধরে টানতে লাগল। কয়েকটা জোর হ্যাঁচকা টান পড়তে পাটাতনটা নড়ল। তারপর আরো কয়েকটা জোরে টান পড়তে পাটাতনটা উঠে এল। ভেতরে নিষ্প্রভ আলোয় দেখা গেল পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে।

–শাঙ্কো–মশাল জ্বালো। শাঙ্কো কোমরে গোঁজা চকমকি পাথর আর লোহার টুকরো বের করল। পাথর ঠুকে দু’টো মশাল জ্বালল।

ফ্রান্সিস জ্বলন্ত মশাল হাতে নামতে যাবে শাঙ্কো জামার তলা থেকে ওর ছোরাটা বের করে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস ছোরাটা কোমরে গুঁজে নিল। তারপর আস্তে আস্তে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।

মশালের আলোয় ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। নিরেট এবড়োখেবড়ো পাথরের ঘর। একপাশে একটা মাটির বড় জ্বালা। আরও একটা কী। কাছে এসে দেখল একটা ভাঙা কাঠের সিংহাসন। সিংহাসনটা সরাতে গেল। ওটা একেবারেই ভেঙে পড়ল। বেশ শব্দ হল।

–কী হল? ওপর থেকে মারিয়ার ভয়ার্ত গলা শোনা গেল।

–কিছু না। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল। ফ্রান্সিস মশাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক ভালোভাবে দেখতে লাগল। মাকড়সার জাল একটা নাক চাপা গন্ধ এসব নিয়ে পরিত্যক্ত ঘর। কে জানে কত বন্দীর দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে এখানকার পরিবেশে। নাঃ। কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

ফ্রান্সিস সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। উৎসুক মারিয়া জিজ্ঞেস করল–কিছু হদিশ পেলে? ফ্রান্সিস মাথা এপাশ ওপাশ করল।

মশাল নিভিয়ে ফ্রান্সিসরা রাজবাড়ির বাইরে চলে এল। যোদ্ধা দু’জনকেফ্রান্সিস বলল– আজকে আর কোন খোঁজাখুঁজি নয়। তোমরা চলে যেতে পারো। যোদ্ধারা চলে গেল।

ঘরে এসে ফ্রান্সিস বিছানায় বসল। হ্যারি বলল

–কোন সূত্র পেলে?

–নাঃ। ঐ গর্ভগৃহে গুপ্তধন রাখা হয়নি। এখন বাকি রইল লুভিনা পাহাড়। কালকে পাহাড়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–গুপ্তধনের ব্যাপারটাই গন্ডগোলে। মারিয়া মন্তব্য করল।

ফ্রান্সিস হেসে বলল–গুপ্তধন বলে কথা। ওসব বরাবরই গোলমেলে ব্যাপার।

-বনেজঙ্গলে দেখলে গর্ভগৃহে দেখলে কোথাও তো পেলে না। মারিয়া বলল।

–পাহাড়টাও দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।

–যদি ওখানে না পাও। মারিয়া বলল।

–আমরা সব নতুন করে দেখবো।

–আবার? মারিয়া প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।

ফ্রান্সিস হেসে উঠল। বলল–সত্যি তোমার ধৈর্যশক্তি খুবই কম। এত সহজে হাল ছেড়ে দিচ্ছো?

–না বাপু। জাহাজে ফিরে চলো। মারিয়া বলল।

–শাঙ্কো যাক–তোমাকে জাহাজে রেখে আসুক। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়ার একটু অভিমানই হল। দেয়ালে হেলান দিতে দিতে বলল

–তাহলে ধৈর্য ধরতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

রাত হল। মারিয়া ফ্রান্সিসদের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে রাজবাড়ি চলে গেল। বার বার বলে গেল–আমি তোমাদের সঙ্গে যাবো কিন্তু।

রাজকুমারী আপনাকে রেখে আমরা যাবো না। আপনি সকালেই চলে আসবেন। হ্যারি বলল।

পরদিন ভোরেই মারিয়া চলে এল। সকালের খাবার খেয়ে এসে ফ্রান্সিস বলল হ্যারি–দেরি করো না। রোদ চড়ে যাবে। এখনই চলল।

তখনই সেনাপতি এল। সঙ্গে গতকালের সেই দুই পাহারাদার যোদ্ধা। সেনাপতি হেসে বলল–শুনলাম কালকে রাজবাড়িতে তল্লাশী চালিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছো?

-কে আর দু’হাত ভরে গুপ্তধন দেবে? ফ্রান্সিসও হেসে বলল।

–হদিশ পেলে কিছু? সেনাপতি বলল।

–সময়ের সদ্ব্যবহার কীভাবে করবো? খাবোদাবো ঘুমুবো? ফ্রান্সিস বলল।

–না–তা নয়–মানে–

–আমরাই সময়ের ঠিক সদ্ব্যবহার করছি। চিন্তাভাবনা করছি-বুদ্ধির গোড়ায় শান দিচ্ছি। বুদ্ধিকে শাণিত করছি। আলস্যে সময় কাটাচ্ছিনা। ফ্রান্সিস বলল।

–যাগে–যেমন তোমাদের মর্জি। চলি। সেনাপতি চলে গেল।

ফ্রান্সিসরা দ্রুত তৈরী হয়ে নিল। প্রান্তর পার হয়ে জেলেপাড়ার ঘাটের দিকে চলল। সঙ্গে যোদ্ধা দুজনও চলল।

যেতে যেতে ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল বেশ বলশালী যোদ্ধাটি মাঝে মাঝেইওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। নৌকোয় উঠেও সে ফ্রান্সিসের পাশে বসল। এতে দাঁড় টানতে ফ্রান্সিসের বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। কিন্তু ও কিছু বলল না ব্যাপারটা হ্যারিও লক্ষ্য করেছিল।

বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে যখন তখন হ্যারি নিম্নস্বরে বলল–ফ্রান্সিস কী ব্যাপার বলো তো?

কোন ব্যাপারে বলছো? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–একজন যোদ্ধা তোমার মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। হ্যারি বলল।

–হুঁ–ফ্রান্সিসও গলা নামিয়ে বলল–আমিও লক্ষ্য করেছি। তবে কেন এরকম করছে সেটা ঈশ্বরই জানে।

–ব্যাপারটা আমার ভালো ঠেকছে না। ওরা তরোয়ালও নিয়ে এসেছে। তুমি সাবধানে থেকো। ওর ওপর নজর রেখো। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল।

–আরে যেতে দাও–ফ্রান্সিস তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বলল।

–উঁহু তুমি ব্যাপারটা এভাবে উড়িয়ে দিও না। হ্যারি বলল। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না।

বনভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে সবাই লুভিনা পাহাড়ের নিচে এল। খুব একটা উঁচু পাহাড় নয়। আর খুব ছোটও নয়।

ফ্রান্সিস যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলল-আমাদের গুহাটার মুখে নিয়ে চলো।

–তাহলে পাহাড়ে উঠতে হবে। যোদ্ধাদের একজন বলল

–চলো। ফ্রান্সিস বলল।

দুজন এ পাথর সে পাথর কখনও ধরে কখনও ডিঙিয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। পেছনে লাইনে ফ্রান্সিসরাও উঠতে লাগল। মারিয়ার উঠতে দেরি হচ্ছিল। শাঙ্কো মারিয়াকে পাহাড়ে উঠতে সাহায্য করছিল।

একসময় গুহার মুখে এসে পৌঁছল সবাই। রোদের বেশ তেজ। আর জোর হাওয়া বইছিল। তাতে কষ্টটা কম হচ্ছিল। ফ্রান্সিস গুহার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল শাঙ্কো-মশাল জ্বালো। শাঙ্কো দুটো মশাল কোমরে ফেট্টিতে গুঁজে উঠেছিল। ও চকমকি পাথর লোহার টুকরো বের করল। ঠুকে ঠুকে মশাল জ্বালল। একটা মশাল ফ্রান্সিস অন্যটা হ্যারিকে দিল। শাঙ্কো মারিয়াকে হাত ধরে নিয়ে চলল।

কিছুটা এগোতেই নিকষ অন্ধকার। গুহার মেঝেয় পাথরের টুকরো ছড়ানো। একটু উঁচু নিচুও। চারদিক ধেকে দেখে হাঁটছিল। এবড়ো খেবড়ো পাথর এখানে ওখানে উঁচিয়ে আছে। বেশ কিছুটা যেতে গুহা পথের উত্তর মুখে ঢাল শুরু হল। এখানে গুহার অংশটা উঁচু। ফ্রান্সিস হাতের মশালটা উঁচু করে তুলে ওপরের দিকে তাকাল। দেখল এক খোদল মত ওপরের দিকেও উঠে গেছে। ওপরে কী আছে বোঝা গেল না। এবার উত্তরের ঢাল বেয়ে ওরা চলল। এরকম অভিযানে তো মারিয়া অভ্যস্ত নয়। ও ভাবছে কতক্ষণে গুহা থেকে বেরোবে। আর সবাই নির্বিকার হেঁটে চলেছে।

কিছু পরে ওদিককার গুহামুখ দেখা গেল। প্রায় গোল মুখ। যেমন একটা রোদ মাখানো গোলাকার কাপড় ঝুলছে। গুহা পথ শেষ। সবাই বাইরে উজ্জ্বল রোদে এসে দাঁড়াল। অন্ধকার থেকে এসে চোখে একটু অস্বস্তি হল। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই অস্বস্তিটা কেটে গেল।

উত্তরের বনের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস একটা ব্যাপার দেখে বেশ আশ্চর্য হল। এদিকে নিচে বেশ দূর পর্যন্ত টানা উধর মাটি। ঘাসের বা গাছের কোন চিহ্ন নেই বেশ কিছু দূর পর্যন্ত। যেন এই টানা জায়গাটা আগুনে পুড়ে গেছে। অথচ দু পাশে ঘাস গাছগাছালি। ফ্রান্সিস হ্যারিকে দেখাল সেটা। দেখেটেখে হ্যারি বলল–এখানে হয়তো দাবাগ্নি জ্বলেছিল।

–তেমনি কিছু হবে। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিস ওপরের দিকে তাকাল। পাহাড়ের এবড়ো খেবড়ো গা উঠে গেছে সেই চূড়ড়া পর্যন্ত।

ফ্রান্সিস ফিরে যোদ্ধাদের বলল–মৃত্যু সায়রটা কোথায়?

–এদিক দিয়ে উঠেও যাওয়া যায় আবার ওদিক থেকেও উঠেও দেখা যায়। বলশালী যোদ্ধাটি বলল?

–আমরা এদিক দিয়ে উঠবো। ফ্রান্সিস বলল। এবার মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি শাঙ্কোর সঙ্গে এখানে থাকো। পাহাড়ে উঠতে পারবে না।

–না আমি উঠতে পারবো। শাঙ্কো উঠতে সাহায্য করবে। মারিয়া বলল

–বেশ চলো। ফ্রান্সিস বলল।

সবাই এপাথরের চাই ওপাথরের চাইয়ের পাশ দিয়ে কখনো চাই ডিঙিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

বেশ সময় লাগল উঠতে। পাহাড়ের চূড়োর কাছাকাছি উঠে দেখল একটা মাত্র শুকনো আঁকাবাঁকা ডালওয়ালা গাছ। তার পাশেই একটা ছোট জলাশয়। বলিষ্ঠ যোদ্ধাটি বলল–এটাই মৃত্যু-সায়র।

ছোট জলাশয়। ফ্রান্সিস ঢাল বেয়ে জলাশয়ের একেবারে কাছে চলে এল। ভালো করে মৃত্যু সায়রটা দেখতে লাগল। হলদেটে রঙের জল। কেমন একটা নাক-চাপা গন্ধ। পাথরের গা থেকে নিশ্চয়ই বিষাক্ত কিছু বেরিয়ে এই জলে মেশে। তাতেই বিষাক্ত হয়ে গেছে এই জল।

হঠাৎ শাঙ্কোর উত্তেজিত ডাক শুনল ফ্রান্সিস। সেইসঙ্গে মারিয়ার ভয়ার্ত চিৎকার।

ফ্রান্সিস এক পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। বলিষ্ঠ যোদ্ধাটি তখন দ্রুত ওর সামনে নেমে এসেছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। ফ্রান্সিসকে ধাক্কা দিয়ে মৃত্যু-সায়রে ফেলে দেওয়া। ফ্রান্সিস তৎক্ষণাৎ শরীর ঘুরিয়ে সরে গেল। ঢালু পাথরে টাল সামলাতে পারল না যোদ্ধাটি। পাথরের নুড়িতে পা হড়কে মৃত্যু-সায়রে পড়ে গেল। একগাদা নুড়ি পাথরও সেইসঙ্গে জলে পড়ল। ঝপাৎ করে শব্দ হল। যোদ্ধাটি দু’হাত তুলে জলে ডুবে গেল। আর উঠল না। আস্তে আস্তে জলে ঢেউ বন্ধ হল।

মুহূর্তে ঘটে গেল সব। মারিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস একটু হাঁপাতে হাঁপাতে গাছটার কাছে উঠে এল। সঙ্গের যোদ্ধাটির মুখ তখন ভয়ে সাদা। এরকম অঘটন ও হয়তো কল্পনাও করেনি। ফ্রান্সিস ওর কাছে এল। বলল–তোমার যোদ্ধা বন্ধু আমাকে ঠেলে ফেলতে চেয়েছিল কেন? মাথা দুলিয়ে যোদ্ধাটি বলল-জানি না।

–ফ্রান্সিস? হ্যারি ডাকল।

–হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল।

–আর এখানে নয়। নেমে চলল। হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ। মৃত্যু-সায়রটাই দেখা বাকি ছিল। চলো। কথাটা বলে ফ্রান্সিস মারিয়ার কাছে এল। মারিয়া তখনও ফেঁপাচ্ছে। মারিয়ার মাথায় হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল–কেঁদো না। অত সহজে আমার মৃত্যু হবেনা। এবার তো বুঝলে এসবঅভিযানে এমনি ভয়ানক ঘটনা ঘটে। তাই তোমাকে সঙ্গে আনিনা। যাগেশান্ত হও। মারিয়ার ফোঁপানি বন্ধ হল।

এবার ফ্রান্সিসরা পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে নামতে লাগল। নামতে নামতে হ্যারি, মৃদুস্বরে বলল–এর মূলে স্তিফানো। নিশ্চয়ই ওর এরকম নির্দেশ ছিল।

–অসম্ভব নয়। ফ্রান্সিসও গলা নামিয়ে বলল। ফ্রান্সিস দেখল দক্ষিণ দিক দিয়ে পাহাড়টায় ওঠানামা সহজ। প্রান্তরের কাছে এসে যোদ্ধাটি সৈন্যাবাসের দিকে চলে গেল।

ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকল। মারিয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। হ্যারি শাঙ্কো বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। কেউ কোন কথা বলল না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস বলল–কালকে আবার লুভিনা পাহাড়ে যাবো। গুহাটা। ভালো করে দেখা হয়নি। গুহাটা আর তার চারপাশ ভালো করে দেখতে হবে।

-আমিও যাবো। মারিয়া বলল।

–বেশ। যেও। ফ্রান্সিস বলল।

পরদিন সকালে সেনাপতি এল। ফ্রান্সিসকে বলল

–তোমাকে রাজা মন্ত্রীমশাই দু’জনেই ডেকেছেন। রাজসভায় চলো।

–ফ্রান্সিস কালকের ব্যাপারটা। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল। ফ্রান্সিসও মৃদুস্বরে বলল বোঝাই যাচ্ছে।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–আমি আর হ্যারি যাচ্ছি।

দুজনে যখন রাজসভায় পৌঁছল দেখল রাজসভায় কোন বিচার চলছেনা। বোধহয়। আগেই সে সব কাজ সেরে ফেলা হয়েছে। রাজসভায় প্রজাদের ভিড় নেই।

রাজা প্রোফেন ফ্রান্সিসদের এগিয়ে আসতে বললেন। পাশে বসা মন্ত্রী স্তিফানোর মুখ বেশ গম্ভীর।

কালকে তোমরা লুভিনা পাহাড়ে গিয়েছিলে? রাজা বললেন।

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা কাত করে বলল।

–আমাদের একজন যোদ্ধা কী করে মৃত্যু-সায়রে পড়ে গেল? রাজা বললেন।

–সে আমাকে ঠেলে মৃত্যু-সায়রে ফেলতে চেয়েছিল। আমি সময়মত সরে যেতে সে শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে মৃত্যু-সায়রে পড়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।

–দুর্ঘটনাটা কি এভাবেই ঘটেছিল? স্তিফানো বলল। ফ্রান্সিস চারপাশে তাকাল। দেখল সঙ্গী যোদ্ধাটি কখন ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিস তাকে দেখিয়ে বলল–আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে এই যোদ্ধাটিকে জিজ্ঞেস করুন। সত্যি ঘটনাটা ওই বলবে।

–ও যা বলার বলেছে। রাজা বললেন।

নিশ্চয়ই দুর্ঘটনার কথা বলেছে। ফ্রান্সিস বলল।

–তা বলেছে কিন্তু আমার সন্দেহ যাচ্ছেনা। স্তিকানো বলল।

–আমি অকারণে নরহত্যা করি না। তাছাড়া সেই যোদ্ধা এদেশের একজন যোদ্ধা। ওর সঙ্গে তো আমার রাগদ্বেষের সম্পর্ক থাকার কথা নয়। ও নিজেই পা পিছলে পড়ে গেছে।

যাক গে–ব্যাপারটা আমি দেখছি। তোমরা এ দেশ ছেড়ে যেতে পারবে না। স্তিফানো বলল।

–আমরা গুপ্ত ধনভান্ডারের খোঁজ করছি। কাজেই এখান থেকে চলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে আমার স্ত্রী রয়েছে। তাকে ফেলে রেখে আমরা পালাতেও পারবো না। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমরা কি লুভিনা, পাহাড়ে আবার যাবে? রাজা বললেন।

–হ্যাঁ। আজ দুপুরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

এবার চারজন যোদ্ধা তোমাদের পাহারা দিতে যাবে। স্তিফানো বলল।

–সমস্ত সৈন্যবাহিনী গেলেও আমাদের আপত্তি নেই। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশি বাজে বকো না। স্তিফানো প্রায় গর্জে উঠল। হ্যারি চাপাস্বরে বলে উঠল– ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। তারপর বলল

–মান্যবর রাজা আমরা তাহলে চলে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।

দুজনে রাজবাড়ি থেকে চলে এল।

মারিয়া জানতে চাইল রাজা ডেকেছিলেন কেন? ফ্রান্সিস সব কথা বলল।

–আশ্চর্য। তুমি ঐ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে বলে সন্দেহ করছে? মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ। আমাকে বিপদে ফেলাই স্তিফানোর উদ্দেশ্য। ফ্রান্সিস বলল।

দুপুরে ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে সেনাপতির কাছে পাঠাল। কিছু পরে চারজন যোদ্ধার সঙ্গে শাঙ্কো ফিরে এল। যোদ্ধারা ফ্রান্সিসদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।

ফ্রান্সিসরা তৈরি হয়ে প্রান্তরে এসে নামল। পেছনে চারজন যোদ্ধাও চলল।

জেলেপাড়াঘাট বন পার হয়ে লুভিনা পাহাড়ের গুহামুখে এল। শাঙ্কো দুটো মশাল জ্বালল। শাঙ্কো আর ফ্রান্সিস মশাল হাতে গুহায় ঢুকল।

গুহার এবড়োখেবড়ো মেঝের ওপর দিয়ে হেঁটে চলল সবাই। প্রায় মাঝামাঝি এসে মাথার ওপর খোঁদলের জায়গাটা পার হবার সময় ওপরের খোদলটা দেখল একবার। খোদলটা হাত দশবারো উঁচুতে। একনজর দেখে হাঁটতে শুরু করল ফ্রান্সিস।

গুহা শেষ। উত্তর দিকে সামনেই সেই অনুর্বর এলাকা। ফ্রান্সিস এবার বলল–হ্যারি এখন আমরা দেশীয় ভাষায় কথা বলবো। যোদ্ধারা কিছু কিছু স্পেনীয় ভাষা বোঝে। শোন–সামনে যে অনুর্বর লম্বাটে জায়গাটা দেখছো সেই জায়গা দিয়ে নিশ্চয়ই অন্তত একবার মৃত্যু-সায়রের বিষাক্ত জল বয়ে গিয়েছিল। কারণ গুহার ঢালটা এদিকেই। কিন্তু পাহাড়ের ওপর থেকে বিষাক্ত জল নামল কী করে?

-কোনভাবে নেমেছে।

জল বাইরে দিয়ে পড়ে নি। গুহার মধ্যে পড়ে এসেছিল। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে মৃত্যু-সায়রের সঙ্গে গুহাটার যোগ আছে? হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ আছে। এখন সেই যোগটা খুঁজে দেখতে হবে। মনে হয় আজ রাতেই সেই যোগটা খুঁজে পাবো। ফ্রান্সিস বলল।

কিন্তু চারজন যোদ্ধা পাহারায় থাকবে। হ্যারি বলল।

–না। ওদের নজর এড়িয়ে আমি আর শাঙ্কো আসব। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ না হয় জল নেমে এল। তাতে কী হল? হ্যারি বলল।

-মৃত্যু-সায়রের শুকনো তলদেশটা দেখতে পারবো। আমার কেমন মনে হচ্ছে। ওটার তলদেশে নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

–অসম্ভব নয়। হ্যারি বলল।

যোদ্ধারা ওদের দেশীয় ভাষা কিছুই বুঝল না। বোকার মত তাকিয়ে রইল।

–এখন ফিরে চলো। আর কিছু দেখবো না। ফ্রান্সিস বলল।

সবাই ফিরে চলল। নৌকোয় উঠে মারিয়া মৃদুস্বরে বলল–গুহা দেখে কিছু হদিশ পেলে?

–প্রায়। তবে আজ রাতে সব লুকিয়ে দেখতে হবে। ফ্রান্সিসও গলা নামিয়ে বলল।

ঘরে এসে ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগল। চোখ বুজেই ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো এগিয়ে এল।

–সেনাপতিকে বলে একটা কুড়ল নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস চোখ বুজেই বলল।

শাঙ্কো চলে গেল। একটু পরেই একটা কুড়ুল নিয়ে ফিরল। পেছনে পেছনে সেনাপতিও এল। হেসে বলল-কুড়ুল দিয়ে কী করবে?

–মই বানাবো।

–মই? মই দিয়ে কী করবে?

–লুভিনা পাহাড়ের মাথায় উঠবো। পাহাড়ের চূড়োটা দেখা হয়নি।

–মইয়ে চড়ে চুড়োয় উঠবে? অদ্ভুত কথা শোনলে। সেনাপতি হাসতে লাগল।

-হ্যাঁ। আমরা একটু অদ্ভুত। আমাদের কান্ডকারখানাও একটু অদ্ভুত। ফ্রান্সিস হেসে। বলল। সেনাপতি হাসতে হাসতে চলে গেল।

রাত হল। খাওয়াদাওয়া শেষ। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–শাঙ্কো এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। গভীর রাতে লুভিনা পাহাড়ে যেতে হবে।

–রাতে কী খোঁজাখুঁজি করবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।

–আছে–আছে। এখনও দেখার মত কিছু আছে। ফ্রান্সিস বলল।

–পাহারাদার যোদ্ধারা? শাঙ্কো বলল।

খুব গোপনে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়ার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

বলল–তাহলে আমিও যাবো।

-না মারিয়া। এই কাজটা খুব গোপনে সারতে হবে। তোমাকে নিয়ে গেলে ধরা পড়ে যেতে পারি। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক আছে। আমি রাজবাড়ি শুতে যাচ্ছি। কাল ভোরে এসে সব শুনবো।

মারিয়া রাজবাড়ি চলে গেল।

ফ্রান্সিসরা ঘুমিয়ে পড়ল।

রাত গভীর হল। ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ডাকলশাঙ্কো। কুড়ুল আর মশাল।

–সব গুছিয়ে রেখেছি।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–হ্যারি তোমাকে আর নিয়ে যাব না।

-না-না। লোক যত কম হয় ততই ভালো। হ্যারি বলল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। প্রান্তরে উজ্জ্বল জোৎস্না। ফ্রান্সিস দেখল রাজবাড়ির ছায়া পড়েছে। ও শাঙ্কোর হাত টেনে সেই ছায়ায় নিয়ে এলো। ছায়ার মধ্যে দিয়ে দুজন চলল।

প্রান্তর শেষ। বসতি এলাকার শুরু। পাহারাদারদের এলাকাটা নির্বিঘ্নে পার হওয়া গেল।

নৌকোয় খাঁড়ি পার হয়ে বনভূমি পার হয়ে যাচ্ছে তখনই শাঙ্কোকে বলল-লম্বা গাছ কেটে মই বানাতে হবে। চলো গাছ কাটতে হবে। খুঁজে খুঁজে দুটো সরু অথচ লম্বা গাছ পেল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়েছে। সেটুকু আলো কাজে লাগাল। দুটো লম্বা গাছ কাটল। তারপর গাছের ডালগুলো কাটল। বুনো শুকনো লতা জোগাড় করে কাটা ডাল বেঁধে বেঁধে মই বানাল।

এবার লুভিনা পাহাড়ের দিকে চলল। শাঙ্কো মই কাঁধে চলল।

গুহামুখে এসে দাঁড়াল। মশাল জ্বালল। মশাল আর মই নিয়ে দুজনে গুহায় ঢুকল। যেতে যেতে প্রায় মাঝমাঝে জায়গায় মইটা নিয়ে এল। মশালের আলোয় ফ্রান্সিস খোদলটা দেখল। তারপরমই পাতল। মইটা প্রায় মাপমত হল। শাঙ্কোকেমইটা ধরতে বলে ফ্রান্সিস মই বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। হাতে মশাল। মশালের আলোয় দেখল খোদলটা ওপরে বড়। একপাশে পাথরের থাক। সেই থাকটা আর সামনের পাথুরে অংশটা কেটে কেটে তৈরি। প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। মানুষের হাত পড়েছে এখানে। এখানে মানুষ এসেছিল কেন?

ফ্রান্সিস মশালটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। তখনই স্তম্ভের মত পাথরের গায়ে একটা পাথরের ফলক মত দেখল। ফলকটা মোটামুটি কেটে মসৃণ করা। বাঁদিকে একটা পাথুরে খাঁজ। সেই খাঁজে মশালটা রেখে ফলকটায় হাত দিয়ে দেখল। কী যেন কুঁদে ভোলা আছে। নিশ্চয়ই কুঁদে কিছু লেখা। ফ্রান্সিস লেখাটা পড়বার চেষ্টা করল। নাঃ কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু বুঝল স্পেনীয় অক্ষর। তাও দুর্বোধ্য। ও ফলকটা ধরে কয়েকবার নাড়া দিল। আশ্চর্য। ফলকটা নড়ে গেল। ও চাপাস্বরে বলল– শাঙ্কো কুড়ুলটা। শাঙ্কো মই বেয়ে উঠে ওকে কুড়ুলটা দিয়ে গেল। ও কুলের মাথা এ ফলকের কোনাগুলোতে চেপে চেপে আস্তে ঠুকতে লাগল। ফলকটা নড়ল। তারপর আস্তে আস্তে খুলে এল। ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। ফলকটা একহাতে ঝুলিয়ে নিল। মশালটা পাথুরে দেয়ালে ঘষে নিভিয়ে ফেলল।

এবার নামা। ফ্রান্সিস ফলকটা বাঁহাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে মই বেয়ে নেমে এল। শাঙ্কো বলল–কিছু হদিশ পেলে?

–একটা সূত্র পেয়েছি। এই ফলকটা। এটায় কিছু কুঁদে লেখা। লেখাটা কী সেটা জানতে হবে। তবে অক্ষরগুলো স্পেনীয় ভাষায়। চলো। আগে এই ফলকের পাঠোদ্ধার করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–মইটা কী করবে? শাঙ্কো বলল।

–মইটা নিয়ে চলো। জঙ্গলে কোথাও লুকিয়ে রাখবো। ফ্রান্সিস বলল।

দু’জনে মইটা নামিয়ে ধরে ধরে গুহা থেকে বেরিয়ে এল। তারপর বনভূমিতে ঢুকল। একটা ঝাকড়াপাতার গাছের আড়ালে মইটা লুকিয়ে রাখল। জায়গাটা ভালো করে দেখে রাখল ফ্রান্সিস। পরে যাতে খুঁজে পাওয়া যায়।

বনভূমি থেকে বেরিয়ে এল। প্রান্তর রাজবাড়ির ছায়ায় ছায়ায় পার হয়ে নিজেদের ঘরের দরজায় টোকা দিল। হ্যারি দরজা খুলে দিল। হ্যারির হাতে পাথরের ফলকটা নিয়ে ফ্রান্সিস বলল–এটাতে কুঁদে কিছু লেখা আছে। দেখতে পড়তে পারো কিনা।

-কোথায় পেলে এটা? হ্যারি জানতে চাইল।

–সব বলছি। তার আগে লেখাটা পড়তে পারো কিনা দেখ। ফ্রান্সিস একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। তারপর বিছানায় বসে পড়ল। হ্যারি ঘরের মশালের আলোর কাছে নিয়ে ফলকের লেখাটা পড়বার চেষ্টা করতে লাগল।

ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়ে পড়ল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে রাজার বাগানের গাছগাছালিতে পাখির ডাক শোনা গেল। বাইরে ভোর হল।

হ্যারি পাথরের ফলকটা বিছানায় রাখতে রাখতে বলল–পড়তে পারলাম না। তবে মনে হয় প্রাচীন স্পেনীয় ভাষায় কিছু লেখা।

এখন কাকে দিয়ে পড়াবো তাই ভাবছি। অথচ এই শব্দের অর্থ জানাটা খুবই জরুরী। ফ্রান্সিস বলল।

–সেনাপতিকে একবার বলে দেখতে পারো। হ্যারি বলল।

–অন্যভাবে বলতে হবে। এই ফলকের কথা বলা চলবে না। ফ্রান্সিস বলল।

–সেনাপতিকেই অন্যভাবে বলল। হ্যারি বলল। ফ্রান্সিস বলল

শাঙ্কো একবার সেনাপতিকে ডাকো। শাঙ্কো চলে গেল। তখনই মারিয়া এল। মৃদুস্বরে বলল–কিছুহদিশ করতে পারলে?

–অনেকটা এগিয়েছি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর পাথরের ফলকটা বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখতে রাখতে বলল–এই ফলকটা পেয়েছি। এটার মধ্যে কিছু লেখা আছে। সেটার পাঠোদ্ধার করতে পারলেই গুপ্তধনের হদিশ পেয়ে যাবো।

সেনাপতি শাঙ্কোর সঙ্গে এল। বলল কী ব্যাপার?

–আপনাদের বৈদ্যি আমাকে একটা ওষুধ দিয়েছিল। তার নামটা মনে পড়ছে না। বৈদ্যিকে যদি একবার ডেকে দেন তাহলে খুবই ভালো হয়। ফ্রান্সিস বলল।

–বৈদ্যিবুড়োর কথা বলছে। ও তো পুরনো আমলের লোক। ওর চিন্তাভাবনা সবই, পুরোনোআমলের। এমন সব ওষুধের নাম বলে যার অর্থই আমরা বুঝিনা। সেনাপতি বলল।

–তাই বলছিলাম যদি বৈদ্যিকে একবার ডেকে দেন। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক আছে। তোক পাঠাচ্ছি। সেনাপতি চলে গেল।

ফ্রান্সিসদের এক চিন্তা–বৈদ্যিবুড়ো কি শব্দটা পড়তে পারবে? অর্থটা বলতে পারবে?

কিছুক্ষণ বাদেই বৈদ্যিবুড়ো কাঠের বোয়াম ঝোলায় নিয়ে এল।

কার কী হয়েছে? বৈদ্যিবুড়ো বিছানায় বসল।

–সব বলছি। তার আগে একটা কথা। আপনি তো পুরোনো আমলের লোক। পুরোনো স্পেনীয় শব্দের অর্থ বলতে পারবেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–কী শব্দ? আমি প্রাচীন স্পেনীয় ভাষা মোটামুটি জানি। বৈদ্যি বলল।

আর একটা কথা অতীতের রাজা মুন্তাকিম কি স্পেনীয় ভাষা মানে–প্রাচীন ভাষা জানতেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

কী যে বলো। রাজা মুন্তাকিম বিদেশেও ব্যবসার কাজে যেতেন। স্পেনীয় পোর্তুগীজ ইংরেজি ভালো জানতেন। বেশ খেয়ালি মানুষ হলেও যথেষ্ট জ্ঞানী ছিলেন। বৈদ্যি বলল।

এবার ফ্রান্সিস বিছানার তলা থেকে পাথরের ফলকটা বের করল। বিছানায় ফলকটা পেতে বলল–এই পাথরের ফলকে কিছু কুঁদে লেখা আছে–দেখুন তো আপনি এর অর্থ বোঝেন কিনা।

–এই পাথরের ফলক কোথায় পেলে? বৈদ্যি জানতে চাইল।

–সামনের প্রান্তরের পূর্বকোনায় মাটির নিচে। ফ্রান্সিস মিথ্যে করে বলল।

–ও দেখি তো। বৈদ্যিবুড়ো মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল–প্রাচীন স্পেনীয় শব্দ। যতদূর বুঝতে পারছি কথাটা হল–এ বিয়ের্তো ইনন্দার।

তার মানে। ফ্রান্সিস সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল।

–মুক্ত ধারা। বৈদ্যিবুড়ো বলল। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ বৈদ্যিবুডোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর উচ্ছ্বাস গোপন করে বলল–

–ঠিক আছে। আমাদের কারো অসুখ করেনি। আপনি যেতে পারেন। বৈদ্যিবুড়ো ঝোলা হাতে বেরিয়ে যেতেই ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠে চাপাস্বরে বলে উঠল–হ্যারি রাজা মুস্তাকিমের গুপ্ত ধনভান্ডার হাতের মুঠোয়। শাঙ্কো মারিয়া কেউই ফ্রান্সিসের কথা থেকে কিছুই বুঝল না। শুধু হ্যারি বলল

সাবাস ফ্রান্সিস।

এবার ফ্রান্সিস শান্ত হয়ে বিছানায় বসল। তারপর চাপাস্বরে বলল–আজ রাতে আবার লুকিয়ে লুভিনা পাহাড়ে যেতে হবে। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। কী করতে হবে তাই ভাবতে লাগল।

গভীর রাত তখন। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। চাপাস্বরে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো ঘুম ভেঙে উঠে দাঁড়াল। দুটো মশাল নিয়ে তৈরি হলো। ফ্রান্সিস কুড়ুলটা নিল।

দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে উজ্জ্বল জোৎস্না। রাজবাড়ির ছায়ার আড়ালে আড়ালে বসতি এলাকায় ঢুকল। নৌকোয় উঠে খাঁড়ি পার হয়ে বনভূমিতে ঢুকল। একটু খুঁজতেই মাটিতে শুইয়ে রাখা মইটা পেল। শাঙ্কো মই কাঁধে চলল।

গুহার মুখ দিয়ে ঢুকলো দু’জনে। ফ্রান্সিস সেই খোঁদলের কাছে এসে মই পাতল। শাঙ্কো চকমকি পাথরে লোহা ঠুকে আগুন জ্বালল। দু’টো মশালে। ফ্রান্সিস বলল–এবার শাঙ্কো–তুমি গুহার দক্ষিণদিকে গিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করো। সাবধান। উত্তরে চালের দিকে যাবে না আর বাইরে গিয়ে মশাল নিভিয়ে ফেল।

ফ্রান্সিসের কথামত শাঙ্কো দক্ষিণদিক দিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল। মশাল নিভিয়ে ফ্রান্সিসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

ফ্রান্সিস একহাতে জ্বলন্ত মশাল আর অন্যহাতে কুড়ুল নিয়ে ভারসাম্য রেখে আস্তে আস্তে মই বেয়ে সেই খাঁজটার জায়গায় এসে দাঁড়াল। পাথরের দেয়ালে গর্ত ছিল। সেখানে মশালটা ঢুকিয়ে বাখল। তারপর যে পাথরে ফলকটা বসানো ছিল সেই পাথরে কুড়ুলের ঘা মারতে লাগল। কুড়ুলের ঘায়ের শব্দ গুহায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তখনই ও কুড়ুলের ঘা সাবধানে মারতে লাগল যাতে বেশি শব্দ না হয়।

পরপর কয়েকটা জোর ঘা পড়তেই পাথরটা দু’ভাগ হয়ে ভেঙে পড়ল। ঝরঝর করে হলদেটে জলের ধারা নেমে এল। ফ্রান্সিস মৃদু হাসল–মৃত্যু-সায়রের জল। ও খাঁজের দেয়ালে পিঠ চেপে দাঁড়াল যাতে বিষাক্ত জলের ছিটে না লাগে। জল পড়তে লাগল।

গুহার বাইরে দাঁড়ানো শাঙ্কো কুড়ুলের ঘায়ের জল পড়ার মৃদু শব্দ শুনল। বুঝল মৃত্যু সায়রের জলই পড়ছে। এই ওর চিন্তা হল এই বিষাক্ত জল যদি ফ্রান্সিসের গায়ে লাগে! তবে এটা ভাবল ফ্রান্সিস সব দিক ভেবেই ঐ জল নামিয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জলপড়া বন্ধ হল। মৃত্যু-সায়রে জল নিঃশেষ। তবু টুপ্টা জল পড়ছিল। সেটাও যেন গায়ে না লাগে। সাবধান হল ফ্রান্সিস। ও অপেক্ষা করতে লাগল। .

অল্পক্ষণের মধ্যেইটুপটাপ জল পড়াও বন্ধ হল। ফ্রান্সিস মশালটা তুলে নিয়ে মই বেয়ে। নিচের দিকে নামল। মই থেকেই দেখল ওর অনুমান সঠিক। বিষাক্ত জলধারা উত্তরের ঢাল বেয়ে গুহার বাইরে চলে গেছে। কিন্তু এইবার ও চিন্তায় পড়ল। গুহার মেঝেয় অল্প হলেও কিছু পরিমাণ বিষাক্ত জল জমে আছে। পা ফেলা যাবেনা। জল যাতে না লাগে তার উপায় ভাবতে হল। ও ভাবল ওপরে পাথরের চাঙর দিয়ে যে বা যারা ঐ মুক্তধারা’ কথাটি। ফলকের গায়ে উত্তীর্ণ করেছিল তারা নিশ্চয়ই মই ব্যবহার করে নি। অন্য কোন পথে ঐ খাঁজে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে বা তাদের জলের স্পর্শ এড়াতে হয়েছিল। সেই পথ ওখানেই আছে যে পথ দিয়ে সে বা ওরা ওখানে এসেছিল আবার বেরিয়েও গিয়েছিল।

ফ্রান্সিস মশাল হাতে মই বেয়ে ওপরের পাথরের খাঁজে উঠেএল। তারপরমশাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। বারকয়েকমশাল ঘোরাতেইনজরে পড়ল একটা ছোটমুখ। কাছে গিয়ে দেখল একটা সুড়ঙ্গের মুখ। আগে এই সুড়ঙ্গমুখ ওরনজরে পড়ে নি।

সুড়ঙ্গের মুখের কাছে গেল। ভেতরে তাকিয়ে দেখল অন্ধকার। ফ্রান্সিস হাতের মশালটা ছুঁড়ে দিল সুড়ঙ্গের মধ্যে। একটু দূরে গিয়েই পড়ল মশালটা। মশালের আলোয় দেখল ভেতরটা মুখের মত ছোট নয়। বড়ই।

ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। তারপর মাথা ঢুকিয়ে শরীর হিঁচড়ে টেনে নিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকল। সুড়ঙ্গের এবড়োখেবড়ো মেঝে দিয়ে চলল মশালটার দিকে।

মশালের কাছে এল। আবার ছুঁড়ে দিল মশালটা। মশালটা কিছু দূরে পড়ল। আমার, শরীর হিঁচড়ে টেনে চলল। মশালের কাছে এসেই দেখল একটু দূরে সুড়ঙ্গের মুখ। অস্পষ্ট চাঁদের আলো ঐ মুখে। আবার হিঁচড়ে চলল। সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখল জ্যোৎস্নালোকিত পাহাড় গাছগাছালি।

হাঁপাতে হাঁপাতে চলল গুহামুখের দিকে। গুহামুখে এসে দেখলশাঙ্কো দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস একটা পাথরে বসতে বসতে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো গুহামুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চমকে পিছু ফিরে তাকাল। দেখল ফ্রান্সিস একটা পাথরে বসে হাঁপাচ্ছে। ফ্রান্সিসের সারা গায়ে ধূলোবালি। নতুন জামার এখানে ওখানে ছেঁড়া। শাঙ্কো বলে উঠল–এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?

-অক্ষত ফিরে এসেছ। এটাই যথেষ্ট। ফ্রান্সিস হাতের মশাল নেভাল।

–গুহার ভেতরে কুড়ুলের শব্দ জলের শব্দ। কী ব্যাপার? শাঙ্কো বলল।

–সব বলবো। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল–ভোর হতে দেরি নেই। শেষ কাজটা এখনো বাকি। চলো।

–কোথায়? শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল।

–মৃত্যু-সায়রে। ফ্রান্সিস বলল।

–কেন? শাঙ্কো বলল।

–গিয়ে দেখবে। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল।

দুজনে পাহাড়ে উঠতে লাগল। কিছু পরে মৃত্যু-সায়রের পাশে শুকনো ডালের গাছটার কাছে এল। ঢাল বেয়ে দু’জনে নেমে মৃত্যু সায়রের মধ্যে তাকাল। মৃত্যু সায়র জলশূন্য। পড়ে আছে একটা নরকঙ্কাল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–সেই যোদ্ধার কঙ্কাল। আমাকে যে হত্যা করতে চেয়েছিল।

–বিষাক্ত জল কোথায় গেল? শাঙ্কো তখনও ঠিক বুঝতে পারছিল না।

–সব বিষাক্ত জল গুহায় নেমে গেছে। ভালো করে নিচে তাকিয়ে দেখ। শাঙ্কো চাঁদের আলোয় দেখল মৃত্যু-সায়রের তলদেশে হীরের অলঙ্কার সোনার মুকুট। আরো কী কী রয়েছে। শাঙ্কো অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল তাহলে

–হ্যাঁ। রাজা মুস্তাকিমের গুপ্ত ধনভান্ডার। মশাল জ্বালো। আরো দেখতে পাবো। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো মশাল জ্বালল। ফ্রান্সিস জ্বলন্ত মশালটা মৃত্যু-সায়রে ছুঁড়ে ফেলল।

দপ করে মৃত্যু-সায়রের গন্ধকের স্তরে আগুন লেগে গেল। ফ্রান্সিস সরে যেতে যেতে বলে উঠল–বিষাক্ত ধোঁয়া বেরুবে। সরে এসো।

ওরা গাছটার কাছে উঠে এল। মৃত্যু-সায়র থেকে নীলচে ধোঁয়া বেরোতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যে ধোঁয়া কেটে গেল। মৃত্যু-সায়রের ধারে এসে দাঁড়াল দু’জনে। তখনও মৃত্যু-সায়রের তলদেশে অল্প আগুন জ্বলছিল। সেই আগুনের আলোয় দেখা গেল তলদেশে কত সোনার চাকতি হীরে মণিমানিক্য ছড়ানো। শাঙ্কো খুশিতে মৃদুস্বরে ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো।

এখন এই ধনসম্পদ তুলবে না? শাঙ্কো বলল।

না। সে সব রাজা করবেন। তিন চারদিন পর। ভোর হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি নেমে চলো–ফ্রান্সিস বলল।

দুজনে বেশ দ্রুতই নেমে এল পাহাড় থেকে। তখন বনভূমিতে পাখিদের কাকলি শুরু হয়েছে। বনভূমি পার হতে হতে সূর্য উঠল।

দুজনে যখন নিজেদের ঘরের কাছে এল তখনই দেখল সেনাপতি আসছে।

ফ্রান্সিস দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ল। ওর ধূলোবালি মাখা পোশাক দেখলে সেনাপতির সন্দেহ হতে পারে। ফ্রান্সিসের অবস্থা দেখে মারিয়া কিছু বলতে গেল। ফ্রান্সিস মুখে আঙ্গুল দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিল।

সেনাপতি প্রান্তরে নেমে চলল রাজবাড়ির পেছনের দিকে। ফ্রান্সিস দেখে নিশ্চিত হল। বলল–মারিয়া আমার পুরোনো পোশাকটা নিয়ে এসো। মারিয়া দ্রুত হেঁটে রাজবাড়িতে চলে গেল। ফিরল ফ্রান্সিসের আর একটি নতুন পোশাক নিয়ে। ফ্রান্সিস পোশাক নিয়ে স্নান করতে গেল।

মারিয়ারা ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল। হ্যারি একটু অধৈর্য হয়ে বলল–শাঙ্কো ফ্রান্সিস রাজা মুস্তাকিমের ধনসম্পদ উদ্ধার করতে পেরেছে?

-হ্যাঁ। শাঙ্কো হেসে বলল।

–সত্যি? মারিয়া প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।

–রাজকুমারী–আস্তে। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস আসুক সেই সব বলবে।

স্নান সেরে ফ্রান্সিস ঘরে এল নতুন পোশাক পরে। মারিয়া অনুচ্চস্বরে বলল–তুমি নাকি– ফ্রান্সিস হেসে ওকে হাতের চেটো দেখিয়ে থামিয়ে বলল–সব বলছি। তার আগে সকালের খাবারটা খেয়ে নি। খাওয়ার ঘরে চলো।

সবাই খেতে চলল। ওরা খাওয়া সেরে ঘরে ফিরে এল।

সবাই বিছানায় বসলে ফ্রান্সিস বলতে লাগল–গুহাটা দেখার সময় একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম। উত্তরের দিকে গুহার ঢাল। সেটার মুখের পরেই নিচে লম্বালম্বি অনুর্বর লম্বাটে একটা অংশ। একটা ঘাসও নেই। অথচ ও জায়গার দুপাশে বন গাছপালা। কেন এরকম হল? নিশ্চয়ই কিছু ও জায়গায় ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। কী বয়ে যেতে পারে? সোজা উত্তর মৃত্যু-সায়রের বিষাক্ত জল। তাহলে সেই জল বেরোবার পথ গুহার মধ্যে আছে। অতীতের রাজা মুস্তাকিম ঐ পথ লোক লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একটা ফলকও গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। তাতে উত্তীর্ণ ছিল–একটা প্রাচীন স্পেনীয় শব্দ–এ বিয়োর্তা ইনান্দার। অর্থ মুক্তধারা। সুতরাং আমি নিশ্চিত হলাম এই ফলক আটকানো পাথরটা ভাঙলেই মৃত্যু-সায়রের জল নেমে আসবে। আমি তাই করেছি। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল–আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। রাজা মুন্তাকিম খেয়ালি রাজা ছিলেন। একা একা বনভূমিতে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। এই তথ্য থেকে আমার সন্দেহ হয় ঐ মৃত্যু-সায়রেই উনি তার ধনরত্ন ফেলে দিতেন। সকলের অগোচরে। মৃত্যু-সায়রে। নেমে ধনরত্ন চুরি করা অসম্ভব। অতএব মৃত্যু-সরোবর থেকে বিষাক্ত জল নামাতে হবে।

তারপর ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলে গেল কীভাবে ও বিষাক্ত জল নামিয়েছে। শুকনো মৃত্যু সায়রেকীরকম ধনরত্ন ওরা দেখেছে তাও বলল।

-সাবাস ফ্রান্সিস। এখন কী করবে? মারিয়া বলে উঠল।

–আজ সন্ধ্যেবেলা রাজাকে সব জানাবো। আমি স্তিফানোকে বিশ্বাস করি না। ধনরত্ন উদ্ধার হয়েছে এটা জানতে পারলে ও আসল চেহারা ধরবে। তখন রাজাকে হত্যা করতে পারে। আমাদেরও বন্দী করতে পারো। অতএব রাজাকে খুব সাবধানে ঐ ধনরত্ন উঠিয়ে আনতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

সন্ধ্যে হল। ফ্রান্সিস বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ডাকল–হ্যারি। হ্যারিও উঠে দাঁড়াল। তারপর রাজবাড়ির দিকে দুজনে চলল।

সদর দরজায় দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিস বলল

রাজামশাইকে বলে আমরা বিদেশীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। খুব বিশেষ প্রয়োজন।

একজন প্রহরী চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল। বলল–চলুন। ফ্রান্সিসরা প্রহরীর পেছনে পেছনে রাজবাড়ির মন্ত্রণাকক্ষে এল। আসনে বসল।

কিছুক্ষণ পরে রাজা এলেন। বললেন–কী ব্যাপার?

ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়ে বসে পড়ল। তারপর ফ্রান্সিস বলল–মান্যবর রাজা–আমরা কাল সকালে চলে যাচ্ছি। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

–ও। তাহলে আমাদের এক পূর্বপুরুষের ধনরত্নের ভান্ডার উদ্ধার করতে পারলে না। রাজা বললেন।

–না। আমরা সেই ধনরত্নের গোপন ভান্ডার খুঁজে পেয়েছি।

-বলো কি? রাজা প্রোফেন প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। বললেন–কোথায় সেই ধনরত্নের ভান্ডার?

লুভিনা পাহাড়ের মৃত্যু-সায়রে। ফ্রান্সিস বলল।

–ঐ সাংঘাতিক বিষাক্ত জলে নামবে কে? রাজা বুললেন।

–এখন ঐ মৃত্যু-সায়রে জল নেই। কয়েকদিন পরে একফোঁটা জলও থাকবে না। তখন আপনি সেই ধনভান্ডার তুলে আনতে পারবেন। কিন্তু এরমধ্যে আদেশ জারি করে দিন মৃত্যু-সায়রে যেন কেউ না যায়।

আদেশ জারির দরকার নেই। কেউ ওখানে যেতে সাহস পায় না। রাজা বললেন।

তবু আদেশ জারি করবেন। আর একটা কথা আপনার মন্ত্রী স্তিফানো যেন গুপ্ত ধনভান্ডারের খোঁজ না পায়। সমস্ত ব্যাপারটাই আপনি গোপন রাখবেন। ফ্রান্সিস বলল।

–মন্ত্রীমশাই হয়তো কোনভাবে জানতে পারে। রাজা বললেন।

–আপনি সে ব্যাপারে সাবধান হবেন। আমি কারো সম্বন্ধে অন্য কাউকে কিছু বলি না। সহজে দোষারোপও করি না। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি–স্তিফানো অত্যন্ত শঠ ও নির্দয়। ও ধনভান্ডারের সংবাদ পেলে আপনার জীবনও বিপন্ন হতে পারে। তাকে বিশ্বাস করবেন না–এই অনুরোধ। ফ্রান্সিস বলল।

এখন তাহলে কী করবো? রাজা বললেন।

কয়েকদিন অপেক্ষা। আমি আগুন জ্বেলে জল অনেকটা শুষিয়ে দিয়েছি। কয়েকদিন সূর্যালোক পেলে সব জল বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। তখন নেমে ধনসম্পদ তুলে নেবেন। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে তাই করবো। রাজা বললেন।

–আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্তজন কে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–সেনাপতি। মন্ত্রী স্তিফানোর প্রতি তার রাগ আছে। রাজা বললেন।

–সেটাই স্বাভাবিক। সেনাপতিকে স্তিফানো কোন পাত্তাই দেয় না। যাহোক সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে কোন গভীর রাতে মৃত্যু-সায়র থেকে ধনরত্ন তুলে নিয়ে আসুন। আপনি একা পারবেন না। কিন্তু ধনভান্ডারের কথা গোপন রাখবেন। বিশেষ করে স্তিফানোর কাছ থেকে। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ তাই হবে। কিন্তু তোমরা ধনভান্ডার উদ্ধার করলে। তোমাদের তো কিছু প্রাপ্য হয়। রাজা বললেন।

আমরা কিছুই চাই না। বুদ্ধি খাটিয়ে পরিশ্রম করে উদ্ধার করলাম এতেই আমরা খুশি। ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল।

–আপনার জন্যেই আমরা বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ রইলাম। হ্যারি বলল।

–তাহলে চলি। ফ্রান্সিস বলল।

দুজনে রাজবাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল।

পরদিন ভোরে মারিয়া রাজবাড়ি থেকে চামড়ার থলে আর কাপড়ের বোঝা নিয়ে চলে এল ফ্রান্সিসদের ঘরে। সৈন্যাবাসে গিয়ে ঘর থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে এল। প্রান্তর পার হয়ে জেলেপাড়ার ঘাটে এল। ওরা দুজন নৌকোয় উঠল। দাঁড় বাইতে লাগল ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো। খাঁড়ি পার হয়ে নৌকো দুটো সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে পড়ল। দ্রুত নৌকো চালিয়ে ওরা ওদের জাহাজের কাছে এল। শাঙ্কো ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো। সেই ধ্বনি শুনে জাহাজে ভাইকিং বন্ধুদের কয়েকজন ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। বন্ধুরা জাহাজ থেকে দড়ির মইনামিয়ে দিল। ফ্রান্সিসরা মই বেয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এল। বন্ধুরা ছুটে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়াল। সবাই জানতে চায় ফ্রান্সিস গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পেরেছে। কিনা। ফ্রান্সিস বলল–বড় ক্লান্ত। শাঙ্কো সব বললে। সবাই শাঙ্কোর কাছে এল। শাঙ্কো হাত পা নেড়ে ফ্রান্সিসের অভিযানের কাহিনী বলতে লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress