একাদশীতে উপবাস (পুরাণ কথা,বিজ্ঞান ও বেদ)
“একাদশী ” কথাটির সাথে যেমন নির্মল আকাশে অত্যুজ্জ্বল শুক্লা একাদশীর চাঁদ — মন আনন্দে ভরিয়ে দেয় বা মধ্যরাতে অভিমানি অনুজ্জ্বল কৃষ্ণা একাদশীর চাঁদ— মন কেমন করা উদাসী সুর আনে…… তেমনই “একাদশীর উপবাস” কথায় প্রথমেই হিন্দুঘরে আরোপিত সব রঙ মুছে, সাদা থান পরিহিতা বিধবা মেয়ে ও মায়েদের ছবিও ফুটে ওঠে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের লিখিত ” সধবার একাদশী” এক সফল নাটক–তখনকার “বাবু কালচার”, মদ্যপান ও বারবনিতা গৃহে যাতায়াত ইত্যাদির বিষয়ভাবাপন্ন নাটকটি মঞ্চে অভিনীত ও প্রহসনে পরিণত হয় এবং তৎকালে চূড়ান্ত খ্যাতি লাভ করে।
একাদশীতে উপবাস যদিও স্বেচ্ছায় যে কেউ নিতে পারেন কিন্ত শুধুমাত্র হিন্দু বিধবাদের প্রতি এ ছিল এক নিরম্বু উপবাসের কঠোর কৃচ্ছ্বসাধনার পরাকাষ্ঠা। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানে মাঝে মাঝে উপবাস শারীরিক সুস্বাস্থ্য রক্ষার ইঙ্গিত দেয়। তবে উপবাস বা অনাহার কিন্ত এক ব্যাপার নয়, যেমন ক্ষুধাবোধ বা খালিপেট থাকাও এক নয়।
বৈদিক কাল থেকেই বিশেষ যজ্ঞ কালে উপবাস অভ্যাস ও তার উপযোগীতার অনুসরণ রীতি ছিল ।
ব্রহ্ম পুরাণে উল্লেখ্য, একাদশীতে উপবাসের এক মাহাত্ম্য কথায় আধ্যাত্মিক উন্নতির ইঙ্গিত আছে। কেমন তা বর্ণনা করি। সাধারণত সমাজে বরাবর চামার , চণ্ডালদের হীনচোখে দেখা হয়, শুধু নীচ বর্ণ বলেই নয়,তাদের যথাবিহিত কাজকর্মের জন্য তারা ঘৃণ্য ত বটেই আবার অধার্মিক ও নিষ্ঠুর বলেও প্রচলিত উদাহরণ দেওয়া হয়। দোষটা তাদের নয়, দোষ সমাজিক ব্যবস্থার। যাক্ সে কথা, এমনই এক চণ্ডালের আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা বিবৃত আছে।
অবন্তী নগরে এক চণ্ডাল পশুর চামড়ার কারবার করতেন, তার অর্থের প্রতি কোন লোভ ছিল না, খামার চালাতে যে টুকু দরকার তাতেই খুসী থাকতেন। অবসরে সুন্দর গান গাইতেন আর প্রতিমাসে দুবার একাদশীর উপবাস করতেন। কাজ সেরে রাতভর বিষ্ণু দুয়ারে গান গাইতেন এবং সকালে কোন বৈষ্ণবকে সেবা দিয়ে নিজে আহার করতেন। এইভাবে একদিন চণ্ডাল বিষ্ণু সেবার জন্য নদীর কাছে বনেতে ফুল সংগ্রহ করছিলেন, পাশে এক বহেড়া গাছ থেকে নেমে এলেন এক ব্রহ্মরাক্ষস,চণ্ডালকে খেতে চাইলেন।
চণ্ডাল ভয় পেলেও বলেন, “আজ রাতে বিষ্ণু পূজা সেরে কাল সকালে তোমার কাছে আসব,তখন খাবে।” ব্রহ্মরাক্ষস রাজী হয় না, “না, তা হবে না। কাল যদি তুমি না আসো?” চণ্ডাল বলেন, ” আমি কথা দিচ্ছি। ঠিক আসব। আজ বিষ্ণুকে বলে আসব, কাল থেকে আর পূজো দিতে আসতে পারব না।”
ব্রহ্মরাক্ষসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, সারারাত পূজো করেন গান গেয়ে , সকালে সেই বহেড়া গাছের তলে এসে দাঁড়ালেন চণ্ডাল। ব্রহ্মরাক্ষস ত অবাক ! সত্যিই এসেছে ত! চণ্ডাল বলে , “তোমায় তিন সত্য কথা দিয়েছিলাম, তাই এসেছি, কথা দিয়ে না রাখলে মহাপাতক হয়। সারারাত শ্রীহরির পূজো করলাম, গান করলাম, বাড়িও যাই নি, স্ত্রী জানতে পারলে আসতে দিতো না।” ব্রহ্মরাক্ষস বললেন , ” তুমি বিষ্ণুর পূজো করো, আর কি করো?” চণ্ডাল বললেন, ” কুড়ি বছর ধরে পূজা করছি আর মাসে দুটো একাদশীতে উপবাস করে থাকি।” ব্রহ্মরাক্ষস ভাবলেন, তাইত এ যে মহা পুণ্যাত্মা। আমি যদি এর থেকে কিছু পুণ্য আদায় করি, তাহলে এ রাক্ষস জন্ম থেকে উদ্ধার পাই। মুখে বললেন , ” তোমার পুণ্যের কিছু আমায় দান করো যাতে এই রাক্ষস জন্ম থেকে মুক্তি পাই ” চণ্ডাল বলেন, “তুমি ত আমাকে পুরো ভক্ষণ করবে, তাহলে আমার আর পুণ্য কোথায় থাকবে, সবই তোমার হবে।” ব্রহ্মরাক্ষস কাতর প্রার্থনা করেন, পুর্বজন্মে তিনিও ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্ত নানা পাপকর্মের ফলে মৃত্যুর পর রাক্ষসযোনিতে জন্ম হয়েছে।
চণ্ডাল তখন তাকে মুক্তির জন্য কিছু পুণ্য দান করেন এক শর্তে, তিনি যেন জীব হিংসা থেকে বিরত থাকেন।
কিন্ত এ ঘটনার পর, চণ্ডালের মনে প্রশ্ন জাগে, তার নিজের কেন চণ্ডাল জন্ম হলো ? সংসার ত্যাগ করে বিন্ধ্যাচলে চলে গেলেন। চিন্তায় মগ্ন হতে হতে পূর্ব জন্মের কথা তার স্মরণ হয়।
তিনিও ছিলেন এক ন্যায়নিষ্ঠ ঋসি, কিন্ত রাগ দমন করতে পারতেন না। ক্রোধ দমন করতে না পারায় পরজন্মে হলেন চণ্ডাল। ঘটনাটি খুব সংক্ষেপে লিখলাম।
যদিও একাদশী উপবাসের কথা আছে এখানে, কিন্ত প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র একাদশী উপবাসব্রত করলেই কি সফল ধর্মলাভ হয়? না , ভক্তিযোগ ও নিজ সত্য পথ উপলব্ধির বিকাশই হলো প্রকৃত ধর্মলাভ। এখানে প্রকারান্তরে তাই বলা হয়েছে।