লাইব্রেরী বা গ্রন্থাগার
এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জ্ঞান সংরক্ষণ এবং জ্ঞানের প্রসার সরবরাহ বজায় রাখে গ্রন্থাগার। সমাজের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রন্থাগার মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় মানুষের নির্ভরযোগ্য এক সঙ্গী হলো গ্রন্থাগার।
‘সংসদ্ বাংলা অভিধান’-এর মতে, গ্রন্থাগার ( গ্রন্থ+আগার) মানে যে গৃহে নির্দিষ্ট পাঠকের জন্য বহু সংগৃহীত গ্রন্থ সাজাইয়া রাখা হয়।
গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ’Library’ শব্দটি
আমাদের কাছে পরিচিত। Library শব্দের উৎপত্তি হয়েছে মূলত ল্যাটিন শব্দ ’Liber’ থেকে। Liber শব্দটি থেকে এসেছে Librarium শব্দটি, যার অর্থ ’বই রাখার স্থান’। এর থেকে উদ্ভূত হয়েছে ফরাসি শব্দ librairie, যা অর্থ ’বইয়ের সংগ্রহ’, এখান থেকে অ্যাংলো ফ্রেঞ্চ শব্দ librarie এবং সব শেষে ইংরেজি Library। গ্রন্থাগার বলতে সাধারণত বোঝায় যেখানে তথ্য সামগ্রী সংগ্রহ করে রাখা হয়, সংরক্ষণ করা হয় এবং চাহিদা অনুযায়ী পাঠককে সরবরাহ করা হয়।
তাই বলা যায়, গ্রন্থাগার একটি জীবন্ত উপকরণ, যা অতীতের সমস্ত তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে যাতে বর্তমান প্রজন্ম তা ব্যবহার করতে পারে। এটা এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা অতীত এবং বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধন করে এবং তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে যা তথ্য সমূহের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ব্যবহার করার উপযোগী করে তোলে।
ইউনিস্কো-এর মতে,লাইব্ররীর সংজ্ঞা ”মুদ্রিত বই, সাময়িকী অথবা অন্য যে কোন চিত্রসমৃদ্ধ বা শ্রবণ-দর্শন সামগ্রীর একটি সংগঠিত সংগ্রহ হলো গ্রন্থাগার। যেখানে পাঠকের তথ্য, গবেষণা, শিক্ষা অথবা বিনোদন চাহিদা মেটানোর কাজে সহায়তা করা হয়।”
রবীন্দ্রনাথ লাইব্রেরী সম্পর্কে যা বলেছেন, তা খুব প্রাণীধান যোগ্য –
” বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে! “
কার্লাইল বলেছেন,
” The true University of these days is a Collection of Books”
( আজকের এই দিনগুলির সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হ’ল বইয়ের সংগ্রহ।)
বিধ্বংসীকারী হিসাবে ক্যালিফ ওমর বলেছেন,
“Burn the Libraries,for their value is in the one Book “
( লাইব্রেরিগুলি পোড়াও, কারণ তাদের সম্মান একটি বইতে রয়েছে।)
J. H. Shera এর মতে, “The library is an organization, a system designed to preserve and facilitate the use of graphic records.”
(গ্রন্থাগার হ’ল এমন একটি সংস্থা, গ্রাফিক রেকর্ডগুলির ব্যবহার সংরক্ষণ এবং সুবিধার্থে নকশা করা একটি পদ্ধতি। “
C. C, Aguolu & I. E. Aguolu এর মতে, ”গ্রন্থাগার হচ্ছে মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেরে নথিপত্রের সমষ্টি যেটি নানা ফরম্যাট ও ভাষায় সংগঠন ও ব্যাখ্যা করা হয়। গ্রন্থাগার মানুষের জ্ঞান, বিনোদন ও নান্দনিক উপভোগের নানা চাহিদা পূরণ করে।”
তাহলে বোঝা গেল –
”গ্রন্থাগার হলো এমন একটি সংগঠন যেখানে বই, পত্র পত্রিকাও সমজাতীয় উপকরণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হয়।”
গ্রন্থাগারের প্রকারভেদ:
গ্রন্থাগার নানা প্রকারের হয়ে থাকে। সাধারনত প্রতিষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থাগারকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১। জাতীয় গ্রন্থাগার
২। গণগ্রন্থাগার
৩। একাডেমিক গ্রন্থাগার
৪। বিশেষ গ্রন্থাগার।
১। জাতীয় গ্রন্থাগার:
জাতীয় গ্রন্থাগার সাধারণত দেশের সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। অন্যান্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সকল কারণ বিদ্যমান, এ ক্ষেত্রেও তার সবগুলো কারণ বিদ্যমান। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। আর এটি হয় এ’জন্য যে, জাতীয় পর্যায়ের গ্রন্থাগার অন্য আর দশটি অনুরূপ প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটি একটি নন-লেন্ডিং প্রতিষ্ঠান। মূলত: জাতীয় গ্রন্থাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার সংগ্রহের পরিধি জাতীয় ভিত্তিক, গুরুত্ব আন্তর্জাতিক এবং দেশ ও জাতি সম্পর্কে দেশী-বিদেশী সকল প্রকাশনা সংগ্রহ করে জাতীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করাই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
২। গণগ্রন্থাগার:
পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগার জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। সমাজের সকল স্তরের লোকের চাহিদা পূরণের জন্য এর উৎপত্তি ও বিকাশ। অন্য কোন গ্রন্থাগার এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় না। এমনকি এর মতো বহুমুখি সেবা দিতেও পারে না। সমগ্র জাতিকে পরিকল্পিত উপায়ে সাহায্য করা এর লক্ষ্য, বিশেষ করে বুদ্ধির পরিপক্কতা অর্জনে সহায়তা গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি। সমাজে সকল প্রকারের সদস্য ছাত্র, যুবক, বৃদ্ধ, মহিলা ও বিভিন্ন পেশাজীবী যেহেতু এর ব্যবহারকারী সুতরাং আবশ্যিকভাবে সংগ্রহ করা হয়ও বহুমুখী।
৩।
একাডেমিক গ্রন্থাগার: একাডেমিক গ্রন্থাগার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পাঠ ও গবেষণক প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব গ্রন্থাগারে কেবল পাঠ্য ও পাঠ্য সহায়ক উপকরণই থাকে না, পাশাপাশি বিভিন্ন রেফারেন্স সামগ্রীসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য উপকরণ সংগৃহীত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে গবেষকদের প্রয়োজনীয় পাঠ্য উপকরণ সংগ্রহের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চায় এগিয়ে যেতে সহায়তা করা।
৪।
বিশেষ গ্রন্থাগার: বিশেষ গ্রন্থাগার আসলে এক ধরনের গবেষণা গ্রন্থাগার, যাকে আমরা টেকনিক্যাল লাইব্রেরিও বলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে নানা বিষয়ে গবেষণা কর্মের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। এই গবেষণা কর্মে সহায়তা জোগানোর জন্যই বিশেষ গ্রন্থাগারের আবির্ভাব। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে তথ্য উপকরণ সংগ্রহের মাধ্যমে বিশেষ গ্রন্থাগারগুলো সমাজে এক ব্যাতিক্রমী ভূমিকা পালন করে থাকে।