আমি উমাকে দেখেছি
উমা সোরেনকে মনে আছে ?
দুচ্ছাই চেনো না , আরে যে থাকে বাঘমুন্ডির জঙ্গলে। পাহাড় থেকে শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে , আট কিলোমিটার হেঁটে গঞ্জে গিয়ে বিক্রি করতো। আনতো , একটু চাল , আলু আর পিঁয়াজ। থাকতো চারটে ডাল কেটে রুক্ষ মাটিতে কষ্ট করে পুঁতে ওপরে আর ধারে তালপাতা দিয়ে ছাউনি আর ঘরের দেওয়াল বানিয়েছিল।
এইবার খেয়াল এলো। তোমরা ওর জীবন নিয়ে একটা সিনেমা করেছিলে । যে সিনেমাটা সাড়া ফেলেছিল সমাজে , এনেছিল রাশি রাশি পুরস্কার । সিনেমার শেষে দৃশ্যগুলোতে দেখিয়েছিলে ,উমা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে আর তার সমাজের মেয়েদের উন্নতির জন্য কাজ করছে ।
ধন্য ধন্য রবে ফুলেছিলে তোমারা , আর পকেট ফুলেছিল পুরস্কারের অর্থে। টালির বস্তি বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাট কিনে চলে গিয়েছিলে। দরজার বাইরে প্রযোজকদের লাইন লেগেছিল । স্কচে চুমুক দিয়ে ভুলেছিলে উমার কথা।
আজ গল্প বলি উমার, সে কেমন আছে ।
না সেলুলয়েডের পর্দার রঙিন জীবন তার নেই।
পাথর খোদাই করা ভাস্কর্য , সুঠাম দেহ আর অল্প বয়স,তোমাদের প্রযোজকের লম্পট ছেলের নজরে সে গর্ভবতী হলো । পাড়ার ধাই নাড়ি কেটে বের করেছিল এক মৃত সন্তান , ওদের সমাজ ওকে একঘরে করেছিল। কাঠকুটো আনতে যেতে পারতো না , রাতের অন্ধকারে চোরের মত বন্য জন্তুদের উপেক্ষা করে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনতো কাঠকুটো । তারপর সোজা হাঁটা পনেরো কিলোমিটার অন্য গ্রামের বাজারে । দিন কাটছিল।ফের নজরে লাগলো পঞ্চায়েত প্রধানের। বিয়ের টোপ,ফের অন্তঃসত্তা । চাপে পরে গর্ভপাত। দিনের পর দিন চললো ধর্ষণ,বিয়েটা কিন্তু হলো না। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলের সাথে বদলে গেল রাজপাট , প্রধান গ্রামছাড়া । সমাজপতিদের বৈঠকে , উমা তকমা পেল বেশ্যা । গ্রামের বাইরে জঙ্গলের ধার ঘেঁষে তার ঠাঁই হলো। কিন্তু সে থাকবে কোথায় ? ঘর তো নেই , একটুকরো খাস জমি জুটছে । সম্বল কয়েকটা ভাঙা বাসন আর একটা কাটারি । যে কাজ সে কোনদিন করেনি কাঁদতে কাঁদতে চারটে ডাল কেটে আনলো। উমা গাছেদের খুব ভালোবাসত। গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে নিজের কথা বলতো , হাওয়তে যখন পাতা নড়তো, উমা বুঝতো গাছ তাকে উত্তর দিচ্ছে । আবাল্য প্রাণের সাথীর গায়ে সে আজ বাধ্য হলো কাটারির কোপ বসাতে , তার অঙ্গচ্ছেদ করতে । খাড়া হলো ওর ভাষাতে একটা ঘর। মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো এবার খাবারের খোঁজ। নিজের গ্রামে সে ব্রাত্য । তাই শুরু হলো জীবন সংগ্রাম । সারারাত জঙ্গলে কাঠকুটো কুড়িয়ে আর ঘরের দিকে নয় পনেরো কিলোমিটার হাঁটা অন্য গ্রামে , রোদ জল ঠান্ডার প্রকোপ সব হজম করা দু মুঠো অন্নের জন্য। ক্রমশঃ দেহ ভাঙতে লাগলো আর ধরলো রাজরোগ । কাশতে কাশতে মুখ থেকে একদিন উঠে এলো রক্ত । তখনই তোমরা দেখেছিলে উমাকে। তৈরি করেছিলে সিনেমা। শহুরে মাতব্বরেরা ওই সিনেমা দেখে ধন্য ধন্য করেছিল,পুরস্কারের বন্যায় ভেসে গিয়েছিলে। প্রচুর অর্থ ঘরে এসেছিল,শুধু ঐ সুনামিতে ভেসে গিয়েছিল উমাকে দেওয়া তোমাদের প্রতিশ্রুতি।আর , তোমাদের পায়ের ছাপ দেখা যায়নি উমার জীর্ণ ঝুপরির চৌকাঠে । ক্ষয় রোগে ভুগে আজ উমা জঙ্গলে যেতে পারে না। ঘরের সামনে বসে থাকে রাতদিন । জানগুরু টুডু হাঁসদা ভালো লোক। ওর বৌ একবেলা এসে উমার ভাঙা সানকিতে দূর থেকে খাবার দেয় আর জলের বোতলে জল ঢেলে দেয় ।তোমরা যে উমাকে দেখে সিনেমা করেছিলে , আজ তার কঙ্কাল দেখলে ঘৃণাতে মুখ ঘুরিয়ে নিতে। নিঃসঙ্গ উমা , তবুও,আজও যদি দেখে গ্রামের লোক কাটারি হাতে জঙ্গলে যাচ্ছে,অতি কষ্টে হাত জোড় করে মিনতি করে ঐ কাটারি যেন তারা গাছের গায়ে না ছোঁয়ায় ।
উমা এখন ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে জীবন প্রদীপ নেভাতে । কি শহুরে বাবুরা এখানকার উমাকে নিয়ে করবে না কি আর একটা সিনেমা ?