Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভাতৃ-দ্বিতীয়া || Piyali Parua

ভাতৃ-দ্বিতীয়া || Piyali Parua

সূর্যদেব ও দেবী সংজ্ঞার দুই পুত্র এবং এক কন্যা। মনু-যম-যমুনা। যমুনার নামটা খানিক বড়। তাই ছোটো করে সবাই ডাকে যমী। যম-যমী ছিল যমজ ভাই-বোন। আর ওই যে বড় ভাই মনু তার উত্তরসূরি হলাম আমরা। মানুষ। মানবজাতি।••••

এইটুকু বলে ফুলমাসী ফল কাটায় মন দিলো। ফুলমাসী মায়ের চোদ্দ ভাই-বোনের উপরের দিকের এক দিদি। মায়েদের বাড়ি চন্দনা গাঁয়ের ‘জমিদার বাড়ি’। অতীত হয়ে যাওয়া স্মৃতির সম্মানে আজও পরিচিত মানুষজন ‘জমিদার বাড়ি’ নামটা ব্যবহার করে। ছড়ানো ছিটানো আগানো বাড়ানো ভিটে। বাড়ি তো নয়। যেন আস্ত পাড়া একখানা। ইস্কুল বাড়ির মতন টানা শোওয়ার ঘরগুলোর একেবারে বাইরে, আলাদা করে ছিল হেঁসেলের ব্যবস্থা। মাটির ঘরে মাটির উনুন। ঝিঁক তোলা চারমুখের এত্তবড় গুহা। গায়ে গায়ে লাগান দু’খানা। মনে হতো রাত নেই দিন নেই হাঁ হাঁ করে জ্বলছে। সামনে দিয়ে ঠেঁসে পেটে পোরা একগাদা কাঠকুটো। উনুনের উল্টো কোনায় মস্ত একখানা শিল পাতা। কোনো না কোনো মশলা তাতে পেষাই হয়েই চলেছে। অন্য এক কোনে নানান সাইজের গোটা চারেক বঁটি। তার পাশে খেত থেকে তোলা ঝুড়ি ঝুড়ি আনাজ। অবশিষ্ট কোনটায় সারি সারি কাঠের তাক। কলাই’এর জার আর কিছু কাঠের। তাতে যে কতরকমের মশলা! রইল বাকি বাসন-কোসন। তখনও স্টিলের চকমকানি চমক ধরায়নি গাঁ-গেরামে। মামাবাড়ির বেশিরভাগ থালাবাসন কাঁসা পিতল।
“তোমরা সোনার থালায় ভাত খাও?”
কলকাতাবাসী নাতি নাতনীর অজ্ঞতায় হেসেছিল সবাই। ফুলমাসী পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়েছিল হাত ধরে। তেঁতুল দিয়ে ঘসে ঘসে একদল কারিগর সেখানে সোনার থালা তৈরীতে ব্যস্ত। রান্না ঘরের পিছনে খিড়কি পুকুর। এখানে শুধু বাসন মাজা, কাপড় ধোওয়ার কাজ চলে। রান্না ঘর কিন্তু একা নয়। এক্কেবারে যমজ। নিরামিষ আমিষ। দুটো রান্না ঘরের মাঝে দুখানা ঘর। একটায় শুধু কাঠকুটো, তাল খেজুর নারকেল পাতা। এটা জ্বালানি ঘর। যার তাকের উপর থেকে তক্ষক জানান দেয় ‘খক খক’ ‘ঠিক ঠিক’। দেওয়ালের অপর দিকে ভাঁড়ার ঘর। এখানে যে কি আছে আর কি নেই! সে এক গভীর রহস্য। এই দুই ঘরের দু’পাশে নিরামিষ আমিষ দুখানা হেঁসেল। নামেই দু’খানা। এই একখানা হেঁসেলের মধ্যে আধুনিক ফ্ল্যাটের চারখানা বেডরুম আরামসে ঘুমিয়ে থাকবে। দুই হেঁসেল, ভাঁড়ার আর জ্বালানি ঘরের সামনে দিয়ে লম্বা পূর্বমুখী বারান্দা। যেটাকে বলা হতো দাওয়া। অগুনতি কাঠের পিঁড়ি আর মাদুরের ছোটো চৌকো চাটাই রাখা থাকত। তবে বাবা অথবা বাড়ির জামাই স্থানীয় অভ্যাগতদের জন্য ছিল উল দিয়ে ফুল তোলা চটের আসন। কি অপূর্ব তার শিল্পকর্ম। যেকোনো অনুষ্ঠানে চোখ বন্ধ করে এই টানা দাওয়ায় সত্তর পঁচাত্তর জন সারি বেঁধে খেতে বসতাম। এবার আমরা এসেছি ভাইফোঁটায়। মা আমি আর ভাইটি। বাবা গেছে পিসিদের কাছে। তাই অন্য মেসোরা বারবার বাবার কথা বলছে।
সকাল থেকেই আজ সাজো সাজো রব। জমিদার বাড়ির প্রথা মেনে সকাল হয় সূর্য ওঠার আগেই। ভোর চারটেয়। কার্তিকের ভোরে শিরশিরে ঠাণ্ডা। আমি ঘুম কাতুরে। উঠতে ইচ্ছা করে না। তবে এখানে সবাই নিয়ম মেনে চলে। নিয়ম ভেঙে রক্তকরবী ফোটানোর কল্পনা নিতান্তই নন্দিনী হওয়ার দুঃসাহস। অনিচ্ছাতেও কয়েদ সংখ্যা মেনে নিই রাজার প্রজা হয়ে। অমলের বন্ধ ঘরে সুধা হয়ে ফুলেল মুক্ত বাতাস বয়ে আনে ফুলমাসী। কত গল্প যে জানে! আমি তাই ফুলমাসীর আঁচল ধরা। এতো সকালেও তার স্নানের পুকুরে ডুব কাটা সারা। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল কানের দু’পাশ থেকে নিয়ে গিঁট বেঁধে পিঠে ছড়িয়ে রাখা। চওড়া সিঁদুর। ছোট্ট কপালে বড় টিপ। টিকোলো নাকে চকচকে পাথরের নাকছাবি। হীরে কি! জানি না। মুক্তো মুখে হীরের মতো ছটাটুকুই চোখ টানত। তুলি আঁকা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। আটপৌরে করে পরা শাড়ির আঁচলে একগোছ চাবি। আমি জানি ছুঁয়ে দিলে আবার স্নান করতে হবে ফুলমাসীকে। ভাইফোঁটার জোগাড় করছে যে। এ বাড়িতে নিয়মের এতটাই কড়াকড়ি। টানাটানি করতে না পেরে আমি তাই অধৈর্য্য হয়ে শুধাই;
“তারপর বলো না। মনুর বংশধর আমরা। আর যম যমীর গল্প!”
স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসি ছড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণ সাধিকা মাসীর শরীর ঠিকরে। গল্প শুরু করে স্নিগ্ধ মৃদুতায়।

••••• একসময় একসাথেই বড় হয়ে উঠল যম যমী। যমুনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের সাথে। কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে। যমুনা চলে যাবে দূর দেশে। মনে ভারি দুঃখু। অনেক ভেবে এক উপায় বের করল। মনের শান্তির জন্য। বিয়ের আগে মনু আর যম দুই ভাই’এর কপালে ফোঁটা এঁকে মঙ্গল প্রার্থনা করে বোন। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত হলো, ভাই বোনের পবিত্র উৎসব “ভাইফোঁটা”। বিষ্ণুপুরাণে আছে এই গল্প।

আর সেই বছর। যেবার আমরা জাহাজ বাড়িতে। কালীপুজোর ছায়া ধরে এসে গেল ভাইফোঁটা। কচিদাদু শোনাল বামনপুরাণের অন্য এক আকর্ষণীয় পৌরাণিক কাহিনী।

°°°°° পাতাল-রাজ প্রবল পরাক্রান্ত “বলি”। একসময় তার হাতে বন্দী হন স্বয়ং ভগবান‌ শ্রীবিষ্ণু। বিপদে পড়ে দেবকুল শরণ নেন লক্ষ্মী মাতার।
দেবী লক্ষ্মী বলিকে আহ্বান জানান বৈকুণ্ঠে। কার্তিক মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে। স্বীকৃতি দেন ভাই বলে। কপালে দেন মঙ্গল তিলক চিহ্ন। ভাতৃত্বের বন্ধন স্বীকার করে নেন বলিরাজও। নতুন সম্পর্ককে সম্মানীত করতে উপহার দিতে ইচ্ছুক হন তিনি। আশীর্বাদী রূপে স্বামী নারায়ণের মুক্তি চেয়ে নেন দেবী।
প্রচলন হয় ভাই-বোনের মধুর এই রীতি “ভাইফোঁটা”।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress