শনকা – 1
রঙ্গনার কাছে দাঁড়াতে বলেছিল প্রভাস। ঠিক দুটোয় আসবে গাড়ি । গাড়ির নম্বরডব্লিউ বি-এম- থ্রি-জিরো-জিরো-টু। অফ্ হোয়াইট অ্যাম্বাসাডর।
বার বার ঘড়ি দেখছে শনকা। আজ খুব সেজেছে। অবশ্য ইচ্ছে করেই এ সাজ। মাসটা নভেম্বর । তাই দুপুরের রোদ টা গা সওয়া লাগছে । দামী ঢাকার মসলিন পড়েছে । শাড়ি টা মাসী এনেছিল । এর নাম নাকি ‘সবনম’। ইরানী শব্দ,অর্থ সান্ধ্য শিশির । আরও গভীর সব অর্থ। মাসী বুঝিয়েছিল,যে শাড়ি টা শিশিরে ভিজিয়ে ঘাসের উপর বিছিয়ে দিলে এটার কোন অস্তিত্বই বোঝা যাবে না । মনে হবে শিশির ছড়িয়ে পড়েছে ঘাসে। ভাগ্য ভালো শাড়ি তে ফিলিগ্রি করা আছে,মানে রূপোর তারের কাজ করা আছে । তাই শরীরে কিছু টা আব্রু আছে । মাসীর থেকে আরো শোনা যে ইতিহাসে উল্লিখিত আছেযে,
আওরঙ্গজেবের কন্যা সাত ফের দিয়েআবরোয়ান মসলিন পড়ে পিতার সামনে যাওয়ায় ,নির্লজ্জা বলে ভর্ৎসিতা হন।
আবরোয়ান ইরানী শব্দ। যার অর্থ জলস্রোত। জলের মধ্যে মিলিয়ে যেত বলেই এর নাম ছিল আবরোয়ান। মসলিন যে এতো রকমের আছে তা জানা ছিল না শনকার। সবচেয়ে আশ্চর্যের মনে হয়েছিল এই কারণেই যে বিখ্যাত ঢাকাই মসলিন আমাদের ভারতে তৈরী।
দক্ষিণ ভারতের মছলিপত্তনম বন্দর এই এর উৎপত্তি। ঐ বন্দর হতেই ইওরোপীয় বনিকেরা মসলিন বস্ত্র কিনে নিয়ে যেতেন। রোমের মেয়েরা নাকি ঢাকাই মসলিনের অনুরাগী ছিলেন। এসব অবশ্য শণকা এরিয়ানের “পেরিপ্লাস অব দা ঈরিট্রিয়ন সী” নামেরএকটা বইয়েপড়েছে। ভ্রমণকারী ট্রাভার্নিয়ার লিখেছেন যে ইরানের দূত মহম্মদ আলিবেগ, ভারত থেকে ফেরার পথে শাহকে উপহার দেয়ার জন্য ষাট হাত লম্বা একখানা মসলিন, একটা নারকেল মালায় করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ মসলিন এক গজ প্রস্থ, কুড়ি হাত লম্বা। একটা আংটির মধ্যে দিয়ে নেওয়া যেত।
শাড়ি টা কোনো’ অনুষ্ঠানে পড়ার কথা মনে হয় নি। শণকার কি করে যে শাড়ি বাছার সময় এইশাড়িতে হাত চলে গেছে আজ ভেবে অবাক শণকা। যাক গে এখন আর কিছুই করার নেই। মাসী বলেছিলো ,”পুরুষের মন জয় করতে এই শাড়ি পড়তে হয়,বুঝলি”? তাই কি শণকা এই শাড়িটা আজ বেছেছে?ছিঃছিঃ ,কি করে যে এটা হলো! ভেতরের চোলি কাট্ এর ব্লাউজটা শরীরের খাঁজে খাঁজে বসে আছে । শণকা লোভী পুরুষগুলোর নগ্ন দৃষ্টিতে বুঝতে পারে । যেন শণকা রাস্তায় পশরা সাজিয়েছে। বুকের কাছে শাড়ির ভাঁজগুলো ভালো করে দেখে নিল।নাঃ সব ঠিকঠাক পাট পাট আছে । কুঁচির দিকে মনোযোগ দিতেই গাড়ির হর্ণটায় ওর মনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । গাড়িতে বসা একজনের অশালীন দৃষ্টি ওর দিকে। ঐ চোখের দৃষ্টিতে অন্য ইঙ্গিত। ভয় পায় শণকা। এরই সঙ্গে যেতে হবে না কি? গাড়ির নম্বর দেখে নেয় এক লহমায় । মনে হয় প্রভাসের দেওয়া গাড়ির নম্বর আর তার সাথে মালিকের চেহারার বিবরণ। না এ গাড়ি তার জন্য নয়। অশালীন লোকটা হঠাৎ ই দরজা খুলেছে দেখে ভয় পেলো শণকা। আজকাল যা কিডন্যাপিং হচ্ছে । হ্যাঁ,লোকটা ওর দিকেই এগিয়ে আসছে । ভয়ে শণকা গাড়ির পেছন থেকে রাস্তার ওপারে যেতে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই একটা অফ্ হোয়াইট অ্যাম্বাসাডর ওকে বাঁচাতে ব্রেক কসলো। ভেতরের পুরুষের আভিজাত্যের ছোঁওয়া দেখে শণকার সন্দেহ হল । এই সে নয়তো? ভয়ে পিছিয়ে এলো শণকা । দেখলো আগের গাড়ি তখন ও দাঁড়িয়ে । এই মানুষটির ও শণকার প্রতি ঔৎসূক্য তা বোঝা যাচ্ছে । শণকা, আগের ড্রাইভার এর দিকে তাকাল । না আগের জন থমকে গেছে নতুন গাড়ির আগমনে। প্রভাসের দেওয়া নম্বরের সাথে এই গাড়ির নম্বর মিলে যাচ্ছে । চট করে পিছনের দরজার হাতলে হাত রাখলো শনকা। কিন্তু গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারলো না । কারণ ভেতর থেকে লক করে রেখেছে ভেতরে বসা সেই মানুষটি । এবার তিনি সামনের দরজা খুলে শণকার অপেক্ষায় রয়েছেন। সামনেই বসলো শণকা । নাচতে নেমে ঘোমটা মাথায় দিয়ে লাভ নেই । অতীতে ফিরে যায় এই কি সে? যাকে খোঁজার তাগিদে শণকা ছুটে চলেছে এই অচেনা পুরুষের সাথে।
শণকার ইউনিভার্সিটি র বন্ধু প্রভাস। খুব ভাল ছেলে প্রভাস। ওরই দাদার বন্ধু এই অরিন্দম চৌধুরী সদ্য বিলেত ফেরত ডাক্তার । ফেরত বললে ভুল বলা হয়। দিদিমা অসুস্থ ,তাই বোধ হয় কয়েক মাসের জন্য এদেশে আসা। দিদিমা অসুস্থ তাই বুঝি কয়েক মাসের জন্য এদেশে আসা। দিদিমা ছোট থেকেই অরিন্দম চৌধুরীকে মানুষ করেছেন। ওর বাবা থাকতেন লক্ষ্নৌ । সেখানে মরিস কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ওর বাবা । শিশু কাল থেকেই মাতৃপিতৃ হারা অরু দিদিমার কাছে মানুষ হয়েছে ডায়মন্ড-হারবারে। সেখানে দিদিমার বিশাল বাড়িতে থেকে সব পড়াশুনোর পাঠ শেষ করে । সেখানেই যৌবনের ঘোর লাগা চোখে ভালো লাগল তিতিরকে ভালোবেসে ফেলে অরু। সেই শুরু যখন তখন তিতিরের বাড়িতে যাওয়া । তিতিরের মা ভালোবেসে ফেলেছেন মাতৃহারা ছেলেটাকে। তিতিরের বাবা না থাকায় দাদারা সংসারের হাল ধরেছে । বড়দা পি-জি হাসপাতালে কাজ করেন । ছোড়দা বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ান। দুই মেয়ের বিয়ে তিতিরের বাবা দিয়ে গেছেন । ছোট দুই ভাই অঘোর আর অমর । অরুদার সাথে তিতিরের ফস্টিনষ্টির সাহায্যকারী দুই ভাই অঘোর আর অমর । মায়ের কড়া নজর থেকে দিদিকে বাঁচানো ওদের কাজ । কারণ দিদির অরুদাকে ভালোবাসার খবর, মা যেন টের টি না পায়। দিদির যে অরুদাকে ভালো লাগে তা বুঝতে পারতো ওরা। তাই দিদিকে যেন তেন প্রকারেন সাহায্য করা ওদের কাজ। বড়দা অলক ও ছোরদা অলিক। এরা অরুকে পছন্দ করে না। হয়তো বা বোনের ভাব ভঙ্গিতে ওদের ব্যাপারটা বুঝতে বাকি থাকে নি। দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর পার হয়ে গেছে । অরু এম,বি,বি,এস, করেছে । তাই এবার তিতিরের দাদাদের অরুর প্রতি বিরক্তির পরিমানটা একটু কমেছে ।
তিতিরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর হঠাৎই ঠিক হল বাংলাদেশ বেড়াতে যাওয়া। কয়েকদিন ওদের বাড়ি না আসায় অরু জানতে ও পারেনি যে ওরা বাংলাদেশ বেড়াতে গেছে । তিতির অরুকে সে কথা বলার সুযোগ ও পায়নি। তাই অরু ভীষণ রেগে গিয়েছিল তিতিরের উপর। তিতিরের ফিরে আসার পর ও অনেক দিন ওদের বাড়ি যায় নি অরু। তিতির লুকিয়ে কান্না কাটি করেছে। নজর এড়ায়নি ছোট দুই ভাই ,অঘোর আর অমরের । ছোট ভাইরা দিদিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে দিদির হয়ে বলেছে——‘আমি মেরেছি তাই দিদি কাঁদছে ‘। সেজন্য ছোট দুই ছেলেকে অনেক বকাবকি শুনতে হয়েছে । কিন্তু তিতিরের মা আশ্চর্য হয়ে গেছেন সে কথায় । কারণ দিদির প্রতি ওদের ভালোবাসার কথা মায়ের জানা । মা সন্দেহের চোখে সরে গেছেন । পরে অঘোর মাকে রাজী করিয়েছে দিদিকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়ার কথায় ।
– মা ,দিদির মন খারাপ। তাই দিদিকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখতে যাই? মায়ের সম্মতিতে অমর কে দিয়ে অরুদা কে খবর পাঠিয়েছে।অবশ্য অরুর যাওয়ার কথা মায়ের কাছে গোপন করেছে। পরের পরের দিন ঠিক সময়েই অঘোর আর তিতির বাসে করে চলে আসে বেহালার অশোকা সিনেমা হল এর কাছে । নেমে দেখে অরু গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে । তার মানে অরুদার রাগ এখনও পড়েনি। তাই অঘোর নিজেই তদ্বির শুরু করে দেয় অরুদাকে পটাতে।
– অরুদা,তুমি আর দিদি কোথাও ঘুরে এসো। সিনেমা তো দেরি আছে । এতক্ষণে অরুর দৃষ্টি ফেরে তিতিরের দিকে । অরু বলে—-তোর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না । এক সঙ্গে চল । গাড়ি এনেছি । গাড়ির কথায় অঘোর নেচে উঠল । কতই বা বয়স অঘোরের , সবে সতেরো । তাই হলো ,দিদিকে সামনে বসিয়ে নিজে পিছনে বসেছে । অঘোর হঠাৎ ই উল্লসিত হয়ে বলল ।
– অরুদা তুমি দিদিকে বিয়ে করবে? লজ্জায় তিরিশ মাথা নিচু হয়ে গেল । কি যে বলে অঘোরটা। এক ফোঁটা যদি বুদ্ধি থাকতো!ভাবে শণকা। অঘোর আবার বলে।
– সত্যি বলছি । কাল দিদি তোমার জন্য কাঁদছিল। অরুর মুখে দুষ্টু হাসি । বলে—তোর দিদি রাজী থাকলে এখুনি বিয়ে করবো। অঘোর দিদির মাথা নিচু দেখে চিৎকার করে বলল।
– দিদি রাজী। সত্যিই কাল দিদি তোমার জন্য কাঁদছিল। দিদিকে কষ্ট দিও না অরুদা। গাড়ির গতি ক্রমে বাড়তে লাগল। ওরা পৌঁছলো কালী ঘাটের মন্দিরে । ওরা সেখানে কি পুজো দিতে এলো? মালা পুজোর ডালি নেওয়া হল। অঘোরের মাথায় চিন্তা! অরুদা কি এখন ই দিদিকে বিয়ে করার কথা ভাবছে! কিন্তু, এ কি! সিঁদূর দান কি এখন ই হবে? অঘোরের ভয় করছে। অরুদা কি এখন ই দিদি কে বিয়ে করার কথা বলেছে! হত বাক অঘোর। ভয়ে অঘোর বলল- তুমি কি এখনই দিদিকে বিয়ে করবে নাকি? কিন্তু কেমন যেন ভয় পায় অরুর ভাব সাব দেখে । হতবাক অঘোর ! এ কী ! এতো সত্যি সত্যিই বিয়ে হচ্ছে!! মুখ দিয়ে কথা বের হলো না অঘোরের। অঘোরের কি কন্ঠ রোধ হয়ে গেল? সত্যিই দিদির বিয়ে হয়ে গেল । মালা বদল, সিঁদূর দান সবই একে একে হয়ে গেল। কিন্তু এ তো একেবারেই অসিদ্ধ বিয়ে? এবার দিদির কি হবে? কেন যে বিয়ের কথা বলতে গেল অঘোর!এবার বাড়িতে কি বলবে ওরা! আবার চলতে শুরু করল । অঘোর একটু একটু করে ধাতস্থ হলো । এটা তুমি কি করলে অরুদা? কারোকে না বলে এভাবে দিদিকে বিয়ে করলে? তুমি তো বিদেশে চলে যাবে । দিদির কি হবে? বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অঘোর । অরু বলল- দূর বোকা । এটাও সত্যি বিয়ে । এখন কারো কে বলার দরকার নেই। লন্ডন থেকে ফিরে এসে তোর দিদিকে জাঁকজমক করে নিয়ে আসব।
পেছনে অঘোর আর সামনে তিতির কে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে অরু। পেছন থেকেই অঘোরের নজরে পড়ছে অরুদার বাঁ হাতের ওঠা নামা। দিদি টা কেমন পাল্টে গেল। অরুর দা কে কিছুই বলছে না কেন?
এখন অঘোরের মাথা থেকে সিনেমার কথা লোপাট হয়ে গেছে। ডায়মন্ড হারবার পৌঁছৈ অরু তিতির কে বলল।
– চল ,আমাদের আউট হাউজে মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নেবে । সিঁদূর মুছে ফেল। অঘোর তুই গাড়িতে বস। আউট হাউজের ভেতরে তিতির চলে গেল। অরু ও সঙ্গে গেল। ভেতরে গিয়েই তিতিরের কম্পিত শরীরটা টেনে নিল নিজের বুকে । কপালে এঁকে দিল চুম্বন।
বলল- ভয় নেই। এফ আর সি এস করে ফিরে আসব তোমার কাছে। অপেক্ষা করো আমার জন্য। নিজের হাতের হীরের আংটি তিতিরকে পড়িয়ে দিল। ওদের বেড়িয়ে আসতে দেরি দেখে অঘোর ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই ওরা বেড়িয়ে এল। লজ্জা জড়ান তিতিরের অবনত নজর। অঘোর চেয়েই আছে তিতিরের দিকে । এই দিদিকে অঘোর চেনে না।
Khub bhalo laaglo