মিলন
” কাঁদতে কাঁদতে জনম গেলো
জীয়ন্তে মরন,
পিরিতি এত জ্বালাতন।
আশা করে পিরিত করে
শেষে জ্বলে পুড়ে মরে
নগরে বাজারে ঘুরে
পাগলের মতন—–‘”
অদ্ভুত মায়াবী কন্ঠের স্বর! স্বরটা বুকের গহীনে অনুরণন তোলে। কংসাবতীর উদাস ধূ ধূ চরে গানটা যেন মনকেমনিয়া সুরে ভেসে বেড়াচ্ছে।ফৌজদার দের পাগল ছেলেটা আসছে—-এক মাথা উমনো ঝুমনো চুল আর বড় মায়াবী দুটি চোখ। অদ্ভুত মনকাডা গলা। বনতালসির ফৌজদার রা বড়গুনী। মল্লভূমি রাজের সেরা শিল্পী থাক যে। তাদের বাড়ির ছেলে এই কানাই— হাত যেন কথা বলে— পোড়ামাটি আর পঙ্খ দুয়ের কাজেই ওস্তাদ। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। বাবা আবার সংসারী হয়ে বিষ্ণুপুরে চলে গেছে। ছেলেটা ছোট থেকেই দাদু ঠাকুমার আশ্রয়ে। দাদু রঘু সর্দারের শিল্পের উত্তরাধিকার ওই পেয়েছে। আর পেয়েছে বাউল মনোবৃত্তি টাও। কাজ আর গান এই ওর জীবন। দাদু ঠাকুমার চাইতো ওকে সংসারী করতে। ওতো ছোটবেলা থেকেই বৃন্দা কে ভালোবাসে। বৃন্দা—- ফৌজদার জোতদারের মেয়ে। এই অসম প্রেম কেন মানবে সমাজ? ফলে জোর করে বৃন্দার বিয়ে দেয় বাড়ির লোক। তখন থেকেই কানাইয়ের বাউন্ডুলেপনা আরো বেড়ে গেছে। বিষ্ণুপুর রাজের মন্দির তৈরীর কাজে যোগ দিয়ে ঘর ছাড়া হয়েছেও। কোন পিছুটান তো নেই তাই মাঝে মাঝেই বাউল ফকিরদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। আজ যেমন কাঁসাইয়ের চরে বাউল আনন্দের আখড়ায় যাচ্ছে। আনন্দ আখড়ায় বাগানে গাছ পরিচর্যা করছিল। দূর থেকে কানাইয়ের গান ভেসে আসতে মাথা নেড়ে হেসে বলল” পাগল একটা”। বাঁশের আগড ঠেলে আখড়ায় ঢুকে কানাই– আনন্দ গলা মেলায় ওর সাথে—জীয়ন্তে মরণ পিরিতির এত জ্বালাতন।
এসেই জিজ্ঞাসু মায়াবী চোখ দুটো তুলে ধরে আনন্দের পানে—- কৌতূহলের সাগর যেন টলমল করছে দুচোখে! আনন্দ দুহাতে জড়িয়ে কানাই কে বলে—” ভালো আছে রে, চিন্তা করিস না”!
আনন্দ বৃন্দা কানাইয়ের ভালোবাসার বৃন্দা দূতী ছিল। এখনো বৃন্দা র শ্বশুরবাড়িতেও যাতায়াত আছে ওই খবর জানতে কানাই আসে মাঝে মাঝে।
বড় কষ্ট হয় কানাই কে দেখলে। এই গানটাই সব সময় গুন গুন করে কানাই। পিরিতে জিয়ন্তে মরেছেও।
দেখতে দেখতে দন্ড পলের হিসেবে কেটে গেছে দু যুগ। আনন্দ বাউলের আখড়া এখন কানাই ওস্তাদের আস্তানা। পোড়ামাটি পঙ্খের কাজ সাথে সাথে গান— এইতো জীবন কানাইয়ের! আজও বৃন্দার অপেক্ষায় আছে কানাই মনে মনে। আনন্দ বাউল দেহ রাখার পর আর বৃন্দার খবর পায় নি ও। খোঁজখবর ও করে নি। বিশ্বাস ভালবাসা আসল হলে ঠিক এই বিরহের অন্ত হবেই।
জন্মাষ্টমী রাতে আসর বসেছে— লোকগানের— পুজোর সাথে সাথে লোকে সারারাত জেগে গান শোনে। একতারা দোতারা খমক ডুবকির তালে সারা আসর জমজমাট। কানাইয়ের মরমী গলা ভেসে আসছে—
” কাঁদতে কাঁদতে জনম গেলো
জীয়ন্তে মরন—
পিরিতির এত জ্বালাতন—- হঠাৎ দর্শকের ভিড় থেকে দোহার কি করে কেউ গেয়ে ওঠে—-
আশা করে পিরিত করে
শেষে জ্বলে পুড়ে মরে
নগরে বাজারে ফেরে
পাগলের মতন
পিরিতির একি জ্বালাতন—- দেখে মধ্যবয়স্কা বৃন্দা, নাকে রসকলি গলায় কণ্ঠি হাতে একতারা– কানাই এগিয়ে এসে হাতে ধরে আসরেনিয়ে আসে তাকে। যুগলে গেয়ে ওঠে—” মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে”
দুজনের চোখেই আনন্দের অশ্রু!!