মানবিক মুখ
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়। সকাল দশটা সাড়ে দশটা হবে। প্রচণ্ড ব্যস্ততা সারা এলাকা জুড়ে। গাড়ি ঘোড়া ভর্তি। একদিকে গাড়ির সিগন্যাল খুললে আরেকদিকে সিগন্যাল বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যস্ততার মধ্যেও লোকজন নিজেদের বাঁচিয়ে এ গাড়ি ও গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পারাপার করছে। জীবনের ঝুঁকি রয়েছে তবুও এটাই এখানকার নিত্যদিনের ব্যাপার।
এই শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়েই আজ ডিউটিতে আছেন ট্রাফিক সার্জেন্ট অনিমেষ রায়। নিজের এনফিল্ড বুলেটটাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে তার উপরেই বসে আছেন উনি। কোনরকম বেচাল দেখলেই নিজের ওয়াকিটকিতে নির্দেশ পাঠাচ্ছেন।
এই অনিমেষ রায় একটি বর্ণময় চরিত্র। সুপুরুষ বছর পয়ত্রিশ বয়স। প্রায় ছয় ফিট উচ্চতা। দেখতে একেবারে রাজপুত্র। সেই সাথে ব্যাকব্রাশ করা চুল। দেখলেই বোঝা যায় স্কুল কলেজে পড়াকালীন উনি নিশ্চিতভাবেই প্রচুর মেয়ের ক্রাশ ছিলেন। এই যে এখন উনি গাড়িতে বসে আছেন তাতেও রক্ষা নেই। পথচলতি মানুষজন ওনাকে লক্ষ করছে। উনি অবশ্য এটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছেন।
উনি গাড়িটাকে দাঁড় করিয়েছিলেন ভূপেন বোস এ্যাভিনিউয়ের দিকে। হঠাৎ ওনার চোখে পড়ল বছর দশ বারোর একটি মেয়ে একা ছুটে রাস্তা পার করছে। আর ঠিক ওর পেছনে একটা বেসরকারি বাস দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে সিগন্যাল খোলা পেয়ে। মেয়েটি রাস্তা পারাপার করতে করতে হঠাৎ বাঁ দিকে চোখ যেতেই ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর দ্রুতগামী বাসটা প্রায় মেয়েটিকে ধাক্কা মারবার মতো অবস্থায় চলে এসেছে। অনিমেষ আর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের বাইক থেকে অতি দ্রুততার সাথে নেমে এলেন এবং একটা দৌড় দিলেন। মেয়েটিকে বাজপাখির মতন ছোঁ মেরে কোলে তুলে রাস্তা পেরোতে গেলেন। কিন্তু শেষরক্ষা মনে হয় হলো না। উনি রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন। আর বাসটি ওনার পায়ে চুমু খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
বাসটি দাঁড়িয়ে যেতেই উনি উঠলেন। উঠে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে রাস্তার একপাশে এলেন।পড়ে যাবার সময় বাচ্চা মেয়েটির কোথাও চোট লেগেছে কিনা দেখলেন আর পাশের ওষুধের দোকান থেকে মেয়েটির প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে নিলেন। ততক্ষনে মেয়েটির বাবা মা ওখানে চলে এসেছেন। অনিমেষ বাবু ওনাদের রীতিমতো বকাঝকা করে বাচ্চাটিকে ওনাদের হাতে তুলে দিলেন।
এত কিছু হবার পর উনি নিজের দিকে তাকালেন। দেখলেন পায়ের গোড়ালিটা ফুলে উঠেছে এবং পা মাটিতে ফেললেই ব্যথা করছে। তবুও ওনার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। হাসিটা একজনের প্রাণ বাঁচাতে পারবার হাসি।