নদী কথায় কংসাবতী
আমাদের জঙ্গলমহলের আদরের মেয়ে কাঁসাইয়ের পরান কথা শোনাবো আজ। পুরুলিয়ার ঝালদার পাহাড় ঝাবরবন এখানেই কাঁসাই নালা রূপে এর উৎপত্তি। শাল মহুয়া পলাশ শিমুলের সোহাগী সবুজে ঢাকা টাঁড চাট্টানের উঁচু-নিচু ডুঙ্গরি টিলায় ছোট্ট কিশোরীর মতো নেচে চলেছে কাঁসাই—- পাশের অযোধ্যা পাহাড় থেকে নামা সাহারঝোরা এসে মিলেছে এর সাথে। কিশোরী-তরুণী হয়– কংসাবতী নামে তার চলন। ভারী সুন্দরতার পরান কথা। কালিদাসের মেঘদূত’ ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যে একে “কপিশা “নামে উল্লেখ করা হয়েছে! কথিত যে কংসাবতীর রূপে মুগ্ধ সাগর—- তাই সমুদ্রের বাগদত্তা ছিল কাঁসাই— নদী কংসাবতী! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দামোদর নদের রূপে তাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলে কংসাবতী দ্রুত ধাবমান হয়ে সমুদ্রে মিলিত হন! তাইতো তার প্রবাহ পথের দূরত্ব এত কম!
শিখর ভূমের রুখু পাথুরে মালভূমির মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীর তীর কখনো পান্নাসবুজ কখনো ধূসর। ডুঙ্গরি টিলা চাট্টানের ভূমিরূপ প্রকৃতির সাথে সাথে রং বদলায়। বসন্তের ফুলের আগুনে সারা জঙ্গল পাহাড় ভেসে যায়। শাল মহুয়ার সুবাসে মাতোয়ারা হয় প্রকৃতি। আদিবাসী মাদলের দ্রিম দ্রিম বোল আদিবাসী সারিন্দার মধুর ধ্বনিতে মুখরিত হয় কাঁসাই তীর। জঙ্গলমহলের বড় আদরের দুলালী সে— যেখান দিয়ে সে বয়ে চলেছে দু’তীরে সোহাগী সবুজে তীরভূমি কে করেছে লাবণ্যময়ী। রুখু প্রকৃতিতে শান্তির প্রলেপ লাগিয়েছে সে। শাল মহুয়া পলাশের বনে তার কি অপরূপ বিস্তার। তবে সে যেন এই জঙ্গল ভূমির মাটির মেয়ে ,বড় খেয়ালি, বড় অভিমানী! বর্ষায় হঠাৎ বানে ভাসিয়ে নিয়ে যায়
দুই তীর আবার জল কমলে চলে যায় নিজের আপন খাতে। কাহার কন্যার মত উদ্দাম তার ভালোবাসা— এই ভাঙছে এক কূল তো গডছে অন্য কূল । প্রবাহ পথের পরিবর্তনে ভূমিরূপকে করছে নবরূপে অলংকৃত। নদী যেখানে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছে কি তার রুপ। পাখির কলতানে মুখরিত জীবন্ত বনভূমি। নদী চরে পানকৌরি বালিহাঁসের আড্ডা। দলমার দামাল হাতির পাল করে জলকেলি। সন্ধ্যা নামলে চখাচখি চলে যায় দুকুলে। রাক্ষসী বেলার রক্তরাগ ডানায় মেখে পশ্চিমে উড়ে চলে বকের ঝাঁক। সন্ধ্যাতারার উদয়ের নিশি টহলে বেরোয় পেঁচা দম্পতি । এই নদী যে জঙ্গলমহলের প্রাণ ভোমরা। লোধা শবর সাঁওতাল কুড়মিদের বড় আদরের ধন। নদী তাদের মাতৃরূপা ,নদীর মীন ফসল তাদের জীবন ধারণের হাতিয়ার। মাছের শেষ নেই— পাবদা, পুঁটি, চেলা কালবোস ,চিংড়া—- মন ভরে যায় ,ভরে যায় খালুই ও।
নদীর ঘাটে ঘাটে ঋতুবদলে চলে লোক উৎসবের ধুম। হৈমন্তী ফসলের ডালা উপচানো দুই তীরে বসে মেলা —নবান্ন ,টুসু কিংবা মকরসংক্রান্তির ধূম লাগে ।
টুসু গানে মুখরিত হয়ে ওঠে কংসাবতী নদীর ঘাট।
চৌদলের রংয়ের মেলায়, টুসু গানের সুরে নদীতীর ভেসে যায়। উত্সব ছাড়াও নদীতীরের সাপ্তাহিক হাটে চলে মোরগ লড়াইয়ের উদ্দীপনা। ভূমিপুত্র দের আমোদের এক প্রধান উপকরণ এই মোরগ লড়াই।
নদীতীরের বড়াম থানের হাতি ঘোড়ার ছলনে খেলা করে রৌদ্রছায়ার মীনাকারি। মানতের ছলনের স্তুপ জমা হয় আটনে। নদীর চর জাগা বুকে শিউলির অস্থায়ী ছাউনিতে নলেন গুড়ের সুবাস– মিষ্টি সুবাস মাখা হিমেল বাতাসে ম ম করতে থাকে সারা চরাচর । কার্তিকে বাঁদনা পরব এর উচ্ছলতা আহিরার গানের সুরে ঝুমুরের বোলে, ভেসে যায় কংসাবতীর তীর। মনসা থানের বিষম ঢাকির ধুমূলে জেগে ওঠে নদীর চর।
তুমডি বাঁশির সুরে, বেদেনীর গানে ,ভাসান মেলা জমে ওঠে! বামুনডিহা নদীর বাঁকে যেখানে কাদা কাল বালিখাল মিলেছে সেখানে “সাতবউনির থান।” পৌষসংক্রান্তিতে মেলা বসে।
মকর সংক্রান্তিতে নদীর ঘাটে ঘাটে উৎসবের ধুম। দামোদরের আলিঙ্গনের ভয় ভীতা কাঁসাই ছুটে চলে সাগর পানে। দু শাখায় ভাগ হয়ে এক শাখা পালার পাই নামে রূপনারানের দিকে গেছে অন্য শাখা কেলেঘাইএর সাথে মিশে হলদি নামে সাগরে মিশেছে।
এই কাসাই কুলের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে আনন্দ যাপন। হাতের অঞ্জলিতে তাকে কুড়িয়ে নিয়েছি বেঁধে রেখেছি কালি কলমের বন্ধনে।
লোক কবিদের আহিরার সুরে ভেসে চলে সরল মানব জীবন দর্শন—-
ভালা আহিরে — মানবজীবন ভালা
ঝিঙা ফুলের কলিরে—বাহ হো
সাঁঝে ফুটে বিহানে মলিনঅ রে।
শীতের নিলুয়া বাতাসে ভেসে বেড়ায় লোক সুর
কাঁসাইচরের বেনা ঘাসের জঙ্গলে, সর্ষের হলুদ ফুলে, পাকা ধানের সোনার অঙ্গে কাঁপন ধরায়—- নটরাজের জপমালার কাল চক্র ঘুরে চলে আপন খেয়ালে।