Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিঠুর নিদয়া মিষ্টি হৃদয়া || Musharraf Khan

নিঠুর নিদয়া মিষ্টি হৃদয়া || Musharraf Khan

একি রাহাত! টানা তিন মাসের ছুটি চাইছো?
দুই চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল হিউম্যান রিসোর্সের রূপসী কন্যা এ্যাঞ্জেলা লু।
– এত লম্বা ছুটি নিচ্ছো কেন? বিয়ে করতে যাচ্ছো নাকি?
– আরে ধুর! বিয়ে আর কে করে আমাকে! তোমার পেছনে ঘুর ঘুর করেই তো সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। একেবারেই পাত্তা দিচ্ছোনা।
– জায়গা খালি নেই রাহাত মিয়া। পুরানো বয়ফ্রেন্ড আছে। নইলে তোমার মত হ্যান্ডসামকে কি আর হাতছাড়া করি?
বন্ধুত্বের উষ্ণতা আর সহমর্মিতায় ভরপুর এই চাইনিজ মেয়েগুলোকে খুব ভাল লাগে রাহাতের। ওরা কখনো আঘাত দিয়ে কথা বলে না। প্রত্যাখ্যানের তেতো কুইনাইনখানিও বড় মিষ্টি ক’রে গিলিয়ে দেয়। রাহাত ভাবে দেশের মেয়েদের এমন কিছু বললে বুঝিবা মরমে মরেই যেত। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে মুখ ঝামটা দিয়ে বলতো, ছিঃ! আপনাদের ঘরে কি মাবোন নেই? মনে মনে হাসে রাহাত।
– নেক্সট টাইম এ্যাঞ্জেলা ডার্লিং। ইউ আর ওয়ার্থ ওয়েটিং ফর আ হানড্রেড লাইভস্। ছুটিটা গ্র্যান্ট করিয়ে রেখো সুইট হার্ট।
অ্যাঞ্জেলার কমপ্লিমেন্টটুকু সুদে আসলে পরিশোধ করে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায় রাহাত।
রাহাত নিশ্চিত জানে এবার আর ওর ঢাকায় ফেরা হচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারদের দেয়া টাইম লাইন মোটামুটি ঠিকই থাকে। যদিও মাস দিনের হের ফের এক আধটু হয় বটে কখনো। সম্ভাব্য সময়টাও অনুমান করা হয়ে আছে। মেরে কেটে মাস তিনেক সময় হয়তো পাওয়া যাবে। সেই হিসেবে সামনের দিনগুলোতে কী কী করণীয় তার একটা ছকও তৈরী করা আছে।
ভার্সিটি থেকে বেরিয়েই সেই যে চাকুরী নিয়ে সিঙ্গাপুরে অভিবাসন গড়েছিল আজ যাই কাল যাই ক’রে আর দেশে ফেরা হয়নি। মাঝে মাঝে রাহাত ভাবে কোথায় যাবে, কোথায় যাওয়া যায়! কোথায় কাটানো যায় দুর্লভ দুস্পাপ্র এই ক্রান্তিকাল? এতো বছরের প্রবাস জীবনে এশিয়া-ইউরোপ জুড়ে বন্ধুবান্ধব শুভানুধ্যায়ীদের একটা নিবিড় চক্র গড়ে উঠেছে। ওদের আশেপাশে থাকতেই বরং স্বস্তি বোধ করে বেশি। ঢাকায় তো আছে মাত্র কিছু হাতে গোনা পরিজন। তাও তেমন খুব কাছের কেউ নয়। পুরনো বন্ধুবান্ধবরা কে কোথায় আছে তারও তেমন হদিস নেই। এতদিনে হয়তো ওরা ভুলেই গেছে রাহাতকে। এত বছরের উপার্জন। একাকী মানুষ, খরচই বা তেমন কী? অনেকগুলো টাকা জমে গেছে ব্যাংকে। টাকাগুলোরও একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
ডাক্তারের সাথে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিনের যোগাযোগে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চেয়েছিল রাহাত।
– আর কতদিন ডাক্তার?
রোগীর শরীরের সব খবর রোগীকে জানাতে হবে। কোনো দৌর্বল্য কোন জটিলতা গোপন করা যাবে না।
এটাই নিয়ম। করলে তা হবে কর্তব্যের অপলাপ। অতএব বেআইনী। সুতরাং অপরাধ।
ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিল –
– এসব ক্ষেত্রে শেষের অংকটা কেমন যায় ডক্টর? শেষ দৃশ্য, শেষ যবনিকা পতন?
প্রবীণ ডাক্তার সব জানে। উঠে এসে রাহাতের একটা হাত নিজের নরম মাংসল মুঠিতে পুরে নিয়ে সস্নেহে শাসন করেছেন।
– এইসব নিয়ে ভেবো না তো ছেলে!
– খুব জানতে ইচ্ছে করে, ডাক্তার!
চুলে আদুরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাক্তার বলেছে –
– এই ছেলে! তুমি না যোদ্ধা? কত সংকট সামাল দিয়েছ অবলীলায়। এটাও পারবে। হাতের সময়টুকু হৃদয় মন ঢেলে উপভোগ কর। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর। মন যা চায় তাই কর।
যা বুঝার বুঝে নিয়েছে রাহাত।
এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লীগামী ফ্লাইটটাও ক্যান্সেল হয়ে গেল। খুব খারাপ আবহাওয়া চলছে সারা সাইথ ইস্ট জুড়ে। সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে বসেছিল রাহাত। ডাক্তারের কথাটি উল্টে পাল্টে ভেবে চলেছে। মন যা চায় ! করা কি যায় মন যা চায় তাই ? মন কী চায় রাহাত ? আরেকবার, শুধু আরেকবার বাবার কাঁধে চড়ে হেলে দুলে সরষে ক্ষেতের আইল বেয়ে পাশের গ্রামে স্কুলে যেতে! মন চায় বড় আপার হাত ধরে পৌষা সংক্রান্তির মেলায় ঘুরে বেড়াতে। রঙিন ঘুড়ির বায়না ধরতে। মন চায় আম্মার কোলে মাথা রেখে আম্মাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলতে,
– আম্মাগো! আমার শরীরটা একদম ভাল যাচ্ছে না। মন চায় স্বাতীর সাথে যদি আর একবার কোথাও –
রাহাতের চিন্তার স্রোত অকস্মাৎ প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে যায়। সামনের অবিশ্বাস্য দৃশ্যপটটি যুগপৎ বিস্মিত ও নির্বাক করে দেয় ওকে। এখনই আগত একটি ফ্লাইট থেকে নেমে আসা যাত্রীর ভীরে এক তরুণীর পাশাপাশি হেঁটে আসছে এক ছন্দময়ী ললনা। স্বাতী না ? স্বাতীই তো! মাই গড! দেখেই চিনে ফেলেছে স্বাতী। হাসতে হাসতে সামনে এগিয়ে এলো। চলার সেই মিষ্টি ছন্দটা এখনো ধরে রেখেছে। এত বছরেও এতটুকু মেদ জমেনি দেহে। সেই আগের মতই স্লিম স্নিগ্ধ সপ্রতিভ।
– আরে! আপনি এখানে রাহাত! আপনারও আমাদের অবস্থা নাকি ? আমাদের ফ্লাইট ডিলে।
– এখন কোত্থেকে আসছিলে তোমরা? রাহাত জানতে চাইল।
– কোলকাতা। সানাই বাদক ঠিক করে এলাম।
– সানাই বাদক? কী ব্যাপার?
– আমার মেয়ে সেমন্তী। আগামী মাসে ওর বিয়ে। পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল স্বাতী।
– হাই সেমন্তী ! কংগ্রাচুলেশনস! সেমন্তীকে উইশ করল রাহাত।
স্বাতী বলল,
– সেমন্তীর বাবার খুব শখ, মেয়ের বিয়েতে শানাই বাজবে। আমরা বললাম বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের সিডি বাজালেই তো হয়। তা ও একেবারে নাছোড়। বলে, না। লাইভ সানাই বাজবে সেমন্তীর বিয়েতে। বিয়ে বাড়ীর এক কোণে উঁচু করে মাচা বেঁধে দেয়া হবে সানাই বাদকদের জন্য।
স্বাতীর কথা বলার ধরণ সেই আগের মতই আছে। চনমনে ঝরঝরে ননস্টপ।
– এখন কি ঢাকায় ফিরছিলে ? রাহাত জানতে চাইল।
– ব্যাংকক। ওখানে কিছু শপিং করে তারপর ঢাকায় ফিরব। আমাদের থাই এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ডিলে সেই রাত আটটা পর্যন্ত। এখন তো মাত্র দুপুর। আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?
– যাচ্ছিলাম আন্দামানস্। ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে গেছে আমারও।
– আন্দামানস? পোস্টিং নাকি ? স্বাতী জানতে চাইল।
– অমন এক্সোটিক জায়গায় পোস্টিং হলে তো খুবই এক্সাইটিং ব্যাপার হতো। কিন্তু ওখানে তো আমার করার মত কোন কাজ নেই।
– তাহলে, দেশ ভ্রমণ ?
– অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল আন্দামানস্ দেখব। মানচিত্রে দেখবে ভারত মহাসাগরের মধ্যিখানে বিন্দু বিন্দু আন্দামানস্ নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ইংরেজ আমলের ভারতবর্ষের মুক্তিযোদ্ধা রাজদ্রোহী দেশপ্রেমিকদের দ্বীপান্তরিত অভিনিবাস। শুনেছি সাম্প্রতিককালে অনেক বাংলাদেশীও সেখানে ইমিগ্র্যান্ট হয়েছে।
স্বাতী এবার প্রসঙ্গ বদলিয়ে একটু ঠাট্টা করল,
– শারীরিক দিক থেকে তো বেশ ভালই আছেন দেখছি। ভার্সিটিতে পড়ার সময় যা তালপাতার সেপাই ছিলেন। মনে আছে আমাদের ক্লাসের দুষ্টু মেয়ে মিতু আপনাকে একবার একটা চিঠি লিখেছিল। প্রিয় রাহাত ভাই, আপনাকে একটি অনুরোধ, ঝড়ের সময় আপনি কিন্তু বাইরে যাবেন না। গেলেও মনে করে পকেটে দুই খানা ইট রাখতে ভুলবেন না! রাহাত ভাবল বলবে নাকি স্বাতীকে, স্বাতী তুমি জানো না বাইরের এই আমি এক আপাতঃ দৃশ্যমান ইলিউশন বৈ কিছু নই। এই শোভন শরীরের কোষে কোষে জেঁকে বসেছে ঘুণ পোকাদের জমাট আসর। সেথায় চলছে হাভাতে কীটদের ভুরিভোজের মহোৎসব। নিয়ত বিশুদ্ধ রক্তধারায় মিশে যাচ্ছে দূষণের অপ্রতিরোধ্য ঘোলা জল। একদার সেই সজীব দেহের খানাখন্দে নিয়ত বইছে প্রবল ধ্বসের কালবোশেখী। ধ্যাৎ ! এসব কথা কি স্বাতীকে বলা যায়। কাওকেই কি বলা যায় ?
– ঠাট্টা করলাম। বলুন কেমন আছেন ?
স্বাতীর কথা রাহাতের ভাবনায় রাশ টানল।
– তুমিই তো বললে ভালই আছি।
– আপনি কিন্তু জানতে চাননি আমি কেমন আছি।
রাহাত ভাবল অভিমান নাকি?
– প্রয়োজন হয়নি। দেখেই বুঝেছি খুব ভাল আছো।
স্বাতী আর কিছু বলল না।
রাহাত ভাবছিল স্বাতী কেমন সারাক্ষণ অচেনা মানুষের মত আপনি আপনি করে কথা বলে গেল। একটু কি আহত বোধ করল রাহাত? স্টুপিড। তুমি কি ভেবেছিলে এত বছর পরে এই দীর্ঘ বিভাজন পেরিয়েও রাহাতের সময়কে স্বাতী আগের মতই নৈকট্যের উষ্ণতায় ভরিয়ে দেবে ? গাঢ় স্বরে তুমি সম্বোধনের প্রীতি উপহারে সংলাপ সাজাবে ? স্বাতীকে ক্ষমা করার পথ খুঁজল রাহাত। পুরানো প্রেমিকের সাথে এত বছর পর দেখা হলে সহসাই কি আর তুমি করে বলতে পারে সবাই ?
– আমার বাসা এয়ারপোর্ট থেকে খুব কাছেই। এই কার্ডটা রাখ। কোন প্রয়োজন হলে আমার সেল নাম্বারে ফোন দিয়ো।
সাধারণ ফর্মালিটি। এতটুকু বলা যায়। রাহাতের ইচ্ছা হচ্ছিল স্বাতীকে বলে –
এখন তো মাত্র দুপুর। তোমাদের হাতে অনেক সময়। চাও তো বিকেলে সিঙ্গাপুরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি। আবার ভাবল, না থাক। স্বাতী যদি রিফিউজ করে বসে। স্বাতীদের এয়ারলাইন্স থেকে হোটেল দিয়েছে। হোটেলের গাড়িতে ওরা বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে সেমন্তী একবার পেছনে ফিরে হাত নাড়ল। রাহাত ভেবেছিল স্বাতীও বুঝি ফিরে চাইবে।
হোটেলর রুমে ঢুকেই সেমন্তী স্বাতীকে নিয়ে পড়ল। ছুটে গিয়ে পেছন থেকে স্বাতীকে এসে এমন জোরে জড়িয়ে ধরল যে দু’জনে হুড়মুড় করে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। সামলে ওঠে স্বাতী চেঁচিয়ে উঠল –
– কী মেয়ে রে বাবা! কী হয়েছে ?
– আম্মাজান! এই রাহাত আংকেলটা কে?
কোন ভনিতা না করেই সেমন্তী জানতে চাইল।
– ইউনিভার্সিটিতে আমার ক্লাসমেট ছিল। কেন ?
– জাস্ট ক্লাসমেট? অর আ বিট মোর দ্যান দ্যাট আম্মাজান? সেমন্তী চোখ সরু করল।
– পাকামো হচ্ছে, না ? জাস্ট ক্লাসমেট।
– ইউ আর ব্লাশিং আম্মুনি। সত্যি সত্যি বল। নো লায়িং।
– মা ও মেয়েতে চকিকে চোখাচোখি। বুঝিবা কিছুটা অদৃশ্য বোঝাপড়াও হয়ে গেল মূহূর্তে। দু’জনের চোখে দুই ধরণের হাসি। মেয়েরটা দুষ্টুমির। মায়েরটা যেন কিছু লজ্জা মেশানো। বোঝা যায় বেশ বন্ধুত্ব আছে দু’জনে। দু’জনের আত্মিক যোগাযোগ স্বতস্ফূর্ত এবং সাবলীল। অনুভবের অবাধ আদান-প্রদানের একটা অভয় সেতু গড়া আছে দুইয়ের মাঝে, যা দিয়ে অবলীলায়
নির্বিঘ্নে আনাগোনা। যেন একজনের কাছে আরেকজনের হৃদয়ের অন্তঃপুরে যখন তখন অনুপ্রবেশের সিজন টিকিটখানি কাটাই আছে।
– বুঝেছি। আর বলতে হবে না। হি ইজ সো হ্যান্ডসাম এন্ড ম্যানলি আম্মু!
– বড্ড বখে গেছিস তুই সেমন্তী। স্বাতী মেয়েকে চোখ রাঙ্গায়।
ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছিল। স্বাতীরা এয়ারপোর্টে যাবার জন্য তেরী হচ্ছিল। সেমন্তী ওয়াশ রুমে। স্বাতী ভাবল চলে যাওয়ার আগে রাহাতকে একটা ফোন করলে হয়। লৌকিকতা বলে কথা। নাম্বার দিয়েছিল রাহাত। ব্যাগ খুলে রাহাতের কার্ড বের করে নাম্বার ডায়াল করল। কী বলবে রাহাতকে ? আমরা যাচ্ছি রাহাত। আবার দেখা হবে। ভাল থাকবেন। এসব ? নাকি কি? একটি মহিলা কণ্ঠ কল রিসিভ করেছে।
– হ্যালো। কে বলছেন? ইংরেজিতে কথা বলছে মহিলা। আশপাশ থেকে অনেক মানুষের ব্যস্ততা আর গুঞ্জনের শব্দ ভেসে আসছে।
– এটা রাহাত সাহেবের সেল ফোন না? ওর সাথে কথা বলতে পারি? স্বাতী জানতে চাইল।
– মহিলা কণ্ঠটি খানিকটা সময় চুপ রইল। তারপর বলল –
– হ্যাঁ। এটা মিস্টার রাহাতেরই ফোন। কিন্তু ওর সাথে তো এখন কথা বলা যাবে না। আমি ওয়েস্টার্ন মেমোরিয়াল হসপিটাল থেকে বলছি। রাইট দিস মোমেন্ট রাহাত ইজ আন্ডার ট্রিটমেন্ট ইন আওয়ার ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট। আপনি কি রাহাতের কোন আত্মীয় ? লাইক নেক্সট কিন ?
একটু চুপ থেকে স্বাতী বলল –
– আমি ওর পরিচিত। জানতে পারি কি হয়েছে রাহাতের?
মহিলা কন্ঠটি খুব ভারী গলায় থেমে থেমে বলল –
– আপনি কি ওর ফ্যামিলির কারো ঠিকানা দিতে পারবেন আমাদের ? মিস্টার রাহাত ইজ টার্মিনালি ইল। আজ বিকেলে হঠাৎই ওর হেলথ কন্ডিশন অ্যাগ্রাভেট করে গিয়েছিল। হি ওয়াজ ফ্লোন টু আওয়ার হসপিটাল। এখন কোমায় রয়েছে।
স্বাতী যেন মুহূর্তে পাথর হয়ে গেছে। কথা থেমে গেছে। ফোন হাতে কতক্ষণ হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল খেয়াল ছিল না। সম্বিত ফিরে পেতে কানে ফোন দিতেই বুঝল হসপিটালের মহিলা কণ্ঠিট লাইন কেটে দিয়েছে। সেমন্তী ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এল। স্বাতীর দিকে চেয়ে বলল –
– আম্মু, তুমি এখনো তৈরী হওনি ? ফ্লাইটের তো বেশি দেরি নেই আর। এতক্ষণ কাকে ফোন করছিলে ?
স্বাতী কোন কথা বলল না। সেমন্তীর হাতে সেল ফোনটি দিয়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়ল।
– ম্যাডাম!
হোটেলের উর্দিপরা বেল বয় এন্ড্রুস দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। নিচে শাটল লেগেছে। এক্ষুনি এয়ারপোর্টের পথে রওনা না দিলে ফ্লাইট মিস হবে। সেমান্তি তাড়া দিল,
– কই আম্মু, বসে রইলে কেন ? চলো!
স্বাতীদের লাগেজ সব আগেই চেক ইন হয়ে গিয়েছিল। হাতে বয়ে নেয়ার মত তেমন কিছু ছিল না। হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিয়ে স্বাতী বলল –
– হ্যাঁ, চল যাই।
এমন সময় স্বাতীর সেল ফোন বেজে উঠল। লন্ডন থেকে সেমান্তীর বাবা রিজওয়ান তাড়া দিচ্ছে।
– তোমরা কোথায় স্বাতী ?
– এখনই বেরোচ্ছি আমরা।
– এখনো হোটেলে তোমরা ? জলদি বেরোও ! তোমাদের ফ্লাইটের বেশী দেরী নেই তো !
স্বাতীর মনে হল এন্ড্রুস সেমন্তী রিজওয়ানরা সবাই মিলে স্বাতীকে জোর করে ঠেলে এয়ারপোর্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
হাইওয়েতে প্রচন্ড ভিড় ছিল এদিন। এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে স্বাতীদের বেশ দেরি হয়ে গেল। প্রায় দৌড়ে দৌড়ে ইমিগ্রেশন সিকিউরিটি চেক আপের ফর্মালিটিসগুলো শেষ করতে হল। স্বাতী যন্ত্র চালিতের মত সেমন্তীর পিছু পিছু সব কিছু করে গেল।
থাই এয়ারলাইন্সের অতিকায় এয়ারবাস আকাশের অনেক উঁচুতে রাতের অন্ধকার ছিঁড়ে ফুঁড়ে আপন গন্তব্যে ধেয়ে চলেছে। একটু আগেই যাত্রীদের সিট বেল্ট বাঁধার সাইন নিভে গেছে। বিমান সেবিকারা ডিনার সার্ভিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হোটেল থেকে বেরোবার পর স্বাতী আর একটিও কথা বলেনি। সেমন্তী বুঝে নিয়েছিল সামথিং ইজ রং উইথ আম্মু। মে বি দ্যাট ফোন কল। ইচ্ছে করেই মাকে আর ঘাটাতে চায়নি। প্লেনের সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে কাত হয়ে শুয়ে আছে স্বাতী। রাহাতের কথা ভাবছিল। এমন অভিমান কেউ করে ? স্বাতীকে পাওয়া হয়নি বলেই কি জীবনটাকে এভাবে ভাসিয়ে দিতে হবে? স্টুপিড! আমার জন্য এমন ছেলেমানুষী ? কী এমন মহার্ঘ বস্তু ছিলাম আমি ? কই, যে আমাকে পেয়েছে তার প্রাপ্তির আনন্দের প্রকাশতো দেখিনি কখনো। যেন এটাই নিয়ম। যেন এমনিই একদিন হঠাৎ কেউ কারো স্ত্রী হয়ে যায়। তাহলে রাহাত তুমি কেন অর্থহীন অভিমানে বোকার মত নিজেকে নিঃশেষ করে দিলে ? তুমি জানতেনা রাহাত! আমি ছিলাম লক্ষ্মী মেয়ের মোড়কে জড়ানো মায়ের হাতের বারবি পুতুল। বাড়ির সবাইকে খুশি রাখাই ছিল আমার কাজ। জেদ করে কিছু পেতে শিখিনি। প্রিয় কিছুর জন্য কখনো বায়না ধরিনি। মীন রাশির নির্জীব জাতিকা আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ, প্রতিরোধহীন। বাবা-মায়ের প্রবল শাসনে প্রতিবাদের শক্তিই গড়ে ওঠেনি আমার। নিজেই জানতাম না আমি কত ভঙ্গুর। আমার বিশাল স্বজন বাহিনীর কাছে তোমার তো কোন স্বীকৃতি ছিল না রাহাত। নুয়ে পড়া মেরুদন্ড নিয়ে আমি তোমার জন্য যুদ্ধ তো দূর, রুখে দাঁড়াবার শক্তিটুকওু পাইনি। ওয়েস্টার্ন মেমোরিয়ালের সিসিইউর নিঃসীম অন্ধকারের শূন্যতায় তুমি এখন কী করছ রাহাত? খুব কী কষ্ট হচ্ছে তোমার? খুব কষ্ট, রাহাত ? খুব কষ্ট ? খুউব?
সেমন্তী দেখল স্বাতী ঘুমিয়ে গেছে। স্বাতীর চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া জলের রেখা স্বাতীর গাল বেয়ে ঠোঁটের কোলে স্থির হয়ে আছে। সেমন্তী স্বাতীর গায়ে একটি কম্বল জড়িয়ে দিল। তারপর খুব যত্নের সাথে মায়ের চোখের অশ্রুটুকু আঙ্গুল দিয়ে তুলে নিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress