পর্ব – ১
নেপাল বাবুর আজ মেজাজটা টং ,গত কয়েকদিন ধরেই শুরু হয়েছে ব্যাপারটা। বাতিকগ্রস্থ নেপাল সাধুখাঁ একটা বেসরকারী অফিসের বড়বাবু। বিয়ে করেন নি। মফস্বল শহরের এক এজমালি বাড়ির অন্যতম শরিক এই নেপাল বাবু। বাড়িতে একটা মাঝারি মাপের ঘর আর সংলগ্ন এক চিলতে বারান্দা ওনার জন্য বরাদ্দ। পায়খানা চানঘর বাড়ির অন্যান্য সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। সাপ্লাই-এর জল ধরে রাখা তার নিত্যদিনের কাজ। বারান্দার এক ধার টিন দিয়ে ঘিরে রান্নাঘর বানিয়ে নিয়েছেন। উনি বড়বাবু ,অফিসের চাবির দায়িত্ব ওনার তাই সকালে উঠে স্নানাদি সেরে ঘরের কুলুঙ্গীতে রাখা ঠাকুর দেবতাদের ধূপ দেখিয়ে জল বাতাসা দিয়ে দূর্গা নাম জপতে জপতে অফিস চলে যান। পথে সত্যর চায়ের দোকানে এক কাপ চা আর দু’টো সস্তার বিস্কুট পেটে চালান করেন।অফিসের কাছেই একটা কলেজের ছাত্রদের হস্টেল আছে ,অনেকদিন আগে যখন এত কড়াকরি ছিল না তখন হস্টেল সুপার আর রান্নার ঠাকুরকে পটিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাটা মাসকাবারি চুক্তিতে করে নিয়েছিলেন ,সে নিয়ম আজও চলছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে একটা মোবাইল ফোনও কিনেছেন। কিছুটা কথা বলার জন্য আর বাকিটা রেডিও শোনার জন্য। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে সত্যর দোকানে সাময়িক বিরতি ,চা পান বার দুয়েক ,আধ বাসি হয়ে যাওয়া কাগজটাতে চোখ বোলানো তারপর বাড়ি এসে জামাকাপড় বদলে দুটো ভাত ফুটিয়ে নেওয়া। এই হলো নেপাল বাবুর রোজ নামচা। রবিবার দিন গুলোতে হস্টেলে খাওয়া বন্ধ , ঘরেই একটু তরিবত করে রান্না করে খেয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেরিয়ে পরা। বেশ কাটছিল দিনগুলো। অফিসের ছোকরা কেরাণী তাপসের কথায় “বিন্দাস” আর পুরনো বেয়ারা বিষ্ণুর ভাষায় “পুরো একঘর”। এ হেন নেপাল বাবুর কিছুদিন হলো মেজাজ খিঁচড়ে আছে। এক অভিনব পদ্ধতিতে অফিসের কলিগরা ওনার পেছনে লাগাছে। বড়বাবু বলে মালিকের ঘরে তাকেই অফিসের সব কাজের জবাবদিহি করতে হয় , কাজকর্মের হিসেব দিতে হয় ,অন্যান্য স্টাফেদের অভাব অভিযোগ পেশ করতে হয় ,কত্তার আদেশ কর্মচারীদের কাছে বয়ে আনতে হয় মানে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই করতে হয়। নম্র ভদ্র বদমেজাজ নেই তাই নেপাল বাবুকে কর্মচারী এবং মালিক উভয় পক্ষই পছন্দ করে। এরই মধ্যে ছন্দপতন ,হপ্তা খানেক আগে বিষ্টুর সর্দি হয়েছিল ,সারাদিন হাঁচি আর নাকঝাড়া। নেপালবাবু আবার এইসব হাঁচি কাশি টিকটিকির সংস্কার মেনে চলেন। একদিন বড়কত্তা ডেকেছে একটা জরুরি কথা বলাল জন্য। নেপাল বাবুর কাছে সমস্যার সমাধান মজুদ। ফোনে ডাক পেয়ে নোট খাতা আর পেন নিয়ে যেই না বড়কত্তার দরজার সামনে পৌঁছেছেন পেছন থেকে বিষ্ণু দিল এক রাম হাঁচি। নেপাল বাবু
” ধ্যাততেরিকা ” বলে ভষ্ম করে দেওয়ার দৃষ্টি নিয়ে বিষ্ণুর দিকে তাকাতেই সে বলে ” আরে বড়বাবু এটা সর্দির হাঁচি , আপনি নিশ্চিন্তে যান “। বিষ্ণু নেপালের এই বাতিকগুলো জানে। বিষ্ণুর কথাতে নেপাল বাবু আশ্বস্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতেই কত্তা মশাই খেঁকি কুকুরের মত খ্যাঁক করে উঠলো , হাতের ফাইলটা ছুঁড়ে বলেছিল
“এটা কি ” ? নেপাল ফাইল খুলে দেখে তাপসের ফাইল ওনার কোনও ভূমিকা নেই ,কত্তা বলে যাচ্ছে ” এইভাবে ফাইল পাঠাবেন না , কাজ করার ইচ্ছে না থাকলে বলে দিন ,আমি সোজা কথা পছন্দ করি “, আরও কত কি। বিনা দোষে নেপাল বাবু অপরাধী হয়ে গেল। ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এসে তাপসকে খুঁজতে গিয়েই বিষ্ণুকে দেখতে পেল। ব্যস আর যায় কোথায় ,এতদিন চাকরি করছে ওনার নিজের লেখার ভুল হলেও মালিক ডেকে স্নেহের সুরে মমতা মাখা গলায় ভুল ধরিয়ে কি করে ঠিক করবেন তা বুঝিয়ে দিতেন আর আজ !!! ভুলটা তাপসের উনি খামোকা মুখঝামটা খেলেন ,কিন্ত কেন ,ঐ বিষ্ণু ব্যাটার হাঁচিই এর কারণ। প্রথমে বিষ্ণু পরে তাপস , দু’জনকে ডেকে বেধরক বকা দিলেন। শান্ত নেপাল বাবুর এ হেন অশান্ত হয়ে যাওয়া হয়ত কারুরই হজম হলো না। জনান্তিকে বলে বেড়াতে লাগলো বড়বাবুর গ্যাসের পেশেন্ট ,গ্যাস মাথায় চড়ে গেছে। তারপর থেকেই যখনই নেপালবাবু মালিকের ঘরে ঢুকতে যাবেন পেছন থেকে হাঁচি। শুরু করেছিল তাপস আর বিষ্ণু ,ক্রমশ ছোঁয়াচে রোগের মত এমন ছড়িয়ে পড়লো যে কহতব্য নয়। এমনকি একদিন কত্তা বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় উনি পর্যন্ত হাঁচি দিয়ে হাসি মুখে স্যরি বলেছিলেন। মালিক বলে কথা ,কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে বাইরে আসতেই অঘটন ,মিস মিত্রর সঙ্গে ধাক্কা ,যাকে বলে হেড অন কলিশন। ধাক্কা খেয়ে মিস মিত্র পড়েই যাচ্ছিলেন। নেপাল বাবু দু হাতে কোন রকমে জাপটে ধরে পতন রোধ করলে কি হবে অফিস শুদ্ধু লোক পেছনে সামনে একটাই কথা বলতে লাগলো বুড়োর রস দেখো। একদিন অফিসের সবথেকে বয়স্ক স্টাফ ব্যানার্জীদাও একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন –
” নেপাল এবার বিয়েটা করেই ফেল। বয়স তো হচ্ছে , বুড়ো বয়সে একটা অবলম্বন দরকার সকলের। তুমি বললে আমি মিলির সঙ্গে কথা বলতে পারি “। মিলি, মানে মিস মিত্র ,আর এরপর যা হলো, সারা অফিস তোলপাড়। নেপাল বাবুর ঐ রুদ্র রূপ অফিসে আগে কেউ দেখেনি। চিৎকার চেঁচামেচি ,পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো ” গ্যাস সাধুখাঁ ” ,” পাগলা প্রেমিক ” আরও কত কি। একটা করে টিপ্পনি আসে আর আগুনে ঘি পড়ে। নেপাল বাবুর গলা আরও সপ্তমে ওঠে।