যাপিত যাপন
মায়াবী কুয়াশা জড়ানো ভোর সুবর্ণরেখার উদাস চরকে মুডে রেখেছে সোহাগী চাদরে। দূরে শাল জঙ্গলের মাথা ছোঁয়া কুয়াশার পাগড়ী —তা থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে শিশির ফোঁটা— চরের কাশ বেনার ঝাড়ে। সোনালী রোদের ঝলকে বেনা ঘাসের ওপর থাকা মাকড়সার জালে শিশিরের হীরক দ্যুতি। শুরু হয় একটা সোনালী দিনের।
দিন মনির চলন শুরু হলেই শুরু হয় কর্মব্যস্ত একটা দিন । দন্ডছত্রী মাঝি ও চাষীএকসাথেই রওনা দেয় ভাসাপোল পেরিয়ে নদীর চরের দিকে। ওই ঘাটে ডিঙি নিয়ে মাছ ধরবে সে চাষী যাবে পাড ঘেষা জমিতে নিডেন দিতে। সবজি খেতে বড় আগাছা যে। মাঝির খালুই ভরে ওঠে রূপালী চকচকে মীন ফসলে। পায়ের পাতা ডোবা জলে তির তির করে আলপনা কাটে জল মাকড়সা। চাষী সবজি ক্ষেতের আগাছা তোলে ।সর্ষের হলুদ ফুলে মৌ মাছি গুন গুন করে ।বেগুন ক্ষেতে টুনটুনির উড়াউড়ি দিকভ্রষ্ট করে দেয় ভ্রমর কে। সুনীল আকাশে চক্কর কাটে গেরোবাজ শঙ্খচিল টা নদী তটের পাকুড়ের ডালে বসে ঝিমায়।চিলের তীক্ষ্ণ স্বরে চমকে ওঠে নদী চর। গাঙশালিখের দল জটলা করে। তেলে মুনিয়ার ঝাঁক বেনা-কাশের জঙ্গলে মজলিস বসায়! নদী জলে নাল ফুল দোলে যেন প্রকৃতির নোলক! ধীরে ধীরে চাকা গডিয়ে চলে রোদের তেজ বাড়ে। মাঝি কোমরের গামছা খুলে ঘেমো মুখ মুছে বলে–” মা সাঁতাই বুড়ি, খলুই ভরে দাও মা। তোমার আটনে ছলন ভরে দেবো। ঘর যে কুটুমে ভরা গো। মাছ না পেলে মান থাকে না।” নিড়ানি সেরে চাষীএ নদীতে আসে। মুখ হাত-পা ধোয়— হাঁক দেয়–” কি মাছ পেলে গো খুডা? চিংড়া আছে নাকি? পাবো কি?”
দুজনের সুখ-দুঃখের কথায় গড়িয়ে চলে সোনালী দিনটা!
নদীর পাড়ের পাকুড গাছে বসা শঙ্খচিলটা সকালের মিঠেল রোদে ডানা শেঁকছে। চোখ রয়েছে জলের দিকে কখন ভেসে উঠবে কালবোশে ছানা– তারই অপেক্ষায়! দূর থেকে ভেসে আসছে গাঙ শালিকের ডাকাডাকি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে প্রখর রোদের তাপ নদীর তীরকে নীরব করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে চিলের তীক্ষ্ণ স্বর। আউল বাতাসে রামেশ্বর মন্দিরের শঙখ ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে –বাবার দুপুরের ভোগ লাগলো যে।
কড়া রোদে ভেজা ঘাসের ওপর কার মাকড়সার জালের শিশির গেছে শুকিয়ে ।নদীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা গভীর জলে বালি বওয়া ডিঙি টা নিয়ে চলেছে দন্ডছত্রী। সেতুর নিচের ছায়াঘেরা ঘাটে নৌকা ভিডিয়ে স্নানের উদ্যোগ করে। সেতুর পাশের পাড বেয়ে বেশ ক’জন স্নানার্থী এসে জোটে। গাল-গল্পে সরগরম হয়ে ওঠে নদী ঘাট। কিছুক্ষণ পর আবার ফাঁকা হয়ে পড়ে। ভিজে গামছা মাথায় দন্ডছত্রী রওনা দেয় গ্রামের দিকে। একটা একা বক একপা একপা করে সেতুর পিলারের তলার জলে ব্যাঙ ধরার চেষ্টা করে। আবার একটা সোনালী দিন কাটতে থাকে।
দিনমণি অস্তাচলগামী হন। রাক্ষসী বেলার লালিমা সারা নদীচরকে এক মায়াবী চাদরে ঢেকে দেয়। বকের দল নদী জল ছেড়ে পুবের মাঠের দিকে উড়ান টানে। দূর থেকে ভেসে আসে মন্দিরের সন্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি। এই স্বর আউল বাতাসে ভেসে চলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নজর মিনারের মাথা ছুঁয়ে তপোবনের গভীর বনের মহীরুহের ভিড়ে। আস্তে আস্তে আঁধার ঘন হয় ।নিশি টহলে বেরোয় পেঁচা দম্পতি ।আকাশে একটি দুটি তারা ফুটে ওঠে যেন তামসী তপস্বিনীর জপমালার মোতির মত। হঠাৎ দূর দিগন্তের থেকে ভেসে আসে আলোডন —–মহাকাল!!! দলমার দামাল হাতির পাল আসছে নদী পেরিয়ে ,নদীর জলে আলোড়ন তুলে ,শাল জঙ্গল ভেঙ্গে তারা এসে ওঠে নদীতীরের সবজি খেতে। হুলা পার্টির হইচই মশালের আলো-আঁধারি পটকার আওয়াজে নদীর চর নদীকূল সরগরম হয়ে ওঠে। বনদপ্তর এর লোকেরা হাতির পাল কে তাড়িয়ে নিয়ে চলে জঙ্গলের দিকে। আস্তে আস্তে মশালের আলো মিলিয়ে যায় জঙ্গলের মাঝে। আবার নদী চর নিস্তব্ধতার চাদরে মুখ ঢাকে। আকাশের বুকের অবাঞ্ছিত নক্ষত্রেরা উল্কা হয়ে ঝরে পড়ে। প্রকৃতির আলোছায়া আঁচলে মিলিয়ে যায় তারা। রাত গড়িয়ে চলে।