শিশির বিন্দু
‘কিব্যাপার বলতো,জরুরী তলব পাঠালি ? আর, চেহারা খানাই বা অমন হাড়গিলের মতো শুকনো কেন রে অমল ? বাদল তীব্র কৌতূহলে ডাক্তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে -আ-আমি-আমি না-আমি- আমতা মুখ অমলের । -ধেৎ, কি আমি না,আমি নাকরছিস? খুলে বলবি তো- অমল ঢোঁক গিলে,শোন না, আমি না একজনকে মানেএকটা মেয়েকে ভালবাসি বুঝলি, কিন্তু কথাটা ওকে কি করে বলবো ভেবেই পাচ্ছিনে তাই,তোকে-এ্যাই, বাদল, একটা উপায় বাৎলে দে না রে, – বিপন্ন অমলের মুখে চোখে ব্যাকুলতার ছাপ । -কেন? কেন? এতো বেশ সহজ ব্যাপার যে, একেবারে জলবৎ তরলং,বেশ মোলায়েম করে, মিষ্টি সুরে, সুন্দর করে বলে ফ্যাল্, এসব কাজে শুভস্য শীঘ্রম-বুঝলি? অমলকাচুমাচু -, তুই তো বলেই খালাস । একমাস ধরে লাগাতার চেষ্টা করছি, কিন্তু কথাটা বলারআগেই-আবার ঢোঁক গিলে সে। বিস্ময়ে অমলের আপাদমস্তকে চোখ বুলায় বাদল। -ও বাবা,একি রে,পা থেকে মাথা অব্দি বেশ তো হ্যান্ডসাম দেখতে, তাও এই সামান্য কথাটা বলতে পারিসনি ? মাছের কাঁটার মতো গলায় বিঁধে যাচ্ছে? নাহ্ তোর দ্বারা কিস্যু হবে না -আশ্চর্য! কলেজ লাইফে যে এতো দিস্তে দিস্তে কবিতা – টবিতা লিখতিস কেমন করে বুঝিনে বাপু -ঢের ঢের গর্দভ দেখেছিকিন্তু তুই -তুই একটা আকাট গর্দভ-বলে ভেংচে ওঠে বাদল । অমল নিরুপায় দৃষ্টিতে তাকায় প্রাণের বন্ধুর দিকে। -সে তুই যাই বলিস -আসলে,কবিতা লেখা অনেক সহজ, কিন্তু একটা মেয়েকে ভালবাসার কথা বলা – না ভাই – খিঁচিয়ে উঠে বাদল,-কাপুরুষ ! জানিসনে,লাজ, ঘৃনা-ভয়- প্রেমে তিন থাকতে নয়। আচ্ছা,ওই মেয়েটা কবিতা ভালবাসেনা? অমল মলিন হাসে-হ্যাঁ,তা বাসে -হঠাৎ কবিতার কথা কেন? বাদল মুচকি হাসে – 8- তাহলে ওই পথেই এগিয়ে যা-তারপর,ঝোপ বুঝে – শুনেই কঁকিয়ে উঠে অমল-, সে চেষ্টাও কিআর আমি করিনি ভেবেছিস, উপায় নেই বন্ধু,রূপসা বশ হবার নয়। -আ্যাঁ, দাঁড়া, দাঁড়া,-কোন রূপসা রে ? গতবছর আমাদের পূজো প্যান্ডেলে যে মেয়েটি গান গেয়ে মাত করেছিলো, সে ই ই- হ্যাঁ,হ্যাঁ-সেই- -আচ্ছা,তোর সাথে তো ওদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল জানতাম, তাহলে- -তাআছে বটে । গেলেই ওর মা যথেষ্ট আদর – যত্ন ও করেন কিন্তু সে তো পরিবারের ডাক্তার হিসেবে -তার বেশী- বাদল ওকে থামিয়ে বলে- হ্যারে, তুই যে রূপসাকে ভালবাসিস -ও জানে কথাটা? অমল চটে যায়-ধুস! কি যে বলিস মাথামুন্ডু-জানলে কি আর তোকে ল্যাংবোট ধরি? বাদল চেয়ার থেকে ঠিকড়ে ওঠে -তবে রে, আমি বুঝি ল্যাংবোট ? বেশ, তোর জন্য নাহয়, তাও -শোন, ঝপ্ করে কথাটা কাল সোজাসুজি বলেই দ্যাখনা- অমলেরআশান্বিতমুখ -সত্যি বলছিস !
-ওকি, অমলদা ! কি হয়েছে তোমার ? অসুখ-টসুখ – -না,না,ও কিছু না, অমনি একটু, তা তোমরা ভালো তো ? মাসিমা- -নেই। মেজমাসিরবাড়ি গেছেন-কি হলো? অমন পালাই পালাই করছো কেন? বসো-বসো না- জানো, আজমাংসের একটা নতুন ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেছি । ভালোই হলো তুমি এসে পড়াতে -জাজমেন্ট টা তুমিই ভালো দিতে পারবে -অমল বিমূঢ় -মাংসের আবার জাজমেন্ট কিসের ? -আহা! শোনোই না, সরুদির সাথে বাজি ধরা হয়েছে, দস্তুরমতো হেড- টেল করে, ও নিয়েছে পাঁঠা, আমি মুরগী, তুমি হাত -মুখটা চট করে ধুয়ে এসো-আমি গরম লুচি ভেজে আনছি – -সেকি ! মুরগী, পাঁঠা দুটোই খেতে হবে নাকি ? অমল আঁতকে উঠে । খাবার ব্যাপারে সে একটু নিয়ম মেনে চলে, ডাক্তার হলেই বা – রূপসার অবাক গলা -আলবাৎ খেতে হবে । নইলে,কারটা ভালো -জাজমেন্ট দেবে কি করে শুনি ? -প্লিজ রূপসা, আজ রেহাই দাও,বরং অন্যদিন- এবারে রেগে যায় রূপসা -বটে! চলো -চলো -চলোবলছি, নাও, বসো- সরুদি, ও সরুদি, লুচি নিয়ে এসো –
অগত্যা,নিরুপায় অমলকে ডাইনিং টেবিলে বসতেই হয়। সরুদি খাবারদিয়ে মুচকি হাসে – দাদাবাবু, খাইয়া দ্যাহেন,আইজ আমাগো দিদিমণি রান্দাবাড়া করছে, না খাইলে মনে কষ্টপাইবো – দাদার দিকে তাকিয়ে ভয়ানক চমকে ওঠে অমল-ও বাবা,তাই বলে এতোটা ? না,সরুদি, পারবো না । কারন, মহাভারতের ভীমের হজম আমার নেই,দয়া করো সরুদি – -একি! কি হচ্ছে শুনি? এখনো হাত গুটিয়ে? পুডিং এর বাটিটা অমলের থালার পাশে রাখতে রাখতে বলে রূপসা। রূপসাকে ঘাঁটাতে সাহস পায়না অমল, যা মেজাজী মেয়ে! জিভ ও শানানো হয়তো কি বলতে কি বলে বসবে । তারচাইতে-হাত বাড়িয়ে থালাটা টানে- রূপসার দৃষ্টি অমলের দিকে স্থির। মনে বিচিত্র ভাবের খেলা। অমল একদিকে ডাক্তার ও কবি, স্বভাবে – চরিত্রে-ওর মতো ছেলে হয়না । -মাংসটা কেমন হলো অমলদা ? আগ্রহের সুর রূপসার । একমনে মুরগীর ঠ্যাং চিবুচ্ছিল অমল । রূপসার কথা শুনে বলে -ভালোই-তা কোনটা বেশী ভালো হয়েছে ? পাঁঠা না মুরগী ? রূপসা উদগ্রীব । সেকথার জবাব না দিয়ে অমল তারস্বরে ডাক দেয়- -সরুদি -ওসরুদি – সরু -সরমা এ বাড়ির খাস্রাঁধুনী । অমলের হাঁক ডাকেকুন্ঠিত পায়ে ছুটে আসে- -আমারে ডাকতেছেন ডাক্তারবাবু ? অমল উচ্ছ্বসিত-,তোমার হাতের জবাব নেই, খাসা রেখেছো, পাঁঠাটা কচি বলে টেস্ট ও- -আর,আমারটা ? আমার মুরগীটা কেমন হলো বললে নাতো ? অভিমানে ঠোঁট বুলায়রূপসা । -ওফ্,তোমারটা ? তোমারটা তো তুলনাহীন,ফ্যান্টাসটিক -সত্যি ! সত্যি বলছো? ভালো হয়েছে, না কি মন রাখতে, আচ্ছা, ঝালটা ঠিক আছে ? -না,না,ওসব ঠিকই আছে, তবে- -আহ্তবেকি বলবে তো ? না,মানে, এ্যাইনু-নুন দিতে ভুলে গেছো কিনা, তাই- -কি! তবে যে এতোক্ষণ প্রশংসা করছিলে, ওঠো, ওঠো বলছি,আর খেতে হবে না -ফূঁসে উঠে রূপসা । কাঁচুমাচু মুখ অমলের -আহা, চটছো কেন ? এ্যাই রূপসা- -কবি নাকচু ! মেয়েদের মন রাখতে জানে না,ডাক্তারি ছুরি চালায় – শোনো, শোনো রূপসা, একটা কথা- অনুনয় করে অমল । -উহু,আর একটা কথাও নয়,এবার তুমি বিদেয় হতে পারো- অমল কি যেন লিখছিলো । ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে রূপসাথমথমে মুখে, আচ্ছা,অমলদা,এই চিঠিটা তুমি পাঠিয়েছো ? ফর্সা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম,ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে রূপসা । অমল গভীর চোখে তাকায়। রূপসাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে । হাল্কা পিংক কালারের চুড়িদার, কপালের টিপটাও ম্যাচ করা । বা- হাতে সোনার বালা, ডানহাতে সোনার ঘড়ি । চুলগুলো হস্টেল করে বাঁধা । ছিমছাম রুচিসম্পন্ন বেতসলতার মতো ছিপছিপে শরীর । রোদের আঁচে মুখখানায়সিঁদূরে আমের ছোপ । দারুণ আ্যাট্রাকটিভ্!
অমলের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে একটুও নরম হয়না রূপসা । অধৈর্য্য কন্ঠে বলে -কি হলো ? কথা কানে ঢুকছে না বুঝি ? চিঠিটা তুমি লিখেছো কিনা-অমলদা, শুনছো-, -হ্যাঁ,কি যেন বলছিলে তুমি? ও হ্যাঁ,চিঠির কথা তো? ওটা আমিই-কি করি বলো,বাড়িতে গেলে দু’টো কথাই বলা যায় না -বসো না,বসো, আইসক্রীমখাবে ? -না । আচ্ছা,কি এমন জরুরী কথা যে – একান্তে দেখা করতে চেয়েছো ? ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করলে কৃতার্থ হই- গ্রীবা বাঁকিয়ে বলেরূপসা । ঢোঁক গিলে অমল-আ-আমি তোমায় ভালোবাসি রূপসা – আ্যঁ! কি,বললে? ভা-ল-বা-সা-টেনেটেনেকথাটা বলে রূপসাতির্যক দৃষ্টিতে তাকায়। বুকেকেমন একটা কষ্টের সুড়সুড়ি টের পায় অমল । রূপসার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনা,তবু মরীয়া হয়েই বলে-বিশ্বাস করো, কথাটা অনেকদিন থেকেই বলবো, বলছি করে -শেষ অব্দি- রূপসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় অমল । রূপসার মুখের বিদ্রুপের হাসি-ও,ভালবাসা কি ফুটপাতে কেনা জিনিষ যে যখন খুশি ছুঁড়ে দিলেই হলো ? তোমার সাহস তো কম নয় ? -কেন? অমন করে বলছো কেন? আমি কি এতোটাই অপদার্থ? কেন অমন আত্ম অহংকারের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছো তুমি ? তাছাড়া, সামাজিক প্রতিপত্তি, যশ,অর্থ বলো কি নেই আমার যে- -বেশতো ! তা,আমার পেছনে ঘুরঘুর না করে অন্য কোথাও ছিপ্ফেলে দেখো না, ওরা তোমাকে লুফে নিতে পারে,আমিও বাঁচি- দমকা হাওয়ার মতোইকথার তির ছুঁড়ে বেড়িয়ে যায় রূপসা । ব্যথাহতঅমলেরদৃষ্টি ওর গমনপথের দিকে । একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস বেড়োয় । রূপসা যে কোন ধাতুতে গড়া বুঝতে পারেনা । অথচ, এমনও হয়েছে, কোন মেয়ে পেশেন্টের একটু বেশী যত্ন-আত্তি নিলে ওই রূপসাই রেগে একেবারে কাঁই, আশ্চর্য্য !
-এ্যাই,অমল, রূপসারকথা কিছু বললিনা? কি হলো তারপর ? বন্ধুর কথায়ম্লানএকচিলতেহাসি অমলের ঠোঁটে ঝুলে,বলবার মতো তেমন কিছু নয় রে । তোরা ঠিকই বলেছিস,অদ্ভুত খামখেয়ালী ওই রূপসা, রহস্যময়ীও বটে- -তবে যে শুনেছিলাম, তোদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে- -হ্যা়ঁ, তা ঠিক, কিন্তু সবই ভবিতব্য বুঝলি ! ওর বাবা- মা বিয়েতে রাজি হলেও অজ্ঞাত কারনেরূপসা নিজেইবেঁকে বসলো – -সে কিরে! ও না তোকে ভালোবাসতো,-আমরাও দেখেছি- অমল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । -কি জানি, হয়তো বাসতো,হয়তো বাসতো না,আসলে, ও যে ঠিক কি চাইতো তাই ও হয়তো নিজেই জানতো না। ওর মনের খবর,বাড়িতে গেলে যত্ন-আত্তি,দু-চারদিন দেখা না হলে খুনসুটি,দেখা হলেও তর্কের খেলায় মেতে আমায় নাস্তানাবুদ করতো -আমি অনেক ভেবেছি জানিস ! সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে ঠেকছে- -হুম। বুঝলাম। ওঠ্চলতো, এবারে আমি নিজেই আসরে নামবো । জিজ্ঞেস করবো, ওর মতলবটা কি? -না,থাক। লাভ নেই বন্ধু । অনেক দেরী হয়ে গেছে,ওরা এখানে নেই – -সেকি! নেই মানে ? কোথায় গেছে জানিস না ? – নাহ্ এখানে ছিলাম না, এসে দেখি
বছর খানেক পর । পুরীর সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যকে দেখছিল একটি তরুনী। দু’চোখে অপার বিস্ময় ভরা মুগ্ধতা আঁকা! অন্তহীনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এসে সমুদ্র তটে আছড়ে পড়ছে, সাদা ফেনা মুখে । সমুদ্রের নোনা জলে মেয়েটির পা ভিজে যাচ্ছে। পাশেই একজন বৃদ্ধ,কি যেন বলছেন মৃদুস্বরে মেয়েটিকে । অমল আনমনে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটছিল। একসময় মুখ তুলতেই ওর দৃষ্টিটা থমকে যায়,কেমন যেন চেনা চেনা মুখের আদল! পা-পা-এগোতেই একেবারে মুখোমুখি । কয়েক পলক দুজনেই বোবা ! অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে বাকহীন অমল! তরুনীই বিস্ময়মাখা কন্ঠে বলে-ওমা! কি আশ্চর্য্য! অমলদা! এখানে? কি ব্যাপার? অমল দেখে,অনেক শুকিয়ে গেছে রূপসা । আয়তচোখের কোলে গাঢ় কালির পোঁচ,সেই সতেজ লাবন্যআজ ম্লান । মনটা নিদারুণ কষ্টে হু-হু করে । অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত করে রূপসার দিকে তাকায়-কেমন আছো রূপসা ? এখানে বেড়াতে এসেছো বুঝি ? অমল এগিয়ে রূপসার বাবাকে প্রণাম করে-কেমন আছেন মেসোমশাই? কবে এলেন? এদিকে বেড়াতে বুঝি? রূপসার বাবা এখানে অকস্মাৎ অমলকে দেখে অপ্রস্তুত একটু, কি জবাব দেবেন ভেবে পাননা, আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবার আগেই রূপসা বাবাকে সরিয়ে অমলের সামনে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে মুখিয়ে ওঠে-কি অদ্ভুত! আমার ভালোমন্দ নিয়ে এখনো বুঝি তোমার ভাবনার শেষ হয়নি অমলদা? কেমনতরো মানুষ তুমি? কেন এতো দরদ বলতে পারো ? অমল চমকে উঠে । বেদনায় ছেয়ে যায় অন্তর । সেই রূপসা ! একটুকুও বদলায়নি । কিন্তু কেন? অমলের প্রতি এই রূঢ় আচরণ কেন? কথাবার্তা ও কেমন চ্যাছাছোলা, খিটখিটে গোছের ! অথচ,এই রূপসা তো অমন ছিলো না ! কি হয়েছে ওর! তবে কি-তবেকি রূপসা অসুস্থ? কি অসুখ! তাই কি রূপসা -কেন যেন বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো একটা কথা খেলে যায় অমলেরমস্তিষ্কের কোষে কোষে। একটু হেসেই বলে-তুমি কিন্তু অনেক পাল্টে গেছো রূপসা । তা, যাকগে,সুখে আছতো ? রূপসা ভ্রুভঙ্গি করে-তা,সেটা জানতেই কি এতোদূর অব্দি ধাওয়া করে এসেছো ? -না,আমি তোমার সুখের ব্যালান্স মাপতে আসিনি । সে ইচ্ছে ও নেই । এখানে একটা কনফারেন্স ছিলো । আচ্ছা,একটা কথার জবাব দেবে ? বারবার আমাকে আঘাত করে কি সুখ পাও তুমি? কেন রূপসা? কি অপরাধে এমনি করে সূচ ফোটাও কথার ঘায়ে? কেন এমন করো বলো? এ্যাই,এই রূপসা,জবাব না দিয়ে চলে যাচ্ছো যে- রূপসা নির্বিচারে আরেকটা চাবুক মারে অমলকে- সত্যি বলবো? তবে শোনো, তোমাকে কিছুতেই সহ্য করতেপারিনা বলে- একমূহূর্ত আর দাঁড়ায় না, হনহনিয়ে এগিয়ে যায়।
বেদনার তীব্র কষাঘাতে অমলের মুখে ছাইরং। বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, দু’চোখ ঝাপসা্- হঠাৎ কাঁধে কার হাতের স্পর্শ! চমকে মুখ ফেরাতেই -রূপসার বাবাকেদেখে অবাক হয়-একি,আপনি! রূপসার বাবা মৃদুস্বরে বলেন-তোমার মনের কষ্ট আমি সব বুঝি বাবা, কিন্তু- তুমিও যে জানো না,তোমাকে এভাবে বারবার আঘাত করে আমার হতভাগী মেয়েটা শতধা হয়,কতো কষ্ট সে তার বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে তাতুমি কল্পনাও করতে পারবে না বাবা! হতভম্ব অমল -এসব কি বলছেন আপনি? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি নে,রূপসার কিসের কষ্ট, কি হয়েছে? আমি তো কিছুই জানিনে- বৃদ্ধ ধুতির খুটে চোখদুটো মুছেন-,কি করে জানবে বাবা? ও তো জানাতে দেয়নি,আজ ও বলতাম না, মেয়ে যে দিব্যি দিয়েছিলো, কিন্তু তুমি আমার মেয়েটাকে বিনাদোষে ভুল বুঝে ওকে ঘৃণা করে ওর প্রতি মিথ্যে ধারনা নিয়ে যাবে,বাবা হয়ে সেটা কি আমি মেনে নিতে পারি বলো-ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধ । বিস্ময়ের সীমা থাকেনা অমলের । ছুটে গিয়ে সযত্নে বৃদ্ধকে বসিয়ে চোখ মুছিয়ে বলে-কিছু লুকোবেন না মেসোমশাই । আমি আপনার ছেলের মতো । প্লিজ, বলুন, কি এমন হয়েছে রূপসার? কেনইবা বিয়ের কার্ড ছাপানোসত্ত্বেও রূপ সাবিয়ে ভেঙ্গে দিলো-কেন সে-গভীর বিষাদের সুর বৃদ্ধের – সেকথাই বলছি বাবা- একে একে ঝাপসা কালোপর্দা যতোই সরতে থাকে, নিবিড় ব্যথায় ছেয়ে যায় অমলের মন । সব এখন পরিস্কার, দিবালোকের মতো । সমস্ত অন্তর মোচড় দিয়ে উঠে,মানসপ্রতিমা জ্যোতির্ময়ী হয়ে ধরা দিলো, সব ভ্রান্তির অবসানে । রূপসাকে রাজ রোগে ধরেছে !
রূপসা!
-কে!কে?অমলদা! এতো আঘাত দিই , তবুও বারবার কেন ছুটে ছুটে আসো ?কেন অমলদা? কেমন মানুষ তুমি! এই যে ,কতো কটু কথা বলি ,তাই শুনেও!ঘৃণা ,উপেক্ষা,এগুলো কি গায়ে বাজেনা এতোটুকুও? দু’হাতে মুখ ঢাকে রূপসা ।আঙ্গুলের ফাঁক বেয়ে ঝরঝরিয়ে অশ্রু গলে পড়তে থাকে টপ টপ
– আমায় ক্ষমা করো রূপসা ।আমি তোমায় ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু ,কেন ?কেন লুকোতে গেলে আমাকে?মিথ্যে ছলনা করার কি দরকার ছিল বলো?আমার উপর ভরসা রাখতে পারোনি? আচ্ছা,পাগল মেয়েতো !ভালবাসা কি এতোই ঠুনকো?ধরো,আমাদের বিয়ের পরে যদি ঐরকম একটা অসুখ আমারই হতো ,তাহলে,কি তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে রূপসা?
-চুপ করো অমলদা।বালাই ষাট!তোমায় ভালোবাসি বলেই এই ক্ষয়াটে জীবনের ভারে তোমার জীবনটাও দূর্বিসহ হোক তা চাইনি,আর তাই-পালিয়েছিলাম । কিন্তু শেষরক্ষা হলো কৈ! হতাশায় কন্ঠস্বর বুজে আসে রূপসার ।
অপরিসীম মমতায় ,ভালবাসায় অমলের মনটা দুলে উঠে ,চোখ মুছিয়ে দেয় রূপসার,ছিঃ কাঁদে না ,আর কখনো ও রকম কথা বলবে না ।একটা জীবনে মানুষ সবকিছু পায় না রূপসা ,তাই বলে তো জীবন মলিন হয়ে যায় না ,জীবনের মূল্য ও কমে যায় না ।জীবনকে উপেক্ষা করা যায় না কিছুতেই ।তারচে’ চলো না কিছুদিনের পাওয়া জীবনটাকে, দু’জনে মিলে বদলে ফেলি–চলো না ,রূপসা,আমরা একটু সুখের নীড় রচনা করি-
– না,না, তা আর হয়না অমলদা ! কালের ভেরী বাজে ,ঐ ওই শুনি পদধ্বনি তার ,আমার বুকের মাঝে- বড্ড দেরী হয়ে গেছে যে-
গলা বুঁজে আসে-রূপসার-
-কোন দেরী হয়নি,যা বাকি আছে ,তাই বা কম কি! যদ্দিন বাঁচবো পুরো সময়টাই নিজেদের মনের মতো করে বাঁচবো আমরা দু’জনে কেমন? মিষ্টি হাসি ছলকে উঠে রূপসার পান্ডুর মুখে,সত্যি! অমলের খুব ভালো লাগে,কতোদিন পর ,সে রূপসার মুখে সেই হাসিটা দেখতে পেলো। উচ্ছ্বসিত আবেগে অভিভূত অমল,চলো না,আমরা চেরাপুঞ্জি চলে যাই! ,সারাবছর সেখানে মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা ।গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো পাহাড়গুলির গা ‘বেয়ে নেমে আসছে অসংখ্য বেনীর মতো ঝর্ণা ।চারপাশে সবুজ পাহাড়,আর মেঘ, চেরাপুঞ্জির দূর্গম চড়াই-উৎরাই পথ।নীচে গভীর খাদ। আর জানো,ঝিরঝির বৃষ্টির শাওয়ারে স্নান করছে পাহাড়ের গা’য় জন্মানো রঙ-বেরঙের ফুলগুলি।কুয়াশায় ঢাকা শৈলভূমি চেরাপুঞ্জি।যেন নৈঃস্বর্গের স্বপ্নভূমি!ওই খানে,মেঘের দেশে তুমি আর আমি কালকেই চলে যাবো রূপসা-
রূপসার চোখে আলোর ফুলকি ঝিকমিক করে। অমল পরম মমতায় রূপসার মাথায় হাত বুলাতে থাকে আহ্ কি শান্তি!কি মধুর! অমলের স্নেহশীতল ছোঁয়ায় রূপসার চোখ বুজে আসে ।