বিসর্জনে আগমনীর সুর
দাদুর ডাকে সুবল তাড়াতাড়ি অন্য ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে চিৎকার করছ কেন?
আমি তো ওই অসুরের মুখটা রঙ করছিলাম। রঙের কৌটো হাতেই ধরা তখনও।
সুবলের দাদুও তখন একতাল মাটিতে কি একটা আঠা আর খরের কুচি দিয়ে মিশ্রন করছিল। ‘ভাদ্রমাস’ কখনো বৃষ্টি কখনও জ্বালাপোড়া গরম।
এই প্লাস্টিকের ঝুপড়ির মধ্যে ঠাকুর বানানো; ছোটছোট আলাদা আলাদা ঝুপড়ির মধ্যে কত মাটির মূর্তি বানানো হয়, সে না দেখলে বোঝা যাবেনা। প্রতিমার প্রতিষ্টা প্রথম এই ছোট ঝুপড়িতেই। এরাই প্রতিমার প্রকৃত রূপ সৃষ্টি করে একদম ধ্যান অনুযায়ী।
সামনেই দেবীর আগমন।
‘অনেক বায়না আছে’
মহালয়ার আগেই সব প্রস্তুত করতে হবে।
তাই দিনরাত পরিশ্রম করছে সুবল দাদুর সাথে।
সুবলকে দেখে ওর দাদু বললো, কাল ভোরে গিয়ে ওই ওদের বাড়ির মাটি নিয়ে আসবি। নইলে দূর্গা মায়ের মুর্তি সম্পূর্ন হবেনা।
সুবল রেগে যায় দাদুর কথা শুনে।
ও বলে, আমি এবারে যেতে পারবোনা। ওরা খুব গালগালি করে।
দাদু বলে- হুমম.. কি একেবারে সব সতীলক্ষ্মী। বলেই একটা মুখভঙ্গি করে একটা গালাগালি দিল ওদের উদ্দেশে।
তারপর আবার নিজের মনেই বললো, ওদের অনেক ভাগ্য ভালো যে দেবীঅঙ্গে স্থান পায় ওই বেশ্যা বাড়ির মাটি! অর্ধসমাপ্ত দেবী প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বললো, মায়ের কৃপায় ওরা ওই নোংরা জীবন থেকে উদ্ধার হয়। তাই আবার বেশি দেমাক; এই বলে সুবলকে আবার বলে..
কিছু টাকা চাইলে ছুঁড়ে দিয়ে আসিস মুখের ওপর। ওরাতো টাকা ছাড়া কিছু বোঝেনা; এই বলে আবার একটা গালাগালি দিয়ে উঠলো।
রাস্তার এপার আর ওপার।
পোটো পাড়ার ঠাকুর গড়ে সুবল। সুবলের এখানেই জন্ম। ছোট্ট বেলা থেকে ওদের দেখে অভ্যস্ত।
কতবার ওদের বাড়ির ভেতর থেকে ঘুড়ি কুড়িয়ে এনেছে! তখন ওরা কিছু বলতনা। কিন্তু এখন একটু মাটি চাইতে গেলেই তাড়া করে।
ওরা বলে দুর্গা ঠাকুরের পূজোর সময় আমাদের একটু অঞ্জলী দিতে দেয়না-এদিকে আমাদের বাড়ির মাটি না হলে দেবী সম্পূর্ণ হবেনা! যাও যাও মাটি পাবেনা। হুমমম, যত্তসব ভদ্রলোক বাবুরা।
সব দিনের বেলায় মা দুগ্গার পূজো করবে, আর মাঝ রাতে আমাদের ঘরে এসে আরাম করবে। হুমম, সবাইকে আমাদের চেনা আছে!
সুবল আগে ওদের কথাবার্তা ঠিক বুঝতো না। কিন্তু ইদানিং সব বুঝতে পারে। তাই ওদের ওখানে যেতে চায়না।
তবুও অগত্যা যেতে হবে। দাদু আবার গোঁজামিল দিয়ে ঠাকুর গড়বে না। তাতে নাকি দেবী রুষ্ঠ হবে।যত্তোসব কু-সংস্কার!
সুবল ভাবে, কে দেখতে আসছে তোমার মাটি!! এদিকে ওদের উঠোনের মাটি চাইতে যাওয়া এক বিভ্রাট। ওরা গালাগালি দিয়ে এইসব বলতে থাকবে। ওর একদম পছন্দ হয়না।
ওদিকে সুবল কখনো যায়নি। দাদুই যেত। এখন আবার দু বছর ধরে যায় দাদুর অনুরোধে।
ওর যেতে ইচ্ছে করেনা। ছোট বেলায় ও বুঝতোনা এদের সবাই কেন আলাদা চোখে দেখে। অনেক পরে বুঝতে পেরেছিল।লেখাপড়া করেছে মাধ্যমিক পর্যন্ত। কিন্তু এর বেশি পড়াতে পারেনি দাদু।
ওর বাবা মা- এক বছরের মাথায় অসুস্থ হয়ে ওকে রেখে স্বর্গে চলে গেল। তখন ওর মাত্র এগারো বছর বয়স। ঠাকুমা তো কবেই মারা গেছে। দাদুর কাছেই বড় হ’ল। আর সেই থেকেই দাদুর সাথে প্রতিমা গড়ার কাজ শিখলো।
এখন সুবলের প্রাপ্ত বয়স। ও এখন বেশ ভালোই মৃৎশিল্পে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। ওর হাতের ছোঁয়ায় এক একটি প্রতিমা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। মা.. দূর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর চোখ আঁকে ও নিজেই। একদম ওর নিজের মায়ের ছবির চোখের মতো। ওর মাকেও একদম প্রতিমার মতো দেখতে ছিল।
দাদু আবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, কি হ’ল কথাটা কানে গেছে? সুবল আর কিছু না বলে- ঠিক আছে বলে, মুখ ব্যাজার করে নিজের কাজ করতে চলে গেল।
পরের দিন সকাল সকাল একটি পাত্র নিয়ে সুবল ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকতে সাহস পাচ্ছেনা। যদি এবারও গালমন্দ করে!
সকালের সুর্য, আকাশ মেঘে ঢাকা। গুরুম গুরুম মেঘের গর্জন। যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে। দেখলো একটি বেশ সুন্দরী মেয়ে প্রতিমার মতো দেখতে, বেড়িয়ে এসে সুবলকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, এতো সকালেই আসতে হ’ল?
সবে তো সকাল হয়েছে বাপু।
সুবলের চোখে মুখে লজ্জা আর ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠলো। ভাবলো, দাদু এদের এইজন্য সহ্য করতে পারেনা।
সুবল নিজের রাগকে সংযত রেখে বললো, আমি একটু মাটি নিতে এসেছি।
দুর্গা প্রতিমা গড়তে লাগবে। আমি ওপারে পোটো পাড়ার ছেলে, ঠাকুর তৈরী করি। প্রতিমা গড়ি।
সুবল আরো বলে, মা..দুর্গার মুর্তি গড়তে বেশ্যা বাড়ির মাটি লাগে, তাই নিতে এসেছি।
এমন সময় ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামলো। তেমনি মেঘের গর্জন।
মেয়েটি সুবলকে তাড়াতাড়ি নিজের বারান্দায় উঠে দাঁড়াতে বললো। এরপর একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে ওর হাতে একটা প্লেটে মিষ্টি আর জল দিয়ে বললো, এটা খেয়ে নিন। ‘ঠাকুরের প্রসাদ’ সুবলের তখন এক মাসিমার কথা মনে পড়লো। ও বললো, আমি ছোট বেলায় খুব আসতাম জানো! একজন মাসিমা আমাকে ঠাকুরের প্রসাদ দিত। আজ আবার তুমি দিলে। মেয়েটি বললো, উনি আমার মা ছিল।
সুবল অবাক হয়ে দেখলো সত্যি যেন এই মেয়েটিকে ওই মাসিমার মতো দেখতে। ততক্ষণে বৃষ্টি নামল মুষলধারায়।
সুবল জিজ্ঞাসা করলো, তখন তোমায় দেখতে পাইনি তো! মেয়েটি হেসে বললো, আমি ছোট থেকে মাসির বাড়ি থাকতাম। মা. আমাকে এই নরক থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল।
আমার মাকে আমার বাবা বিয়ে করে গ্ৰাম থেকে এনে এখানে বেচে দিয়ে অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। আমার তখন পাঁচ বছর বয়স।
মা..আমাকে মাসির বাড়ি রেখে এসেছিল। কিন্তু, আমার পোড়া কপালের দোষে আমাকেও এখানেই আসতে হ’ল।
সুবল অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো কেন?
মেয়েটি দৃষ্টি নামিয়ে বললো,
মা মারা যাবার পর, বাবা কোথা থেকে এসে মাসির বাড়িতে হামলা করে, আমাকেও এখানে আবার নতুন করে বেচে দিল।
এইতো সবে তিন মাস হলো এসেছি। বলে কাঁদতে লাগলো। এরই মধ্যে কত ভদ্রলোককে খুশি করলাম বলে, চোখে বিতৃষ্ণার হাসি খেলে গেল।
সুবলের চোয়াল শক্ত হচ্ছে।
আর ভাবছে, ছিঃ মা..দুর্গার মুর্তি বানিয়ে কি হবে!! আসল মাকেই যারা রাতের অন্ধকারে কলুষিত করে!
মেয়েটি সুবলের হাত থেকে জলের গ্লাস ফেরত নিতে নিতে আবার বললো, জানেন, আমরা স্বেচ্ছায় এপথে আসিনা। অনেকেই পেটের দায় আসে আবার অনেকেই বাধ্য হয় অনেককেই আবার জোর করে আনে। যেমন আমার বাপ।
এই বলে, ফুঁপিয়ে কাঁদে। সুবলের মনে যেন একটা ধাক্বা লাগলো। মেয়েটির বয়স কত আর হবে, এই আঠারো উনিস’ এরকম কারোর বাপ হয়!!
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায়না সুবল।
বৃষ্টি তখনও অঝোরে ঝড়ছে। মেয়েটি বললো, আপনি কিছু মনে করবেন না সব বললাম বলে। দূর থেকে আমাদের দেখে সবাই ঘৃণা করে। আমরা ঘৃণার পাত্রি। অথচ মায়ের মুর্তি গড়া বা দেবী দুর্গার পূজোয় এই বাড়ির মাটি না হলে চলেনা। কেন বলতে পারেন? এই বলে তির্যক দৃষ্টিতে সুবলের চোখে চোখ রাখে।
সুবল এক মুহূর্ত ভাবে, ঠিকই তো বলেছে। এই প্রশ্নের উত্তর ওর জানা নেই। ওর দৃষ্টি তখন মেয়েটির মুখের ওপরে নিবদ্ধ।
নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কি? মেয়েটি বলে ‘জয়া’ মায়ের দেওয়া নাম। মেয়েটি আবারও বলে, জানো; আমি যেদিন প্রথম এখানে এলাম, সেদিন ঠিক আমার বাবার বয়সী একজন প্রথম আমার সর্বনাশ করলো। আমার কত স্বপ্ন ছিল বড় হব…. লেখাপড়া শিখবো। কিন্তু….. এই বলে কাঁদতে লাগলো। সুবল হাত মুষ্ঠি করে নিজেকে সংযত রাখছে। সুবলের মুখে কথা নেই। এই সমাজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে।
সুবল আবার জয়াকে জিজ্ঞেস করে, তোমার মাসি তোমাকে ছাড়লো কেন? তোমার বাপকে তো ভালই চেনে!
জয়া বললো, বাপটা মাসিকে বলেছিল, তার এখন অনুতাপ হচ্ছে স্ত্রীর মৃত্যুতে। তাই মেয়েকে নিয়ে নিজের কাছে রেখে একসঙ্গে থাকবে। বয়স হচ্ছে কেউ দেখার নেই মেয়ে সঙ্গে থাকলে ভরসা পাবে। মাসিও বিশ্বাস করেছিল।
তাছাড়া মাসির অভাবের সংসার। নিজের দুটো মেয়েকে নিয়ে বিধবা মানুষ ক্ষেতখামারে কাজ করে পেট চালায়। বোঝা যত নামে ততই মঙ্গল। কে বলো পরের বোঝা ঘাড়ে নেয়! এই বলে জয়া চুপ করলো।
প্রায় ঘন্টা খানিক বাদে বৃষ্টি থামতে, জয়া নিজের হাতে উঠোন থেকে মাটি তুলে দিয়ে বললো, প্রতিমা লেপনের মাটি দিলাম নিয়ে যাও। এবার আমাদের একটু প্রতিমা দর্শন করতে দিও। মায়ের চরণে যেন একটু ফুল অর্পণ করতে পারি। ছলছল চোখে কি ছিল কে জানে? সুবলের অন্তরে একটা ঘা..পড়লো।
এরপর সুবল, প্রায়ই আসতে লাগলো। জয়ার কাছে। ক্রমশঃ সুবলের মন জয়ার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই জয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসতো। ভালো লাগতো জয়াকে। একদিন জয়া সুবলকে জিজ্ঞেস করে, তুমি এখানে আসো কেন?
সুবল সেদিন ওর মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বলেছিল, দেবী দর্শন করতে। জয়ার হৃদয় কম্পন হ’লো। পুরুষের এমন স্পর্শ আগে কখনো অনুভব করেনি। পুরুষের স্পর্শে যে এতো শিহরণ লাগে,এই প্রথম উপলব্ধি করলো। ওর দুচোখের পাতা লজ্জায় বুজে এলো।
সুবল ওর কানের কাছে মুখ এনে বললো, আমার হৃদয়শ্বরী তুমি। জয়া অন্য জগত থেকে বললো, কিন্তু আমি যে অস্পৃস্য গো সমাজের জঞ্জাল। আমাদের কেউ ভালবাসেনা। ভোগ করে টাকা দেয়। জয়াকে বাহুডোরে বেঁধে সুবল বললো, নাহ্ শরীরে নোংরা লাগলে ধুয়ে ফেলা যায়, তোমার মনে কোথাও অস্পৃশ্যতা নেই, তুমি নারী, দেবীর অংশ, তুমি শুদ্ধ। আর কখনো ওই কাজ করবেনা। আমি তোমার সব দায়িত্ব নেব। জয়ার দুচোখ জলে ভরে উঠলো আনন্দে আবেগে।
সুবলের বুকের ওপর মাথা রাখে। শান্তির ওম যেন জয়ার সমস্ত কিছু শুদ্ধ করে দিচ্ছে। সুবল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কথা দিল তুমি শুধু আমার। আর কারোর সঙ্গে শয্যাসঙ্গীনি হবেনা।
এরপর থেকে জয়া কোনো বাবুকে আর ঢুকতে দেয়না। সেই নিয়ে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয় ওকে। তবুও সে সুবলকে পেয়েছে। ভালবাসর সন্ধান।
জয়ার জীবনে আলোর দিশা।
দেখতে দেখতে দুর্গোৎসব এসে গেল। পোটো- পাড়ারার পূজোয় জয়া ও সুবল একসঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রতিমার চরণে পুষ্পাঞ্জলী দিল।
বিজয়া দশমীর দিনে দেবী বরণ হচ্ছে, সবাই সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে, এমন সময় সুবল মুঠো ভর্তি সিঁদুর জয়ার সিঁথিতে ও সারা মুখে ভরিয়ে দিয়ে বললো,
তুমি আমাকে মাটি দিয়েছিলে দেবীর অঙ্গ লেপনের জন্য, আমি তোমাকে আজ দেবী বরণের সিঁদুর তোমার মাথায় দিয়ে শোধ করলাম।
জয়া অবাক হয়ে চমকে উঠলো।
সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ওদের ওপর।
সুবল বললো, আজ থেকে তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী.. দেবী দুর্গা, এবং সমস্ত অধিবাসিবৃন্দ সাক্ষী রইল।
সুবলের দাদুর কানেও কথাটা গেল সঙ্গে-সঙ্গে। এবং জয়ার পরিচয়ও পেল লোকমুখে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর, দুর্গা মন্ডপে ছুটে এলো দাদু। সুবল জয়াকে দাদুর সামনে এনে বললো,
এই তোমার নাতবৌ; আর্শীব্বাদ করো দাদু, যেন ওকে অন্ধকার জীবনে আর না থাকতে হয়।
সুবলের দাদু জয়ার পবিত্র সুধামাখা মুখখানি দেখে, ওর মধ্যে মা দুর্গার রূপ দেখতে পেল। দুজনকে দুই হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললো, জয় মা-দুর্গার জয়। ঠিক তখনি ঢাকের বাদ্যিতে বিজয়ার সুরে ভরে উঠলো আকাশ বাতাস।
দাদু বললো, বিজয়ার সুর মানে বিসর্জন নয়, বিজয়ের উৎসব!! জয়ের আনন্দে মুখরিত আজ আকাশ বাতাস। সবাই বলো জয় মা দুর্গার জয়। জয়ারও জীবন আজ বিজয়ের আনন্দে ভরে উঠলো। বিসর্জনের বাজনায় যেন আগমনী সুর।