সদ্যোজাত শিশুকণ্ঠের কান্না
হঠাৎ সদ্যোজাত শিশুকণ্ঠের কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙিয়া গেল…পাশের ঘর হইতে কে যেন জলদমন্দ্র স্বরে বলিল, লিখে রাখ, ৩রা চৈত্র ১টা ১৭ মিনিটে জন্ম…
রাত্রে এক স্বপ্ন দেখিয়াছি। কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছি না; এত স্পষ্ট, এত অদ্ভুত। আমার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। অহিদত্ত রঞ্জুল, বৃদ্ধ অসিধাবক তণ্ডু, লালসাময়ী রল্লা
এ কি স্বপ্ন? না আমারই মগ্নচৈতন্যের স্মৃতিকন্দর হইতে বাহির হইয়া আসিল আমার পূর্বতন জীবনের ইতিবৃত্ত! পূর্বতন জীবন বলিয়া কিছু কি আছে? মৃত্যু জানি, কিন্তু সেইখানেই তো সব শেষ। আবার সেই শেষটাকে শুরু ধরিয়া নূতন কোনও জীবন আরম্ভ হয় নাকি?
আমার স্বপ্নটা যেন তাহারই ইঙ্গিত দিয়া গেল। একটা মানুষের জীবন—সে মানুষটা কি আমি?—উল্টা দিক দিয়া দেখিতে পাইলাম; এক মৃত্যু হইতে অন্য জন্ম পর্যন্ত। বীজ হইতে অঙ্কুর, অঙ্কুর হইতে ফুল ফল আবার বীজ—ইহাই জীব-জগতের পূর্ণ চক্র। কিন্তু এই চক্র পরিপূর্ণভাবে আমাদের দৃশ্যমান নয়, মাঝখানে চক্রাংশ খানিকটা অব্যক্ত। মৃত্যুর পর আবার জন্ম—মাঝ দিয়া বিস্মরণের বৈতরণী বহিয়া গিয়াছে। আমার স্বপ্ন যেন এই বৈতরণীর উপর সেতু বাঁধিয়া দিল।
সত্যই কি সেতু আছে? আমি বৈজ্ঞানিক, অলীক কল্পনার ধার ধারি না। আলোকরশ্মি ঋজু রেখায় চলে কি না, এই বিষয় লইয়া গত তিন বৎসর গবেষণা করিতেছি। কঠিন পরিশ্রম করিতে হইয়াছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোধ হয় সত্য সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি। কাল আমার কাজ শেষ হইয়াছে। হালকা মন ও হালকা মস্তিষ্ক লইয়া শয়ন করিতে গিয়াছিলাম। তারপর ঐ স্বপ্ন! ভাবিতেছি, এ-স্বপ্ন যদি অলীক কল্পনাই হয়, তবে সে এই সকল অদ্ভুত উপাদান সংগ্রহ করিল কোথা হইতে? আমার জাগ্রত চেতনার মধ্যে তো এ-সকল অভিজ্ঞতা ছিল না! কল্পনা কি কেবল শূন্যকে আশ্রয় করিয়া পল্লবিত হয়? রক্তের মধ্যে সামান্য একটু কার্বন-ডায়ক্সাইডের আধিক্য কি নিরবয়ব নাস্তিকে মূর্ত বাস্তব করিয়া তুলিতে পারে?
জানি না। আমার যুক্তি-বিধিবদ্ধ বুদ্ধি এই স্বপ্নের আঘাতে বিপর্যস্ত হইয়া গিয়াছে।
যে-শিশু কাঁদিয়া উঠিল, সে কে? আমি? আর সেই জলদমন্দ্র কণ্ঠস্বর!—পুরাতন ডায়েরি খুলিয়া দেখিতেছি, ৩৫ বৎসর পূর্বে ৩রা চৈত্র রাত্রি ১টা ১৭ মিনিটে আমার জন্ম হইয়াছিল।
দেখিতেছি, আমার সম্মুখে অত্যুজ্জ্বল অঙ্গার-পিণ্ড জ্বলিতেছে। বৃহৎ অঙ্গার-চুল্লী, ভস্ত্রার ফুকারে উগ্র নিধুম প্রভায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে, আবার ভার বিরামকালে অপেক্ষাকৃত নিস্তেজ রক্তিমবর্ণ ধারণ করিতেছে। এই অগ্নির মধ্যস্থলে প্রোথিত রহিয়াছে আমার অসি-ফলক।
কক্ষ ঈষদন্ধকার; চারিদিকে নানা আকৃতির লৌহ-ফলক বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। কোনটি খঙ্গের আকার ধারণ করিতে করিতে সহসা থামিয়া গিয়াছে; কোনটি দণ্ডের আকারে শূল অথবা মুদগরে পরিণত হইবার আশায় অপেক্ষা করিতেছে। প্রাচীরগাত্রে সুসম্পূর্ণ ভল্ল অসি লৌহজালিক সজ্জিত রহিয়াছে। অঙ্গার-পিণ্ডের আলোকে ইহারা ঝলসিয়া উঠিতেছে, পুনরায় স্নান অস্পষ্ট হইয়া যাইতেছে।
এই দৃশ্য দেখিতে দেখিতে স্বপ্নলোকে জাগিয়া উঠিলাম। জ্বলন্ত চুল্লীর অদূরে বেত্রাসনে বসিয়া আমি করলগ্ন-কপোল দেখিতেছি, আর অসিধাবক তণ্ডু অগ্নির সম্মুখে বসিয়া ভস্ত্রা চালাইতেছে।
এই দৃশ্য আমার কাছে একান্ত পরিচিত, তাই বিস্মিত হইতেছি না। চেতনার মধ্যে ইহার সমস্ত পূর্ব-সংযোগ নিষ্ক্রিয়ভাবে সঞ্চিত রহিয়াছে। এই ছায়ান্ধকার কক্ষটি উজ্জয়িনীর প্রসিদ্ধ শস্ত্র-শিল্পী তণ্ডুর যন্ত্রাগার। আমি দক্ষিণ মণ্ডলে উপনিবিষ্ট শকবাহিনীর একজন পত্তিনায়ক—আমার নাম অহিদত্ত রঞ্জুল। আমি তণ্ডুর যন্ত্রাগারে বসিয়া আছি কেন? অসি সংস্কার করিবার জন্য? তণ্ডুর মতো এত বড় অসি-শিল্পী শুনিয়াছি শক-মণ্ডলে আর নাই, সে অসিতে এমন ধার দিতে পারে যে, নিপুণ শস্ত্রী তাহার দ্বারা আকাশে ভাসমান কাশ-পুষ্পকে দ্বিখণ্ডিত করিতে পারে! কিন্তু এই জন্যই কি গত বসন্তোৎসবের পর হইতে বারবার তাহার গৃহে আসিতেছি?
চুল্লীর আলোকে তণ্ডুর মুখের প্রত্যেক রেখাটি দেখিতে পাইতেছি। শীর্ণ, রক্তহীন মুখ; গুম্ফ ও জ্বর রোম চুল্লীর দাহে দগ্ধ হইয়া গিয়াছে, গণ্ডের চর্ম কুঞ্চিত হইয়া হনু-অস্থিকে প্রকট করিয়া তুলিয়াছে। ললাটের দুই প্রান্ত নিম্ন। অস্থির বক্র নাসিকা এই জরাবিধ্বস্ত মুখের চর্মাবরণ ভেদ করিয়া বাহির হইবার প্রয়াস করিতেছে। মুখখানা দেখিলে মনে হয় মৃতের মুখ, শুধু সেই মৃত মুখের মধ্যে কোটরপ্রবিষ্ট চক্ষু দুটা অস্বাভাবিক রকম জীবিত,—ভগ্নমেরু মুমূর্ষু সর্পের চক্ষুর মতো যেন একটা বিষাক্ত জিঘাংসা বিকীর্ণ করিতেছে।
তণ্ডু যন্ত্রচালিতের মতো কাজ করিতেছে। আমার অসি-ফলক অঙ্গার হইতে বাহির করিয়া রসায়ন-মিশ্র জলে ড়ুবাইতেছে, সন্তর্পণে ফলকের ধার পরীক্ষা করিতেছে, আবার তাহা অঙ্গারমধ্যে প্রোথিত করিতেছে। তাহার মুখে কথা নাই, কখনও সে সর্পচক্ষু আমার দিকে ফিরাইয়া অতর্কিতে আমাকে দেখিয়া লইতেছে, তাহার পীতদন্ত মুখ ঈষৎ বিভক্ত হইয়া যাইতেছে, অধরোষ্ঠ একটু নড়িতেছে—যেন সে নিজ মনে কথা কহিল—তারপর আবার কর্মে মন দিতেছে।
আমিও তাহার পানে চাহিয়া বসিয়া আছি, কিন্তু আমার মন তাহাকে দেখিতেছে না। মন দেখিতেছে কাহাকে?—রল্লা। লালসাময়ী কুহকিনী রল্লা! আমার ঐ উত্তপ্ত অসি-ফলকের ন্যায় কামনার শিখারূপিণী রল্লা!!
একটা তীক্ষ্ণ বেদনা সূচীর মতো হৃদয়যন্ত্রকে বিদ্ধ করিল। তণ্ডুর দেহ ভাল করিয়া আপাদমস্তক দেখিলাম। এই জরাগলিত দেহ বৃদ্ধ রল্লার ভর্তা। রল্লা আর তণ্ডু! বুকের মধ্যে একটা ঈর্ষা-ফেনিল হাসি তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিল—ইহাদের দাম্পত্য জীবন কি রূপ। নিজের দেহের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলাম। বক্ষে বাহুতে উদ্ধত পেশী আস্ফালন করিতেছে—পঁচিশ বৎসরের দর্পিত যৌবন! তপ্ত শক-রক্ত যেন শুভ্র চর্ম ফাটিয়া বাহির হইতে চাহিতেছে। আমি লোলুপ চোরের মতো নানা ছলে তণ্ডুর গৃহে যাতায়াত করিতেছি, আর তণ্ডুরল্লার স্বামী!
রল্লা কি কুহক জানে? নারী তো অনেক দেখিয়াছি,—তীব্রনয়না গর্বিতা শক-দুহিতা, মদালসনেত্রা স্ফুরিতাধরা অবন্তিকা, বিলাসভঙ্গিমগতি, রতিকুশলা হাস্যময়ী লাট-ললনা। কিন্তু রল্লারল্লার জাতি নাই। তাহার তাম্র-কাঞ্চন দেহে নারীত্ব ছাড়া আর কিছু নাই। সে নারী। আমার সমস্ত সত্তাকে সে তাহার নারীত্বের কুহকে জয় করিয়াছে।
একবার মাত্র তাহাকে দেখিয়াছি, মদনোৎসবের কুঙ্কুম-অরুণিত সায়াহ্নে। উজ্জয়িনীর নগর-উদ্যানে মদনোৎসবে যোগ দিয়াছিলাম। এক দিনের জন্য প্রবীণতার শাসন শিথিল হইয়া গিয়াছে। অবরোধ নাই, অবগুণ্ঠন নাই লজ্জা নাই। যৌবনের মহোৎসব। উদ্যানের গাছে গাছে হিন্দোলা দুলিতেছে, গুল্মে গুল্মে চটুলচরণ নাগরিকার মঞ্জীর বাজিতেছে, অসস্তৃত অঞ্চল উড়িতেছে, আসব-অরুণ নেত্র ঢুলুঢুলু হইয়া নিমীলিত হইয়া আসিতেছে। কলহাস্য করিয়া কুঙ্কুমপ্রলিপ্তদেহা নাগরী এক তরুগুল্ম হইতে গুল্মন্তরে ছুটিয়া পলাইতেছে, মধ্যপথে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পিছু ফিরিয়া চাহিতেছে, আবার পলাইতেছে। পশ্চাতে পুষ্পের ক্রীড়াধনু হস্তে শবরবেশী নায়ক তাহার অনুসরণ করিতেছে। নিভৃত লতানিকুঞ্জে প্রণয়ী মিথুন কানে কানে কথা কহিতেছে। কোনও মৃগনয়না বিভ্রমচ্ছলে নিজ চক্ষু মার্জনা করিয়া কহিতেছে—তুমি আমার চক্ষে কুঙ্কুম দিয়াছ! প্রণয়ী তরুণ সযত্নে তাহার চিবুক ধরিয়া তুলিয়া অরুণাভ নয়নের মধ্যে দৃষ্টি প্রেরণ করিতেছে, তারপর ফুঙ্কার দিবার ছলে গৃঢ়-হাস্য-মুকুলিত রক্তাধর সহসা চুম্বন করিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে মিলিত কণ্ঠের বিগলিত হাস্য লতামণ্ডপের সুগন্ধি বায়ুতে শিহরণ তুলিতেছে।
শত শত নাগর-নাগরিকা এইরূপ প্রমোদে মত্ত নিজের সুখে সকলেই নিমজ্জিত, অন্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবার অবসর নাই। যৌবন চঞ্চল-বসন্ত ক্ষণস্থায়ী; এই স্বল্পকাল-মধ্যে বৎসরের আনন্দ ভরিয়া লইতে হইবে। বৃহৎ কিংশুক বৃক্ষমূলে বেদীর উপর স্নিগ্ধ সুরভিত আসব বিক্রয় হইতেছে—পৈষ্ঠী গৌড়ী মাধুকনাগরিক-নাগরিকা নির্বিচারে তাহা পান করিতেছে; অবসন্ন উদ্দীপনাকে প্রজ্বলিত করিয়া আবার উৎসবে মাতিতেছে। কঙ্কণ, নূপুর, কেয়ূরের ঝনৎকার, মাদলের নিক্কণ, লাস্য-আবর্তিত নিচোলের বর্ণচ্ছটা, খলিত কণ্ঠের হাস্য-বিজড়িত সঙ্গীত;—নির্লজ্জ উন্মুক্তভাবে কন্দর্পের পূজা চলিয়াছে।
নগর-উপবনের বীথিপথে আমি একাকী ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম। মনের মধ্যে একটা নির্লিপ্ত সুখাবেশ ক্রীড়া করিতেছিল। এই সব রসোন্মত্ত নরনারী—ইহারা যেন নট-নটী; আমি দর্শক। সুরাপান করিয়াছিলাম, কিন্তু অধিক নয়। বসন্তের লঘু আতপ্ত বাতাসের স্পর্শে বারুণী-জনিত উল্লাস যেন আমার চিত্তকে আত্মসুখলিল্লার ঊর্ধ্বে ভাসাইয়া লইয়া চলিয়াছিল। চারিদিকে অধীর আনন্দ-বিহ্বলতা দেখিতেছিলাম; মনে আনন্দে স্পর্শ লাগিতেছিল, আপনা আপনি উচ্চকণ্ঠে হাসিতেছিলাম, কিন্তু তবু এই ফেনোচ্ছল নর্ম-স্রোতে ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারিতেছিলাম না। আমি সৈনিক, নাগরিক সাধারণ আমাকে কেহ চিনে না; তাই অপরিচয়ের সঙ্কোচও ছিল; উপরন্তু এই অপরূপ মধু-বাসরে বোধ করি নিজের অজ্ঞাতসারেই গাঢ়তর রসোপলব্ধির আকাঙ্খা করিতেছিলাম।
উপবনের মধ্যস্থলে কন্দর্পের মর্মর-দেউল। স্মরবীথিকারা দেউল ঘিরিয়া নৃত্য করিতেছে, বাহুতে বাহু শৃঙ্খলিত করিয়া লীলায়িত ভঙ্গিমায় উপাস্য দেবতার অর্চনা করিতেছে। তাহাদের স্বল্পবাস দেহের মদালস গতির সঙ্গে সঙ্গে বেণীবিসর্পিত কুন্তল দুলিতেছে, চপল মেখলা নাচিতেছে। চোখে চোখে মদসিক্ত হাসির গূঢ় ইঙ্গিত, বিদ্যুৎস্ফুরণের ন্যায় অতর্কিত ভূবিলাস, যেন মদনপূজার উপচাররূপে উৎসৃষ্ট হইতেছে।
আমি তাহাদের মধ্যে গিয়া দাঁড়াইলাম। পুষ্পধন্বা মদনবিগ্রহকে প্রণাম করিয়া মদনের কিঙ্করীদের প্রতি সহাস্য দৃষ্টি ফিরাইলাম। আমাকে দেখিয়া তাহাদের নৃত্য বন্ধ হইল, তাহারা পুষ্প-শৃঙ্খলের মতো আমাকে আবেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। তারপর তাহাদের মধ্যে একটি বিম্বাধরা যুবতী দ্বিধা-মন্থর পদে আমার সম্মুখে আসিল। আমার মুখের পানে চাহিয়া সে চক্ষু নত করিল, তারপর আবার চক্ষু তুলিয়া একটি চম্পক-অঙ্গুলি দিয়া আমার উন্মুক্ত বক্ষ স্পর্শ করিল। দেখিলাম, তাহার কালো নয়নে কোনও অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষার ছায়া পড়িয়াছে।
আমি কৌতুকভরে আমার কুঞ্চিত কেশবন্ধন হইতে একটি অশোক-পুষ্প লইয়া তাহার চূড়া-পাশে পরাইয়া দিলাম, তারপর হাসিতে হাসিতে নগরবধূদের বাহুরচিত নিগড় ভিন্ন করিয়া প্রস্থান করিলাম।
ক্ষণকালের জন্য সকলেই মূক হইয়া রহিল। তারপর আমার পশ্চাতে বহু কলকণ্ঠের হাস্য বিচ্ছুরিত হইয়া উঠিল। আমিও হাসিলাম, কিন্তু পিছু ফিরিয়া দেখিলাম না।
ক্রমে দিবা নিঃশেষ হইয়া আসিল। পশ্চিম গগনে আবীর-কুকুমের খেলা আরম্ভ হইল। দিগ্বধূরাও যেন মদনমহোৎসবে মাতিয়াছে।
উদ্যানের এক প্রান্তে একটি মাধবীবিতানতলে প্রস্তরবেদীর উপর গিয়া বসিলাম। স্থান নির্জন; অদূরে একটি কৃত্রিম প্রস্রবণ হইতে বৃত্তাকার আধারে জল ঝরিয়া পড়িতেছে। মণি-মেখলাধৃত জলরাশি সায়াহ্নের স্বর্ণাভ আলোকে টলমল করিতেছে, কখনও রবিরশ্মিবিদ্ধ চূর্ণ জলকণা ইন্দ্রধনুর বর্ণ বিকীর্ণ করিতেছে। যেন সুন্দরী রমণীর অধীর চঞ্চল যৌবন।
আলস্যস্তিমিত অন্যমনে আলোকের এই জলক্রীড়া দেখিতেছি, এমন সময় সহসা একটি কুঙ্কুম-গোলক আমার বক্ষে আসিয়া লাগিল; অভ্র-আবরণ ফাটিয়া সুগন্ধিচূর্ণ দেহে লিপ্ত হইল। সচকিতে মুখ তুলিয়া দেখিলাম, একটি নারী লতাবিতানের দ্বারে দাঁড়াইয়া আছে।
তাহাকে দেখিয়া ক্ষণকালের জন্য রুদ্ধবা হইয়া গেলাম, বোধ করি হৃদযন্ত্রের স্পন্দনও কয়েক মুহূর্তের জন্য থামিয়া গেল। তারপর হৃদয় উন্মত্তবেগে আবার স্পন্দিত হইতে লাগিল। চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। বিস্ফারিত নেত্র তাহার দেহের উপর নিবদ্ধ রাখিয়া তাহার সম্মুখীন হইলাম।
তাম্রকাঞ্চনবণী লোলযৌবনা তন্বী; কবরীতে মল্লীমুকুলের মালা জড়িত, মুখে চূর্ণ মনঃশিলার। প্রলেপ, কিংশুক-ফুল্ল ওষ্ঠাধর হইতে যেন রতি-মাদকতার মধু ক্ষরিয়া পড়িতেছে। কর্ণে কর্ণিকার কলি গণ্ডের উত্তাপে ম্লান হইয়া গিয়াছে। পত্রলেখা-চিত্রিত উরসে তাজালের ন্যায় সূক্ষ্ম কঞ্চুকী, তদুপরি স্বচ্ছতর উত্তরীয় যেন কাশ্মীরবর্ণ কুহেলী দ্বারা অপূর্ণ চন্দ্রকলাকে আচ্ছাদন করিয়া রাখিয়াছে। নাভিতটে আকুঞ্চিত নিচোল; চরণ দুটি লাক্ষারস-নিষিক্ত।
এই বিমোহিনী মূর্তি কুটিল অপাঙ্গে চাহিয়া নিঃশব্দে মৃদু মৃদু হাসিতেছে। তাহাকে আপাদমস্তক দেখিয়া আমার বুকের মধ্যে ভয়ের মতো একটা অনুভূতি গুরু গুরু করিতে লাগিল। সহসা আমার এ কি হইল? এই তো কিছুকাল পূর্বে মদন-পূজারিণীদের নীরব সঙ্কেত হাসিমুখে উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছি! কিন্তু এখন!
অবরুদ্ধ অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কে?
তাহার অধরোষ্ঠ ঈষৎ বিভক্ত হইল, দশনপংক্তিতে বিজলী খেলিয়া গেল। বঙ্কিম কটাক্ষে ভ্রূ-ধনু বিলসিত করিয়া সে বলিল, আমি রল্লা।
রল্লা! তাহার কণ্ঠস্বর ও নামোচ্চারণের ভঙ্গিতে আমার দেহে তীব্র বেদনার মতো একটা নিপীড়ন অনুভব করিলাম। আমি তাহার দিকে আর এক পদ অগ্রসর হইয়া গেলাম। ইচ্ছা হইল—কি ইচ্ছা হইল জানি না। হাসিতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু হাসি আসিল না।
মদনোৎসবে অপরিচিত তরুণ-তরুণীর সাক্ষাৎকার ঘটিলে তাহারা কি করে? হাসিয়া পরস্পরের দেহে কুঙ্কুম নিক্ষেপ করে, দুই-চারিটা রঙ্গ-কৌতুকের কথা বলে, তারপর নিজ পথে চলিয়া যায়। কিন্তু আমি—মূঢ় গ্রামিকের মতো তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলাম। শেষে আবার প্রশ্ন করিলাম, কে তুমি?
এবার সে ভঙ্গুর কণ্ঠে কৌতুক ভরিয়া হাসিল, হাসিতে হাসিতে বেদীর উপর আসিয়া বসিল, অধর নয়ন এবং ভূর একটি অপূর্ব চটুল ভঙ্গিমা করিয়া বলিল, দেখিয়াও বুঝিতে পারিতেছ না? আমি নারী।
কথাগুলি যেন দৈহিক আঘাতের মতো আমার বুকে আসিয়া লাগিল। নারী—হাঁ, নারীই বটে। ইহা ভিন্ন তাহার অন্য পরিচয় নাই। পুরুষের অন্তর-গুহায় যে অনির্বাণ নারী-ক্ষুধা জ্বলিতেছে, এই নারীই বুঝি তাহাতে পূণাহুতি দান করিতে পারে।
তারপর কতক্ষণ এই লতাবিতানতলে কাটিয়া গেল জানি না। রল্লার লালসাময় যৌবনশ্রী, তাহার মাদক দেহসৌরভ অগ্নিময় সুরার মতো আমার রক্তে সঞ্চারিত হইল। আমি উন্মত্ত হইয়া গেলাম। কিন্তু তবু—তাহাকে ধরিতে পারিলাম না। ধনুকের গুণ যেমন বাণকে নিজ বক্ষে টানিয়া লইয়াই দূরে নিক্ষেপ করে, রল্লা তেমনই তাহার দেহের কুহকে বারবার আমাকে কাছে টানিয়া আবার দূরে ঠেলিয়া দিল। আমি তাহাকে স্পর্শ করিতে গেলাম, সে চপল চরণে সরিয়া গেল—
বলিল, তুমি বুঝি ব্যাধ? কিন্তু সুন্দর ব্যাধ, বল—হরিণীকে কি এত শীঘ্র ধরা যায়?
তপ্তস্বরে বলিলাম, আমি ব্যাধ নই, তুমি নিষ্ঠুরা শবরী—আমাকে বধ করিয়াছ। তবু কাছে আসিতেছ না কেন?
এবারে সে কাছে আসিল। আমার স্পন্দমান বক্ষের উপর একটি উষ্ণ রক্তিম করতল রাখিয়া ছদ্ম গাম্ভীর্যে বলিল, দেখি। তারপর যেন ত্রস্তভাবে দ্রুত সরিয়া গিয়া কহিল, কই, বধ করিতে তো পারি নাই! বোধ হয় সামান্য আহত হইয়াছ মাত্র। তোমার কাছে যাইব না, শুনিয়াছি আহত ব্যাঘ্রের নিকট যাইতে নাই।
এই চটুলতার সম্মুখে আমি ব্যর্থ হইয়া রহিলাম।
তখন সে তার আমার কাছে আসিল। কজ্জল-দূষিত চক্ষে আমার সর্বাঙ্গ লেহন করিয়া একটি অর্ধ-নিশ্বাস ত্যাগ করিল। অস্ফুট স্বরে কহিল, তুমি বোধ হয় ছদ্মবেশী কন্দর্প।
আমি তাহার দুই বাহু চাপিয়া ধরিলাম; শরীরের ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ শিহরিয়া গেল। তাহাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করিয়া গাঢ় স্বরে বলিলাম, রল্লা–
এই সময় যেন আমার কথার প্রতিধ্বনি করিয়া লতাবিতানের বাহিরে কিয়দ্দূরে কর্কশ কণ্ঠে আহ্বান আসিল, রল্লা! রল্লা–!
উকণ্ঠ হইয়া রল্লা শুনিল; তারপর হাত ছাড়াইয়া লইল। আমার মুখের দিকে চাহিয়া এক অদ্ভুত হাসি তাহার কিংশুক-ফুল্ল অধরে খেলিয়া গেল। সে বলিল, আমার মদনোৎসব শেষ হইয়াছে। আমি গৃহে চলিলাম।
গৃহে চলিলে।—যে ডাকিল সে কে?
রল্লা আবার নিদাঘ-বিদ্যুতের মতো হাসিল, আমার—ভর্তা।
অকস্মাৎ মুদারাঘাতের মতো প্রচণ্ড আঘাত পাইয়া যেন বিমূঢ় হইয়া গেলাম—ভর্তা!
রল্লা লতাবিতানের দ্বারের দিকে চলিল। যাইতে যাইতে গ্রীবা ফিরাইয়া বলিল, আমার ভতাকে দেখিবে? লতার অন্তরালে লুকাইয়া দেখিতে পার। তীক্ষ্ণ বঙ্কিম হাসিয়া রল্লা সহসা অদৃশ্য হইয়া গেল।
মূঢ়বৎ কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম, তারপর লতামণ্ডপের পত্রান্তরাল সরাইয়া বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম।
রল্লা আর তণ্ডু মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছে। বৃদ্ধ তণ্ডুর সচক্ষু সন্দেহে প্রখর; রল্লার রক্তাধরে বিচিত্র হাসি।
তণ্ডু কর্কশ কণ্ঠে বলিল, উৎসব শেষ হইয়াছে, গৃহে চল।
রল্লা ক্লান্তিবিজড়িত ভঙ্গিতে দুই বাহু ঊর্ধ্বে তুলিয়া দেহের আলস্য দূর করিল, তারপর বৃদ্ধকে বলিল, চল।
তণ্ডু একবার লতাবিতানের দিকে কুটিল দৃষ্টিপাত করিল, একবার যেন একটু দ্বিধা করিল, তারপর বৃদ্ধ ভল্লুকের মতো বিপরীত মুখে চলিতে আরম্ভ করিল। রল্লা মন্থর পদে তাহার পশ্চাতে চলিল।
যাইতে যাইতে রল্লা একবার নিজের কবরীতে হাত দিল; কবরী হইতে একটি রক্ত কুরুবক খসিয়া মাটিতে পড়িল।
আমি বাহিরে আসিয়া কুরুবকটি তুলিয়া লইলাম। রল্লা তখন দূরে চলিয়া গিয়াছে, দূর হইতে ফিরিয়া চাহিল। প্রদোষের ছায়াম্লান আলোকে যেন তাহার সর্বাঙ্গ নিঃশব্দ সঙ্কেত করিয়া আমাকে ডাকিল।
আমি দূরে থাকিয়া তাহার অনুসরণ করিলাম। জনাকীর্ণ নগরীর বহু সঙ্কীর্ণ পথ অতিক্রম করিয়া অবশেষে রল্লা নগরপ্রান্তের এক দীন গৃহের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হইয়া গেল। দেখিলাম, গৃহের প্রাচীরে দুইটি অসি চিত্রিত রহিয়াছে।
তারপর নানা ছুতা করিয়া অসিধাবক তণ্ডুর গৃহে আসিয়াছি। অধীর দুর্নিবার অন্তরে স্থির হইয়া বসিয়া সুযোগের প্রতীক্ষ্ণ করিয়াছি। তণ্ডুর যন্ত্রাগারের পশ্চাতে তাহার বাসগৃহ; সেখানে রল্লা আছে, দূর হইতে কচিৎ তাহার নূপুরশিঞ্জন শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়াছি; চোখে মুখে উগ্র কামনা হয়তো প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। তণ্ডু কুটিল বক্র কটাক্ষে আমাকে নিরীক্ষণ করিয়াছে। কিন্তু রল্লাকে দেখিতে পাই নাই—একটা তুচ্ছ সঙ্কেত পর্যন্ত না।