Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

প্রাণিতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা মাটি খুড়িয়া অধুনালুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক জীবের যে সকল অস্থি-কঙ্কাল বাহির করেন, তাহাতে রক্তমাংস সংযোগ করিয়া তাহার জীবিতকালের বাস্তব মূর্তিটি তৈয়ারি করিতে গিয়া অনেক সময় তাঁহাদিগকে নিছক কল্পনার আশ্রয় লইতে হয়। ফলে যে মূর্তি সৃষ্টি হয়, সত্যের সহিত তাহার সাদৃশ্য আছে কি না এবং থাকিলেও তাহা কতদূর, সে সম্বন্ধে মতভেদ ও বিবাদ-বিসংবাদ কিছুতেই শেষ হয় না।

আমাদের দেশের ইতিহাসও কতকটা ঐ ভূ-প্রোথিত অতিকায় জন্তুর মতো। যদি বা বহু ক্লেশে সমগ্র কঙ্কালটুকু পাওয়া যায়, তাহাতে প্ৰাণপ্ৰতিষ্ঠা হওয়া দূরের কথা, তাহার সজীব চেহারাখানা যে কেমন ছিল তাহা আংশিকভাবে প্রতিপন্ন হইবার পূর্বেই বড় বড় পণ্ডিতেরা অত্যন্ত তেরিয়া হইয়া এমন মারামারি কাটাকাটি শুরু করিয়া দেন যে, রথি-মহারার্থী ভিন্ন অন্য লোকের সে কুরুক্ষেত্রের দিকে চক্ষু ফিরাইবার আর সাহস থাকে না। এবং যুদ্ধের অবসানে শেষ পর্যন্ত সেই কষ্কালের বিভিন্ন হাড় কয়খানাই। রণাঙ্গনে ইতস্তত পড়িয়া থাকিতে দেখা যায়।

তাই, যখনই আমাদের জন্মভূমির এই কঙ্কালসার ইতিহাসখানা আমার চোখে পড়ে তখনই মনে হয়, ইহা হইতে আসল বস্তুটির ধারণা করিয়া লওয়া সাধারণ লোকের পক্ষে কত না দুরূহ ব্যাপার। যে মৃৎপ্রদীপের কাহিনী লিখিতে বসিয়াছি, তাহারই কথা ধরি না কেন। প্রাচীন পাটলিপুত্রের যে সামান্য ধ্বংসাবশেষ খনন করিয়া বাহির করা হইয়াছে, তাহারই চারিপাশে স্বপ্নাবিষ্টের মতো ঘুরিতে ঘুরিতে জঞ্জাল-স্তুপের মধ্যে এই মৃৎপ্রদীপটি কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম। নিতান্ত একেলে সাধারণ মাটির প্রদীপের মতোই তাহার চেহারা, ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া প্ৰায় কাগজের মতো পাতলা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এতকাল পরেও তাহার মুখের কাছটিতে একটুখানি পোড়া দাগ লাগিয়া আছে। এই নোনাধরা জীর্ণ বিশেষত্ববর্জিত প্ৰদীপটি দেখিয়া কে ভাবিতে পারে যে, উহার মুখের ঐ কালির দাগটুকু একদিন ইতিহাসের একটি পৃষ্ঠাকে একেবারে কালো করিয়া দিয়াছিল এবং উহারই উদ্ধেবখিত ক্ষুদ্র শিখার বহ্নিতে একটা রাজ্য পুড়িয়া ছারখার হইয়া গিয়াছিল।

অনুসন্ধিৎসু ঐতিহাসিকেরা বোধ করি। অবহেলা করিয়া এই তুচ্ছ প্ৰদীপটা ফেলিয়া দিয়াছিলেন, মিউজিয়ামে স্থান দেন নাই। আমি সযত্নে কুড়াইয়া আনিয়া সন্ধ্যার পর আমার নির্জন ঘরে মধুমিশ্ৰিত গব্য ঘৃত দিয়া উহা জ্বলিলাম। কতদিন পরে এ প্ৰদীপ আবার জ্বলিল? পুরাবৃত্তের কোন মসীলিপ্ত অধ্যায়কে আলোকিত করিল? বিজ্ঞ পুরাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা তাহা কোথা হইতে জানিবেন? উহার অঙ্গে তো তাম্রশাসন-শিলালিপি লটকানো নাই! সে কেবল আমার. —এই জাতিস্মরের মস্তিষ্কের মধ্যে দুরপনেয় কলঙ্কের কালিমা দিয়া মুদ্রিত হইয়া আছে।

প্ৰদীপ জ্বলিলে যখন ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া বসিলাম, তখন নিমেষমধ্যে এক অদ্ভুত ইন্দ্ৰজাল ঘটিয়া গেল। স্তম্ভিত কাল যেন অতীতের সঙ্গী এই প্ৰদীপটাকে আবার জ্বলিয়া উঠিতে দেখিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে পিছু ফিরিয়া তাকাইয়া রহিল। এই পাটলিপুত্র নগর মন্ত্রবলে পরিবর্তিত হইয়া কবেকার এক অখ্যাত মগধেশ্বরের মহাস্থানীয় রাজধানীতে পরিণত হইল। আর আমার মাথার মধ্যে যে স্মৃতিপুত্তলিগুলি এতক্ষণ স্বপ্নের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, তাহারা সজীব হইয়া আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র ঘটনা—কত নগণ্য অনাবশ্যক কথা—এই বর্তিকার আলোকে দীপ্তিমান জীবন্ত স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমার সম্মুখ হইতে বর্তমান মুছিয়া একাকার হইয়া গেল, কেবল অতীতের বহুদূর জন্মান্তরের স্মৃতি ভাস্বর হইয়া জ্বলিতে লাগিল। সেই প্ৰদীপ সম্মুখে ধরিয়া তাহারই আলোতে আজ এই কাহিনী লিখিতেছি।

আজ হইতে ষোল শতাব্দী আগেকার কথা।

ক্ষুদ্র ভূস্বামী ঘটোৎকচগুপ্তের পুত্ৰ চন্দ্ৰগুপ্ত লিচ্ছবি রাজবংশে বিবাহ করিয়া শ্যালককুলের বাহুবলে পাটলিপুত্র দখল করিয়া রাজা হইলেন। রাজা হইলেন বটে, কিন্তু নামে মাত্ৰ। পট্টমহাদেবী লিচ্ছবিদুহিতা কুমারদেবীর দুর্ধর্ষ প্ৰতাপে চন্দ্ৰগুপ্ত মাথা তুলিতে পারিলেন না। রাজমুদ্রায় রাজার মূর্তির সহিত মহাদেবীর মূর্তি ও লিচ্ছবিকুলের নাম উৎকীর্ণ হইতে লাগিল। রাজার নামে রানী স্বেচ্ছামত রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। রাজা একবার নিজ আজ্ঞা প্রচার করিতে গিয়া দেখিলেন, তাঁহার আজ্ঞা কেহ মানে না। চন্দ্ৰগুপ্ত বীরপুরুষ ছিলেন, তাঁহার আত্মাভিমানে আঘাত লাগিল; কিন্তু কিছুই করিতে পারিলেন না। নিম্বফল ক্রোধে শক্তিশালী শ্যালককুলের প্রতি বক্ৰদূষ্টিপাত করিয়া তিনি মৃগয়া, সুরা ও দ্যুতক্ৰীড়ায় মনোনিবেশ করিলেন।

প্রজাদের তাহাতে বিশেষ আপত্তি ছিল না। রাজা বা রানী যিনিই রাজত্ব করুন, তাহাদের কিছু আসে যায় না। মহামারী, দুৰ্ভিক্ষ অথবা যুদ্ধের হাঙ্গামা না থাকিলেই তাহারা সস্তুষ্ট। কাম্ববংশ লুপ্ত হইবার পর বহুবর্যব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্ৰহ অন্তর্বিবাদে দেশ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। প্রকাণ্ড মগধ সাম্রাজ্য বিষ্ণুচক্রে চিন্ন সতীদেহের ন্যায় খণ্ড খণ্ড হইয়া বহু ক্ষুদ্র রাজ্যের সমষ্টিতে দাঁড়াইয়াছিল। ক্ষুদ্র রাজারা ক্ষুদ্র কারণে পরম্পর কলহ করিয়া প্রজার দুৰ্গতি বাড়াইয়া তুলিয়াছিলেন। এই সময় চন্দ্ৰগুপ্ত পাটলিপুত্র ও তাহার পারিপার্শ্বিক ভূখণ্ড অধিকার করিয়া কিছু শান্তি আনয়ন করিয়াছিলেন। শান্তিতে জীবনযাত্ৰা নির্বাহ করিতে পাইয়া প্রজারা তৃপ্ত ছিল, রাজা বা রানী—কে প্রকৃতপক্ষে রাজ্যশাসন করিতেছেন, তাহা দেখিবার তাঁহাদের প্রয়োজন ছিল না।

যাহা হউক, তরুণী পট্টমহিষী একমাত্র শিশুপুত্র সমুদ্রগুপ্তকে ক্ৰোড়ে লইয়া রাজ-অবরোধ হইতে প্ৰজা শাসন করিতেছেন, দেশে নিরুপদ্রব শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করিতেছে, এমন সময় একদিন শরৎকালের নির্মল প্ৰভাতে মহারাজ চন্দ্ৰগুপ্ত নগরোপকণ্ঠের বনমধ্যে মৃগয়া করিতে গেলেন। মহারাজ মৃগয়ায় যাইবেন, সুতরাং পূর্ব হইতে বনমধ্যে বস্ত্ৰাবাস ছাউনি পড়িল। কারুকার্যখচিত রক্তবর্ণের পট্টাবাসা সকল অকালপ্রফুল্ল কিংশুকগুচ্ছের ন্যায় বনস্থলী আলোকিত করিল। কিঙ্করী, নর্তকী, তাম্বলিক, সংবাহক, সূপকার, নহাপিত প্রভৃতি বহুবিধ দাসদাসী কর্ম-কোলাহলে ও আনন্দ কলরবে কাননলক্ষ্মীর বিশ্রাব্ধ শান্তি ভঙ্গ করিয়া দিল। তারপর যথাসময়ে পারিষদ-পরিবেষ্টিত হইয়া সুরারুণনেত্ৰ মগধেশ্বর মৃগয়াস্থলে উপস্থিত হইলেন।

প্রভাতে দূতক্রীড়া ও তিক্তিরি-যুদ্ধ দর্শন করিয়া চন্দ্ৰগুপ্ত আনন্দে কালাহরণ করিলেন। দ্বিপ্রহরে পানভোজনের পর অন্য সকলকে শিবিরে রাখিয়া মাত্র চারিজন বয়স্য সঙ্গে মহারাজ অশ্বারোহণে অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বয়স্যরা সকলেই মহারাজের সমবয়স্ক যুবা, সকলেই সমান লম্পট ও উচ্ছঙ্খল। চাটুমিশ্রিত ব্যঙ্গ-পরিহাস করিতে করিতে তাহারা মহারাজের সঙ্গে চলিল।

মৃগা-অন্বেষণে বিচরণ করিতে করিতে প্ৰায় দিবা তৃতীয় প্রহরে এক ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর কুলে সহসা তাঁহাদের গতিরোধ হইল। সর্বাগ্রে মহারাজ দেখিলেন, তটিনীর উচ্চ তাঁটের উপর ছিন্নমৃণাল কুমুদিনীর মতো এক নারীমূর্তি পড়িয়া আছে। দেহে বস্ত্ৰ কিংবা আভরণ কিছুই নাই—সম্পূৰ্ণ নগ্ন। কণ্ঠে, প্রকোষ্ঠে, কৰ্ণে অল্প রক্ত চিহ্ন। দেখিলে বুঝা যায়, দসু্যুতে ইহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া পলাইয়াছে।

রাজা ত্বরিতপদে অশ্ব হইতে নামিয়া রমণীমূর্তির নিকটে গেলেন। নির্নিমেন্য নোত্রে তাহার নগ্ন দেহ-লাবণ্যের দিকে চাহিয়া রহিলেন। নারীর বয়স ষোড়শ কি সপ্তদশের অধিক হইবে না। নবেদ্ভিন্ন যৌবনের পরিপূর্ণ বিকশিত রূপ; রাজা দুই চক্ষু ভরিয়া পান করিতে লাগিলেন। তাহার পর নতজানু হইয়া সন্তৰ্পণে বক্ষে হস্তার্পণ করিয়া দেখিলেন—প্ৰাণ আছে, দ্রুত হৃৎস্পন্দন অনুভূত হইতেছে।

বয়স্য চারিজন ইতিমধ্যে রাজার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল ও লুব্ধদৃষ্টিতে সংজ্ঞাহীনার অনাবৃত সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করিতেছিল। সহসা রাজা তাহাদের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “এ নারী কাহার?”

রাজার আরক্ত মুখমণ্ডল ও চক্ষুর ভাব দেখিয়া বয়স্যগণ পরিহাস করিতে সাহসী হইল না। একজন কৃষ্ঠাজড়িত কণ্ঠে বলিল, “রাজ্যের সকল নর-নারীই মহারাজের।”

মহারাজ বোধ করি অন্য কিছু ভাবিয়া এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন, কিন্তু এইরূপ উত্তর পাইয়া তিনি প্ৰদীপ্ত দৃষ্টিতে দ্বিতীয় বয়স্যের দিকে ফিরিলেন। পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, “এ নারী কাহার?”

মন বুঝিয়া বয়স্য বলিল, “মহারাজের।”

তৃতীয় বয়স্যের দিকে ফিরিয়া চন্দ্ৰগুপ্ত জিজ্ঞাসু নেত্ৰে চাহিলেন।

কিন্তু তৃতীয় বয়স্য—সে অন্তরের দুর্দম লালসা গোপন করিতে পারিল না—ঈষৎ হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “দসু-উপদ্রুতা নারী শ্ৰীমৎ মগধেশ্বরের ভোগ্য নয়। এই নারীদেহটা মহারাজ অধমকে দান করুন।”

বারুণী-কষায়িত নেত্রী কিছুক্ষণ তাহার মুখের উপর স্থাপন করিয়া মহারাজ উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “বিট, স্বর্গের পারিজাত লইয়া তুই কি করিবি? এ নারী আমার!”-এই বলিয়া উষ্ণীষ খুলিয়া সূক্ষ্ম বস্ত্ৰজালে রমণীর সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া দিলেন।

লুব্ধ বয়স্য তখনও আশা ছাড়ে নাই—ব্রুপসীর প্রতি সতৃষ্ণ একটা কটাক্ষ হানিয়া বলিল, “কিন্তু মহারাজ, এ অনুচিত। পট্টমহাদেবী শুনিলে…”

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় রাজা ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। কর্কশ কণ্ঠে কহিলেন, “পট্টমহাদেবী? রে পীঠমর্দ, পট্টমহাদেবী আমার ভব্রী নয়, আমি তার ভতৰ্চ—বুঝিলি? এ রাজ্য আমার, এ নারী আমার-পট্টমহাদেবীর নয়।”

এই আকস্মিক উগ্ৰ ক্ৰোধে বয়স্যগণ ভয়ে নিশ্চল বাকশূন্য হইয়া গেল। চন্দ্ৰগুপ্ত নিজেকে কিঞ্চিৎ সংযত করিয়া কহিলেন, “এই নারীকে আমি মহিষীরূপে গ্ৰহণ করিলম। বয়স্যগণ, মহাদেবীকে প্ৰণাম কর।”

যন্ত্রচালিতবৎ বয়স্যগণ প্ৰণাম করিল।

তখন সেই সংজ্ঞাহীন দেহ সন্তপণে বক্ষে তুলিয়া মহারাজ অশ্বারোহণে শিবিরে ফিরিয়া চলিলেন। মূৰ্ছিতার অবেণীবদ্ধ মুক্ত কুন্তল কৃষ্ণ ধূমকেতুর মতো পশ্চাতে উড়িতে উড়িতে চলিল।

শিবিরে ফিরিয়া সংজ্ঞালাভ করিবার পর রমণী যে পরিচয় দিল তাহা এইরূপ—

তাহার নাম সোমদত্তা। সে শ্রাবস্তীর এক শ্রেষ্ঠীর কন্যা, পিতার সহিত চম্পাদেশে যাইতেছিল, পথে আটবিক দস্য কর্তৃক অপহৃত হয়। তাহার পিতাকে দাসুয়ূরা মারিয়া ফেলে। অতঃপর দস্যপতি তাহার রূপযৌবন দেখিয়া তাহাকে আত্মসাৎ করিতে মনস্থ করে। অন্য দসু্যাগণ তাহাতে ঘোরতর আপত্তি করিল। ফলে তাহারা পরস্পরের সহিত বিবাদ-বিসংবাদ আরম্ভ করিল। এবং একে অন্যের পশ্চাদ্ধাবন করিতে গিয়া, যাহাকে লইয়া কলহ। তাহাকেই অরক্ষিত ফেলিয়া গেল। যাইবার সময় একজন চতুর দাসু, পাছে সোমদত্তা কোথাও পলায়ন করে, এই ভয়ে তাহার বস্ত্ৰ কড়িয়া লইয়া তাহাকে অজ্ঞান করিয়া রাখিয়া যায়।

যথাকালে চন্দ্ৰগুপ্ত সোমদত্তাকে দোলায় তুলিয়া নগরে লইয়া গেলেন। শাস্ত্ৰমত বিবাহ হইল কি না জানা গেল না, যদি বা হইয়া থাকে তাহা গান্ধৰ্ব কিংবা পৈশাচ-জাতীয়। যাহা হউক, দাসীসহচরীপরিবৃত সোমদত্তা রাজপুরীর পুরস্ত্রী হইয়া বাস করিতে লাগিল। তাহার অবস্থানের জন্য মহারাজ একটি স্বতন্ত্র মহল নির্দেশ করিয়া দিলেন।

কুমারদেবী রাজার এই দুষ্মন্ত-উপাখ্যান শুনিলেন, কিন্তু ঘৃণাভরে কোনও কথা বলিলেন না। বিশেষত, সেকালের রাজাদের পক্ষে ইহা এমন কিছু গৰ্হিত কার্য ছিল না। একাধিক পত্নী ও উপপত্নী সকল রাজ-অন্তঃপুরেই স্থান পাইত। এমন কি, প্রকাশ্য বেশ্যাকে বিবাহ করাও রাজন্যসমাজে অপ্রচলিত ছিল না। কুমারদেবী অবিচলিত নিষ্ঠার সহিত পুত্রকে সম্মুখে রাখিয়া রাজকাৰ্য পরিচালনা করিতে লাগিলেন। মহারাজ চন্দ্ৰগুপ্ত মধুভাণ্ডের নিকট ষট্‌পদের মতো সোমদত্তার পদপ্রান্তে পড়িয়া রহিলেন।

এইরূপে ছয় মাস কাটিল।

তারপর একদিন চুত-মধুক-সুগন্ধি বসন্তকালের প্রারম্ভে জলস্থল অন্ধকার করিয়া পঙ্গপালের মতো এক বিরাট বাহিনী দেশ ছাইয়া ফেলিল। ইতিহাসে এই ঘটনার উল্লেখমাত্ৰ আছে। পুষ্করণা নামক মরুরাজ্যের অধিপতি চন্দ্রবর্মা দিগ্বিজয় যাত্রার পথে মগধ আক্রমণ করিলেন। হীনবীৰ্য মগধ বিনা যুদ্ধে অধিকৃত হইল। কিন্তু চন্দ্ৰবর্মা যাহা সংকল্প করিয়াছিলেন তাহা এত সহজে সিদ্ধ হইল না,—তিনি পাটলিপুত্রে জয়স্কন্ধাবার স্থাপন করিতে পারিলেন না। তাঁহার বিশাল সেনা-সমুদ্রের মধ্যস্থলে পাটলিপুত্র দুর্গ দশ লৌহদ্বারে ইন্দ্ৰকীলক আটিয়া দিয়া ক্ষুদ্র পাষাণদ্বীপের মতো জাগিয়া রহিল।

মগধেশ্বর তখন সোমদত্তার গজদন্ত পালঙ্কে শুইয়া ঘুমাইতেছিলেন; প্রহরিণীর মুখে এই বাতা শুনিয়া শয্যায় উঠিয়া বসিলেন। তাঁহার বহুকাললুপ্ত ক্ষত্ৰিতেজ নিমেষের জন্য জাগ্রত হইয়া উঠিল, কক্ষের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “আমার বর্ম?”—বলিয়াই তাঁহার কুমারদেবীর কথা স্মরণ হইল, মুখের দীপ্তি নিবিয়া গেল। ক্ষীণ শ্লেষের হাসি হাসিয়া বলিলেন, “আক্রমণ করিয়াছে তা আমি কি করিব। পট্টমহাদেবীর কাছে যাও।”—বলিয়া পুনশ্চ শয্যায় শয়ন করিলেন।

সোমদত্তা প্রাসাদ চুড়া হইতে দ্রুত চঞ্চলপদে নামিয়া আসিয়া দেখিল, রাজা পূর্ববৎ নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছেন। তাহার শিখরতুল্য দশনে বিদ্যুতের ন্যায় হাসি হাসিয়া গেল। রাজার মস্তকে মৃদু করম্পর্শ করিয়া অস্ফুটম্বরে কহিল, “ঘুমাও বীরশ্রেষ্ঠ! ঘুমাও!”

এদিকে প্রহরিণী পট্টমহাদেবীকে গিয়া সংবাদ দিল। কুমারদেবী তখন ষষ্ঠবর্ষীয় কুমার সমুদ্রগুপ্তকে শিক্ষা দিতেছিলেন : “পুত্র, তুমি লিচ্ছবিকুলের দৌহিত্র, এ কথা কখনও ভুলিও না। পাটলিপুত্র তোমার পাদপীঠ মাত্র। ভরতের মতো, মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের মতো, চণ্ডাশোকের মতো এই সমুদ্রবেষ্টিত বসুন্ধরা তোমার সাম্রাজ্য,–এ কথা স্মরণ রাখিও। তুমি বাহুবলে গুর্জর হইতে সমতট, হিমাদ্রি হইতে অনার্য পাণ্ড্য-দেশ পর্যন্ত পদানত করিবে। তোমার যজ্ঞীয় অশ্ব উত্তরাপথে ও দক্ষিণাপথে, আযাবর্তে ও দক্ষিণাত্যে সমান অপ্ৰতিহত হইবে।”

বালক রত্নখচিত ক্রীড়াকান্দুক হস্তে লইয়া গম্ভীরমুখে মাতার কথা শুনিতেছিল।

এমন সময় প্রতিহারিণীর মুখে ভয়ংকর সংবাদ শুনিয়া মহাদেবীর মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল; ক্ষণকাল নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিলেন। একবার ইচ্ছা হইল জিজ্ঞাসা করেন, আর্যপুত্র কোথায়। কিন্তু সে ইচ্ছা নিরোধ করিয়া বলিলেন, “শীঘ্ৰ কঞ্চকীকে মহামাত্যের কাছে পাঠাও—এখনি তাঁহাকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করুক। দুর্গের দ্বার সকল রুদ্ধ হউক। বিনা যুদ্ধে মহাস্থানীয় শত্রুর হস্তে সমর্পণ করিব না।”

মহাদেবীর আদেশের প্রয়োজন ছিল না, মহাসচিব ও সান্ধিবিগ্রহিক পূর্বেই দুৰ্গদ্বার রোধ করিয়াছিলেন। প্রাকারে প্রাকারে ভল্লহস্তে সতর্ক প্রহরী ঘুরিতেছিল, সিংহদ্বারগুলির উপরে বৃহৎ কটাহে তৈল উত্তপ্ত হইতেছিল। লৌহজালিকে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করিয়া স্নায়ুজ্যাযুক্ত ধনুহস্তে ধানুকিগণ ইন্দ্ৰকোষে লুক্কায়িত থাকিয়া পরিখা-পারস্থিত শত্রুর উপর বিষ-বিদূষিত শর নিক্ষেপ করিতেছিল। প্রাকারের হস্তিনখমধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া সেনানীগণ শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছিল। বুভূক্ষিত কুম্ভীরদল পরিখার কমলবনের মধ্যে খাদ্যান্বেষণে ইতস্তত সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছিল। বাহিরে শত্রুসৈন্য মাঝে মাঝে একযোগে দুৰ্গদ্বার আক্রমণ করিতেছিল। তখন মকরমুখ হইতে প্ৰচণ্ডবেগে তপ্ত-তৈল বর্ষিত হইতেছিল। আক্রমণকারীরা হতাহত সহচরদিগকে দুৰ্গদ্বারে ফেলিয়া ভগোদ্যমে ফিরিয়া যাইতেছিল।

পূর্ণ একদিন এইভাবে যুদ্ধ হইল। চন্দ্রবমর্ণ রণহস্তীর দ্বারা দুৰ্গদ্বারা ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সে চেষ্টাও বিফল হইল। সর্বাঙ্গ বাণিবিদ্ধ হস্তী মাহুতকে ফেলিয়া দিয়া আর্তনাদ করিতে করিতে পলায়ন করিল। চন্দ্রবর্মা দেখিলেন, যুদ্ধ করিয়া দুৰ্গজয় সহজ নহে।

তখন তাঁহার সৈন্য যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়া দুর্গ বেষ্টন করিয়া বসিল। ক্রোশের পর ক্রোশ, যোজনের পর যোজন ব্যাপ্ত করিয়া তাহদের শিবির পড়িল। নদীতে কাতারে কাতারে তরণী আসিয়া দুৰ্গ-প্রাকারের বাহিরে গণ্ডি রচনা করিল। পাটলিপুত্রে পিপীলিকারও আগম-নিগমের পথ রহিল। rt

ভিতরে মহামাত্য কুমারদেবীকে গিয়া সংবাদ দিলেন, “আশু ভয়ের কারণ নাই। কিন্তু বর্বর চন্দ্রবর্মা আমাদের অন্যহারে শুকাইয়া মারিবার চেষ্টা করিতেছে। দেখা যাক, কতদূর কি হয়।”

দিগ্বিজয়ী রণপণ্ডিত চন্দ্ৰবর্মার উদ্দেশ্য কিন্তু দুই প্রকার ছিল। ক্ষুদ্র দুর্বল পাটলিপুত্র অচিরাৎ দখল করিতে তিনি বড় ব্যগ্র ছিলেন না। হইলে ভালো, না হইলেও বিশেষ ক্ষতি নাই; আপাতত মগধের অন্যত্র জয়স্কন্ধাবার স্থাপন করিলেই চলিবে। কিন্তু তাঁহার স্থল-সৈন্য বহুদূর পথ যুদ্ধ করিতে করিতে আসিয়া পরিশ্রান্ত—তাহাদের কিছুদিন বিশ্রামের প্রয়োজন। তাই তিনি অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজার দেশে নিরুপদ্রবে। ক্লান্তিবিনোদনের জন্য বসিলেন। গঙ্গার স্রোতে তাঁহার নৌবহর নোঙ্গর ফেলিল। দুগবিরোধ ও শ্রান্তি অপনোদন একসঙ্গে চলিল।

দুর্গ অবরোধের পঞ্চম দিবসে মহামাত্য আসিয়া রানীকে জানাইলেন যে, দুর্গের খাদ্যভার কমিতে আরম্ভ করিয়াছে—শীঘ্ৰ ইহার কিছু বিধি-ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

মন্ত্রীর সহিত কুমারদেবী বহুক্ষণ পরামর্শ করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “গোপনে খাদ্য আনিবার কোনও পথ কি নাই?”

সচিব বলিলেন, “হয়তো আছে, কিন্তু আমরা জানি না। নদীপথে খাদ্য আনা যাইতে পারিত,

কিন্তু সে পথও বন্ধ। দুবৃত্ত চন্দ্রবর্মা নৌকা দিয়া বৃহ সাজাইয়া রাখিয়াছে।”

“তবে এখন উপায়?”

“একমাত্র উপায় আছে।”

তারপর আরও অনেকক্ষণ পরামর্শ চলিল।

শেষে মহামাত্য বিদায় লইলে পর কুমারদেবী অলক্ষিতে প্রাসােদশীর্ষে উঠিলেন। অঞ্চলের ভিতর হইতে রক্তচক্ষু ধূম্ৰবৰ্ণ দৃত-পারাবিত বাহির করিয়া আকাশে উড়াইয়া দিলেন। পারাবত দুইবার প্রাসাদ পরিক্রমণ করিয়া উত্তরাভিমুখে ধাবিত হইল।। যতক্ষণ দেখা যায়, কুমারদেবী আকাশের সেই কৃষ্ণবিন্দুর দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তারপর নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া আসিলেন।

অতঃপর আরও আট দিন কাটিল। চন্দ্ৰবৰ্মা কোনও প্রকার যুদ্ধোদ্যম না করিয়া কেবলমাত্র পথরোধ করিয়া বসিয়া রহিলেন। ক্রমে দুর্গে খাদ্যদ্রব্য দুমূল্য হইতে আরম্ভ করিল। নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল।

এইরূপে আশায় আশঙ্কায় আরও একপক্ষ অতীত হইল। ফাল্গুন নিঃশেষ হইয়া আসিল।

একটা কথা বলিতে ভুলিয়াছি। সেই বিট—সেই পীঠমর্দ, যে সোমদত্তার অনাবৃত যৌবনশ্ৰী দেখিয়া উন্মত্ত হইয়াছিল, সে আমি। তখন আমার নাম ছিল, চক্রায়ুধ ঈশানবমর্ণ। ঘটোৎকচগুপ্তের ন্যায় আমার পিতাও একজন পরাক্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর আমি স্বাধীন হইয়া রাজধানীতে রাজার সাহচর্যে নাগরিক-বৃত্তি অবলম্বন করিয়া ঐশ্বর্ষে বিলাসে কালব্যাপন করিতেছিলাম।

তীব্র আসবপান করিলে যে বিচারহীন বিবেকহীন মত্ততা জন্মে, সোমদত্তাকে দেখিয়া আমার সেই মত্ততা জন্মিয়াছিল। অবশ্য, বিবেকবুদ্ধি তৎপূর্বেই যে আমার অত্যন্ত অধিক ছিল তাহা নহে। চিরদিন আমার চিত্ত বল্পীশূন্য অশ্বের মতো শাসনে অনভ্যস্ত। কোনও বস্তু আত্মসাৎ করিতে—তা সে নারীই হউক বা ধনরত্নই হউক—নিজের ঐহিক সুবিধা ও সামর্থ্য ভিন্ন কোনও নিষেধ কখনও স্বীকার করি নাই। গুরুলঘুজ্ঞান কদাপি আমার বাসনার সামগ্ৰীকে দুপ্ৰাপ্য করিয়া তুলে নাই। যখন যাহা অভিলাষ করিয়াছি, ছলে-বলে যেমন করিয়া পারি তাহা গ্রহণ করিয়াছি।

চন্দ্ৰগুপ্ত যখন সোমদত্তাকে শ্যেনপক্ষীর মতো আমার চক্ষুর সম্মুখ হইতে ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল, তখন বাধাপ্ৰাপ্ত প্রতিহত বাসনা দুবার আক্ৰোশে আমার বক্ষের মধ্যে গর্জন করিতে লাগিল। চন্দ্ৰগুপ্ত রাজা, আমি তাহার নামসহচর—বয়স্য; কিন্তু তথাপি কোনও দিন তাহাকে আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বা যোগ্যতার ভাবিতে পারি নাই। শ্যালকপ্ৰসাদে সে রাজা হইয়াছে; সুযোগ ঘটিলে আমিও কি হইতে পারিতাম না? বাহুবলে, রণশিক্ষায়, নীতিকৌশলে, বংশগরিমায় আমি তাহার অপেক্ষা কোনও অংশে ন্যূন নাহি। তবে কোন অধিকারে সে আমার ঈন্সিত বস্তু কাড়িয়া লাইল?

অন্য তিন জন রাজপ্ৰসাদলোভী চাটুকার, যাহারা সেদিন আমার নিগ্ৰহ দেখিয়াছিল, তাহারা আমার ক্রোধ ও অন্তর্দাহে ইন্ধন নিক্ষেপ করিতে লাগিল, তামাশা-বিদ্রুপ-ইঙ্গিতের গোপন দংশনে আমাকে জর্জরিত করিয়া তুলিল। একদিন, চন্দ্ৰগুপ্ত তখনও সভায় আগমন করেন নাই, সভাস্থ পারিষদবর্গের মধ্যে নিম্নকণ্ঠে বাক্যালাপি হাস্য-পরিহাস চলিতেছিল, এমন সময় সিদ্ধাপাল আমাকে লক্ষ্য করিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চকণ্ঠে বলিল, “চক্রায়ুধ, দেখ তো এই রত্নটি কেমন, কৌশলের কোনও শ্রেষ্ঠী মহারাজকে উপহার দিয়াছে। মহারাজ বলিয়াছেন, রত্নটি যদি অনাবিদ্ধ হয় তাহা হইলে স্বয়ং রাখিবেন, নচেৎ তোমাকে উহা দান করিবেন। দেখ তো, রত্নটি বজ্ৰসমূৎকীর্ণ কি না।”—বলিয়া একটি ক্ষুদ্র অতি নিকৃষ্টজাতীয় মণি আমার সম্মুখে তুলিয়া ধরিল।

সভার দৃঢ় ব্যক্তিগণ এই কদৰ্য ইঙ্গিতে কেহ দাঁত বাহির করিয়া, কেহ বা নিঃশব্দে হাসিল। সিংহাসনের পার্শ্বে চামরবাহিনী কিঙ্করীগণ মুখে অঞ্চল দিয়া পরস্পরের প্রতি সকৌতুকে কটাক্ষ হানিল। আমি লজায় মরিয়া গেলাম।

ক্ৰমে আমার কথা পাটলিপুত্ৰ নগরের কাহারও অবিদিত রহিল না। আমি কোনও গোষ্ঠীসমবায় বা সমাপানকে পদাপণ করিবামাত্ৰ চোখে চোখে কটাক্ষে কটাক্ষে গুপ্ত ইঙ্গিতের স্রোত বহিয়া যাইত। রাজসভায় রাজা আমাকে দেখিয়া ভুকুটি করিতে লাগিলেন। অতঃপর আমাকে রাজসভা ছাড়িতে হইল, লোক-সমাজও দুঃসহ হইয়া উঠিল। নিজ হর্ম্যতলে একাকী বসিয়া অন্তরের অগ্নিতে অহরহ দগ্ধ হইতে লাগিলাম।

এই সময় সমুদ্রোচ্ছাসতুল্য অভিযান পাটলিপুত্রের দুর্গাঁতটো আসিয়া প্ৰহত হইল। আমি ক্ষত্ৰিয়, যুদ্ধের সময় আমার ডাক পড়িল। মহাবলাধিকৃত বিরোধব্যমা আমাকে শতরক্ষীর অধিনায়ক করিয়া গৌতম-দ্বার নামক দুর্গের পশ্চিম তোরণ রক্ষার ভার দিলেন।

কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্ৰহীন রাত্রি। আমি অভ্যাসমত প্রাকারের উপর একাকী পদচারণ করিতেছিলাম। অবসন্ন বসন্তের শেষ চম্পা চারিদিকে তীব্র বাস বিকীর্ণ করিতেছিল।

বাহিরে শত্রুশিবিরে দীপসকল প্রায় নিবিয়া গিয়াছে—দূরে দূরে দুই একটা জ্বলিতেছে। নিম্নে পরিখার জল স্থির কৃষ্ণদৰ্পণের মতো পড়িয়া আছে, তাহাতে আকাশস্থ নক্ষত্রপুঞ্জের প্রতিবিম্ব পডিয়াছে। নগরের মধ্যে শব্দ নাই, আলোক নাই, গৃহে গৃহে দ্বার রুদ্ধ, দীপ নিবপিত। রাজপথেও আলোকইন, তামসী রাত্রির গহন অন্ধকার যেন বিরাট পক্ষ দিয়া চরাচর আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে।

পাটলিপুত্ৰ সুপ্ত, অরাতি-সৈন্যও সুপ্ত। কিন্তু নগরদ্বারের প্রহরীরা জাগ্রত। তোরণের উপর নিঃশব্দে রাষ্ট্ৰীগণ প্রহরা দিতেছে। প্রাকারের উপর স্থানে স্থানে সতর্ক রক্ষী নিশ্চলভাবে লণ্ডায়মান। শত্ৰু পাছে অন্ধকারে গা ঢাকিয়া অতর্কিতে প্ৰাকার-লঙঘনের চেষ্টা করে, এইজন্য রাত্ৰিতে পাহারা দ্বিগুণ সাবধান থাকে।

রাজপুরী হইতে বেহাগ-রাগিণীতে মধ্যরাত্রি বিজ্ঞাপিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে পাটলিপুত্রের দশ দ্বারের প্রহরী দুন্দুভি বাজাইয়া উচ্চ-কণ্ঠে প্রহর হকিল। নৈশ নীরবতা ক্ষণকালের জন্য বিক্ষুব্ধ করিয়া এই উচ্চ রোল ক্ৰমে ক্ৰমে মিলাইয়া গেল; নগরী যেন শক্রকে জানাইয়া দিল—“সাবধান! আমি জাগিয়া আছি!”

একাকী পদচারণ করিতে করিতে নানা চিন্তা মনে উদয় হইতেছিল। কিসের জন্য এই রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিদ্ৰা ত্যাগ করিয়া নিশাচরের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছি? পাটলিপুত্র দুর্গ রক্ষা করিয়া আমার লাভ কি? যাহার রাজ্য, সে তো কামিনীর কণ্ঠালগ্ন হইয়া সুখে নিদ্রা যাইতেছে। পাটলিপুত্র যদি চন্দ্রবর্মা অধিকার করে, তবে কাহার কি ক্ষতি? দুর্গের মধ্যে অন্নাভাবের সঙ্গে সঙ্গে রোগ দেখা দিয়াছে, মানুষ না খাইয়া মরিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাহির হইতে খাদ্য আনয়নের উপায় নাই। শুধু রাত্রির অন্ধকারে লুকাইয়া জালিকেরা নদী হইতে প্রত্যহ কিছু কিছু মৎস্য সংগ্ৰহ করিতেছে। কিন্তু তাঁহাই বা কতটুকু?—নগরীর ক্ষুধা তাহাতে মিটে না। এভাবে আর কত দিন চলিবে? অবশেষে একদিন বশ্যতা স্বীকার করিতেই হইবে; তবে অনৰ্থক এ ক্লেশ ভোগ কেন? সমগ্ৰ দেশ যখন চন্দ্ৰবর্মার চরণে আত্ম-সমৰ্পণ করিয়াছে, তখন পাটলিপুত্র নগর একা কয়দিন টিকিয়া থাকিবে?

চন্দ্ৰগুপ্ত যদি রাজ্যাধিকারের যোগ্য হইত, তবে সে নিজে আসিয়া নিজের রাজ্য রক্ষা করিত। আমি কেন এই অপদার্থ রাজার রাজ্যেরক্ষায় সাহায্য করিতেছি? সে আমার কি করিয়াছে? আমার মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়াছে, আমাকে জগতের সম্মুখে হাস্যাম্পদ করিয়াছে। সোমদত্তা! সেই দেবভোগ্য অন্সরা! বুঝি পুরুষের লালসা-পরিতৃপ্তির জন্যই তাহার অনুপম দেহ সৃষ্ট হইয়াছিল। তাহাকে না পাইলে আমার এই অনির্বাণ তৃষ্ণা মিটিবে কি?—সে এখন চন্দ্রগুপ্তের অঙ্কশায়িনী। চন্দ্ৰগুপ্ত কি তাহাকে বিবাহ করিয়াছে? কারুক না করুক, সোমদত্তাকে আমার চাই; যেমন করিয়া পারি, যে উপায়ে পারি, সোমদত্তাকে আমি কাড়িয়া লইব। পারিব না? নারীর মন কত দিন এক পুরুযে আসক্ত থাকিবে? তখন চন্দ্ৰগুপ্ত! তোমাকে জগতের কাছে হাস্যাস্পদ করিব। সেই আমার লাঞ্ছনার যোগ্য প্রতিশোধ হইবে।

এই সর্বগ্রাসী চিন্তা মনকে এমনই আচ্ছন্ন করিয়াছিল যে, অজ্ঞাতসারে গোতম-দ্বার হইতে অনেকটা দূরে আসিয়া পড়িয়াছিলাম। প্রাকারের এই অংশ রাত্রিকালে স্বভাবতই অতিশয় নির্জন। এই স্থানের দুর্গ-প্রাচীর এতই দুরধিগম্য যে, প্রহরী-স্থাপনেরও প্রয়োজন হয় নাই।

ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিতে করিতে ফিরিব ভাবিতেছি, এমন সময় সহসা চোখে পড়িল, সম্মুখে কিছুদূরে প্রাকারের প্রান্তস্থিত এক কণ্টকগুলোর অন্তরালে দীপ জ্বলিতেছে। পাছে বাহির হইতে শত্রু দুর্গ-প্রাচীরে আরোহণ করে, এজন্য প্রাচীরগাত্রে সর্বত্র কাঁটাগাছ রোপিত থাকিত। কখনও কখনও এই সকল কাঁটাগাছ প্রাকারশীর্ষ ছাড়াইয়া মাথা তুলিত। সেইরূপ দুইটি ঘন-পল্লবিত কণ্টকতরুর মধ্যস্থিত ঝোপের ভিতর প্রদীপ জ্বলিতেছে দেখিলাম। প্ৰদীপ। কখনও উঠিতেছে, কখনও মণ্ডলাকারে আবর্তিত হইতেছে। কেহ যেন একান্তে দাঁড়াইয়া কোনও অদৃশ্য দেবতার আরতি করিতেছে।

পাদুকা খুলিয়া ফেলিয়া নিঃশব্দে কটি হইতে তরবারি বাহির করিয়া হস্তে লইলাম। তারপর অতি সন্তপণে সেই সঞ্চরমাণ দীপশিখার দিকে অগ্রসর হইলাম।

কণ্টকগুলোব মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তন্মধ্যে এক নারী দাঁড়াইয়া পরিখার অপর পারে অনন্য স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া আছে; এবং প্রদীপ ইতস্তত আন্দোলিত করিতেছে; পশ্চাৎ হইতে তাহার মুখ সম্পূৰ্ণ দেখিতে পাইলাম না, শুধু চোখে পড়িল, তাহার নবমল্লিকাবেষ্টিত কুণ্ডলিত কবরীভার, তন্মধ্যে দুইটি পদ্মরাগমণি সৰ্পচক্ষুর মতো জ্বলিতেছে। বুঝিতে বিলম্ব হইল না, এ রমণী গুপ্তচর; আলোকের ইঙ্গিতে শত্রুর নিকট সংবাদ প্রেরণ করিতেছে।

লঘুহন্তে তাহার স্কন্ধ স্পর্শ করিলম। সশব্দ নিশ্বাস টানিয়া বিদ্যুদ্বেগে রমণী ফিরিয়া দাঁড়াইল। তখন তাহারই হস্তধৃত মৃৎপ্রদীপের আলোকে তাহাকে চিনিলাম।

সোমদত্তা!

কম্পিত দীপশিখার আলোক তাহার ত্রাসবিবৃত মুখের উপর পড়িল। চক্ষুর সুবৃহৎ কৃষ্ণতারকা আরও বৃহৎ দেখাইল। মুহুর্তের জন্য আমার মনে সন্দেহ জন্মিল, এ কি সত্যই সোমদত্তা, না আমার দৃষ্টিবিভ্ৰম? যে চিন্তা অহরহ আমার অন্তরকে গ্রাস করিয়া আছে, সেই চিন্তার বস্তু কি মূর্তি ধরিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল? কিন্তু এ ভ্ৰম অল্পকালের জন্য, আকস্মিক আঘাতে বিপন্ন বুদ্ধি পরক্ষণেই ফিরিয়া আসিল। দেখিলাম, সোমদত্তার হস্তে প্ৰদীপ থারথার করিয়া কাঁপিতেছে, এখনই পড়িয়া নিবিয়া যাইবে। আমি তরবারি কোষাবদ্ধ করিয়া তাহার হাত হইতে প্ৰদীপ লইলাম,–“তাহার মুখের সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া মৃদুহাস্যে বলিলাম, “এ কি! পরমভট্টারিকা মহাদেবী সোমদত্তা!”

সোমদত্তা ভয়সূচক অস্ফুটধ্বনি করিয়া নিজ বক্ষে হস্তার্পণ করিল। পরীক্ষণেই ছুরির একটা ঝলক এবং সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষাগ্ৰ অস্ত্র আমার বস্ত্ৰাবৃত লৌহজালিকের ব্যবধানপথে বক্ষের চর্ম স্পর্শ করিল। ভিতরে লৌহজালিক না থাকিলে সোমদত্তার হন্তে সেদিন আমার প্রাণ যাইত। আমি ক্ষিপ্ৰহস্তে ছুরিকা কাড়িয়া লইয়া নিজ কাটিতে রাখিলাম, তারপর সবলে দুই বাহু দিয়া তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিলাম। তাহার কর্ণে কহিলাম, “সোমদত্তা, কুহকিনী, আজ তোমাকে পাইয়াছি।”

তৈলপ্রদীপ মাটিতে পড়িয়া নিবিয়া গেল।

জলবদ্ধ ব্যাস্ত্রীর মতো সোমদত্তা আমার বাহুমধ্যে যুদ্ধ করিতে লাগিল, নখ দিয়া আমার মুখ ছিঁড়িয়া দিল। আমি আরও জোরে তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিলাম, “ভালো, ভালো। তোমার নখর-ক্ষতি কাল চন্দ্ৰগুপ্তকে দেখাইব।”

সহসা সোমদত্তার দেহ শিথিল হইয়া এলাইয়া পড়িল; অন্ধকারে ভাবিলাম, বুঝি মূছাঁ গিয়াছে। তারপর তাহার দ্রুত কম্পনে ও কষ্ঠোখিত নিরুদ্ধ শব্দে বুঝিলাম, মুছা নহে—সোমদত্তা কাঁদিতেছে। কাঁদুক—কামিনীর ক্ৰন্দন আমার জীবনে এই প্রথম নহে। প্রথম প্রথম এমনই কাঁদে বটে। আমি তাহাকে কাঁদিতে দিলাম।

কিছুক্ষণ ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিবার পর সোমদত্তা সোজা হইয়া দাঁড়াইল; অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে কহিল, “তুমি কে? কেন আমাকে ধরিয়াছ? শীঘ্ৰ ছাড়িয়া দাও!”

আমি আলিঙ্গন শিথিল করিলম না, বলিলাম, “আমি কে শুনিবে? আমি চক্রায়ুধ ঈশানবম-—তোমার চন্দ্রগুপ্তের বয়স্য, উপস্থিত দুৰ্গ-তোরণের রক্ষক। আরও অধিক পরিচয় চাও তো বলি, আমি সোমদত্তার রূপের মধুকর। যেদিন তটিনীতিটে অচেতন হইয়া পড়িয়াছিলে, ছলনাময়ী, সেইদিন হইতে তোমার রূপযৌবনের আরাধনা করিতেছি!”

অনুভব করিলম, সোমদত্ত শিহরিয়া উঠিল। আমি বলিলাম, “চিনিয়াছ দেখিতেছি! হাঁ, আমি সেই বিট, যে স্বর্গের পারিজাত দেখিয়া লুব্ধ হইয়াছিল।”

সোমদত্ত কহিল, “পাপিষ্ঠ, আমাকে ছাড়িয়া দাও, নচেৎ রাজ-আদেশে তোমার মুণ্ড যাইবে।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “পাপিষ্ঠ, তোমাকে ছাড়িব না। ছাড়িয়া দিলে পট্টমহাদেবীর আদেশে আমার মুণ্ড যাইতে পারে। তুমি নিশীথ সময়ে রাজপুরী ছাড়িয়া কি জন্য বাহিরে আসিয়াছ? প্রকারের নিভৃত স্থানে প্ৰদীপ লইয়া কি করিতেছিলে?”

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া সোমদত্তা উত্তর করিল, “আমি রাজার অনুমতি লইয়া পুরীর বাহিরে আসিয়াছি।”

“এমন কখনো হইতে পারে না।”

“বুঝিলাম। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তুমি যদি চন্দ্ৰগুপ্তকে সত্যই ভালবাস, তবে তাহার সর্বনাশ করিতেছ কেন?”

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সোমদত্তা বলিল, “চন্দ্ৰবর্মা আমার পিতা।”

ঘোর বিস্ময়ে কহিলাম, “তুমি চন্দ্রবর্মার কন্যা?”

অধোমুখে সোমদত্ত কহিল, “হাঁ, কিন্তু বারাঙ্গনার গর্ভজাত।”

“বুঝিয়াছি।”

“তুমি নরাধম, কিছু বুঝি নাই। আমি শৈশব হইতে রাজ-অন্তঃপুরে পালিতা।”

“ভালো, তাহাও বুঝিলাম। বুঝিলাম যে, পিতার জন্য তুমি স্বামীর সর্বনাশ করিতে প্ৰস্তুত। কিন্তু আমার কথাও তুমি বুঝিয়া লও। আমি গৌড় চাহি না, চম্পা চাহি না, কাশী-কোশল কিছুই চাহি না—আমি তোমাকে চাই। অস্বীকার করিলে কোনও ফল হইবে না-উপরন্তু চন্দ্ৰগুপ্ত তোমার এই অভিসার-কথা জানিতে পরিবে।”

সোমদত্তা কম্পিত স্বরে কহিল, “ইচ্ছা হয়, আমাকে হত্যা করিয়া ঐ পরিখার জলে ফেলিয়া দাও, আমি কোনও কথা কহিব না। কিন্তু মহারাজকে এ কথা বলিও না। পুরুষের মন সর্বদা সন্দিগ্ধ, তিনি আমার প্রকৃত অভিপ্রায় বুঝিবেন না, আমাকে অবিশ্বাস করিবেন। স্বীকার কর, বলিবে না?”

নারী-চরিত্র কে বুঝিবে? কহিলাম, “উত্তম, বলিব না। কিন্তু আমার পুরস্কার?”

সোমদত্তা নীরব।

আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার পুরস্কার?”

তথাপি সোমদত্তা মৌন।

আমি তখন ক্ষিপ্ত। নির্মম পীড়নে তাহার দেহলতা বিমথিত করিয়া অধরে চুম্বন করিলাম।

বলিলাম, “সোমদত্তা, তোমার রূপের আগুনে আজ আপনাকে আহুতি দিলাম।”

সোমদত্তা যেন মৰ্মতন্তু ছিঁড়িয়া কথা কহিল, “শুধু তুমি নহ, তুমি, আমি, চন্দ্ৰগুপ্ত, মগধ—সব এই আগুনে পুড়িয়া ছাই হইবে!”

Pages: 1 2 3
Pages ( 1 of 3 ): 1 23পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress