পুণা গ্রাম হইতে
পুণা গ্রাম হইতে প্রায় সাত-আট ক্রোশ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে উপত্যকা হইতে বহু ঊর্ধ্বে গিরিসংকটের ভিতর দিয়া দুইজন সওয়ার নিম্নাভিমুখে অবতরণ করিতেছিল। চারিদিকেই উচ্চনীচ ছোটবড় পাহাড়ের শ্রেণী—যেন কতকগুলা অতিকায় কুম্ভীর পরস্পর ঘেঁষাঘেঁষি হইয়া তাল পাকাইয়া এই হেমন্ত অপরাহ্ণের সোনালী রৌদ্রে শুইয়া আছে। তাহারি মধ্যে পিপীলিকার মতো দুইটি প্রাণী সূর্যের দিকে পশ্চাৎ করিয়া ক্রমশ দীঘায়মান ছায়া সম্মুখে ফেলিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া আসিতেছিল।
এখান হইতে উপত্যকা দৃষ্টিগোচর নয়, পথেরও কোনও চিহ্ন কোথাও নাই। চতুর্দিকে কেবল উলঙ্গ কৰ্কশ পাহাড়, মাঝে মাঝে দুই একটা খবাখতি কণ্টকগুল্ম। এই সকল চিহ্ন ছাড়া পথিককে বহুদূরস্থ জনপদে পরিচালিত করিবার কোনও নিদর্শন নাই—অনভিজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে এরূপ স্থানে দিকভ্ৰান্ত হইবার সম্ভাবনা অত্যন্ত অধিক।
অশ্বারোহী দুইজন যে পথ দিয়া নামিতেছিল। তাহাকে পথ বলা চলে না, বিষার জল চুড়া হইতে নামিবার সময় পর্বতগাত্রে যে উপলপিচ্ছিল প্ৰণালী রচনা করে, এ সেইরূপ একটি প্রণালী, পাহাড়ের শীর্ষ হইতে প্রায় ঋজুরেখায় পদমূল পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে।
সওয়ার দুইজন ঘোড়ার বল্গা ছাড়িয়া দিয়া পরস্পর বাক্যালাপ করিতে করিতে চলিয়াছিল, খৰ্ব্বদেহ রোমশ পাহাড়ী ঘোড়া স্বেচ্ছামত সেই ঢালু বিপজ্জনক পথে সাবধানে অবতরণ করিতেছিল। এই স্থানে পথ এত বেশি ঢালু যে একবার অশ্বের পদস্থলন হইলে আরোহীর মৃত্যু অনিবার্য; কিন্তু সেদিকে আরোহীদের দৃষ্টি নাই।
আরোহীদের মধ্যে একজন প্রাচীন বয়স্ক; মাথার চুল ও গোঁফ পাকা, বর্ণ এত বয়সেও তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়। কপালের একপ্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শ্বেতচন্দনের দুইটি রেখা বোধ করি জরাজনিত ললাটরেখাকে ঢাকিয়া দিয়াছে। মস্তকে শুভ্ৰ কাপসিাবস্ত্রের উষ্ণীষ; দেহে তুলটু আংরাখার ফাঁকে বাম স্কন্ধের উপর উপবীতের একাংশ দেখা যাইতেছে। চোখে-মুখে একটি দৃঢ় আচঞ্চল বুদ্ধির প্রভা। দেখিলেই বুঝা যায় ইনি একজন শাস্ত্ৰাধ্যায়ী অভিজাতবংশীয় ব্ৰাহ্মণ। ইহার হস্তে কোনও অস্ত্ৰ নাই, কিন্তু যেরূপ স্বচ্ছন্দ নিশ্চিন্ততার সহিত অবতরণশীল অশ্বপৃষ্ঠে অটল হইয়া বসিয়া আছেন, তাহাতে মনে হয় কেব ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলন করিয়াই ইনি জীবন অতিবাহিত করেন নাই।
দ্বিতীয় আরোহীটি ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। বয়স বোধ করি ষোল বৎসরও অতিক্রম করে নাই; দেহের বর্ণ শ্যাম, কিন্তু মুখের গঠন অতিশয় ধারালো। মৃদঙ্গসদৃশ মুখের মধ্যস্থলে শ্যেনচষ্ণুর মতো নাসিকা এই অল্প বয়সেই তাহার মুখে শিকারীর মতো একটা শাণিত তীব্ৰতা আনিয়া দিয়াছে। চক্ষু দুটি বড় বড়, চক্ষুতারকা নিবিড় কৃষ্ণবৰ্ণ; বালকসুলভ চঞ্চলতা সত্ত্বেও দৃষ্টি অতিশয় তীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী। ওষ্ঠের উপর ও চিবুকের নিম্নে ঈষান্মাত্র রোমরেখা দেখা দিয়াছে, তাহাও বর্ণের মলিনতার জন্য স্পষ্ট প্রতীয়মান নয়। ভ্রূ-যুগল সূক্ষ্ম ও দূরপ্রসারিত। সহসা এই বালকের মুখ দেখিলে একটা অপূর্ব বিভ্ৰম জন্মে, মনে হয় যেন একখানা তীক্ষ্ণধার বাঁকা কৃপাণ সূৰ্য্যলোকে ঝকঝক করিতেছে।
মুখ হইতে দৃষ্টি নামাইয়া দেহের প্রতি চাহিলে কিন্তু আরো চমক লাগে। মুখের মতো দেহের সৌষ্ঠব নাই, প্রস্থের তুলনায় দৈর্ঘ্যে দেহ অত্যন্ত খর্ব। প্রথমেই মনে হয়, অতিশয় বলশালী। কটি হইতে পায়ে শুড়তোলা নাগরা জুতা পর্যন্ত প্ৰাণসার অথচ ক্ষীণ, মৃগাচরণের মতো যেন অতি দ্রুত দৌড়িবার জন্যই সৃষ্ট হইয়াছে; কিন্তু কটি হইতে ঊর্ধ্বে দেহ ক্রমশ প্রশস্ত হইয়া বক্ষঃস্থল এরূপ বিশাল আয়তন ধারণ করিয়াছে যে বিস্মিত হইতে হয়। আরো অদ্ভুত তাহার দুই বাহু; আজানুলম্বিত বলিলেও যথেষ্ট হয় না, সন্দেহ হয় ঘোড়ার পিঠে বসিয়া হাত বাড়াইলে মাটি হইতে উপলখণ্ড তুলিয়া লইতে পারে। তাহার উপর যেমন সুপুষ্ট তেমনি পেশীবহুল; দুই বাহু দিয়া কাহাকেও সবলে জড়াইয়া ধরিলে তাহার পঞ্জর ভাঙিয়া যাওয়া অসম্ভব নয়।
এই বালক হাসিতে হাসিতে চতুর্দিকে চঞ্চল চক্ষে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে নামিতেছিল। ঘোড়ার রেকব নাই, লাল রেশমের জরিমোড়া লাগামও ছাড়িয়া দিয়াছে, অথচ কম্বলের জিনের উপর এমনভাবে বসিয়া আছে যেন সে আর ঘোড়া পৃথক নয়— কোন ক্রমেই তাঁহাদের বিচ্ছিন্ন করা যাইবে না। বাম হস্তে আগাগোড়া লোহার ভারী বল্লমটা এমনি অবহেলাভীরে ধরিয়া আছে যেন পাগড়ির উপর খেলাচ্ছলে রোপিত শুকপুচ্ছটার চেয়েও সেটা হালকা।
ঘোড়া দুইটি পাহাড়ের পদমূলে আসিয়া দাঁড়াইল। সম্মুখে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে আর একটা পাহাড় আরম্ভ হইয়াছে, এবার সেইটাতে চড়িতে হইবে। সূর্য পিছনের উচ্চ পাহাড়ের চুড়া স্পর্শ করিল, শীঘ্রই তাহার আড়ালে ঢাকা পড়িবে।
বালক চতুর্দিকে চাহিয়া যেন প্রাণশক্তির আতিশয্যবশতঃই উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, তারপর বলিল, দাদো, প্ৰতিধ্বনি শুনবে? হোয়া হো হো হো হো! চুপা! এইবার শোনো।
কয়েক মুহুর্ত পরেই তিন দিক হইতে ভৌতিক শব্দ ফিরিয়া আসিল— হোয়া! হো হো হো!
বালক অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া উত্তর দিকের একটা উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দেখাইয়া বলিল, ঐটে সবচেয়ে দূরে! আওয়াজ ফিরে আসতে কত দেরি হল দেখলে? চোখে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না কোনটা কাছে, কোনটা দূরে। অন্ধকার রাত্রে পথ হারিয়ে গেলে প্রতিধ্বনি ভারী কাজে লাগে— না দাদো?
বৃদ্ধ মৃদুহাস্যে উত্তর করিলেন, তা লাগে; কিন্তু অন্ধকার রাত্রে এ-রকম জায়গায় পথ হারিয়ে যাবার তোমার কোনও সম্ভাবনা আছে কি?
বালক বলিল, তা নেই। তুমি আমার চোখ বেঁধে দাও, দেখ আমি ঠিক পুণায় ফিরে যেতে পারব।
বৃদ্ধ বলিলেন, সে আমি জানি। লেখাপড়ার দিকে তোমার একেবারে মন নেই, কেবল দিবারাত্রি পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পেলেই ভালো থাকো। তোমার বাবা যখন আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইবেন, তখন যে আমি কি কৈফিয়ৎ দেব তা জানি না।
বালকের মুখে একটা দুষ্টামির হাসি খেলিয়া গেল, সে বৃদ্ধের দিকে আড়চোখে কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, আচ্ছা দাদো, আলিফ ভালো, না অ ভালো? বাঁ দিক থেকে ডান দিকে লেখা সুবিধে, না ডান দিক থেকে বা দিকে?
বৃদ্ধ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, সে তুমি বুঝতে পারবে না। ষোল বছর বয়স হল, এখনো নিজের নাম সই করতে শিখলে না। তোমার লেখাপড়ার চেষ্টা করাই বৃথা!— কিন্তু শিকারের দিকেও তো তোমার মন নেই দেখতে পাই। আজ সারাদিন ঘুরে একটা খরগোসও মারতে পারলে না।
বালক আক্ষেপে হস্ত উৎক্ষিপ্ত করিয়া বলিল, খরগোস আমি মারতে পারি না, আমার ভারী মায়া হয়। ঐটুকু জানোয়ার, তার ওপর হিংসার লেশ তার শরীরে নেই— খালি প্ৰাণপণে পালাতে জানে।
বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে কোন জানোয়ার মারতে চাও শুনি—বাঘ!
উৎসাহ-প্ৰদীপ্ত চক্ষে কিশোর বলিল, হ্যাঁ, বাঘ। এ পাহাড়ে বাঘ পাওয়া যায় না, দাদো?
বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না, শুনেছি। আরো দক্ষিণে পাহাড়ের গুহায় বাঘ আছে; কিন্তু তুমি বাঘ মারবে কি করে?
ভয় করবে না?
ভয়! বালকের উচ্চহাস্য আবার চারিদিকে প্রতিধ্বনি তুলিল। আচ্ছা দাদো, ভয় জিনিসটা কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারো? সকলের মুখেই ওই কথাটা শুনতে পাই, কিন্তু ওটা যে কি পদার্থ তা বুঝতে পারি না। ভয় কি ক্ষুধার মতো একটা প্রবৃত্তি?
দাদো বলিলেন, ভয় কি তা বুঝতে পারবে, যেদিন প্রথম যুদ্ধে নামবে, যেদিন হাতিয়ারবন্দ শত্রুকে সামনে দেখতে পাবে।
বালক কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু পরীক্ষণেই নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল।
দাদো বলিলেন, আমি বড় বড় বীরের মুখে শুনেছি যে তাঁরাও প্রথমে শত্রুর সম্মুখীন হয়ে ভয় পেয়েছেন। এতে লজ্জার বিষয় কিছু নেই; সেই ভয়কে জয় করাই প্রকৃত বীরত্ব।
সূর্য গিরিশৃঙ্গের অন্তরালে অদৃশ্য হইল, সঙ্গে সঙ্গে নিম্নভূমির উপর ছায়ার একটা সূক্ষ্ম, যবনিকা পড়িয়া গেল। শুধু ঊর্ধ্বে নগ্ন গিরিকূট এবং আরো ঊর্ধ্বে নীল আকাশে একখণ্ড মেঘ সিন্দূরবর্ণ ধারণা করিয়া জ্বলিতে লাগিল।
দাদো নিজের অশ্ব সম্মুখে চালিত করিয়া কহিলেন, আর দেরি নয়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এখনো দুটো পাহাড় পার হতে বাকি ] পুণা পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।
বালক তাঁহার অনুগামী হইয়া বলিল, তা হলেই বা? আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে ঠিক নিয়ে যাব।
দাদো বলিলেন, রাত্রে এসব পাহাড়-পর্বত নিরাপদ নয়। শোনোনি, এদিকের গাঁয়ে—বস্তিতে আজকাল প্ৰায় লুঠ-তরাজ হচ্ছে?
বালক ভারী বিস্ময় প্ৰকাশ করিয়া বলিল, তাই নাকি? কৈ, আমি তো শুনিনি; কারা লুঠ-তরাজ করছে?
দাদো বলিলেন, তা কেউ জানে না। বোধ হয় এই দিকের বুনো পাহাড়ী মাওলীরা ডাকাতি করছে। বিজাপুর এলাকার তিনটে বড় বড় গ্রাম গত চার মাসের মধ্যে লুঠ হয়ে গেছে। শুনতে পাই তাদের সদর একজন ছোকরা, লোহার সাজোয়া আর মুখোস পরে ঘোড়ায় চড়ে লুঠেরাগুলোকে ডাকাতি করতে নিয়ে যায়। ছোঁড়াটা নাকি ভয়ংকর কালো, বেঁটে আর জোয়ান।
বালক তাহার হাতের বল্লমটা খেলাচ্ছলে ঘুরাইতে ঘুরাইতে তাচ্ছিল্যাভরে জিজ্ঞাসা করিল, তই নাকি? তুমি এত কথা কোথা থেকে জানলে, দাদো?
দাদো পাহাড়ে ঘোড়া চড়াইতে চড়াইতে বলিলেন, ও অঞ্চলের দেশমুখরা দরবারে নালিশ করতে এসেছিল। তাদের বিশ্বাস ডাকাতের সদর পুণার লোক।
দাদোর পশ্চাতে বালকও পাহাড়ে উঠিতে উঠিতে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা দরবার থেকে কি ব্যবস্থা করলে?
বালক পশ্চাতে থাকিয়া মিটমিটি হাসিতেছিল, দাদো তাহা দেখিতে পাইলেন না। কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না।
পাহাড়ের পিঠের উপর উঠিয়া দুইজনে ক্ষণকাল পাশাপাশি দাঁড়াইলেন। এখানে আবার সূর্যকিরণ আসিয়া বালকের বল্লমের ফলায় যেন আগুন ধরাইয়া দিল।
সম্মুখের পাহাড়তলিতে তখন ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে, নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বালক বলিল, আচ্ছা দাদো, এখন যদি আমাদের ডাকাতে আক্রমণ করে, তুমি কি করো?
দাদো ক্ষিপ্ৰদৃষ্টিতে একবার চতুর্দিকে চাহিয়া বলিলেন, কি আর করি। তাদের সঙ্গে লড়াই করি।
তারা যদি পঞ্চাশজন হয়?
তা হলেও লড়ি।
বালক বলিল, কিন্তু সে যে ভারী বোকামি হবে, দাদো। পঞ্চাশজনের সঙ্গে লড়াই করে তুমি পারবে কেন?
দাদো বলিলেন, তাতে কি! না হয় লড়াই করতে করতে মরব।
বালক বিস্মিত হইয়া বলিল, কিন্তু এরকম মরে লাভ কি, দাদো? তারপর মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি কিন্তু লড়ি না, তীরের মতো এই ধার বেয়ে পালাই। এত জোরে পালাই যে ডাকাতের বর্শা আমাকে ছুঁতেও পারবে না।
ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে দাদো বলিলেন, ক্ষত্ৰিয়ের ছেলে তুমি, দুশমনের সামনে থেকে পালাবে? এই না বলছিলো, ভয় কাকে বলে জানো না?
বালক বলিল, ভয়! পালানোর সঙ্গে ভয়ের সম্পর্ক কি? পালাব, কারণ পালালেই আমার সুবিধে হবে, পরে ডাকাতদের জব্দ করতে পারব। আর লড়ে যদি মরেই যাই, তাহলে তো ডাকাতদের জিত হল।
দাদো মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না না, এসব শিক্ষা তুমি কোথা থেকে পাচ্ছি? না লড়ে পালিয়ে যাওয়া ভয়ংকর কাপুরুষতা। যে বীর, সে কখনো পালায় না। রাজপুত বীরদের গল্প শোনোনি?
বালক বলিল, রাজপুতদের গল্প শুনলে আমার গা জ্বালা করে। তারা শুধু লড়াই করতে পারে, বুদ্ধি এতটুকু নেই। যিনি যতবড় বীর, তিনি ততবড় বোকা।
দাদো খোঁচা দিয়া বলিলেন, তুমিও তো রাজপুত! মায়ের দিকে থেকে তোমার গায়েও তো যদুবংশের রক্ত আছে।
বালক সবেগে শিরঃসঞ্চালন করিয়া বলিল, না, আমি রাজপুত হতে চাই না, আমি মারাঠী। বালকের ললাট মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে হাসিয়া উঠিয়া বলিল, আচ্ছা দাদো, তোমার কাছে তো বড় বড় যুদ্ধের গল্প শুনেছি, কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারি না। সম্মুখ-যুদ্ধ করার মানে কি?
দাদো সহসা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলেন না। শেষে বলিলেন, সম্মুখ-যুদ্ধ মানে সামনা-সামনি শক্তি পরীক্ষা। যার শক্তি বেশি সেই জিতবে।
আর যার শক্তি কম, সে যদি চালাকি করে জিতে যায়?
সে তো আর ধর্মযুদ্ধ হল না।
নাই বা হল! যুদ্ধে হার-জিতই তো আসল— ধর্মযুদ্ধ হল কি না তা দেখে লাভ কি?
দাদো অনেকক্ষণ বালকের জিজ্ঞাসু মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, শেষে দুঃখিতভাবে ঘাড় নাড়িয়া বিড়বিড় করিয়া বলিলেন, বাপের স্বভাব ষোল আনা পেয়েছে, তেমনি ধূর্ত আর ইশিয়ার— সর্বদাই লাভ-লোকসানের দিকে নজর। আর শুধু বাপ কেন, বংশটাই ধূর্ত! মালোজী ভোঁসলে যদি চালাকি করে যদুবংশের মেয়ে ঘরে না আনতে পারত, তাহলে ভোঁসলে বংশকে চিনত কে? আর শাহুই বা এতবড় জায়গীরদার হাত কোথা থেকে?
পলকের মধ্যে বালকের সংশয়প্রশ্নপূর্ণ মুখভাবের পরিবর্তন হইল। বালকোচিত কৌতুহলে দাদোর নিকটে সরিয়া গিয়া সানুনয়কণ্ঠে বলিল, দাদো, তুমি যে আমার মার বিয়ের গল্প বলবে বলেছিলে, কৈ বললে না? বলো না দাদো, কি করে ঠাকুদা যদুবংশী মেয়ে ঘরে আনলেন।
এই সময় নিমের ছায়াচ্ছন্ন প্রদোষান্ধকার হইতে গাভীর হাম্বারবি ভাসিয়া আসিল। বালক সচকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, ঐ শোনো, দেওরামের গরু ঘরে ফিরে এলো। চলো, চলো দাদো, আর দেরি নয়; সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে ভারী ক্ষিদে পেয়ে গেছে— এতক্ষণ তা লক্ষ্যই করিনি। দেওরামের মেয়ে নুন্নার সঙ্গে সেই যে সকালবেলা তেঁতুলিবনের ধারে দেখা হয়েছিল, সে বলেছিল ফেরবার সময় তাজা দুধ খাওয়াবে। জয় ভবানী!