সন্ধ্যার আকাশ
সেদিন সন্ধ্যার আকাশে দ্রুত সঞ্চরমাণ মেঘের দল শিপ্রার বিষর্ষিকীত বক্ষে ধূমল ছায়া ফেলিয়া চলিয়াছিল। বৃষ্টি পড়িতেছে না বটে, কিন্তু পশ্চিম হইতে খর আদ্ৰ বায়ু বহিতেছে–শীঘ্রই বৃষ্টি নামিবে। ছিন্ন ধাবমান মেঘের আড়ালে পঞ্চমীর চন্দ্ৰকলা মাঝে মাঝে দেখা যাইতেছে–যেন মহাকালের করুচ্যুত বিষাণ খসিয়া পড়িতেছে, এখনই দিগন্তরালে অদৃশ্য হইবে।
শিপ্রার পূর্বতটে উজ্জয়িনীর পাষাণ-নির্মিত বিস্তৃত ঘাট। ঘাটের অসংখ্য সোপান বহু ঊর্ধ্ব হইতে ধাপে ধাপে নামিয়া শিপ্রার গর্ভে প্রবেশ করিয়াছে, ক্ষিপ্ৰ জল-ধারা এই পাষাণ প্ৰতিবন্ধকে আছাড়িয়া পড়িয়া আবর্ত সৃষ্টি করিয়া বহিয়া যাইতেছে। কিন্তু শূন্য ঘাটে আজ শিপ্রার আক্ষেপোক্তি শুনিবার কেহ নাই।
ঘাট নির্জন। অন্যদিন এই সময় বহু স্নানার্থিনীর ভিড় লাগিয়া থাকে; তাহদের কলহাস্য ও কঙ্কণ কিঙ্কিণী মুখরভাবে শিপ্রাকে উপহাস করিতে থাকে; তাহাদের ঘটোচ্ছিলিত জল মসৃণ সোপানকে পিচ্ছিল করিয়া তোলে। আজ কিন্তু ভিড় নাই। মাঝে মাঝে দুই একটি তরুণী বধু আকাশের দিকে সশঙ্ক দৃষ্টি হানিয়া ঘট ভরিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিতেছে। ক্কচিৎ এক ঝাঁক কিশোরী বয়স্যা মঞ্জীর বাজাইয়া গাগরী ভরিতে আসিতেছে; তাহারাও অল্পকাল জলক্রীড়া করিয়া পূৰ্ণঘট-কক্ষে চঞ্চল-চরণে সোপান আরোহণ করিয়া প্ৰস্থান করিতেছে। নির্জন ঘাটে সন্ধ্যার ছায়া আরও ঘনীভূত হইতেছে।
ঘাট নির্জন বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ জনশূন্য নহে। একটি পুরুষ নিম্নতর সোপানের এক প্রান্তে চিন্তামগ্নভাবে নীরবে বসিয়া আছেন। পুরুষের বয়স বোধ হয় পয়ত্ৰিশ কিংবা ছত্রিশ বৎসর হইবে।–যৌবনের মধ্যাহ্ন। দেহের বর্ণ তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়, মস্তক মুণ্ডিত, স্কন্ধে উপবীত, ললাটে শ্বেত চন্দনের ত্রিপুণ্ডক। মেঘাচ্ছন্ন প্রাবৃটি-সন্ধ্যার স্বল্পালোকেও তাঁহার খড়েগর ন্যায় তীক্ষ্ণ নাসা ও আয়ত উজ্জ্বল চক্ষু স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। তিনি কখনও আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন, কখনও উদ্বেল-যৌবনা নদীর তরঙ্গ-ভঙ্গ নিরীক্ষণ করিতেছেন, কখনও ক্রীড়া-চপলা, তরুণীদের রহস্যালাপ শ্রবণ করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছেন।
কিন্তু তাঁহার মুখ চিন্তাক্রান্ত। গত দুইদিন হইতে একটি দুরূহ সমস্যা কিছুতেই তিনি ভঞ্জন করিতে পারিতেছেন না। অলঙ্কারশাস্ত্ৰ ঘাঁটিয়া শেষ করিয়া ফেলিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার প্রশ্নের উত্তর কোথাও পাওয়া যায় নাই। এদিকে মহারাজ অবন্তীপতি ও সভাস্থ রসিক-মণ্ডলী সাগ্রহে প্রতীক্ষ্ণ করিয়া আছেন। ঘরে গৃহিণী তাঁহার ঔদাস্য ও অন্যমনস্কতায় সন্দিগ্ধ হইয় উঠিতেছেন। নানা দুশ্চিন্তায় দুভাবনায় এই মধুর আষাঢ় মাসেও রাত্রিতে নিদ্রা নাই!
কয়েকটি যুবতী এই সময় মঞ্জীর-ঝঙ্কারে অমৃতবৃষ্টি করিয়া সোপানশীর্ষ হইতে জলের ধারে নামিয়া আসিল। পুরুষকে কেহ লক্ষ্য করিল না–উত্তরীয় কলস নামাইয়া রাখিয়া জলে অবতরণ করিল; কৌতুক-সরস আলাপ করিতে করিতে পরস্পরের দেহে জল ছিটাইতে লাগিল। পুরুষ একবার সচকিতে তাহাদের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া নতমুখে তাহাদের আলাপের ছিন্নাংশ শুনিতে লাগিলেন।
কাল তোর বর দেশে ফিরিয়াছে–না? তাই–
সমুচ্চ কলহাস্যে বাকি কথাগুলি চাপা পড়িয়া গেল।
কি ভাই? কি হইয়াছে ভাই?
তুই আইবুড় মেয়ে—আমাদের সঙ্গে মিশবি কেন লা? তোকে কিছু বলিব না।
আহা বল বল–ওর তো এই মাসেই বর আসিবে-ও এখন আমাদের দলে। …
মধু, মোম, কুক্কম আর ইঙ্গুদী-তৈল মিশাইয়া ঠোঁটে লাগাস–আর কোনও ভয় থাকিবে না। সেই সঙ্গে একটু কেয়ার রেণুও দিতে পারিস, কিন্তু খুব সামান্য…
ওলো দ্যাখ। দাখ, কপৌতিকার কি দশা হইয়াছে…
…লোলার কি দুঃখ ভাই! তাহার স্বামী আজিও ফিরিল না–কে জানে হয়তো–যবদ্বীপ কতদূর ভাই?
সিংহল পার হইয়া যাইতে হয়–ছয় মাসের পথ—লোলার জন্য বড় দুঃখ হয়–আমাদের সঙ্গে আসে না—
—দ্যাখ, মেঘগুলা আজ পূর্বমুখে ছুটিয়াছে–
—হ্যাঁ। এ মেঘ অলকায় যাইবে না। পুরুষ কর্ণ উদ্যত করিয়া শুনিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু আর অধিক শুনিতে পাইলেন না। যুবতীরা গাত্র মার্জনা সমাপন করিয়া তীরে উঠিল।
এই যুবতীযুথের মধ্যে একটিকে পুরুষ চিনিতেন। তাহারা বস্ত্ৰ-পরিবর্তন সমাপ্ত করিলে তিনি ডাকিলেন– মায়ুরিকে, তোমরা একবার এদিকে শুনিয়া যাও।
চমকিত হইয়া সকলে মুখ ফিরাইল। বোধ করি একটু লজ্জাও হইল। তাই উত্তরীয় দ্বারা তাড়াতাড়ি অঙ্গ আবৃত করিয়া ফেলিল।
মঞ্জরিকা নিম্নকণ্ঠে পুরুষের নাম উচ্চারণ করিল, নিমেষের মধ্যে চোখে চোখে একটা উত্তেজিত ইঙ্গিত খেলিয়া গেল। তারপর সকলে সংযতভাবে পুরুষের সমীপবর্তী হইয়া দাঁড়াইল।
মঞ্জরিকা যুক্ত করে প্রণাম করিয়া বলিল–ভট্ট, আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন।
ভট্ট স্মিতমুখে আশীর্বাদ করিলেন–আয়ুষ্মতী হও। তোমরা এতক্ষণ কি কথা কহিতেছিলে?
সকলে পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিল। যে সকল কথা হইতেছিল, তাহা পুরুষকে, বিশেষত ভট্টকে কি করিয়া বলা যাইতে পারে?
মঞ্জরিকা ইহাদের মধ্যে ঈষৎ প্ৰগলভা, সে-ই উত্তর দিল। কৌতুক-চঞ্চল-দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল–ভট্ট, আজ আকাশের মেঘদল পূর্বদিকে চলিয়াছে। উত্তরে অলকাপুরীতে পৌঁছিতে পরিবে না, তাই আমরা আক্ষেপ করিতেছিলাম।
ভট্ট জিজ্ঞাসা করিলেন–সে জন্য আক্ষেপ কেন?
মঞ্জরিকা বলিল–যক্ষপত্নী বিরহ-বেদনায় কালব্যাপন করিতেছেন, যাক্ষের সংবাদ পাইবেন। না,–এই জন্য আক্ষেপ।
এতক্ষণে যেন বুঝিতে পারিয়াছেন এমনিভাবে ভট্ট বলিলেন–বুঝিয়াছি। তোমরা মেঘদূত কাব্যের কথা বলিতেছ। ভাল, তোমরা দেখিতেছি কাব্যশাস্ত্ৰে সুচতুরা। আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পার?
সকলে যুক্ত করে বলিল—আজ্ঞা করুন।
ভট্ট চিন্তা করিলেন; পরে শিরঃসঞ্চালনা করিয়া কহিলেন-না, সে বড় কঠিন প্রশ্ন, তোমরা পরিবে না।
মঞ্জরিকা অনুনয় করিয়া বলিল–তবু আজ্ঞা করুন আর্য।
ভট্ট সকলের চক্ষে অধীর কৌতূহল লক্ষ্য করিয়া বলিলেন–উত্তম, বলিতেছি শুন। —তোমরা বলিতে পার, কাব্যে নায়ক-নায়িকার বিবাহ সম্পাদিত হইবার পর কবির আর কিছু বক্তব্য থাকে কি না?
সকলে বিস্মিতভাবে নীরব রহিল; ভট্ট যে তাঁহাদের মতো অপরিণত-বুদ্ধি যুবতীদের নিকট কাব্যশাস্ত্ৰ সম্বন্ধীয় এরূপ প্রশ্ন করিবেন, তাহা যেন সহসা ধারণা করিতেই পারিল না।
শেষে মঞ্জরিকা বলিল–আৰ্য, নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটিলেই তো কাব্য শেষ হইল! তাহার পর কবির আর কি বক্তব্য থাকিতে পারে?
ভট্ট বলিলেন—ময়ুরিকে, আমি মিলনের কথা বলি নাই, বিবাহের কথা বলিয়াছি।
বিস্মিতা মঞ্জরিকা বলিল–উভয়ই এক নহে কি?
ভট্ট গূঢ় হাসিয়া বলিলেন–উহাই তো প্রশ্ন। ভট্টের কথার মর্ম কেহ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না, সকলে নিবাক হইয়া রহিল। ভট্ট ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া চিন্তিতভাবে রহিলেন।
অবশেষে অরুণিক কথা কহিল। সে ইহাদের মধ্যে সবাপেক্ষা চতুরা, এতক্ষণ কথা বলে নাই, এবার মুখ টিপিয়া জিজ্ঞাসা করিল–ভট্ট, এ প্রশ্নটি কখনও ভট্টিনীর নিকট করিয়াছিলেন কি?
ভট্ট চমকিয়া মুখ তুলিলেন। দেখিলেন আরুণিকার অরুণ ওষ্ঠ্যপ্রান্তে একটু চাপা হাসি খেলা করিতেছে। তিনি ঈষৎ বিব্রতভাবে বলিলেন–না, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই, স্মরণ ছিল না। আজ গৃহে ফিরিয়াই জিজ্ঞাসা করিব। –কিন্তু তোমরা আর বিলম্ব করিও না, এবার গৃহে যাও। রাত্ৰি আগতপ্রায়।
বক্রোক্তিটা সকলের কানে পৌঁছিল না; শুধু অরুণিকা বুঝিল, ভট্ট মৃদু রকমের প্রতিশোধ লাইলেন। সকলে যুক্তহস্ত হইয়া বলিল–আৰ্য, আমাদের আশীর্বাদ করুন।
ভট্ট হাসিলেন– তোমাদের আমি আর কি আশীর্বাদ করিব? আমি শঙ্করের দাস–অথচ স্বয়ং শঙ্কর্যারি তোমাদের সহায়। ভাল, আশীর্বাদ করিতেছি–মুহূর্ত-কাল নীরব থাকিয়া জলদগভীর-কণ্ঠে কহিলেন, মাতৃভূদেবং ক্ষণমপি চ তে স্বামিনা বিপ্রয়োগঃ।
সকলে কপোতহস্তে আশীর্বাদ গ্রহণ করিয়া শিরোধার্য করিল! তারপর প্রফুল্ল মনে প্রীতিবিম্বিতমুখে শ্রেণি-কলস-ভার-মস্থর পদে প্ৰস্থান করিল।
ভট্ট বসিয়া রহিলেন। যুবতীদের নুপুরনিক্কণ ক্ৰমে শ্রুতি-বহির্ভূত হইয়া গেল। তখন আবার তাঁহার মুখ চিন্তাচ্ছন্ন হইল। কি করা যায়? এ প্রশ্নের কি সমাধান নাই? তীরে আসিয়া শেষে তরী ড়ুবিবে? অবশ্য এ কথা সত্য যে, নায়ক-নায়িকার বিবাহ দিবার পর কবির কর্তব্য শেষ হয়। কিন্তু তবু তাঁহার মন সন্তোষ মানিতেছে না কেন? কাব্য তো শেষ হইয়াছে –আর এক পদ অগ্রসর হইলে প্ৰতিজ্ঞা-লঙ্ঘন হইবে, যাহা প্ৰতিপন্ন করিবার জন্য লেখনী ধারণা করিয়াছিলেন। তাহার অতিরিক্ত কথা বলা হইবে। তাহা করিবার প্রয়োজন কি? নায়িকার মুখে সলজ্জ হাসি ফুটাইয়া বিদায় লওয়াই তো কবির উচিত; আর সেখানে থাকিলে যে রাসভঙ্গ হইবে। সবই ভট্ট বুঝিতেছেন, তবু তাঁহার মন উঠিতেছে না। কেবলি মনে হইতেছে–এ হইল না, কাব্য শেষ হইল না, চরম কথাটি বলা হইল না।
এদিকে রাত্রি মেঘের ধূসর পক্ষে আশ্রয় করিয়া দ্রুত অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। সন্ধ্যা-আহ্নিকও হয় নাই–মন বিক্ষিপ্ত! ভট্ট উঠিবার চেষ্টা করিয়া চারিদিকে চাহিলেন। দেখিলেন, কলস-কক্ষে একটি তরুণী নিঃশব্দে নামিয়া আসিতেছে। তাহার গতিভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল–যাহা দেখিয়া ভট্ট উঠিতে পারিলেন না, আবার বসিয়া পড়িলেন।
তরুণী ধীরে ধীরে কলস নামাইয়া সোপানের শেষ পৈঠায় আসিয়া বসিল। কোনও দিকে লক্ষ্য করিল না, বিষণ্ণ ব্যথিত চক্ষু দুটি তুলিয়া যেখানে শিপ্রার স্রোত দূরে বাঁকের মুখে অদৃশ্য হইয়াছে, সেই দিকে চাহিয়া রহিল।
ভট্ট দেখিলেন–রমণীর দেহে সৌভাগ্যের চিহ্ন ব্যতীত অন্য কোনও অলঙ্কার নাই। রুক্ষকেশের রাশি একটা-মাত্ৰ বেণীতে আবদ্ধ হইয়া অংসের উপর পড়িয়া আছে, শুষ্ক অশ্রুহীন চোখে কাজল নাই।
এই নীরব শোকপরায়ণা একবেণী ধরা যুবতীকে ভট্ট বালিকা-বয়সে চিনিতেন। সম্প্রতি বহুদিন দেখেন নাই। তাঁহার চক্ষে জল আসিল, কিন্তু বক্ষে আনন্দের ক্ষণপ্ৰভাও খেলিয়া গেল। তিনি ডাকিলেন–লোলা!
তন্দ্রাহতের ন্যায় যুবতী ফিরিয়া চাহিল। ভট্টকে দেখিয়া সলজ্জে উত্তরীয় দ্বারা অঙ্গ আবৃত করিয়া সঙ্কোচ-জড়িত-পদে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ভট্টের চক্ষু বড় তীক্ষ্ণ, বস্ত্ৰ ভেদ করিয়া দেহ ও দেহ ভেদ করিয়া মনের অন্তরতম কথাটি দেখিয়া লয়। লোলা কুণ্ঠিত নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
ভট্ট জিজ্ঞাসা করিলেন–তুমি রৈবতক নাবিকের বধু?
লোলা হেঁট মুখে রহিল, উত্তর করিল না। তাহার অধর কাঁপিতে লাগিল।
ভট্ট পুনরায় বলিলেন—তোমার স্বামী শ্রেষ্ঠী বরুণমিত্রকে লইয়া গত বৎসর ব্যবদ্বীপে গিয়াছে–আজিও ফিরে নাই?
লোলার চক্ষু দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। সে কেবল মাথা নাড়িল।
ভট্ট সুস্মিত মুখে বলিলেন–তুমি ভয় করিও না, রৈবতক কুশলে আছে।
ব্যাকুল নয়নে লোলা ভট্টের মুখের দিকে চাহিল। তাহার দৃষ্টির কাতর-বিহ্বল প্রশ্ন ভট্টের বক্ষে সূচীবেধবৎ বিঁধিল। তিনি লজ্জিত হইলেন—ছি, ছি, এতক্ষণ এই বালিকার আকুল আশঙ্কা লইয়া তিনি খেলা করিতেছিলেন!
অনুতপ্তস্বরে বলিলেন–আজ রাজসভায় সংবাদ আসিয়াছে–রৈবতক সমস্ত নৌকা লইয়া সমুদ্র-সঙ্গমে ফিরিয়াছে! দুই-এক দিনের মধ্যেই গৃহে ফিরিবে। তুমি নিশ্চিন্ত হও।
থরথর কাঁপিয়া লোলা সেইখানেই বসিয়া পড়িল। তারপর গলদ শ্রদ্ধানেত্ৰে গলবস্ত্ৰ হইয়া ভট্টকে প্ৰণাম করিল, বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল–দেব, আপনি আজ অভাগিনীর প্রাণ দিলেন। মহাকাল আপনাকে জয়যুক্ত করুন। উদগত অশ্রু সম্বরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল—আজ সংবাদ আসিয়াছে?
হ্যাঁ।
সকলে নিরাপদে আছেন?
হ্যাঁ, সকলেই নিরাপদে আছেন। —লোলা, তুমি অনুপমা। রৈবতক আসিলে তাহাকে আমার কাছে পাঠাইয়া দিও, তাহাকে তোমার কথা বলিব।
অশ্রু মার্জনা করিয়া লোলা সিক্ত হাসি হাসিল, অস্ফুটস্বরে বলিল–যে আজ্ঞা।
এতক্ষণে শীকরকণার ন্যায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, বায়ুতাড়িত জলকণা তির্যকভাবে ভট্টের মুখে পড়িতে লাগিল। তিনি উঠিলেন, সস্নেহস্বরে লোলাকে বলিলেন–লোলা, দুঃখের অন্তেই মিলন মধুর হয়। আমার উমাকে আমি যে দুঃখ দিয়াছি তাহা স্মরণ করিলেও বক্ষ বিদীর্ণ হয়; কিন্তু চরমে সে ঈন্সিত বর লাভ করিয়াছে। মদন পুনরুজজীবিত হইয়াছে। —তুমিও আমার গৌরীর ন্যায় সুভগা। তোমার জীবনেও মদন পুনরুজ্জীবিত হইবেন। কল্য তাঁহার মন্দিরে পূজা পাঠাইও।
লোলা কৃতাঞ্জলি হইয়া বসিয়া রহিল, ভট্টের সকল কথা বুঝিতে পারিল না, কিন্তু অপরিমিত সুখাবেশে তাহার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ভট্ট সহাস্যে তাহার মস্তকে একবার হস্তার্পণ করিয়া ত্বরিত পদে সোপান অতিবাহিত করিয়া প্ৰস্থান করিলেন।