Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মনচোরা || Sharadindu Bandyopadhyay

মনচোরা || Sharadindu Bandyopadhyay

রাত্রির কলিকাতা। মহানগরীর পথে পথে বিদ্যুদ্দীপালী। জলন্ত চক্ষু মোটরের ছুটাছুটি। উচ্চাঙ্গের বিলাতী হোটেলে যৌথনৃত্য। রেডিও যন্ত্রে গগনভেদী সঙ্গীত। কোনও নবাগত দর্শক দেখিয়া শুনিয়া মনে করিতে পারেন না যে নগরের একটা অন্ধকার দিকও আছে।

আকাশে শুক্লা তিথির চাঁদ; তাহারও অর্ধেক উজ্জ্বল, অর্ধেক অন্ধকার।

কলিকাতার পথে-বিপথে সঞ্চরণ করিয়া শেষে একটি অপেক্ষাকৃত নির্জন অভিজাত পল্লীতে আসিয়া উপনীত হওয়া যায়। এ অঞ্চলে প্রায় প্রত্যেক বাড়ি পাঁচিল দিয়া ঘেরা, আপন আপন ঐশ্বর্যবোধের গর্বে পরস্পর হইতে দূরে দূরে অবস্থিত।

একটি পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির ফটক। ফটক না বলিয়া সিংদরজা বলিলেই ভাল হয়। লোহার গরাদযুক্ত উচ্চ দরজার সম্মুখে গুর্খা দারোয়ান গাদা বন্দুক কাঁধে তুলিয়া ধীর গম্ভীর পদে পায়চারি করিতেছে। গরাদের ফাঁক দিয়া অভ্যন্তরের বৃহৎ দ্বিতল বাড়ি দেখা যাইতেছে; বাড়ি ও ফটকের মধ্যবর্তী স্থান নানা জাতীয় ফুলগাছ ও বিলাতী পাতাবাহারের ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। একটি কঙ্করাকীর্ণ পথ ফটক হইতে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত গিয়া আবার চক্রাকারে ফিরিয়া আসিয়াছে।

ফটকের একটি স্তম্ভে পিতলের ফলকে খোদিত আছে—

যদুনাথ চৌধুরী
জমিদার–হুতুমগঞ্জ

সিংদরজা উত্তীর্ণ হইয়া বাড়ির সম্মুখীন হইলে দেখা যায়, গাড়িবারান্দার নীচে ভারী এবং মজবুত সদর দরজা ভিতর হইতে বন্ধ রহিয়াছে।

সদর দরজা দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে সম্মুখেই পড়ে একটি আলোকোজ্জ্বল বড় হলঘর। ঘরের মধ্যস্থলে একটি গোল টেবিল; তাহার উপর টেলিফোন। টেবিলের চারিদিকে কয়েকটি চেয়ার। সম্মুখের দেয়ালে একটি বৃহৎ ঠাকুর্দা-ঘড়ি। তাছাড়া অন্যান্য আসবাবপত্রও আছে।

বাঁ দিকের দেয়ালে সারি সারি তিনটি ঘরের দ্বার। প্রথমটি ভোজনকক্ষ, দ্বিতীয়টি গৃহস্বামীর শয়নকক্ষ; তৃতীয়টি ঠাকুরঘর। ডান দিকে দুইটি ঘর; লাইব্রেরি ও ড্রয়িংরুম। পিছনের দেয়াল ঘেঁষিয়া উপরে উঠিবার সিঁড়ি।

হল-ঘরে কেহ নাই। কিন্তু ভোজনকক্ষ হইতে মানুষের কণ্ঠস্বর আসিতেছে। সুতরাং সেদিকে যাওয়া যাইতে পারে।

ভোজনকক্ষে দেশী প্রথায় মেঝেয় আসন পাতিয়া ভোজনের ব্যবস্থা। কিন্তু ঘরে একটি বড় ফ্রিজিডেয়ার ও কয়েকটি জালের দ্বারযুক্ত আলমারি আছে। মেঝেয় পাশাপাশি তিনটি আসন পাতা। মাঝের আসনটিতে বসিয়া বাড়ির কর্তা যদুনাথবাবু আহার করিতেছেন। দুই দিকের আসন দুইটি খালি; তবে আসনের সম্মুখে থালায় খাদ্যদ্রব্যাদি সাজানো রহিয়াছে।

যদুনাথের অনুঢ়া নাতিনী নন্দা সম্মুখে বসিয়া আহার পরিদর্শন করিতেছে এবং মাঝে মাঝে কোনও বিশেষ ব্যঞ্জনের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে। সেই সঙ্গে দুই চারটি কথা হইতেছে। বাড়ির সাবেক ভৃত্য সেবকরাম এক ঝারি জল ও তোয়ালে লইয়া দ্বারের কাছে বসিয়া আছে। সেও কথাবার্তায় যোগ দিতেছে।

যদুনাথবাবুর বয়স অনুমান সত্তর; আকৃতি শীর্ণ এবং কঠোর; সহজ কথাও রুক্ষভাবে বলেন। একদিকে যেমন ঘোর নীতিপরায়ণ, অন্যদিকে তেমনি ছেলেমানুষ; তাই তাঁহার ব্যবহার কখনও সম্ভ্রম উৎপাদন করে, আবার কখনও হাস্যরসের উদ্রেক করে। শরীর বাতে পঙ্গু তাই সচরাচর লাঠি ধরিয়া চলাফেরা করেন। বর্তমানে লাঠি তাঁহার আসনের পাশে শয়ান রহিয়াছে।

নন্দার বয়স আঠারো উনিশ। সে একাধারে সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী, স্নেহময়ী ও তেজস্বিনী। বাড়িতে পড়িয়া আই-এ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। এই নাতিনী ও এক নাতি ছাড়া যদুনাথের সংসারে আর কেহ নাই।

সেবক বয়সে বৃদ্ধ; সম্ভবত যদুনাথের সমবয়স্ক। কিন্তু তাহার ছোটখাটো ক্ষীণ দেহটি পঞ্চাশ বছরে আসিয়া আটকাইয়া গিয়াছে; আর অধিক পরিণতি লাভ করে নাই।

ছাড়া-ছাড়া কথাবার্তা চলিতেছে।

নন্দা বলিল——দাদু, অন্য জিনিস খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলো না, আমি নিজের হাতে তোমার জন্যে পুডিং তৈরি করেছি।

যদুনাথ গলার মধ্যে একটা শব্দ করিলেন। নন্দা গিয়া ফ্রিজিডেয়ার হইতে পুডিং-এর পাত্রটি আনিয়া আবার বসিল।

সেবক হঠাৎ বলিল-বাবু, ছাকড়াগাড়িবাবুকে তাড়িয়ে দিলে কেন? কী করেছিলেন তিনি?

নন্দা বলিল-হ্যাঁ, ভুবনবাবুকে ছাড়িয়ে দিলে কেন দাদু? সেক্রেটারির কাজ তত ভালই করছিলেন।

যদুনাথ কিছুক্ষণ নীরবে আহার করিয়া চক্ষুযুগল তুলিলেন, বলিলেন—ভুবন মিছে কথা বলেছিল। আমার কাছে মিথ্যে কথা! হতভাগা! ভেবেছিল আমার চোখে ধুলো দেবে।

যদুনাথ আবার আহারে মন দিলেন। নন্দা ও সেবক একবার চকিত শঙ্কিত দৃষ্টি বিনিময় করিল। সেবকের মুখের ভাব দেখিয়া মনে হয়, সে মনে মনে বলিতেছে কর্তা যদি আমাদের মিছে কথা জানতে পারেন তাহলে কি করবেন! নন্দা অস্বস্তিপুর্ণ মুখে একটু বসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—তা একটু-আধটু মিছে কথা কে না বলে? ভুবনবাবু কি টাকাকড়ি গোলমাল করেছিলেন?

যদুনাথ বলিলেন-না, কিন্তু করতে কতক্ষণ? যে-লোক মিছে কথা বলতে পারে, সে চুরিও করতে পারে। এরকম লোককে বাড়িতে রাখা যেতে পারে না। যদি আমার সূর্যমণি চুরি করে! তখন আমি কি করব?

নন্দা হাসিল-কী যে বল দাদু! ঠাকুরঘরের তালা ভেঙে সূর্যমণি চুরি করবে এত সাহস কারুর নেই।

তবু সাবধানের মার নেই। চুরিই বলো আর মিথ্যে কথাই বলো, সব এক জাতের। যার মিথ্যে কথা একবার ধরা পড়েছে, আমার বাড়িতে তার ঠাঁই নেই।

সে যেন হল। কিন্তু তোমার তো একজন সেক্রেটারি না হলে চলবে না। তার কি হবে?

এবার খুব দেখেশুনে বাছাই করে সেক্রেটারি রাখব।

বাছাই করে

হ্যাঁ, এবার কাগজে বিজ্ঞাপন দেব ঠিকুজি-কোষ্ঠীসহ আবেদন করহ। যারা দেখা করতে আসবে তাদের ঠিকুজি আনতে হবে। ঠিকুজি পরীক্ষা করে যদি দেখি লোকটা ভাল, চোরবাটপাড় নয়, মিথ্যেবাদী নয়, তবেই তাকে রাখব। আর চালাকি চলবে না।

নন্দার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলিয়া গেল। সেবক গলা খাঁকারি দিল।

বলিল—ঠিকুজি-কোষ্ঠীর কথায় মনে পড়ল, আমার দিদিমণির ঠিকুজি-কোষ্ঠী কী বলে? আর কতদিন বই পড়বে? ওনার বিয়ে-থা কি হবে না?

নন্দা ঠোঁটের উপর আঁচল চাপা দিল।

যদুনাথ কহিলেন-নন্দার কোষ্ঠী অনেকদিন দেখিনি, কাল দেখব!-নন্দা, তুই খেতে বসলি না?

নন্দা বলিল—আমার তাড়া নেই। দাদা আসুক, দুজনে একসঙ্গে খাব।

যদুনাথ পাশের আসনের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, তারপর কুঞ্চিত করিয়া মুখ তুলিলেন।

মন্মথ এখনও ফেরেনি?

এই সময় পাশের হল-ঘরে ঠং ঠং করিয়া নটা বাজিতে আরম্ভ করিল।

নন্দা হালকাভাবে বলিল—এই তো সবে নটা বাজল। দাদা দশটার আগেই ফিরবে।

যদুনাথ কিছুক্ষণ উদ্বিগ্ন চক্ষে নন্দার পানে চাহিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন—আমি নটার সময় শুয়ে পড়ি, ডাক্তারের হুকুম; মন্মথ কখন বাড়ি ফেরে জানতে পারি না। ঠিক দশটার আগে ফেরে তো? দশটার পর আমার বাড়ির কেউ বাইরে থাকে আমি পছন্দ করি না।

নন্দার সহিত সেবকের আর একবার চকিত দৃষ্টি বিনিময় হইল। সেবক বলিল—আজ্ঞে বাবু, কোনও দিন দাদাবাবুর দশটা বেজে এক মিনিট হয় না, ঠিক দশটার আগে এসে হাজির হয়।

হুঁ। কিন্তু এত রাত্রি পর্যন্ত থাকে কোথায়? করে কি?

নন্দা কহিল-কী আর করবে, বন্ধুদের সঙ্গে ব্রিজ খ্যালে, না হয় ক্লাবে গিয়ে বিলিয়ার্ড ব্যালে—এই আর কি।

যদুনাথ ভারী গলায় বলিলেন—তা তাস-পাশা খ্যালে খেলুক। বিয়ের ছমাস যেতে না যেতে নাতবৌ মারা গেলেন, ওর মনে খুবই লেগেছে; তাই আমি আর বেশি কড়াকড়ি করি না। খেলাধুলোয় যদি মন ভাল থাকে তো থাক। কিন্তু দশটার পর বাড়ির বাইরে থাকার কোনও ওজুহাতই থাকতে পারে না। যারা বাইরে থাকে তারা বজ্জাৎ, দুশ্চরিত্র।

নন্দা আশ্বাসের সুরে বলিল—না দাদু, দাদা ঠিক সময়ে বাড়ি ফেরে।

সেবক বলিল—ঘরে বৌ থাকলে আরও সকাল সকাল বাড়ি ফিরত। কথায় বলে ঘর না ঘরণী। বাবু, এবার তাড়াতাড়ি দাদাবাবুর নতুন বিয়ে দাও; দেখবে ঘর ছেড়ে আর বেরুবে না।

যদুনাথ বলিলেন—আমার কি অনিচ্ছে। কিন্তু একটা বছর না কাটলে লোকে বলবে কি!—দে, হাতে জল দে।

সেবক হাতে জল ঢালিয়া দিল, যদুনাথ ভোজনপাত্রের উপরেই মুখ প্রক্ষালন করিয়া লাঠি হাতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন—সেবক, বাড়ির দোর-জালা সব বন্ধ হয়েছে কিনা ভাল করে দেখে নিবি।

আজ্ঞে

ভোজনকক্ষ হইতে হল-ঘরে প্রবেশ করিয়া যদুনাথ ঠাকুরঘরের দিকে চলিলেন; নন্দা ও সেবক তাঁহার পিছনে চলিল। ঠাকুরঘরের দ্বারে একটি বড় তালা ঝুলিতেছিল, যদুনাথ কোমর হইতে চাবির থোলো লইয়া দ্বার খুলিলেন।

ঠাকুরঘরে দুইটি ঘৃত-প্রদীপ জ্বলিতেছে। ঘরের মধ্যস্থলে রূপার সিংহাসনের উপর একটি সোনার থালা খাড়াভাবে রাখা রহিয়াছে; থালার মাঝখানে চাকার নাভিকেন্দ্রের মতো একটি প্রকাণ্ড মাণিক্য আরক্ত প্রভা বিকীর্ণ করিতেছে। ইহাই অমূল্য সূর্যমণি; ইহাই যদুনাথের বংশানুক্রমিক গৃহদেবতা।

যদুনাথ দ্বারের সম্মুখে জোড়হাতে দাঁড়াইয়া প্রণাম করিলেন।

জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোস্মি দিবাকরম্।

যদুনাথের পশ্চাতে নন্দা ও সেবক যুক্ত কর কপালে ঠেকাইয়া প্রণাম করিল। তারপর যদুনাথ আবার দ্বারে তালা লাগাইলেন।

শয়নকক্ষের দ্বার পর্যন্ত আসিয়া যদুনাথ সেবককে বলিলেন—সেবক, লাইব্রেরিতে উড়ুদায় প্রদীপ বইখানা আছে, এনে দে বিছানায় শুয়ে পড়ব।

যদুনাথ শয়নকক্ষে প্রবশ করিলেন। সেবক নন্দার মুখের পানে চাহিয়া কয়েকবার চক্ষু মিটিমিটি করিল—উড়ু উড়ু পিদ্দিম—সে আবার কি বই দিদিমণি?

নন্দা হাসিয়া বলিল—উড়ুদায় প্রদীপ—একখানা জ্যোতিষের বই। আয় দেখিয়ে দিচ্ছি।

দুইজনে হল-ঘরের অপর প্রান্তে লাইব্রেরির দিকে চলিল।

লাইব্রেরি-ঘরে একটি বড় টেবিল, কয়েকটি গদিমোড়া চেয়ার; অনেকগুলি আলমারিতে অসংখ্য পুস্তক সাজানো। নন্দা টেবিলের উপর হইতে উড়দায় প্রদীপ লইয়া সেবককে দিল—এই নে। আর দ্যাখ সেবক, দাদার খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে দে, বাবু যে কখন ফিরবেন তার তো কিছু ঠিক নেই, এগারোটাও হতে পারে-বারোটাও হতে পারে।

সেবক বিমর্ষভাবে বলিল—হুঁ। এদিকে কর্তার কাছে মিছে কথা বলে বলে আমাদের জিভ তেউড়ে গেল। কোথায় যায় বল দিকি? কি করে এত রাত অব্দি?

জানিনে বাপু। ভাবতেও ভাল লাগে না। দাদু যদি জানতে পারেন অনর্থ হবে। কিন্তু সে হুঁশ কি দাদার আছে?—থাকগে ও কথা, সেবক-তোকে আর-একটা কাজ করতে হবে। তুই নিজের খাওয়া-দাওয়া সেরে আমার খাবার ওপরে আমার ঘরে দিয়ে আসিস, লক্ষ্মীটি। এখন খেলে ঘুম পাবে, পড়াশুনা হবে না। এদিকে শিরে সংক্রান্তি, একজামিন এসে পড়েছে।

ঐ তো! রাত জেগে জেগে বই পড়ছ, এদিকে বিয়ের নামটি নেই। থুবড়ো মেয়ে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।

নন্দা মুখ টিপিয়া হাসিল—আচ্ছা—হয়েছে

দুজনে লাইব্রেরি হইতে বাহির হইল। নন্দা সিঁড়ি দিয়া উপরে গেল; সেবক বই লইয়া যদুনাথের ঘরের দিকে গেল।

.

বাড়ির দ্বিতলে একটি লম্বা বারান্দার দুই পাশে দুই সারি ঘর। একটি ঘর নন্দার; তাহার সম্মুখেরটি মন্মথর। অন্য ঘরগুলি প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহৃত হয়।

নন্দা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া আসিল এবং নিজের ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার ঘরটি বেশ বড়, একটু লম্বাটে ধরনের। একদিকে খাট বিছানা; অন্যদিকে পড়ার টেবিল, বই রাখার চরকি আলমারি ইত্যাদি। মাঝখানে একটি আয়নার কবাটযুক্ত বড় ওয়ার্ডরোব। ঘরটি মেয়েলি হাতের নিপুণতার সহিত পরিপাটিভাবে সাজানো।

নন্দা প্রথমে গিয়া বাহিরের দিকের জানালা খুলিয়া দিল। দ্বিতলের জানালা, তাই গরাদ নেই। বাহিরের অস্ফুট জ্যোত্সা ঘরে প্রবেশ করিল। নন্দা জানালায় দাঁড়াইয়া অলস হস্তে কানের দুল খুলিতে লাগিল। তারপর দুল দুটি ওয়ার্ডরোবে রাখিয়া দিয়া সে পড়ার টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; টেবিলের উপর একটি পড়ার আলো ছিল, তাহা জ্বালিয়া দিল।

টেবিলে একটি বই খোলা অবস্থায় উপুড় করা ছিল; মলাটের উপর তাহার নাম দেখা গেল-রঘুবংশম্। নন্দা চেয়ারে বসিল; ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বইটি তুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।

.

হল-ঘরের ঘড়িতে দশটা বাজিতে পাঁচ মিনিট। ঘরের আলো নিষ্প্রভ; মাত্র একটা বা জ্বলিতেছে।

যদুনাথ শয্যায় শয়ন করিয়া বই পড়িতেছিলেন, আলো নিভাইয়া শুইয়া পড়িলেন। চাবির গোছ তাঁহার বালিশের পাশে ছিল, তাঁহার একটা হাত তাহার উপর ন্যস্ত হইল।

.

নন্দা নিজের ঘরে বসিয়া রঘুবংশ পড়িতেছে।

সা দুষ্প্রর্ধষা মনসাপি হিংস্রৈঃ —

ভেজানো দরজার বাহির হইতে সেবকের কণ্ঠস্বর আসিল

দিদিমণি, তোমার খাবার এনেছি

নন্দা গলা তুলিয়া বলিল—নিয়ে আয়।

সেবক দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল এবং চরকি আলমারির উপর খাবারের থালা রাখিল। অনুযোগের স্বরে বলিল—দশটা বাজল, এখনও ছোট কর্তার দেখা নেই! আচ্ছা, রোজ রোজ এ কি ব্যাপার দিদিমণি? তুমি কিছু বলতে পার না?

নন্দা বলিল-হাজার বার বলেছি। রোজই বলে—আজ আর দেরি হবে না। কি করব বল?

সেবক বলিল-হুঁ। যাই, দোরের কাছে বসে থাকিগে। দোর খুলে দিতে হবে তো। কিন্তু এসব ভাল কথা নয়, মোট্টে ভাল কথা নয়—

দ্বার ভেজাইয়া দিয়া সেবক চলিয়া গেল। নন্দা কিছুক্ষণ উদ্বিগ্ন চক্ষে শুন্যে তাকাইয়া রহিল, তারপর বই টানিয়া লইয়া আবার পড়ায় মন দিল।

সেবক নীচে নামিয়া আসিয়া ভোজনকক্ষে গেল। আসনের সম্মুখে থালায় খাবার সাজানো ছিল, সেবক একটা জালের ঢাকনি দিয়া তাহা ঢাকা দিয়া রাখিল। হল-ঘরে ফিরিয়া সদর দরজা সন্তর্পণে খুলিয়া একবার বাহিরে উঁকি মারিল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া দরজা ভেজাইয়া দরজায় পিঠ দিয়া বসিল।

.

লিলি নাম্নী এক নর্তকীর ড্রয়িংরুম।

লিলি আধুনিকা নর্তকী। বয়স আন্দাজ ত্রিশ, কিন্তু ঠাটঠমক ও প্রসাধনের চাকচিক্যে নবযৌবনের বিভ্রম এখনও বজায় রাখিয়াছে। আজ রাত্রি দশটার সময় সে পিয়ানোতে বসিয়া গান গাহিতেছে এবং মন্মথ গগদ মুখে তাহার পাশে দাঁড়াইয়া আছে। মন্মথর বয়স ছাব্বিশ, বুদ্ধিসুদ্ধি বেশি নাই, সে বিলাতী পোশাক পরিতে এবং বড়মানুষী দেখাইতে ভালবাসে।

লিলি ও মন্মথ ছাড়া ঘরে আরও দুইটি লোক রহিয়াছে—দাশু ও ফটিক। ইহারা লিলির দলের লোক। দাশু মোটা লম্বা, ফটিক রোগা বেঁটে; দুজনেরই সাজপোশাক বাবুয়ানির পরিচায়ক, যেন তাহারাও বড়লোকের ছেলে। আসলে তাহারা ভদ্রবেশী জুয়াচোর; লিলির সাহায্যে বড়মানুষের ছেলে ফাঁসাইয়া শোষণ করা তাহাদের পেশা। বর্তমানে তাহারা যেন লিলির প্রণয়াকাঙক্ষী এবং মন্মথর প্রতিদ্বন্দ্বী—এইরূপ অভিনয় করিতেছে।

লিলি গাহিতেছে—

কেন পোহায় বলো সুখ-ফাগুন-নিশা
বঁধু না মিটিতে বুকে প্রেমতৃষা।
নব-যৌবন টলমল গো
চল চঞ্চল গো
চলে যায়–রহে না
তার ত্বর সহে না
চোখে বিজলী হানে কালোকাজল-দৃশা।
ফুলের বুকে আছে এখনও মধু,
আছে অরুণ হাসি অধরে, বঁধু
এস ধরিয়া রাখি—তারে ধরিয়া রাখি।
যেন পোহায় না গো সুখ-ফাগুন-নিশা।

গান শেষ হইলে মন্মথ সানন্দে করতালি দিয়া বলিয়া উঠিল—ওয়াণ্ডারফুল! ওয়াণ্ডারফুল!

লিলি সলজ্জে বিভ্রম দেখাইয়া বলিল—ধন্যবাদ মন্মথবাবু। এই গানটা আমার নতুন নাচের সঙ্গে গাইব। ভাল হবে না?

মন্মথ সোৎসাহে বলিল—চমৎকার হবে। নাচও তৈরি করেছেন নাকি?

হ্যাঁ। দেখবেন?

লিলি উঠিয়া দাঁড়াইল। মন্মথ বক্রচক্ষে দাশু ও ফটিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল। বলিল—আজ থাক। আর একদিন দেখব।

দাশু মুখ হইতে সিগার হাতে লইয়া হাসিল।

হে হে— আমি আগেই দেখেছি।

ফটিক বলিল-আমিও—হে হে।

মন্মথ ভর্ৎসনা-ভরা চোখে লিলির পানে তাকাইল।

ওঁদের আগেই দেখিয়েছেন। তা—বেশ। আমার দেখার কী দরকার?, আমি নাচের কী বা বুঝি?

প্রস্থানোদ্যত মন্মথকে হাত ধরিয়া লিলি থামাইল। বলিল—রাগ করছেন কেন, মন্মথবাবু? ওঁরা সেদিন জোর করে ধরলেন, না দেখে ছাড়লেন না। নইলে আপনাকেই তো আগে দেখাবার ইচ্ছে ছিল। বসুন, আজই আপনাকে নাচ দেখাব।

লিলি মন্মথকে ধরিয়া বসাইল। দাশু ফটিকের পানে চাহিয়া চোখ টিপিল। মন্মথ সন্তুষ্ট হইল বটে কিন্তু নিজের হাত-ঘড়ির দিকে চাহিয়া উৎকণ্ঠিত হইল।

আজ! কিন্তু আজ বড় দেরি হয়ে গেছে,

লিলি বলিল—কোথায় দেরি, এই তো সবে দশটা। ফটিকবাবু, ঘরের মাঝখান থেকে টেবিল-চেয়ারগুলো সরিয়ে নিন দেখি।

কিন্তু মন্মথ তথাপি ইতস্তত করিতে লাগিল।

আজ থাক, মিস লিলি। কাল আমি সকাল সকাল আসব। কাল হবে।

দাশু হাসিয়া উঠিল। বলিল—ওঁকে আজ ছেড়েই দিন, মিস লিলি। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে হয়তো ঠাকুর্দার কাছে বকুনি খাবেন।

মন্মথ ক্রুদ্ধ চোখে তাহার পানে চাহিল।

মোটেই না—আসুন মিস লিলি, আজ আপনার নাচ দেখে বাড়ি যাব।

তখন দাশু ও ফটিক উঠিয়া আসবাবপত্র দেয়ালের দিকে সরাইয়া দিতে প্রবৃত্ত হইল, লিলি শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়াইয়া নাচিবার জন্য প্রস্তুত হইতে হইতে বলিল—আপনাকে কিন্তু বাজাতে হবে, মন্মথবাবু। সুরটা তো শুনলেন, ফলো করতে পারবেন?

নিশ্চয়।

মন্মথ মিউজিক টুলে বসিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress