ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে
ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে আরব সাগরের উপকুলে কাথিয়াবাড় প্রদেশ, যেখানে বিশ্ববরেণ্য মহাপুরুষ– অহিংসার পূর্ণাবতার– জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সেখানে অনেকগুলি ছোট ছোট রাজ্য ছিল। ছোট ছোট রাজারা সাবেক পদ্ধতিতে রাজ্য ভোগ করিতেন। তাঁহারা আমোদ-প্রমোদে মগ্ন থাকিতেন; পাত্রমিত্র সচিবেরা নিজেদের লাভের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া শাসনতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত করিতেন; মহাজনেরা অর্থ শোষণ করিতেন।
গিরি-প্রান্তর বিচিত্র দেশ। পিছনে শুষ্ক নগ্ন গিরিমালা, সম্মুখে মরুভূমির মত পাদপ-বিরল শিলা বন্ধুর ভূমি তাহার ভিতর দিয়া অসমতল কুটিল পথের রেখা। এই দেশ আমাদের কাহিনীর রঙ্গভূমি। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও এই দেশে এক জাতীয় বীর দস্যুর আবির্ভাব হইত যাহাদের রবিন হুডের সঙ্গে তুলনা করা যায়। দেশের লোক তাহাদের বলিত– বারবটিয়া!
যুগে যুগে দেশে দেশে প্রবলের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে দুর্বলের মনুষ্যত্ব বিদ্রোহ করিয়াছে; এই বীর দস্যুরা সেই বিদ্রোহের জীবন্ত বিগ্রহ। যখনই ধর্মের গ্লানি হইয়াছে, অন্যায়ের অভ্যুদয় ঘটিয়াছে তখনই ইহারা আর্তের পরিত্রাণের জন্য আমাদের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। আপাতদৃষ্টিতে ইহাদের সমাজদ্রোহী বলিয়াই মনে হয়, কিন্তু যুগে যুগে ইহারাই সমাজকে রক্ষা করিয়াছেন, ন্যায়ের শাসন প্রবর্তন করিয়াছেন। কখনও দস্যুর বেশে, কখনও দিগ্বিজয়ীর বেশে, কখনও কৌপীনধারী সন্ন্যাসীর বেশে।
.
নিকটতম নগর হইতে প্রায় ক্রোশ তিনেক দূরে যেখানে সমতল ভূমি শেষ হইয়া পাহাড়ের চড়াই শুরু হইয়াছে, সেইখানে নির্জন গিরিপথের পাশে ক্ষুদ্র একটি প্রপা বা জলসত্র। জলসঙ্কটপূর্ণ মরুদেশের ইহা একটি বিশেষ অঙ্গ, সর্বত্র পথের ধারে দুই তিন ক্রোশ অন্তর একটি করিয়া প্রপার ব্যবস্থা আছে; ইহা রাজকীয় ব্যবস্থা, আবহমান কাল চলিয়া আসিতেছে। দেশের লোক ইহাকে বলে পরপ। সংস্কৃত প্রপা শব্দটি এই অপভ্রংশের মধ্যে এখনও বাঁচিয়া আছে। প্রতি প্রপার একটি করিয়া প্রপাপালিকা রমণী থাকে; পিপাসার্ত পথিক ক্ষণেক দাড়াইয়া জলপান করিয়া আবার গন্তব্য পথে চলিয়া যায়।
জলসত্র গৃহটি অতি ক্ষুদ্র; অসংস্কৃত-পাথরের টুকরা দিয়া নির্মিত একটি ছোট ঘর, সম্মুখে একটুখানি বারান্দা। বারান্দায় সারি সারি জলের কুম্ভ সাজানো আছে। চারিদিকে জংলী ঝোপঝাড়, পাথরের চাঙড়া; অন্য কোনও লোকালয় নাই। পিছনে পোয়াটাক পথ দূরে পার্বত্য ঝরনার জল জমিয়া একটি জলাশয় তৈয়ার হইয়াছে, সেই সরোবর হইতে জল আনিয়া প্রপাপালিকা জলসত্রে সঞ্চয় করিয়া রাখে।
এই সত্রের প্রপাপালিকাটি বয়সে যুবতী; তাহার নাম চিন্তা। সে দেখিতে অতিশয় সুশ্রী, কিন্তু তাহার সুকুমার মুখখানি সর্বদাই যেন ম্লান ছায়ায় আচ্ছন্ন বলিয়া মনে হয়। একদিন অপরাহ্নে সে বারান্দার কিনারায় বসিয়া টাকুতে সুতা কাটিতেছিল আর উদাসকণ্ঠে গান গাহিতেছিল। এ পথে অধিক পান্থের যাতায়াত নাই, তাই চিন্তা অধিকাংশ সময় তকলি কাটিয়া ও গান গাহিয়া কাটায়। সঙ্গিহীন প্রপায় আর কিছু করিবার নাই। যে তরুণ শিকারীটি মাঝে মাঝে অকস্মাৎ দেখা দিয়া তাহার প্রাণে বসন্তের হাওয়া বহাইয়া দিয়া যায় সে আজ আসিবে কিনা চিন্তা জানে না, তবু তাহার চোখ দুটি থাকিয়া থাকিয়া পথের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত অন্বেষণ করিয়া আসিতেছে, কান দুটিও একটি পরিচিত অশ্বক্ষুরধ্বনির জন্য সতর্ক হইয়া আছে।–
দরশ বিনে মোর নয়ন দুখায়
দূর পথের পানে চেয়ে থাকি
কভু ঝরে আঁখি, কভু শুকায়।
বুকের আঁধারে প্রদীপ-শিখা
কাঁপে আশার বায়ে
রহি শ্রবণ পাতি
ঐ নূপুর বাজে বুঝি রাঙা পায়ে
মরি হায় রে!
কোন বৈরাগী খঞ্জনি বাজায়ে যায় রে
মোর আশার দামিনী মেঘে লুকায়।
গানে বাধা পড়িল। পথের যে-প্রান্তটা পাহাড়ের দিকে উঠিয়াছে সেই দিকে হুমহুম শব্দ শুনিয়া চিন্তা চাহিয়া দেখিল, একটি ড়ুলি নামিয়া আসিতেছে। সামনে পিছনে তিনজন করিয়া বাহক, দুই পাশে দুইজন বল্লমধারী রক্ষী। ড়ুলি জলসত্রের সম্মুখে পৌঁছিতেই ড়ুলির ভিতর হইতে তীক্ষ্ণ রমণীসুলভ কণ্ঠের আওয়াজ বাহির হইল ওরে, থামা থামা—এটা পরপ না?
বাহকেরা তৎক্ষণাৎ ড়ুলি নামাইল। ড়ুলির মুখ রৌদ্র ও ধূলি নিবারণের জন্য পদ দিয়া ঢাকা ছিল। এখন পর্দা সরাইয়া যিনি মুখ বাহির করিলেন, তিনি কিন্তু রমণী নয়, পুরুষ। প্রৌঢ় শেঠ গোকুলদাসের কণ্ঠস্বর রমণীর মত এবং চেহারা মর্কটের মত, কিন্তু দেশসুদ্ধ লোক তাঁহাকে ভয় করিত। দেশে সুদখোর মহাজনের অভাব ছিল না কিন্তু এই গোকুলদাসের মত এমন বিবেকহীন হৃদয়হীন সাহুকার আর দ্বিতীয় ছিল কিনা সন্দেহ।
ঘটনাচক্রে চিন্তা গোকুলদাসকে চিনিত, তাই তাঁহাকে দেখিয়া তাহার মুখ কঠিন হইয়া উঠিয়াছিল। গোকুলদাস তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন,-
ওরে ঐ! পটের বিবির মত বসে আছিস চোখে দেখতে পাস না? জল নিয়ে আয়।
চিন্তা কোনও ত্বরা দেখাইল না, ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া একটি লম্বা আকৃতির ঘটিতে জল ভরিয়া ড়ুলির সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল।
গোকুলদাস গলা বাড়াইয়া নিজের দক্ষিণ করতল মুখের কাছে অঞ্জলি করিয়া ধরিলেন, চিন্তা তাহাতে জল ঢালিয়া দিতে লাগিল। জল পান করিতে করিতে গোকুলদাস চক্ষু বাঁকাইয়া কয়েকবার চিন্তাকে দেখিলেন, তারপর জলপান শেষ হইলে মুখ মুছিতে মুছিতে বলিলেন,
আরে এ মেয়েটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। বীর গ্রামের সেই রাজপুতটার মেয়ে না?
ড়ুলির এ-পাশে যে বল্লমধারী রক্ষীটা দাঁড়াইয়া ছিল তাহার নাম কান্তিলাল; সে এতক্ষণ নির্লজ্জ লেলিহ চক্ষু দিয়া চিন্তার রূপ-যৌবন নিরীক্ষণ করিতেছিল, এখন প্রভুর প্রশ্নে গোঁফে একটা মোচড় দিয়া বলিল,-
হাঁ শেঠ, চৈৎ সিংয়ের মেয়েই বটে। দেখছে না মুখখানা হাঁড়িপানা করে রয়েছে একটু হাসছেও না।
গুজরাত কাথিয়াবাড়ে আপনি বলিবার রীতি নাই— সকলে সকলকে নির্বিচারে তুমি বা তুই বলে।
ভৃত্যের এই রসিকতায় গোকুলদাস কৃষ্ণ-দন্ত বাহির করিয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে বসিলেন—
হি হি হি-তুই চৈৎ সিংয়ের মেয়ে! শেষে পরপে কাজ করছিস?
চিন্তার চোখে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলিতে লাগিল। সে চাপা স্বরে বলিল, হ্যাঁ। দেনার দায়ে তুমি আমার বাবার যথাসর্বস্ব নিলেম করে নিয়েছিলে, সেই অপমানে বাবা মারা গেলেন। তাই আজ আমি জলসত্রের দাসী।
গোকুলদাস বলিলেন, তোর বাপ টাকা ধার নিয়েছিল কেন? আর এতই যদি মানী লোক, তোকে বিক্রি করে আমার টাকা ফেলে দিলেই পারত। তাহলে তো আর তোকে দাসীবৃত্তি করতে হত না।
কান্তিলাল রসান দিয়া বলিল,-দাসীবৃত্তি! রানীর হালে থাকত শেঠজী। খরিদ্দার ওকে মাথায় করে রাখত।
চিন্তা তাহার দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, কিন্তু পরপওয়ালীর অগ্নিদৃষ্টি কে গ্রাহ্য করে? কান্তিলাল গোঁফে চাড়া দিতে দিতে কদর্য ভঙ্গিতে হাসিতে লাগিল। চিন্তা আর কোনও কথা না। বলিয়া নিবিড় ঘৃণাভরে ফিরিয়া চলিল।
ড়ুলির বাহকেরা এতক্ষণ ঘর্মাক্ত-দেহে দাঁড়াইয়া গামছা ঘুরাইয়া বাতাস খাইতেছিল, তাহাদের মধ্যে একজন অনুনয়ের কণ্ঠে চিন্তাকে বলিল,-
বেন, আমাদের এক গণ্ডূষ জল দাও না–বড় তেষ্টা পেয়েছে।
কান্তিলাল শুনিতে পাইয়া লাফাইয়া উঠিল—
কি বললি—তেষ্টা পেয়েছে? নবাবের নাতি সব! উৎরাই-পথে ডুলি নামিয়েছিস তাতেই তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। নে চল-ডুলি কাঁধে নে
গোকুলদাস ইতিমধ্যে ড়ুলির পর্দার অন্তরালে অদৃশ্য হইয়াছেন; ভিতর হইতে তীক্ষ্ণস্বর আসিল
ড়ুলি তোল—চাকা ডোববার আগে গদিতে পৌঁছানো চাই—গদিতে অনেক কাজ
চিন্তা দাঁড়াইয়া রহিল, ড়ুলি চলিয়া গেল। যতদূর দেখা গেল, ড়ুলির সহগামী কান্তিলাল ঘাড় ফিরাইয়া চিন্তার দিকে তাকাইতে লাগিল। তাহারা একটা বাঁকের মুখে অদৃশ্য হইয়া গেলে চিন্তা হাতের ঘটি রাখিয়া পূর্বস্থানে আসিল; কিছুক্ষণ শক্ত হইয়া থাকিবার পর একটা উষ্ণ নিশ্বাস ফেলিয়া টাকু তুলিয়া লইল। অস্ফুটস্বরে বলিল,–জানোয়ার সব। ঠগ জোচ্চোর ডাকাত
.
পাহাড়ের ভিতর দিয়া পথের যে-অংশটা গিয়াছে সেই পথ দিয়া এক তরুণ অশ্বারোহী নামিয়া আসিতেছে। অশ্বারোহীর নাম প্রতাপ সিং, তাহার পরিধানে যোধপুরী পায়জামা ও বড় বড় পকেটযুক্ত ফৌজী কুর্তা, পিঠে একনলা গাদা বন্দুক ঝুলিতেছে। প্রতাপ শিকারে বাহির হইয়াছিল; পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে জঙ্গল আছে। তাহাতে হরিণ ময়ুর খরগোশ পাওয়া যায়। কিন্তু আজ শিকারীর ভাগ্যে কিছুই জোটে নাই, প্রতাপ রিক্ত হস্তে ফিরিতেছিল।
ঘোড়াটি স্বচ্ছন্দ-মন্থরপদে চলিয়াছে। একস্থানে পথ দ্বিধাবিভক্ত হইয়া গিয়াছে, এইখানে পৌঁছিয়া প্রতাপ বলগা টানিয়া ঘোড়া দাঁড় করাইল, চোখের উপর করতল রাখিয়া নিম্নে উপত্যকার দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিল। এখান হইতে প্রতাপের বাসস্থান ক্ষুদ্র শহরটি ধোঁয়াটে বাতাবরণের ভিতর দিয়া দেখা যায়। এখনও অনেক দূর-ঘোড়ার পিঠে এক ঘণ্টার পথ।
এই সময়ে প্রতাপের পকেটের মধ্যে চিঁ চিঁ শব্দ হইল। প্রতাপ প্রথম একটু চমকিত হইয়া তারপর মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। পকেটের উপর সন্তর্পণে হাত বুলাইয়া বলিল,–
আহা বেচারা। খিদে পেয়েছে বুঝি? আর একটু চুপ করে থাক, আস্তানায় পৌঁছুতে আর দেরি নেই। আমারও তেষ্টা পেয়েছে। মোতি, চল বেটা
বলগার ইঙ্গিত পাইয়া মোতি নিম্নাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করিল। এবার তাহার গতি অপেক্ষাকৃত দ্রুত।
চিন্তা পূর্ববৎ বসিয়া সুতা কাটিতেছে, দূর হইতে অশ্বক্ষুরধ্বনি তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল। চকিতে মুখ তুলিয়া চিন্তা উৎকর্ণভাবে শুনিল, ক্ষুরধ্বনি কাছে আসিতেছে। শুনিতে শুনিতে তাহার বিষণ্ণ মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। মোতির ক্ষুরধ্বনিতে হয়তো পরিচিত কোনও বিশিষ্টতা ছিল, চিন্তা চিনিতে পারিল কে আসিতেছে। সে দ্রুত বেশবাস সংবরণপূর্বক মুখখানি বেশ গম্ভীর করিয়া আবার তকলি কাটিতে লাগিল।
অল্পক্ষণ মধ্যেই প্রতাপ প্রপার সম্মুখ উপস্থিত হইয়া রাশ টানিল, ঘোড়ার পিঠ হইতে লাফাইয়া অবতরণপূর্বক চিন্তার দিকে চাহিল, দেখিল চিন্তার পরম মনোযোগের সহিত তকলি কাটিয়া চলিয়াছে, পথিকসুজন যে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে সেদিকে লক্ষ্যই নাই। প্রতাপের মুখে একটু চাপা হাসি খেলিয়া গেল, সে মোতির বলগা ছাড়িয়া দিয়া চিন্তার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, বন্দুকটা কাঁধ হইতে নামাইয়া রাখিয়া গূঢ়-কৌতুকে তাহার সুতাকাটা নিরীক্ষণ করিল, তারপর পরম সম্ভ্রমভরে হাত জোড় করিয়া বলিল,-
প্রপাপালিকে, পরিশ্রান্ত এবং পিপাসার্ত পথিক একটু জল পেতে পারে কি?
চোখাচোখি হইলেই আর হাসি চাপা যাইবে না, তাই চোখ না তুলিয়া ক্ষিপ্রহস্তে সুতা কাটিতে কাটিতে বলিল,-
পরিশ্রান্ত এবং পিপাসার্ত পথিক, পিপাসা নিবারণের আগে এইখানে বসে খানিক বিশ্রাম কর।
এই বলিয়া সে একটু সরিয়া বসিল, যেন ইঙ্গিতে নিজের পাশে প্রতাপের বসিবার স্থান নির্দেশ করিয়া দিল। প্রতাপ দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহার পাশে গিয়া বসিল, মহা আড়ম্বরে হস্ত প্রসারণ করিয়া বলিল,–
ভদ্রে, তোমার সুমধুর ব্যবহারে আমার ক্লান্তি আপনি দুর হয়েছে— তৃষ্ণাও আর নেই। তোমার অধর-সুধা পান করে—
চিন্তা ভ্রূভঙ্গি করিয়া তাহার পানে তাকাইল।
—অর্থাৎ তোমার অধরক্ষরিত বাক্যসুধা পান করে আমার তৃষ্ণা নিবারণ হয়েছে, জলের আর প্রয়োজন নেই।
চিন্তা বলিল,–প্রয়োজন আছে বৈ কি। মাথায় জল না ঢাললে তোমার মাথা ঠাণ্ডা হবে না।
উভয়ের মিলিত উচ্চহাস্যে অভিনয়ের মুখোশ খসিয়া পড়িল। প্রতাপ হাত ধরিয়া চিন্তাকে কাছে টানিয়া লইল, তারপর গাঢ়স্বরে বলিল,-
চিন্তা, এস বিয়ে করি— আর ভাল লাগছে না। শিকারের ছুতোয় এসে দুদণ্ডের জন্যে চোখে দেখা— একি ভাল লাগে? বল একটিবার মুখের কথা বল, কালই আমি তোমাকে ডুলিতে তুলে ঘরে নিয়ে যাব।
চিন্তার চোখ দুটি চাপা বাষ্পোচ্ছ্বাসে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। এই প্রস্তাবটিই সে অনেকদিন হইতে আকাঙক্ষা করিতেছিল, আবার মনের কোণে একটু আশঙ্কাও ছিল। সে ক্ষণেক চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল,-
তুমি গণ্যমান্য লোক—পরপের মেয়েকে বিয়ে করবে?
প্রতাপ বলিল,—আমি রাজপুত, তুমি রাজপুতের মেয়ে— এর বেশী আর কি চাই? আমি মাকে বলেছি, তিনি খুব খুশি হয়ে রাজি হয়েছেন।
চিন্তা বলিল,-লোকে কিন্তু ছি ছি করবে।
করুক— লোকের কথায় কি আসে যায়? তোমার মন আছে কিনা তাই বল।–চিন্তা, আমার ঘরে যেতে তোমার ইচ্ছে করে না?
চিন্তার চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। কত ইচ্ছা করে তাহা সে কি করিয়া বুঝাইবে? সে স্খলিতস্বরে বলিল,-
করে
প্রতাপ আবেগভরে চিন্তার স্কন্ধে বাহু দিয়া জড়াইয়া তাহাকে কাছে আকর্ষণ করিল,
ব্যস্— আর কিছুই চাই না
প্রতাপের পকেটের মধ্যে সম্ভবত দুই জনের দেহের চাপ পাইয়া অতি ক্ষীণ চিচি শব্দ উত্থিত হইল। প্রতাপের কণ্ঠোদগত আনন্দ-বিহ্বলতা আর শেষ হইতে পাইল না! সে থামিয়া গেল; তারপর উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল—
আরে— ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এই নাও তোমার জন্যে সওগাত এনেছি।
সুপরিসর পকেট হইতে প্রতাপ সন্তর্পণে দুইটি কপোত-শিশু বাহির করিল। কৃষ্ণবর্ণ বনকপোতের শাবক, এখনও ভাল করিয়া পালক গজায় নাই; চিন্তা সাগ্রহে তাহাদের হাতে তুলিয়া লইয়া উচ্ছসিত কণ্ঠে বলিল,-
কী সুন্দর পায়রার ছানা, আমি পুষব।—কোথায় পেলে এদের?
কোথায় আবার গাছের মগডালে বাসার মধ্যে বসেছিল, তুলে নিয়ে এলাম।
অ্যাঁ-মায়ের বাছাদের বাসা থেকে কেড়ে নিয়ে এলে?
কি করি? দেখলাম একটা বাজপাখি ওদের বাসা ঘিরে উড়ছে, ওদের মা বাপ প্রাণের ভয়ে পালিয়েছে। শেষে বাজের পেটে যাবে, তাই পকেটে করে নিয়ে এসেছি।
চিন্তা ছানা দুটিকে বুকের কাছে চাপিয়া ধরিল। অত্যাচারী পৃথিবীর উপর তাহার অভিমান স্ফুরিত হইয়া উঠিল—
কি হিংস্র নিষ্ঠুর সবাই। ডাকাত-ডাকাত সব।
সে কি আমিও ডাকাত হলাম?
হাঁ, তুমিও ডাকাত।
প্রতাপ ঈষৎ হাসিল! বলিল,–
আমি যদি ডাকাত হতাম চিন্তা, তাহলে আগে তোমাকে হরণ করে নিয়ে যেতাম।
উৎফুল্লনেত্রে চিন্তা প্রতাপের পানে চাহিল।
নিয়ে গেলে না কেন? আমি তোমাকে আঁচড়ে দিতাম, কামড়ে দিতাম, তারপর যেতাম
চিন্তা প্রণয়ভঙ্গুর হাসিল। প্রতাপ আঙুল দিয়া তাহার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া চোখের মধ্যে চাহিল। রাজপুতের মেয়ে, হরণ করে নিয়ে না গেলে বিয়ে করেও সুখ হয় না। বেশ, তাই হবে। কাল লোকলস্কর নিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে এসে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে যাব। কেমন, তাহাতে মন ভরবে তো?
দুজনে উদ্বেল আনন্দভরে পরস্পর মুখের পানে চাহিয়া রহিল।
.
প্রায় সায়ংকাল। অবসন্ন সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা পশ্চিম দিঙমণ্ডলকে অরুণায়িত করিয়াছে।
শহরের এক অংশ; বঙ্কিম সঙ্কীর্ণ পথ দুর্গম নির্জন। এইখানে প্রতাপের প্রাচীন পৈতৃক বাসভবন। সম্মুখে একটি সিংদরজা আছে, ভিতরে খানিকটা মুক্ত স্থান। বাড়িটি আকারে বৃহৎ, কিন্তু বহুদিন সংস্কারের অভাবে কিছু জীর্ণ ও শ্রীহীন হইয়া পড়িয়াছে।
বাড়ির সাবেক ভৃত্য লছমন উঠানের চিকু গাছতলায় শয়ন করিয়া বোধকরি ঘুমাইতেছিল; সে বৃদ্ধ হইয়াছে, ঘুমাইবার সময়-অসময় নাই। প্রতাপের বিধবা মাতা অস্থিরভাবে বার বার বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইতেছেন এবং আবার ভিতরে প্রবেশ করিতেছেন। তিনি ঈষৎ স্থূল কলেবরা; দেহের মাংস অকালে লোল হইয়া গিয়াছে। তাঁহার হৃদযন্ত্র অতিশয় দুর্বল, মনটিও উদ্বেগপ্রবণ, সহজেই উৎকণ্ঠিত হইয়া ওঠে। বিশেষত আজ তাঁহার উৎকণ্ঠার গুরুতর কারণ ঘটিয়াছে।
তিনি বারান্দায় আসিয়া উদ্বিগ্নকণ্ঠে ডাকিলেন,
লছমনভাই, ও লছমনভাই, এই ভর-সন্ধ্যেবেলা তুমি ঘুমুলে?
লছমন চেটাইয়ের উপর উঠিয়া বসিল।
ঘুমোব কেন বাঈ, ঘুমোব কেন— একটু গড়াচ্ছিলাম।
সুয্যি পাটে বসতে চলল, এখনও প্রতাপ ফিরল না লছমনভাই।
লছমন চিকু তলা হইতে উঠিয়া আসিল। বলিল,–
ফিরবে বৈ কি বাঈ, ফিরবে বৈ কি। তোমার জোয়ান ছেলে শিকারে বেরিয়েছে, ফিরবে বৈ কি। সেকালে কর্তারা শিকারে বেরুতো, তা রাত দুপুরের আগে কেউ ফিরতো না। কথায় বলে শিকরে বাজ আর প্যাঁচা দুইই শিকারী— কেউ দিনে কেউ রাত্তিরে।
মা কানের কাছে হাত তুলিয়া উৎকৰ্ণভাবে কিছুক্ষণ শুনিলেন।
ঐ বুঝি প্রতাপ এল, মোতির ক্ষুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি
আসবে বৈ কি বাঈ, আসবে বৈ কি।
বাহিরে প্রতাপের গৃহের সিংদরজা। সিংদরজার থামে একটুকরা কাগজ লটকানো রহিয়াছে।
প্রতাপকে পিঠে লইয়া মোতি হাঁটা-পথে আসিয়া সিংদরজায় প্রবেশ করিল; এই সময় কাগজের টুকরার উপর প্রতাপের নজর পড়িলে সে ঘোড়া থামাইয়া হাত বাড়াইয়া কাগজের টুকরা তুলিয়া লইল; ভ্রূ ঈষৎ তুলিয়া কাগজের লেখা পড়িতে লাগিল।
বারান্দায় দাঁড়াইয়া মা প্রতাপকে দেখিতে পাইয়াছিলেন, তিনি দুহাতে বুক চাপিয়া উদ্বেগভরা মুখে প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন। তাঁহার দুর্বল হৃদযন্ত্র অত্যন্ত দ্রুত স্পন্দিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে।
কাগজের লেখা পাঠ করিয়া প্রতাপ তাচ্ছিল্যভরে সেটা মুঠির মধ্যে গোলা পাকাইয়া লইল; তারপর অঙ্গনে প্রবেশ করিয়া লাফাইয়া মোতির পিঠ হইতে নামিয়া লছমনের হাতে রাশ ফেলিয়া দিল। লছমনকে বলিল,-
লছমনভাই, মোতিকে দানা-পানি দাও।
দেব বৈ কি ভাই, দেব বৈ কি। আজ বুঝি শিকার কিছু পেলে না?
পেয়েছি— পরে বলব।
হাসিয়া পিঠ হইতে বন্দুক নামাইতে নামাইতে প্রতাপ বারান্দায় গিয়া উঠিল। বারান্দার দেয়ালে পাশাপাশি দুটি খোঁটা পোঁতা ছিল, তাহার উপর বন্দুক রাখিয়া দিয়া প্রতাপ মার দিকে ফিরিল।
মা উদ্বিগ্নস্বরে বলিলেন,-প্রতাপ, চিঠি পড়লি?
প্রতাপ তাচ্ছিল্যভরে বলিল,-চিঠি? ও শেঠ গোকুলদাসের রোকা! ও কিছু নয়।
মা বলিলেন,-না না বাবা, তুই গোকুলদাসের চিঠি তুচ্ছ করিস নে! গোকুলদাস বড় ভয়ানক সাহুকার–কত লোকের সর্বনাশ করেছে তার ঠিক নেই
প্রতাপ এক হাতে মায়ের স্কন্ধ জড়াইয়া লইল, বলিল,–
তুমি ভয় পাচ্ছ কেন মা? বাবা তো মাত্র পাঁচশো টাকা ধার করেছিলেন যখন ইচ্ছে শোধ করে দেব।
মা বলিলেন,—ওরে না না, গোকুলদাস নিজে এসে চিঠি টাঙিয়ে গেছে, আর শাসিয়ে গেছে সুদে-আসলে তার দশ হাজার টাকা পাওনা হয়েছে; আজই নাকি মেয়াদের শেষ দিন; যদি শোধ না হয়, তোর জমি-জমা বাড়ি-ঘর সব বাজেয়াপ্ত করে নেবে।
তিনি আবার নিজের স্পন্দমান বুক চাপিয়া ধরিলেন। প্রতাপ তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়া সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল,
সে কী। পাঁচশো টাকা দশ হাজার টাকা হবে কি করে?
লছমন তখনও মোতিকে আস্তাবলে লইয়া যায় নাই, অঙ্গনে দাঁড়াইয়া মাতা-পুত্রের কথা। শুনিতেছিল; সে উত্তর দিল,-
হয় বৈ কি ভাই, হয় বৈ কি। মহাজনের সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে কিনা।
প্রতাপ হতবুদ্ধিভাবে বলিল, মহাজনের সুদ–হ্যাঁ— কিন্তু এ যে অসম্ভব। দশ হাজার টাকা…আমি এখনই যাচ্ছি গোকুলদাসের কাছে নিশ্চয় তোমাদের বুঝতে ভুল হয়েছে—
প্রতাপ ত্বরিতে গিয়া আবার ঘোড়ার পিঠে উঠিল, ঘোড়ার মুখ বাহিরের দিকে ফিরাইয়া বলিল,–মা, তুমি ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সে বাহির হইয়া গেল।
.
প্রাচীরবেষ্টিত চতুষ্কোণ-ভূমির উপর শেঠ গোকুলদাসের দ্বিতল প্রাসাদ। সম্মুখে লৌহকবাটযুক্ত সিংদরজা; দুইজন তকমাধারী সান্ত্রী সেখানে পাহারা দিতেছে।
বাড়ির দ্বিতলের একটি জানালা খোলা রহিয়াছে। জানালার কবাট লৌহময় কিন্তু গরাদ নাই; সুতরাং এই পথে আমরা গোকুলদাসের তোশাখানায় প্রবেশ করিতে পারি।
তোশাখানা ঘরটি ঈষদন্ধকার; একটি মাত্র দরজা ও একটি জানালা আছে। দরজার দুই পাশে দুটি গাদা পিস্তল দেয়ালে আটকানো রহিয়াছে। গোকুলদাস ধর্মে জৈন কিন্তু নিজের ঐশ্বর্য রক্ষার জন্য তিনি যে প্রাণীহত্যায় পরাঙ্মুখ নয়, পিস্তল দুটি তাহারই সাক্ষ্য দিতেছে।
ঘরের চারিটি দেয়াল জুড়িয়া সারি সারি লোহার সিন্দুক। ঘরের মাঝখানে মোটা গদির উপর হিসাবের বহি খাতা ও একটি কাঠের হাত বাক্স।
গোকুলদাস ঘরেই আছেন। প্রকাণ্ড চাবির থোলো হইতে একটি চাবি বাছিয়া লইয়া তিনি সিন্দুকের ছিদ্রমুখে প্রবেশ করাইয়া দিলেন, তারপর সতর্কভাবে দ্বারের দিকে একবার তাকাইয়া চাবি ঘুরাইলেন।
সিন্দুকের কবাট খুলিলে দেখা গেল, তাহার থাকে থাকে অসংখ্য সোনা ও জহরতের গহনা সাজানো রহিয়াছে, তাছাড়া মোটা মোটা মোহরের থলি ও মূল্যবান দলিলপত্র আছে। গোকুলদাস সন্তর্পণে একটি জড়োয়া-হার তুলিয়া লইয়া সতৃষ্ণভাবে সেটি দেখিতে লাগিলেন। কাবুলি মটরের মত কয়েকটা হীরা স্বল্পালোকেও ঝলমল করিতে লাগিল। গোকুলদাসের কন্ঠ হইতে একটি লুব্ধ ঘুৎকার বাহির হইল।
এই সময় নিঃশব্দে দ্বার ঠেলিয়া একটি যুবতী ঘরে প্রবেশ করিল। চম্পা গোকুলদাসের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। গোলগাল গড়ন, মিষ্ট ছেলেমানুষী ভরা মুখে, সে পা টিপিয়া টিপিয়া গোকুলদাসের পিছনে গিয়া সিন্দুকের মধ্যে উঁকি মারিল; যাহা দেখিল তাহাতে তাহার মুখ দিয়া হর্ষোল্লাসসূচক শীৎকার বাহির হইল। স্বামীর সিন্দুকের অভ্যন্তরভাগ সে আগে কখনও দেখে নাই।
পলকমধ্যে গোকুলদাস সিন্দুকের কবাট বন্ধ করিয়া সিন্দুকে পিঠ দিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, যেন কোণ-নেওয়া বিড়াল। কিন্তু চম্পাকে দেখিয়া তাঁহার ভয় দূর হইল। তিনি বলিলেন,
ও চম্পা। আমি ভেবেছিলাম—
চম্পা হাসিয়া বলিল,—ডাকাত?
হীরার হারটি গোকুলদাসের হাতেই রহিয়া গিয়াছিল, এখন তিনি আবার সিন্দুক খুলিয়া উহা ভিতরে রাখিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
চম্পা লুব্ধস্বরে বলিল,-ওটা কি, দেখি দেখি। উঃ, কী সুন্দর হার।
চম্পা হারটি লইবার জন্য হাত বাড়াইয়াছিল, গোকুলদাস তাড়াতাড়ি উহা সরাইয়া লইলেন। বলিলেন,-
আরে না না, এতে হাত দিও না।
চম্পা বলিল,–কেন দেব না? আমি তোমার বৈরী কি না? তৃতীয় পক্ষের বৈরী কি বৈরী নয়? তবে আমি তোমার জিনিসে হাত দেব না কেন?
সংসারপ্রাজ্ঞ গুজরাতি স্ত্রীকে বৈরী বলিয়া থাকেন।
গোকুলদাস হার সিন্দুকের মধ্যে বন্ধ করিয়া চাবির গোছা কোমরে ঝুলাইলেন। বলিলেন,–
আহা, বুঝলে না চম্পা, ওটা এখনও আমার হয়নি বন্ধকী মাল। তবে একবার যখন আমার সিন্দুকে ঢুকেছে তখন আর বেরুচ্ছে না!
গোকুলদাস হুঁ হুঁ করিয়া হাসিলেন। চম্পা একটু বিমনাভাবে স্বামীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল।
এই সিন্দুকগুলোকে তুমি বড্ড ভালবাস না?
গোকুলদাস উত্তরে কেবল আনুনাসিক হাসিলেন।
এর সিকির সিকি যদি বৌদের ভালবাসতে তাহলে তারা হয়তো সুখী হত।
গোকুলদাস ক্ষুদ্র ইন্দুর-চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া চাহিলেন।
কেন, আমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে তুমি সুখী হওনি?
চম্পা মুখে একটা ভঙ্গি করিয়া হাসিয়া উঠিল।
ওমা, হইনি আবার। তোমার মত মানুষ দেশে আর কটা আছে? দেশসুদ্ধ লোক তোমার ভয়ে কাঁপে, স্বয়ং রাজা তোমার খাতক! তোমাকে বিয়ে করে সুখী হইনি এমন কথা কে বলে!– নাও চল এখন, খাবার বেড়ে রেখে এসেছি এতক্ষণে বোধহয় সূর্য ড়ুবল।
জৈনগণ সূর্যাস্তের পূর্বেই নৈশ আহার সমাধা করেন।
এই সময় বাহিরের জানালার নীচে হইতে গণ্ডগোলের আওয়াজ আসিল। চম্পা দ্রুত জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল, গোকুলদাস তাহার পশ্চাতে গিয়া সতর্কভাবে উঁকি মারিলেন।
নীচে সিংদরজার বাহিরে অশ্বারূঢ় প্রতাপের সহিত দ্বাররক্ষী সান্ত্রীদের বচসা আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। সান্ত্রীদ্বয় সিংদরজা আগলাইয়া দাঁড়াইয়াছে, প্রতাপকে প্রবেশ করিতে দিতেছে না।
প্রতাপ বলিতেছে-শেঠের সঙ্গে এখনি আমার দেখা না করলেই নয়
সান্ত্রী বলিল,-শেঠ এ সময় কারুর সঙ্গে দেখা করে না। যাও–কাল সকালে এস।
কিন্তু আজ আমাকে দেখা করতেই হবে বড় জরুরী দরকার
চম্পা জানালায় গোকুলদাসের দিকে ফিরিল।
হাঁগা, কে ও নওজোয়ান? ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছে কেন?
গোকুলদাস বলিলেন,-চুপ–আস্তে। ও একটা রাজপুত আমার খাতক। বোধ হয় টাল শোধ দিতে এসেছে
তাহলে?
চুপ—তুমি ওসব বুঝবে না।
নীচে সান্ত্রীরা লোহার কাট বন্ধ করিয়া দিতেছে।
প্রতাপ বলিল,–আজ কিছুতেই দেখা হবে না?
সান্ত্রী বলিল,-না, আজ রাজা এলেও দেখা হবে না।
ক্রুদ্ধ-হতাশ-চক্ষু ঊর্ধ্বে তুলিতেই জানালার উপর প্রতাপের দৃষ্টি পড়িল। গোকুলদাস ঝটিতি জানালা বন্ধ করিয়া দিলেন। প্রতাপ কিছুক্ষণ বিস্ফারিত নেত্রে সেই দিকে চাহিয়া রহিল, তার ক্রোধতপ্ত একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ঘোড়ার মুখ ফিরাইল।