Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মধুরঙ্গ || Ashutosh Mukhopadhyay

মধুরঙ্গ || Ashutosh Mukhopadhyay

মধু রঙ্গনাথনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ছাব্বিশ-সাতাস বছর আগে। তার বয়স তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ, আমারও তাই। ট্রেনে কলকাতা থেকে বম্বে যাচ্ছিলাম। আমার একটা গল্প ছবি করার ব্যাপারে সেখানে গরম তোড়জোড় চলছিল। বাংলা গল্পের হিন্দি ছবি হবে। হামেশাই হয়। কিন্তু সেই উঠতি বয়সে অমন ভাগ্য দুর্লভ মনে হয়েছিল। তাই মনে আনন্দ ছিল। ভিতরে বেশ একটু উত্তেজনাও ছিল। গল্পের কাঠামো একটু-আধটু অদল-বদল করার ব্যাপারে খোদ পরিচালকের টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটেছি। পরের পয়সায় ফার্স্ট ক্লাসে তোফা আরামে যাচ্ছিলাম।

সেই সময় সামনের বার্থের একটি সমবয়সী অবাঙালী ছেলে আমার চোখ টেনেছিল। ছিপছিপে বেঁটে-খাট গড়ন, গায়ের রঙ কালোই বলা যায়। সে-ও আমার মতোই নিঃসঙ্গ যাত্রী, কিন্তু যতবার চোখাচোখি হয়েছে, দেখি অস্বাভাবিক গম্ভীর। অথচ ওই মুখের আদল কেমন যেন চেনা-চেনা ঠেকছিল আমার। ১৪৮

আলাপের চেষ্টায় এগিয়েছিলাম, কিন্তু লোকটা ভয়ানক নির্লিপ্ত আর নিরুত্তাপ। সে-ও বম্বে যাচ্ছে শুনে আমি একটু উৎসাহ বোধ করেছিলাম, কিন্তু তার ঠাণ্ডা হাবভাব দেখে সেটা বেশিক্ষণ থাকল না। ভাবলাম আমি পরের পয়সায় কায়দা করে ফার্স্ট ক্লাসে চলেছি, এ হয়তো পয়সাঅলা কোন বড়লোকের ছেলে হবে, সেই দেমাকে এত গম্ভীর। অতএব আমিও বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত নিস্পৃহ থাকতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু যতবার তার দিকে চোখ গেছে ততবার মনে হয়েছে এই মুখ আমি কোথাও দেখেছি।

একবার ও নিজের ছোট সুটকেসটা টেনে এনে খোলার মুখে ডালার ওপর লেবেল আঁটা নাম চোখে পড়ল–মধুরঙ্গ। এই নাম দেখে কোন দেশের বা কোন জাতের মানুষ ঠাওর করা গেল না। কিন্তু সুটকেস থেকে যে বস্তুটা বার করল, দেখে আমার চক্ষুস্থির। লম্বাটে ধরনের এক বাণ্ডিল বিড়ি। কোন ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জারের মুখে বিড়ি দেখব এটা তখন কল্পনার বাইরে। একটা বিড়ি নিজের ঠোঁটে ঝোলাল। আমাকে চেয়ে থাকতে দেখে ড্যাবড্যাব করে সেও খানিক চেয়ে রইল। তারপর ইংরেজিতে মন্তব্য করল–ফাইন স্টাফ, চলবে?

আমি হকচকিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালাম। অতি সাধারণ একটা লাইটার জ্বালিয়ে সে আমার বিড়ি ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা ধরাল। তারপর মস্ত একটা তৃপ্তির টান।

আমাদের কাণ্ড দেখে কামরার অপর দুই প্রায়-বৃদ্ধ দম্পতি অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

সাধারণ বিড়ি, আকারে একটু বড়, এমন কিছু ফাইন স্টাফ বলে আমার মনে হল না। কিন্তু ঐ লোকটা খুব মৌজ করে টানছে। আধাআধি শেষ করে আমার দিকে ফিরল আবার। তেমনি নির্লিপ্ত মন্তব্য করল, খুব সস্তা বলে এ জিনিসটা আরো ভালো। লাগে, একগাদা কিনে নিয়েছি।

ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীর মুখে এ-কথা শুনে একটু যেন ধাক্কাই খেলাম। বলে ফেললাম, শুধু সস্তা বলে বিড়ি খান, না কড়া জিনিসের লোভে?

জবাব দিল, চুরুট আরো কড়া, আরো বেশি ভালও লাগে, কিন্তু বেশি দাম–

হেসেই জিজ্ঞাসা করলাম, এত দূরের পথ ফার্স্ট ক্লাসে যাচ্ছেন অথচ বেশি দামের জন্য চুরুট কিনে খান না?

বিড়িতে শেষ টান দিয়ে সাদাসাপটা জবাব দিল, আমিও আপনার মতই ফোকটে ফার্স্ট ক্লাসে যাচ্ছি–নিজের পয়সায় থার্ড ক্লাসে যেতে হলে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হয়!

আমি হতভম্ব। ও ফোকটে মানে পরের পয়সায় যাচ্ছে সেটা নিজে বলল, কিন্তু আমি কার ঘাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছি সে তো আমার গায়ে লেখা নেই–জানল কি করে!

আমার বিস্ময় ওর নিস্পৃহ বিশ্লেষণের বস্তু যেন। নিজে থেকেই বলল, আপনি তো অমুক প্রযোজকের অমকু ছবির স্ক্রীপট-এর কাজে সাহায্য করতে যাচ্ছেন?

বিমূঢ় মুখে মাথা নাড়লাম।

কড়ে আঙ্গুলের ডগটা নিজের কানের গহ্বরে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘন-ঘন নাড়ল একপ্রস্থ। আয়েসে চোখ দুটো ছোট হয়ে এলো। তারপর রয়েসয়ে বলল, আমি বাংলা কথা-বার্তা মোটামুটি বুঝি, আপনাকে যারা তুলে দিতে এসেছিল তাদের আর আপনার কথা থেকেই জেনেছি কেন বম্বে যাচ্ছেন–আপনার ওই ছবিতে আমিও একটা রোল পাবার চেষ্টা করেছিলাম–হল না।

আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি ফিলম আর্টিস্ট?

মাথা নাড়ল।-আর্টিস্ট ঠিক না, ফিলম-ভাঁড় বলতে পারেন।

সুটকেসের লেবেলে নাম দেখেছি মধুরঙ্গ। এই নামের কোন কমিক অ্যাকটর স্মরণে আসছে না। অথচ মুখখানা চেনা-চেনা লাগছে। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি শেষ কোন ছবিতে কাজ করেছেন?

বলল– আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আমার। হ্যাঁ, হাঁড়ি-মুখো এক কিশোর জবর হাসিয়েছিল বটে এই ছবিটাতে। আর্টিস্ট-এর নামটাও মনে পড়ে গেল তখুনি।

শুধোলাম, আপনার নাম কি?

–মধু রঙ্গনাথন। ছেঁটে সেটাকে মধুরঙ্গ করেছি। ফিল্মের নাম ভিন্ন।

সেই ভিন্ন নাম আজ সুপরিচিত। আর সেই কারণেই নামটা অনুক্ত থাক।

ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে সেই দুদিনের যাত্রাপথে মধু রঙ্গনাথন আমার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল। সেই বন্ধুত্ব দিনে দিনে বেড়েছে। বম্বেতে সেই প্রথমবারে পৌঁছেও বড়লোকের আতিথ্য ছেড়ে ওর একখানা ঘরেরই ভাগীদার হয়েছিলাম। আর আমার সক্রিয় চেষ্টার ফলে পরিচিত ডিরেক্টার ভদ্রলোক প্রযোজককে বলে ওর একটা রোলের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন।

ট্রেনের দুদিনের সান্নিধ্যেই আমার মনে হয়েছিল, মধু রঙ্গনাথন একদিন বড় আর্টিস্ট হবে। কারণ দুদিনের মধ্যে দুবারও ওকে আমি হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অথচ ওর কথা শুনে আমি এক-একবার অট্টহাস্য করে উঠেছি। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ওর গাম্ভীর্যটা এতটুকু কৃত্রিম মনে হয়নি কখনো। যেন সত্যি ভাবলেশশূন্য পটের মূর্তি একখানা।

ওকে জিজ্ঞাসা করেছি, ছবিতে না হয় না-ই হাসলে, বাইরেও অত গাম্ভীর্য কেন?

মধু জবাব দিয়েছে। কোনটা হাসির ব্যাপার আর কোনটা নয় সেটা যাচাই করার ফাঁকেই হাসির সময়টা উৎরে যায়। তাছাড়া এক-এক সময় হাসি, যখন কেউ হাসে না তখন জোরে হেসে উঠি।

-কেন?

–তাতে অন্য লোকের আমাকে বোকা ভাবতে সুবিধে হয়। তারা হাসে।

ট্রেনের সেই দীর্ঘ দুদিনের অবকাশে অনেক মনের কথা আর মজার করা বলেছে। মধু রঙ্গনাথন। যত শুনেছি তত আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি।

…বিয়ে করেছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ও বলেছিল, এবারে কলকাতায় আসার আগেও বাবা তার একজন গেলাসের বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। বাবা তার সঙ্গে থাকে না, অন্যত্র থাকে, আর সূয্যি ডুবলেই মদ নিয়ে বসে। নেশার ঘোরে সেদিন ওর ঘরে এসে গর্জন করে বলল, তোর বউ দরকার, একটা বউ এনে দিচ্ছি।

ছেলে সায় দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, তা তো দরকার…কিন্তু কার বউ আনবে? শুনে ওর বাবাও নাকি চিন্তায় পড়ে গেছে, বলেছে, তাই তো, কার বউয়ের দিকে আবার হাত বাড়াতে যাব!

…কলেজে পড়তে সমবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নাকি পাগল হয়ে উঠেছিল মধু। শেষ পর্যন্ত সেই মেয়ের ওপর চড়াও হয়ে একদিন আবেদন জানাল, কি বললে তুমি বিশ্বাস করবে আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে বিয়ে করতে চাই?

মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে সেই মেয়ে নাকি জবাব দিয়েছে, মোটে তিনটে কথা বললে!

–কি কথা? কি তিনটে কথা? মধু আশান্বিত।

–এক লক্ষ টাকা।

মধু লম্বা লাফ মেরে পালিয়েছে।

…হয়তো বানানো গল্প সব। শুনে আমি হেসে অস্থির। কিন্তু ওর মুখে হাসি দেখিনি।

বর্তমানের মনের কথাও বলেছে। একটা মেয়েকে ভয়ানক ভালবাসে। ওখানকারই মেয়ে। তার বাপ য়ুনিভার্সিটির প্রোফেসার মেয়ের নাম দুর্গা। সে-ও য়ুনিভার্সিটিতে পড়ছে। ভালো ছাত্রী। কিন্তু মধুর থেকেও গম্ভীর নাকি। বিয়ের কথা একবার বলতে এমন তাকিয়েছিল যে মধুর জমে যাওয়ার দাখিল। অনেক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়া ওদের, সেই সুবাদে ছেলেবেলা থেকে জানাশুনা। মধুর সাফ সিদ্ধান্ত, দুর্গাকে হয়। বিয়ে করবে নয়তো খুন করবে। ওর মতে দুর্গা ভয়ানক অবুঝ মেয়ে, ওর জন্যই বেশি টাকা রোজগারের আশায় মধু ফিল্মে নেমেছে, মেয়ে কোথায় খুশি হবে তা না, উল্টে রাগে ফুটছে!

এ-গল্পও খুব যে বিশ্বাস করেছিলাম এমন নয়। কিন্তু বেড়াতে বেড়াতে একদিন ও আমাকে দুর্গার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির। তখনো ওর মতলব বুঝিনি। দুর্গাকে ডেকে বাংলা দেশের মস্ত লেখক বলে পরিচয় দিল আমার। আমার পরিচয় বড় করে তুলে নিজের কদর বাড়াতে চায় বোধহয়। কিন্তু বাংলা দেশের মস্ত লেখকের প্রতি দুর্গার তেমন আগ্রহ আছে মনে হল না। তবে মার্জিত রুচির মেয়ে, অভদ্রতাও করল না। সুন্দরী কিছু নয়, বেশ স্বাস্থ্যবতী সুশ্রী মেয়ে।

পরের চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আরো বারতিনেক বম্বেতে এসেছি। মধুও আর একবার কলকাতায় আমার অতিথি হয়ে এসেছিল। কমিক অ্যাক্টর হিসেবে তখন মোটামুটি নাম হয়েছে ওর! আর আমার সঙ্গে বন্ধুত্বও গাঢ় হয়েছে। কিন্তু মধু রঙ্গনাথনের হাবভাব কথাবার্তা সেই একরকমই আছে। দুর্গার জন্য ওর হা-হুঁতাশ বেড়েছে। দুর্গা এখন কলেজের মাস্টার, ওর দিকে ভালো করে ফিরেও তাকাতে চায়

ফেরাবার চেষ্টা করলেও রেগে আগুন হয়। মধু রঙ্গনাথনের সুখশান্তি সব গেল। দুর্গাকে খুন করার সময় এগিয়ে আসছে কিনা এখন সেই চিন্তা করছে।

এর দুমাসের মধ্যে বম্বে থেকে মধুর উচ্ছ্বাসভরা চিঠি পেলাম, দুর্গাকে খুন করতে পেরেছে, অর্থাৎ বিয়ে করে ঘরে আনতে পেরেছে। সেই প্রহসন শুনলে বন্ধু (অর্থাৎ আমি) নিশ্চয় চমৎকৃত হবে। কিন্তু বিয়ে করার পর দুর্গারই উল্টে খুনী মেজাজ এখন। সকাল বিকেল দুপুর রাত্তিরে মুখ দিয়ে নয়তো চোখ দিয়ে ঝটাপেটা করে ছাড়ছে। কেবল মধুর একটু-আধটু শরীর-টরীর খারাপ হলে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বড় ডাক্তার ডাকে, অতএব মধু প্রাণপণে শরীর খারাপ করতেই চেষ্টা করছে।

এরপর বম্বেতে এসে ওদের অতিথি হয়েছি। সত্যিই ভালো লেগেছে। মধু রঙ্গনাথন সেইরকমই গম্ভীর প্রায়; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও যে আনন্দে ভাসছে তাও বোঝা যায়।

কি করে শেষ পর্যন্ত দুর্গাকে ঘরে আনা গেল, মধু একদিন চুপি চুপি তাও বলল আমাকে। শুনে আমি হাঁ। বিশ্বাস করব কি করব না ভেবে পেলাম না।

– বললাম, সত্যি বলছ কি বানিয়ে বলছ, দুর্গাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করব।

মধু আঁতকে উঠল।আমার পেশার দিব্বি কেটে বলছি, এক বর্ণও মিথ্যে বলিনি। –কিন্তু দুর্গাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে ও ঠিক ডিভোর্স করবে আমাকে!

বিশ্বাস করেছি। কিন্তু যতবার মনে পড়েছে প্রহসনটা, নিজের মনেই হেসে বাঁচি না। মধুর মাথা বটে একখানা–এমন কাণ্ড করেও কাউকে বিয়ে করে ঘরে টেনে আনা যায়!

…দুর্গাকে বিয়ে করতে পারার এই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা আর একটু বাদে ব্যক্ত করব। কারণ ওই একই ব্যাপার থেকে মধু রঙ্গনাথন-এর জীবনের দুটো দিক দেখা গেছে। …একটা জীবনের দিক, অন্যটা জীবন-মৃত্যুর দিক।

বম্বে গেলে ওদের অতিথি হতাম। দুর্গা আমাকে আদরযত্ন করত। এই দীর্ঘকালের মধ্যে ওরাও যুগলে এসে কলকাতায় অনেকবার আমার বাড়িতে থেকে গেছে। সেই শুরু থেকে দেখে এসেছি, মধু রঙ্গনাথনকে দুর্গা কড়া শাসনে রাখে।

বেশি বাঁচালতা করলে অন্য লোকের সামনেই ধমকে ওঠে। দুর্গা কলেজের মাস্টারি ছাড়েনি, স্বামীটির ওপর সর্বদাই ওর মাস্টারি মেজাজ। আমার কেমন ধারণা, দুর্গার ওই কড়া শাসন মধুর ভালো লাগে, আর সেই কারণে ওর গম্ভীর বাঁচালতা বাড়ছে। বই কমেনি।

কমিক অ্যাক্টর হিসেবে তার দস্তুরমতো নামডাক তখন। কিন্তু তার ছবির ভাঁড়ামোও দুর্গার চক্ষুশূল যেন। ও ব্যাপারের মাত্রা ছাড়ালে সে দস্তুরমতো রাগারাগি করে! একবারের ঘটনায় বম্বেতেই উপস্থিত ছিলাম আমি। মধুর একটা ছবি তখন। হৈ-চৈ করে চলছে। আমিও দেখে এলাম। ওর রোল আর অভিনয় দেখে পেটে খিল ধরার দাখিল। এক বড়লোকের বাড়ির ড্রাইভারের ভূমিকা ওর। নির্লিপ্ত বোকা-মুখ করে বড়লোকের বাড়ির কেচ্ছা দেখে অভ্যস্ত। ঘরে তার বিষম রাগী আর ঝগড়াটে স্ত্রী এবং একটি বয়স্থা মেয়ে। মেয়ে রূপসী নয় আদৌ। অতএব মেয়ের মা পছন্দ মতো পত্র পায় না। মাথা খাঁটিয়ে মেয়ের মা একটা রাস্তা বার করল। মেয়েকে বলল, বক্স নম্বর দিয়ে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দে–তাতে লেখা থাকবে বড়লোকের ছাব্বিশ বছরের একটিমাত্র মেয়ের জন্য শিক্ষিত সুশ্রী এবং দিলদরিয়া মেজাজের পুরুষ সঙ্গী চাই। মেয়ের বিবাহ কাম্য নয়, অন্তরঙ্গ মেলামেশাটুকুই কাম্য।

মেয়ের মায়ের আশা, এই টোপে বড়লোকের যোগ্য ছেলেরা ছুটে আসবে, আর অন্তরঙ্গ মেলামেশার পরেও মেয়ে মায়ের সাহায্যে একজনকে গেঁথে তুলতে পারবেই।

বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। কিছুদিন বাদে মা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, বক্স নম্বরের বিজ্ঞাপনের জবাব আসছে না?

মেয়ে আমতা-আমতা করে জবাব দিল, একটা মাত্র এসেছে।

–কার কাছ থেকে? মা উদগ্রীব।

–সেটা একটু গোপনীয়, বলব না।

–হতচ্ছাড়ী মেয়ে, শীগগীর বল–কার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিস?

কাতর মুখ করে মেয়ে জবাব দিল, বাবার কাছ থেকে।

এরপর ওই দজ্জাল মায়ের হাতে বাবার হেনস্থা দেখে হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার উপক্রম।

এই ছবি দেখে দুর্গা নাকি মধুর সঙ্গে কুরুক্ষেত্র করে ছেড়েছে। দুর্গা নিজেই আমাকে বলেছে, ছবিতে নিজের ওই প্রহসন মধু নাকি নিজেই বানিয়ে নিয়েছে। –আসল গলায় ওর কোনো ভূমিকা ছিল না।

কিন্তু যতই কড়া মেজাজ হোক, স্বামীর প্রতি দুর্গার প্রচ্ছন্ন যত্নটুকুও আমি স্বচক্ষে দেখেছি। ও কম খেলে বা শরীর একটু খারাপ হলে বকা-ঝকার ভিতর দিয়েও ওর আসল দরদের মূর্তিটা আমার চোখ এড়ায় নি।

…গত বছর অর্থাৎওদের বিয়ের প্রায় বিশ বছর বাদে হঠাৎ একদিন খবর পেলাম মধু দুর্গাকে খুইয়েছে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে দুর্গা মারা গেছে।

শুনে মনটা কি যে খারাপ হয়েছিল নিজেই জানি। মধুকে দুতিনখানা চিঠি লিখেও জবাব পাইনি। মাস ছয় বাদে বম্বেতে খাবার আমার সুযোগ মিলল। এসেই ওর বাড়ি ছুটলাম। কিন্তু বাড়ি তালাবন্ধ, মধু নেই। কোথায় গেছে তাও কেউ বলতে পারল না। আজ চারমাস ধরে সে নাকি নি-পাত্তা। একসঙ্গে চার-পাঁচটি প্রযোজক ছবির মাঝখানে ওর জন্যে আটকে গিয়ে নাকি মাথায় হাত দিয়ে বসেছে।

আমার পরিচিত পরিচালক এবং আরো জনাকয়েকের মুখে ওর কথা শুনলাম। সকলেই বীতশ্রদ্ধ মধুর ওপর। কথায় কথায় পরিচালক বলল, ভাঁড়ের ভাড়ামীরও একটা সীমা আছে। বউ মরে যেতে সক্কলের সামনে শ্মশানে দাঁড়িয়ে পর্যন্ত মধু কি। করল জানেন? দুর্গাকে চিতায় শোয়ানো হয়েছে, আর মধু দুই চোখের জল ছেড়ে দিয়ে নিজের একটা হাতের উল্টোদিক মুখে ঠেকিয়ে চটচট শব্দ করে চুমু খেতে লাগল–যেন দুর্গাকেই ক্রমাগত চুমু খেয়ে চলেছে-তার চোখমুখের সে কি হাব-ভাব তখন। যারা ছিল তারা শোক করবে কি, হেসে সারা।

…হাতের উল্টোপিঠ মুখে ঠেকিয়ে শব্দ করে চুমু খাওয়ার একটা রহস্য আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তাই সকলে একটা ভঁড়ামী ভেবেছে।

…দুর্গাকে বিয়ে করতে পারার সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা এবারে ব্যক্ত করা যেতে পারে।

…মধুকে দুর্গা আমল দেবেই না। আর মধুও না-ছোড়। সেদিনের ঘটনা, সেই সকালেও নাকি দুর্গা দাবড়ানী দিয়ে মধুকে বাতিল করতে চেয়েছে, বলেছে, পুরুষকার থাকলে কোনো ছেলে ছবিতে ভাড়ামী করে না–সে একটি দুর্বল-চিত্ত অমানুষকে আবার বিয়ে!

সেই দুপুরেই একজন বান্ধবীর সঙ্গে দুর্গার দেড়শ-দুশ মাইল দূরে কোথায় যাবার কথা। মধুর হাতে কোনো কাজ নেই শুনে দুর্গার বাবা মধুকেই ওদের চলনদার ঠিক করে দিয়েছে। দুর্গার আপত্তি ছিল, কিন্তু এ-ব্যাপারে সোরগোল করে আপত্তি করতেও ওর রুচিতে বাধে। কিন্তু মধু সঙ্গে যাচ্ছে শুনে দুর্গার বান্ধবী মহাখুশি। সে আবার মধুর খুব ভক্ত।

ট্রেনের একটা খুপরিতে ওরা দুজন পাশাপাশি বসেছে, ওদের উল্টোদিকে মধু রঙ্গনাথন। দুর্গার বান্ধবী সেই থেকে ভারী খুশিমেজাজে মধুর সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করছে–আর অনর্গল তার প্রশংসা করে চলেছে। দুর্গা বেশির ভাগ সময়ই গম্ভার।

একসময় একটা মস্ত টানেলের মধ্যে গাড়িটা ঢুকে পড়ল। মধু জানে লম্বা টানেল। গাড়ীর ভিতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে নিজের হাতের উল্টো পিঠ মুখে ঠেকিয়ে বেশ রসিয়ে এবং অল্প অল্প শব্দ করে দীর্ঘ একটা চুমু খেয়ে বসল।

গাড়ি অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরুবার আগেই তার আবার হাবাগোবা মুখ।

গাড়ি আবার আলোয় আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই মহিলা দুজনের দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো। দুজনারই খরখরে মুখ, করকরে চাউনি। সারাক্ষণ আর কেউ কারো সঙ্গে কথা বলল না।

গন্তব্যস্থানে পৌঁছে মধুকে আড়ালে টেনে এনে দুর্গা মুখে যা আসে তাই বলে গালাগালি করল- শয়তান বলল, চরিত্রহীন বলল, তাড়িয়ে দিতে চাইল।

মধু জবাবদিহি করল, আমাকে দুর্বল পুরুষকারশূন্য বলো, তাই ভাবলাম

দুর্গা আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। আরো বেশি গর্জন করে ওকে তাড়িয়ে দিতে চাইল।

ফলে মধুরও একটু রাগ হয়ে গেল। বলে ফেলল, এতই যদি খারাপ লাগল তো ধরলাম যখন, আমাকে ঠেলে ফেলে দিলে না কেন–অতক্ষণ ধরে চুমু খাওয়া সত্ত্বেও একটু বাধা দিলে না কেন, তোমার ভালো লাগছে ভেবেই আমার আনন্দ হল, আর তাইতেই একটু শব্দ বেরিয়ে গেল। আসলে বান্ধবী পাশে ছিল বলেই তোমার অত রাগ এখন, তখন তো দিব্বি গলা জড়িয়ে ধরলে–

–কি? কি বলছ তুমি? রাগে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল দুর্গা। তুমি আমাকে ধরেছিলে, আর আমি বাধা দিলাম না! আমি তোমাকে ঠেলে ফেলে দিলাম না, আমি। তোমার গলা জড়িয়ে ধরলাম! পাজী শয়তান মিথ্যেবাদী কোথাকার! ১৫৪

–যাঃ কলা! মধুর বিমূঢ় মূর্তি।–অন্ধকারে আমি তাহলে নার্ভাস হয়ে গিয়ে কাকে ধরতে কাকে ধরেছিলাম? ছি ছি ছি ছি-আমাকে সত্যি তুমি গুলী করে মারো, তুমি না মারলে আমি ফিরে গিয়ে নিজেই আত্মহত্যা করব।

সঙ্গে সঙ্গে গালের ওপর ঠাস করে একটা চড়। চড় মেরে দুর্গা জ্বলতে জ্বলতে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

…বাড়ি ফিরে বিয়েতে রাজী হয়েছে। কিন্তু দুর্গা কোনদিন বিশ্বাস করেনি, মধু সত্যিই ভুল করে ওই কাণ্ড করেছে। তার বদ্ধ বিশ্বাস, তাকে জব্দ করা আর আক্কেল দেবার জন্যেই বেপরোয়ার মতো বান্ধবীর ওপর ওই হামলা করেছে। বিয়ের পরেও নাকি এই নিয়ে ওকে অনেক গঞ্জনা দিয়েছে দুর্গা।

ওদের মুখে শোনা শেষের দৃশ্যটা আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। দুর্গা চিতাশয্যায় শয়ান। আর চোখের জলে ভেসে মধু পাগলের মতো নিজের হাতের উল্টোপিঠ মুখে ঠেকিয়ে সশব্দে চুমু খেয়ে চলেছে!

…এই বেপরোয়া কাণ্ড করে মধু রঙ্গনাথন দুর্গাকে একদিন নিজের জীবনে টেনে আনতে পেরেছিল। আর ঠিক এমনি করেই নিজেকে জাহান্নামে পাঠাবার ভয় দেখিয়ে দুর্গাকে সে চিতা-শয্যা থেকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress