Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সৈনিক || Ashutosh Mukhopadhyay

সৈনিক || Ashutosh Mukhopadhyay

অপর্ণা এবারে সত্যিই চলল তাহলে! অনেক দিন যাবে যাবে করেছে, অনেক দিন বলেছে সময় হয়ে এলো। মেজর ঘোষ চৌধুরী এ-কানে শুনে ও-কান দিয়ে বার করে দিয়েছেন। অপর্ণা উপেক্ষা ভেবেছে কিনা কে জানে! সদা ব্যস্ত স্বামীর কান মন সজাগ নেই ভাবত কিনা কে জানে! নইলে অত করে বলত কেন?

ভিড়ের রাস্তা ছেড়ে গাড়ি রেড রোডে পড়তেই স্পিডের কাটা তিরিশ থেকে এক লাফে পঁয়তাল্লিশের দাগে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু সে কাটা কেউ দেখছে না। মেজর ঘোষ চৌধুরী ঘড়ির কাঁটা দেখলেন একবার। বেলা চারটে বাজতে দশ। রাস্তা ফাঁকা। কতক্ষণ আর লাগবে। যাবেন আসবেন। এই জন্যেই আর কাউকে না পাঠিয়ে নিজে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছেন। প্রতিটা মুহূর্তের অনেক দাম এখন। মরণ-বাচনের দাম। জীবনের একটাই মিনতি রাখা না-রাখার দাম। না, একটানা তেত্রিশ বছরের যুক্ত জীবনে অপর্ণার আর কোনো প্রার্থনা বা মিনতি এই মুহূর্তে অন্তত মনে পড়ছে না মেজর ঘোষ চৌধুরীর। অপর্ণা বলেছিল, তুমি এত ব্যস্ত, তাই ভয় হয়। শেষ সময়ে কাছে থেকো, নইলে ভয়ানক খারাপ লাগবে আমার–থাকবে তো?

একবার নয়, অনেকবার করে বলেছিল। এই গত পরশুও বলেছিল। কালও একবার বোধহয় বলতে চেষ্টা করেছিল। আর আজ সকাল থেকে মুখে বলতে না পারুক হঠাৎ-হঠাৎ তাকিয়ে দেখেছিল তিনি আছেন কিনা।

চোখদুটো ভয়ানক চকচক করছে মেজর ঘোষ চৌধুরীর। অথচ ঝাপসা ঝাপসা দেখছেন। কঁচাপাকা লোমশ দুই পরিপুষ্ট হাতে স্টিয়ারিং ধরে আছেন। একটা হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকল। হুইস্কির ছোট বোতল বেরুলো। দাতে করে মুখ খুললেন। রাস্তাটা ফাঁকা, তাছাড়া কে দেখল না দেখল পরোয়া করেন না। দরকার বলেই খাচ্ছেন। মাথা ঝিমঝিম করলে চলবে না, চোখে ঝাপসা দেখলে চলবে না। সময়ের অনেক দাম এখন। হাত শক্ত, স্নায়ু সবল রাখা দরকার। ছোট বোতল উপুড় করে গলায় ঢাললেন খানিকটা। অর্ধেকের বেশিই খালি হয়ে গেছে গত দু-ঘণ্টার মধ্যে। সাধারণত বেশি খান না। দুদিন ধরে বেশিই খাচ্ছেন। দুদিনে এরকম চারটে ছোট বোতল খালি। হয়ে গেল…না, দিস ইজ দি ফোর্থ, খালি হতে চলেছে!

দাঁতে করে বোতলের মুখ আটকে আবার পকেটে রাখলেন। স্পীডের কাটা প্রায় পঞ্চাশ ছুঁয়ে আছে। একটু আধটু কমছে, আবার পঞ্চাশের কাছে দাঁড়াচ্ছে। হাত একটুও কাঁপছে না মেজর ঘোষ চৌধুরীর। এজন্যেই আর কাউকে না পাঠিয়ে তিনি নিজে ছুটেছেন। আর্মিতে তার দুরন্ত গাড়ি ছোটানো দেখে কত লোকের তাক লেগে যেত। তিনি গাড়ি চালাবেন শুনলে ভয়ে অনেকে সে-গাড়ি এড়াতে চাইত।

…সেই অপর্ণা সত্যিই চলল তাহলে!

মেজর ঘোষ চৌধুরীর মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা। কি কাণ্ড করেই না তিনি ঠিক-ঠিক ঘরে এনে ছেড়েছিলেন তাকে। অথচ এরই মাঝে কিনা তেত্রিশটা বছর কেটে গেল!

আবার দুচোখ চকচক করছে, আবার একটু একটু ঝাপসা দেখছেন। সেই সঙ্গে ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আভাসও।…তেত্রিশ বছর আগের নয়, মাত্র সেদিনের দৃশ্য যেন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে থেকে থেকে।

…ডাক্তারী পড়ার চতুর্থ বছর সেটা। পড়ার চাপ বেশি। একটা পাঁচমিশিলি নামী হস্টেলে থাকতেন। জানালা খুললেই পড়ায় ব্যাঘাত হত। অথচ না খুলেও পারতেন না। রাস্তার উল্টোদিকের বাড়ীর মেয়ে অপর্ণা। নাম আরো দেড় বছর আগেই জানেন। তার যখন ডাক্তারীতে ফোর্থ ইয়ার, অপর্ণার তখন কলেজের থার্ড ইয়ার। সেই সময়ে গণ্ডগোলটা হল। এমন নতুন কিছুই করেননি। সেদিন চতুর্থ বছরের ডাক্তারী নবিশ ত্রিদিবেশ ঘোষ চৌধুরী রোজকার মতই মাঝে মাঝে জানালায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন, অন্য দিনের মতই মৃদু মৃদু হেসেছিলেন চোখাচোখি হতে। বাড়তির মধ্যে আভাসে। হয়ত বা কথা বলার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন।

ব্যস, অপর্ণা ঠাস করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করেছিল। আধ ঘণ্টার মধ্যে অপর্ণার মারমুখী দাদা-কাকারা হস্টেলে এসে হাজির হয়েছিল। অন্য ছেলেরা তার হয়ে তুমুল বচসা করেছিল। আর তার কান দিয়ে আগুন ছুটেছিল। সেইদিনই ডাকে তিনি অপর্ণার নামে চিঠি ছেড়েছিলেন। সার কথা, একদিন তাকে তাদের বাড়ীতে তার ঘরে আসতেই হবে। ইচ্ছে হলে একথা সে তার বাবা মা দাদা কাকাদের জানিয়ে দিতে পারে।

মেজর ঘোষ চৌধুরী হাসছেন একটু একটু। ওই রকম গোঁয়ারই ছিলেন বটে। জানালায় এরপর আর খুব বেশি দাঁড়াতেন না। হঠাৎ একদিন কানে এলো–অপর্ণার বিয়ে পাকা হয়ে এসেছে। পড়াশুনা সিকেয় উঠল তার। মাথায় আগুন জ্বলল। একটা দিনের অক্লান্ত চেষ্টায় ও বাড়ীর দূর-সম্পৰ্কীয় এক লোকের মারফৎ বার করলেন। কোথায় বিয়ে পাকা হয়ে এসেছে। ঠিকানাও সংগ্রহ করলেন। তারপর উড়ো চিঠি ছাড়লেন।–অপর্ণা এবং একটি ছেলে পরস্পরকে বিয়ে করবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ। অতএব ছেলের অন্যত্র বিয়ে করাই ভালো।

বিয়ে ভেঙে গেল। কারণও একেবারে গোপন থাকল মা হয়ত। কারণ দিনকতক বাদেই অপর্ণাকে হস্টেলের এই ঘরের দিকে চেয়ে তাদের জানালায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আর ধীর পদক্ষেপে তিনিও নিজের জানালায় এসে দাঁড়ালেন। নিঃশঙ্কচিত্তে নির্দ্বিধায় স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিলেন তিনিই এই ব্যবস্থা করেছেন।

পরীক্ষা হয়ে গেল। তিনি হস্টেল ছাড়লেন। রেজাল্ট বেরুলো। ভালো পাস করলেন। অপর্ণা জানেও না তিনি কি পড়তেন বা কোথায় চলে গেলেন।

অভাবিত একটা ভালো সম্বন্ধ পেলেন অপর্ণার বাবা-মা একজনের মারফৎ। সেই একজন ত্রিদিবেশ ঘোষ চৌধুরীরই লোক সে আর কে বলতে গেছে। তারা জানালেন, বড়ঘরের ছেলে, বরাবর ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তার হয়েছে।

মিথ্যে জানলেন না তারা।

অপর্ণার বাবা নিজে এলেন খোঁজখবর করতে। এই ভদ্রলোক দেড় বছর আগের বিবাহের ঘটনা কিছুই জানেন না। তার সবই ভারী পছন্দ হল। এত সহজে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে আশা করেননি। ছেলের বাবা-মায়ের উদারতা দেখে তিনি মুগ্ধ। ছেলে দেখেও খুশি। মুখখানা চেনা চেনা লাগল। ফলে বাবা বলেই দিলেন, ছেলের পছন্দ বলেই তিনি এগোচ্ছেন, ছেলে মেয়ে দেখেছে–উল্টোদিকের হস্টেলই ছেলে থাকত।

জানাজানি হওয়া সত্ত্বেও বিয়েতে বিঘ্ন হল না। আর তারপর কটা দিন কি কাণ্ড! দুচোখ চকচক করছে মেজর ঘোষ চৌধুরীর, কিন্তু অল্প অল্প হাসছেনও।…বিয়ের পর অপর্ণা তার দিকে আর চোখ তুলে যেন তাকাবেই না, এমন অবস্থা।…সব যেন সে দিনের কথা মাত্র।

পিচের রাস্তা ঘষটে ঘ্যাঁচ করে থামল গাড়িটা। লাল আলো জ্বলে উঠেছে রেড লাইট! গলা দিয়ে অস্ফুট একটা বিরক্তির শব্দ বার করলেন মেজর ঘোষ চৌধুরী। সবুজ না হওয়া পর্যন্ত থাকো বসে! আরো অসহিষ্ণু বোধ করলেন তিনি, কারণ বিপরীত দিকে অর্থাৎ যে-দিকটার লাইন ক্লিয়ার–সেই রাস্তায় একটি গাড়ি আসছে না বা যাচ্ছে না। যান্ত্রিক ব্যবস্থায় সময় ধরে রোড সিগন্যাল পড়ে, এ-দিক বন্ধ তো ও দিক খোলা, ওদিক বন্ধ তো এ-দিক।

পকেটে হাত। হুইস্কির বোতল। খুললেন। গলায় ডাললেন। বন্ধ করে ওটা পকেটে রাখার অবকাশ পেলেন না– সবুজ আলো! বোতল পাশে পড়ে থাকল। গাড়ি ছুটল।

…সময় নেই।

আর্মিতে চাকরি নিতে অপর্ণা ঘাবড়েছিল। অনেক নিষেধ করেছিল, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার জন্য ঝকাঝকি করেছিল, তার ভয় তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। সর্বদাই ও যে একটা চাপা আতঙ্কে ভুগত সেটা তিনি টের পেতেন। সিভিল পোস্টিং হলে তবু স্বস্তি, সঙ্গে থাকত বলে অত ছটফট করত না। ইমারজেন্সি এরিয়ায় বদলী হলেই অপর্ণার আহার-নিদ্রা ঘুচত যেন। এই জন্যেই অসময়ে পূজো-আর্চা ধরেছিল বলে বিশ্বাস। মেজর ঘোষ চৌধুরী হাসতেন, আবার বিরক্তও হতেন।…লেফটানেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন হয়েছেন, ক্যাপ্টেন থেকে মেজর, তবু অপর্ণার ভয় ঘোচেনি। সে ছেলেমেয়েগুলোকে ঠিকমত মানুষ করে তুলেছে, তার প্রতি সকল কর্তব্য করেছে আর সেই সঙ্গে একটা অহেতুক ভয় পুষেছে। আশ্চর্য, দৈব বিড়ম্বনায় অসময়ে আর্মি। থেকে অবসর নিতে হল তাকে, তবু অপর্ণার ভয়ে ভয়ে থাকাটা যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। পাথর পড়ে পা ভাঙার ফলে আর্মির চাকরি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। মেজর ঘোষ চৌধুরী ঠাট্টা করেছিলেন, ঠাকুর তোমার ডাক শুনেছে, মিলিটারির চাকরি ছাড়িয়েছে!

অপর্ণার নির্বাক চাউনিটা স্পষ্ট মনে আছে। দুচোখে জল টলমল করছিল।

.

গাড়ি থামল। এই দোকানই। নেমে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন মেজর ঘোষ চৌধুরী। পরক্ষণে আরো বেগে ছুটে এসে গাড়িতে উঠলেন। মুখ শুকনো, চোখের নিমেষে গাড়ি ওধারের বড় রাস্তার দিকে ঘোরালেন৷

.

..অপর্ণা চললই তাহলে! বড় দোকানে ওষুধ মিলল না। মিলবে কিনা সন্দেহ ছিলই। পাওয়া গেলেও অপর্ণা থাকবে কিনা সন্দেহ–ডাক্তার তো তিনিও, আর নামী ডাক্তারই–সবই বোঝেন। তবু আশা, শহরের সব থেকে নামজাদা ডাক্তার বলেছেন, এই ওষুধটা একটা কেসএ জাদুর কাজ করেছিল–পান কিনা এক্ষুনি দেখুন। ওমুক জায়গায় যান—

সেই জন্যেই টেলিফোনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বাঁচিয়ে নিজেই গাড়ি হাঁকিয়েছেন। আর কারো ওপর নির্ভর করতে পারেননি। ওষুধটা কোথাও থাকলে তাকে পেতে হবে। ওদিকের বড় রাস্তা ধরে গেলে আরো দুটে দোকান আছে।

কিন্তু ওদিকটায় আবার ট্রাম বাস মোটর চলাচলের ভিড়। তার ফাঁক দিয়েই বেগে। ছুটেছে। এই ওষুধটার জন্য তিনি যেন সর্বস্ব দিতে পারেন। টাকার তো অভাব নেই, অভাব যার ঘটতে চলেছে টাকা দিয়ে তা পূরণ হবে না।…অপর্ণা রাগই করত, সময়ে নাওয়া নেই, খাওয়া নেই–তোমার এত টাকার কি দরকার?

মিলিটারি চাকরির যা পেনশন পান, সেদিকে তাকানোও দরকার হয় না তার। যে টাকা তিনি প্র্যাকটিস করে রোজগার করেন, তা কল্পনার বাইরে। সেই এক আট টাকা ভিজিট করে রেখেছেন তিনি–তাই রোগী আসে কাতারে কাতারে। প্রায় তিন বেলাই হিমসিম অবস্থা হয় তাঁর। বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে চেম্বার। কিন্তু খোঁড়া মেজরের কাছে রোগী আসে পাঁচ সাত মাইল দূর থেকেও। পা জখম হবার পর থেকে একটু খুঁড়িয়ে চলেন বলে রোগীদের মুখে মুখে এখন এই নাম।

ওয়ার্থলেস!

মুখ বিকৃত করে চার রাস্তার মুখ সবেগে পার হবার মুখেই ঘ্যাচ করে গাড়িটা থামাতে হল। লাল আলো। ভ্রূকুটি করে ওধারের রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে তাকালেন তিনি, গ্রীন পেয়ে এখনো নড়তেও শুরু করেনি। এই ফাঁকে অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারতেন। বাবুরা সব গদাই লস্করি চালে গাড়ি চালায়।

ঘন ঘন লাল আলোর দিকে তাকাচ্ছেন তিনি। অসহিষ্ণু হাতে পাশের হুইস্কির বোতল ট্রাউজারের পকেটে ঢোকালেন। গায়ে তো শুধু পুরু গেঞ্জি একটা।

.

সর্বদা অত ভয়ে ভয়ে থাকত বলেই একে একে হার্টের দুদিকেরই ভালব খারাপ হয়ে গেল কিনা অপর্ণার, মেজর ঘোষ চৌধুরীর এখন সেই সন্দেহ হয়। শয্যা নিয়েও তার দুশ্চিন্তা যায় না তার জন্য। ঘড়ি ধরা সময়ে খেতে না এলে বা সময়ে শুতে না এলে বিছানায় শুয়েই ছটফট করবে। ছেলেরা আর মেয়েরা অনেকবার সেই নালিশ করেছে। আর এখন তো মুখে কেবল এক কথা, শেষ সময়ে তুমি যেন কখনো আমার কাছছাড়া হয়ো না, কাছে থেকো–থাকবে তো?

মেজর ঘোষ হেসেছেন, শেষ সময় অত সস্তা নয়, বুঝলে?

–তবু তুমি কথা দাও- কথা দাও না গো!

কথা দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার তবু ভয় যায় না দেখে বিছানার গায়ে। টেলিফোন এনে দিতে হয়েছে। একটু খারাপ বুঝলেই অপর্ণা চেম্বার থেকে ডাকবে তাঁকে।

মা-কে বাবার এই কথা দেওয়ার খবরটা ছেলেমেয়েরাও কি করে যেন জেনেছে। মায়ের অসুখ বাড়বাড়ির দিকে গড়াবার আগে তারা এই নিয়ে হাসাহাসিও করেছে। টেলিফোন হাতে পেয়ে ওদের মা যেন পরীক্ষা করার জন্যেই এ পর্যন্ত দিনতিনেক ডেকেছে তাকে।

গ্রীন লাইট। গাড়ি ছুটল।

.

দ্বিতীয় বড় দোকানেও নেই। চললই তাহলে অপর্ণা। মিথ্যেই দুর্বল হচ্ছেন তিনি, ওষুধ পেলেও যাবেই। তবু অন্য দোকানটাও দেখতে হবে। সময় নেই।…বাড়ির সঙ্গে কানে একটা টেলিফোন লাগানো থাকলে বুঝি ভালো হত। বাকি বড় দোকানটা দেখেই সোজা বাড়ি। তিনি কথা দিয়েছেন পাশে থাকবেন, সে-কথা যে কি-কথা সেটা এখন। অনুভব করছেন। যে অবস্থায় দেখে কেঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়েছেন–আর দেরি করা ঠিক হবে না।

আশ্চর্য! অপর্ণা কি তাহলে থাকবে এ-যাত্রা? ওষুধ পেয়েছেন। তিনি তো ডাক্তার, জীবন-মন্ত্র ভাবছেন নাকি এটা? ওষুধ হাতে পাবার পর আশাও তেমন করতে পারছেন কই? এই অবস্থা থেকেও ফেরে কেউ? সত্যি মিরাকল হয়?

এবারে আরো বেগে ছুটেছেন।

..খাইয়ে তো দেবেন, যেমন করে হোক কিছুটা পেটে যাওয়া চাই। চাই-ই।

ইমপসিবল! ইমপসিব! বিরক্তিতে অসহিষ্ণুতায় গলা দিয়ে জোরেই শব্দ বার করে ফেললেন মেজর ঘোষ চৌধুরী।

লাল আলো। অর্থাৎ থামো।

অথচ মাত্র দুটো সেকেণ্ডের জন্য বোধহয়। প্রথম সাদা দাগ ছাড়িয়েই এসেছিলেন। দ্বিতীয় দাগটা ছাড়াতে পারলেই আর থামতে হত না। কিন্তু তার আগেই সবুজ আলো হলদে হয়েছে, তারপর লাল। ও-ধারের রাস্তার গাড়ি স্টার্ট নেবার আগে এমন কি হলদে আলো সবুজ হবার আগেই তিনি হাওয়া হয়ে যেতে পারতেন।

কিন্তু কি আর করা যাবে! পিছনের দিকে দেখে নিয়ে দ্বিতীয় সাদা দাগের কাছ থেকে গাড়ি বরং হাতকয়েক পিছিয়ে নিতে হল।

..এ-রকম হয় না কেন, যে রাস্তায় গাড়ি যাবে সে রাস্তায় শুধু যাবেই, যে রাস্তায় আসবে, শুধু আসবেই–চার রাস্তা থাকবে না–এস রোড থাকবে না।

মাথা গরম হয়েছে বোধহয় তাঁর, কিন্তু এখানে বোতল খোলা মুশকিল।

নাকের ডগা দিয়ে যে গাড়িগুলো যাচ্ছে, সেগুলিকে ভস্ম করার চোখ মেজর ঘোষ চৌধুরীর।

আশ্চর্য, অপর্ণা যে তার এতখানি এ কি নিজেই জানতেন! পাশে থাকতে কথা দিয়েছেন যখন, তখনও কি জানতেন? তখনো কি এরকম করে অনুভব করতে পেরেছিলেন?

ক্রস রোডে গাড়ি চলেছে তো চলেছেই। এক মিনিট এত বড় হয় কি করে?

…তবু তুমি কথা দাও, কথা দাও না গো!

কথা যখন দিয়েছিলেন, তখনো কি সেই আকৃতি এমন করে শিরাতে শিরাতে ওঠা-নামা করেছিল তার? তিনি তো তার পরেও লোকের চিকিৎসা নিয়ে সদা ব্যস্ত ছিলেন, এমন দম-আটকানো শূন্যতা তো কখনো অনুভব করেননি?

….চিকিৎসার বাইরে আর সকল দিক অপর্ণা এ-ভাবে ভরাট করে রেখেছিল বলেই অনুভব করেননি। তাই বটে। কোনদিন আর কোনদিকে তাকানোর দরকারই হয়নি তার! দুটো মেয়ের বিয়ে হয়েছে, বড় ছেলেটার বিয়ে হয়েছে, আর একটা ছেলেও আগামী বারে ডাক্তারী পাস করে বেরুবে। এরা সব ছোট থেকে হঠাৎ চোখের ওপর দিয়ে কেমন করে যে বড় হল, যোগ্য হল, তাও যেন ভালো জানেন না মেজর ঘোষ চৌধুরী। সব-দিক এমনিই ভরে রেখেছিল বটে অপর্ণা। তেত্রিশ বছরের এই ভরাট দিকটাই শূন্য হওয়ার দাখিল। তাই সবদিকই শূন্য। নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে কষ্ট। চোখে ভয়ানক ঝাপসা দেখছেন।

বিষম চমকে উঠলেন– সবুজ আলো! গ্রীন! ব্লেসেড গ্রীন!

হাওয়ার বেগে গাড়ি ছুটল। আশ-পাশের গাড়িওয়ালারা তাঁর গাড়ির এই গতি পছন্দ করছে না। অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে ভাবছে। হলেই হল। মিলিটারি চাকরিতে কোন পথ দিয়ে কি স্পীডে গাড়ি চালাতে হয়েছে তা কে জানবে কি করে। চকচকে চোখ, কিন্তু ঠোঁটে আবার যেন হাসির আভাস একটু–জানলে অপর্ণা বোধহয় সুস্থ শরীরেই হার্টফেল করত। নির্ভয়ে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে আর দুটো চোখ আর সবগুলো স্নায়ু একত্র করেই অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিচ্ছেন তিনি। গাড়িতে বসলে তার খোঁড়া পা আর খোঁড়া থাকে না–ওনলি ডোন্ট ডিসটার্ব মি: এনিবডি অ্যাণ্ড লেট দেয়ার বি নো রেড লাইট এনি মোর!

বাড়ি।

সিঁড়ির গোড়ায় পা রেখেইে নিশ্চল স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। কানে গলানো শিসে ঢুকল এক ঝলক। ঝলকে ঝলকে ঢুকছে। তিনি নিস্পন্দ কাঠ।

দোতলার ওই অনেক গলার আর্তনাদের একটাই অর্থ।…অপর্ণা থাকল না। গেলই।

কয়েক নিমেষের মধ্যে বুঝি বুড়িয়ে গেলেন মেজর ঘোষ চৌধুরী। এত বুড়িয়ে গেলেন যে সিঁড়ির শেষ নেই মনে হচ্ছে। ঝকঝকে দুচোখে মুক্তোর মত দুটো কি। হাঁপ ধরছে। দাঁড়ালেন। কি যেন একটা ভুল হয়ে গেছে।…কি? মাথার ভিতরে এরকম লাগছে কেন? তিনি ডাক্তার, জানতেনই তো অপর্ণা থাকবে না!

পকেটের বোতলটা উবুড় করে নিঃশেষে গলায় ঢাললেন।

দোতলা। অপর্ণা শুয়ে আছে। মেয়ে দুটো আর ছোট ছেলেটা আছড়া-আছত করে কাঁদছে। বড় ছেলে, ছেলের বউ কাঁদছে। জামাইরা কাঁদছে।

তাকে দেখেই ছোট ছেলে আর্তনাদ করে উঠল, বাবা, তুমি আর একটা মিনিট দেড়টা মিনিট আগে এলে না? আর একটু আগে এসে কথা রাখতে পারলে না বাবা? যাবার দশ সেকেণ্ড আগেও মা যে চোখ তাকিয়ে চারদিকে খুঁজল তোমাকে?

মেজর ঘোষের এইবার মনে পড়েছে। তিনি কথা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন পাশে থাকবেন। কি আশ্চর্য, তিনি কি পাশে ছিলেন না এতক্ষণ?

অপর্ণার দিকে তাকালেন। ঘুমুচ্ছে যেন। হাসি-মাখা ঘুম। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ডেকে ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করবেন তার? বলবেন, শোনো অপর্ণা, আমি চেষ্টা করেছিলাম, আমিও তাই চেয়েছিলাম–চেয়েছিলাম!

নির্বাক, বোবা তিনি।

ঘণ্টাখানেক বাদে কান্নার প্রাথমিক আবেগ স্তিমিত হল। জামাইরা দেহ নেবার যোগাড়যন্ত্রে বেরিয়েছে। দুই ছেলে শিয়রে আর পায়ের কাছে বসে। পাশে তিনি।

ধরা-গলায় এক সময় বড় মেয়ে বলল, আর একটু যদি আগে আসতে বাবা…মায়ের কাছে তুমি শেষ কথাটা রাখতে পারলেই না……!

ক্লান্ত-ক্লিষ্ট মুখে মেজর ঘোষ চৌধুরী আস্তে আস্তে বললেন, হবার নয় বলেই হল না রে,…তিন-তিনবার রাস্তার লাল আলোয় আটকে গেলাম–বড় ক্রসিং, এক মিনিট করে থামতে হল। যাবার সময় অন্য রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই, অথচ লাল আলো, আর আসার সময় একেবারে বেরিয়ে মুখে-মুখে দুবার।

বড় ছেলে বেশ জোরেই বলে উঠল, বেরিয়ে আসার মুখে তো বেরিয়েই এলে না কেন? কে কি করত? বড় জোর একশ দেড়শ টাকা জরিমানা হত–এর বেশি আর কি হত?

মেজর ঘোষ চৌধুরী হতভম্ব বিমূঢ় হঠাৎ। বেরিয়ে আসা যেত ঠিকই। অনায়াসেই যেত। আর একশ দেড়শ টাকা ছেড়ে কথা রাখার জন্য এক হাজার দু হাজার দশ হাজারও বার করে দিতে আপত্তি ছিল না তার। কিন্তু লাল আলো দেখেও বিধি নাকচ করে ওভাবে বেরিয়ে আসা যেতে পারে সেটা মাথায়ও আসেনি তার। এখনো যেন ভালো করে আসছে না।

ছেলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন মেজর ঘোষ, চৌধুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress