Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চলো জঙ্গলে যাই || Ashutosh Mukhopadhyay

চলো জঙ্গলে যাই || Ashutosh Mukhopadhyay

সকালে খানিকক্ষণ রেডিও শোনা অভ্যাস। তাই শুনছিলাম। চোখ অন্য-কাজে ব্যস্ত থাকলেও কান সজাগ ছিল। এই দিনে চোখ-কান-হাত-পা সব একই সঙ্গে যে বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করতে পারে না তার অগতি ব্যাহত হতে বাধ্য। আমার হাতে সিগারেট ছিল, চোখ দুটো সামনের বইয়ের দিকে ছিল, মনের একভাগ বইয়ের লেখকের দিকে আরেক ভাগ রেডিওর দিকে ছিল, আর মগজের কোষে-কোষে সিগারেট, বই, লেখক, রেডিও থেকে শুরু করে সমস্ত দিনের প্ল্যান-প্রোগ্রাম সবই আসা-যাওয়া করছিল। এই সব গুণ করায়ত্ত বলেই সিদ্ধির পথে আমার সহজ স্বচ্ছন্দ গতি। গেলবারে আমার সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক বন্ধুরা, সরকারী বে-সরকারী বহু পদস্থ শুভার্থীরা। আমাকে যখন মানপত্র দেন, তখন আমার বহু গুণের কথা উল্লেখ করে অনেকেই তারা সশ্রদ্ধ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের সেই বিস্ময়ের উত্তরে আমি বিনীত জবাব দিয়েছিলাম, সবেতে সহিষ্ণু, সংযম, উদার দৃষ্টিভঙ্গি আর অতি মন্দের মধ্যেও ভালো দেখার চেষ্টা ছাড়া আমার আর কোনো গুণ নেই। শুধু এই কটি মিলিয়ে আমি যা–তাই।

মিথ্যে বলিনি বা অতিশয়োক্তি করিনি। মনেপ্রাণে এই তিন মন্ত্রের ওপরে নির্ভর করেই আমি দিনযাপন করে চলেছি।

সকালে রেডিও খুলি, কারণ প্রথম দিকে ভালো ভালো ঠাকুর-দেবতার গান থাকে কয়েকটা, যা শুনলে চিত্ত প্রসন্ন হয়, একটা শুচিশুদ্ধ ভাব জাগে মনে। তারপর রেডিওর খবরও খবরের কাগজের খবরের থেকে আমার ভালো লাগে। খবরের কাগজগুলো। সর্বদা দু-নৌকায় পা দিয়েই আছে, মানুষের চিন্তা বিভ্রান্ত করাই যেন তাদের কাজ। একই সঙ্গে প্রশংসা আর নিন্দা, স্তুতি আর কটুক্তি, আস্থা আর অনাস্থা–সব পাশাপাশি বিরাজ করছে। কিন্তু বেতারের খবরে উন্নতির প্রয়াস, অগ্রগতির চেষ্টা, সততা, নিষ্ঠা আর আশা-আশ্বাসের, একটা স্পষ্ট চিত্র মেলে। উজ্জ্বল সম্ভবনায় মন প্রসন্ন হয়।

বাড়িতে অবশ্য উঠতি বয়সের ছেলেছোকরা আছে আরো, নিজেদের তারা বেশ দিগগজই ভাবে। ভালো ভালো খবর শুনলেও তাদের মন ভরে না, তাদের চোখে অবিশ্বাস উঁকিঝুঁকি দেয়, ঠোঁটে অনেক সময় বাঁকা হাসি ফোটে, আর মনে মনে হয়ত বক্র শ্লেষও করে। কিন্তু ওদের এই বিরূপতা একটু রূঢ় শাসনেই আমি কাটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছি। কিছুটা সফলও হয়েছি। এখন আর আমার সামনে অন্তত মুখ ফুটে কেউ কিছু বলে না।

আমি ওদের বলি, এত ধৈর্যশূন্য হবার কী আছে, এই তো সেদিন মাত্র স্বাধীন হলাম, শিশু দেশ আমাদের, এরই মধ্যে যা হয়েছে অনেক হয়েছে–ভোজবাজার ব্যাপার তো নয় যে রাতারাতি একেবারে প্রাচুর্যের বন্যা এসে যাবে!

জবাবে সব থেকে মুখের মত আমার স্ত্রীই একদিন মুখ-মচকে প্রতিবাদ করে বসেছিলেন, বলেছিলেন, তাও তো আঠের বছর হয়ে গেল দেশ স্বাধীন হয়েছে, শিশু আর কতকাল থাকবে?

সত্যিই আমার মনটা সেদিন খারাপ হয়ে গিয়েছিল–ঘরের স্ত্রী পর্যন্ত যদি মনে মনে অবিবেচক হন তাহলে কেমন লাগে? রাগ না করে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ছেলের বয়েস কত?

আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, উনিশ…

বললাম, তাকে তুমি কোন চোখে দেখো? মস্ত যোগ্য হয়েছে বলে তাকে তুমি ঠেলে রাস্তায় বার করে দিতে পারো? সেদিন পয়সা চুরি করেছিল বলছিলে, মস্ত নীতিবতী হয়ে, তাকে তুমি জেলে পাঠাওনি কেন? ও-বাড়ির ওই দুর্বল ছেলেটাকে, অমন ঠেঙিয়ে আধমরা করে আসার পরেও ওর তুমি একখানা হাতও ভেঙে দাওনি কেন? আপদে-বিপদে এত সন্তর্পণে তাকে তুমি আগলে রাখো কেন? এই সবেরই একমাত্র কারণ, আসলে ওকে তুমি শিশু ভাবো, এবং ঠিকই ভাবো। দেশটাকেও ঠিক এই চোখেই দেখা উচিত।

সেই মোক্ষম জবাবের পর স্ত্রীর মুখ বন্ধ হয়েছে।

যাক এসব কথা, আজ থেকেই আমার মেজাজ কিছুটা বিগড়ে দিয়েছে যে বস্তুটা, সেটা আমার হাতের এই বই। না পারছি ভালো করে রেডিওর খবরে মন দিতে, না পারছি বই হাতে নিয়ে আর কিছু ভাবতে। জুতোর ভিতর থেকে পায়ের তলায় ক্রমাগত যদি কিছু খচখচ করে বিধতে থাকে, আঘাত সামান্য হলেও কতক্ষণ আর সেটা বরদাস্ত করে নির্লিপ্ত থাকা যায়?

বইটার নাম চলো, জঙ্গলে যাই-জীবন-যন্ত্রণার প্রতীক এক আধুনিক কবির কাব্যসংকলন। চোখাচোখা বাক্যবাণ সাহিত্যের আওতায় আনার ফলে কবির একটু সস্তা নাম হয়েছিল। আমি নামই শুধু শুনেছিলাম, আগে তাঁর লেখা কিছু পড়িনি। পণ্ডশ্রম করার মত অত সময়ও নেই। কবির এই নবতম সংকলনটির প্রসঙ্গে পাঠকের একটু বেশি উচ্ছ্বাস প্রকট হবার ফলেই বইটা আমার হাতে এসেছে। আবার সুস্থ বুদ্ধি দু-চারজনের অনুরোধও এসেছে আমার কাছে, কবিতার বইটা পড়ে কাগজে আচ্ছা করে একটু সমালোচনা করুন তো–এ সব আপিন-সাহিত্য আর তো সহ্য হয় না।

সমালোচনার উদ্দেশ্য নিয়েই বইটা হাতে নিয়েছি, আর এ সপ্তাহে সমালোচনা প্রকাশ করতে হলে আজই এটা উল্টে-পাল্টে দেখে যা লেখার লিখে দিতে হবে। কিন্তু বইটা পড়তে পড়তে গায়ে যেন জল-বিছুটি লাগছে এক-একবার, ইচ্ছে হয়েছে। ছুঁড়ে ফেলে দিই। কিন্তু ছুঁড়ে ফেলে দিলে সমালোচনা লেখা হয় না–আর সমালোচনা না করা মানেই এই সব অসংযমী বেপরোয়া লেখককে প্রশ্রয় দেওয়া।

অতএব পড়ছি আর জ্বলছি।

সবকটা কবিতার মধ্যেই কবি তাঁর পাঠকবর্গসহ জঙ্গেলে যেতে চাইছেন। তাঁর মতে দেশটা এখন আর বাসযোগ্য নয়, এই সভ্যতার মশাল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিলে সব, এই সভ্যতার মোলায়েম হিংসা বনের হিংস্র শ্বাপদকেও হার মানিয়েছে, মানুষের মধ্যে এখন আর লোভ-লালসা দুর্নীতি-বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু দেখছেনই না কবি, দয়া-মায়া-ভালবাসা-মানবতার শুধু মুখোশই দেখা যাচ্ছে সর্বত্র, শাসকের বেশে শোষক ঘুরছে, ধার্মিকের বেশে অত্যাচারী ছুরি হানছে, ন্যায়ের নামাবলী পরে অন্যায়ের বিজয়যাত্রা চলেছে–অতএব এই পাপ যাদের সত্যিই অসহ্য, কবির সঙ্গে তারা যদি জঙ্গলে যাত্রা করে, তাহলে এখান থেকে অন্তত অনেক সুখে থাকবে। নমুনা দিই :

তুমি শান্তি চাও?
বুকের তলায় ডুব দিয়ে দেখো বন্ধু,
দেখো সত্যি কি চাও তুমি।
শান্তি যদি চাও,
তবে অন্য পথ নাও।
এখানে শান্তি বড় চড়া দরে বিকোয়,
এখানে প্রাচুর্যের পাপে নারায়ণ শুকোয়,
তোমার মূলধন তো কানাকড়ি!
নীতির খাপে পোরা তীক্ষ্ণ অস্ত্র নেই তোমার ঝুলিতে,
লোভের আগুন ছাই-চাপা নেই তোমার।
অহিংস উদার বুলিতে,
কথার প্রলেপে তুমি, দিন কে পারো কি রাত করতে?
আর প্রসন্ন ঢেকুর চেপে, চোখ দিয়ে পারো
সমব্যথার অশ্রু ঝরাতে?
হায় রে হায়, তোমার মূলধন যে কানাকড়ি!
তবু যদি বলো শান্তি চাই
তাহলে আমি যা বলি শোনো তাই,
চলো বন্ধু,
চলো জঙ্গলে চাই।

আমি এর পর স্নায়ু ঠাণ্ডা করার জন্যেও খানিকক্ষণ অন্যদিকে মন ফেরানো দরকার। বই রেখে খবরের কাগজ টেন নিলাম। কিন্তু এইসব অপরিণামদর্শী লেখকদের কথা ভেবে গা জ্বলছে। সরকারের ওপর এই প্রথম হয়ত একটা ব্যাপারে রাগ হল আমার –তাদের মুদ্রণ পর্যবেক্ষণ দপ্তর তো আছে একটা, এই সব বই বাজেয়াপ্ত করে না। কেন তারা? কেনই বা শান্তিপ্রিয় লোকগুলোকে এভাবে তাতিয়ে তুলতে দেয়?

খবরের কাগজে কতকগুলো ভালো ভালো খবরের ওপর চোখ বুলিয়ে মনটা একটু প্রসন্ন হল। নতুন কয়েকটা পরিকল্পনা প্রায় সমাপ্তির পথে, খাদ্য-দপ্তর খাদ্যের অনটন দূর করার দৃঢ় উদ্দীপনায় কতকগুলো ভালো ভালো ব্যবস্থায় অগ্রসর হতে চলেছেন, অন্যদিকে শাসকরা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন–মুনাফাখোর, মজুতদার বা ভেজাল-ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি আর তারা কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না–তাদের শুভবুদ্ধির উদ্রেক করার এবং তেমন প্রয়োজনে শাস্তি পর্যন্ত দেওয়ার রাস্তাও বার। করতে বদ্ধপরিকর তারা।

চাকর এসে খবর দিলে, নিচে একটি মেয়ে এসেছে, দেখা করতে চায়।

কে আবার মেয়ে এলো এসময়ে দেখা করতে, বুঝলাম না।

সিঁড়ির মুখে বাধা পড়ল, স্ত্রী উঠে আসছেন। আমাকে দেখে বললেন, যে লোকটা চুপি চুপি বেশি দরে, বাড়িতে মাছ দিয়ে যায় তারও আজ দেখা নেই–কী হবে?

এসব কথা কোনো দিনই ভালো লাগে না, অথচ আমারই কানে বেশি আসবে। বললাম, মাছ ছাড়াও লোকে দু দশ দিন প্রাণধারণ করতে পারে–বেশি মাংস আনিয়ে নাও, মাংস তো পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু এই ফয়সালার পরেও পাশ কাটানো গেল না। তিনি আবার বললেন, কিন্তু রাঁধবে কী দিয়ে মাথামুণ্ড–দিচ্ছি দিচ্ছি করে তিন দিন ধরে তেলঅলারও তো পাত্তা নেই।

এবারে সত্যই রাগ হল, বললাম, নেই তার জন্যে মাথা খারাপ করার কী আছে? এক কালের মানুষ সব কিছু পুড়িয়ে খেত, তাদের স্বাস্থ্য, তোমার-আমার থেকে খারাপ ছিল না।

বলে ফেলেই এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করলাম। জঙ্গলের কবির, জঙ্গলের মানুষদের সমর্থনই যেন করে ফেলা হল। নামতে নামতে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধরে নিলাম।-সেদ্ধ করেও বেশ খাওয়া চলে সব কিছু, তাতে স্বাস্থ্য বরং আরো ভালো থাকে।

নিচে অপেক্ষা করছে বছর বাইশ-চব্বিশের একটি মেয়ে। মোটামুটি সুশ্রী, ভালো। স্বাস্থ্য, একটু গম্ভীর গোছের। যে ধরনের মেয়ে দেখলে চোখে স্বভাবতই প্রীতি হয় একটু। চেনা-চেনা লাগল মুখখানা, অনেকদিন আগে কোথাও যেন দেখেছি।

মেয়েটি উঠে এসে আমাকে প্রণাম করল, কাকাবাবু ডাকল, বলল, আমাকে চিনতে। পারলেন না তো কাকাবাবু?

ওর বাবার নাম বলতেই চিনলাম, আমাদের বিনয়ের মেয়ে। স্কুল-কলেজে বিনয় আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। কোথায় একটা কেরানীগিরি করে এখন, সংসার নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে, বিশেষ দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। কিছুদিন আগে তার এই মেয়ের সম্পর্কেই কী যেন শুনেছিলাম…ঠিক মনে পড়ছে না, কী একটা কারণে মেয়েটা চাকরি ছাড়তে চায়–ওই গোছের কিছু।

মেয়েটির কথাবার্তা বেশ স্পষ্ট, সপ্রতিভ, আলগা লজ্জা-সঙ্কোচ নেই। আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল, কোনো ভালো ভদ্র প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চায়, আমাদের কাগজে কোনো চাকরির ব্যবস্থা হতে পারে কিনা…।

আমি অবাক একটু, কেন, তুমি তো একটা ভালো চাকরি করছিলে কোথায় শুনেছি!

জবাবে প্রায় অসঙ্কোচেই সে জানালো, ভাল চাকরিই করছিল এবং এখনো করছে। শর্টহ্যাণ্ড-জানা-গ্র্যাজুয়েট বলে চাকরি পাওয়াও সহজ হয়েছিল। তারপর স্টেনোটাইপিস্ট থেকে দেড় বছরের মধ্যেই স্টেনোগ্রাফার হয়েছে, থাকতে পারলে শিগগীরই হয়ত পি. এ-ও হয়ে যাবে। কিন্তু থাকাটাই আর সম্ভব হচ্ছে না, আত্মসম্মান বজায় রেখে সেখানে চাকরি করা কঠিন হয়ে উঠেছে। তার ঘন ঘন প্রমোশন পাওয়াটাও সকলে সুচক্ষে দেখছে না…দেখার কথাও নয়।

এইবার মনে পড়ল, ওর বাপের মুখে কী শুনেছিলাম। বাপ দুঃখ করে বলছিল, মেয়েটা যা-ও একটা ভালো চাকরি পেয়েছিল, টিকতে পারছে না। ছাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কী যে মতিগতি হয়েছে আজকাল, ছেলে-ছোকরা ছেড়ে বাপের বয়সী অফিসাররা পর্যন্ত সোজা রাস্তায় চলে না।

যেমন বাপ তেমনি মেয়ে। বিরক্তিকর না তো কী! এই বয়সের মেয়ে পর্যন্ত একটু উদার হতে পারে না! ফ্রয়েড বা হ্যাভলক এলিস পড়া থাকলে এই সব সামান্য সহজাত বিকৃতিগুলোকে বরং একটু দরদের চোখে দেখতে পারত। দুর্নীতির মধ্যে পা না বাড়িয়েও সহজ একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলার বলিষ্ঠ চিন্তা এদের মাথায়ই আসে না। নীতি-নীতি করেই গেল সব, এই সামান্য কারণে একেবারে চাকরিই ছাড়তে

বিরক্তি চেপে ওকে বললাম, আমাদের কাগজের অফিসে মেয়েদের কোনো স্কোপ নেই। এও বললাম, এতেই যদি চাকরি ছাড়তে হয়, তাহলে তার উচিত কেনো মেয়ে-স্কুলে চাকরি নেওয়া।

ওপরে এসে আবার ওই জঙ্গল-ভক্ত কবির বইটাই খুলে বসলাম। প্রথমেই যে জায়গাটায় চোখ পড়ল, মনে হল চোখে যৈন পটপট করে ইনজেকশন ফোটাচ্ছে কেউ :

…তাই বলি বন্ধু, যদি সঙ্গী পাই
তবে খাঁটি সবুজ জঙ্গলে যাই।
যেখানে হিংসা খাঁটি,
আর সরলতাও।
যেখানে বাঘ ভালুক হায়না–
আপন মুখ মুখোশে ঢাকে না।
যেখানে হিংস্র চকিত হুঙ্কারে।
ভক্ষ্য হরিণের ঘাড়ে লাফায়,
রক্ষা করবে বলে তাকে
বৃথা আশ্বাসে ভোলায় না।
যেখানে শ্বাপদ-হিংসা খাঁটি
আর শশকের সরলতাও।
অরণ্যে আরো ক্ষুধা নেই একথা বলি না বন্ধু,
রিপু যেখানে আদিম আর অবিকৃত
সেখানেও বনিতার খোঁজ পড়ে অবিরত।
তবু আপন-নির্ভয়ে সেথায় বনিতারে রক্ষা করা রীতি,
আর অকপট শৌর্যে তারে জয় করা নীতি।
সেখানে ক্ষুধা খাঁটি
আর বনিতার সরলতাও।
দুইই সকলে চেনে।
যেখানে অচেনা কেউ নয়, যেমন এই সভ্যতার অরণ্যে।
তাই, আমরা যারা চেনা মুখ খুঁজে বেড়াই
তারা এসো বন্ধু,
চলো, নির্ভেজাল জঙ্গলে যাই।

জেলের বই ফেলে, সহজ দম নিতে ফেলতে সময় লাগল একটু। ভেবে আর মাথা গরম করব না, লেখার যা লিখব। পারলে জঙ্গলেই পাঠাব কবিকে। খাওয়া-দাওয়ার পর অল্প একটু ঘুমনোর অভ্যাস, তারপরে অফিস।

বাসে বসেও বইটা শেষবারের মত উল্টেপাল্টে দেখছি। আর এতে ভালো করে মন না দিয়ে মনটাকেও ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করছি। বাসে কয়েকটি ছেলেছোঁকর তরল কলরব কানে আসতে মুখ তুলতে হল। বই-খাতা নিয়ে গুটিসাতেক ছেলে কলেজে চলেছে। একজনের সামনের লেডিস সীটের একটা পাশ খালি, অন্য পাশে বছর পঁয়তিরিশেকের এক মহিলা বসে। মহিলার শৌখিন বেশবাস, চোখে পুরু কালো গগলস। রসিকতা করে ছেলেরা সকলকে শুনিয়েই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, মহিলার পাশের ওই খালি সীটটাতে কেউ বসবে কিনা।

শেষে একটি ছেলে জিজ্ঞাসাই করে বসল, ও দিদি, বসব একটু?

না। মহিলা ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন, তোমরা আর একটু ভদ্র হলে বলতে হত না, আমিই বসতে বলতাম।

আর যায় কোথায়, ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ল যেন। ছেলেরা তর্জন-গর্জন করে উঠল, এতবড় কথা! আমরা অভদ্র! মেয়েছেলে বলে যা মুখে আসে বলে পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন? ফর্সা জামাকাপড় পরে আর স্টাইল করে চোখে গগলস চড়ালেই মেয়েরা ভদ্র হয়ে যায়, কেমন?

বাসের দুই-একজন থামাতে চেষ্টা করল তাদের, কিন্তু তার ফল বিপরীত হল। অল্পবয়সী ছেলে সব, সত্যিই চটেছে। মারমূর্তি হয়ে তারা বলতে লাগল, কেন, কেন এই কথা বলবে আমাদের, এই সব মেয়েছেলের এত সাহস কেন? মহিলাকেই চড়াও করল আবার, আপনার মত ফ্যাশানেবল মেয়েদের খুব চিনি আমরা, বুঝলেন? আপনার মত কালো চশমা পরা মেয়েদের জানতে বাকি আছে আমাদের ভাবেন?

ক্রোধে ক্ষোভে মহিলারও আর এক মুর্তি। বলে উঠলেন, না বাবারা, এরই মধ্যে তোমরা সবই জেনে ফেলেছ, কিছুই আর জানতে বাকি নেই তোমাদের। তবে নীল চশমা কেন পরি? এই দেখো, দেখো–

বলেই একটানে চশমাটা খুলে ফেললেন তিনি। তার মুখের দিকে চেয়ে বাসের সকলেই ধাক্কা খেল একটু–ছেলেরাও চুপ কয়েক মুহূর্ত। তার এক চোখ পাথরের, এবং পাতা পড়ে না–দেখলেই অস্বস্তি হয়।

তিনি চশমাটা ফিরে পরতেই ছেলেরা আবার ক্ষেপল, আমরা এরই মধ্যে সবই জেনে ফেলেছি, কিছুই জানতে বাকি নেই–এ-কথার মানে কি? একবার অভদ্র বলেছেন, আবার আমাদের ক্যারেক্টার ধরে টানাটানি! আমরা কৈফিয়ৎ চাই, ওই চোখ দেখিয়েই আপনি আমাদের ভোলাবেন ভেবেছেন?

দাঁতে করে ঠোঁট কামড়ে বসে আছেন মহিলা। চেঁচামেচি আরো বাড়ার আগেই ছেলেদের গন্তব্যস্থান এসে গেল। আমারও। ছেলেরা শাসিয়ে গেল, তারা ছাড়বে না, এই পথে আবার দেখা হলে ভালো হাতেই মহিলাকে জবাবদিহি করতে হবে, কলেজের ছাত্রকে অপমান করে অত সহজে পার পাওয়া যায় না, ইত্যাদি।

মনে মনে আমিও ওই মহিলার ওপরেই বিরূপ হয়েছিলাম। অল্পবয়সের হাসি-খুশি ছেলে-ছোকরার দল, দেশের ভবিষ্যৎ বলতে গেলে ওরাই–কী দরকার ছিল মহিলার এভাবে ওদের বিগড়ে দেওয়া না হয়! করছিলই একটু রসিকতা, এলিস তো বলেছেন, এ-সব হল এক ধরনের সেফটি ভালভ–না সবেতেই অধৈর্য, গায়ে যেন ফোস্কা পড়েছিল।

অফিসে বসে লেখার আগে আর একবার সেই জঙ্গলের কাব্য খুলেছি। পড়বি তো-পড় এমন জায়গাই চোখে পড়ল যে হাতের কলম আছড়ে মারতে ইচ্ছে করে :

তবু আশা বন্ধু? এখনো আশা?
এখনো কিছু দেখতে বাকি!
এখনো ভাবো, আরো একটু থাকি!
এখনো আশা, নতুন কণ্ঠে শুনবে ভাষা?
শোনো বন্ধু, অরণ্যে দাউদাউ দাবাগ্নি জ্বলে
সেই আগুনে বস্তু পোড়ে, অরণ্যের প্রাণ পোড়ে না।
তোমাদের এই সভ্যতার আলোর তলায় মশাল জ্বলে,
এই আগুনে মানবতা পোড়ে, বস্তু পোড়ে না।
নতুন অরণ্য জাগে।
ঋতুস্নাতা ধরণীর অনুরাগে।
কিন্তু তোমার নগরে নতুন মানুষ কারা?
মানবতা-পোড়া বস্তুর, সন্তান যারা?
অনেক তো দেখেছ বন্ধু,
অনেক জেনেছ,
শক্তির দম্ভ আর লোভীর হীনতা
পণ্ডিতের দর্প আর জ্ঞানীর মূঢ়তা
প্রাচীনের গর্ব আর নবীনের ক্লীবতা
এরা কি শোনাবে বলো নতুন দিনের বারতা?
অনেক দেখেছ বন্ধু, অনেক জেনেছ।
তবু আমিও তোমারই মত কিছু আশা চাই,
তাই ডাকি বন্ধু, চলো,
এবারে অকৃপণ উদাত্ত গম্ভীর জঙ্গলে যাই।

বই ফেলে দিয়ে কলম হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম, কি লেখা যায়, কেমন করে উপযুক্ত ঘা দেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে শুভবুদ্ধিই মনে জাগল। সব থেকে ভালো অবজ্ঞা করে যাওয়া, এর অস্তিত্বই অস্বীকার করা। এ ধরনের অবাঞ্ছিত বইয়ের বিরুদ্ধে জোরালো রকমের হাঁকডাক করলেও অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের কৌতূহল বাড়বে। একবার পড়ে দেখার জন্যও বইখানা হয়ত বা তাদের কেনার আগ্রহ হবে। তাদের প্রতি গুরুদায়িত্বের কথা ভেবেই কলম বন্ধ করলাম।

না, সমালোচনা লিখব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress