Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মন পবনের নাও || Ashutosh Mukhopadhyay

মন পবনের নাও || Ashutosh Mukhopadhyay

নিকুঞ্জবিহারীবাবুর একটা গল্প ছাপা হয়েছে। সেও কোনো হেঁজিপেজি কাগজে নয়। দস্তুরমতো নামজাদা এক সাপ্তাহিক-পত্রে। অদূরে ঘাড় গোঁজ করে তার স্ত্রীটি বসে আছে। নিকুঞ্জবিহারীবাবু সেইদিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। লজ্জায় সঙ্কোচে আনন্দে বিড়ম্বনায় স্ত্রী সুধারাণী মাটির সঙ্গে মিশতে পারলে বাঁচে।

এখন পর্যন্ত সুধারাণীর সঙ্গে নিকুঞ্জবিহারীর একটি কথাও হয় নি। গত দশ-বারো দিন দুজনার কথাবার্তা বন্ধ। তার আগে বড় মর্মান্তিক কথা বলেছিলেন নিকুঞ্জবিহারীবাবু। বলেছিলেন–তোমার জন্য হয় আমাকে পাগল হতে হবে, নয়তো জঙ্গলে পালাতে হবে। আর এতই যদি অযোগ্য ভাবো, তাহলে কোর্টে ডাইভোর্সের জন্য দরখাস্ত করে দাও।

কথাগুলো শেলের মতো বিধেছিল সুধারাণীর। নয় বছরের বিবাহিত জীবনে স্ত্রীকে এরকম শক্ত কথা আর কখনো বলেন নি নিকুঞ্জবিহারীবাবু।

এই কথার পরে কথাবার্তা বন্ধ।

সুধারাণীর বয়েস এখন আঠাশ। ছেলেবেলায় সকলেই তাকে বেশ সুশ্রী বলত। এখনো বলে। একটা মাত্র ছেলে। স্বাস্থ্যের বাঁধুনি এখনও ঢিলে হয় নি। ঢলঢলে কাঁচাভাবটুকু এখনো আছে। এরই দাক্ষিণ্যে একটা লোকের ওপর সুধারাণীর অনেক আধিপত্য খাটে বলেই বিশ্বাস। এবং দিনকে দিন তার এই আধিপত্য বাড়ছিল।

ব্যাপারটা আরো অনেক আগে থেকে বলা দরকার। সুধারাণীর বয়েস যখন এগারো বারো, তখন থেকে। তখন থেকেই পোড়ারমুখি ইন্দিরা তার শত্রু।

খুব সাদামাটা বুদ্ধির মেয়ে ছিল সুধারাণী। কোনো প্যাঁচ-ঘোঁচ বুঝত না। উঠতে বসতে বাড়ির লোক বোকা বলত তাকে। এই খেদে ইস্কুলে তার, চালাক হবার একটু চেষ্টা ছিল। বিশেষ করে ইন্দিরার কাছে। ইন্দিরার রূপ কোনাদিন তার থেকে বেশী ছিল বলে সে মনে করে না। কিন্তু চাল-চলন আচার-আচরণে সবাই সেরা রূপসী ভাবত, তাকে। এমনকি সুধারাণী নিজেও তাই ভাবত। ওই বয়সেই ইন্দিরা অনেক জানত, অনেক বুঝত, অনেক বিচিত্র কথা বলত, আর অনেক রকম ভু ভঙ্গিতে, হাসতে পারত। মোট কথা সুধারাণীর ভিতরে ভিতরে তখন থেকেই একটা ইন্দিরা-কমপ্লেক্স দানা পাকিয়ে উঠেছিল।

ওই বয়সেই কি জব্দই না হয়েছিল একবার ইন্দিরার কাছে। মনে পড়লে এখনো। লজ্জা পায় সুধারাণী। ইন্দিরা তখন থেকেই ছেলেদের আচার-আচরণ কিছুটা বুঝতে শিখেছিল। আভাসে ঠারেঠোরে অনেক কথা বলত সে। এমনি একটা প্রসঙ্গে চুপিচুপি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল–সত্যি করে বল তো, তুই কারো প্রেমে পড়েছিস?

শুনে সুধারাণী বাইরে ইন্দিরার মতোই মুখ টিপে হেসেছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। আসলে প্রেমে-পড়া ব্যাপারটা ঠিক যে কি, ভালো করে জানে না। অথচ প্রশ্নের ধরন-ধারণ কেমন যেন নিগূঢ়। প্রেম বলতে বাড়িতে মাস্টার মশাইয়ের কাছে ভগবানের বিশ্বপ্রেম সম্পর্কে ছোটদের একটা কবিতা। পড়েছিল সে-মাস্টারমশাই বুঝিয়েছিলেন, ভগবান এত বড় যে অতি ছোট অতি ক্ষুদ্রকেও তিনি অবহেলা করেন না।

কিন্তু ভাববার সময় নেই, ইন্দিরা জবাবের প্রতীক্ষা করছে। সুধারাণী সমঝদারের মতো তক্ষুণি মুচকি হেসে মাথা নেড়েছিল।

–কার সঙ্গে রে? কার সঙ্গে? বল না! আমি কাউকে বলব না।-ইন্দিরার উৎসুক চাপা আগ্রহ দেখে ভিতরে ভিতরে সুধারাণী ফাঁপরে পড়েছিল। কাউকে বলবে কি বলবে না এই সংশয়ের ফাঁকে সে একটু ভেবে নেবার সুযোগ পেয়েছিল। প্রেমে পড়তে হলে দ্বিতীয় একজন লোক দরকার, আর যতদূর মনে হয় পুরুষমানুষই হওয়া দরকার। আর, সেই পুরুষমানুষ খুব বড় কেউ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

-মাস্টার মশাইয়ের

শোনামাত্র ইন্দিরা একেবারে হাঁ। সুধারাণীর মাস্টার মশাইকে ইন্দিরাও জানে। ওদের বয়েস বারো, আর তিনি বাষট্টি।

সুধারাণীর কল্পনায় ভগবানের পরেই মাস্টার মশাই বড়। কিন্তু ইন্দিরার চোখমুখ দেখেই মনে হল তার জবাবটা বেখাপ্পা গোছের হয়েছে। তাই আরো জোর দিয়ে বলল–মাস্টার মশাই যে কত বড়, তুই ভালো করে জানিস না

–সে কী রে! একটা বুড়ে-হাবড়া, তুই ফাজলামো কচ্ছিস

ইন্দিরার কি মনে পড়ে গিয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো করে বলেছিল –কেন শিব ঠাকুরও তো বুড়ো-হাবড়া, নামেরও মিল আছে–শিবশঙ্কর। ৬২৬

ইন্দিরা পেটে হাত চেপে হাসার উপক্রম করতেই সুধারাণী বুঝেছিল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি ইন্দিরার একটু আগের সংশয়োক্তি, আঁকড়ে ধরল।

-আচ্ছা বোকা তুই, ঠাট্টাও বুঝিস না!

সেই ইন্দিরা কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে কলেজের থার্ড ইয়ার ফোর্থ ইয়ারের ছেলেগুলোরও মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সুধারাণী তখন নিঃসন্দেহ, রূপ ইন্দিরার থেকে তার কম নয়। কিন্তু ইন্দিরার চটকের কাছে কলেজের সব মেয়েই। প্রায় নিষ্প্রভ।

ওই সময়েই সুধারাণীকে একটা রোগে ধরল। ইন্দিরা তখন এক উঠতি তরুণ লেখকের প্রেমে পড়েছে। যার গল্প-উপন্যাস তারা ছাপার অক্ষরে পড়েছে। অনেক বড় বড় কাগজ যার লেখার সমালোচনা করছে, টাকা-টিপ্পনী কাটছে। যে তরুণ লেখককে একবার চোখের দেখা দেখতে পেলেও চক্ষু সার্থক হত, রক্ত-মাংসের সেই মানুষটারই কিনা প্রেমে পড়েছে ইন্দিরা! তার সঙ্গে বেড়ায়, সিনেমা দেখে, তার লেখা চিঠি ওদের দেখায়। সেই সব চিঠিও এক একটা জীবন্ত কাব্যের মতো। ভাগ্য আর কাকে বলে!

সুধারাণীর তখন মনে হত, প্রেমিক লেখক না হলে জীবনই বৃথা। যে দু-চারজন ছেলে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার আগ্রহে তার আশে-পাশে ঘুরঘুর করত, সুধারাণী তাদের। প্রতি কঠিন হয়ে উঠল। ওদের একটাও না লেখক, না কবি। রেস্টুরেন্টে বসে শুধু চপ-কাটলেট সাবড়াতে ওস্তাদ সব! তখন থেকেই এক তরুণ লিপি-যাদুকরের মূর্তি। মনের তলায় লালন করতে লাগল সে।

কিন্তু ইতিমধ্যে বাড়ির লোকেরা যেন ষড়যন্ত্র করেই একজনের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ। পাকা করে ফেলল তার। মা বাবা খুশী, ভালো জামাই সংগ্রহ করেছেন তারা। বর। কোন এক বড় সাহেবের পি-এ। ভালো মাইনে। কিন্তু ভাবী বরের নাম শুনেই দুই চক্ষু কপালে উঠল সুধারাণীর–নিকুঞ্জবিহারী! কোথায় ইন্দিরার মৃণাল বসু, আর কোথায় তার নিকুঞ্জবিহারী। শুধু এই নামের ধাক্কা সামলাতেই দিন কয়েক সময় লাগল সুধারাণীর। তারপর যুক্তি দিয়ে আশার আলো টানতে চেষ্টা করল সে। বড় বড় স্মরণীয় লেখক বা কবিদের নাম মনে করতে চেষ্টা করল-বঙ্কিমচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, প্যারীচাঁদ, হেমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর–নাম হিসেবে এগুলো এমন কি মিষ্টি নাম! অথচ এখন তো মনে হয় শুধু ওই নামেই মানায় ওঁদের। আসলে নাম কিছু নয়, গুণই সব। পি-এ যখন–সমস্ত দিন লেখালেখিই করতে হয়। লেখার অভ্যাস থাকলে গল্প-কবিতাই বা লিখতে পারবে না কেন?

সুতরাং বিয়ে হয়ে গেল। প্রথম দর্শনে স্বামীটিকে মোটামুটি মন্দ পছন্দ হল না সুধারাণীর। বেশ চোখা সপ্রতিভ চেহারা। বাসরের প্রথম সঙ্কোচ কাটতে সুধারাণী ঈষৎ আগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, তুমি লেখো?

নিকুঞ্জবিহারী অবাক।–না তো, কি লিখব?

-এই গল্প, কবিতা–যা হোক?

নিকুঞ্জবিহারী চালাক মানুষ। বাসরে স্ত্রীকে নিরাশ করতে মন সরল না। বললেন –এক কালে কলেজে থাকতে লিখতাম-টিকতাম, এখন আর অভ্যেস নেই–কেন। তোমার বুঝি ওসব খুব ভালো লাগে?

-খু-উব। অভ্যেস করলেই আবার লিখতে পারবে, তাছাড়া অফিসে তো কত কি লিখতেই হয় তোমাকে। একেবারে অভ্যেস নেই বলতে পারো না। কলেজের ম্যাগাজিনে তোমার লেখা ছাপা হত?

নিরুপায় নিকুঞ্জবিহারীকে মাথা নাড়তে হয়।-হত।

সুধারাণীর মুখে খুশী ধরে না।

পি-এর চাকরির দরুনই হোক, বা যে জন্যেই হোক, লোককে খুশী রাখার চেষ্টাটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে নিকুঞ্জবিহারীর। এরপর দিনে দিনে স্ত্রীর স্বপ্নের দিকটা চিন্তা করেই অফিসে বা রাতের নিরিবিলিতে একটু আধটু লিখতে চেষ্টা করেছেন তিনি। প্রথমে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন। তারপর গল্প। তারপর প্রবন্ধ। সবই স্ত্রীকে দেখিয়েছেন। আর সুধারাণীর সবই অদ্ভুত ভালো লেগেছে। স্বামীকে না বলেই সেই সব লেখা সে ডাকটিকিট দিয়ে একে একে মাসিকে সাপ্তাহিকে পাঠিয়ে দিয়েছে– দিয়ে দুরু দুরু বক্ষে প্রতীক্ষা করেছে। বলা বাহুল্য সে-সব লেখাই আবার একে একে তার কাছে ফেরত এসেছে।

মান বাঁচাবার জন্য নিকুঞ্জবিহারী বলেছেন–এটা কোটারীর যুগ, দলে না মিশলে বা পেছনে লোক না থাকলে, না পড়েই মাসিক সাপ্তাহিকের সম্পাদকরা তা ফিরিয়ে দিয়ে থাকেন।

সুধারাণী বিশ্বাস করেছে আর সেই সব অদেখা সম্পাদকদের ওপর মনে মনে জ্বলেছে।

এই করেই একে একে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। কিন্তু সুধারাণী এখনও আশা ছাড়ে নি। আর সেই আশার তাগিদে এখনো মাঝে-সাজে নিকুঞ্জবিহারীকে কিছু না কিছু লিখতে হয়।

সুধারাণী যে এখনো আশা ছাড়তে পারে নি, তার একটা বিশেষ কারণ আছে। ইন্দিরার সঙ্গে এখনও মধ্যে মধ্যে দেখা হয়। সেই লেখকের সঙ্গেই তার বিয়ে হয়েছে। তাই দেখা হলে লেখার প্রসঙ্গ ওঠেই। বিয়ের পর অনেকদিন বাদে যখন প্রথম দেখা হয়, সুধারাণী তখনই তাকে ফিসফিস করে বলেছিল–এরও লেখার রোগ আছে রে!

ইন্দিরা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল তাই নাকি, কোন কোন কাগজে লেখেন, নাম-টাম দেখি না

ঢোক গিলে সুধারাণীকে বলতে হয়েছিল-সে-কথা আর বলিস না, আমি ছেড়ে বন্ধুবান্ধবরাও বলে, অত সুন্দর লেখা ছাপাও না কেন? তা ওর এক কথা, লেখার আনন্দের জন্যেই লিখি, ছেপে কি হবে

সুধারাণীর ধারণা, ইন্দিরা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অবিশ্বাস করেছে এবং ঠোঁট বাঁকিয়েছে। অতএব স্বামীকে লেখক বানাবার ঝোঁক সুধারাণীর এখনো কাটে নি।

স্ত্রীর এত আগ্রহ দেখে তলায় তলায় স্বামীরও বাসনা, দুই একটা লেখা অন্তত ছাপা হোক, মান-মর্যাদা বাঁচুক। তাছাড়া একটা লেখা ছাপা হয়ে গেলে স্ত্রীর কাছ থেকে যে উষ্ণ সমাদর লাভ হবে, তাও লোভনীয়।

চেষ্টা-চরিত্র করে একটা খবরের কাগজের রবিবাসরীয় সাহিত্যপত্রে শেষ পর্যন্ত একটা লেখা অনুমোদন করিয়ে ছাড়লেন তিনি। শুক্রবারের কাগজে রবিবারের লেখক সূচীর চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন বেরোয়। সেই বিজ্ঞাপনে নিকুঞ্জবিহারীর নাম বেরুলো– রবিবারে তার অমুক নামে একটা সারগর্ভ রচনা থাকবে।

সুধারাণীর এতকালের আশা সফল। বাড়িতে সেই রাতে যেন নন্দনকাননের বাতাস বইল।

কিন্তু রবিবার হতেই মুখ একেবারে আমসি সুধারাণীর। লেখাটা বেরোয় নি। সম্পাদক লিখেছেন–যান্ত্রিক গোলযোগ বশতঃ নির্ধারিত সব লেখা এ সপ্তাহে প্রকাশ করা সম্ভব হল না।

স্ত্রীর মুখ দেখেই বেশী রকম আঘাত পেলেন নিকুঞ্জবিহারীবাবু। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, কিছু একটা কারণে এবারে আটকে গেছে, লেখা মনোনীত হয়েছে। যখন সামনের বারে নিশ্চয় বেরুবে।

কিন্তু শুনে কিছুমাত্র আশ্বস্ত হল না সুধারাণী। তার সমস্ত মুখ বিবর্ণ পাংশু। একসময় সচকিত হয়ে দ্রুত উঠে চলে গেল সে।

সোম মঙ্গল দুটো দিন কাজের চাপে অবকাশ মেলে নি নিকুঞ্জবিহারীর। বুধবার স্ত্রীর এই কদিনের শুকনো মূর্তি স্মরণ করেই উক্ত কাগজের সাহিত্য-সম্পাদকের দপ্তরে হানা দিলেন তিনি, লেখাটা আগামী সপ্তাহে বেরুচ্ছে কি না, সেই খবর নিতে।

গম্ভীর মুখে সম্পাদক বললেন–ভেবেছিলাম বেরুবে। কিন্তু বেরুবে না, আপনার লেখা ফেরত নিয়ে যান।

নিকুঞ্জবিহারী বিমূঢ়।-কেন?

সম্পাদক তিনখানা পোস্টকার্ড তার চোখের সামনে তুলে ধরলেন। বললেন আপনার লেখা না বেরুতেই সেই লেখা সম্পর্কে পাঠকের কাছ থেকে তিনখানা প্রশংসাপত্র এসেছে-লেখা ছাপা হলে কি কাণ্ড হবে ঠিক কি!

হতভম্ব নিকুঞ্জবিহারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে এলেন শেষ পর্যন্ত। ট্রামে বাড়ি ফেরার অবকাশে মাথা কিছুটা সাফ হল।

প্রথমেই স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কি করেছ?

সুধারাণী ঢোক গিলে অস্ফুট জবাব দিল।–কেন, আমি তো আবার তাদের চিঠি লিখে বারণ করে দিয়েছি।

তার দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিকুঞ্জবিহারী ঘরে চলে গেলেন।

সুধারাণী বুঝল যে ভয় করেছিল, তাই ঘটে গেছে। শুক্রবারের বিজ্ঞাপন দেখেই খুব অন্তরঙ্গ আত্মীয়-পরিজনদের পাঁচ-ছজনকে টেলিফোন করেছিল সে, আর কলকাতার বাইরে পাঁচ-ছখানা চিঠি লিখেছিল। লিখেছিল, তারা যেন রবিবার পেরুলেই অমুক কাগজে অমুক লেখার বিশেষ প্রশংসা করে সম্পাদককে চিঠি দেয়। বাইরে সেই কাগজ যদি নাও পায়, তাহলেও যেন চিঠি অবশ্যই সম্পাদককে পাঠায়–বিশেষ কারণ আছে পরে জানাবে।

এইভাবেই স্বামীর লেখার প্রতি সম্পাদকের বিশেষ দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিল সুধারাণী। তাই রবিবারে সেই লেখা না বেরুতে মাথায় বাজ পড়েছিল তার। টেলিফোন যাদের করেছিল তাদের আবার টেলিফোনে নিষেধ করেছে। আর চিঠি যাদের লিখেছিল, মরিয়া হয়ে তাদেরও আবার নিষেধ করে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু বিভ্রাট যা হবার তা হয়েই গেছে।

সুধারাণী যেন আসামী। একটু ঠাণ্ডা মাথায় নিকুঞ্জবিহারী প্রশ্ন করে করে সব বার করে নিলেন। তারপর রাগের মাথায় ওই কথা বললেন। বললেন–তোমার জন্যে হয় আমাকে পাগল হতে হবে, নয়তো জঙ্গলে পালাতে হবে। এতই যদি অযোগ্য ভাবো, তাহলে কোর্টে ডাইভোর্সের জন্য দরখাস্ত করে দাও।

সুধারাণী দাতে করে ঠোঁট কামড়ে চোখের জল সামলাতে চেষ্টা করেছে। তারপর থেকে এই দশ-বারোদিন বাক্যালাপ বন্ধ।

.

কিন্তু নিকুঞ্জবিহারীর মাথা সত্যিই ঠাণ্ডা। এই ঠাণ্ডা মাথায় স্ত্রীর অগোচরে একটা গল্প লিখলেন তিনি। স্ত্রীর স্বপ্ন থেকে শুরু করে লেখা ছাপানোর এই বিভ্রাটের গল্প। লিখে এক নামী সাপ্তাহিকের সম্পাদকের হাতে দিয়ে এলেন।

গল্পটা সম্পাদকের এত পছন্দ হয়ে যাবে নিকুঞ্জবিহারীবাবুও আশা করেন নি। পরের সপ্তাহেই সেটা ছাপা হয়ে গেল এবং ডাকে কাগজ এল।

আড়াল থেকে স্ত্রীকে রুদ্ধশ্বাসে সেই লেখা পড়তে দেখেছেন তিনি। পড়া হতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

নিকুঞ্জবিহারীবাবু তার দিকে চেয়ে হাসছেন মিটিমিটি।

আর, লজ্জায় সঙ্কোচে আনন্দে বিড়ম্বনায় সুধারাণী মাটির সঙ্গে মিশতে পারলে বাঁচে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress