বিবাহ
বানভাসিতে ঘরটুকুও ভেসে গেল। ঘরের ভিটেতে পূবের দেওয়ালটা দাঁড়িয়ে রইলো কোন প্রকারে। দিনভাগ শেষ হলে কঙ্কাবতীর চোখে পরে আঁধারে আলেয়া জ্বলছে। মাধব কিছু খুদ~কুঁড়ো, ভেজা কাঠ দিয়ে গেছে বিকেলে। বলে গেছে,- কাজ পেলে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে। এখন কষ্ট করেই বেঁচে থাকতে হবে।
মাধবকে চেনে কঙ্কাবতী সেই কিশোর বয়েস থেকে। নারকেল গাছের মতো বলিষ্ঠ চেহারা। তখনো গোঁফ~দাঁড়ি ওঠেনি। ঘরের ভাঙ্গা দেওয়ালের আবডালে দুটি ইঁট দিয়ে বানানো উনোনে হাঁড়ি রাখল। পুকুর থেকে সামান্য নোনা স্বাদের জল এনে হাড়িতে ঢেলে দিল। জল ফুঁটে গেলে খুদ~কুঁড়ো ঢেলে মাধবের কথা ভাবতে লাগল।
চাল, ডাল, আনাজ নিয়ে মাধব সকালে এলো।
– কঙ্কাবতী, কঙ্কাবতী – এদিক পানে আয়। আনাজ পত্র গুছিয়ে রাখ।
– উঁহু উঁহু,- আড়াল, আবডাল থেকে কঙ্কাবতী কিছু বলতে চাইল, কিন্তু পারল না। ইশারা করল।
মাধবের দুঃশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে,- একথা ভেবে কঙ্কাবতী ভগ্ন দেওয়ালের বাইরে থেকে তার নগ্নপ্রায় অর্ধেক শরীর বের করে বাম হাতটি নাড়তে লাগল। মাধব দেখল, অর্ধঈশ্বরী নিরাভরণ হয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজ করছে। মাধব কহিল,- কিয়ৎকাল অপেক্ষা করো।
দুপুর গড়িয়ে পড়ল। চাল, ডাল সেভাবেই পড়ে আছে। কঙ্কাবতীর আশঙ্কা বাড়তে লাগল। তখনো গ্রাম, গঞ্জটি মুখর ছিল। কতো বয়সের কত জন কঙ্কাবতীকে নষ্ট করতে চেয়েছিল, তা সে ভিন্ন আর কেউ জানেনা। মাধব আসতো, চলে যেত। কোন লোভাতুর চাউনি সে দেখেনি। আজও মাধবের হাঁকে~ডাকে কোন অজানা ভয় কঙ্কাবতীকে সহন করতে হয়নি।
গোধূলির আলো নিভে আসছে। কঙ্কাবতী কোন প্রকারে ছেড়া কাপড়ে বুক ঢেকে বের হয়ে ভাতে ভাত চাপিয়ে পুনরায় আঁধারে নিজেকে ঢেকে নিল। সে জানে, অন্ধকারে মেয়ে শরীরের দাম কত।
ভাত ফুটলো। আঁচ নিভে এলো। মাধব এলো না। দুর্ভাবনা অন্ধকারের লজ্জা থেকে কতো ভয়ানক তা অনুভব করতে পারছে কঙ্কাবতী।
সহসাই আলেয়ার মতো একটি হ্যারিকেন নিয়ে কে যেন হেঁটে আসছে আল ধরে। লোকটিকে চিনতে ভুল হয়নি কঙ্কাবতীর।
– কঙ্কাবতী, আমি এসেছি। আর কোন ভয় নেই।এদিকে আয়। মাধবের ডাক শুনে কঙ্কাবতীর নক্ষত্র ক্ষচিত চোখ জোড়া দেওয়ালের অন্ধকার থেকে লণ্ঠনের আলোয় হাসতে লাগল। সেই প্রলম্বিত হাত নড়ছে।
– এই কাপড় পরে নে। ভুতু মায়ের থানে যেতে হবে।
কঙ্কাবতী লজ্জা ঢাকিল। মাধবের সম্মুখে এসে বলল,- এত রাত্রে সেথায় কেন যাইবা। এখন তো আঁধার। গোধূলির আলো কোথায় পাইবা।
মাধব হাসিল। কঙ্কাবতীর হাত ধরিয়া বলিল,- তোর অক্ষয় সিঁথিতে গোধূলির আলো খেলিতেছে।