সমস্তি পুরের সেই রাতটা
হাঁড় কাপানো কনকনে শীতের রাত,বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি ।
ওঘরে ছেলেমেয়েরা ঠাকমার কাছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ।
সুরমা রান্নাটা সেরে ওদেরকে ডাকতে যাবে বলে এগোতেই দরজায় শব্দ শুনে চমকে যায়।
এমন ঝড়-তুফানের রাতে চোর- ছ্যাচোর নয়তো!
বছর পাঁচেক ধরে সুরমার স্বামীর কোন খোঁজ নেই।
সুরমা ঝিগিরি করে কায়ক্লেশে সংসার চালায়।
এবারে শব্দটা ক্রমেই জোরালো,সাথে অসহিষ্ণু কন্ঠস্বর,মা! ওমা,দরজা খোলো,আমি অশোক—
সুরমার বুক ধক করে ওঠে , অশোক!
বৃদ্ধাও হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসেন পাগলের মত,ওরে অশোক , এতোদিনে মনে পড়লো বাড়ির কথা! বৌমা, শিগগিরই দরজা খুলে দাও–
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সুরমা দরজা খুলতেই ঠান্ডা হিমেল বাতাসের ঝাপটা লাগে।একমাথা রুখু চুল নিয়ে ভিজে ন্যাতা হয়ে অশোক ঘরে ঢুকেই বলে ,ক্ষিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছেগো,ভাত আছে?
সুরমা শুকনো গামছা- কাপড় এনে দেয়।
বৃদ্ধা তাড়া দেন,আহারে! বাছা আমার শুকিয়ে পাট,বিদেশ বিভুঁইয়ে না জানি কত কষ্ট হয়েছে ।
ছেলেমেয়েরা বাবাকে দেখেনি কখনো, আব্দার ধরে,তারাও বাবার সাথেই খাবে।
অশোক বিরক্ত হলেও বৃদ্ধা বলেন,আহারে,ওদেরও তো সাধ হতেই পারে।
সবাইকে খেতে দিয়ে সুরমা আলোটা উস্কে দিতেই
অশোক চেঁচিয়ে ওঠে,ওঁটা সঁরিয়ে নাঁও,সঁইতে পাঁরছিনে-
সুরমা হতভম্ব স্বামীর খোঁনাস্বরে।
বৃদ্ধাও শঙ্কিত ,নাঁকি সুরে বলছিস কেন বাবা?
গোগ্রাসে খেতে খেতেই অশোক বলে,সেঁ অঁনেককঁথা,এ্যাঁকসিডেন্টে গঁলা খাঁরাপ হঁয়ে — ওঁ বৌঁ,ভাঁত ডাঁল নিঁয়ে আঁয়–
সুরমা ভাত দিয়ে ডাল এনে দেখে ভাত শেষ,ডাল দিয়ে ফের ভাত নিয়ে এসে দেখে ডাল শেষ!
একি আজব ক্ষুধারে বাবা!
এদিকে হাঁড়ি,কড়াই শূন্য।
অশোকের খিদে এতোই প্রবল যে নিমেষে ছেলেমেয়ের থালার সবটাই খেয়ে নেয়।
শতহলেও মায়ের মন বৃদ্ধা শুধু বলেন,আগে জানলে আরো বেশি করে– যাকগে , বৌমা শোবার জায়গা করে দাও,বাছা আমার পরিশ্রান্ত।
সুরমার বুকে কতোনা অভিমান স্বামীর উপরে।
স্বামীর মুখের দিকে তাকাতেই দেখে,অদ্ভুত জুলুজুলু দৃষ্টি!
অশোকের মুখে অস্বাভাবিক আলো!কেন জানিনে সুরমার বুকে অস্বস্তির কাঁটা!
বৃদ্ধা চান,ছেলেমেয়ে বাপের কাছেই ঘুমাক।বাছারা বাপের আদরই পায়নি।
ঘুম আসছিলো না সুরমার।শাশুড়ির পাশে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই কখন যেন তন্দ্রা নামে।
মট্- মট্- — মটাং— মটাং– মট্–
বেশ জোরালো আওয়াজ!
সুরমার ঘুমের ঘোর কাটতেই কান সজাগ- কোত্থেকে আসছে এই আজব শব্দ!
আরে! পাশের ঘর থেকেই তো!
সুরমার মত সাহসী মেয়েও কেঁপে ওঠে। সন্তর্পনে বেড়ার ফাঁকে চোখ রাখতেই হিমশীতল ভয়ের স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নামে।একি দেখছে সে! অশোক কোথায়! এই অদ্ভুতুরে জিনের চোখদুটো আগুনের ভাঁটার মতো ।ওমাগো,কি সর্বনাশ! মেয়েটাকে কোলের উপরে রেখে হাড় মাংস চিবিয়ে খাচ্ছে ওই ভূতটা! ওইতো ছেলের ছেঁড়া জামা ,তাহলে কি ওকেও! রক্তে মাখা ভূতটাকে কি সাংঘাতিক দেখাচ্ছে! মেয়েটার নাড়িভুঁড়ি আয়েশে খাচ্ছে দেখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দুলে ওঠে সুরমার। সীমাহীন আতঙ্কে বৃদ্ধাকে ঠেলে মুখ চিপে ধরে দেখাতেই বৃদ্ধার নাড়ি ছাড়ার দশা,ঠকঠকিয়ে কাঁপছেন। সুরমা এতোক্ষণে বিলক্ষণ বুঝে গেছে,এ তার স্বামী অশোক নয়। নির্ঘাৎ কোন ভূত ,নাহলে কোন বাপ কি নিজের ছেলেমেয়েকেই– ওফ্ মাগো,কি বীভৎস!
সুরমা এক লহমায় শাশুড়িকে টেনে দরজা খুলেই উদভ্রান্তের মতো এলোপাথাড়ি ছুটতে থাকে অমাবস্যার গাঢ় আঁধারেই।
পরদিন।
সমস্ত গ্রাম জলে ডুবে গেছে প্রায়।
সকালে গ্রামবাসীরা বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখলো–
সমস্তিপুরের উচুটিলাতে চন্ডী মন্ডপে দুজন থুত্থুরে পক্ককেশী উন্মাদ কি যেন বিড়বিড় করে কপালে করাঘাত করে বুক চাপড়ে কাঁদছে–